All Stories
Showing posts with label প্রাণের উৎপত্তি. Show all posts
Showing posts with label প্রাণের উৎপত্তি. Show all posts
প্রথম স্বয়ম্ভূর খোঁজে
প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্বের পর....মূল প্রবন্ধ: The secret of how life on earth বেগান

১৯৬০ সালের পরে বিজ্ঞানীগণ প্রাণের উৎস অনুসন্ধানে তিনটি মতবাদে বিভক্ত হয়ে গেলেন। কারো ধারণা জীবন শুরু হয়েছিল প্রাথমিক পর্যায়ের জৈবিক কোষ গঠনের মাধ্যমে। অন্য একদল বিজ্ঞানী মনে করেন জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল রাসায়নিক বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কিন্তু আরেক দল বিজ্ঞানী বংশগতি এবং আপন কোষের প্রতিলিপি সৃষ্টির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শেষ দলের বিজ্ঞানীগণ, যে কোষটি নিজেই নিজের অনুরূপ সৃষ্টি করতে পারে তাদের স্বরূপ কেমন ছিল সেটা অন্বেষণের চেষ্টা করেন। এই বিজ্ঞানীগণ প্রথম থেকেই জোর দিয়ে প্রচার করেন জীব-কোষ আরএনএ দিয়ে তৈরি।

১৯৬০ দশকের বিজ্ঞানীগণের চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ ছিল যে আরএনএ হল সকল প্রাণের উৎস। বিশেষত আরএনএ এমনকিছু করতে পারে যেটা ডিএনএ করতে পারে না। আরএনএ হল একটা নমনীয় সুতো সদৃশ মলিকিউল। অন্যদিকে ডিএনএ হল দুইটা সুতো যারা নিজেরা পেঁচিয়ে স্তরে স্তরে বিভিন্ন আকারে সাজানো থাকে। আপনি এনজাইম ছাড়া বাঁচতে পারবেন না। আরএনএ এর ভিতরে কাগজের মত ভাজ করা একটা বস্তু দেখা গেল যেটা প্রোটিনের মত আচরণ করে। প্রোটিন দেখতে সাধারণত অনেকটা লম্বা সুতোর মত। প্রোটিন নিউক্লিওটাইড নয় বরং অ্যামাইনো এসিড দিয়ে তৈরি এবং তারা বিশদ জটিল অবয়ব সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আরএনএ হল প্রোটিন উৎপাদনের সবচেয়ে আশ্চর্য দক্ষতা। কিছু আরএনএ রাসায়নিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে অনুঘটকের কাজ করে। এই সমস্ত প্রোটিনকেই এনজাইম বলে।

আপনার মেরুদণ্ডের হাড়ের মজ্জায় বিপুল পরিমাণ এনজাইম বিদ্যমান। এনজাইম খাদ্যের জটিল মলিকিউলকে ভেঙে শর্করা বা চিনিজাতীয় সাধারণ সরল খাদ্য উপাদানে পরিণত করে যাতে প্রাণীর দেহকোষ সহজে গ্রহণ করতে পারে।

লেজলি ওরগেল এবং ফ্রান্সিস ক্রিক’র মনে হচ্ছিল যদি আরএনএ প্রোটিনের মত ভাজে ভাজে থাকে তাহলে আরএনএ এর মধ্যে জীবন্ত মলিকিউল থাকার সম্ভাবনা আছে এবং সেখানে তথ্যগুলো ডিএনএ আকারে সংরক্ষিত থাকে আর কিছু প্রোটিন রাসায়নিক বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। লেজলি ওরগেল এবং ফ্রান্সিস ক্রিক’র সন্দেহ ছিল নিছক ধারণা কিন্তু দশক ধরে সেই ধারণার কোন সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।

Thomas Cech in 2007
Thomas Cech in 2007 (Credit: Douglas A. Lockard, CC by 3.0)

টমাস রবার্ট চেক জন্মগ্রহণ করেন আমেরিকার আইওয়া শহরে এবং সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। শিশুকাল থেকেই চেক পাথর এবং খনিজ উপাদানের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ অনুভব করেন। তিনি যখন নিম্ন মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র তখনই সে স্থানীয় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের গবেষণাগারের দরজায় উঁকি দিয়ে শিক্ষকদের কাছে খনিজ উপাদানের গঠন প্রণালী দেখতে চেয়েছিলেন। টমাস রবার্ট চেক জৈব রসায়নবিদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন এবং তার আগ্রহের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল আরএনএ। এখন দেখা যাচ্ছে জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল আরএনএ দিয়ে এবং এতদিনের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর প্রায় দ্বারপ্রান্তে।

১৯৮০ সালের শুরুর দিকে টমাস রবার্ট চেক এবং তার কিছু সহকর্মী কোলারাডো বোলডার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে এককোষী প্রাণ ‘Tetrahymena thermophila’ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এককোষী প্রাণের অনুষঙ্গের সুতা সদৃশ বস্তুটি আরএনএ দিয়ে গঠিত। চেক আবিষ্কার করলেন আরএনএ’র একটা বিশেষ অংশ কখনো কখনো মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে যেন তাকে কাঁচি দিয়ে কেটে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। চেকের গবেষকদল যখন সব এনজাইমকে পৃথক করে ফেললেন তখন অন্যান্য মলিকিউল কাঁচির মত কাটাকুটির কাজ করছিল। এই কাজটি চালিয়ে নিচ্ছিল আরএনএ। তারা খুঁজে পেলেন প্রথম আরএনএ এনজাইম। আরএনএ’র ক্ষুদ্র অংশ যারা নিজেদেরকে বৃহৎ অংশ থেকে দ্বিখণ্ডিত করতে সক্ষম।

চেক তার গবেষণামূলক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করলেন ১৯৮২ সালে। পরের বছর অন্য একটি বিজ্ঞানীদল রাইবোজম নামের দ্বিতীয় আরেকটি আরএনএ এনজাইমের সন্ধান পেলেন। দুইটি আরএনএ পাওয়ার সফলতার দ্রুত ইঙ্গিত দিলো সেখানে আরও অনেক কিছুর অস্তিত্ব আছে। এই আবিষ্কারের ফলে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল জীবন সৃষ্টি হয়েছিল আরএনএ থেকে।

ম্যাসাচুচেটস প্রদেশের কেমব্রিজের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওয়াল্টার গিলবার্ট প্রথম মানুষের বংশগতি ধারণার গোড়াপত্তন করেন। পদার্থবিজ্ঞানী হলেও গিলবার্ট মলিকিউলার বায়োলজিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মানুষের জীনের ক্রমবিবর্তনের ধারা প্রমাণ করতে তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা। বিচ্ছিন্ন বস্তুকণা থেকে আরএনএ জগতে উত্তরণ হল প্রাণের বিকাশে রাজকীয় যাত্রার শুরু। ১৯৮৬ সালে ‘নেচার’ বিজ্ঞান সাময়িকীতে গিলবার্ট প্রস্তাব করেন প্রাণের উৎপত্তি হয়ে আরএনএ’র হাত ধরে।

গিলবার্ট যুক্তি দেখান বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে নিউক্লিওটাইড ঘনতরল থেকে বস্তুকণা থেকে নিজেই নিজের প্রাণ সৃষ্টির কাজকে ত্বরান্বিত করে আরএনএ মলিকিউল। আরএনএ সম্মিলিতভাবে দ্বিভাজিত হয় এবং নিজের স্বরূপ সৃষ্টি করে। আরএনএ মলিকিউল ক্রমান্বয়ে অনেক প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার জন্ম দিল। আরএনএ খুঁজে পেল প্রোটিন এবং প্রোটিন এনজাইম সৃষ্টির উপায় এবং প্রমাণিত হল তাদের গুরুত্ব এবং তারা যাত্রা শুরু করলো জীবনের পথে যে জীবন আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রাণের বিকাশ প্রথমদিকের নিউক্লিওটাইড আদিম ঘনতরল স্যুপ থেকে একাধিক জৈবরাসায়নিক অণুজীবের গঠনের উপর যুগপৎ নির্ভর করেনি বরং একটা বিশেষ অণুজীব প্রাণ সৃষ্টির সর্বকাজের কাজি। ২০০০ সালে আরএনএ তত্ত্বের সমর্থনে এক নাটকীয় প্রমাণ পাওয়া গেল।

রাইবোজম প্রোটিন সৃষ্টি করছে
রাইবোজম প্রোটিন সৃষ্টি করছে (কৃতজ্ঞতা: লেগুনা ডিজাইন/ বিজ্ঞান চিত্রশালা)

যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবরসায়নের অধ্যাপক টমাস আর্থার স্টিৎজ সুদীর্ঘ ৩০ বছর ধরে জীবন্ত কোষে অণুজীবের গঠন নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। ১৯৯০ সালে তিনি রাইবোজোমের গঠনপ্রণালী খুঁজে দেখার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলেন। প্রকৃত ঘটনা হলো প্রাণের প্রয়োজনীয় ক্রিয়াকর্ম আরএনএ নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এবং আরএনএ কেন্দ্রিক প্রাণের বিকাশ বেশি গ্রহণযোগ্য।

প্রতিটি জীবন্ত কোষে রাইবোজোম আছে। রাইবোজোম আরএনএ থেকে সংকেত গ্রহণ করতে পারে এবং আরএনএ’র অভ্যন্তরীণ সুতোর-মত জালিকা অ্যামাইনো এসিড একত্রিত করে প্রোটিন সৃষ্টি করতে পারে। প্রাণীদেহের বেশিরভাগ কোষ রাইবোজোম দ্বারা গঠিত। রাইবোজোম কোষের আরএনএ বহনকারী হিসেবে পরিচিত। ২০০০ সালে অধ্যাপক স্টিৎজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল রাইবোজোমের গঠনের বিশদ চিত্র খুঁজে পেলেন এবং আবিষ্কার করলেন রাইবোজোমের অন্তঃস্থলে অনুঘটকের কাজ করছে আরএনএ।

ভাবতেই কেমন জটিল লাগছে, তাই না? কারণ রাইবোজোম হলো জীবনের ভিত্তিমূল এবং একই সাথে প্রাচীন। যেসব বিজ্ঞানীগণ সমর্থন করতেন প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএন থেকে তাদের আনন্দের আর সীমা নাই। এই অসামান্য আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালে অধ্যাপক টমাস আর্থার স্টিৎজ রসায়নে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। কিন্তু সমস্যা ঘটে যায় অন্যত্র। এই আবিষ্কারের ফলে প্রাণ সৃষ্টির রহস্য আবার পিছনের দিকের সেই তিনটি ধারণার মধ্যে সন্দেহ ঘনীভূত হলো। আসলেই কী দিয়ে প্রাণ সৃষ্টি, কীভাবে সৃষ্টি? আরএনএ থেকে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল এই মতবাদের শুরুতেই দুইটা সমস্যা বিদ্যমান ছিল। আরএনএ কী প্রকৃতপক্ষে নিজে নিজেই প্রাণের সবধরনের ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম? পৃথিবীর প্রথম-যুগে কী প্রথমেই আরএনএ সৃষ্টি হয়েছিল?

বিজ্ঞানীগণ তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে গবেষণাগারে নিজেই নিজের সৃষ্টিকর্তা আরএনএ সৃষ্টির কাজ শুরু করলেন। ৩০ বছরের দীর্ঘ গবেষণার পরেও গিলবার্ট প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ দিয়ে এই মতবাদের সমর্থনে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারলেন না। গিলবার্ট পেলেন অণুজীব কিন্তু সেটা প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল। যদি প্রাণ সৃষ্টি হয় আরএনএ অণুজীব দিয়ে তাহলে আরএনএ অবশ্যই নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারবে। আরএনএ’কে হতে হবে স্বয়ম্ভূ।

কিন্তু আরএনএ নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে না। ডিএনএ’র দ্বারাও একাজ সম্ভব নয়। আরএনএ বা ডিএনএ যাকিছুই বলি না কেন নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে হলে তাদের দরকার বিপুল পরিমাণ এনজাইম এবং অন্যান্য অণুজীব। ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে কিছু জীববিজ্ঞানী প্রাণ বিকাশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কিছু অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের সমাধান করতে গবেষণা শুরু করেন। তাদের মতবাদের সমর্থনে তারা নেমে পড়লেন নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এমন আরএনএ’র সন্ধানে।

জ্যাক সোসটাক
জ্যাক সোসটাক (কৃতজ্ঞতাঃ ডেটলেভ ভ্যান র‍্যাভেনসায়ে/ বিজ্ঞান চিত্রশালা)

হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের জীনতত্ত্বের প্রফেসর জ্যাক ইউলিয়াম সোসটাক প্রাণের উৎস সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। শিশুকাল থেকেই তিনি রসায়নের প্রতি এত মুগ্ধ ছিলেন যে তার বাড়ির বেইজমেন্টে তার নিজস্ব একটা গবেষণাগার ছিল। তার নিজের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লেও তিনি একবার রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটান। ফলাফলে যা ঘটেছিল তা ছিল বিস্ময়কর। বিস্ফোরণের ফলে একটা গ্লাসের টিউব তীব্র-বেগে ছুটে গিয়ে ছাদের দেয়ালে গেঁথে গিয়েছিল।
১৯৮০ দশকের শুরুতে সোসটাক প্রমাণ করে দেখাতে সক্ষম হন কীভাবে জীন বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। তার এই গবেষণার ফলাফল তার জন্য নোবেল পুরষ্কার এনে দিয়েছিল। তিনি দেখান আরএনএ এনজাইম কতটা শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু তিনি অতি দ্রুতই টমাস রবার্ট চেক’র আরএনএ এনজাইমের গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। সোসটাক বলেন, “আমি মনে করেছিলাম এনজাইম নিয়ে গবেষণা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। মোটের উপর সম্ভবত আরএনএ নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে।”

১৯৮৮ সালে চেক এক বিশেষ ধরণের আরএনএ ইনজাইমের সন্ধান পেলেন যারা ক্ষুদ্র আরএনএ মলিকিউল বানাতে পারে এবং এই আরএনএ ১০ নিউক্লিওটাইডের সমান দীর্ঘ। সোসটাক গবেষণাগারে নতুন ধরণের আরএনএ ইনজাইম সৃষ্টি করে তার আবিষ্কারকে সমৃদ্ধ করতে গবেষণা শুরু করলেন। সোসটাকের গবেষকদল বিপুল পরিমাণ গবেষণার ফলাফল দৈব-চয়ন পদ্ধতিতে আবার পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন কোন ধরণের এনজাইম অনুঘটকের কাজ করে। সেই পরীক্ষাগুলো থেকে আবার পরীক্ষা করলেন। একই পদ্ধতিতে ১০ বার পরীক্ষার পর সোসটাক এমন এক আরএনএ এনজাইম সৃষ্টি করলেন যার বিক্রিয়ার অনুঘটক ক্ষমতা সাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশের তুলনায় ৭০লক্ষ গুণ বেশি গতিশীল। তারা দেখালেন আরএনএ এনজাইম প্রকৃত অর্থেই প্রভূত শক্তিশালী কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদের আরেকটি অনুরূপ সৃষ্টি করতে পারে না। এমনকি অনুরূপ সৃষ্টির ধারে কাছেও যায় না। সোসটাক যেন অসম্ভবের দেয়ালে আঘাত করলেন।

প্রথম স্বয়ম্ভূর খোঁজে
মনে হয় না আরএনএ জীবনের যাত্রাপথের সূচনা করেছিল। (কৃতজ্ঞতা: বিজ্ঞান চিত্রশালা/আলামি)

তারপরে সবচেয়ে বড় সাফল্য এলো ২০০১ সালে অধ্যাপক সোসটাক’র সাবেক শিক্ষার্থী কেমব্রিজের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির জীব বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড বারটেল’র হাত ধরে। বারটেল আর১৮ নামে আরএনএ এনজাইম সৃষ্টি করলেন যা বিদ্যমান আরএনএ জালের সাথে নতুন নিউক্লিওটাইড যোগ করতে পারে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে এই সাফল্য শুধু আরএনএ’র সাথে যথেচ্ছ নিউক্লিওটাইড সংযুক্তিই নয় বরং পূর্বের পরীক্ষার ফলাফলের যথাযথ প্রতিফলন।

এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের যা কিছু অর্জন তার কিছুই নিজেই নিজের অবিকল কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু অগ্রগতি প্রায় উদ্দেশ্যের কাছাকাছি চলে এসেছে। আর১৮ ১৮৯টি নিউক্লিওটাইড সুতোর জাল দিয়ে গঠিত এবং এটা নির্ভরযোগ্য-ভাবে আরও ১১টি নিউক্লিওটাইড আগের আরএনএ সুতোর জালের সাথে যুক্ত করতে পারে যা নিজের দৈর্ঘ্যের প্রায় ৬ শতাংশ। নতুন গবেষণা আশা জাগালো জালের কিছু সুতোর প্রান্ত ১৮৯টি নিউক্লিওটাইডের সমান দীর্ঘ। তবে এটা নিশ্চিত হওয়া গেল প্রাণের সৃষ্টি আরএনএ থেকে সূত্রপাত হয়নি।

২০১১ সালে কেমব্রিজের মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগে গবেষণাগারে সবচেয়ে সফল পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন ফিলিপ হোলিগার। তার গবেষকদল আর১৮ আরএনএ’র উন্নতি সাধন করেন তার নাম দিলেন টিসি১৯জেড। এই নতুন আরএনএ যেটা নিজেদের ফলাফলের নিউক্লিওটাইড ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিলিপি করতে পারে। তাদের ৪৮ শতাংশ নিজেদের দৈর্ঘ্য যা আর১৮ আরএনএ থেকেও বড় কিন্তু ১০০ শতাংশ সেখানে অত্যাবশ্যকীয় নয়। ক্যালিফোর্নিয়াতে লা জোলা’তে অবস্থিত ‘স্ক্রিপস রিসার্চ ইন্সটিটিউটে’ বিকল্প আর একটা গবেষণা তখন চলছিল জেরাল্ড ফ্রান্সিস জয়েস এবং ট্রেসি লিংকন’র নেতৃত্বে। ২০০৯ সালে তারা আর একধরণের এনজাইমের সন্ধান পেলেন যারা নিজেদের অগোচরেই নিজেদেরকে অবিকল প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। নতুন সৃষ্ট এনজাইম দুইটা ক্ষুদ্র আরএনএ’র সাথে যুক্ত হয়ে দ্বিতীয় আরেকটা এনজাইমের জন্ম দেয়। এই এনজাইম আর দুইটা আরএনএ’র সাথে যুক্ত হয়ে আবার নতুন এনজাইম সৃষ্টি করে। প্রয়োজনীয় উপাদান এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এনজাইম সৃষ্টির এই সরল চক্র অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতেই থাকে। কিন্তু এনজাইম শুধু তখনই সফলভাবে কাজ করতে পারে যখন তাদেরকে সঠিক আরএনএ সূত্র দেয়া হয়। ঠিক এই পরীক্ষাটাই জেরাল্ড ফ্রান্সিস জয়েস এবং ট্রেসি লিংকন গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করেন।

অনেক বিজ্ঞানী প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে এমন তত্ত্বে সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন কারণ আরএনএ নিজেই নিজের আর একটা অবিকল প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে না এবং এটাই এই তত্ত্বের প্রধান দুর্বলতা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আরএনএ থেকে জীবনের সূচনা হয়নি। সম্ভবত নবগঠিত পৃথিবীতে অন্যকোন ধরণের জৈব-কণার উপস্থিতি ছিল সেখান থেকেই প্রাণের সৃষ্টি। প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে যখন রসায়নবিজ্ঞানগণ পারস্পারিক সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন কোন বস্তু থেকে আরএনএ উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়। ডিএনএ’র তুলনায় অণুজীবকে মনে হল অনেক সাধারণ কিন্তু আরএনএ সৃষ্টি করা ভীষণ কঠিন এবং শ্রমসাধ্য কাজ। সমস্যা দেখা দিলো কোষের শর্করা উৎপাদন করতে গিয়ে এবং যার উপর ভিত্তি করে নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি হয় সেখানে বিস্তর ঝামেলা। কোষের এই দুইটা অপরিহার্য উপাদান আলাদা আলাদা উৎপাদন করা সম্ভব কিন্তু এই দুইটা উপাদানের মাঝে কোনভাবেই সংযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই সমস্যা ১৯৯০ দশকের শুরুতেই পরিষ্কার জানা গিয়েছিল সুতরাং অনেক বিজ্ঞানীই নাকসিটকিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে এই তত্ত্ব শুধুই নিরেট ধারণা মাত্র, বাস্তবের সাথে লেশমাত্র সম্পর্ক নাই। তত্ত্বটা মোটেও সঠিক নয়।

সম্ভবত নবগঠিত পৃথিবীতে অন্যকোন ধরণের জৈব-কণার উপস্থিতি ছিল যারা আরএনএ থেকে সরল এবং যারা পৃথিবীর আদিম জৈব-কণা ভর্তি ঘন তরল থেকে নিজেদেরকে সংগঠিত করতে পারে এবং নিজেদের অবিকল প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে শুরু করে এবং আরএনএ, ডিএনএ এবং অন্যান্য উপাদান সৃষ্টির দিকে ধাবিত করে।

[ সম্ভবত ডিএনএ পৃথিবীতে প্রাণের সূচনা করতে প্রথম সংগ্রাম শুরু করে। (কৃতজ্ঞতা: বিজ্ঞান চিত্রশালা/ আলামি) ]
[ সম্ভবত ডিএনএ পৃথিবীতে প্রাণের সূচনা করতে প্রথম সংগ্রাম শুরু করে। (কৃতজ্ঞতা: বিজ্ঞান চিত্রশালা/ আলামি) ]

ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পিটার নিলসেন ১৯৯১ সালে দাবী করলেন জীবনের সূচনা সেই আদিম পুকুরের ঘন তরল থেকে। যেখানে অণুজীব নিজের প্রতিলিপি নিজেই সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এটা ছিল বিস্তর বিবর্তিত ডিএনএ। পিটার নিলসেন পূর্বের বিজ্ঞানীদের গবেষণার উপর ভিত্তি করেই এগিয়ে গেলেন নতুন উদ্যমে এবং স্থির থাকলেন ডিএনএ’র মধ্যে প্রাপ্ত এ, টি, সি এবং জি এনজাইমে। নিলসেন অণুজীব গবেষণার মূল ভিত্তি গড়ে দিলেন এবং ডিএনএ’র ভিতরে শর্করার পরিবর্তে পলিএমাইডস অ্যামাইনো এসিডের সন্ধান পেলেন। তিনি নতুন প্রাপ্ত অণুজীবের নাম দিলেন পলিএমাইডস নিউক্লিক এসিড সংক্ষেপে পিএনএ। যদিও বিভ্রান্তিকরভাবে আমরা এখনো পিএনএ’কে জানি পেপটাইড নিউক্লিক এসিড নামে। আরএনএ’র পিএনএ গঠন এত দুঃসাধ্য নয়, সম্ভবত পৃথিবীর আদিম অবস্থায় পিএনএ গঠিত হয়েছিল।

পিএনএ প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, একে সৃষ্টি করতে হয় এবং আচরণ অনেকাংশে ডিএনএ’র মত। পিএনএ’র সুতার মতো একটা প্রান্ত ডিএনএ’র একটা প্রান্ত দখল করে নিতে পারে। অণুজীবের এই মিলে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তদুপরি পিএনএ, ডিএনএ’র মত দুইটা প্রান্ত পেঁচিয়ে মইয়ের আকার ধারণ করতে পারে। স্ট্যানলি মিলার এখানেই আমাদেরকে মুগ্ধ করে এবং প্রাণ সৃষ্টির রহস্য জগতে কৌতূহলী করে তোলে। তিনি প্রাণের বিকাশ হয়ে আরএনএ থেকে এই তত্ত্বের ঘোরতর অবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন প্রথম প্রাণের উপাদান সৃষ্টিতে পিএনএ বরং অনেক বেশী বিশ্বাসযোগ্য এবং যুক্তিপূর্ণ দাবীদার।

২০০০ সালে স্ট্যানলি মিলার আরও শক্তিশালী প্রমাণ উপস্থাপন করলেন। ইতিমধ্যে তিনি ৭০ বছরের অভিজ্ঞতায় পৌঁছে গেছেন। কিন্তু বিধি বাম, সেই সময়ে তিনি পরপর কয়েকটি ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন ফলে তাকে গবেষণা ছেড়ে নার্সিং হোমে চলে যেতে হয়। তার কাজ আর সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। মিলার তার সেই ক্লাসিকাল ‘স্ট্যানলি মিলার-হ্যারল্ড উরে পরীক্ষা’ পুনরায় করে দেখেন যে পরীক্ষার কথা আমরা ইতিমধ্যেই প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। এবারের পরীক্ষায় মিলার মিথেন, নাইট্রোজেন, অ্যামোনিয়া, পানির সাথে পিএনএ যুক্ত করে দিলেন।

A molecule of threose nucleic acid (TNA)
A molecule of threose nucleic acid (TNA) (Credit: Alfred Pasieka/Science Photo Library)

অন্যান্য রসায়নবিদগণ প্রাণ গবেষণায় এগিয়ে এলেন তাদের নিজস্ব বিকল্প নিউক্লিক এসিড এবং তাদের তত্ত্ব ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান নিয়ে। প্রতিটি বিকল্প নিউক্লিক এসিড ব্যবহারের পিছনে ভিন্ন ভিন্ন সমর্থক বিজ্ঞানীদলের বিশেষ করে যারা এই এসিডের উদ্ভাবন করেছেন তাদের পৃথক যুক্তি আছে। ২০০০ সালে আলবার্ট ইসেনমসার কৃত্রিম জেনেটিক পলিমার ‘থ্রেওস নিউক্লিক এসিড’ উদ্ভাবন করেন। থ্রেওস নিউক্লিক এসিড বা টিএনএ মূলত ডিএনএ কিন্তু এর রাইবোজোমে ভিন্ন ধরণের শর্করা আছে। টিএনএ রাইবোজোমের সুতোর প্রান্ত দুইটা দ্বিমুখী কুণ্ডলী বানাতে পারে এবং আরএনএ এবং টিএনএ’র মাঝে পূর্বাপর তথ্যের অবিকল প্রতিলিপি আদান প্রদান করতে পারে। এছাড়াও টিএনএ জটিলতর ভাজে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারে এবং প্রোটিন সংরক্ষণ করতে পারে। এথেকেই বোঝা যায় টিএনএ আরএনএ’র মতই এনজাইমের কাজ করতে পারে। একইভাবে ২০০৫ সালে এরিক মেগারস গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে গ্লাইকল নিউক্লিক এসিড উৎপাদন করলেন যেগুলো প্যাঁচানো কাঠামো তৈরি করতে পারে। এতক্ষণ যতগুলো নিউক্লিক এসিড নিয়ে আলোচনা হয়েছে তাদের কোনটিই প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, সৃষ্টি হয়েছে গবেষণাগারে। সুতরাং যদি প্রথম প্রাণ এইসব নিউক্লিক এসিডের মধ্য থেকে কোন একটিকে ব্যবহার করে থাকে তাহলে বলতেই হবে এতদিনের চলমান বিতর্ক চলে যাবে আরএনএ এবং ডিএনএ’র পক্ষে অর্থাৎ প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল আরএনএ এবং ডিএনএ দিয়ে। এই মতবাদ হয়ত সত্য, কিন্তু বিজ্ঞানীদের হাতে এই দাবীর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই।

