All Stories

পর্ব-২
শ্রীচৈতন্য ১৫১০ সালে এসেছিলেন পুরীতে। সেই সময় ওড়িশার রাজা ছিলেন প্রতাপরুদ্র। বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে ছিলেন যুদ্ধে লিপ্ত। কৃষ্ণদেব রায় ১৫০৯ সালে সিংহাসনে বসার সময় থেকেই উভয় রাজ্যের মধ্যে ছোটখাট যুদ্ধ বিগ্রহ চলছিল। এ কারণে ১৫০৯ সাল থেকেই প্রতাপরুদ্র ছিলেন দক্ষিণে। ১৫১০ সালের প্রথমদিকে শ্রীচৈতন্য তীর্থপর্যটনে বেড়িয়ে মোটামুটি উপকূল ভাগ ধরে পুরী থেকে কন্যাকুমারী হয়ে পৌঁছেছিলেন দ্বারকায়। সেখান থেকে তিনি নর্মদার তীর বরাবর হয়ে পুরীতে ফিরে আসেন ১৫১২ সালে।

১৫ শতকের শুরুতে মহাপ্রভু ২ বছরের জন্য দাক্ষিণাত্যে তীর্থযাত্রা করেন। এই সময় তিনি পুরী ধাম হতে শ্রীরঙ্গক্ষেত্র, রাম সরোবর, কন্যাকুমারী হয়ে পায়াসিবিনি নদী ধরে দক্ষিণ ভারতের একটি প্রাচীন মন্দির (আদি কেশব মন্দির) এসেছিলেন। মহাপ্রভু একস্থানে বসার পর তিনি বিশেষ ভাব অনুভব করছিলেন, তিনি ভক্তদের তার বসার স্থানের নীচের মাটি খননের আদেশ দিলেন, ভক্তরা মাটি খুড়তে খুড়তে কিছু কর্দমাক্ত মাটির নিচে ব্রহ্ম সংহিতা পেলেন। পান্ডুলিপিটি সম্পূর্ণ রূপে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল মাটির নিচে পোকাদের আক্রমণে। শুধুমাত্র ৫ম অধ্যায়টি অক্ষুণ্ণ ছিল। তাই বর্তমানে শতাধ্যায়ী ব্রহ্ম সংহিতার শুধুমাত্র ৫ম অধ্যায়টিই পাওয়া যায়।

গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মতে, যেহেতু অনেক কাল আগে থেকে এইটি এইভাবে গুপ্ত ছিল তাই শঙ্করাচার্য, রামানুজাচার্য, মধ্বাচার্য, নিম্বার্কাচার্য বা অন্য কোনো আচার্যদের গ্রন্থে এই ব্রহ্মসংহিতার নাম উল্লেখ নেই। যুক্তিবাদ ও ঐতিহাসিকতার দিক থেকে ব্রহ্মসংহিতার প্রামাণিকতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকলেও যেহেতু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এইটিকে অনুমোদন করেছেন তাই এইটি গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের কাছে স্বীকৃত শাস্ত্র।

পুরী ফিরে এসে মহাপ্রভু বাসুদেব সার্বভৌম এবং রামানন্দ রায়কে ব্রহ্মসংহিতার বিষয় অবগত করিয়ে মুদ্রণের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিলেন। এভাবে ব্রহ্ম সংহিতার প্রচার শুরু হল।

কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর মতে উচ্চপর্যায়ের পারমার্থিক বিষয় অবগত হওয়ার জন্য ব্রহ্ম সংহিতার মতো আর অন্য কোন শাস্ত্র নেই।
অচিন্ত্য ভেদাভেদতত্ত্ব, অপ্রাকৃত জগতের বিবরন, গোবিন্দের অপ্রাকৃত লীলাবিলাস, ভগবানের প্রতি ভালোবাসা, ভক্তির পর্যায় প্রভৃতি ব্রহ্মসংহিতার আলোচ্য বিষয়।
তার আগেই, প্রতাপরুদ্রের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের সেনাদল অতিক্রম করে ওড়িশার উত্তর সীমানা। এ সম্পর্কে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক N.B.Roy তাঁর ‘Ala-ud-din Hussain Shah’ প্রবন্ধে লিখেছেন –
“জগন্নাথ মন্দিরের নথি ‘মাদলা পাঞ্জী’তে আছে, ১৫০৮-০৯ সালে আরাম্বাগ জেলার মন্দারণশিবির থেকে বেড়িয়ে শাহ ইশমাইল গাজী বিদ্যুৎগতিতে যাজপুর-কটকে অভিযান চালিয়ে বহু হিন্দুমন্দির ধ্বংস করে পুরী পর্যন্ত এগিয়ে যান। এই যুদ্ধজয়ের স্মারকমুদ্রায় যাজনগর ওড়িশার উল্লেখ করা হয়। মুসলমান সেনাদলের এই আকস্মিক অভিযানের খবর পেয়ে গজপতি প্রতাপরুদ্র তাঁর দক্ষিণ অভিযান থেকে ফিরে আসেন এবং আগ্রাসী মুসলিমবাহিনীর পিছু ধাওয়া করে আরামবাগের নিকট মন্দারণ পর্যন্ত চলে আসেন। বিজয়ী ওড়িয়াবাহিনী মন্দারণ দুর্গ অবরোধ করে কিন্তু গোবিন্দ বিদ্যাধর নামক জনৈক উচ্চপদস্ত রাজকর্মচারীর বিশ্বাসঘাতকতায় শেষ পর্যন্ত দুর্গ টি অধিকার করতে ব্যর্থ হয়।’’
অধ্যাপক প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের কথা, “গোবিন্দ কটক দুর্গের অধ্যক্ষ ছিল। উড়িষ্যার পতনের জন্য যে বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠী আংশিকভাবে দায়ী, তাদের প্রধান এই গোবিন্দ।’’
‘‘Govinda was the commandant of the fort of Cuttack. He was the first of that group of traitors who were partly responsible for the fall of Orissa.” (The Gajapati Kings of Orissa)
প্রতাপরুদ্র বিশ্বাসঘাতক বিদ্যাধরকে শাস্তি দেননি, তাকে উচ্চতর পদ ও ধন সম্পদ দান করে তার মন জয় করতে চেয়েছেন। ‘মাদলা পাঞ্জী’ তে আছে “বহুত সুকৃত তাহাঙ্কু রাজা বলে।কনক স্নাহান করাইলে, বিদ্যাধর পদরে রাজা তাহাঙ্কু সাড়ী দেলে, পাত্র কলে। তাহাঙ্কু মুলে রাজা রাজ্যভার দেলে।’’ (মাদলা পাঞ্জী, প্রাচী সংস্করণ, পঃ ৫২-৫৩)
রাজা তাকে কনক-স্নান করিয়ে ‘রাজা’র পদ দান করলেন। ‘রাজ্যভার’ কথাটির অর্থ অধ্যাপক প্রভাত মুখোপাধ্যায় করেছেন ‘সমগ্র রাজ্যের ভার’ (Medieval Vaishnavism in Orissa, Pg. 173) এবং বলেছেন মাদলা পাঞ্জীর এ তথ্য অনৈতিহাসিক। এ বিষয়ে কিছু নতুন তথ্য পাওয়া গেছে, যাতে দেখা যায়, সমগ্র রাজ্যের নয়, কলিঙ্গ প্রদেশ বা রাজ্যের ভার দেওয়া হয়েছিল বিদ্যাধরকে।
বিজয়নগরাধিপতি কৃষ্ণদেব রায়ের গুরু শ্রী ব্যাসরায়ের সংস্কৃত জীবনী ‘শ্রীব্যাসযোগিচারিতম’ (রচনাকাল আঃ ১৫৩৫ সাল) গ্রন্থে বিদ্যাধর পাত্রকে ‘কালিঙ্গাধিপতি’ রূপে উল্লেখ করা হয়েছে – ‘বিদ্যাধর পাত্র নামা কলিঙ্গাধিপতি’ (পঞ্চম অধ্যায়)। এতে বলা হয়েছে – কালিঙ্গাধিপতি বিদ্যাধর পাত্র কৃষ্ণদেব রায়ের নিকট একটি দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ পাঠিয়েছিলেন। গুরু শ্রীব্যাসরায় অতিদ্রুত ওই গ্রন্থের একটি সুন্দর ভাষ্য রচনা করলে কৃষ্ণদেব রায় চমৎকৃত হন। ‘শ্রীব্যাসযোগিচরিতম’ এর সম্পাদক B. Venkoba Rao এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, কলিঙ্গাধিপতির উল্লেখের ধরন দেখে বোঝা যায় কলিঙ্গযুদ্ধ তখন শেষ হয়েছে – “The manner of the reference to the lord of Kalinga shows that the Kalinga war was then over.” (Introduction, Para 132)
বিদ্যাধর পাত্র কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে ঠিক কোন সময়ে এই ধরণের যোগাযোগ করেছিলেন, সে বিষয়ে অবশ্য শ্রীযুক্ত রাওয়ের মত নিশ্চিত হওয়া যায় না। বিদ্যাধরের মতো উচ্চাকাঙ্খী ও অভিসন্ধিপরায়ণ ব্যাক্তির পক্ষে কলিঙ্গযুদ্ধ চলার সময়ও কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রেখে চলা অসম্ভব নয়। বিদ্যাধরের বিশ্বাসঘাতকতায় প্রতাপরুদ্রের পক্ষে মন্দারনদুর্গ দখল করা সম্ভব হয়নি। কলিঙ্গযুদ্ধের হতাশাব্যাঞ্জক ফলাফলের পিছনেও কলিঙ্গাধিপতি বিদ্যাধরের প্রতাপরুদ্র-বিরোধী ভূমিকা থাকা অসম্ভব নয়।
কলিঙ্গযুদ্ধে কৃষ্ণদেব রায় ১৫১৪ সালে দখল করলেন উদয়গিরি। ১৫১৫ সালে জয় করলেন গুন্তুর জেলার কোন্ডবীডু। তিনি রাজপুত্র বীরভদ্রকে বন্দি করে এগিয়ে এলেন সীমহাচলম্ পর্যন্ত। অপমানজনক শর্তে সন্ধি করতে বাধ্য হলেন প্রতাপরুদ্র। গোদাবরীর দক্ষিণে সমস্ত রাজ্য তাঁর হাতছাড়া হয়ে গেল। এইভাবে ওড়িশার রাজনৈতিক মর্যাদা হ্রাসের পিছনে চৈতন্য বা তাঁর ধর্ম কতটা দায়ী অথবা আদৌ দায়ী কিনা তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ওড়িয়া জাতির সামরিক দক্ষতা হ্রাসের জন্য চৈতন্য প্রচারিত ধর্ম ওই ধর্মের প্রতি রাজা প্রতাপরুদ্রের অনুরাগকে দায়ী করেছেন। সাম্প্রতিক কালেও ওড়িশার বিদ্বৎ সমাজের একাংশ ওড়িশার রাজনৈতিক স্বাধীনতালোপের জন্য দায়ী করে থাকেন চৈতন্যকে। অথচ দেশকে যারা ভিতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল, সেই বিশ্বাসঘাতক গোবিন্দ বিদ্যাধর বা অন্যান্যদের ভূমিকা সম্পর্কে তারা একটি কথাও বলেন না।
ওড়িশার ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই গোবিন্দ বিদ্যাধর অত্যন্ত হীনচরিত্রের মানুষ ছিল। প্রতাপরুদ্রের অনুগ্রহে অর্থ ও ক্ষমতা লাভ করে সে ১৫৪০ সালে প্রতাপরুদ্রের মৃত্যুর পরেই তাঁর দুই পুত্র কালুয়া দেব (১৫৪০-৪১) কে হত্যা করে সিংহাসন দখল করে। আবার বিদ্যাধরের নাতি নরসিংহকে হত্যা করে তাঁর সেনাপতি মুকুন্দদেব হরিচন্দন সিংহাসনে বসে। এইভাবে গুপ্তহত্যা ও অন্তর্ঘাতে দেশ ও জাতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পুর্বোক্ত পন্ডিতেরা এদিকে না তাকিয়ে রাখালদাসের মন্তব্যটিকে নির্বিচারে গ্রহণ করে ওড়িয়া জাতির পতনের জন্য চৈতন্য ও চৈতন্যধর্মকে দায়ী করে থাকেন।
তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, গোবিন্দ বিদ্যাধর বা তার সমগোত্রীয় কেউ চৈতন্যকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু তৎকালীন ওড়িশার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ থেকে একথা জোর দিয়ে বলা চলে যে, সেকালে শ্রীচৈতন্য অধিকাংশ ওড়িশাবাসীর উপাস্য হয়ে উঠলেও (১) জনগণ ও রাজার উপর তাঁর ক্রমবর্ধমান প্রভাবে কিছু সংখ্যক মানুষ আশঙ্কিত হয়েছিল। (২) ‘জগন্নাথ দারুব্রহ্ম আর চৈতন্য ছিল তাঁর সচল বিগ্রহ’ – এই জাতীয় প্রচার জগন্নাথসেবকদের একাংশের মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, (৩) চৈতন্য ও তাঁর সহচরদের জাতিভেদ বিরোধী প্রচার ও ক্রিয়াকর্ম ব্রাহ্মণ পুরোহিত সম্প্রদায়ের জীবিকায় এবং সামাজিক মান মর্যাদায় ঘা পড়েছিল, দলিত সাপের মতো হিংস্র হয়ে উঠেছিল তারা এবং (৪) বিদ্যাধরের সঙ্গে অভিসন্ধি পরায়ণ রাজনীতিক ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ এইসব বিক্ষুব্ধ ধর্মান্ধদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, এটাই স্বাভাবিক, এই অশুভ আঁতাতের মধ্যেই সম্ভবত নিহিত আছে শ্রীচৈতন্যের তিরোভাবের মূল কারণ।
ঐতিহাসিক ও সামাজিক পটভূমির এই পরিচয়ের ভিত্তিতে চৈতন্যতিরোভাবের বিবৃতিগুলি আর একবার পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।
জয়ানন্দ চৈতন্যের দেহাবসানের একটা বাস্তবানুগ বিবরণ দিয়ে বলেছেন তাঁর মায়া শরীর টোটার মাটিতে পড়ে ছিল। কিন্তু তাঁর কথামত সত্যই যদি এই ঘটনা গদাধর পণ্ডিতের সামনে ঘটত, তাহলে চৈতন্যের শবদেহের সদ্গতি বা সমাধিবিষয়ে বঙ্গীয় বৈষ্ণবদের নিশ্ছিদ্র অজ্ঞতা সম্ভবপর হতো না। উপরন্তু শ্রীকৃষ্ণের বাঁ পায়ে জরাব্যাধের শরাঘাত এবং চৈতন্যের বাঁ পায়ে ‘ইটাল’ বা ইটের টুকরোর আঘাত এতে যেন কৃষ্ণ-চৈতন্য সমীরণের তত্ত্বটিকেই বড় করে তুলে ধরেছেন জয়ানন্দ।
লোচনদাস বলেছেন, চৈতন্য নিজ-জনদের বাইরে রেখে মন্দিরে প্রবেশ করা মাত্র ‘তখন দুয়ারে নিজ লাগিল কপাট’। ভক্তদের থেকে তাকে এইভাবে কি বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া হয়েছিল? উপরন্ত লক্ষনীয়, মন্দিরের ভিতর থেকে একজন ‘পড়িছা’ বা পুরোহিত ঘোষণা করল জগন্নাথঅঙ্গে চৈতন্য বিলীন হয়ে গেছেন। তখন ভক্তবৃন্দ, রাজগুরু কাশী মিশ্র এবং অন্যান্য অনেকে বিলাপ করতে লাগলেন। রাজা স্বয়ং এ সংবাদ শুনে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন, কিন্তু চৈতন্যের পার্থিবদেহ সম্পর্কে কেউ অনুসন্ধান করলেন না। জগন্নাথঅঙ্গে বিলীন হওয়ার সংবাদটি ছড়িয়ে দেওয়ার পিছনে কূটকৌশলী কোনও চক্রের চতুর পরিকল্পনার অস্তিত্ব কি অসম্ভব? জগন্নাথের ‘সচল বিগ্রহ’ কে জগন্নাথ আত্মসাৎ করেছেন, ‘সচল বিগ্রহ’ বাদী ভক্তরা একথা অস্বীকার করতে পারবেন না এবং জগন্নাথঅঙ্গে বিলীন হওয়ার পর মায়া শরীরের খোঁজখবর করা নিতান্ত অশাস্ত্রীয় ও অধার্মিক ব্যাপার হবে, সম্ভবত এই ছিল চতুর চক্রের চিন্তাধারা।
ঈশান নাগর বলেছেন –
‘প্রবেশ মাত্রেতে দ্বার স্বয়ং রুদ্ধ হৈল।
ভক্তগণ মনে বহু আশঙ্কা জন্মিল।।’
এই আশঙ্কার কারণ কি? আবার মন্দিরদ্বার খোলা মাত্র ‘গৌরাঙ্গাপ্রকট সভে অনুমান কৈল’। এরই বা কারণ কি? তবে কি সেই অশুভ ঘটনার পূর্ভাবাস কেউ কেউ পেয়েছিলেন?
ওড়িয়া গ্রন্থগুলিতে এই বিগ্রহে লীন হওয়ার তত্ত্বই সমর্থিত হয়েছে। ঈশ্বরদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ অনুসারে সেকালের একটি মাত্র মানুষ, বাসুদেব তীর্থ, এর সত্যতায় সন্দিহান হয়ে প্রকাশ্যে মুক্তিমণ্ডপে এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক করেছিলেন। অবশ্য তখন চৈতন্য তিরোভাবের পর অন্তত ‘একশ’ বছর কেটে গেছে (অধ্যাপক প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের মতে ঈশ্বরদাস সপ্তদশ শতকের প্রথমভাগে ‘চৈতন্যভাগবত’ রচনা করেন। ড.বিমানবিহারী মজুমদারের হিসাব অনুসারে ঈশ্বরদাসের গ্রন্থ চৈতন্য তিরোভাবের ১৫০/১৭৫ বছর পরে লিখিত হয়)। এই কাল ব্যবধানেই সম্ভবত ঈশ্বরদাসকে দিয়েছিল সেই নিরাপত্তা যার ভিত্তিতে তিনি চৈতন্যের পার্থিবদেহের পরিণতি সম্পর্কে অলৌকিকতার মোড়কে মুড়ে কিছু বাস্তবতথ্য পরিবেশনে সাহসী হয়েছেন। ঈশ্বরদাসের মতে, লোকলোচনের অন্তরালে পুরী থেকে বহু দূরে নদীগর্ভে বিসর্জন দেওয়া হয় চৈতন্যের পাথির্বদেহ। তাঁর মতে প্রতাপরুদ্র এ ব্যাপারে কিছু জানতেন না। তিনি বলেছেন, তিরোধানের খবর পেয়ে রাজা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন, ‘রাজন ক্রোধ কে কহিব’। চৈতন্যতিরোধানের পিছনে কোনও অপরাধমূলক চক্রান্ত না থাকলে রাজা ক্রুদ্ধ হলেন কেন? সব কিছু স্বাভাবিক থাকলে রাজাকে গোপন করা হল কেন? ঈশ্বরদাসের বিবরণীতে স্পষ্ট আভাস মেলে, রুদ্ধদ্বার মন্দিরমধ্যে চক্রান্তকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তাদেরই কেউ কেউ যখন জগন্নাথঅঙ্গে চৈতন্যের বিলীন হওয়ার কথা ঘোষণা করতে থাকে, তখন অন্যেরা গোপনে সে দেহ বহন করে নিয়ে বিসর্জন দেয় বহূ মাইল দূরে কোনও নদীতে।