আর এইসব কিছুর অর্থ দাঁড়ালো, ২০০০ শতকের মাঝামাঝি উপনীত হয়ে আরএনএ মতবাদের বিজ্ঞানীগণ প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। আরএনএ মতবাদের বিজ্ঞানীগণের চিন্তা, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ খুব যৌক্তিক এবং গোছানো পরিপাটি কিন্তু প্রাণের উৎস সম্পর্কে পুরোপুরি সত্যের কাছে পৌঁছাতে পারেননি।

A molecule of threose nucleic acid (TNA)
A molecule of threose nucleic acid (TNA) (Credit: Alfred Pasieka/Science Photo Library)

অন্যদিকে আরএনএ এনজাইম প্রকৃতিতেই বিদ্যমান ছিল এবং সুসংবাদ হলো সেই এনজাইমে জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক উপাদান রাইবোজোমের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু এমন কোন আরএনএ’র সন্ধান পাওয়া গেল না যে নিজেই নিজের অনুরূপ প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এবং কোন বিজ্ঞানীই প্রমাণ করতে পারলেন না যে আদিম ঘন তরল স্যুপ থেকে কীভাবে আরএনএ সৃষ্টি হয়েছিল। বিকল্প নিউক্লিক এসিড হয়ত পরবর্তী প্রশ্নের সমাধান দিতে সক্ষম কিন্তু হতাশার খবর এই যে, প্রাণের এইসব প্রাথমিক উপাদানগুলো প্রকৃতিতে আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল তার কোন নির্ভুল প্রমাণ বিজ্ঞানীগণের হাতে নেই। ঠিক সেই সময়ে ১৯৮০ দশক থেকে আরএনএ মদবাদের বিরোধী আর একটি মতবাদ ধীরেধীরে তাদের যুক্তির স্বপক্ষে প্রমাণ যোগার করতে ব্যস্ত ছিল। নতুন মতবাদে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীগণ যুক্তি দেখাতে লাগলেন জীবন আরএনএ বা ডিএনএ বা অন্যকোন বংশগতির বস্তু থেকেও নয় বরং জীবন সৃষ্টি হয়েছিল শক্তির যান্ত্রিক কৌশল ত্বরান্বিত করে। কারণ জীবনকে বেঁচে থাকতে হলে দরকার শক্তি।

Life needs energy to stay alive (Credit: Equinox Graphics Ltd)
Life needs energy to stay alive (Credit: Equinox Graphics Ltd)

পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি পর্ব-৩

প্রথম স্বয়ম্ভূর খোঁজে
প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্বের পর....মূল প্রবন্ধ: The secret of how life on earth বেগান

১৯৬০ সালের পরে বিজ্ঞানীগণ প্রাণের উৎস অনুসন্ধানে তিনটি মতবাদে বিভক্ত হয়ে গেলেন। কারো ধারণা জীবন শুরু হয়েছিল প্রাথমিক পর্যায়ের জৈবিক কোষ গঠনের মাধ্যমে। অন্য একদল বিজ্ঞানী মনে করেন জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল রাসায়নিক বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কিন্তু আরেক দল বিজ্ঞানী বংশগতি এবং আপন কোষের প্রতিলিপি সৃষ্টির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শেষ দলের বিজ্ঞানীগণ, যে কোষটি নিজেই নিজের অনুরূপ সৃষ্টি করতে পারে তাদের স্বরূপ কেমন ছিল সেটা অন্বেষণের চেষ্টা করেন। এই বিজ্ঞানীগণ প্রথম থেকেই জোর দিয়ে প্রচার করেন জীব-কোষ আরএনএ দিয়ে তৈরি।

১৯৬০ দশকের বিজ্ঞানীগণের চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ ছিল যে আরএনএ হল সকল প্রাণের উৎস। বিশেষত আরএনএ এমনকিছু করতে পারে যেটা ডিএনএ করতে পারে না। আরএনএ হল একটা নমনীয় সুতো সদৃশ মলিকিউল। অন্যদিকে ডিএনএ হল দুইটা সুতো যারা নিজেরা পেঁচিয়ে স্তরে স্তরে বিভিন্ন আকারে সাজানো থাকে। আপনি এনজাইম ছাড়া বাঁচতে পারবেন না। আরএনএ এর ভিতরে কাগজের মত ভাজ করা একটা বস্তু দেখা গেল যেটা প্রোটিনের মত আচরণ করে। প্রোটিন দেখতে সাধারণত অনেকটা লম্বা সুতোর মত। প্রোটিন নিউক্লিওটাইড নয় বরং অ্যামাইনো এসিড দিয়ে তৈরি এবং তারা বিশদ জটিল অবয়ব সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আরএনএ হল প্রোটিন উৎপাদনের সবচেয়ে আশ্চর্য দক্ষতা। কিছু আরএনএ রাসায়নিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে অনুঘটকের কাজ করে। এই সমস্ত প্রোটিনকেই এনজাইম বলে।

আপনার মেরুদণ্ডের হাড়ের মজ্জায় বিপুল পরিমাণ এনজাইম বিদ্যমান। এনজাইম খাদ্যের জটিল মলিকিউলকে ভেঙে শর্করা বা চিনিজাতীয় সাধারণ সরল খাদ্য উপাদানে পরিণত করে যাতে প্রাণীর দেহকোষ সহজে গ্রহণ করতে পারে।

লেজলি ওরগেল এবং ফ্রান্সিস ক্রিক’র মনে হচ্ছিল যদি আরএনএ প্রোটিনের মত ভাজে ভাজে থাকে তাহলে আরএনএ এর মধ্যে জীবন্ত মলিকিউল থাকার সম্ভাবনা আছে এবং সেখানে তথ্যগুলো ডিএনএ আকারে সংরক্ষিত থাকে আর কিছু প্রোটিন রাসায়নিক বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। লেজলি ওরগেল এবং ফ্রান্সিস ক্রিক’র সন্দেহ ছিল নিছক ধারণা কিন্তু দশক ধরে সেই ধারণার কোন সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।

Thomas Cech in 2007
Thomas Cech in 2007 (Credit: Douglas A. Lockard, CC by 3.0)

টমাস রবার্ট চেক জন্মগ্রহণ করেন আমেরিকার আইওয়া শহরে এবং সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। শিশুকাল থেকেই চেক পাথর এবং খনিজ উপাদানের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ অনুভব করেন। তিনি যখন নিম্ন মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র তখনই সে স্থানীয় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের গবেষণাগারের দরজায় উঁকি দিয়ে শিক্ষকদের কাছে খনিজ উপাদানের গঠন প্রণালী দেখতে চেয়েছিলেন। টমাস রবার্ট চেক জৈব রসায়নবিদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন এবং তার আগ্রহের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল আরএনএ। এখন দেখা যাচ্ছে জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল আরএনএ দিয়ে এবং এতদিনের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর প্রায় দ্বারপ্রান্তে।

১৯৮০ সালের শুরুর দিকে টমাস রবার্ট চেক এবং তার কিছু সহকর্মী কোলারাডো বোলডার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে এককোষী প্রাণ ‘Tetrahymena thermophila’ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এককোষী প্রাণের অনুষঙ্গের সুতা সদৃশ বস্তুটি আরএনএ দিয়ে গঠিত। চেক আবিষ্কার করলেন আরএনএ’র একটা বিশেষ অংশ কখনো কখনো মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে যেন তাকে কাঁচি দিয়ে কেটে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। চেকের গবেষকদল যখন সব এনজাইমকে পৃথক করে ফেললেন তখন অন্যান্য মলিকিউল কাঁচির মত কাটাকুটির কাজ করছিল। এই কাজটি চালিয়ে নিচ্ছিল আরএনএ। তারা খুঁজে পেলেন প্রথম আরএনএ এনজাইম। আরএনএ’র ক্ষুদ্র অংশ যারা নিজেদেরকে বৃহৎ অংশ থেকে দ্বিখণ্ডিত করতে সক্ষম।

চেক তার গবেষণামূলক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করলেন ১৯৮২ সালে। পরের বছর অন্য একটি বিজ্ঞানীদল রাইবোজম নামের দ্বিতীয় আরেকটি আরএনএ এনজাইমের সন্ধান পেলেন। দুইটি আরএনএ পাওয়ার সফলতার দ্রুত ইঙ্গিত দিলো সেখানে আরও অনেক কিছুর অস্তিত্ব আছে। এই আবিষ্কারের ফলে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল জীবন সৃষ্টি হয়েছিল আরএনএ থেকে।

ম্যাসাচুচেটস প্রদেশের কেমব্রিজের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওয়াল্টার গিলবার্ট প্রথম মানুষের বংশগতি ধারণার গোড়াপত্তন করেন। পদার্থবিজ্ঞানী হলেও গিলবার্ট মলিকিউলার বায়োলজিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মানুষের জীনের ক্রমবিবর্তনের ধারা প্রমাণ করতে তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা। বিচ্ছিন্ন বস্তুকণা থেকে আরএনএ জগতে উত্তরণ হল প্রাণের বিকাশে রাজকীয় যাত্রার শুরু। ১৯৮৬ সালে ‘নেচার’ বিজ্ঞান সাময়িকীতে গিলবার্ট প্রস্তাব করেন প্রাণের উৎপত্তি হয়ে আরএনএ’র হাত ধরে।

গিলবার্ট যুক্তি দেখান বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে নিউক্লিওটাইড ঘনতরল থেকে বস্তুকণা থেকে নিজেই নিজের প্রাণ সৃষ্টির কাজকে ত্বরান্বিত করে আরএনএ মলিকিউল। আরএনএ সম্মিলিতভাবে দ্বিভাজিত হয় এবং নিজের স্বরূপ সৃষ্টি করে। আরএনএ মলিকিউল ক্রমান্বয়ে অনেক প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার জন্ম দিল। আরএনএ খুঁজে পেল প্রোটিন এবং প্রোটিন এনজাইম সৃষ্টির উপায় এবং প্রমাণিত হল তাদের গুরুত্ব এবং তারা যাত্রা শুরু করলো জীবনের পথে যে জীবন আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রাণের বিকাশ প্রথমদিকের নিউক্লিওটাইড আদিম ঘনতরল স্যুপ থেকে একাধিক জৈবরাসায়নিক অণুজীবের গঠনের উপর যুগপৎ নির্ভর করেনি বরং একটা বিশেষ অণুজীব প্রাণ সৃষ্টির সর্বকাজের কাজি। ২০০০ সালে আরএনএ তত্ত্বের সমর্থনে এক নাটকীয় প্রমাণ পাওয়া গেল।

রাইবোজম প্রোটিন সৃষ্টি করছে
রাইবোজম প্রোটিন সৃষ্টি করছে (কৃতজ্ঞতা: লেগুনা ডিজাইন/ বিজ্ঞান চিত্রশালা)

যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবরসায়নের অধ্যাপক টমাস আর্থার স্টিৎজ সুদীর্ঘ ৩০ বছর ধরে জীবন্ত কোষে অণুজীবের গঠন নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। ১৯৯০ সালে তিনি রাইবোজোমের গঠনপ্রণালী খুঁজে দেখার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলেন। প্রকৃত ঘটনা হলো প্রাণের প্রয়োজনীয় ক্রিয়াকর্ম আরএনএ নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এবং আরএনএ কেন্দ্রিক প্রাণের বিকাশ বেশি গ্রহণযোগ্য।

প্রতিটি জীবন্ত কোষে রাইবোজোম আছে। রাইবোজোম আরএনএ থেকে সংকেত গ্রহণ করতে পারে এবং আরএনএ’র অভ্যন্তরীণ সুতোর-মত জালিকা অ্যামাইনো এসিড একত্রিত করে প্রোটিন সৃষ্টি করতে পারে। প্রাণীদেহের বেশিরভাগ কোষ রাইবোজোম দ্বারা গঠিত। রাইবোজোম কোষের আরএনএ বহনকারী হিসেবে পরিচিত। ২০০০ সালে অধ্যাপক স্টিৎজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল রাইবোজোমের গঠনের বিশদ চিত্র খুঁজে পেলেন এবং আবিষ্কার করলেন রাইবোজোমের অন্তঃস্থলে অনুঘটকের কাজ করছে আরএনএ।

ভাবতেই কেমন জটিল লাগছে, তাই না? কারণ রাইবোজোম হলো জীবনের ভিত্তিমূল এবং একই সাথে প্রাচীন। যেসব বিজ্ঞানীগণ সমর্থন করতেন প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএন থেকে তাদের আনন্দের আর সীমা নাই। এই অসামান্য আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালে অধ্যাপক টমাস আর্থার স্টিৎজ রসায়নে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। কিন্তু সমস্যা ঘটে যায় অন্যত্র। এই আবিষ্কারের ফলে প্রাণ সৃষ্টির রহস্য আবার পিছনের দিকের সেই তিনটি ধারণার মধ্যে সন্দেহ ঘনীভূত হলো। আসলেই কী দিয়ে প্রাণ সৃষ্টি, কীভাবে সৃষ্টি? আরএনএ থেকে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল এই মতবাদের শুরুতেই দুইটা সমস্যা বিদ্যমান ছিল। আরএনএ কী প্রকৃতপক্ষে নিজে নিজেই প্রাণের সবধরনের ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম? পৃথিবীর প্রথম-যুগে কী প্রথমেই আরএনএ সৃষ্টি হয়েছিল?

বিজ্ঞানীগণ তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে গবেষণাগারে নিজেই নিজের সৃষ্টিকর্তা আরএনএ সৃষ্টির কাজ শুরু করলেন। ৩০ বছরের দীর্ঘ গবেষণার পরেও গিলবার্ট প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ দিয়ে এই মতবাদের সমর্থনে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারলেন না। গিলবার্ট পেলেন অণুজীব কিন্তু সেটা প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল। যদি প্রাণ সৃষ্টি হয় আরএনএ অণুজীব দিয়ে তাহলে আরএনএ অবশ্যই নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারবে। আরএনএ’কে হতে হবে স্বয়ম্ভূ।

কিন্তু আরএনএ নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে না। ডিএনএ’র দ্বারাও একাজ সম্ভব নয়। আরএনএ বা ডিএনএ যাকিছুই বলি না কেন নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে হলে তাদের দরকার বিপুল পরিমাণ এনজাইম এবং অন্যান্য অণুজীব। ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে কিছু জীববিজ্ঞানী প্রাণ বিকাশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কিছু অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের সমাধান করতে গবেষণা শুরু করেন। তাদের মতবাদের সমর্থনে তারা নেমে পড়লেন নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এমন আরএনএ’র সন্ধানে।

জ্যাক সোসটাক
জ্যাক সোসটাক (কৃতজ্ঞতাঃ ডেটলেভ ভ্যান র‍্যাভেনসায়ে/ বিজ্ঞান চিত্রশালা)

হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের জীনতত্ত্বের প্রফেসর জ্যাক ইউলিয়াম সোসটাক প্রাণের উৎস সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। শিশুকাল থেকেই তিনি রসায়নের প্রতি এত মুগ্ধ ছিলেন যে তার বাড়ির বেইজমেন্টে তার নিজস্ব একটা গবেষণাগার ছিল। তার নিজের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লেও তিনি একবার রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটান। ফলাফলে যা ঘটেছিল তা ছিল বিস্ময়কর। বিস্ফোরণের ফলে একটা গ্লাসের টিউব তীব্র-বেগে ছুটে গিয়ে ছাদের দেয়ালে গেঁথে গিয়েছিল।
১৯৮০ দশকের শুরুতে সোসটাক প্রমাণ করে দেখাতে সক্ষম হন কীভাবে জীন বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। তার এই গবেষণার ফলাফল তার জন্য নোবেল পুরষ্কার এনে দিয়েছিল। তিনি দেখান আরএনএ এনজাইম কতটা শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু তিনি অতি দ্রুতই টমাস রবার্ট চেক’র আরএনএ এনজাইমের গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। সোসটাক বলেন, “আমি মনে করেছিলাম এনজাইম নিয়ে গবেষণা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। মোটের উপর সম্ভবত আরএনএ নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে।”

১৯৮৮ সালে চেক এক বিশেষ ধরণের আরএনএ ইনজাইমের সন্ধান পেলেন যারা ক্ষুদ্র আরএনএ মলিকিউল বানাতে পারে এবং এই আরএনএ ১০ নিউক্লিওটাইডের সমান দীর্ঘ। সোসটাক গবেষণাগারে নতুন ধরণের আরএনএ ইনজাইম সৃষ্টি করে তার আবিষ্কারকে সমৃদ্ধ করতে গবেষণা শুরু করলেন। সোসটাকের গবেষকদল বিপুল পরিমাণ গবেষণার ফলাফল দৈব-চয়ন পদ্ধতিতে আবার পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন কোন ধরণের এনজাইম অনুঘটকের কাজ করে। সেই পরীক্ষাগুলো থেকে আবার পরীক্ষা করলেন। একই পদ্ধতিতে ১০ বার পরীক্ষার পর সোসটাক এমন এক আরএনএ এনজাইম সৃষ্টি করলেন যার বিক্রিয়ার অনুঘটক ক্ষমতা সাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশের তুলনায় ৭০লক্ষ গুণ বেশি গতিশীল। তারা দেখালেন আরএনএ এনজাইম প্রকৃত অর্থেই প্রভূত শক্তিশালী কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদের আরেকটি অনুরূপ সৃষ্টি করতে পারে না। এমনকি অনুরূপ সৃষ্টির ধারে কাছেও যায় না। সোসটাক যেন অসম্ভবের দেয়ালে আঘাত করলেন।

প্রথম স্বয়ম্ভূর খোঁজে
মনে হয় না আরএনএ জীবনের যাত্রাপথের সূচনা করেছিল। (কৃতজ্ঞতা: বিজ্ঞান চিত্রশালা/আলামি)

তারপরে সবচেয়ে বড় সাফল্য এলো ২০০১ সালে অধ্যাপক সোসটাক’র সাবেক শিক্ষার্থী কেমব্রিজের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির জীব বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড বারটেল’র হাত ধরে। বারটেল আর১৮ নামে আরএনএ এনজাইম সৃষ্টি করলেন যা বিদ্যমান আরএনএ জালের সাথে নতুন নিউক্লিওটাইড যোগ করতে পারে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে এই সাফল্য শুধু আরএনএ’র সাথে যথেচ্ছ নিউক্লিওটাইড সংযুক্তিই নয় বরং পূর্বের পরীক্ষার ফলাফলের যথাযথ প্রতিফলন।

এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের যা কিছু অর্জন তার কিছুই নিজেই নিজের অবিকল কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু অগ্রগতি প্রায় উদ্দেশ্যের কাছাকাছি চলে এসেছে। আর১৮ ১৮৯টি নিউক্লিওটাইড সুতোর জাল দিয়ে গঠিত এবং এটা নির্ভরযোগ্য-ভাবে আরও ১১টি নিউক্লিওটাইড আগের আরএনএ সুতোর জালের সাথে যুক্ত করতে পারে যা নিজের দৈর্ঘ্যের প্রায় ৬ শতাংশ। নতুন গবেষণা আশা জাগালো জালের কিছু সুতোর প্রান্ত ১৮৯টি নিউক্লিওটাইডের সমান দীর্ঘ। তবে এটা নিশ্চিত হওয়া গেল প্রাণের সৃষ্টি আরএনএ থেকে সূত্রপাত হয়নি।

২০১১ সালে কেমব্রিজের মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগে গবেষণাগারে সবচেয়ে সফল পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন ফিলিপ হোলিগার। তার গবেষকদল আর১৮ আরএনএ’র উন্নতি সাধন করেন তার নাম দিলেন টিসি১৯জেড। এই নতুন আরএনএ যেটা নিজেদের ফলাফলের নিউক্লিওটাইড ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিলিপি করতে পারে। তাদের ৪৮ শতাংশ নিজেদের দৈর্ঘ্য যা আর১৮ আরএনএ থেকেও বড় কিন্তু ১০০ শতাংশ সেখানে অত্যাবশ্যকীয় নয়। ক্যালিফোর্নিয়াতে লা জোলা’তে অবস্থিত ‘স্ক্রিপস রিসার্চ ইন্সটিটিউটে’ বিকল্প আর একটা গবেষণা তখন চলছিল জেরাল্ড ফ্রান্সিস জয়েস এবং ট্রেসি লিংকন’র নেতৃত্বে। ২০০৯ সালে তারা আর একধরণের এনজাইমের সন্ধান পেলেন যারা নিজেদের অগোচরেই নিজেদেরকে অবিকল প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। নতুন সৃষ্ট এনজাইম দুইটা ক্ষুদ্র আরএনএ’র সাথে যুক্ত হয়ে দ্বিতীয় আরেকটা এনজাইমের জন্ম দেয়। এই এনজাইম আর দুইটা আরএনএ’র সাথে যুক্ত হয়ে আবার নতুন এনজাইম সৃষ্টি করে। প্রয়োজনীয় উপাদান এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এনজাইম সৃষ্টির এই সরল চক্র অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতেই থাকে। কিন্তু এনজাইম শুধু তখনই সফলভাবে কাজ করতে পারে যখন তাদেরকে সঠিক আরএনএ সূত্র দেয়া হয়। ঠিক এই পরীক্ষাটাই জেরাল্ড ফ্রান্সিস জয়েস এবং ট্রেসি লিংকন গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করেন।

অনেক বিজ্ঞানী প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে এমন তত্ত্বে সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন কারণ আরএনএ নিজেই নিজের আর একটা অবিকল প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে না এবং এটাই এই তত্ত্বের প্রধান দুর্বলতা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আরএনএ থেকে জীবনের সূচনা হয়নি। সম্ভবত নবগঠিত পৃথিবীতে অন্যকোন ধরণের জৈব-কণার উপস্থিতি ছিল সেখান থেকেই প্রাণের সৃষ্টি। প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে যখন রসায়নবিজ্ঞানগণ পারস্পারিক সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন কোন বস্তু থেকে আরএনএ উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়। ডিএনএ’র তুলনায় অণুজীবকে মনে হল অনেক সাধারণ কিন্তু আরএনএ সৃষ্টি করা ভীষণ কঠিন এবং শ্রমসাধ্য কাজ। সমস্যা দেখা দিলো কোষের শর্করা উৎপাদন করতে গিয়ে এবং যার উপর ভিত্তি করে নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি হয় সেখানে বিস্তর ঝামেলা। কোষের এই দুইটা অপরিহার্য উপাদান আলাদা আলাদা উৎপাদন করা সম্ভব কিন্তু এই দুইটা উপাদানের মাঝে কোনভাবেই সংযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই সমস্যা ১৯৯০ দশকের শুরুতেই পরিষ্কার জানা গিয়েছিল সুতরাং অনেক বিজ্ঞানীই নাকসিটকিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে এই তত্ত্ব শুধুই নিরেট ধারণা মাত্র, বাস্তবের সাথে লেশমাত্র সম্পর্ক নাই। তত্ত্বটা মোটেও সঠিক নয়।

সম্ভবত নবগঠিত পৃথিবীতে অন্যকোন ধরণের জৈব-কণার উপস্থিতি ছিল যারা আরএনএ থেকে সরল এবং যারা পৃথিবীর আদিম জৈব-কণা ভর্তি ঘন তরল থেকে নিজেদেরকে সংগঠিত করতে পারে এবং নিজেদের অবিকল প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে শুরু করে এবং আরএনএ, ডিএনএ এবং অন্যান্য উপাদান সৃষ্টির দিকে ধাবিত করে।

[ সম্ভবত ডিএনএ পৃথিবীতে প্রাণের সূচনা করতে প্রথম সংগ্রাম শুরু করে। (কৃতজ্ঞতা: বিজ্ঞান চিত্রশালা/ আলামি) ]
[ সম্ভবত ডিএনএ পৃথিবীতে প্রাণের সূচনা করতে প্রথম সংগ্রাম শুরু করে। (কৃতজ্ঞতা: বিজ্ঞান চিত্রশালা/ আলামি) ]

ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পিটার নিলসেন ১৯৯১ সালে দাবী করলেন জীবনের সূচনা সেই আদিম পুকুরের ঘন তরল থেকে। যেখানে অণুজীব নিজের প্রতিলিপি নিজেই সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এটা ছিল বিস্তর বিবর্তিত ডিএনএ। পিটার নিলসেন পূর্বের বিজ্ঞানীদের গবেষণার উপর ভিত্তি করেই এগিয়ে গেলেন নতুন উদ্যমে এবং স্থির থাকলেন ডিএনএ’র মধ্যে প্রাপ্ত এ, টি, সি এবং জি এনজাইমে। নিলসেন অণুজীব গবেষণার মূল ভিত্তি গড়ে দিলেন এবং ডিএনএ’র ভিতরে শর্করার পরিবর্তে পলিএমাইডস অ্যামাইনো এসিডের সন্ধান পেলেন। তিনি নতুন প্রাপ্ত অণুজীবের নাম দিলেন পলিএমাইডস নিউক্লিক এসিড সংক্ষেপে পিএনএ। যদিও বিভ্রান্তিকরভাবে আমরা এখনো পিএনএ’কে জানি পেপটাইড নিউক্লিক এসিড নামে। আরএনএ’র পিএনএ গঠন এত দুঃসাধ্য নয়, সম্ভবত পৃথিবীর আদিম অবস্থায় পিএনএ গঠিত হয়েছিল।

পিএনএ প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, একে সৃষ্টি করতে হয় এবং আচরণ অনেকাংশে ডিএনএ’র মত। পিএনএ’র সুতার মতো একটা প্রান্ত ডিএনএ’র একটা প্রান্ত দখল করে নিতে পারে। অণুজীবের এই মিলে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তদুপরি পিএনএ, ডিএনএ’র মত দুইটা প্রান্ত পেঁচিয়ে মইয়ের আকার ধারণ করতে পারে। স্ট্যানলি মিলার এখানেই আমাদেরকে মুগ্ধ করে এবং প্রাণ সৃষ্টির রহস্য জগতে কৌতূহলী করে তোলে। তিনি প্রাণের বিকাশ হয়ে আরএনএ থেকে এই তত্ত্বের ঘোরতর অবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন প্রথম প্রাণের উপাদান সৃষ্টিতে পিএনএ বরং অনেক বেশী বিশ্বাসযোগ্য এবং যুক্তিপূর্ণ দাবীদার।

২০০০ সালে স্ট্যানলি মিলার আরও শক্তিশালী প্রমাণ উপস্থাপন করলেন। ইতিমধ্যে তিনি ৭০ বছরের অভিজ্ঞতায় পৌঁছে গেছেন। কিন্তু বিধি বাম, সেই সময়ে তিনি পরপর কয়েকটি ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন ফলে তাকে গবেষণা ছেড়ে নার্সিং হোমে চলে যেতে হয়। তার কাজ আর সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। মিলার তার সেই ক্লাসিকাল ‘স্ট্যানলি মিলার-হ্যারল্ড উরে পরীক্ষা’ পুনরায় করে দেখেন যে পরীক্ষার কথা আমরা ইতিমধ্যেই প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। এবারের পরীক্ষায় মিলার মিথেন, নাইট্রোজেন, অ্যামোনিয়া, পানির সাথে পিএনএ যুক্ত করে দিলেন।

A molecule of threose nucleic acid (TNA)
A molecule of threose nucleic acid (TNA) (Credit: Alfred Pasieka/Science Photo Library)