ঈশ্বরদাস বলেছেন, তিনি তাঁর গুরুর কাছে চৈতন্যদেহ বিসর্জনের ‘অত্যন্ত গুপ্ত এহু কথা’ শুনেছেন। চৈতন্য তিরোধানের পর ঈশ্বরদাসের কাল পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ এক-দেড়শ বছর একথা গুপ্ত রইল কিভাবে? হয়তো এর আগে যারা জানতেন, রাজদণ্ডের ভয়ে তাঁরা একথা প্রকাশ করতেন না। অত্যন্ত ক্ষমতাশালী, রাজকীয় মর্যাদার অধিকারী কেউ এসবের মূলে না থাকলে এমন নিশ্ছিদ্র গোপনীয়তা এবং সমকালীন ভক্ত কবিদের চৈতন্যদেহ বাঁ চৈতন্যসমাধি সম্পর্কে এমন লৌহ কঠিন নীরবতা সম্ভব হত না। এসবই আবার প্রতাপরুদ্রের পুত্রহন্তা, সিংহাসন দখলকারী ও ভোই বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোবিন্দ বিদ্যাধরের দিকে সন্দেহের তির ফলকটি সঞ্চালিত করে।
শ্রীচৈতন্যের কয়েকশো বছর আগে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের প্রবক্তা শ্রীরামানুজ বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন পুরীতে। তাঁকেও যে বিষম পরিণতির সন্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁর প্রমাণ আছে ‘প্রপন্নামৃত’ সংস্কৃত গ্রন্থে। এতে বলা হয়েছে, ‘শ্রীজগন্নাথদেব শ্রীরামানুজস্বামীকে ‘একরাত্রে পুরুষোত্তম থেকে কূর্মতীর্থে টেনে ফেলে দিয়েছিলেন’ (চৈতন্যচরিতামৃত, গৌড়ীয় মঠ সং, অমৃতপ্রবাহভাষ্য, মধ্য ৭/১১৩)। এই কিংবদন্তীর তাৎপর্য সম্ভবত এই যে, জগন্নাথক্ষেত্রে রামানুজ ধর্ম প্রচার করতে এলে তাঁর সঙ্গে বিরোধ বেধেছিল জগন্নাথসেবকদের সঙ্গে। ‘টেনে ফেলে দেওয়া’ কথাটির মধ্যে সেই বিরোধ ও বর্জনের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ওড়িশা বাসিদের উপর রামানুজের তুলনায় চৈতন্যের প্রভাব ছিল নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। জনগনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা মনে রেখে তাই ষড়যন্ত্রকারীদের অনেক অনেক ভেবেচিন্তে মাথা খাটিয়ে কাজ করতে হয়েছে গোপনে। আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথি অন্তর্ধানের সময় হলে বুঝতে হবে, রথযাত্রা উৎসবে যখন দেশের মানুষ অত্যন্ত ব্যস্ত তখন তাদের সেই ব্যস্ততারই সুযোগ নিতে চেয়েছে ষড়যন্ত্রকারীরা।
পরিষেশে অসংকোচে বলা যায়, শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্যের যবনিকা সম্পূর্ণ উন্মোচিত করার মতো নিশ্চিন্ত কোনও তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি আজও। এ আলোচনায় উদ্দেশ্য হল অন্তর্ধানের পিছনে অপরাধমুলক ক্রিয়াকাণ্ডের সম্ভাব্যতা বিচার করা। তৎকালীন সাহিত্য, সমাজ ও রাজনীতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেল তা আদৌ অসম্ভব ছিল না।
‘ভারতের সাধক’ তৃতীয় খণ্ডে শঙ্করনাথ রায় শ্রীচৈতন্যের লোকান্তর প্রসঙ্গে লিখেছেন,
“১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দে। আষাঢ় মাস। বেলা তখন প্রায় তৃতীয় প্রহর। এক দিব্য ভাবাবেশে আবিষ্ট হইয়া প্রভু জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রবেশ করিলেন। নাটমন্দিরে গরুড় স্তম্ভের নীচে প্রতিদিন গিয়া দাঁড়ান, যুক্ত করে ভাবতন্ময় অবস্থায় পুরষোত্তম বিগ্রহের চিন্ময় রূপসুধা পান করেন, নয়নজলের ধারায় সারা দেহ ভিজিয়া যায়। কিন্তু আজ কেন তিনি সরাসরি মূল বেদীকোঠায় ঢুকিয়া পড়িলেন? কেন এই অদ্ভুত ব্যতিক্রম?
ভক্তগণ সবিস্ময়ে তাঁহার কাণ্ড লক্ষ্য করিতেছেন। হটাৎ এক সময়ে অন্তগৃহের দ্বার বন্ধ হইয়া গেল। সবাই বাহিরে, ভিতরে রহিলেন শুধু প্রভু আর তাঁহার শ্রীজগন্নাথ।
সন্মুখে বিরাজিত পরম জাগ্রত দারুব্রহ্ম, শ্রীচৈতন্যের ধ্যানের ধন, ‘ঈশ্বর পরমঃ কৃষ্ণ’-এর দিব্যি শ্রীবিগ্রহ। ভাবোদ্বেল প্রভু হুঙ্কার দিয়া সেদিকে ধাবিত হইলেন।
বাইশ বৎসর পূর্বে, প্রথম দর্শনের দিনটিতে এমনি আত্মহারা এমনি পাগলপারা হইয়া এই পুরুষোত্তম বিগ্রহকে কোলে নিতে তিনি ছুটিয়াছিলেন। সেদিন ঘটিয়াছিল নীলাচল-লীলার উদ্বোধন। আজ আবার এ কোন পর্ব? একই নিত্যলীলায় প্রবেশের সূচনা?
এইদিনও শ্রীবিগ্রহকে চৈতন্য তাঁহার বুকে তুলিয়া নিতে গেলেন। মূহূর্তমধ্যে এক মহা অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়া গেল। চিরতরে তিনি হইলেন অন্তর্হিত।
বহু খোঁজাখুঁজিতেও প্রভুর মরদেহের সন্ধান আর পাওয়া যায় নাই। অগণিত ভক্তের ব্যাকুল অনুসন্ধান, উড়িষ্যারাজ প্রতাপরুদ্রের আপ্রাণ প্রয়াস, সব কিছু সেদিন ব্যর্থ হয়। এ রহস্যময় অন্তর্ধান চিরদুর্বোধ্য রহিয়া যায়।’’
চলবে....

শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য- ২


পর্ব-২
শ্রীচৈতন্য ১৫১০ সালে এসেছিলেন পুরীতে। সেই সময় ওড়িশার রাজা ছিলেন প্রতাপরুদ্র। বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে ছিলেন যুদ্ধে লিপ্ত। কৃষ্ণদেব রায় ১৫০৯ সালে সিংহাসনে বসার সময় থেকেই উভয় রাজ্যের মধ্যে ছোটখাট যুদ্ধ বিগ্রহ চলছিল। এ কারণে ১৫০৯ সাল থেকেই প্রতাপরুদ্র ছিলেন দক্ষিণে। ১৫১০ সালের প্রথমদিকে শ্রীচৈতন্য তীর্থপর্যটনে বেড়িয়ে মোটামুটি উপকূল ভাগ ধরে পুরী থেকে কন্যাকুমারী হয়ে পৌঁছেছিলেন দ্বারকায়। সেখান থেকে তিনি নর্মদার তীর বরাবর হয়ে পুরীতে ফিরে আসেন ১৫১২ সালে।

১৫ শতকের শুরুতে মহাপ্রভু ২ বছরের জন্য দাক্ষিণাত্যে তীর্থযাত্রা করেন। এই সময় তিনি পুরী ধাম হতে শ্রীরঙ্গক্ষেত্র, রাম সরোবর, কন্যাকুমারী হয়ে পায়াসিবিনি নদী ধরে দক্ষিণ ভারতের একটি প্রাচীন মন্দির (আদি কেশব মন্দির) এসেছিলেন। মহাপ্রভু একস্থানে বসার পর তিনি বিশেষ ভাব অনুভব করছিলেন, তিনি ভক্তদের তার বসার স্থানের নীচের মাটি খননের আদেশ দিলেন, ভক্তরা মাটি খুড়তে খুড়তে কিছু কর্দমাক্ত মাটির নিচে ব্রহ্ম সংহিতা পেলেন। পান্ডুলিপিটি সম্পূর্ণ রূপে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল মাটির নিচে পোকাদের আক্রমণে। শুধুমাত্র ৫ম অধ্যায়টি অক্ষুণ্ণ ছিল। তাই বর্তমানে শতাধ্যায়ী ব্রহ্ম সংহিতার শুধুমাত্র ৫ম অধ্যায়টিই পাওয়া যায়।

গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মতে, যেহেতু অনেক কাল আগে থেকে এইটি এইভাবে গুপ্ত ছিল তাই শঙ্করাচার্য, রামানুজাচার্য, মধ্বাচার্য, নিম্বার্কাচার্য বা অন্য কোনো আচার্যদের গ্রন্থে এই ব্রহ্মসংহিতার নাম উল্লেখ নেই। যুক্তিবাদ ও ঐতিহাসিকতার দিক থেকে ব্রহ্মসংহিতার প্রামাণিকতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকলেও যেহেতু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এইটিকে অনুমোদন করেছেন তাই এইটি গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের কাছে স্বীকৃত শাস্ত্র।

পুরী ফিরে এসে মহাপ্রভু বাসুদেব সার্বভৌম এবং রামানন্দ রায়কে ব্রহ্মসংহিতার বিষয় অবগত করিয়ে মুদ্রণের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিলেন। এভাবে ব্রহ্ম সংহিতার প্রচার শুরু হল।

কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর মতে উচ্চপর্যায়ের পারমার্থিক বিষয় অবগত হওয়ার জন্য ব্রহ্ম সংহিতার মতো আর অন্য কোন শাস্ত্র নেই।
অচিন্ত্য ভেদাভেদতত্ত্ব, অপ্রাকৃত জগতের বিবরন, গোবিন্দের অপ্রাকৃত লীলাবিলাস, ভগবানের প্রতি ভালোবাসা, ভক্তির পর্যায় প্রভৃতি ব্রহ্মসংহিতার আলোচ্য বিষয়।
তার আগেই, প্রতাপরুদ্রের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের সেনাদল অতিক্রম করে ওড়িশার উত্তর সীমানা। এ সম্পর্কে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক N.B.Roy তাঁর ‘Ala-ud-din Hussain Shah’ প্রবন্ধে লিখেছেন –
“জগন্নাথ মন্দিরের নথি ‘মাদলা পাঞ্জী’তে আছে, ১৫০৮-০৯ সালে আরাম্বাগ জেলার মন্দারণশিবির থেকে বেড়িয়ে শাহ ইশমাইল গাজী বিদ্যুৎগতিতে যাজপুর-কটকে অভিযান চালিয়ে বহু হিন্দুমন্দির ধ্বংস করে পুরী পর্যন্ত এগিয়ে যান। এই যুদ্ধজয়ের স্মারকমুদ্রায় যাজনগর ওড়িশার উল্লেখ করা হয়। মুসলমান সেনাদলের এই আকস্মিক অভিযানের খবর পেয়ে গজপতি প্রতাপরুদ্র তাঁর দক্ষিণ অভিযান থেকে ফিরে আসেন এবং আগ্রাসী মুসলিমবাহিনীর পিছু ধাওয়া করে আরামবাগের নিকট মন্দারণ পর্যন্ত চলে আসেন। বিজয়ী ওড়িয়াবাহিনী মন্দারণ দুর্গ অবরোধ করে কিন্তু গোবিন্দ বিদ্যাধর নামক জনৈক উচ্চপদস্ত রাজকর্মচারীর বিশ্বাসঘাতকতায় শেষ পর্যন্ত দুর্গ টি অধিকার করতে ব্যর্থ হয়।’’
অধ্যাপক প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের কথা, “গোবিন্দ কটক দুর্গের অধ্যক্ষ ছিল। উড়িষ্যার পতনের জন্য যে বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠী আংশিকভাবে দায়ী, তাদের প্রধান এই গোবিন্দ।’’
‘‘Govinda was the commandant of the fort of Cuttack. He was the first of that group of traitors who were partly responsible for the fall of Orissa.” (The Gajapati Kings of Orissa)
প্রতাপরুদ্র বিশ্বাসঘাতক বিদ্যাধরকে শাস্তি দেননি, তাকে উচ্চতর পদ ও ধন সম্পদ দান করে তার মন জয় করতে চেয়েছেন। ‘মাদলা পাঞ্জী’ তে আছে “বহুত সুকৃত তাহাঙ্কু রাজা বলে।কনক স্নাহান করাইলে, বিদ্যাধর পদরে রাজা তাহাঙ্কু সাড়ী দেলে, পাত্র কলে। তাহাঙ্কু মুলে রাজা রাজ্যভার দেলে।’’ (মাদলা পাঞ্জী, প্রাচী সংস্করণ, পঃ ৫২-৫৩)
রাজা তাকে কনক-স্নান করিয়ে ‘রাজা’র পদ দান করলেন। ‘রাজ্যভার’ কথাটির অর্থ অধ্যাপক প্রভাত মুখোপাধ্যায় করেছেন ‘সমগ্র রাজ্যের ভার’ (Medieval Vaishnavism in Orissa, Pg. 173) এবং বলেছেন মাদলা পাঞ্জীর এ তথ্য অনৈতিহাসিক। এ বিষয়ে কিছু নতুন তথ্য পাওয়া গেছে, যাতে দেখা যায়, সমগ্র রাজ্যের নয়, কলিঙ্গ প্রদেশ বা রাজ্যের ভার দেওয়া হয়েছিল বিদ্যাধরকে।
বিজয়নগরাধিপতি কৃষ্ণদেব রায়ের গুরু শ্রী ব্যাসরায়ের সংস্কৃত জীবনী ‘শ্রীব্যাসযোগিচারিতম’ (রচনাকাল আঃ ১৫৩৫ সাল) গ্রন্থে বিদ্যাধর পাত্রকে ‘কালিঙ্গাধিপতি’ রূপে উল্লেখ করা হয়েছে – ‘বিদ্যাধর পাত্র নামা কলিঙ্গাধিপতি’ (পঞ্চম অধ্যায়)। এতে বলা হয়েছে – কালিঙ্গাধিপতি বিদ্যাধর পাত্র কৃষ্ণদেব রায়ের নিকট একটি দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ পাঠিয়েছিলেন। গুরু শ্রীব্যাসরায় অতিদ্রুত ওই গ্রন্থের একটি সুন্দর ভাষ্য রচনা করলে কৃষ্ণদেব রায় চমৎকৃত হন। ‘শ্রীব্যাসযোগিচরিতম’ এর সম্পাদক B. Venkoba Rao এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, কলিঙ্গাধিপতির উল্লেখের ধরন দেখে বোঝা যায় কলিঙ্গযুদ্ধ তখন শেষ হয়েছে – “The manner of the reference to the lord of Kalinga shows that the Kalinga war was then over.” (Introduction, Para 132)
বিদ্যাধর পাত্র কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে ঠিক কোন সময়ে এই ধরণের যোগাযোগ করেছিলেন, সে বিষয়ে অবশ্য শ্রীযুক্ত রাওয়ের মত নিশ্চিত হওয়া যায় না। বিদ্যাধরের মতো উচ্চাকাঙ্খী ও অভিসন্ধিপরায়ণ ব্যাক্তির পক্ষে কলিঙ্গযুদ্ধ চলার সময়ও কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রেখে চলা অসম্ভব নয়। বিদ্যাধরের বিশ্বাসঘাতকতায় প্রতাপরুদ্রের পক্ষে মন্দারনদুর্গ দখল করা সম্ভব হয়নি। কলিঙ্গযুদ্ধের হতাশাব্যাঞ্জক ফলাফলের পিছনেও কলিঙ্গাধিপতি বিদ্যাধরের প্রতাপরুদ্র-বিরোধী ভূমিকা থাকা অসম্ভব নয়।
কলিঙ্গযুদ্ধে কৃষ্ণদেব রায় ১৫১৪ সালে দখল করলেন উদয়গিরি। ১৫১৫ সালে জয় করলেন গুন্তুর জেলার কোন্ডবীডু। তিনি রাজপুত্র বীরভদ্রকে বন্দি করে এগিয়ে এলেন সীমহাচলম্ পর্যন্ত। অপমানজনক শর্তে সন্ধি করতে বাধ্য হলেন প্রতাপরুদ্র। গোদাবরীর দক্ষিণে সমস্ত রাজ্য তাঁর হাতছাড়া হয়ে গেল। এইভাবে ওড়িশার রাজনৈতিক মর্যাদা হ্রাসের পিছনে চৈতন্য বা তাঁর ধর্ম কতটা দায়ী অথবা আদৌ দায়ী কিনা তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ওড়িয়া জাতির সামরিক দক্ষতা হ্রাসের জন্য চৈতন্য প্রচারিত ধর্ম ওই ধর্মের প্রতি রাজা প্রতাপরুদ্রের অনুরাগকে দায়ী করেছেন। সাম্প্রতিক কালেও ওড়িশার বিদ্বৎ সমাজের একাংশ ওড়িশার রাজনৈতিক স্বাধীনতালোপের জন্য দায়ী করে থাকেন চৈতন্যকে। অথচ দেশকে যারা ভিতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল, সেই বিশ্বাসঘাতক গোবিন্দ বিদ্যাধর বা অন্যান্যদের ভূমিকা সম্পর্কে তারা একটি কথাও বলেন না।