অন্যান্য রসায়নবিদগণ প্রাণ গবেষণায় এগিয়ে এলেন তাদের নিজস্ব বিকল্প নিউক্লিক এসিড এবং তাদের তত্ত্ব ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান নিয়ে। প্রতিটি বিকল্প নিউক্লিক এসিড ব্যবহারের পিছনে ভিন্ন ভিন্ন সমর্থক বিজ্ঞানীদলের বিশেষ করে যারা এই এসিডের উদ্ভাবন করেছেন তাদের পৃথক যুক্তি আছে। ২০০০ সালে আলবার্ট ইসেনমসার কৃত্রিম জেনেটিক পলিমার ‘থ্রেওস নিউক্লিক এসিড’ উদ্ভাবন করেন। থ্রেওস নিউক্লিক এসিড বা টিএনএ মূলত ডিএনএ কিন্তু এর রাইবোজোমে ভিন্ন ধরণের শর্করা আছে। টিএনএ রাইবোজোমের সুতোর প্রান্ত দুইটা দ্বিমুখী কুণ্ডলী বানাতে পারে এবং আরএনএ এবং টিএনএ’র মাঝে পূর্বাপর তথ্যের অবিকল প্রতিলিপি আদান প্রদান করতে পারে। এছাড়াও টিএনএ জটিলতর ভাজে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারে এবং প্রোটিন সংরক্ষণ করতে পারে। এথেকেই বোঝা যায় টিএনএ আরএনএ’র মতই এনজাইমের কাজ করতে পারে। একইভাবে ২০০৫ সালে এরিক মেগারস গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে গ্লাইকল নিউক্লিক এসিড উৎপাদন করলেন যেগুলো প্যাঁচানো কাঠামো তৈরি করতে পারে। এতক্ষণ যতগুলো নিউক্লিক এসিড নিয়ে আলোচনা হয়েছে তাদের কোনটিই প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, সৃষ্টি হয়েছে গবেষণাগারে। সুতরাং যদি প্রথম প্রাণ এইসব নিউক্লিক এসিডের মধ্য থেকে কোন একটিকে ব্যবহার করে থাকে তাহলে বলতেই হবে এতদিনের চলমান বিতর্ক চলে যাবে আরএনএ এবং ডিএনএ’র পক্ষে অর্থাৎ প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল আরএনএ এবং ডিএনএ দিয়ে। এই মতবাদ হয়ত সত্য, কিন্তু বিজ্ঞানীদের হাতে এই দাবীর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই।

আর এইসব কিছুর অর্থ দাঁড়ালো, ২০০০ শতকের মাঝামাঝি উপনীত হয়ে আরএনএ মতবাদের বিজ্ঞানীগণ প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। আরএনএ মতবাদের বিজ্ঞানীগণের চিন্তা, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ খুব যৌক্তিক এবং গোছানো পরিপাটি কিন্তু প্রাণের উৎস সম্পর্কে পুরোপুরি সত্যের কাছে পৌঁছাতে পারেননি।

A molecule of threose nucleic acid (TNA)
A molecule of threose nucleic acid (TNA) (Credit: Alfred Pasieka/Science Photo Library)

অন্যদিকে আরএনএ এনজাইম প্রকৃতিতেই বিদ্যমান ছিল এবং সুসংবাদ হলো সেই এনজাইমে জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক উপাদান রাইবোজোমের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু এমন কোন আরএনএ’র সন্ধান পাওয়া গেল না যে নিজেই নিজের অনুরূপ প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এবং কোন বিজ্ঞানীই প্রমাণ করতে পারলেন না যে আদিম ঘন তরল স্যুপ থেকে কীভাবে আরএনএ সৃষ্টি হয়েছিল। বিকল্প নিউক্লিক এসিড হয়ত পরবর্তী প্রশ্নের সমাধান দিতে সক্ষম কিন্তু হতাশার খবর এই যে, প্রাণের এইসব প্রাথমিক উপাদানগুলো প্রকৃতিতে আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল তার কোন নির্ভুল প্রমাণ বিজ্ঞানীগণের হাতে নেই। ঠিক সেই সময়ে ১৯৮০ দশক থেকে আরএনএ মদবাদের বিরোধী আর একটি মতবাদ ধীরেধীরে তাদের যুক্তির স্বপক্ষে প্রমাণ যোগার করতে ব্যস্ত ছিল। নতুন মতবাদে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীগণ যুক্তি দেখাতে লাগলেন জীবন আরএনএ বা ডিএনএ বা অন্যকোন বংশগতির বস্তু থেকেও নয় বরং জীবন সৃষ্টি হয়েছিল শক্তির যান্ত্রিক কৌশল ত্বরান্বিত করে। কারণ জীবনকে বেঁচে থাকতে হলে দরকার শক্তি।

Life needs energy to stay alive (Credit: Equinox Graphics Ltd)
Life needs energy to stay alive (Credit: Equinox Graphics Ltd)

Posted at August 10, 2019 |  by Arya ঋষি

২০০০ সালের প্রথমদিকে জীবনের প্রথম পথ চলা কীভাবে শুরু হয় এই গবেষণার প্রধান দুইটা তত্ত্ব প্রচলিত ছিল। আরএনএ ঘরানার বিজ্ঞানীগণ মনে করতেন প্রাণের বিকাশ হয়েছিল নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এমন অণুজীব থেকে। ইতিমধ্যে যেসব বিজ্ঞানীগণ “বিপাক ক্রিয়া” প্রথম শুরু হয়েছিল বলে মনে করতেন তারা গভীর সমুদ্রের আগ্নেয়গিরির গরম তরল প্রবাহের জ্বালামুখে কীভাবে প্রাণের বিকাশ হয়েছিল তার বিশদ বিবরণ হাজির করলেন। যাইহোক চলমান এই বিতর্কের মধ্যেই আমাদের সামনে উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে প্রাণের উৎস গবেষণার তৃতীয় আর একটা মতবাদ।

আমরা জানি পৃথিবীতে জীবিত সব প্রাণই কোষ দ্বারা গঠিত। প্রতিটি কোষই মূলত নরম তুলতুলে ছিদ্রযুক্ত গোলাকার সদৃশ বস্তু যার চারিধার অমসৃণ পর্দার আবরণে ঘেরা। কোষের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল কোষ জীবনের সব প্রয়োজনীয় উপাদান একত্রে ধরে রাখে। যদি কোষের দেয়াল কোন কারণে জীর্ণ হয়ে ধ্বসে যায় তাহলে কোষের মূল উপাদান বেরিয়ে পড়ে এবং কোষের মৃত্যু ঘটে। ঠিক যেমন যদি কোন মানুষের উদর থেকে নাড়ীভুঁড়ি কেটে ফেলে দিই তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সে আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না।

পৃথিবীর আদিতে প্রচণ্ড তাপ আর ঘূর্ণিপাকে কিছু রাসায়নিক উপাদান একত্রিত হয়ে অবিকশিত কোষ গঠিত হয়। কোষের বাইরের পর্দার আবরণ এতই প্রয়োজনীয় যে প্রাণের উৎস সন্ধানী কিছু গবেষক যুক্তি দেখালেন যে, কোষ সৃষ্টির আগেই কোষের আবরণ সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করতেন ‘যেভাবে জীবনের শুরু’ বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ের আলোচিত “জীনতত্ত্ব প্রথম” এবং চতুর্থ অধ্যায়ের “বিপাক ক্রিয়া প্রথম” ধারণাগুলো বিভ্রান্তিকর। তাদের বিকল্প মতবাদটি ছিল “কোষের কাঠামো পৃথকীকরণ প্রথম” ঘটেছিল। এই মতবাদের পুরোধা ব্যক্তি হলেন ইটালির রোমে অবস্থিত রোমা ট্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিয়ের লুইগি লুইজি।

লুইজির মতবাদের স্বপক্ষে কারণ যথেষ্ট সহজ সরল হলেও ব্যাখ্যা করার জন্য এত সহজ ছিল না। কীভাবে আপনি প্রমাণ করবেন “বিপাক ক্রিয়া” বা “স্বয়ম্ভূ আরএনএ” মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব যদি একটা বিশেষ স্থানে প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো যায়। অন্যথায় অণুজীব থেকে প্রাণ সঞ্চার হবে কোথায়?

যদি আপনি উপরের যুক্তি স্বীকার করে নেন তাহলে প্রাণ সৃষ্টির একটাই উপায় আছে সেটা হল, যেকোনভাবে আদি পৃথিবীর উত্তপ্ত ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যেও প্রাণ সৃষ্টির কিছু কাঁচামাল একত্রিত হয়ে অবিকশিত কোষ বা প্রাথমিক কোষের জন্ম নেয়া। প্রতিকূলতা পেরিয়ে গবেষণাগারে এই তত্ত্ব প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। বিজ্ঞানীগণ গবেষণাগারেই একটা সরল এককোষী জীবন্ত কোষ বানানো সম্ভব করেছেন।

কোষের জন্ম
All living things are made up of cells (Credit: Cultura Creative RF/Alamy)

লুইজি যেন তার সব চিন্তার সাথে যোগসূত্র স্থাপনে ফিরে গেলেন অ্যালেক্সান্ডার ওপারিনের কাছে এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রাণের সৃষ্টি রহস্য গবেষণার ঊষালগ্নে। অ্যালেক্সান্ডার ওপারিনের গবেষণার বিষয় ইতিমধ্যে প্রথম অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। ওপারিন গুরুত্বের সাথে দেখালেন কোয়াসারভেট থেকে উৎসারিত কিছু উষ্ণ রাসায়নিক তরলের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে যার কেন্দ্রে আছে কিছু অবিকশিত কোষের মত বস্তু। তিনি দাবী করেন কোয়াসারভেটগুলোই আসলে কোষের প্রথম নমুনা।

সঠিক উপাদান থাকার পরেও গবেষণাগারে কোষের প্রাথমিক নমুনা সৃষ্টি খুব কঠিন কাজ। যেকোনো চর্বিযুক্ত বা তৈলাক্ত বস্তু আছে এমন পানিতে ব্লব বা ফিল্ম সৃষ্টি হয় আর এইসব রাসায়নিক উপাদান একসাথে লিপিড নামে পরিচিত। আলোচনার এই পর্যায়ে বিজ্ঞানীগণ ধারণা পোষণ করতে থাকেন লিপিড থেকেই জীবনের প্রথম সূচনা। আমরা প্রাণের সৃষ্টি গবেষণায় বিজ্ঞানের এই মতবাদকে ‘লিপিড ঘরানা’ বলতে পারি।

কিন্তু শুধুই রাসায়নিক উষ্ণ ঘন তরলের ধারা সৃষ্টি করলেই সব সমাধা হয়ে গেল এমন নয় বিষয়টা। বিগত কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন বস্তু ব্যবহার করেও লুইজি এমনকিছু বানাতে পারলেন না যা দিয়ে তিনি বিজ্ঞানীদের সম্মতি অর্জনের জন্য জীবন-সদৃশ কিছু উপস্থাপন করা যায়। এখানে উল্লেখ্য উষ্ণ রাসায়নিক পানির প্রবাহের স্থিতিশীলতা থাকতে হবে এবং সেই প্রবাহ থেকে বিভাজিত হয়ে আর একটা ধারা সৃষ্টি করার সক্ষমতা থাকতে হবে। সেই ধারার মধ্যে কী কী উপাদান পরিবাহিত হচ্ছে তার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। এতকিছু করতে হবে কিন্তু আধুনিক একটা কোষের পরিণত প্রোটিন ব্যবহার না করেই।

কোষের জন্ম
Somehow cells formed (Credit: Christian Jegou/Publiphoto Diffusion/Science Photo Library)

এরপরে ১৯৯৪ সালে লুইজি এক সাহসী প্রস্তাবনা রাখলেন। তিনি বলেন প্রাথমিক পর্যায়ের কোষে অবশ্যই আরএনএ থাকতে হবে। তিনি আরও দাবী করেন এই আরএনএ অবশ্যই নিজের আর একটা প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে সম্ভব। লুইজির প্রস্তাবনা বিজ্ঞানের নতুন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিলো। তার মানে হল, প্রাণ বিকাশের প্রথম প্রস্তাবনায় আমরা আসলে প্রাণের সৃষ্টি রহস্য গবেষণার বিভিন্ন তত্ত্বের মিলন মেলায় মিলিত হয়েছি এবং দীর্ঘ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছি। লুইজির প্রস্তাবিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি আমলে নিলে, প্রাণ বিকাশের প্রথম প্রস্তাবনা কম্পার্টমেন্টালাইজেশন তত্ত্ব বা কোষের বিভাজন তত্ত্বকে বাতিল করে দিতে হয়। কিন্তু লুইজির কাছেও উপযুক্ত কারণ ছিল।

ভিতরে জীন বিহীন চারপাশে আবৃত কোষ খুব বেশী কিছু করতে পারে না। হয়ত কোষ বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ সৃষ্টি করতে পারে কিন্তু তারা নিজের বংশগতির কোন তথ্য, উপাত্ত পরবর্তী কোষের মাঝে সঞ্চার করতে পারবে না। কোষ কেবল তখনি বিবর্তিত হতে শুরু করবে এবং ক্রমাগত জটিলতর হয়ে উঠতে পারবে যদি কোষের অভ্যন্তরে জীন থাকে।

এই তত্ত্ব খুব দ্রুত জ্যাক সোসটাকের সমর্থকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। আমরা ইতিমধ্যে তৃতীয় অধ্যায়ে সোসটাকের আরএনএ নিয়ে গবেষণা আলোচনা তুলে ধরেছি। যখন লুইজি ছিলেন কম্পার্টমেন্টালাইজেশন তত্ত্বের প্রথম দিকের সমর্থক ঠিক তখন সোসটাক সমর্থন করতেন জীনতত্ত্বকে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন কোন মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত ছিল না। আমরা প্রাণের সৃষ্টি রহস্য গবেষণার বিভিন্ন তত্ত্বের মিলন মেলায় মিলিত হয়েছি এবং দীর্ঘ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছি এবং সোসটাকের গবেষণার সূত্র ধরে নির্ধারণ করছে চাচ্ছি কোনটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ। মোটের উপর আমরা বুঝতে পারলাম দুই গবেষণাতেই কোষের উপস্থিতি আছে। আমরা একটা সম্মতিতে এলাম যে প্রাণের উৎস সন্ধানে কম্পার্টমেন্টালাইজেশন বা বিভাজন তত্ত্ব এবং জীনতত্ত্ব উভয় গবেষণাতেই কোষ খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।

কোষের জন্ম
Almost all life is single-celled (Credit: Science Photo Library/Alamy)

সোসটাকের তত্ত্ব প্রাণের উৎস গবেষণার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী এবং সোসটাক অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন তার গবেষণা তত্ত্বে অর্থ বিনিয়োগ করবেন যেখানে তার আগ্রহ। কারণ হিসেবে বললেন, “এমন একটা তত্ত্বের সমর্থনে তত্ত্বকে গবেষণার বাইরে রাখতে পারি না।” তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন প্রাথমিক কোষ দিয়ে গবেষণা শুরু করবেন।

দুই বছর পরে সোসটাক এবং তার দুইজন সহকর্মী ২০০১ সালে বড় ধরণের সাফল্যের সুসংবাদ দিলেন। বিজ্ঞান বিষয়ক বিখ্যাত ‘নেচার’ জার্নালে তারা যুক্তি দেখিয়ে লিখলেন প্রকৃতিতে প্রাপ্ত আপাত বিচ্ছিন্ন উপাদান থেকে সহজেই প্রাথমিক কোষ সৃষ্টি করা সম্ভব। চর্বিযুক্ত তেলতেলে বস্তুর সংস্পর্শে আরএনএ নিজের নিজের প্রতিলিপি জন্ম দিতে পারে।

কোষের জন্ম
Vesicles are simple containers made of lipids (Credit: Alfred Pasieka/Science Photo Library)

সোসটাক এবং তার গবেষক-দল কোষের ভেসিকল (কোষের তরল পূর্ণধারক) নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ভেসিকল দেখতে অনেকটা সর্পিল ঘন তরলের আকার যার গভীরে এবং বাইরের আবরণে দুইটা ফ্যাটি এসিডের স্তর আছে। ভেসিকলের উৎপাদন ত্বরান্বিত করার উপায় খুঁজতে গিয়ে সোসটাকের গবেষক-দল এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদার মত দেখতে থকথকে একটা বস্তুকে বিক্রিয়ার কাজে লাগিয়ে দিলেন এবং মনে করলেন এই নিরীক্ষা প্রাণ গবেষণার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে। এই যৌগের মিশ্রণ গবেষণা কাজে যোগ করার পরেই ভেসিকলের উৎপাদন ১০০ গুণ ত্বরান্বিত হয়ে গেল। কাদার মত বস্তুর পৃষ্ঠতল ভেসিকল উৎপাদনে অনুঘটকের কাজ করে যে কাজটা সচারচার এনজাইম করে থাকে।

তদুপরি, ভেসিকল এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদার কণা এবং কাদার পৃষ্ঠতল থেকে আরএনএ গ্রহণ করতে পারে। প্রথমদিকের এইসব কোষ এখন বহন করছে জীন এবং অনুঘটক আর এতকিছু ঘটে যাচ্ছে একটা সরল কাঠামোর মধ্যে। তবে প্রাণ গবেষণার এই পর্যায়ে এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদা প্রয়োগের সিদ্ধান্ত কিন্তু হঠাৎ করে নেয়া হয়নি। বিগত কয়েক দশক ধরে চলমান গবেষণার পরম্পরা গবেষকদলকে এই সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এবং তারা অনুমান করেছিলেন প্রাণ সৃষ্টিতে এই যৌগ হয়ত খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কোষের জন্ম
This lump of clay is mostly montmorillonite (Credit: Susan E. Degginger/Alamy)

এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ খুব সহজলভ্য। এখনকার সময়ে আমাদের ব্যবহার্য নিত্যদিনের জিনিসপত্রে এটা হরহামেশা ব্যবহৃত হয় এমনকি বিড়ালের বিছানা বানাতেও এটার ব্যবহার দেখা যায়। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় নির্গত ছাইয়ের ধুলো পৃথিবীর আবহাওয়াতে মিশে এই যৌগ সৃষ্টি হয়। যেহেতু পৃথিবীর শৈশবে অনেক আগ্নেয়গিরি ছিল সেহেতু এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ ছিল পরিমাণে বিপুল।

ফিরে যাই ১৯৮৬ সালে, তখন আমেরিকান রসায়নবিদ জেমস ফেরিস দেখালেন এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ আসলে অণুঘটক যা জৈব-কণা সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আরও পরে তিনি আবিষ্কার করেন এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ আরএনএ সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখে। এই দুইটি কাজের উপর ভিত্তি করে জেমস ফেরিস ধারণা করেন গড়পড়তা দেখতে কাদার মত এই যৌগটি আসলে প্রাণ সৃষ্টির উপাদান। জ্যাক সোসটাক ফেরিসের ধারণাকে গ্রহণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন এবং এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ ব্যবহার করে প্রথম কোষ সৃষ্টি করলেন। সোসটাক যুক্তি দেখালেন, আদি-কোষ যদি বেড়ে উঠতে পারে তাহলে সেটা বিভাজিতও হতে পারে। এক বছর পরে সোসটাকের গবেষক-দল প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, প্রথমদিকের কোষ নিজেদের মত করেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেড়ে উঠতে পারে। এমনকি আদি-কোষে আরএনএ সংরক্ষিত থাকে এবং সময়ের হাত ধরে কোষের দেয়ালের বাইরের পাশ অতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। মনে হয় যেন আদি-কোষ একটা ফুলে ওঠা পাকস্থলী এবং যেকোনো সময় সশব্দে ফেটে পড়বে। ফেটে পড়া রোধ করতে গিয়ে কোষ অধিকমাত্রায় ফ্যাটি এসিড গ্রহণ করে এবং তাদের সমন্বয়ে নিজের দেয়ালকে আরও মজবুত করে তোলে ফলে কোষ ফুলে আকারে আর একটু বড় হয় এবং ফেটে পড়ার আশংকা দূর হয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল আদি-কোষ যে কোষের আরএনএ কম তার থেকে ফ্যাটি এসিড গ্রহণ করছে ফলে সেই কোষগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ছে। তার মানে এ থেকে বোঝা যায় আদি-কোষ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল এবং যে কোষের আরএনএ বেশী স্বাভাবিকভাবে সে কোষ জিতে যায়। এই অনুসিদ্ধান্ত আমাদের মনে আরও বিস্ময় জাগায়। যদি আদি-কোষ বেড়ে ওঠতে পারে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের অনুরূপ কোষ সৃষ্টি করতে পারে তবে কি সোসটাকের গবেষণালব্ধ প্রাথমিক কোষ নিজের প্রতিলিপি বানাতে পারবে?

কোষের জন্ম
Cells reproduce by dividing into two (Credit: Science Photo Library/Alamy)


সোসটাকের প্রথম পরীক্ষায় দেখানো হয়েছে কীভাবে আদি-কোষ বিভাজিত হয়। আদি-কোষকে দুমড়ে মুচড়ে যদি ছোট ছিদ্র পথের সুড়ঙ্গে ঢুকিয়ে দেয়া যায় তাহলে সেখান থেকে আদি-কোষ ভেঙে ছড়িয়ে পড়বে। আদি-কোষ বেড়ে ওঠে, তাদের আকার পরিবর্তিত হয়, আয়তনে প্রসারিত হয় এবং তাদের শরীরে রশির মত লম্বা পাতলা প্রান্ত দেখা যায়।

এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া একেবারে নির্ভেজাল কারণ এখানে কোষের কোন যান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম জড়িত নাই। এখানে শুধু চাপ প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু এটা কোন সমাধান নয় কারণ নিজেই নিজের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় আদি-কোষ তার নিজস্ব কিছু উপাদান হারায়। এছাড়াও আদি-কোষ তখনই বিভাজিত হতে পারে যখন ছোট ছিদ্রপথে বল প্রয়োগে প্রবেশ করানো হয়।

ভেসিকলকে বিভাজিত করার বিভিন্ন উপায় আছে যেমন কোষকে পানির প্রবল স্রোত যুক্ত করতে পারলে কোষে নতুন শক্তির সৃষ্টি হয়। আদি-কোষের অভ্যন্তরীণ উপাদান বের হতে না দিয়ে কোষকে বিভাজন করার জন্য এই কৌশল অবলম্বন করা হয়।

অবশেষে ২০০৯ সালে জ্যাক সোসটাক এবং তার সহযোগী ছাত্র টিং ঝু একটা সমাধান বের করতে সক্ষম হন। তারা সামান্য একটু জটিল আদি-কোষ সৃষ্টি করলেন যার চতুর্দিকে একাধিক দেয়াল যেন অনেকটা পেয়াজের মত। সরল আদি-কোষের গঠনে জটিলতা থাকলেও সহজেই তাদেরকে সৃষ্টি করা সম্ভব। টিং ঝু যখন আদি-কোষের সাথে আরও বেশী ফ্যাটি এসিড যোগ করলেন তখন আদি-কোষের আকার পরিবর্তিত হয়ে গেল, সুতার মত দেখতে প্রান্তগুলো আরও লম্বা হয়ে গেল। আদি-কোষের আকার যথেষ্ট বড় হয়ে গেলে অল্প চাপে আদি-কোষ ভেঙে বেশকিছু ছোট ছোট আদি-কোষে রূপান্তরিত হল। পিতৃ-কোষের কোন আরএনএ কিন্তু হারিয়ে গেল না বরং প্রতিটি ক্ষুদ্র আদি-কোষ তার পিতৃ-কোষের আরএনএ বহন করতে লাগল। তাছাড়া, আদি-কোষ নতুন কোষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া পৌনঃপুনিক ভাবে চালিয়ে যেতে পারে। নতুন আদি-কোষ পরিপূর্ণ হয়ে গেলে নিজেই আবার নতুন কোষে বিভাজিত হতে শুরু করে।

পরবর্তী পরীক্ষায় ঝু এবং সোসটাক আদি-কোষ ভেঙে নতুন কোষ জন্ম দেয়ার ভিন্ন ভিন্ন উপায় খুঁজে বের করতে পেরেছিলেন। গবেষণার এই পর্যায়ে মনে হচ্ছিল অবশেষে সমস্যার বুঝি সমাধান পাওয়া গেল।

যাইহোক আদি-কোষ কিন্তু তখন যথেষ্ট কার্যকরী ছিল না। লুইজি ভেবেছিলেন, আদি-কোষ আরএনএ প্রতিলিপি সৃষ্টির ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করবে কিন্তু যতদূর বোঝা যায় আদি-কোষে আরএনএ শুধু অলস বসে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ করে না।

সত্যিকার অর্থেই যদি আদি-কোষ থেকে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের বিকাশ প্রমাণ করতে হয় তাহলে সোসটাকের দেখাতে হবে আরএনএ কীভাবে কোষের অভ্যন্তরে নিজেই নিজের প্রতিলিপি জন্ম দেয়। কিন্তু এই তথ্যকে তত্ত্ব হিসেবে প্রমাণ করে দেখানো এত সহজ নয় কারণ দশকব্যাপী পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর পরেও কোন বিজ্ঞানী আরএনএ উৎপাদন করে দেখাতে পারেন নি যা নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে। ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা বিশদ আলোচনা করে ফেলেছি। এই সমস্যার কারণেই প্রাণ বিকাশে আরএনএ তত্ত্ব ঘরানার গবেষণার কাজ প্রথমদিকে ব্যাহত হচ্ছিল এবং তখন পর্যন্ত কেউ এই সমস্যার সমাধান বের করতে পারেনি। সুতরাং সোসটাক লেসলি ওরগেলের গবেষণার ফলাফল ও লিখিত কাগজ পুনরায় পড়তে শুরু করেন। আমরা জানি লেসলি ওরগেল দীর্ঘদিন আরএনএ তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। পুরনো ধুলো পড়া কাগজের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল প্রাণের উৎস গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র।

কোষের জন্ম
So The first cells had to host the chemistry of life (Credit: Science Photo Library/Alamy)

ওরগেল ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আরএনএ’র সুতোর মত প্রান্তগুলো কীভাবে নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করে সেই গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ওরগেলের গবেষণার সারাংশ ছিল খুবই সহজ সরল এবং সাধারণ। আরএনএ’র সুতোর মত একপ্রান্ত থেকে আলগা নিউক্লিওটাইড তুলে নেয়া হল এবং তখন নিউক্লিওটাইড জড়ো করে আরএনএ’র প্রথম সুতোর মত অবিকল আর একটা প্রান্ত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ, ধরি আরএনএ’র একটা সুতোর মত প্রান্তে CGC লিখিত আছে এবং সেখানেই উৎপাদিত হয়েছে অনুরূপ আরেকটা সুতোর মত প্রান্ত যেটা পড়তে GCG এর মত মনে হয়। সম্ভবত কেউ যদি এই প্রক্রিয়া দুইবার করে তবে প্রকৃত CGC পাওয়া যাবে।

ওরগেল বুঝতে পারলেন যে, কোন অনুকূল পরিবেশে আরএনএ’র সুতোর মত প্রান্ত একই প্রক্রিয়ায় এনজাইমের সাহায্য ছাড়াই আরএনএ’র প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে। সম্ভবত এভাবেই প্রথম প্রাণ আরএনএ থেকে জীন সংগ্রহ করত। ১৯৮৭ সালে ওরগেল আবিষ্কার করলেন, আরএনএ’র ১৪ লম্বা নিউক্লিওটাইড সুতোর প্রান্ত অনুরূপ ১৪ নিউক্লিওটাইড লম্বা প্রান্ত সৃষ্টি করতে সক্ষম। তিনি এর থেকে বেশী লম্বা আরএনএ’র প্রান্ত বানাতে পারেন নি কিন্তু সোসটাকের চিন্তার সলতেই আগুন উস্কে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। সোসটাকের ছাত্রী ক্যাটারজিনা অ্যাডামালা আদি-কোষ সৃষ্টির জন্য পুনরায় প্রবৃত্ত হলেন। তারা যে আদি-কোষ সৃষ্টি করলেন সেগুলো আগের কোষের গায়ের বাইরের সংলগ্ন মলিকিউল থেকে জীন বহন করে।

তারা বুঝতে পারলেন, এই বিক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য ম্যাগনেসিয়াম প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা এখানেই যে, ম্যাগনেসিয়ামের উপস্থিতি আদি-কোষকে ধ্বংস করে। সব সমস্যারই সমাধান আছে এবং এই সমস্যার সমাধানে ব্যবহার করা হল সাইট্রিক এসিড। লেবু, কমলা জাতীয় ফলে প্রচুর সাইট্রিক এসিড পাওয়া যায় এবং প্রতিটি জীবন্ত কোষে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সাইট্রিক এসিডের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটা গবেষণায় গবেষক-দল উল্লেখ করেন তারা বিক্রিয়ার সময় সাইট্রেট যুক্ত করে দেন ফলে বিক্রিয়াতে অংশগ্রহণ থেকে ম্যাগনেসিয়ামকে বিরত রাখা সম্ভব হয়। এতে আদি-কোষ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং কোষের প্রতিলিপি সৃষ্টির প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে চলতে থাকে। সরলভাবে বলতে গেলে গবেষক-দল ১৯৯৪ সালে ইটালিয়ান বিজ্ঞানী পিয়ের লুইগি লুইজির প্রস্তাবিত তত্ত্বকে বাস্তবায়ন করলেন। জ্যাক সোসটাক বলেন, “আমরা কোষের ফ্যাটি এসিডে ভেসিকলের অভ্যন্তরে আরএনএ’র অবিকল প্রতিলিপি সৃষ্টির রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু করলাম।”

কোষের জন্ম
Szostak’s protocells can survive extreme heat (Credit: Jon Sullivan, PDPhoto.org)

মাত্র এক দশকের বেশী কিছু সময়ের গবেষণায় জ্যাক সোসটাকের গবেষক-দল প্রাণের উৎস সন্ধানে যুগান্তকারী অর্জন সম্পন্ন করে ফেললেন। তারা আদি-কোষ বানাতে সক্ষম হলেন যারা পূর্বের কোষের জীন বহন করে এবং কোষের বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় মলিকিউল সংগ্রহ করতে পারে। এই আদি-কোষ নিজেরাই নিজেদের বৃদ্ধি এবং বিভাজন করতে পারে এমনকি নিজেদের মাঝে প্রতিযোগিতা পর্যন্ত করতে পারে। আর কোষের অভ্যন্তরে চলতে থাকে আরএনএ’র অবিকল প্রতিলিপি সৃষ্টির অবিরাম কর্মযজ্ঞ। যেকোনো বিচারেই এই প্রক্রিয়া নতুন জীবন সৃষ্টির সূচনা বলা যেতে পারে।

এতকিছু স্বত্বেও সোসটাকের গবেষণার ফলাফল প্রায় ৪০ বছর ধরে চলমান প্রাণের উৎস গবেষণার বিপরীতে চলে গেল। কোষের নিজেই নিজেকে জন্ম দিয়েছিল প্রথমে এই মতবাদকে প্রাধান্য না দিয়ে অথবা কোষের বিভাজন প্রক্রিয়াকে অধিক গুরুত্ব না দিয়ে সোসটাক এই দুই মতবাদের সমন্বয় সাধন করে বলতে চেয়েছিলেন এই দুই প্রক্রিয়া সমান-তালে একসাথে চলছিল। কিন্তু সোসটাকের গবেষক-দল যেকোনো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে প্রস্তুত। ২০০৮ সালে সোসটাকের গবেষক-দল বুঝতে জানতে পারলেন, আদি-কোষ প্রায় ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও দিব্যি টিকে থাকতে পারে অথচ এই পরিমাণ উচ্চ তাপমাত্রায় বর্তমান সময়ের পরিণত বেশীরভাগ কোষেরই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা। ফলে সোসটাকের ধারণা আরও জোরালো হয় যে আদি-কোষের সাথে প্রথম প্রাণের যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। এর থেকে আরও প্রমাণিত হয় অবিরাম চলতে থাকা উল্কা পতনের প্রভাবে সৃষ্ট গরমেও আদি-কোষ বহাল তবিয়তে টিকে ছিল।

জার্মানির ওসনাব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শিক্ষক আরমেন মালকিদজানিয়ান সোসটাকের গবেষণাকে অতুলনীয় হিসেবে অভিহিত করেন। সোসটাকে তত্ত্বাবধানে ইতিপূর্বে বর্ণিত দুই মতবাদের সমন্বয় করার প্রচেষ্টা প্রাণের উৎস গবেষণায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয় যার কারণে শুরু হয় প্রাণ কীভাবে কাজ করে তার আলোচনা। এই “সবকিছু প্রথমে” ধারণা ইতিমধ্যে জোগাড় করে ফেলেছে তথ্য প্রমাণের আকরিক সম্পদ এবং প্রাণের উৎস গবেষণার চলমান বিতর্কের সম্ভাব্য সমাধান।

কোষের জন্ম
The molecules of life behave in incredibly complex ways (Credit: Equinox Graphics Ltd)

কোষের জন্ম

২০০০ সালের প্রথমদিকে জীবনের প্রথম পথ চলা কীভাবে শুরু হয় এই গবেষণার প্রধান দুইটা তত্ত্ব প্রচলিত ছিল। আরএনএ ঘরানার বিজ্ঞানীগণ মনে করতেন প্রাণের বিকাশ হয়েছিল নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এমন অণুজীব থেকে। ইতিমধ্যে যেসব বিজ্ঞানীগণ “বিপাক ক্রিয়া” প্রথম শুরু হয়েছিল বলে মনে করতেন তারা গভীর সমুদ্রের আগ্নেয়গিরির গরম তরল প্রবাহের জ্বালামুখে কীভাবে প্রাণের বিকাশ হয়েছিল তার বিশদ বিবরণ হাজির করলেন। যাইহোক চলমান এই বিতর্কের মধ্যেই আমাদের সামনে উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে প্রাণের উৎস গবেষণার তৃতীয় আর একটা মতবাদ।

আমরা জানি পৃথিবীতে জীবিত সব প্রাণই কোষ দ্বারা গঠিত। প্রতিটি কোষই মূলত নরম তুলতুলে ছিদ্রযুক্ত গোলাকার সদৃশ বস্তু যার চারিধার অমসৃণ পর্দার আবরণে ঘেরা। কোষের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল কোষ জীবনের সব প্রয়োজনীয় উপাদান একত্রে ধরে রাখে। যদি কোষের দেয়াল কোন কারণে জীর্ণ হয়ে ধ্বসে যায় তাহলে কোষের মূল উপাদান বেরিয়ে পড়ে এবং কোষের মৃত্যু ঘটে। ঠিক যেমন যদি কোন মানুষের উদর থেকে নাড়ীভুঁড়ি কেটে ফেলে দিই তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সে আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না।

পৃথিবীর আদিতে প্রচণ্ড তাপ আর ঘূর্ণিপাকে কিছু রাসায়নিক উপাদান একত্রিত হয়ে অবিকশিত কোষ গঠিত হয়। কোষের বাইরের পর্দার আবরণ এতই প্রয়োজনীয় যে প্রাণের উৎস সন্ধানী কিছু গবেষক যুক্তি দেখালেন যে, কোষ সৃষ্টির আগেই কোষের আবরণ সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করতেন ‘যেভাবে জীবনের শুরু’ বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ের আলোচিত “জীনতত্ত্ব প্রথম” এবং চতুর্থ অধ্যায়ের “বিপাক ক্রিয়া প্রথম” ধারণাগুলো বিভ্রান্তিকর। তাদের বিকল্প মতবাদটি ছিল “কোষের কাঠামো পৃথকীকরণ প্রথম” ঘটেছিল। এই মতবাদের পুরোধা ব্যক্তি হলেন ইটালির রোমে অবস্থিত রোমা ট্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিয়ের লুইগি লুইজি।

লুইজির মতবাদের স্বপক্ষে কারণ যথেষ্ট সহজ সরল হলেও ব্যাখ্যা করার জন্য এত সহজ ছিল না। কীভাবে আপনি প্রমাণ করবেন “বিপাক ক্রিয়া” বা “স্বয়ম্ভূ আরএনএ” মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব যদি একটা বিশেষ স্থানে প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো যায়। অন্যথায় অণুজীব থেকে প্রাণ সঞ্চার হবে কোথায়?

যদি আপনি উপরের যুক্তি স্বীকার করে নেন তাহলে প্রাণ সৃষ্টির একটাই উপায় আছে সেটা হল, যেকোনভাবে আদি পৃথিবীর উত্তপ্ত ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যেও প্রাণ সৃষ্টির কিছু কাঁচামাল একত্রিত হয়ে অবিকশিত কোষ বা প্রাথমিক কোষের জন্ম নেয়া। প্রতিকূলতা পেরিয়ে গবেষণাগারে এই তত্ত্ব প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। বিজ্ঞানীগণ গবেষণাগারেই একটা সরল এককোষী জীবন্ত কোষ বানানো সম্ভব করেছেন।

কোষের জন্ম
All living things are made up of cells (Credit: Cultura Creative RF/Alamy)

লুইজি যেন তার সব চিন্তার সাথে যোগসূত্র স্থাপনে ফিরে গেলেন অ্যালেক্সান্ডার ওপারিনের কাছে এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রাণের সৃষ্টি রহস্য গবেষণার ঊষালগ্নে। অ্যালেক্সান্ডার ওপারিনের গবেষণার বিষয় ইতিমধ্যে প্রথম অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। ওপারিন গুরুত্বের সাথে দেখালেন কোয়াসারভেট থেকে উৎসারিত কিছু উষ্ণ রাসায়নিক তরলের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে যার কেন্দ্রে আছে কিছু অবিকশিত কোষের মত বস্তু। তিনি দাবী করেন কোয়াসারভেটগুলোই আসলে কোষের প্রথম নমুনা।

সঠিক উপাদান থাকার পরেও গবেষণাগারে কোষের প্রাথমিক নমুনা সৃষ্টি খুব কঠিন কাজ। যেকোনো চর্বিযুক্ত বা তৈলাক্ত বস্তু আছে এমন পানিতে ব্লব বা ফিল্ম সৃষ্টি হয় আর এইসব রাসায়নিক উপাদান একসাথে লিপিড নামে পরিচিত। আলোচনার এই পর্যায়ে বিজ্ঞানীগণ ধারণা পোষণ করতে থাকেন লিপিড থেকেই জীবনের প্রথম সূচনা। আমরা প্রাণের সৃষ্টি গবেষণায় বিজ্ঞানের এই মতবাদকে ‘লিপিড ঘরানা’ বলতে পারি।

কিন্তু শুধুই রাসায়নিক উষ্ণ ঘন তরলের ধারা সৃষ্টি করলেই সব সমাধা হয়ে গেল এমন নয় বিষয়টা। বিগত কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন বস্তু ব্যবহার করেও লুইজি এমনকিছু বানাতে পারলেন না যা দিয়ে তিনি বিজ্ঞানীদের সম্মতি অর্জনের জন্য জীবন-সদৃশ কিছু উপস্থাপন করা যায়। এখানে উল্লেখ্য উষ্ণ রাসায়নিক পানির প্রবাহের স্থিতিশীলতা থাকতে হবে এবং সেই প্রবাহ থেকে বিভাজিত হয়ে আর একটা ধারা সৃষ্টি করার সক্ষমতা থাকতে হবে। সেই ধারার মধ্যে কী কী উপাদান পরিবাহিত হচ্ছে তার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। এতকিছু করতে হবে কিন্তু আধুনিক একটা কোষের পরিণত প্রোটিন ব্যবহার না করেই।

কোষের জন্ম
Somehow cells formed (Credit: Christian Jegou/Publiphoto Diffusion/Science Photo Library)

এরপরে ১৯৯৪ সালে লুইজি এক সাহসী প্রস্তাবনা রাখলেন। তিনি বলেন প্রাথমিক পর্যায়ের কোষে অবশ্যই আরএনএ থাকতে হবে। তিনি আরও দাবী করেন এই আরএনএ অবশ্যই নিজের আর একটা প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে সম্ভব। লুইজির প্রস্তাবনা বিজ্ঞানের নতুন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিলো। তার মানে হল, প্রাণ বিকাশের প্রথম প্রস্তাবনায় আমরা আসলে প্রাণের সৃষ্টি রহস্য গবেষণার বিভিন্ন তত্ত্বের মিলন মেলায় মিলিত হয়েছি এবং দীর্ঘ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছি। লুইজির প্রস্তাবিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি আমলে নিলে, প্রাণ বিকাশের প্রথম প্রস্তাবনা কম্পার্টমেন্টালাইজেশন তত্ত্ব বা কোষের বিভাজন তত্ত্বকে বাতিল করে দিতে হয়। কিন্তু লুইজির কাছেও উপযুক্ত কারণ ছিল।

ভিতরে জীন বিহীন চারপাশে আবৃত কোষ খুব বেশী কিছু করতে পারে না। হয়ত কোষ বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ সৃষ্টি করতে পারে কিন্তু তারা নিজের বংশগতির কোন তথ্য, উপাত্ত পরবর্তী কোষের মাঝে সঞ্চার করতে পারবে না। কোষ কেবল তখনি বিবর্তিত হতে শুরু করবে এবং ক্রমাগত জটিলতর হয়ে উঠতে পারবে যদি কোষের অভ্যন্তরে জীন থাকে।

এই তত্ত্ব খুব দ্রুত জ্যাক সোসটাকের সমর্থকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। আমরা ইতিমধ্যে তৃতীয় অধ্যায়ে সোসটাকের আরএনএ নিয়ে গবেষণা আলোচনা তুলে ধরেছি। যখন লুইজি ছিলেন কম্পার্টমেন্টালাইজেশন তত্ত্বের প্রথম দিকের সমর্থক ঠিক তখন সোসটাক সমর্থন করতেন জীনতত্ত্বকে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন কোন মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত ছিল না। আমরা প্রাণের সৃষ্টি রহস্য গবেষণার বিভিন্ন তত্ত্বের মিলন মেলায় মিলিত হয়েছি এবং দীর্ঘ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছি এবং সোসটাকের গবেষণার সূত্র ধরে নির্ধারণ করছে চাচ্ছি কোনটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ। মোটের উপর আমরা বুঝতে পারলাম দুই গবেষণাতেই কোষের উপস্থিতি আছে। আমরা একটা সম্মতিতে এলাম যে প্রাণের উৎস সন্ধানে কম্পার্টমেন্টালাইজেশন বা বিভাজন তত্ত্ব এবং জীনতত্ত্ব উভয় গবেষণাতেই কোষ খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।

কোষের জন্ম
Almost all life is single-celled (Credit: Science Photo Library/Alamy)

সোসটাকের তত্ত্ব প্রাণের উৎস গবেষণার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী এবং সোসটাক অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন তার গবেষণা তত্ত্বে অর্থ বিনিয়োগ করবেন যেখানে তার আগ্রহ। কারণ হিসেবে বললেন, “এমন একটা তত্ত্বের সমর্থনে তত্ত্বকে গবেষণার বাইরে রাখতে পারি না।” তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন প্রাথমিক কোষ দিয়ে গবেষণা শুরু করবেন।

দুই বছর পরে সোসটাক এবং তার দুইজন সহকর্মী ২০০১ সালে বড় ধরণের সাফল্যের সুসংবাদ দিলেন। বিজ্ঞান বিষয়ক বিখ্যাত ‘নেচার’ জার্নালে তারা যুক্তি দেখিয়ে লিখলেন প্রকৃতিতে প্রাপ্ত আপাত বিচ্ছিন্ন উপাদান থেকে সহজেই প্রাথমিক কোষ সৃষ্টি করা সম্ভব। চর্বিযুক্ত তেলতেলে বস্তুর সংস্পর্শে আরএনএ নিজের নিজের প্রতিলিপি জন্ম দিতে পারে।

কোষের জন্ম
Vesicles are simple containers made of lipids (Credit: Alfred Pasieka/Science Photo Library)

সোসটাক এবং তার গবেষক-দল কোষের ভেসিকল (কোষের তরল পূর্ণধারক) নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ভেসিকল দেখতে অনেকটা সর্পিল ঘন তরলের আকার যার গভীরে এবং বাইরের আবরণে দুইটা ফ্যাটি এসিডের স্তর আছে। ভেসিকলের উৎপাদন ত্বরান্বিত করার উপায় খুঁজতে গিয়ে সোসটাকের গবেষক-দল এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদার মত দেখতে থকথকে একটা বস্তুকে বিক্রিয়ার কাজে লাগিয়ে দিলেন এবং মনে করলেন এই নিরীক্ষা প্রাণ গবেষণার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে। এই যৌগের মিশ্রণ গবেষণা কাজে যোগ করার পরেই ভেসিকলের উৎপাদন ১০০ গুণ ত্বরান্বিত হয়ে গেল। কাদার মত বস্তুর পৃষ্ঠতল ভেসিকল উৎপাদনে অনুঘটকের কাজ করে যে কাজটা সচারচার এনজাইম করে থাকে।

তদুপরি, ভেসিকল এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদার কণা এবং কাদার পৃষ্ঠতল থেকে আরএনএ গ্রহণ করতে পারে। প্রথমদিকের এইসব কোষ এখন বহন করছে জীন এবং অনুঘটক আর এতকিছু ঘটে যাচ্ছে একটা সরল কাঠামোর মধ্যে। তবে প্রাণ গবেষণার এই পর্যায়ে এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদা প্রয়োগের সিদ্ধান্ত কিন্তু হঠাৎ করে নেয়া হয়নি। বিগত কয়েক দশক ধরে চলমান গবেষণার পরম্পরা গবেষকদলকে এই সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এবং তারা অনুমান করেছিলেন প্রাণ সৃষ্টিতে এই যৌগ হয়ত খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কোষের জন্ম
This lump of clay is mostly montmorillonite (Credit: Susan E. Degginger/Alamy)

এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ খুব সহজলভ্য। এখনকার সময়ে আমাদের ব্যবহার্য নিত্যদিনের জিনিসপত্রে এটা হরহামেশা ব্যবহৃত হয় এমনকি বিড়ালের বিছানা বানাতেও এটার ব্যবহার দেখা যায়। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় নির্গত ছাইয়ের ধুলো পৃথিবীর আবহাওয়াতে মিশে এই যৌগ সৃষ্টি হয়। যেহেতু পৃথিবীর শৈশবে অনেক আগ্নেয়গিরি ছিল সেহেতু এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ ছিল পরিমাণে বিপুল।

ফিরে যাই ১৯৮৬ সালে, তখন আমেরিকান রসায়নবিদ জেমস ফেরিস দেখালেন এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ আসলে অণুঘটক যা জৈব-কণা সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আরও পরে তিনি আবিষ্কার করেন এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ আরএনএ সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখে। এই দুইটি কাজের উপর ভিত্তি করে জেমস ফেরিস ধারণা করেন গড়পড়তা দেখতে কাদার মত এই যৌগটি আসলে প্রাণ সৃষ্টির উপাদান। জ্যাক সোসটাক ফেরিসের ধারণাকে গ্রহণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন এবং এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ ব্যবহার করে প্রথম কোষ সৃষ্টি করলেন। সোসটাক যুক্তি দেখালেন, আদি-কোষ যদি বেড়ে উঠতে পারে তাহলে সেটা বিভাজিতও হতে পারে। এক বছর পরে সোসটাকের গবেষক-দল প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, প্রথমদিকের কোষ নিজেদের মত করেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেড়ে উঠতে পারে। এমনকি আদি-কোষে আরএনএ সংরক্ষিত থাকে এবং সময়ের হাত ধরে কোষের দেয়ালের বাইরের পাশ অতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। মনে হয় যেন আদি-কোষ একটা ফুলে ওঠা পাকস্থলী এবং যেকোনো সময় সশব্দে ফেটে পড়বে। ফেটে পড়া রোধ করতে গিয়ে কোষ অধিকমাত্রায় ফ্যাটি এসিড গ্রহণ করে এবং তাদের সমন্বয়ে নিজের দেয়ালকে আরও মজবুত করে তোলে ফলে কোষ ফুলে আকারে আর একটু বড় হয় এবং ফেটে পড়ার আশংকা দূর হয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল আদি-কোষ যে কোষের আরএনএ কম তার থেকে ফ্যাটি এসিড গ্রহণ করছে ফলে সেই কোষগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ছে। তার মানে এ থেকে বোঝা যায় আদি-কোষ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল এবং যে কোষের আরএনএ বেশী স্বাভাবিকভাবে সে কোষ জিতে যায়। এই অনুসিদ্ধান্ত আমাদের মনে আরও বিস্ময় জাগায়। যদি আদি-কোষ বেড়ে ওঠতে পারে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের অনুরূপ কোষ সৃষ্টি করতে পারে তবে কি সোসটাকের গবেষণালব্ধ প্রাথমিক কোষ নিজের প্রতিলিপি বানাতে পারবে?

কোষের জন্ম
Cells reproduce by dividing into two (Credit: Science Photo Library/Alamy)


সোসটাকের প্রথম পরীক্ষায় দেখানো হয়েছে কীভাবে আদি-কোষ বিভাজিত হয়। আদি-কোষকে দুমড়ে মুচড়ে যদি ছোট ছিদ্র পথের সুড়ঙ্গে ঢুকিয়ে দেয়া যায় তাহলে সেখান থেকে আদি-কোষ ভেঙে ছড়িয়ে পড়বে। আদি-কোষ বেড়ে ওঠে, তাদের আকার পরিবর্তিত হয়, আয়তনে প্রসারিত হয় এবং তাদের শরীরে রশির মত লম্বা পাতলা প্রান্ত দেখা যায়।

এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া একেবারে নির্ভেজাল কারণ এখানে কোষের কোন যান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম জড়িত নাই। এখানে শুধু চাপ প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু এটা কোন সমাধান নয় কারণ নিজেই নিজের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় আদি-কোষ তার নিজস্ব কিছু উপাদান হারায়। এছাড়াও আদি-কোষ তখনই বিভাজিত হতে পারে যখন ছোট ছিদ্রপথে বল প্রয়োগে প্রবেশ করানো হয়।

ভেসিকলকে বিভাজিত করার বিভিন্ন উপায় আছে যেমন কোষকে পানির প্রবল স্রোত যুক্ত করতে পারলে কোষে নতুন শক্তির সৃষ্টি হয়। আদি-কোষের অভ্যন্তরীণ উপাদান বের হতে না দিয়ে কোষকে বিভাজন করার জন্য এই কৌশল অবলম্বন করা হয়।

অবশেষে ২০০৯ সালে জ্যাক সোসটাক এবং তার সহযোগী ছাত্র টিং ঝু একটা সমাধান বের করতে সক্ষম হন। তারা সামান্য একটু জটিল আদি-কোষ সৃষ্টি করলেন যার চতুর্দিকে একাধিক দেয়াল যেন অনেকটা পেয়াজের মত। সরল আদি-কোষের গঠনে জটিলতা থাকলেও সহজেই তাদেরকে সৃষ্টি করা সম্ভব। টিং ঝু যখন আদি-কোষের সাথে আরও বেশী ফ্যাটি এসিড যোগ করলেন তখন আদি-কোষের আকার পরিবর্তিত হয়ে গেল, সুতার মত দেখতে প্রান্তগুলো আরও লম্বা হয়ে গেল। আদি-কোষের আকার যথেষ্ট বড় হয়ে গেলে অল্প চাপে আদি-কোষ ভেঙে বেশকিছু ছোট ছোট আদি-কোষে রূপান্তরিত হল। পিতৃ-কোষের কোন আরএনএ কিন্তু হারিয়ে গেল না বরং প্রতিটি ক্ষুদ্র আদি-কোষ তার পিতৃ-কোষের আরএনএ বহন করতে লাগল। তাছাড়া, আদি-কোষ নতুন কোষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া পৌনঃপুনিক ভাবে চালিয়ে যেতে পারে। নতুন আদি-কোষ পরিপূর্ণ হয়ে গেলে নিজেই আবার নতুন কোষে বিভাজিত হতে শুরু করে।

পরবর্তী পরীক্ষায় ঝু এবং সোসটাক আদি-কোষ ভেঙে নতুন কোষ জন্ম দেয়ার ভিন্ন ভিন্ন উপায় খুঁজে বের করতে পেরেছিলেন। গবেষণার এই পর্যায়ে মনে হচ্ছিল অবশেষে সমস্যার বুঝি সমাধান পাওয়া গেল।

যাইহোক আদি-কোষ কিন্তু তখন যথেষ্ট কার্যকরী ছিল না। লুইজি ভেবেছিলেন, আদি-কোষ আরএনএ প্রতিলিপি সৃষ্টির ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করবে কিন্তু যতদূর বোঝা যায় আদি-কোষে আরএনএ শুধু অলস বসে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ করে না।

সত্যিকার অর্থেই যদি আদি-কোষ থেকে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের বিকাশ প্রমাণ করতে হয় তাহলে সোসটাকের দেখাতে হবে আরএনএ কীভাবে কোষের অভ্যন্তরে নিজেই নিজের প্রতিলিপি জন্ম দেয়। কিন্তু এই তথ্যকে তত্ত্ব হিসেবে প্রমাণ করে দেখানো এত সহজ নয় কারণ দশকব্যাপী পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর পরেও কোন বিজ্ঞানী আরএনএ উৎপাদন করে দেখাতে পারেন নি যা নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে। ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা বিশদ আলোচনা করে ফেলেছি। এই সমস্যার কারণেই প্রাণ বিকাশে আরএনএ তত্ত্ব ঘরানার গবেষণার কাজ প্রথমদিকে ব্যাহত হচ্ছিল এবং তখন পর্যন্ত কেউ এই সমস্যার সমাধান বের করতে পারেনি। সুতরাং সোসটাক লেসলি ওরগেলের গবেষণার ফলাফল ও লিখিত কাগজ পুনরায় পড়তে শুরু করেন। আমরা জানি লেসলি ওরগেল দীর্ঘদিন আরএনএ তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। পুরনো ধুলো পড়া কাগজের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল প্রাণের উৎস গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র।

কোষের জন্ম
So The first cells had to host the chemistry of life (Credit: Science Photo Library/Alamy)

ওরগেল ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আরএনএ’র সুতোর মত প্রান্তগুলো কীভাবে নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করে সেই গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ওরগেলের গবেষণার সারাংশ ছিল খুবই সহজ সরল এবং সাধারণ। আরএনএ’র সুতোর মত একপ্রান্ত থেকে আলগা নিউক্লিওটাইড তুলে নেয়া হল এবং তখন নিউক্লিওটাইড জড়ো করে আরএনএ’র প্রথম সুতোর মত অবিকল আর একটা প্রান্ত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ, ধরি আরএনএ’র একটা সুতোর মত প্রান্তে CGC লিখিত আছে এবং সেখানেই উৎপাদিত হয়েছে অনুরূপ আরেকটা সুতোর মত প্রান্ত যেটা পড়তে GCG এর মত মনে হয়। সম্ভবত কেউ যদি এই প্রক্রিয়া দুইবার করে তবে প্রকৃত CGC পাওয়া যাবে।