ওড়িশার ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই গোবিন্দ বিদ্যাধর অত্যন্ত হীনচরিত্রের মানুষ ছিল। প্রতাপরুদ্রের অনুগ্রহে অর্থ ও ক্ষমতা লাভ করে সে ১৫৪০ সালে প্রতাপরুদ্রের মৃত্যুর পরেই তাঁর দুই পুত্র কালুয়া দেব (১৫৪০-৪১) কে হত্যা করে সিংহাসন দখল করে। আবার বিদ্যাধরের নাতি নরসিংহকে হত্যা করে তাঁর সেনাপতি মুকুন্দদেব হরিচন্দন সিংহাসনে বসে। এইভাবে গুপ্তহত্যা ও অন্তর্ঘাতে দেশ ও জাতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পুর্বোক্ত পন্ডিতেরা এদিকে না তাকিয়ে রাখালদাসের মন্তব্যটিকে নির্বিচারে গ্রহণ করে ওড়িয়া জাতির পতনের জন্য চৈতন্য ও চৈতন্যধর্মকে দায়ী করে থাকেন।
তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, গোবিন্দ বিদ্যাধর বা তার সমগোত্রীয় কেউ চৈতন্যকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু তৎকালীন ওড়িশার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ থেকে একথা জোর দিয়ে বলা চলে যে, সেকালে শ্রীচৈতন্য অধিকাংশ ওড়িশাবাসীর উপাস্য হয়ে উঠলেও (১) জনগণ ও রাজার উপর তাঁর ক্রমবর্ধমান প্রভাবে কিছু সংখ্যক মানুষ আশঙ্কিত হয়েছিল। (২) ‘জগন্নাথ দারুব্রহ্ম আর চৈতন্য ছিল তাঁর সচল বিগ্রহ’ – এই জাতীয় প্রচার জগন্নাথসেবকদের একাংশের মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, (৩) চৈতন্য ও তাঁর সহচরদের জাতিভেদ বিরোধী প্রচার ও ক্রিয়াকর্ম ব্রাহ্মণ পুরোহিত সম্প্রদায়ের জীবিকায় এবং সামাজিক মান মর্যাদায় ঘা পড়েছিল, দলিত সাপের মতো হিংস্র হয়ে উঠেছিল তারা এবং (৪) বিদ্যাধরের সঙ্গে অভিসন্ধি পরায়ণ রাজনীতিক ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ এইসব বিক্ষুব্ধ ধর্মান্ধদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, এটাই স্বাভাবিক, এই অশুভ আঁতাতের মধ্যেই সম্ভবত নিহিত আছে শ্রীচৈতন্যের তিরোভাবের মূল কারণ।
ঐতিহাসিক ও সামাজিক পটভূমির এই পরিচয়ের ভিত্তিতে চৈতন্যতিরোভাবের বিবৃতিগুলি আর একবার পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।
জয়ানন্দ চৈতন্যের দেহাবসানের একটা বাস্তবানুগ বিবরণ দিয়ে বলেছেন তাঁর মায়া শরীর টোটার মাটিতে পড়ে ছিল। কিন্তু তাঁর কথামত সত্যই যদি এই ঘটনা গদাধর পণ্ডিতের সামনে ঘটত, তাহলে চৈতন্যের শবদেহের সদ্গতি বা সমাধিবিষয়ে বঙ্গীয় বৈষ্ণবদের নিশ্ছিদ্র অজ্ঞতা সম্ভবপর হতো না। উপরন্তু শ্রীকৃষ্ণের বাঁ পায়ে জরাব্যাধের শরাঘাত এবং চৈতন্যের বাঁ পায়ে ‘ইটাল’ বা ইটের টুকরোর আঘাত এতে যেন কৃষ্ণ-চৈতন্য সমীরণের তত্ত্বটিকেই বড় করে তুলে ধরেছেন জয়ানন্দ।
লোচনদাস বলেছেন, চৈতন্য নিজ-জনদের বাইরে রেখে মন্দিরে প্রবেশ করা মাত্র ‘তখন দুয়ারে নিজ লাগিল কপাট’। ভক্তদের থেকে তাকে এইভাবে কি বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া হয়েছিল? উপরন্ত লক্ষনীয়, মন্দিরের ভিতর থেকে একজন ‘পড়িছা’ বা পুরোহিত ঘোষণা করল জগন্নাথঅঙ্গে চৈতন্য বিলীন হয়ে গেছেন। তখন ভক্তবৃন্দ, রাজগুরু কাশী মিশ্র এবং অন্যান্য অনেকে বিলাপ করতে লাগলেন। রাজা স্বয়ং এ সংবাদ শুনে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন, কিন্তু চৈতন্যের পার্থিবদেহ সম্পর্কে কেউ অনুসন্ধান করলেন না। জগন্নাথঅঙ্গে বিলীন হওয়ার সংবাদটি ছড়িয়ে দেওয়ার পিছনে কূটকৌশলী কোনও চক্রের চতুর পরিকল্পনার অস্তিত্ব কি অসম্ভব? জগন্নাথের ‘সচল বিগ্রহ’ কে জগন্নাথ আত্মসাৎ করেছেন, ‘সচল বিগ্রহ’ বাদী ভক্তরা একথা অস্বীকার করতে পারবেন না এবং জগন্নাথঅঙ্গে বিলীন হওয়ার পর মায়া শরীরের খোঁজখবর করা নিতান্ত অশাস্ত্রীয় ও অধার্মিক ব্যাপার হবে, সম্ভবত এই ছিল চতুর চক্রের চিন্তাধারা।
ঈশান নাগর বলেছেন –
‘প্রবেশ মাত্রেতে দ্বার স্বয়ং রুদ্ধ হৈল।
ভক্তগণ মনে বহু আশঙ্কা জন্মিল।।’
এই আশঙ্কার কারণ কি? আবার মন্দিরদ্বার খোলা মাত্র ‘গৌরাঙ্গাপ্রকট সভে অনুমান কৈল’। এরই বা কারণ কি? তবে কি সেই অশুভ ঘটনার পূর্ভাবাস কেউ কেউ পেয়েছিলেন?
ওড়িয়া গ্রন্থগুলিতে এই বিগ্রহে লীন হওয়ার তত্ত্বই সমর্থিত হয়েছে। ঈশ্বরদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ অনুসারে সেকালের একটি মাত্র মানুষ, বাসুদেব তীর্থ, এর সত্যতায় সন্দিহান হয়ে প্রকাশ্যে মুক্তিমণ্ডপে এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক করেছিলেন। অবশ্য তখন চৈতন্য তিরোভাবের পর অন্তত ‘একশ’ বছর কেটে গেছে (অধ্যাপক প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের মতে ঈশ্বরদাস সপ্তদশ শতকের প্রথমভাগে ‘চৈতন্যভাগবত’ রচনা করেন। ড.বিমানবিহারী মজুমদারের হিসাব অনুসারে ঈশ্বরদাসের গ্রন্থ চৈতন্য তিরোভাবের ১৫০/১৭৫ বছর পরে লিখিত হয়)। এই কাল ব্যবধানেই সম্ভবত ঈশ্বরদাসকে দিয়েছিল সেই নিরাপত্তা যার ভিত্তিতে তিনি চৈতন্যের পার্থিবদেহের পরিণতি সম্পর্কে অলৌকিকতার মোড়কে মুড়ে কিছু বাস্তবতথ্য পরিবেশনে সাহসী হয়েছেন। ঈশ্বরদাসের মতে, লোকলোচনের অন্তরালে পুরী থেকে বহু দূরে নদীগর্ভে বিসর্জন দেওয়া হয় চৈতন্যের পাথির্বদেহ। তাঁর মতে প্রতাপরুদ্র এ ব্যাপারে কিছু জানতেন না। তিনি বলেছেন, তিরোধানের খবর পেয়ে রাজা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন, ‘রাজন ক্রোধ কে কহিব’। চৈতন্যতিরোধানের পিছনে কোনও অপরাধমূলক চক্রান্ত না থাকলে রাজা ক্রুদ্ধ হলেন কেন? সব কিছু স্বাভাবিক থাকলে রাজাকে গোপন করা হল কেন? ঈশ্বরদাসের বিবরণীতে স্পষ্ট আভাস মেলে, রুদ্ধদ্বার মন্দিরমধ্যে চক্রান্তকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তাদেরই কেউ কেউ যখন জগন্নাথঅঙ্গে চৈতন্যের বিলীন হওয়ার কথা ঘোষণা করতে থাকে, তখন অন্যেরা গোপনে সে দেহ বহন করে নিয়ে বিসর্জন দেয় বহূ মাইল দূরে কোনও নদীতে।