ওরগেল বুঝতে পারলেন যে, কোন অনুকূল পরিবেশে আরএনএ’র সুতোর মত প্রান্ত একই প্রক্রিয়ায় এনজাইমের সাহায্য ছাড়াই আরএনএ’র প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে। সম্ভবত এভাবেই প্রথম প্রাণ আরএনএ থেকে জীন সংগ্রহ করত। ১৯৮৭ সালে ওরগেল আবিষ্কার করলেন, আরএনএ’র ১৪ লম্বা নিউক্লিওটাইড সুতোর প্রান্ত অনুরূপ ১৪ নিউক্লিওটাইড লম্বা প্রান্ত সৃষ্টি করতে সক্ষম। তিনি এর থেকে বেশী লম্বা আরএনএ’র প্রান্ত বানাতে পারেন নি কিন্তু সোসটাকের চিন্তার সলতেই আগুন উস্কে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। সোসটাকের ছাত্রী ক্যাটারজিনা অ্যাডামালা আদি-কোষ সৃষ্টির জন্য পুনরায় প্রবৃত্ত হলেন। তারা যে আদি-কোষ সৃষ্টি করলেন সেগুলো আগের কোষের গায়ের বাইরের সংলগ্ন মলিকিউল থেকে জীন বহন করে।

তারা বুঝতে পারলেন, এই বিক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য ম্যাগনেসিয়াম প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা এখানেই যে, ম্যাগনেসিয়ামের উপস্থিতি আদি-কোষকে ধ্বংস করে। সব সমস্যারই সমাধান আছে এবং এই সমস্যার সমাধানে ব্যবহার করা হল সাইট্রিক এসিড। লেবু, কমলা জাতীয় ফলে প্রচুর সাইট্রিক এসিড পাওয়া যায় এবং প্রতিটি জীবন্ত কোষে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সাইট্রিক এসিডের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটা গবেষণায় গবেষক-দল উল্লেখ করেন তারা বিক্রিয়ার সময় সাইট্রেট যুক্ত করে দেন ফলে বিক্রিয়াতে অংশগ্রহণ থেকে ম্যাগনেসিয়ামকে বিরত রাখা সম্ভব হয়। এতে আদি-কোষ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং কোষের প্রতিলিপি সৃষ্টির প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে চলতে থাকে। সরলভাবে বলতে গেলে গবেষক-দল ১৯৯৪ সালে ইটালিয়ান বিজ্ঞানী পিয়ের লুইগি লুইজির প্রস্তাবিত তত্ত্বকে বাস্তবায়ন করলেন। জ্যাক সোসটাক বলেন, “আমরা কোষের ফ্যাটি এসিডে ভেসিকলের অভ্যন্তরে আরএনএ’র অবিকল প্রতিলিপি সৃষ্টির রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু করলাম।”

কোষের জন্ম
Szostak’s protocells can survive extreme heat (Credit: Jon Sullivan, PDPhoto.org)

মাত্র এক দশকের বেশী কিছু সময়ের গবেষণায় জ্যাক সোসটাকের গবেষক-দল প্রাণের উৎস সন্ধানে যুগান্তকারী অর্জন সম্পন্ন করে ফেললেন। তারা আদি-কোষ বানাতে সক্ষম হলেন যারা পূর্বের কোষের জীন বহন করে এবং কোষের বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় মলিকিউল সংগ্রহ করতে পারে। এই আদি-কোষ নিজেরাই নিজেদের বৃদ্ধি এবং বিভাজন করতে পারে এমনকি নিজেদের মাঝে প্রতিযোগিতা পর্যন্ত করতে পারে। আর কোষের অভ্যন্তরে চলতে থাকে আরএনএ’র অবিকল প্রতিলিপি সৃষ্টির অবিরাম কর্মযজ্ঞ। যেকোনো বিচারেই এই প্রক্রিয়া নতুন জীবন সৃষ্টির সূচনা বলা যেতে পারে।

এতকিছু স্বত্বেও সোসটাকের গবেষণার ফলাফল প্রায় ৪০ বছর ধরে চলমান প্রাণের উৎস গবেষণার বিপরীতে চলে গেল। কোষের নিজেই নিজেকে জন্ম দিয়েছিল প্রথমে এই মতবাদকে প্রাধান্য না দিয়ে অথবা কোষের বিভাজন প্রক্রিয়াকে অধিক গুরুত্ব না দিয়ে সোসটাক এই দুই মতবাদের সমন্বয় সাধন করে বলতে চেয়েছিলেন এই দুই প্রক্রিয়া সমান-তালে একসাথে চলছিল। কিন্তু সোসটাকের গবেষক-দল যেকোনো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে প্রস্তুত। ২০০৮ সালে সোসটাকের গবেষক-দল বুঝতে জানতে পারলেন, আদি-কোষ প্রায় ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও দিব্যি টিকে থাকতে পারে অথচ এই পরিমাণ উচ্চ তাপমাত্রায় বর্তমান সময়ের পরিণত বেশীরভাগ কোষেরই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা। ফলে সোসটাকের ধারণা আরও জোরালো হয় যে আদি-কোষের সাথে প্রথম প্রাণের যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। এর থেকে আরও প্রমাণিত হয় অবিরাম চলতে থাকা উল্কা পতনের প্রভাবে সৃষ্ট গরমেও আদি-কোষ বহাল তবিয়তে টিকে ছিল।

জার্মানির ওসনাব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শিক্ষক আরমেন মালকিদজানিয়ান সোসটাকের গবেষণাকে অতুলনীয় হিসেবে অভিহিত করেন। সোসটাকে তত্ত্বাবধানে ইতিপূর্বে বর্ণিত দুই মতবাদের সমন্বয় করার প্রচেষ্টা প্রাণের উৎস গবেষণায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয় যার কারণে শুরু হয় প্রাণ কীভাবে কাজ করে তার আলোচনা। এই “সবকিছু প্রথমে” ধারণা ইতিমধ্যে জোগাড় করে ফেলেছে তথ্য প্রমাণের আকরিক সম্পদ এবং প্রাণের উৎস গবেষণার চলমান বিতর্কের সম্ভাব্য সমাধান।

কোষের জন্ম
The molecules of life behave in incredibly complex ways (Credit: Equinox Graphics Ltd)

Posted at January 04, 2019 |  by Arya ঋষি

পৃথিবীর প্রতিটি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে আজ প্রাণ প্রতিষ্ঠিত কিন্তু পৃথিবী যখন সৃষ্টি হয় তখন পৃথিবী ছিল মৃত উষর গলিত পাথর। তাহলে কীভাবে জীবনের শুরু? সচারচার এমন প্রশ্ন খুবই কম লোকেই জিজ্ঞেস করে থাকে। মানব ইতিহাসের বেশিরভাগ পাতা জুড়ে লেখা আছে এবং প্রায় সবাই বিশ্বাস করে কোন না কোন ঈশ্বর আমাদের অতিপ্রিয় জীবনটা এক ফুঁৎকারে বানিয়ে দিয়েছেন। কিছুদিন আগেও ঈশ্বরব্যতীত অন্যকোন ব্যাখ্যা ছিল মানুষের চিন্তারও বাইরে।

ঈশ্বর জীবনের জন্ম দিয়েছেন কথাটা এখন আর সত্য নয়। বিগত শতাব্দী ধরে কিছু বিজ্ঞানী কীভাবে প্রথম প্রাণের বিকাশ হয়েছিল খুঁজতে নিরন্তর গবেষণা করে গেছেন এবং গবেষণা বর্তমানেও চলছে। এমনকি বিজ্ঞানীগণ পরীক্ষাগারে সৃষ্টির আদিতে যেমন পরিবেশ ছিল কৃত্রিমভাবে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করে নিঃস্ব অবস্থা থেকে সম্পুর্ণ নতুন প্রাণের জন্ম দিয়েছেন।

যাকিছু অগ্রগতি হয়েছে সেটা কোন একক প্রচেষ্টা নয় কিন্তু আমরা দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এসেছি। আজকে অনেক বিজ্ঞানীই প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে অধ্যয়ন করছেন এবং তারা আত্মবিশ্বাসী যে তারা সঠিক পথেই আছেন এবং তাদের আত্মবিশ্বাস দাঁড়িয়ে আছে বহুদিনের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। এটা হলো আমাদের উৎপত্তির প্রকৃত উৎস আবিস্কারের কাহিনী। আধুনিক বিজ্ঞানের কিছু যুগান্তকারী আবিষ্কারকে ঘিরে আবর্তিত প্রাণের সৃষ্টি রহস্য গল্পটি মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ, সংগ্রাম এবং অসাধারণ সৃষ্টিশীলতায় পরিপূর্ণ। প্রাণের সৃষ্টিলগ্ন খুঁজতে মানব মানবীকে যেতে হয়েছে আমাদের পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় কোনায় এবং সহ্য করতে হয়েছে অবর্ণনীয় কষ্ট। কিছু বিজ্ঞানী নিযুক্ত ছিলেন অতি দানবীয় গবেষণা এবং পরিশ্রমে, পক্ষান্তরে কোন কোন বিজ্ঞানীকে কাজ করতে হয়েছে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী সরকারের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে।  

প্রথম পর্ব

পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তির গল্প

Dinosaurs actually lived quite recently (Credit: Oleksiy Maksymenko/Alamy)

প্রাণ অনেক পুরনো। ডায়নোসর সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত বিলুপ্ত প্রাণী এবং প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে তারা দোর্দণ্ড প্রতাপে টিকে ছিল। কিন্তু প্রাণের জন্ম খুঁজতে আরও সুদূর অতীতে যেতে হবে। আমাদের চেনাজানা সবচেয়ে পুরনো জীবাশ্মের বয়স প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন বছর যা কিনা সবচেয়ে পুরনো ডায়নোসরের থেকেও ১৪ গুণ বেশি পুরনো। কিন্তু জীবাশ্মের প্রাপ্ত বয়স হয়ত আরও অতীতের হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ২০১৬ সালের আগস্টে গবেষকগণ ৩.৭ বিলিয়ন বছর আগের আণুবীক্ষণিক অনুজীবের ফসিলের সন্ধান পেয়েছেন।

পৃথিবী নিজে এত বেশি পুরনো নয়, এইতো গঠিত হয়েছিল ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে। যদি আমরা ধারণা করি প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল এই পৃথিবীতেই তাহলে সেটা যুক্তিপূর্ণ এবং অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়। আমাদের জানামতে আমরা অন্যকোথাও প্রাণের অস্তিত্ব পাইনি। সংরক্ষিত পুরনো জীবাশ্ম পরীক্ষা করে বোঝা যায় যা কিছু ঘটেছে সেটা পৃথিবী গঠনের পরে এবং ৪.৫ বিলিয়ন বছরের মধ্যে। একই সাথে আমরা যদি প্রাণের বিকাশ মুহুর্তের কাছাকাছি চলে যাই তাহলে প্রকৃতপক্ষেই সৃষ্টিলগ্নে কেমন ছিল তার আধুনিক ধারণা পাবো।

The tree of life: most of the branches are bacteria (Credit: Hug, Banfield et al, Nature Microbiology)

১৯ শতক থেকেই জীববিজ্ঞানীগণ জানেন সব ধরণের জীবিতস্বত্বাই ‘কোষ’ দ্বারা গঠিত যা মূলত বিভিন্ন রকম এবং আকারের অতি ক্ষুদ্র জীবিত বস্তুকণার সমষ্টি। ১৭ শতকে আধুনিক অনুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের পরে প্রথম কোষের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু কোষ থেকেই জীবনের উৎপত্তি সেটা বুঝতে প্রায় এক শতাব্দী সময় লেগেছে। বিজ্ঞানীগণ জানতে পেরেছেন আমাদেরকে একটা কোষ সৃষ্টি করতে হলে ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর পরিবেশগত অবস্থা এবং উপাদান লাগবে।

একজন মানুষ হয়ত দেখতে একটা কইমাছ বা টাইরানোসোরাস রেক্স এর মত নয় কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের গভীর পর্যবেক্ষণে আমরা দেখতে পাবো সবপ্রাণীর দেহ প্রায় একই রকম কোষদ্বারা গঠিত। এমনকি বৃক্ষলতা, অণুজীব বা মাশরুম ইত্যাদি একই উপাদানে তৈরি। প্রাণীজগতের বেশিরভাগ প্রাণীই আণুবীক্ষণিক যাদের প্রায় সবাই একটা মাত্র কোষ দিয়ে গঠিত। ব্যাকটেরিয়া এককোষী প্রাণীদের মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত অতিপ্রজ এবং পৃথিবীর সর্বত্র পাওয়া যায়।

২০১৬ সালের এপ্রিলে বিজ্ঞানীগণ একটা সেমিনারে ‘প্রাণের বংশলতিকা’র’ সর্বশেষ আধুনিক সংস্করণ উপস্থাপন করেন যেখানে সব ধরণের জীবিত প্রাণীকে বংশলতিকায় পর্বের মাধ্যমে দেখানো হয়। প্রাণীপর্বের প্রায় সব শাখাতেই ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য। তদুপরি, প্রাণীর বংশলতিকা দেখে মনে হয় সব জীবের আদিপিতা হলো ব্যাকটেরিয়া। অন্যভাবে বলা প্রতিটি জীবিত প্রাণ এমনকি আপনি নিজেও প্রকৃতপক্ষে ব্যাকটেরিয়ার বংশধর। অর্থাৎ, আমরা এখন জীবনের উৎস কোথায় এই প্রশ্নের আরও যথাযথা উত্তর নিশ্চিত করতে পারবো। একটা কোষ তৈরি করতে আমাদের প্রয়োজন হবে ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগেকার পৃথিবীর উপাদান এবং প্রাণ বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ। তাহলে, প্রাণ সৃষ্টি কত দুরূহ ব্যাপার হবে?

A complete living cell (Credit: Equinox Graphics Ltd)

প্রথম অধ্যায়ঃ প্রথম গবেষণামূলক পরীক্ষা 

সমগ্র ইতিহাসজুড়ে, প্রাণের বিকাশ কীভাবে শুরু হয়েছিল এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনীয়তা কখনো বিবেচিত হয়নি। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে উত্তর তো আগে থেকেই সুনির্দিষ্ট। ১৮০০ শতকের আগে মানুষ বিশ্বাস করতো, প্রাণের উৎস এবং বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে তার পুর্ব শারীরিক এবং রাসায়নিক শক্তির মিথস্ক্রিয়া। এটি ছিল মানুষের সহজাত ধারণা যে সমস্ত জীবন্ত অস্তিত্ব সর্বশক্তিমানের একটি বিশেষ উপহার এবং অলৌকিকতার সাথে সম্পৃক্ত ছিল যা তৈরি হয়েছিল কোন প্রাণহীন পদার্থ থেকে। জীবন সৃষ্টিকারী রাসায়নিক উপাদানগুলো সবই সরল রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়াতে জন্ম নিলেও জীবনের সাথে সেই রাসায়নিক উপাদানগুলোর কোন সম্পর্ক নেই। অলৌকিকভাবে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে এই বিশ্বাস ধর্মবিশ্বাসের সাথে মিলে মিশে ফুলে ফলে পল্লবে শাখায় শাখায় বিকশিত হয়েছে। বাইবেলে বলা হয়েছে প্রথম মানবকে জীবন দান করতে ঈশ্বর তার মুখে ফুঁ দিয়েছিলেন এবং চির অজর অমর আত্মা প্রাণীর দেহে অলৌকিকভাবে বিরাজিত থাকে।

ধর্মীয় তত্ত্বের একটাই সমস্যা ছিল। অলৌকিকতা হলো নির্জলা ভুল ধারণা। ১৮০০ শতকের শুরুর দিকে বিজ্ঞানীগণ এমন কিছু বস্তুর সন্ধান পেলেন যেগুলো মনে হচ্ছিল জীবনের জন্য অনন্য উপাদান। সেইসব উপাদানের মধ্যে ইউরিয়া অন্যতম যা পাওয়া গিয়েছিল মূত্রের মধ্যে এবং ১৭৯৯ সালে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানের যা কিছু অর্জন ছিল সেটা অলৌকিকতার সাথে বেশি মানানসই। শুধু জীবিত প্রাণই এই ধরণের রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন করতে পারে সুতরাং ধারণা করা হয় ইউরিয়ার মধ্যে জীবনের শক্তি সঞ্চিত ছিল এবং এই কারণেই সেই বস্তুগুলো ছিল অন্যদের তুলনায় বিশেষ কিছু।

The German chemist Friedrich Wöhler, in a lithograph by Rudolf Hoffmann from 1856

কিন্তু ১৮২৮ সালে জার্মান রসায়নবিদ ফ্রেডরিখ ভোলার একটা সাধারণ রাসায়নিক দ্রব্য আমোনিয়াম সায়ানেট থেকে ইউরিয়া উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন যার সাথে জীবিত প্রাণের কোন যোগসূত্রতাই ছিল না। অন্যান্য বিজ্ঞানীগণও এগিয়ে এলেন ফ্রেডরিখ ভোলারের পথ অনুসরণ করে এবং কিছুদিনের মধ্যেই বিজ্ঞানীগণ বুঝতে পারলেন, প্রাণের সাথে কোন সম্পর্ক নাই এমন সাধারণ নিরীহ রাসায়নিক দ্রব্য দিয়েও রসায়নে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

বিজ্ঞানের গবেষণায় প্রাণ বিকাশে অলৌকিকতার স্থান এখানেই সমাপ্তি। কিন্তু মানুষ মনের গভীরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রাণ বিকাশের ঐশ্বরিক ধারণা এত সহজে দূর করতে পারে না। অনেকেই বলতে থাকে, রসায়ন থেকে প্রাণ সৃষ্টির মধ্যে বিশেষত্ব কিছু নেই বরং তাদের কাছে মনে হয় রোবটে প্রাণের মত ইন্দ্রজাল যা আমাদেরকে আসতে আসতে যন্ত্রে পরিণত করছে। এবং এটা অবশ্যই বাইবেলের সাথে সাংঘর্ষিক।

দশকের পর দশক জীবনের উৎস কোথায় এই রহস্য অবহেলিত থেকে গেছে। এমনকি বিজ্ঞানীগণ পর্যন্ত প্রাণ সৃষ্টির অলৌকিকত্বকে রক্ষা করতে রীতিমত মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন। যেমন ১৯১৩ সালের শেষ নাগাদ ব্রিটিশ জৈবরসায়নবিদ বেঞ্জামিন মূর ‘জৈব শক্তি’ নামে একটা তত্ত্বের অবতারণা করেন যেটা আসলে নতুন মোড়কে অলৌকিকতা প্রচারের প্রবল চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়। বেঞ্জামিন মূরের ‘জৈব শক্তি’ তত্ত্বে আবেগের প্রাধান্যও যথেষ্ট ছিল। বর্তমানে মূরের ‘জৈব শক্তি’ তত্ত্ব অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন বহু বহু বিজ্ঞানের কল্প-গল্পে দেখা যায় একজন মানুষের জীবনী শক্তি বাড়ানো সম্ভব অথবা জীবনী শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। ইংল্যান্ডের একটা টিভি সিরিয়াল ‘ডক্টর হু’ এর মধ্যে একটা চরিত্র টাইম লর্ডস জীবনী শক্তি নবায়নের চিন্তা করেন যেখানে দেখা যায় শক্তি বাড়ানো হচ্ছে, যদি ধীরেও প্রবাহিত হয় তবুও সে শীর্ষে পৌঁছে যাবে। বৈজ্ঞানিক কল্প-গল্পটিকে অভিনব মনে হলেও বাস্তবে এটা অতিপুরনো একটা অলিক ধারণা মাত্র।

তারপরেও ১৮২৮ সালের পর থেকেই দেবত্ববিহীন প্রাণের বিকাশ প্রথম কীভাবে ঘটেছিলে তার যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজতে থাকেন বিজ্ঞানীগণ। কিন্তু তারা কোন উপায় অন্তর খুঁজে পাননা। যদিও প্রাণ বিকাশের উৎস রহস্যে ঢাকা কিন্তু দশকের পর দশক অবহেলিত ছিল, তবুও তখন বিজ্ঞানীদের মনে হতে লাগল প্রাণের বিকাশ কীভাবে ঘটেছিল তা অবশ্যই আবিষ্কার করার বিষয়। সম্ভবত তখনকার প্রায় সবাই সৃষ্টিতত্ত্বের প্রশ্নে অলৌকিকতাবাদে আবেগের আতিশয্যে এমনভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িত ছিল যে তারা আবিষ্কারের পরবর্তী পদক্ষেপ শুরুই করতে পারছিল না।


Charles Darwin 

পূর্বের অচলাবস্থার পরিবর্তে ১৯ শতকে চার্লস ডারউইন এবং সহযোগীদের চেষ্টায় গড়ে তোলা বিবর্তন তত্ত্বের সুবাদে  জীববিজ্ঞানে নব নব আবিষ্কারের হাতছানি দেখা দেয়। চার্লস ডারউইন জানতেন কীভাবে প্রাণের বিকাশ হয়েছে এটা খুবই গভীর চিন্তা ও আবেগ মেশানো প্রশ্ন। চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের সূচনা হয় ১৮৫৯ সালে পৃথিবী তোলপাড় করা ‘অন দ্য ওরিজিন অফ স্পিসিজ’ বইটি প্রকাশের মাধ্যমে। বিবর্তনবাদে তিনি ব্যাখ্যা করে দেখান কীভাবে এই বিপুলা পৃথিবীর ততোধিক বিপুল পরিমাণ বিচিত্র প্রাণী জগতের উদ্ভব হয়েছে একটা সাধারণ এককোষের আদিপিতা থেকে। এই প্রথম কেউ বললেন ঈশ্বর প্রতিটি জীবকে আলাদা আলাদা করে সৃষ্টি করেননি। প্রাণিজগৎ সৃষ্টি হয়েছে কোটি কোটি বছর আগেকার পৃথিবীর প্রাথমিক জৈব উপাদান থেকে। প্রাণী জগতের সবাই সেই এককোষী আদিপিতার বংশধর।

চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ চারিদিকে বিতর্কের হৈচৈ ফেলে দিলো এবং বাইবেলের সাথে সাংঘর্ষিক তত্ত্বের জন্য বিতর্কিত হয়। বিশেষত উগ্র ধর্মান্ধ খ্রিস্টান সম্প্রদায় থেকে ডারউইন এবং তার বিবর্তনবাদ ভয়ানক হিংস্র আক্রমণের শিকার হলো। কিন্তু বিবর্তনবাদের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি কীভাবে প্রথম প্রাণের বিকাশ সম্ভব হয়।


Darwin wondered if life began in a “warm little pond” (Credit: Linda Reinink-Smith/Alamy)

ডারউইন জানতেন প্রশ্নটা অতীব গুরুতর, কিন্তু তিনি যথাসম্ভব সতর্কভাবে শুরু করেছিলেন তবুও চার্চের সাথে দ্বন্দ্ব এড়ানো সম্ভব হলো না। ১৮৭১ সালে লেখা এক চিঠিতে তিনি বিবর্তনবাদ নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। আবেগমথিত ভাষায় তিনি বলতে চেয়েছিলেন, প্রাণের উৎপত্তি কীভাবে এই তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর তিনি জানেন। প্রাণ বিকাশের প্রথম অনুকল্পটি উদ্ভূত হয়েছিল একটি সর্বগ্রাসী বাকস্বাধীনতাহীন দেশে। কিন্তু যদি (ওহহ কী বিশাল একটা যদি) আমরা বুঝতে পারি তবে দেখতে পাবো একটা ছোট উষ্ণ পুকুরে থাকে পর্যাপ্ত এমোনিয়া এবং ফসফরাস লবণ সেই সাথে আলো, উত্তাপ, বিদ্যুৎ এবং রাসায়নিকভাবে স্বয়ং উদ্ভূত আমিষের জটিলযৌগ আরও জটিল পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

ভিন্নভাবে বলা যেতে পারে, কী ঘটেছিল যখন দীর্ঘদিন সাধারণ জৈব উপাদান একটা ছোট জলাভূমিতে সূর্যালোকে নিমজ্জিত ছিল। কিছু জৈব উপাদান হয়ত মিলেমিশে প্রাণের সদৃশ কোন বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছিল। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় সেখানে সৃষ্টি হয়েছিল আমিষ এবং আমিষ আরও জটিল কোন বস্তুতে পরিণত হচ্ছিল। হতে পারে অস্পষ্ট ধারণামাত্র। কিন্তু ভবিষ্যতে এই অস্পষ্ট ধারণার উপর ভিত্তি করে অনুমান করা সম্ভব প্রথম কীভাবে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল।

এই ধারণার আত্মপ্রকাশ ঘটে সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত স্থানে। আপনি হয়ত ভাবতে পারেন ঈশ্বরবিহীন প্রাণ বিকাশের মত সাহসী চিন্তা বিকশিত হয়েছে একটা গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে মানুষের বাক স্বাধীনতা সামাজিক ঐতিহ্যের অংশ। হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র? কিন্তু না, বাস্তব ঘটনা হলো অলৌকিকতাকে পাশ কাটিয়ে জীবনের উৎপত্তি নিয়ে প্রথম অনুমান করেন নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে যেখানে মুক্তিচিন্তা নিষিদ্ধ। তখন স্ট্যালিনের রাশিয়াতে সবকিছু রাস্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে। মানুষের চিন্তা, এমনকি পঠন পাঠনের বিষয় যা কিছু কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় সেটাও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। ওপারিন কল্পনা করতেন কেমন ছিল পৃথিবী যখন সবেমাত্র সৃষ্টি হলো?

সবথেকে আলোচিত ঘটনা ছিল স্ট্যালিন জীনতত্ত্বের প্রচলিত পঠন পাঠনের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের আরেক জীববিজ্ঞানী এবং কৃষিবিদ ট্রোফিম ডেনিশোভিচ লিসেঙ্কো জোসেফ মেন্ডেলের জিনতত্ত্ব এবং ডারউইনের বিবর্তনবাদকে বাতিল করে বংশপরম্পরার উপর জোর দেন। তিনি মনে করতেন প্রাণী তার জীবনের অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে সঞ্চারিত করে যায়। লিসেঙ্কো দেখালেন উন্নতজাতের গম থেকে উন্নত এবং অধিকফলনশীল কিভাবে উৎপাদন করা যায়। স্ট্যালিন কমিউনিস্ট ভাবধারার সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ ট্রোফিম ডেনিশোভিচ লিসেঙ্কোর মতবাদকে চাপিয়ে দেন। জীনতত্ত্ব নিয়ে যেসব বিজ্ঞানীরা কাজ করছিলেন তাদেরকে জনসাধারণের কাছে লিসেঙ্কোর মতবাদকে সমর্থন এবং প্রচার করতে বাধ্য করা হয়। অন্যথায় তাদের স্থান হতো লেবার ক্যাম্পে।

Alexander Oparin lived and worked in the USSR (Credit: Sputnik/Science Photo Library)

স্ট্যালিনের দমন নিপীড়নের শাসনের মধ্যেই আলেক্সান্ডার ওপারিন চালিয়ে যেতে লাগলেন তার জৈবরাসায়নিক গবেষণা। ওপারিন নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন কারণ তার কমিউনিজমের প্রতি সন্দেহাতীত আনুগত্য। ওপারিন লিসেঙ্কোর তত্ত্বকে সমর্থন দিলেন এবং দেশের সেবা করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের “অর্ডার অফ লেনিন” সর্বোচ্চ পুরষ্কারে ভূষিত হন।

১৯২৪ ওপারিন প্রকাশ করলেন “দ্য ওরিজিন অফ লাইফ” তার অমর গ্রন্থখানি। দ্য ওরিজিন অফ লাইফ বইতে ওপারিন প্রাণের বিকাশ অন্বেষণে যে প্রস্তবনা করেন সেটা ডারউইনের বিবর্তনবাদের “একটি ছোট উষ্ণ পুকুর” ধারণার সাথে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়। ওপারিন চিন্তা কল্পনা করেছিলেন কেমন ছিল সদ্য গঠিত পৃথিবীর চেহারা। পৃথিবীর উপরিভাগ ছিল কল্পনাতীত গরম, মহাকাশ থেকে খসে পড়া জ্বলন্ত পাথরের খণ্ড। পৃথিবী তখন ছিল বিভিন্ন ধরণের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থমিশ্রিত অর্ধগলিত পাথরের বিশৃঙ্খল স্তুপ। পদার্থগুলোর মধ্যে কার্বনের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশী।


Oceans formed once Earth had cooled down (Credit: Richard Bizley/Science Photo Library)

যদি আমরা অণুবীক্ষণযন্ত্রের নিচে কোয়াসারভেটিভ (জৈব রাসায়নিক দ্রবণ) পরীক্ষা করে দেখি তাহলে দেখব দ্রবণটি জীবিত কোষের মত আচরণ করছে। ধীরে ধীরে উত্তপ্ত পৃথিবী ঠাণ্ডা হচ্ছে, জলীয় বাস্প ঘনীভূত হয়ে প্রথম বৃষ্টি নামল পৃথিবীর বুকে, তরল পানিতে তলিয়ে গেল চরাচর। বৃষ্টি পড়ার আগেও সমুদ্র ছিল তবে সেটা প্রচণ্ড উত্তাপে গলিত কার্বননির্ভর ঘন তরল। এমতাবস্থায় দুইটা জিনিস ঘটতে পারে।

প্রথমত, বিভিন্ন রাসায়নিক নিজেদের মাঝে বিক্রিয়া করে অসংখ্য নতুন জটিল যৌগ সৃষ্টি করতে পারে। তাদের মধ্যে কিছু যৌগ আরও জটিল যৌগে পরিণত হবে। আলেক্সান্ডার ওপারিন ধারণা করেন রাসায়নিক দ্রব্যের ক্ষুদ্র মৌলগুলি প্রাণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। চিনি এবং এমাইনো এসিড পৃথিবীর পানি থেকেই উৎপত্তি হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, কিছু রাসায়নিক দ্রব্য নতুন আণুবীক্ষণিক অণুজীবের কাঠামো তৈরি করতে শুরু করে। কিছু অণুজীবের জৈবরাসায়নিক উপাদান পানিতে দ্রবীভূত হয় না। যেমন তেল পানির উপর আস্তরণ সৃষ্টি করে ভেসে থাকে। কিন্তু যখন কিছু জৈবরাসায়নিক উপাদান পানির সাথে মিশে যায় তখন গোলাকার “কোয়াসারভেটিভ” বস্তুর রূপ ধারণ করে যেগুলো আয়তনে .০১ সেমি বা (.০০৪) ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। অণুজীব বেড়ে ওঠে, তারা অবয়ব পরিবর্তন করে এমনকি মাঝেমাঝে তারা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তারা চারপাশের পানির রাসায়নিক দ্রব্যের সাথে বিক্রিয়ায় অংশ নেয়। এভাবেই জীবনসদৃশ রাসায়নিক উপাদান নিজেদের মাঝে সংগঠিত হতে থাকে। ওপারিন প্রস্তাব করেন কোয়াসারভেটিভ হলো আধুনিক জীবিত কোষের পূর্বপুরুষ।

ওপারিনের মতবাদে দেখা যাচ্ছে জীবিত অনুজীবের জন্ম হয়েছে পুরোপুরি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এখানে কোন ঈশ্বরের হাত নেই। এমনকি অলৌকিকভাবে জীবনী শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে এমন চিন্তাও প্রথাগত যার কোন ভিত্তি নেই।

পাঁচ বছর পরে ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী জন বারডন স্যান্ডারসন হালডেন একই মতবাদ নিয়ে র‍্যাশনালিস্ট অ্যানুয়াল জার্নালে একটা ছোট প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। হালডেন ইতিমধ্যেই বিবর্তনবাদে প্রভূত অবদান রেখে ফেলেছেন। তিনি ডারউইনের মতবাদকে বিকাশমান জীনতত্ত্বের আলোকে আরও সংহত করে।

রঙ্গমঞ্চে হালডেন তার জীবনের থেকেও বড় চরিত্র। একবার তিনি কানের পর্দায় ছিদ্রের চিকিৎসায় ডিকম্প্রেসন চেম্বারের অভিজ্ঞতার জন্য ডাক্তারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। কিন্তু পরে তিনি রম্য করে লিখেছিলেন, “কানের পর্দা সাধারণত প্রাকৃতিকভাবেই সুস্থ হয়ে যায়। যদি পর্দায় ছিদ্র থেকেই যায় এবং তারফলে কেউ যদি বধির হয়ে যায় তাহলে সে কারো ভ্রূক্ষেপ না করেই বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে পারবে যেটা হবে একটা সামাজিক অর্জন”।

ওপারিনের মত হালডেনও মতবাদ প্রচার করলেন, সমুদ্র প্রাথমিক অবস্থা থেকে স্থিতিশীল গরম ঘন তরলে পরিণত হলে কিভাবে সেখানের পানিতে রাসায়নিক অনুজীব নিজে থেকেই সৃষ্ট হতে পারে। পৃথিবীর এরকম পরিবেশে প্রথম জন্ম নেয় জীবনের অণুজীব অথবা অর্ধজীবন্ত বস্তু আর এরপরের স্তরে সৃষ্টি হয় স্বচ্ছ তেলতেলে জেলির মত থকথকে বস্তু।

কথিত আছে ওপারিন এবং হালডেন যে তত্ত্বের অবতারণা করেন পৃথিবীর সমস্ত জীববিজ্ঞানী সেগুলো ব্যক্ত করেন মাত্র। প্রাণের প্রথম বিকাশ ঘটেছে পুরোপুরি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এখানে কোন ঈশ্বরের হাত নেই। ডারউইনের বিবর্তনবাদের আগেও পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। ডারউইন সেটাকে যুক্তিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করেছেন কিন্তু এই তত্ত্ব খ্রিস্টবাদের ভিত্তিমূলে চরম কুঠারাঘাত।

ডারউইনের বিবর্তনবাদের একটাই সমস্যা ছিল। তার প্রচারিত বিবর্তনবাদকে নির্ভুল প্রমাণ করতে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার নিরিখে কোন প্রমাণ নাই। ঈশ্বরবিহীন সৃষ্টিতত্ত্ব সোভিয়েত ইউনিয়নে কোন সমস্যা নয় কারণ কমিউনিস্ট শাসিত সোভিয়েত রাষ্ট্রীয়ভাবেই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। সেজন্যই কমিউনিস্ট নেতারা প্রাণের উৎপত্তি গবেষণায় বস্তবাদী ব্যাখ্যাকে অকুন্ঠ সমর্থন জানায়। হাল্ডেন নিজেও ছিলেন একজন নাস্তিক এবং কমিউনিজমের কড়া সমর্থক।

তখনকার সময়ে বিবর্তনবাদ গৃহীত হবে নাকি বাতিল করবে সেটা নির্ভর করত প্রধানত ব্যক্তির ধর্ম বিশ্বাসী ব্যক্তিত্বের উপর। জীবনের উৎস অনুসন্ধান করা বিশেষজ্ঞ জীববিজ্ঞানী জার্মানির ওসনাব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আরমেন মালকিদজানিয়ান বলেন, বিবর্তনবাদ গৃহীত হবে কি হবে না নির্ভর করে মানুষেরা কি ধর্মে বিশ্বাস করে নাকি বাম ধারার কমিউনিজম সমর্থন করে সেটার উপর। সোভিয়েত ইউনিয়নে বিবর্তনবাদ সাদরে গৃহীত হয়েছে কারণ সেখানে ঈশ্বরের প্রয়োজন ছিল না। যদি পশ্চিমাবিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব সেখানের মানুষেরা অনেক বস্তুবাদী। তাদের চিন্তা বাম ঘেঁষা কমিউনিস্ট বা উদারপন্থার দিকে ধাবিত।

প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আদিম জৈবরাসায়নিক ঘন তরল সহযোগে এই ধারণাটি ওপারিন-হালডেন তত্ত্ব বলে ব্যাপক পরিচিত পেয়ে গেল। ওপারিন-হালডেন তত্ত্ব যুক্তির বিচারে গ্রহণযোগ্য হলেও তত্ত্বটির একটা সমস্যা ছিল। ওপারিন-হালডেন তত্ত্বকেও নির্ভুল করার স্বপক্ষে কোন গবেষণালব্ধ প্রমাণ নেই। পচিশ বছর পার হয়ে গেলেও তত্ত্বটির স্বপক্ষে কোন প্রমাণ দাড় করানো যায়নি।


The English geneticist J. B. S. Haldane (Credit: Science Photo Library)

সময়ের সাথে প্রাণের উদ্ভব গবেষণায় যোগ দেন ১৯৩৪ সালে রসায়নে নোবেল বিজয়ী আমেরিকান রসায়নবিদ। হ্যারল্ড উরে পারমাণবিক বোমা বানানোর দলেও কাজ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ম্যানহাটান প্রকল্পে পারমাণবিক বোমার অতি প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম ২৩৫ সমৃদ্ধ করতেন। যুদ্ধের পরে তিনি নিউক্লিয়ার প্রযুক্তিকে সুশীল সমাজের নিয়ন্ত্রণে দেয়ার জন্য আন্দোলন করেন। প্রফেসর উরে ধারণা করেছিলেন, আমদের পৃথিবী আদিম অবস্থায় সম্ভবত অ্যামোনিয়া, মিথেন এবং হাইড্রোজেনের মিশেলে পিণ্ডাকৃতির ছিল। এই মিশ্রণকে যদি বৈদ্যুতিক বিস্ফোরণ এবং পানির সংস্পর্শে আনা যায় তাহলে অ্যামাইনো এসিড উৎপন্ন করা সম্ভব। এটা সর্বজন বিদিত যে, অ্যামাইনো এসিড হলো জীবনের প্রথম উপাদান।

উরে এই সময়ে পৃথিবীর বাইরে মহাকাশ এবং মহাকাশের ভাসমান বস্তুকণার রসায়ন নিয়ে আগ্রহী হন বিশেষকরে দেখতে চেয়েছিলেন সৌরজগৎ যখন সবে সৃষ্টি হলো তখন ঠিক কী ঘটছিল। একদিন তিনি ক্লাসে বললেন সৃষ্টিলগ্নে পৃথিবীর বায়ুস্তরে সম্ভবত অক্সিজেনের অস্তিত্ব ছিল না। রাসায়নিক বিক্রিয়ার সংস্পর্শে অক্সিজেন হয়ত ধ্বংস হয়ে গেছে। উরের ক্লাস লেকচারের প্রস্তাবিত ‘অক্সিজেনবিহীন পৃথিবী’ ওপারিন এবং হালডেনের আদিম জৈবরাসায়নিক ঘন তরল ধারণাকে আরও বেগবান করে। প্রফেসর হ্যারল্ড উরের ক্লাসে উপস্থিত ছিলেন পিএইচডি’র গবেষণারত ছাত্র স্ট্যানলি মিলার। মিলার প্রফেসর উরেকে প্রস্তাব দেন পরীক্ষা করে দেখার আসলেই কেমন ছিল সেদিনের সৌরজগতের পরিবেশ। উরে নিজের ক্লাস লেকচারের উপর কিছুটা সন্দেহ পোষণ করলেও মিলার অক্সিজেনবিহীন পৃথিবীর চিন্তায় মনোনিবেশ করলেন। তাদের মাঝে বিস্তর আলোচনার পরে ১৯৫২ সালে প্রফেসর উরে এবং তার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্ট্যানলি লয়েড মিলার যৌথভাবে প্রথমবারের মত প্রাণের খোঁজে বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাত ‘উরে-মিলার এক্সপেরিমেন্ট’ পরীক্ষা শুরু করলেন।

The Miller-Urey experiment (Credit: Francis Leroy, Biocosmos/Science Photo Library)

পরীক্ষার যন্ত্রপাতি খুব সাধারণ। মিলার পূর্বের আলোচিত ধারণা অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্নের চারটি রাসায়নিক উপাদান গরম পানি, হাইড্রোজেন গ্যাস, অ্যামোনিয়া এবং মিথেন চারটি কাঁচের জারে পূর্ণ করে তাদের মাঝে সংযোগ করে দিলেন। কাঁচের গ্লাসের মাঝে মিলার বারবার তড়িৎপ্রবাহ দিতে লাগলেন যাতে বজ্রপাত ঘটে। আদিকালে পৃথিবীতে বজ্রপাতের ঘটনা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক।  এই পরীক্ষার মাধ্যমে খুব সাধারন পরিবেশেই প্রচুর পরিমাণ জৈব অনু উৎপাদন সম্ভব। মিলার দেখতে পেলেন প্রথমদিনেই কাঁচের জারের মধ্যকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গোলাপী আভা ধারন করেছে এবং সপ্তাহ শেষে ঘন তরল দ্রবণটি গাঢ় লাল হয়ে গেল। পরিষ্কার বোঝা গেল জারে জৈব রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ তৈরি হয়েছে।

মিলার পরীক্ষাগারে বিশ্লেষণ করে মিশ্রণটিতে গ্লাইসিন এবং আলানাইন নামে দুইটা অ্যামাইনো এসিড পেলেন। অ্যামাইনো এসিডকে জীবন সৃষ্টির প্রাথমিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং অ্যামাইনো এসিড আমিষ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আমিষ আমাদের শরীরের শারীরবৃত্তিক এবং জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মিলার গবেষণাগারে জন্ম দিলেন প্রাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।  মিলারের গবেষণার ফলাফল বিখ্যাত সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হলো ১৯৫৩ সালে। প্রাণের বিকাশ অভিযানে ‘উরে-মিলার এক্সপেরিমেন্ট’ স্মরণীয় ঘটনা। উদার প্রফেসর উরে এই গবেষণার সমুদয় কৃতিত্ব মিলারকে দিয়ে আর্টিকেল থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞানের গবেষক জন সাদারল্যান্ড বলেন, “উরে-মিলার পরীক্ষার শক্তি এখানেই যে, আপনি সাধারণ পরিবেশে প্রচুর অণুজীব সৃষ্টি করতে পারবেন”। জীবন আরও জটিল যা আমরা চিন্তা করি তার থেকেও বেশি।

পরবর্তীতে আরও গবেষণায় পৃথিবী সৃষ্টির আদিতে অন্যান্য গ্যাসের মিশ্রণও ছিল আবিষ্কারের কারণে আগের গবেষণা ভুল প্রমানিত হয়। কিন্তু সেটা নিয়ে সম্পূরক আলোচনা হতে পারে। জন সাদারল্যান্ড বলেন, “উরে-মিলার পরীক্ষা ছিল দৃষ্টান্ত, তারা মানুষের কল্পনা জাগাতে পেরেছিলেন এবং প্রাণের উৎস সন্ধানে ব্যাপকভাবে চর্চা করতে থাকে”। মিলারের পরীক্ষার প্রভাবে অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও এগিয়ে এলেন ভিন্ন ভিন্ন মৌল থেকে অনুজীব সৃষ্টির গবেষণা করে প্রাণের উৎস সন্ধানে। প্রাণের রহস্য উন্মোচনের হাতছানি মনে হয় সন্নিকটে। এতদিনে পরিষ্কার হওয়া গেছে জীবন এত জটিল যে আমাদের চিন্তাকে বিহ্বল করে দেয়। অবশেষে জানা গেল জীবন্ত কোষ শুধুমাত্র কিছু রসায়নের জটিল যৌগ নয় জীবন হলো সূক্ষ্ম শিল্পিত যন্ত্রবিশেষ। হঠাৎ করে সম্পর্কহীন বস্তু থেকে নিজেকে সৃষ্টি করে নিজেই আবার বড় বাধা অতিক্রম করে ছুটে যায় নতুন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানীদের বুঝে ওঠার আগেই।


The machinery inside cells is unbelievably intricate (Credit: Equinox Graphics Ltd)

দ্বিতীয় পর্ব

বিজ্ঞান সভায় বিভাজন

১৯৫০ সালের শুরুর দিকে বিজ্ঞানীগণ আমাদের জীবন ঈশ্বরের দান বহুদিনের পুরনো বাসি ধারণা থেকে সরে আসতে থাকে। তার পরিবর্তে তারা সম্ভাবনাময় জীবন কীভাবে নিজে নিজেই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হলো সেই রহস্য উন্মোচনে আগ্রহী হয়ে উঠল। এবং যুগান্তকারী পরীক্ষার জন্য অবশ্যই স্ট্যানলি মিলারকে ধন্যবাদ। বিজ্ঞানীগণ জীবন অন্বেষণে মিলারের পরীক্ষা থেকে ভবিষ্যৎ গবেষণার রশদ পেয়ে গেলেন।

মিলার যখন ভিন্ন ভিন্ন বস্তু থেকে জীবনের উপাদান বানাতে ব্যস্ত তখন কিছু বিজ্ঞানী জীন  কিসের তৈরি খুঁজতে গবেষণারত। ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানীগণ অনেকগুলো অনুজীবকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। চিনি, চর্বি, আমিষ, নিউক্লিক এসিড যেমন ডিঅক্সিরিবোনিউক্লিক এসিড বা সংক্ষেপে ডিএনএ আবিষ্কার হয়ে গেছে এতদিনে। ২০শতক হলো আবিষ্কারের স্বর্ণযুগ। বিজ্ঞানের বড় বড় আবিষ্কারগুলো এই শতাব্দীতেই ঘটেছে।

আজকে আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি ডিএনএ আমাদের জীন বহন করে। কিন্তু ডিএনএ আবিষ্কার ১৯৫০ দশকের বিজ্ঞানীদের জন্য একটা আঘাত কারণ আমিষের জটিল গঠন দেখে তারা আমিষকেই জীন ভেবেছিলেন। ১৯৫২ সালে আলফ্রেড হারশে এবং মার্থা চেস বিজ্ঞানীদের ভুল ভেঙ্গে দেন। তারা ওয়াশিংটনের কার্নেজি ইনস্টিটিউটে শুধু প্রোটিন আর ডিএনএ বহনকারী ক্ষুদ্র ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন। পুনোরুৎপাদনের জন্য ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার মাঝে সংক্রামিত হয়। পরীক্ষায় আলফ্রেড হারশে এবং মার্থা চেস জানতে পারলেন সংক্রামক ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে প্রবেশ করেছে কিন্তু প্রোটিন বাইরেই রয়ে গেল। পরিষ্কার বুঝা গেল, ডিএনএ হলো জীনের উপাদান।

হারশে এবং মার্থা চেস’র পরীক্ষার ফলাফল ডিএনএ কীভাবে কাজ করে এবং কেমন তার গঠন আবিষ্কারের গবেষণায় তোলপাড় সৃষ্টি করে দিলো। পরের বছর ডিএনএ রহস্যের সমাধান করে ফেললেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ফ্রান্সিস ক্রিক এবং জেমট ওয়াটসন। দীর্ঘ পরিশ্রমসাধ্য গবেষণায় তাদেরকে সাহায্য করে রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন। ২০শতকের আবিষ্কারগুলো জীবনের উৎস অন্বেষণের পথে নতুন মাত্রা যোগ করে। আবিষ্কৃত হতে থাকে জীবন্ত কোষের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা অবিশ্বাস্য জটিলতা।


James Watson and Francis Crick with their model of DNA (Credit: A. Barrington-Brown/Gonville and Caius College/Science Photo Library)

ক্রিক এবং ওয়াটসন বুঝতে পেরেছিলেন ডিএনএ হলো দুইটা প্যাচানো মইয়ের সদৃশ বস্তু যারা আবার নিজেদের মধ্যেও সর্পিল আকৃতিতে জড়িয়ে থাকে। প্যাচানো মইয়ের দুই প্রান্ত নিউক্লিওটাইড নামের মলিকিউল দ্বারা গঠিত। আমার আপনার এবং আমাদের সবার জীন এসেছে ব্যাকটেরিয়া নামের আদিপিতা থেকে। ডিএনএ’র গঠন ব্যাখ্যা করে কিভাবে আমাদেরকে কোষ ডিএনএকে অনুসরণ করে। অন্যভাবে বলা যায়, ডিএনএ উন্মোচন করে কিভাবে বাবা-মা তাদের জীনের প্রতিলিপি তৈরি করে এবং পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। এখানের মূল আলোচ্য বিষয় হলো, এখন প্যাচানো দুই সর্পিল মইয়ের রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব। তখন আমরা জানতে পারি জীবের বংশগতির ধারা যা তৈরি হয়েছে জীবের বংশপরম্পরায়। বংশগতির ধারাকে আমরা এ, টি সি এবং জি দিয়ে চিহ্নিত করতে পারি। বংশগতির ভিত্তি সাধারণত ডিএনএ’র সর্পিল মইয়ের মধ্যে সুরক্ষিত অবস্থায় থাকে এবং প্রতিলিপি তৈরির প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।

এই একই প্রক্রিয়ায় বংশগতি জীবনের শুরু থেকেই বাবা-মা তাদের সন্তানদের মাঝে জীবনের বৈশিষ্ট্য প্রবাহিত করতে থাকে। ক্রিক এবং ওয়াটসন আবিষ্কার করেন ব্যাকটেরিয়া থেকে কিভাবে ধাপে ধাপে বংশগতির প্রতিলিপি তৈরি করে প্রাণী আজকের অবস্থানে চলে এসেছে।

ক্রিক এবং ওয়াটসন ১৯৫৩ সালে তাদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান “নেচার”বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করেন। ক্রিক এবং ওয়াটসনের আবিষ্কারের ফলে পরের বছরগুলোতে জৈবরাসায়নিক বিজ্ঞানীগণ ডিএনএ ঠিক কী তথ্য বহন করে সেটার আদ্যপান্ত খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তারা দেখতে চাইলেন কীভাবে DNA তে সংরক্ষিত তথ্য জীবন্ত কোষে ব্যবহৃত হয়। জীবনের অভ্যন্তরে লুকায়িত গোপন খবর প্রথমবারের মত প্রকাশের পথে। তখন হঠাৎ করে বিজ্ঞানীদের কাছে ওপারিনের ধারণাকে মামুলি সাদাসিধা।

আবিষ্কার হয়ে গেল DNA ’র মাত্র একটাই কাজ। আপনার ডিএনএ আপনার কোষদেরকে বলে দেয় কীভাবে প্রোটিন তৈরি করতে হবে। প্রোটিন সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে মলিকিউল। প্রোটিন ছাড়া আপনি খাদ্য হজম করতে পারবেন না, আপনার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাবে এবং আপনি নিশ্বাস নিতে পারবেন না।

DNA থেকে প্রোটিন উৎপন্নের জটিল প্রক্রিয়া দেখলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। যে কারো পক্ষে জীবনের উৎস কী ব্যাখ্যা করতে যাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ল কারণ এত জটিল প্রক্রিয়া কীভাবে একা একা শুরু হয়েছিল সেটা বিজ্ঞানীগণের চিন্তার জন্যও দুরূহ। প্রতিটি প্রোটিনই মূলত অ্যামাইনো এসিডের বিশাল শিকল একটা বিশেষ শৃঙ্খলার বাঁধনে তারা পারস্পারিক আবদ্ধ। অ্যামাইনো এসিডের ক্রম নির্ধারণ করে দেয় প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক আকার এবং এভাবেই প্রোটিন কাজ করে। সর্পিল DNA’র অভ্যন্তরে প্রাণের প্রয়োজনীয় তথ্য সাংকেতিক আকারে লিপিবদ্ধ থাকে। সুতরাং যখন একটা কোষকে কোন নির্দিষ্ট প্রোটিন সৃষ্টি করতে হয় তখন সে অ্যামাইনো এসিডের শিকলের নাগাল পেতে DNA’র মধ্যে সংরক্ষিত জীন থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য বিশ্লেষণ করতে শুরু করে।

কিন্তু এখানেও একটা প্যাচ আছে। DNA জীবনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই কোষ DNA কে সংরক্ষণ করতে নিরাপদে জমিয়ে রাখে। এই কারণে কোষ DNA’র তথ্যকে প্রতিলিপি করে RNA (রাইবোনিউক্লিক এসিড) মলিকিউলে স্থানান্তর করে। DNA যদি পাঠাগারের বই ধরি তাহলে RNA  হবে গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ লেখা ছেঁড়া কাগজের সমষ্টি। DNA’র তুলনায় RNA ছোট। সর্পিল মইতে RNA’র একটামাত্র সুতোর মত প্রান্ত। এপর্যায়ে RNA’র মধ্যে সংরক্ষিত তথ্য প্রোটিনে পরিণত হয় এবং প্রচুর পরিমাণ ‘রাইবোসোম’ মলিকিউল গঠন করে।

প্রতিটি জীবিত কোষে এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এমনকি অতি সাধারণ ব্যাকটেরিয়াও এই প্রক্রিয়ার বাইরে নয়। খাদ্যগ্রহণ এবং অবিরাম নিঃশ্বাস প্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়া জীবনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রাণের উৎস ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদের অবশ্যই DNA, RNA, রাইবোসোম এই তিন প্রোটিনের জটিল মিথস্ক্রিয়া বুঝতে হবে। কীভাবে তাদের উৎপত্তি হলো, কেমন করেই বা তারা পরস্পর কাজ শুরু করে।


Cells can become enormously intricate (Credit: Russell Kightley/Science Photo Library)

হঠাৎ করেই ওপারিন এবং হালডেনের ধারণা নিতান্ত সাদামাটা প্রতীয়মান হয়ে গেল। একই সাথে মিলারের যে যুগান্তকারী পরীক্ষার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়েছিল অ্যামাইনো এসিড যা দিয়ে প্রোটিন সৃষ্টি সম্ভব সেটাকেও মনে হলো অসম্পূর্ণ এবং ভাসাভাসা। কীভাবে জীবন সৃষ্টি হয়েছিল সেই প্রশ্নের উত্তর থেকে এখনো আমরা অনেক দূরে। মিলারের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ছিল সৃষ্টি রহস্য উন্মোচনের দীর্ঘ যাত্রাপথের সূচনামাত্র। জীবন গঠিত হয়েছিল RNA দিয়ে এই ধারণা এখন প্রভূত প্রমাণিত এবং বিজ্ঞানে খুব প্রভাবশালী তত্ত্ব।

জন সাদারল্যান্ড বলেন, “DNA সৃষ্টি করে RNA এবং RNA সৃষ্টি করে প্রোটিন যা লিপিড হিসেবে মুখ আটকানো রসায়নের থলের মধ্যে থাকে। আপনি যদি DNA, RNA এবং লিপিডের দিকে তাকাই তাহলে এর জটিলতা দেখে বিস্ময়ে আপনার মুখ হা হয়ে যাবে। কীভাবে আমরা খুঁজে পাবো