ঈশ্বরদাস বলেছেন, তিনি তাঁর গুরুর কাছে চৈতন্যদেহ বিসর্জনের ‘অত্যন্ত গুপ্ত এহু কথা’ শুনেছেন। চৈতন্য তিরোধানের পর ঈশ্বরদাসের কাল পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ এক-দেড়শ বছর একথা গুপ্ত রইল কিভাবে? হয়তো এর আগে যারা জানতেন, রাজদণ্ডের ভয়ে তাঁরা একথা প্রকাশ করতেন না। অত্যন্ত ক্ষমতাশালী, রাজকীয় মর্যাদার অধিকারী কেউ এসবের মূলে না থাকলে এমন নিশ্ছিদ্র গোপনীয়তা এবং সমকালীন ভক্ত কবিদের চৈতন্যদেহ বাঁ চৈতন্যসমাধি সম্পর্কে এমন লৌহ কঠিন নীরবতা সম্ভব হত না। এসবই আবার প্রতাপরুদ্রের পুত্রহন্তা, সিংহাসন দখলকারী ও ভোই বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোবিন্দ বিদ্যাধরের দিকে সন্দেহের তির ফলকটি সঞ্চালিত করে।
শ্রীচৈতন্যের কয়েকশো বছর আগে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের প্রবক্তা শ্রীরামানুজ বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন পুরীতে। তাঁকেও যে বিষম পরিণতির সন্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁর প্রমাণ আছে ‘প্রপন্নামৃত’ সংস্কৃত গ্রন্থে। এতে বলা হয়েছে, ‘শ্রীজগন্নাথদেব শ্রীরামানুজস্বামীকে ‘একরাত্রে পুরুষোত্তম থেকে কূর্মতীর্থে টেনে ফেলে দিয়েছিলেন’ (চৈতন্যচরিতামৃত, গৌড়ীয় মঠ সং, অমৃতপ্রবাহভাষ্য, মধ্য ৭/১১৩)। এই কিংবদন্তীর তাৎপর্য সম্ভবত এই যে, জগন্নাথক্ষেত্রে রামানুজ ধর্ম প্রচার করতে এলে তাঁর সঙ্গে বিরোধ বেধেছিল জগন্নাথসেবকদের সঙ্গে। ‘টেনে ফেলে দেওয়া’ কথাটির মধ্যে সেই বিরোধ ও বর্জনের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ওড়িশা বাসিদের উপর রামানুজের তুলনায় চৈতন্যের প্রভাব ছিল নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। জনগনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা মনে রেখে তাই ষড়যন্ত্রকারীদের অনেক অনেক ভেবেচিন্তে মাথা খাটিয়ে কাজ করতে হয়েছে গোপনে। আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথি অন্তর্ধানের সময় হলে বুঝতে হবে, রথযাত্রা উৎসবে যখন দেশের মানুষ অত্যন্ত ব্যস্ত তখন তাদের সেই ব্যস্ততারই সুযোগ নিতে চেয়েছে ষড়যন্ত্রকারীরা।
পরিষেশে অসংকোচে বলা যায়, শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্যের যবনিকা সম্পূর্ণ উন্মোচিত করার মতো নিশ্চিন্ত কোনও তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি আজও। এ আলোচনায় উদ্দেশ্য হল অন্তর্ধানের পিছনে অপরাধমুলক ক্রিয়াকাণ্ডের সম্ভাব্যতা বিচার করা। তৎকালীন সাহিত্য, সমাজ ও রাজনীতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেল তা আদৌ অসম্ভব ছিল না।
‘ভারতের সাধক’ তৃতীয় খণ্ডে শঙ্করনাথ রায় শ্রীচৈতন্যের লোকান্তর প্রসঙ্গে লিখেছেন,
“১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দে। আষাঢ় মাস। বেলা তখন প্রায় তৃতীয় প্রহর। এক দিব্য ভাবাবেশে আবিষ্ট হইয়া প্রভু জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রবেশ করিলেন। নাটমন্দিরে গরুড় স্তম্ভের নীচে প্রতিদিন গিয়া দাঁড়ান, যুক্ত করে ভাবতন্ময় অবস্থায় পুরষোত্তম বিগ্রহের চিন্ময় রূপসুধা পান করেন, নয়নজলের ধারায় সারা দেহ ভিজিয়া যায়। কিন্তু আজ কেন তিনি সরাসরি মূল বেদীকোঠায় ঢুকিয়া পড়িলেন? কেন এই অদ্ভুত ব্যতিক্রম?
ভক্তগণ সবিস্ময়ে তাঁহার কাণ্ড লক্ষ্য করিতেছেন। হটাৎ এক সময়ে অন্তগৃহের দ্বার বন্ধ হইয়া গেল। সবাই বাহিরে, ভিতরে রহিলেন শুধু প্রভু আর তাঁহার শ্রীজগন্নাথ।
সন্মুখে বিরাজিত পরম জাগ্রত দারুব্রহ্ম, শ্রীচৈতন্যের ধ্যানের ধন, ‘ঈশ্বর পরমঃ কৃষ্ণ’-এর দিব্যি শ্রীবিগ্রহ। ভাবোদ্বেল প্রভু হুঙ্কার দিয়া সেদিকে ধাবিত হইলেন।
বাইশ বৎসর পূর্বে, প্রথম দর্শনের দিনটিতে এমনি আত্মহারা এমনি পাগলপারা হইয়া এই পুরুষোত্তম বিগ্রহকে কোলে নিতে তিনি ছুটিয়াছিলেন। সেদিন ঘটিয়াছিল নীলাচল-লীলার উদ্বোধন। আজ আবার এ কোন পর্ব? একই নিত্যলীলায় প্রবেশের সূচনা?
এইদিনও শ্রীবিগ্রহকে চৈতন্য তাঁহার বুকে তুলিয়া নিতে গেলেন। মূহূর্তমধ্যে এক মহা অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়া গেল। চিরতরে তিনি হইলেন অন্তর্হিত।
বহু খোঁজাখুঁজিতেও প্রভুর মরদেহের সন্ধান আর পাওয়া যায় নাই। অগণিত ভক্তের ব্যাকুল অনুসন্ধান, উড়িষ্যারাজ প্রতাপরুদ্রের আপ্রাণ প্রয়াস, সব কিছু সেদিন ব্যর্থ হয়। এ রহস্যময় অন্তর্ধান চিরদুর্বোধ্য রহিয়া যায়।’’
চলবে....

Posted at June 15, 2017 |  by Arya ঋষি

0 Comments:

Tags

Text Widget

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipisicing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation test link ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat.

Blog Archive

© 2013 Arya Rishi. WP Theme-junkie converted by Bloggertheme9Published..Blogger Templates
Blogger templates. Proudly Powered by Blogger.
back to top