অন্যান্য বিজ্ঞানীগণকে যদি ধরি প্রাণের উৎস গবেষণার রাস্তা তৈরি করেছেন তাহলে ব্রিটিশ রসায়নবিদ লেজলি ওরগেলকে বলতে হবে প্রথম বিজ্ঞানী যিনি সেই রাস্তায় যাত্রা শুরু করেন। লেজলি ওরগেলই প্রথম ক্রিক এবং ওয়াটসনের DNA’র মডেল নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পরে তিনি মঙ্গলগ্রহে রোবটিক যান পাঠাতে নাসা’র ভাইকিং প্রোগ্রামে সাহায্য করেছিলেন। ওরগেল প্রাণের উৎস কী এই বৈজ্ঞানিক জিজ্ঞাসাকে চিহ্নিত করলেন। ১৯৬৮ সালে লিখিত এক গবেষণাপত্রে তিনি দাবি করেন জীবনের শুরুতে প্রোটিন বা DNA কিছুই ছিলনা। জীবন সৃষ্টি হয়েছিল পুরোপুরি RNA দিয়ে এবং ফ্রান্সিস ক্রিক ওরগেলের এই দাবীকে সমর্থন দেন।

ওরগেলের দাবী যদি সঠিক হয় তাহলে আদিম RNA মলিকিউলকে অবশ্যই অভিযোজন ক্ষমতা থাকতে হবে এবং তারা নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করবে। ধারণা করা হচ্ছে সম্ভবত DNA  একই প্রক্রিয়া কাজ করে।

জীবন গঠিত হয়েছিল RNA দিয়ে এই ধারণা এখন প্রভূত প্রমাণিত হয়েছে এবং বিজ্ঞানে খুব প্রভাবশালী তত্ত্ব। কিন্তু জন্ম দিয়েছে বৈজ্ঞানিক তর্কযুদ্ধের যা অবধি চলছে।

জীবন শুরু হয়েছিল RNA দিয়ে দাবী করেই ওরগেল ক্ষান্ত হননি, তিনিই সবার আগে প্রস্তাব করেন RNA নিজেকে নিজেই পুনরুৎপাদন করতে পারে যা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। অন্যভাবে বলা যায় তিনি শুধু জীবন কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল সেটাই বলেননি, জীবন কী এই প্রশ্নেরই সমাধান তিনি করে ফেলেছেন। এ পর্যায়ে বিজ্ঞানীগন প্রাণের জন্ম রহস্য নিয়ে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেলেন।


DNA is at the heart of almost every living thing (Credit: Equinox Graphics Ltd)

অনেক জীববিজ্ঞানী ওরগেলের ‘প্রাণ নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করে’ দাবীর সাথে সহমত পোষণ করলেন। ডারউইনের বিবর্তনবাদের সারাংশ ছিল নিজের অসংখ্য প্রতিলিপি বা সন্তান জন্মদানের মাধ্যমেই শুধু প্রাণী নিজের বংশ রক্ষা করতে পারে। কিন্তু জীবনের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো যেমন জীবন বেঁচে থাকার জন্য একটি জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে ঘটতে থাকা রাসায়নিক প্রক্রিয়া। বেঁচে থাকতে হলে চারিপাশের পরিবেশ থেকে শক্তি সঞ্চয় করতে হয়। অনেক জীববিজ্ঞানী মনে করেন জীবনের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো জীবনের অভ্যন্তরীণ চলমান রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং জীবের নিজের প্রতিলিপি উদ্ভব হয়েছে অনেক পরে। এখানেই বিতর্কের শুরু। ১৯৬০ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীগণ জীবনের উত্থান গবেষণায় দুই সলে বিভক্ত। সাদারল্যান্ড বলেন, “জীবনের অভ্যন্তরীণ চলমান রাসায়নিক প্রক্রিয়া নাকি বংশগতি প্রথম” প্রশ্নই বিজ্ঞানীগণের নতুন দুই প্রান্তে বিভাজন। তাই বিজ্ঞান সভা মাঝে মাঝেই দ্বিধা বিভাজনের তর্কে পর্যবসিত হয়। ততদিনে তৃতীয় একদল বিজ্ঞানী প্রচার করলেন প্রথমে মলিকিউলের ধারকের জন্ম হয়েছে কারণ তারা ছিল তখন ভাসমান। জীবন সৃষ্টিতে কোষের উপাদানগুলোকে জড়ো করতে হয়েছে। কোষের উপাদানগুলো ছাড়া অভ্যন্তরীণ চলমান রাসায়নিক প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব নয়। সাদারল্যান্ড বলেন, প্রাণ সৃষ্টিতে কোষের প্রয়োজন যে কথা ওপারিন এবং হালডেন কয়েক দশক আগেই জোরালোভাবে বলে গেছেন। সম্ভবত জীবনের প্রথম কোষ চর্বি জাতীয় স্বচ্ছ তরল পর্দায় আবৃত ছিল।

জীবন বিকাশের এই তিনটা গবেষণা এবং তর্কালোচনার স্বপক্ষে বিপক্ষে অনেক বিজ্ঞানী আছেন এবং অদ্যাবধি আলোচনা চলছে। বিজ্ঞানীগণ নিজেদের ধারণার স্বপক্ষে নিরন্তর গবেষণা করেছেন এমনকি অনেক সময় অন্ধভাবে স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করছে। প্রায়ই দেখা যায় একদন বিজ্ঞানী আত্মপক্ষ সমর্থন করে অন্য বিজ্ঞানীগণকে নির্বোধ বলতেও দ্বিধা করছে না। ফলে জীবনের উৎস নিয়ে বিজ্ঞান সভার বিতর্ক সাংবাদিকদের পত্রিকার চটকদার কলাম আর সাধারণ পাঠকদের মুখরোচক গল্পে পরিণত হয়েছে। ওরগেলকে ধন্যবাদ। তিনি প্রথম ধারণা দিলেন বংশগতি নয় বরং জীবন গঠিত হয়েছিল RNA দিয়ে। তারপর এলো ১৯৮০ দশক, বিজ্ঞানের চমক লাগানো আবিষ্কারের যুগ এবং পাওয়া হওয়া গেল কীভাবে জীবনের জন্ম প্রশ্নের অমীমাংসিত উত্তর।


RNA could be the key to life’s beginning (Credit: Equinox Graphics Ltd)

চলবে…

অনুবাদক – বিকাশ মজুমদার 

মূল প্রবন্ধ: The secret of how life on earth began




পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি -প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব

পৃথিবীর প্রতিটি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে আজ প্রাণ প্রতিষ্ঠিত কিন্তু পৃথিবী যখন সৃষ্টি হয় তখন পৃথিবী ছিল মৃত উষর গলিত পাথর। তাহলে কীভাবে জীবনের শুরু? সচারচার এমন প্রশ্ন খুবই কম লোকেই জিজ্ঞেস করে থাকে। মানব ইতিহাসের বেশিরভাগ পাতা জুড়ে লেখা আছে এবং প্রায় সবাই বিশ্বাস করে কোন না কোন ঈশ্বর আমাদের অতিপ্রিয় জীবনটা এক ফুঁৎকারে বানিয়ে দিয়েছেন। কিছুদিন আগেও ঈশ্বরব্যতীত অন্যকোন ব্যাখ্যা ছিল মানুষের চিন্তারও বাইরে।

ঈশ্বর জীবনের জন্ম দিয়েছেন কথাটা এখন আর সত্য নয়। বিগত শতাব্দী ধরে কিছু বিজ্ঞানী কীভাবে প্রথম প্রাণের বিকাশ হয়েছিল খুঁজতে নিরন্তর গবেষণা করে গেছেন এবং গবেষণা বর্তমানেও চলছে। এমনকি বিজ্ঞানীগণ পরীক্ষাগারে সৃষ্টির আদিতে যেমন পরিবেশ ছিল কৃত্রিমভাবে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করে নিঃস্ব অবস্থা থেকে সম্পুর্ণ নতুন প্রাণের জন্ম দিয়েছেন।

যাকিছু অগ্রগতি হয়েছে সেটা কোন একক প্রচেষ্টা নয় কিন্তু আমরা দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এসেছি। আজকে অনেক বিজ্ঞানীই প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে অধ্যয়ন করছেন এবং তারা আত্মবিশ্বাসী যে তারা সঠিক পথেই আছেন এবং তাদের আত্মবিশ্বাস দাঁড়িয়ে আছে বহুদিনের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। এটা হলো আমাদের উৎপত্তির প্রকৃত উৎস আবিস্কারের কাহিনী। আধুনিক বিজ্ঞানের কিছু যুগান্তকারী আবিষ্কারকে ঘিরে আবর্তিত প্রাণের সৃষ্টি রহস্য গল্পটি মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ, সংগ্রাম এবং অসাধারণ সৃষ্টিশীলতায় পরিপূর্ণ। প্রাণের সৃষ্টিলগ্ন খুঁজতে মানব মানবীকে যেতে হয়েছে আমাদের পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় কোনায় এবং সহ্য করতে হয়েছে অবর্ণনীয় কষ্ট। কিছু বিজ্ঞানী নিযুক্ত ছিলেন অতি দানবীয় গবেষণা এবং পরিশ্রমে, পক্ষান্তরে কোন কোন বিজ্ঞানীকে কাজ করতে হয়েছে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী সরকারের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে।  

প্রথম পর্ব

পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তির গল্প

Dinosaurs actually lived quite recently (Credit: Oleksiy Maksymenko/Alamy)

প্রাণ অনেক পুরনো। ডায়নোসর সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত বিলুপ্ত প্রাণী এবং প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে তারা দোর্দণ্ড প্রতাপে টিকে ছিল। কিন্তু প্রাণের জন্ম খুঁজতে আরও সুদূর অতীতে যেতে হবে। আমাদের চেনাজানা সবচেয়ে পুরনো জীবাশ্মের বয়স প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন বছর যা কিনা সবচেয়ে পুরনো ডায়নোসরের থেকেও ১৪ গুণ বেশি পুরনো। কিন্তু জীবাশ্মের প্রাপ্ত বয়স হয়ত আরও অতীতের হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ২০১৬ সালের আগস্টে গবেষকগণ ৩.৭ বিলিয়ন বছর আগের আণুবীক্ষণিক অনুজীবের ফসিলের সন্ধান পেয়েছেন।

পৃথিবী নিজে এত বেশি পুরনো নয়, এইতো গঠিত হয়েছিল ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে। যদি আমরা ধারণা করি প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল এই পৃথিবীতেই তাহলে সেটা যুক্তিপূর্ণ এবং অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়। আমাদের জানামতে আমরা অন্যকোথাও প্রাণের অস্তিত্ব পাইনি। সংরক্ষিত পুরনো জীবাশ্ম পরীক্ষা করে বোঝা যায় যা কিছু ঘটেছে সেটা পৃথিবী গঠনের পরে এবং ৪.৫ বিলিয়ন বছরের মধ্যে। একই সাথে আমরা যদি প্রাণের বিকাশ মুহুর্তের কাছাকাছি চলে যাই তাহলে প্রকৃতপক্ষেই সৃষ্টিলগ্নে কেমন ছিল তার আধুনিক ধারণা পাবো।

The tree of life: most of the branches are bacteria (Credit: Hug, Banfield et al, Nature Microbiology)

১৯ শতক থেকেই জীববিজ্ঞানীগণ জানেন সব ধরণের জীবিতস্বত্বাই ‘কোষ’ দ্বারা গঠিত যা মূলত বিভিন্ন রকম এবং আকারের অতি ক্ষুদ্র জীবিত বস্তুকণার সমষ্টি। ১৭ শতকে আধুনিক অনুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের পরে প্রথম কোষের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু কোষ থেকেই জীবনের উৎপত্তি সেটা বুঝতে প্রায় এক শতাব্দী সময় লেগেছে। বিজ্ঞানীগণ জানতে পেরেছেন আমাদেরকে একটা কোষ সৃষ্টি করতে হলে ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর পরিবেশগত অবস্থা এবং উপাদান লাগবে।

একজন মানুষ হয়ত দেখতে একটা কইমাছ বা টাইরানোসোরাস রেক্স এর মত নয় কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের গভীর পর্যবেক্ষণে আমরা দেখতে পাবো সবপ্রাণীর দেহ প্রায় একই রকম কোষদ্বারা গঠিত। এমনকি বৃক্ষলতা, অণুজীব বা মাশরুম ইত্যাদি একই উপাদানে তৈরি। প্রাণীজগতের বেশিরভাগ প্রাণীই আণুবীক্ষণিক যাদের প্রায় সবাই একটা মাত্র কোষ দিয়ে গঠিত। ব্যাকটেরিয়া এককোষী প্রাণীদের মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত অতিপ্রজ এবং পৃথিবীর সর্বত্র পাওয়া যায়।

২০১৬ সালের এপ্রিলে বিজ্ঞানীগণ একটা সেমিনারে ‘প্রাণের বংশলতিকা’র’ সর্বশেষ আধুনিক সংস্করণ উপস্থাপন করেন যেখানে সব ধরণের জীবিত প্রাণীকে বংশলতিকায় পর্বের মাধ্যমে দেখানো হয়। প্রাণীপর্বের প্রায় সব শাখাতেই ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য। তদুপরি, প্রাণীর বংশলতিকা দেখে মনে হয় সব জীবের আদিপিতা হলো ব্যাকটেরিয়া। অন্যভাবে বলা প্রতিটি জীবিত প্রাণ এমনকি আপনি নিজেও প্রকৃতপক্ষে ব্যাকটেরিয়ার বংশধর। অর্থাৎ, আমরা এখন জীবনের উৎস কোথায় এই প্রশ্নের আরও যথাযথা উত্তর নিশ্চিত করতে পারবো। একটা কোষ তৈরি করতে আমাদের প্রয়োজন হবে ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগেকার পৃথিবীর উপাদান এবং প্রাণ বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ। তাহলে, প্রাণ সৃষ্টি কত দুরূহ ব্যাপার হবে?

A complete living cell (Credit: Equinox Graphics Ltd)

প্রথম অধ্যায়ঃ প্রথম গবেষণামূলক পরীক্ষা 

সমগ্র ইতিহাসজুড়ে, প্রাণের বিকাশ কীভাবে শুরু হয়েছিল এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনীয়তা কখনো বিবেচিত হয়নি। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে উত্তর তো আগে থেকেই সুনির্দিষ্ট। ১৮০০ শতকের আগে মানুষ বিশ্বাস করতো, প্রাণের উৎস এবং বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে তার পুর্ব শারীরিক এবং রাসায়নিক শক্তির মিথস্ক্রিয়া। এটি ছিল মানুষের সহজাত ধারণা যে সমস্ত জীবন্ত অস্তিত্ব সর্বশক্তিমানের একটি বিশেষ উপহার এবং অলৌকিকতার সাথে সম্পৃক্ত ছিল যা তৈরি হয়েছিল কোন প্রাণহীন পদার্থ থেকে। জীবন সৃষ্টিকারী রাসায়নিক উপাদানগুলো সবই সরল রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়াতে জন্ম নিলেও জীবনের সাথে সেই রাসায়নিক উপাদানগুলোর কোন সম্পর্ক নেই। অলৌকিকভাবে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে এই বিশ্বাস ধর্মবিশ্বাসের সাথে মিলে মিশে ফুলে ফলে পল্লবে শাখায় শাখায় বিকশিত হয়েছে। বাইবেলে বলা হয়েছে প্রথম মানবকে জীবন দান করতে ঈশ্বর তার মুখে ফুঁ দিয়েছিলেন এবং চির অজর অমর আত্মা প্রাণীর দেহে অলৌকিকভাবে বিরাজিত থাকে।

ধর্মীয় তত্ত্বের একটাই সমস্যা ছিল। অলৌকিকতা হলো নির্জলা ভুল ধারণা। ১৮০০ শতকের শুরুর দিকে বিজ্ঞানীগণ এমন কিছু বস্তুর সন্ধান পেলেন যেগুলো মনে হচ্ছিল জীবনের জন্য অনন্য উপাদান। সেইসব উপাদানের মধ্যে ইউরিয়া অন্যতম যা পাওয়া গিয়েছিল মূত্রের মধ্যে এবং ১৭৯৯ সালে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানের যা কিছু অর্জন ছিল সেটা অলৌকিকতার সাথে বেশি মানানসই। শুধু জীবিত প্রাণই এই ধরণের রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন করতে পারে সুতরাং ধারণা করা হয় ইউরিয়ার মধ্যে জীবনের শক্তি সঞ্চিত ছিল এবং এই কারণেই সেই বস্তুগুলো ছিল অন্যদের তুলনায় বিশেষ কিছু।

The German chemist Friedrich Wöhler, in a lithograph by Rudolf Hoffmann from 1856

কিন্তু ১৮২৮ সালে জার্মান রসায়নবিদ ফ্রেডরিখ ভোলার একটা সাধারণ রাসায়নিক দ্রব্য আমোনিয়াম সায়ানেট থেকে ইউরিয়া উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন যার সাথে জীবিত প্রাণের কোন যোগসূত্রতাই ছিল না। অন্যান্য বিজ্ঞানীগণও এগিয়ে এলেন ফ্রেডরিখ ভোলারের পথ অনুসরণ করে এবং কিছুদিনের মধ্যেই বিজ্ঞানীগণ বুঝতে পারলেন, প্রাণের সাথে কোন সম্পর্ক নাই এমন সাধারণ নিরীহ রাসায়নিক দ্রব্য দিয়েও রসায়নে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

বিজ্ঞানের গবেষণায় প্রাণ বিকাশে অলৌকিকতার স্থান এখানেই সমাপ্তি। কিন্তু মানুষ মনের গভীরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রাণ বিকাশের ঐশ্বরিক ধারণা এত সহজে দূর করতে পারে না। অনেকেই বলতে থাকে, রসায়ন থেকে প্রাণ সৃষ্টির মধ্যে বিশেষত্ব কিছু নেই বরং তাদের কাছে মনে হয় রোবটে প্রাণের মত ইন্দ্রজাল যা আমাদেরকে আসতে আসতে যন্ত্রে পরিণত করছে। এবং এটা অবশ্যই বাইবেলের সাথে সাংঘর্ষিক।

দশকের পর দশক জীবনের উৎস কোথায় এই রহস্য অবহেলিত থেকে গেছে। এমনকি বিজ্ঞানীগণ পর্যন্ত প্রাণ সৃষ্টির অলৌকিকত্বকে রক্ষা করতে রীতিমত মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন। যেমন ১৯১৩ সালের শেষ নাগাদ ব্রিটিশ জৈবরসায়নবিদ বেঞ্জামিন মূর ‘জৈব শক্তি’ নামে একটা তত্ত্বের অবতারণা করেন যেটা আসলে নতুন মোড়কে অলৌকিকতা প্রচারের প্রবল চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়। বেঞ্জামিন মূরের ‘জৈব শক্তি’ তত্ত্বে আবেগের প্রাধান্যও যথেষ্ট ছিল। বর্তমানে মূরের ‘জৈব শক্তি’ তত্ত্ব অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন বহু বহু বিজ্ঞানের কল্প-গল্পে দেখা যায় একজন মানুষের জীবনী শক্তি বাড়ানো সম্ভব অথবা জীবনী শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। ইংল্যান্ডের একটা টিভি সিরিয়াল ‘ডক্টর হু’ এর মধ্যে একটা চরিত্র টাইম লর্ডস জীবনী শক্তি নবায়নের চিন্তা করেন যেখানে দেখা যায় শক্তি বাড়ানো হচ্ছে, যদি ধীরেও প্রবাহিত হয় তবুও সে শীর্ষে পৌঁছে যাবে। বৈজ্ঞানিক কল্প-গল্পটিকে অভিনব মনে হলেও বাস্তবে এটা অতিপুরনো একটা অলিক ধারণা মাত্র।

তারপরেও ১৮২৮ সালের পর থেকেই দেবত্ববিহীন প্রাণের বিকাশ প্রথম কীভাবে ঘটেছিলে তার যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজতে থাকেন বিজ্ঞানীগণ। কিন্তু তারা কোন উপায় অন্তর খুঁজে পাননা। যদিও প্রাণ বিকাশের উৎস রহস্যে ঢাকা কিন্তু দশকের পর দশক অবহেলিত ছিল, তবুও তখন বিজ্ঞানীদের মনে হতে লাগল প্রাণের বিকাশ কীভাবে ঘটেছিল তা অবশ্যই আবিষ্কার করার বিষয়। সম্ভবত তখনকার প্রায় সবাই সৃষ্টিতত্ত্বের প্রশ্নে অলৌকিকতাবাদে আবেগের আতিশয্যে এমনভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িত ছিল যে তারা আবিষ্কারের পরবর্তী পদক্ষেপ শুরুই করতে পারছিল না।


Charles Darwin 

পূর্বের অচলাবস্থার পরিবর্তে ১৯ শতকে চার্লস ডারউইন এবং সহযোগীদের চেষ্টায় গড়ে তোলা বিবর্তন তত্ত্বের সুবাদে  জীববিজ্ঞানে নব নব আবিষ্কারের হাতছানি দেখা দেয়। চার্লস ডারউইন জানতেন কীভাবে প্রাণের বিকাশ হয়েছে এটা খুবই গভীর চিন্তা ও আবেগ মেশানো প্রশ্ন। চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের সূচনা হয় ১৮৫৯ সালে পৃথিবী তোলপাড় করা ‘অন দ্য ওরিজিন অফ স্পিসিজ’ বইটি প্রকাশের মাধ্যমে। বিবর্তনবাদে তিনি ব্যাখ্যা করে দেখান কীভাবে এই বিপুলা পৃথিবীর ততোধিক বিপুল পরিমাণ বিচিত্র প্রাণী জগতের উদ্ভব হয়েছে একটা সাধারণ এককোষের আদিপিতা থেকে। এই প্রথম কেউ বললেন ঈশ্বর প্রতিটি জীবকে আলাদা আলাদা করে সৃষ্টি করেননি। প্রাণিজগৎ সৃষ্টি হয়েছে কোটি কোটি বছর আগেকার পৃথিবীর প্রাথমিক জৈব উপাদান থেকে। প্রাণী জগতের সবাই সেই এককোষী আদিপিতার বংশধর।

চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ চারিদিকে বিতর্কের হৈচৈ ফেলে দিলো এবং বাইবেলের সাথে সাংঘর্ষিক তত্ত্বের জন্য বিতর্কিত হয়। বিশেষত উগ্র ধর্মান্ধ খ্রিস্টান সম্প্রদায় থেকে ডারউইন এবং তার বিবর্তনবাদ ভয়ানক হিংস্র আক্রমণের শিকার হলো। কিন্তু বিবর্তনবাদের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি কীভাবে প্রথম প্রাণের বিকাশ সম্ভব হয়।


Darwin wondered if life began in a “warm little pond” (Credit: Linda Reinink-Smith/Alamy)

ডারউইন জানতেন প্রশ্নটা অতীব গুরুতর, কিন্তু তিনি যথাসম্ভব সতর্কভাবে শুরু করেছিলেন তবুও চার্চের সাথে দ্বন্দ্ব এড়ানো সম্ভব হলো না। ১৮৭১ সালে লেখা এক চিঠিতে তিনি বিবর্তনবাদ নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। আবেগমথিত ভাষায় তিনি বলতে চেয়েছিলেন, প্রাণের উৎপত্তি কীভাবে এই তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর তিনি জানেন। প্রাণ বিকাশের প্রথম অনুকল্পটি উদ্ভূত হয়েছিল একটি সর্বগ্রাসী বাকস্বাধীনতাহীন দেশে। কিন্তু যদি (ওহহ কী বিশাল একটা যদি) আমরা বুঝতে পারি তবে দেখতে পাবো একটা ছোট উষ্ণ পুকুরে থাকে পর্যাপ্ত এমোনিয়া এবং ফসফরাস লবণ সেই সাথে আলো, উত্তাপ, বিদ্যুৎ এবং রাসায়নিকভাবে স্বয়ং উদ্ভূত আমিষের জটিলযৌগ আরও জটিল পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

ভিন্নভাবে বলা যেতে পারে, কী ঘটেছিল যখন দীর্ঘদিন সাধারণ জৈব উপাদান একটা ছোট জলাভূমিতে সূর্যালোকে নিমজ্জিত ছিল। কিছু জৈব উপাদান হয়ত মিলেমিশে প্রাণের সদৃশ কোন বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছিল। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় সেখানে সৃষ্টি হয়েছিল আমিষ এবং আমিষ আরও জটিল কোন বস্তুতে পরিণত হচ্ছিল। হতে পারে অস্পষ্ট ধারণামাত্র। কিন্তু ভবিষ্যতে এই অস্পষ্ট ধারণার উপর ভিত্তি করে অনুমান করা সম্ভব প্রথম কীভাবে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল।

এই ধারণার আত্মপ্রকাশ ঘটে সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত স্থানে। আপনি হয়ত ভাবতে পারেন ঈশ্বরবিহীন প্রাণ বিকাশের মত সাহসী চিন্তা বিকশিত হয়েছে একটা গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে মানুষের বাক স্বাধীনতা সামাজিক ঐতিহ্যের অংশ। হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র? কিন্তু না, বাস্তব ঘটনা হলো অলৌকিকতাকে পাশ কাটিয়ে জীবনের উৎপত্তি নিয়ে প্রথম অনুমান করেন নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে যেখানে মুক্তিচিন্তা নিষিদ্ধ। তখন স্ট্যালিনের রাশিয়াতে সবকিছু রাস্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে। মানুষের চিন্তা, এমনকি পঠন পাঠনের বিষয় যা কিছু কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় সেটাও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। ওপারিন কল্পনা করতেন কেমন ছিল পৃথিবী যখন সবেমাত্র সৃষ্টি হলো?

সবথেকে আলোচিত ঘটনা ছিল স্ট্যালিন জীনতত্ত্বের প্রচলিত পঠন পাঠনের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের আরেক জীববিজ্ঞানী এবং কৃষিবিদ ট্রোফিম ডেনিশোভিচ লিসেঙ্কো জোসেফ মেন্ডেলের জিনতত্ত্ব এবং ডারউইনের বিবর্তনবাদকে বাতিল করে বংশপরম্পরার উপর জোর দেন। তিনি মনে করতেন প্রাণী তার জীবনের অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে সঞ্চারিত করে যায়। লিসেঙ্কো দেখালেন উন্নতজাতের গম থেকে উন্নত এবং অধিকফলনশীল কিভাবে উৎপাদন করা যায়। স্ট্যালিন কমিউনিস্ট ভাবধারার সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ ট্রোফিম ডেনিশোভিচ লিসেঙ্কোর মতবাদকে চাপিয়ে দেন। জীনতত্ত্ব নিয়ে যেসব বিজ্ঞানীরা কাজ করছিলেন তাদেরকে জনসাধারণের কাছে লিসেঙ্কোর মতবাদকে সমর্থন এবং প্রচার করতে বাধ্য করা হয়। অন্যথায় তাদের স্থান হতো লেবার ক্যাম্পে।

Alexander Oparin lived and worked in the USSR (Credit: Sputnik/Science Photo Library)

স্ট্যালিনের দমন নিপীড়নের শাসনের মধ্যেই আলেক্সান্ডার ওপারিন চালিয়ে যেতে লাগলেন তার জৈবরাসায়নিক গবেষণা। ওপারিন নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন কারণ তার কমিউনিজমের প্রতি সন্দেহাতীত আনুগত্য। ওপারিন লিসেঙ্কোর তত্ত্বকে সমর্থন দিলেন এবং দেশের সেবা করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের “অর্ডার অফ লেনিন” সর্বোচ্চ পুরষ্কারে ভূষিত হন।

১৯২৪ ওপারিন প্রকাশ করলেন “দ্য ওরিজিন অফ লাইফ” তার অমর গ্রন্থখানি। দ্য ওরিজিন অফ লাইফ বইতে ওপারিন প্রাণের বিকাশ অন্বেষণে যে প্রস্তবনা করেন সেটা ডারউইনের বিবর্তনবাদের “একটি ছোট উষ্ণ পুকুর” ধারণার সাথে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়। ওপারিন চিন্তা কল্পনা করেছিলেন কেমন ছিল সদ্য গঠিত পৃথিবীর চেহারা। পৃথিবীর উপরিভাগ ছিল কল্পনাতীত গরম, মহাকাশ থেকে খসে পড়া জ্বলন্ত পাথরের খণ্ড। পৃথিবী তখন ছিল বিভিন্ন ধরণের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থমিশ্রিত অর্ধগলিত পাথরের বিশৃঙ্খল স্তুপ। পদার্থগুলোর মধ্যে কার্বনের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশী।


Oceans formed once Earth had cooled down (Credit: Richard Bizley/Science Photo Library)

যদি আমরা অণুবীক্ষণযন্ত্রের নিচে কোয়াসারভেটিভ (জৈব রাসায়নিক দ্রবণ) পরীক্ষা করে দেখি তাহলে দেখব দ্রবণটি জীবিত কোষের মত আচরণ করছে। ধীরে ধীরে উত্তপ্ত পৃথিবী ঠাণ্ডা হচ্ছে, জলীয় বাস্প ঘনীভূত হয়ে প্রথম বৃষ্টি নামল পৃথিবীর বুকে, তরল পানিতে তলিয়ে গেল চরাচর। বৃষ্টি পড়ার আগেও সমুদ্র ছিল তবে সেটা প্রচণ্ড উত্তাপে গলিত কার্বননির্ভর ঘন তরল। এমতাবস্থায় দুইটা জিনিস ঘটতে পারে।

প্রথমত, বিভিন্ন রাসায়নিক নিজেদের মাঝে বিক্রিয়া করে অসংখ্য নতুন জটিল যৌগ সৃষ্টি করতে পারে। তাদের মধ্যে কিছু যৌগ আরও জটিল যৌগে পরিণত হবে। আলেক্সান্ডার ওপারিন ধারণা করেন রাসায়নিক দ্রব্যের ক্ষুদ্র মৌলগুলি প্রাণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। চিনি এবং এমাইনো এসিড পৃথিবীর পানি থেকেই উৎপত্তি হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, কিছু রাসায়নিক দ্রব্য নতুন আণুবীক্ষণিক অণুজীবের কাঠামো তৈরি করতে শুরু করে। কিছু অণুজীবের জৈবরাসায়নিক উপাদান পানিতে দ্রবীভূত হয় না। যেমন তেল পানির উপর আস্তরণ সৃষ্টি করে ভেসে থাকে। কিন্তু যখন কিছু জৈবরাসায়নিক উপাদান পানির সাথে মিশে যায় তখন গোলাকার “কোয়াসারভেটিভ” বস্তুর রূপ ধারণ করে যেগুলো আয়তনে .০১ সেমি বা (.০০৪) ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। অণুজীব বেড়ে ওঠে, তারা অবয়ব পরিবর্তন করে এমনকি মাঝেমাঝে তারা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তারা চারপাশের পানির রাসায়নিক দ্রব্যের সাথে বিক্রিয়ায় অংশ নেয়। এভাবেই জীবনসদৃশ রাসায়নিক উপাদান নিজেদের মাঝে সংগঠিত হতে থাকে। ওপারিন প্রস্তাব করেন কোয়াসারভেটিভ হলো আধুনিক জীবিত কোষের পূর্বপুরুষ।

ওপারিনের মতবাদে দেখা যাচ্ছে জীবিত অনুজীবের জন্ম হয়েছে পুরোপুরি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এখানে কোন ঈশ্বরের হাত নেই। এমনকি অলৌকিকভাবে জীবনী শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে এমন চিন্তাও প্রথাগত যার কোন ভিত্তি নেই।

পাঁচ বছর পরে ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী জন বারডন স্যান্ডারসন হালডেন একই মতবাদ নিয়ে র‍্যাশনালিস্ট অ্যানুয়াল জার্নালে একটা ছোট প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। হালডেন ইতিমধ্যেই বিবর্তনবাদে প্রভূত অবদান রেখে ফেলেছেন। তিনি ডারউইনের মতবাদকে বিকাশমান জীনতত্ত্বের আলোকে আরও সংহত করে।

রঙ্গমঞ্চে হালডেন তার জীবনের থেকেও বড় চরিত্র। একবার তিনি কানের পর্দায় ছিদ্রের চিকিৎসায় ডিকম্প্রেসন চেম্বারের অভিজ্ঞতার জন্য ডাক্তারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। কিন্তু পরে তিনি রম্য করে লিখেছিলেন, “কানের পর্দা সাধারণত প্রাকৃতিকভাবেই সুস্থ হয়ে যায়। যদি পর্দায় ছিদ্র থেকেই যায় এবং তারফলে কেউ যদি বধির হয়ে যায় তাহলে সে কারো ভ্রূক্ষেপ না করেই বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে পারবে যেটা হবে একটা সামাজিক অর্জন”।

ওপারিনের মত হালডেনও মতবাদ প্রচার করলেন, সমুদ্র প্রাথমিক অবস্থা থেকে স্থিতিশীল গরম ঘন তরলে পরিণত হলে কিভাবে সেখানের পানিতে রাসায়নিক অনুজীব নিজে থেকেই সৃষ্ট হতে পারে। পৃথিবীর এরকম পরিবেশে প্রথম জন্ম নেয় জীবনের অণুজীব অথবা অর্ধজীবন্ত বস্তু আর এরপরের স্তরে সৃষ্টি হয় স্বচ্ছ তেলতেলে জেলির মত থকথকে বস্তু।

কথিত আছে ওপারিন এবং হালডেন যে তত্ত্বের অবতারণা করেন পৃথিবীর সমস্ত জীববিজ্ঞানী সেগুলো ব্যক্ত করেন মাত্র। প্রাণের প্রথম বিকাশ ঘটেছে পুরোপুরি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এখানে কোন ঈশ্বরের হাত নেই। ডারউইনের বিবর্তনবাদের আগেও পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। ডারউইন সেটাকে যুক্তিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করেছেন কিন্তু এই তত্ত্ব খ্রিস্টবাদের ভিত্তিমূলে চরম কুঠারাঘাত।

ডারউইনের বিবর্তনবাদের একটাই সমস্যা ছিল। তার প্রচারিত বিবর্তনবাদকে নির্ভুল প্রমাণ করতে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার নিরিখে কোন প্রমাণ নাই। ঈশ্বরবিহীন সৃষ্টিতত্ত্ব সোভিয়েত ইউনিয়নে কোন সমস্যা নয় কারণ কমিউনিস্ট শাসিত সোভিয়েত রাষ্ট্রীয়ভাবেই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। সেজন্যই কমিউনিস্ট নেতারা প্রাণের উৎপত্তি গবেষণায় বস্তবাদী ব্যাখ্যাকে অকুন্ঠ সমর্থন জানায়। হাল্ডেন নিজেও ছিলেন একজন নাস্তিক এবং কমিউনিজমের কড়া সমর্থক।

তখনকার সময়ে বিবর্তনবাদ গৃহীত হবে নাকি বাতিল করবে সেটা নির্ভর করত প্রধানত ব্যক্তির ধর্ম বিশ্বাসী ব্যক্তিত্বের উপর। জীবনের উৎস অনুসন্ধান করা বিশেষজ্ঞ জীববিজ্ঞানী জার্মানির ওসনাব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আরমেন মালকিদজানিয়ান বলেন, বিবর্তনবাদ গৃহীত হবে কি হবে না নির্ভর করে মানুষেরা কি ধর্মে বিশ্বাস করে নাকি বাম ধারার কমিউনিজম সমর্থন করে সেটার উপর। সোভিয়েত ইউনিয়নে বিবর্তনবাদ সাদরে গৃহীত হয়েছে কারণ সেখানে ঈশ্বরের প্রয়োজন ছিল না। যদি পশ্চিমাবিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব সেখানের মানুষেরা অনেক বস্তুবাদী। তাদের চিন্তা বাম ঘেঁষা কমিউনিস্ট বা উদারপন্থার দিকে ধাবিত।

প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আদিম জৈবরাসায়নিক ঘন তরল সহযোগে এই ধারণাটি ওপারিন-হালডেন তত্ত্ব বলে ব্যাপক পরিচিত পেয়ে গেল। ওপারিন-হালডেন তত্ত্ব যুক্তির বিচারে গ্রহণযোগ্য হলেও তত্ত্বটির একটা সমস্যা ছিল। ওপারিন-হালডেন তত্ত্বকেও নির্ভুল করার স্বপক্ষে কোন গবেষণালব্ধ প্রমাণ নেই। পচিশ বছর পার হয়ে গেলেও তত্ত্বটির স্বপক্ষে কোন প্রমাণ দাড় করানো যায়নি।


The English geneticist J. B. S. Haldane (Credit: Science Photo Library)

সময়ের সাথে প্রাণের উদ্ভব গবেষণায় যোগ দেন ১৯৩৪ সালে রসায়নে নোবেল বিজয়ী আমেরিকান রসায়নবিদ। হ্যারল্ড উরে পারমাণবিক বোমা বানানোর দলেও কাজ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ম্যানহাটান প্রকল্পে পারমাণবিক বোমার অতি প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম ২৩৫ সমৃদ্ধ করতেন। যুদ্ধের পরে তিনি নিউক্লিয়ার প্রযুক্তিকে সুশীল সমাজের নিয়ন্ত্রণে দেয়ার জন্য আন্দোলন করেন। প্রফেসর উরে ধারণা করেছিলেন, আমদের পৃথিবী আদিম অবস্থায় সম্ভবত অ্যামোনিয়া, মিথেন এবং হাইড্রোজেনের মিশেলে পিণ্ডাকৃতির ছিল। এই মিশ্রণকে যদি বৈদ্যুতিক বিস্ফোরণ এবং পানির সংস্পর্শে আনা যায় তাহলে অ্যামাইনো এসিড উৎপন্ন করা সম্ভব। এটা সর্বজন বিদিত যে, অ্যামাইনো এসিড হলো জীবনের প্রথম উপাদান।

উরে এই সময়ে পৃথিবীর বাইরে মহাকাশ এবং মহাকাশের ভাসমান বস্তুকণার রসায়ন নিয়ে আগ্রহী হন বিশেষকরে দেখতে চেয়েছিলেন সৌরজগৎ যখন সবে সৃষ্টি হলো তখন ঠিক কী ঘটছিল। একদিন তিনি ক্লাসে বললেন সৃষ্টিলগ্নে পৃথিবীর বায়ুস্তরে সম্ভবত অক্সিজেনের অস্তিত্ব ছিল না। রাসায়নিক বিক্রিয়ার সংস্পর্শে অক্সিজেন হয়ত ধ্বংস হয়ে গেছে। উরের ক্লাস লেকচারের প্রস্তাবিত ‘অক্সিজেনবিহীন পৃথিবী’ ওপারিন এবং হালডেনের আদিম জৈবরাসায়নিক ঘন তরল ধারণাকে আরও বেগবান করে। প্রফেসর হ্যারল্ড উরের ক্লাসে উপস্থিত ছিলেন পিএইচডি’র গবেষণারত ছাত্র স্ট্যানলি মিলার। মিলার প্রফেসর উরেকে প্রস্তাব দেন পরীক্ষা করে দেখার আসলেই কেমন ছিল সেদিনের সৌরজগতের পরিবেশ। উরে নিজের ক্লাস লেকচারের উপর কিছুটা সন্দেহ পোষণ করলেও মিলার অক্সিজেনবিহীন পৃথিবীর চিন্তায় মনোনিবেশ করলেন। তাদের মাঝে বিস্তর আলোচনার পরে ১৯৫২ সালে প্রফেসর উরে এবং তার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্ট্যানলি লয়েড মিলার যৌথভাবে প্রথমবারের মত প্রাণের খোঁজে বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাত ‘উরে-মিলার এক্সপেরিমেন্ট’ পরীক্ষা শুরু করলেন।

The Miller-Urey experiment (Credit: Francis Leroy, Biocosmos/Science Photo Library)

পরীক্ষার যন্ত্রপাতি খুব সাধারণ। মিলার পূর্বের আলোচিত ধারণা অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্নের চারটি রাসায়নিক উপাদান গরম পানি, হাইড্রোজেন গ্যাস, অ্যামোনিয়া এবং মিথেন চারটি কাঁচের জারে পূর্ণ করে তাদের মাঝে সংযোগ করে দিলেন। কাঁচের গ্লাসের মাঝে মিলার বারবার তড়িৎপ্রবাহ দিতে লাগলেন যাতে বজ্রপাত ঘটে। আদিকালে পৃথিবীতে বজ্রপাতের ঘটনা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক।  এই পরীক্ষার মাধ্যমে খুব সাধারন পরিবেশেই প্রচুর পরিমাণ জৈব অনু উৎপাদন সম্ভব। মিলার দেখতে পেলেন প্রথমদিনেই কাঁচের জারের মধ্যকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গোলাপী আভা ধারন করেছে এবং সপ্তাহ শেষে ঘন তরল দ্রবণটি গাঢ় লাল হয়ে গেল। পরিষ্কার বোঝা গেল জারে জৈব রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ তৈরি হয়েছে।

মিলার পরীক্ষাগারে বিশ্লেষণ করে মিশ্রণটিতে গ্লাইসিন এবং আলানাইন নামে দুইটা অ্যামাইনো এসিড পেলেন। অ্যামাইনো এসিডকে জীবন সৃষ্টির প্রাথমিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং অ্যামাইনো এসিড আমিষ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আমিষ আমাদের শরীরের শারীরবৃত্তিক এবং জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মিলার গবেষণাগারে জন্ম দিলেন প্রাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।  মিলারের গবেষণার ফলাফল বিখ্যাত সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হলো ১৯৫৩ সালে। প্রাণের বিকাশ অভিযানে ‘উরে-মিলার এক্সপেরিমেন্ট’ স্মরণীয় ঘটনা। উদার প্রফেসর উরে এই গবেষণার সমুদয় কৃতিত্ব মিলারকে দিয়ে আর্টিকেল থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞানের গবেষক জন সাদারল্যান্ড বলেন, “উরে-মিলার পরীক্ষার শক্তি এখানেই যে, আপনি সাধারণ পরিবেশে প্রচুর অণুজীব সৃষ্টি করতে পারবেন”। জীবন আরও জটিল যা আমরা চিন্তা করি তার থেকেও বেশি।

পরবর্তীতে আরও গবেষণায় পৃথিবী সৃষ্টির আদিতে অন্যান্য গ্যাসের মিশ্রণও ছিল আবিষ্কারের কারণে আগের গবেষণা ভুল প্রমানিত হয়। কিন্তু সেটা নিয়ে সম্পূরক আলোচনা হতে পারে। জন সাদারল্যান্ড বলেন, “উরে-মিলার পরীক্ষা ছিল দৃষ্টান্ত, তারা মানুষের কল্পনা জাগাতে পেরেছিলেন এবং প্রাণের উৎস সন্ধানে ব্যাপকভাবে চর্চা করতে থাকে”। মিলারের পরীক্ষার প্রভাবে অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও এগিয়ে এলেন ভিন্ন ভিন্ন মৌল থেকে অনুজীব সৃষ্টির গবেষণা করে প্রাণের উৎস সন্ধানে। প্রাণের রহস্য উন্মোচনের হাতছানি মনে হয় সন্নিকটে। এতদিনে পরিষ্কার হওয়া গেছে জীবন এত জটিল যে আমাদের চিন্তাকে বিহ্বল করে দেয়। অবশেষে জানা গেল জীবন্ত কোষ শুধুমাত্র কিছু রসায়নের জটিল যৌগ নয় জীবন হলো সূক্ষ্ম শিল্পিত যন্ত্রবিশেষ। হঠাৎ করে সম্পর্কহীন বস্তু থেকে নিজেকে সৃষ্টি করে নিজেই আবার বড় বাধা অতিক্রম করে ছুটে যায় নতুন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানীদের বুঝে ওঠার আগেই।


The machinery inside cells is unbelievably intricate (Credit: Equinox Graphics Ltd)

দ্বিতীয় পর্ব

বিজ্ঞান সভায় বিভাজন

১৯৫০ সালের শুরুর দিকে বিজ্ঞানীগণ আমাদের জীবন ঈশ্বরের দান বহুদিনের পুরনো বাসি ধারণা থেকে সরে আসতে থাকে। তার পরিবর্তে তারা সম্ভাবনাময় জীবন কীভাবে নিজে নিজেই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হলো সেই রহস্য উন্মোচনে আগ্রহী হয়ে উঠল। এবং যুগান্তকারী পরীক্ষার জন্য অবশ্যই স্ট্যানলি মিলারকে ধন্যবাদ। বিজ্ঞানীগণ জীবন অন্বেষণে মিলারের পরীক্ষা থেকে ভবিষ্যৎ গবেষণার রশদ পেয়ে গেলেন।

মিলার যখন ভিন্ন ভিন্ন বস্তু থেকে জীবনের উপাদান বানাতে ব্যস্ত তখন কিছু বিজ্ঞানী জীন  কিসের তৈরি খুঁজতে গবেষণারত। ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানীগণ অনেকগুলো অনুজীবকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। চিনি, চর্বি, আমিষ, নিউক্লিক এসিড যেমন ডিঅক্সিরিবোনিউক্লিক এসিড বা সংক্ষেপে ডিএনএ আবিষ্কার হয়ে গেছে এতদিনে। ২০শতক হলো আবিষ্কারের স্বর্ণযুগ। বিজ্ঞানের বড় বড় আবিষ্কারগুলো এই শতাব্দীতেই ঘটেছে।

আজকে আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি ডিএনএ আমাদের জীন বহন করে। কিন্তু ডিএনএ আবিষ্কার ১৯৫০ দশকের বিজ্ঞানীদের জন্য একটা আঘাত কারণ আমিষের জটিল গঠন দেখে তারা আমিষকেই জীন ভেবেছিলেন। ১৯৫২ সালে আলফ্রেড হারশে এবং মার্থা চেস বিজ্ঞানীদের ভুল ভেঙ্গে দেন। তারা ওয়াশিংটনের কার্নেজি ইনস্টিটিউটে শুধু প্রোটিন আর ডিএনএ বহনকারী ক্ষুদ্র ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন। পুনোরুৎপাদনের জন্য ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার মাঝে সংক্রামিত হয়। পরীক্ষায় আলফ্রেড হারশে এবং মার্থা চেস জানতে পারলেন সংক্রামক ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে প্রবেশ করেছে কিন্তু প্রোটিন বাইরেই রয়ে গেল। পরিষ্কার বুঝা গেল, ডিএনএ হলো জীনের উপাদান।

হারশে এবং মার্থা চেস’র পরীক্ষার ফলাফল ডিএনএ কীভাবে কাজ করে এবং কেমন তার গঠন আবিষ্কারের গবেষণায় তোলপাড় সৃষ্টি করে দিলো। পরের বছর ডিএনএ রহস্যের সমাধান করে ফেললেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ফ্রান্সিস ক্রিক এবং জেমট ওয়াটসন। দীর্ঘ পরিশ্রমসাধ্য গবেষণায় তাদেরকে সাহায্য করে রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন। ২০শতকের আবিষ্কারগুলো জীবনের উৎস অন্বেষণের পথে নতুন মাত্রা যোগ করে। আবিষ্কৃত হতে থাকে জীবন্ত কোষের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা অবিশ্বাস্য জটিলতা।


James Watson and Francis Crick with their model of DNA (Credit: A. Barrington-Brown/Gonville and Caius College/Science Photo Library)

ক্রিক এবং ওয়াটসন বুঝতে পেরেছিলেন ডিএনএ হলো দুইটা প্যাচানো মইয়ের সদৃশ বস্তু যারা আবার নিজেদের মধ্যেও সর্পিল আকৃতিতে জড়িয়ে থাকে। প্যাচানো মইয়ের দুই প্রান্ত নিউক্লিওটাইড নামের মলিকিউল দ্বারা গঠিত। আমার আপনার এবং আমাদের সবার জীন এসেছে ব্যাকটেরিয়া নামের আদিপিতা থেকে। ডিএনএ’র গঠন ব্যাখ্যা করে কিভাবে আমাদেরকে কোষ ডিএনএকে অনুসরণ করে। অন্যভাবে বলা যায়, ডিএনএ উন্মোচন করে কিভাবে বাবা-মা তাদের জীনের প্রতিলিপি তৈরি করে এবং পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। এখানের মূল আলোচ্য বিষয় হলো, এখন প্যাচানো দুই সর্পিল মইয়ের রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব। তখন আমরা জানতে পারি জীবের বংশগতির ধারা যা তৈরি হয়েছে জীবের বংশপরম্পরায়। বংশগতির ধারাকে আমরা এ, টি সি এবং জি দিয়ে চিহ্নিত করতে পারি। বংশগতির ভিত্তি সাধারণত ডিএনএ’র সর্পিল মইয়ের মধ্যে সুরক্ষিত অবস্থায় থাকে এবং প্রতিলিপি তৈরির প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।

এই একই প্রক্রিয়ায় বংশগতি জীবনের শুরু থেকেই বাবা-মা তাদের সন্তানদের মাঝে জীবনের বৈশিষ্ট্য প্রবাহিত করতে থাকে। ক্রিক এবং ওয়াটসন আবিষ্কার করেন ব্যাকটেরিয়া থেকে কিভাবে ধাপে ধাপে বংশগতির প্রতিলিপি তৈরি করে প্রাণী আজকের অবস্থানে চলে এসেছে।

ক্রিক এবং ওয়াটসন ১৯৫৩ সালে তাদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান “নেচার”বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করেন। ক্রিক এবং ওয়াটসনের আবিষ্কারের ফলে পরের বছরগুলোতে জৈবরাসায়নিক বিজ্ঞানীগণ ডিএনএ ঠিক কী তথ্য বহন করে সেটার আদ্যপান্ত খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তারা দেখতে চাইলেন কীভাবে DNA তে সংরক্ষিত তথ্য জীবন্ত কোষে ব্যবহৃত হয়। জীবনের অভ্যন্তরে লুকায়িত গোপন খবর প্রথমবারের মত প্রকাশের পথে। তখন হঠাৎ করে বিজ্ঞানীদের কাছে ওপারিনের ধারণাকে মামুলি সাদাসিধা।

আবিষ্কার হয়ে গেল DNA ’র মাত্র একটাই কাজ। আপনার ডিএনএ আপনার কোষদেরকে বলে দেয় কীভাবে প্রোটিন তৈরি করতে হবে। প্রোটিন সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে মলিকিউল। প্রোটিন ছাড়া আপনি খাদ্য হজম করতে পারবেন না, আপনার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাবে এবং আপনি নিশ্বাস নিতে পারবেন না।

DNA থেকে প্রোটিন উৎপন্নের জটিল প্রক্রিয়া দেখলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। যে কারো পক্ষে জীবনের উৎস কী ব্যাখ্যা করতে যাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ল কারণ এত জটিল প্রক্রিয়া কীভাবে একা একা শুরু হয়েছিল সেটা বিজ্ঞানীগণের চিন্তার জন্যও দুরূহ। প্রতিটি প্রোটিনই মূলত অ্যামাইনো এসিডের বিশাল শিকল একটা বিশেষ শৃঙ্খলার বাঁধনে তারা পারস্পারিক আবদ্ধ। অ্যামাইনো এসিডের ক্রম নির্ধারণ করে দেয় প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক আকার এবং এভাবেই প্রোটিন কাজ করে। সর্পিল DNA’র অভ্যন্তরে প্রাণের প্রয়োজনীয় তথ্য সাংকেতিক আকারে লিপিবদ্ধ থাকে। সুতরাং যখন একটা কোষকে কোন নির্দিষ্ট প্রোটিন সৃষ্টি করতে হয় তখন সে অ্যামাইনো এসিডের শিকলের নাগাল পেতে DNA’র মধ্যে সংরক্ষিত জীন থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য বিশ্লেষণ করতে শুরু করে।

কিন্তু এখানেও একটা প্যাচ আছে। DNA জীবনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই কোষ DNA কে সংরক্ষণ করতে নিরাপদে জমিয়ে রাখে। এই কারণে কোষ DNA’র তথ্যকে প্রতিলিপি করে RNA (রাইবোনিউক্লিক এসিড) মলিকিউলে স্থানান্তর করে। DNA যদি পাঠাগারের বই ধরি তাহলে RNA  হবে গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ লেখা ছেঁড়া কাগজের সমষ্টি। DNA’র তুলনায় RNA ছোট। সর্পিল মইতে RNA’র একটামাত্র সুতোর মত প্রান্ত। এপর্যায়ে RNA’র মধ্যে সংরক্ষিত তথ্য প্রোটিনে পরিণত হয় এবং প্রচুর পরিমাণ ‘রাইবোসোম’ মলিকিউল গঠন করে।

প্রতিটি জীবিত কোষে এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এমনকি অতি সাধারণ ব্যাকটেরিয়াও এই প্রক্রিয়ার বাইরে নয়। খাদ্যগ্রহণ এবং অবিরাম নিঃশ্বাস প্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়া জীবনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রাণের উৎস ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদের অবশ্যই DNA, RNA, রাইবোসোম এই তিন প্রোটিনের জটিল মিথস্ক্রিয়া বুঝতে হবে। কীভাবে তাদের উৎপত্তি হলো, কেমন করেই বা তারা পরস্পর কাজ শুরু করে।


Cells can become enormously intricate (Credit: Russell Kightley/Science Photo Library)

হঠাৎ করেই ওপারিন এবং হালডেনের ধারণা নিতান্ত সাদামাটা প্রতীয়মান হয়ে গেল। একই সাথে মিলারের যে যুগান্তকারী পরীক্ষার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়েছিল অ্যামাইনো এসিড যা দিয়ে প্রোটিন সৃষ্টি সম্ভব সেটাকেও মনে হলো অসম্পূর্ণ এবং ভাসাভাসা। কীভাবে জীবন সৃষ্টি হয়েছিল সেই প্রশ্নের উত্তর থেকে এখনো আমরা অনেক দূরে। মিলারের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ছিল সৃষ্টি রহস্য উন্মোচনের দীর্ঘ যাত্রাপথের সূচনামাত্র। জীবন গঠিত হয়েছিল RNA দিয়ে এই ধারণা এখন প্রভূত প্রমাণিত এবং বিজ্ঞানে খুব প্রভাবশালী তত্ত্ব।

জন সাদারল্যান্ড বলেন, “DNA সৃষ্টি করে RNA এবং RNA সৃষ্টি করে প্রোটিন যা লিপিড হিসেবে মুখ আটকানো রসায়নের থলের মধ্যে থাকে। আপনি যদি DNA, RNA এবং লিপিডের দিকে তাকাই তাহলে এর জটিলতা দেখে বিস্ময়ে আপনার মুখ হা হয়ে যাবে। কীভাবে আমরা খুঁজে পাবো

অন্যান্য বিজ্ঞানীগণকে যদি ধরি প্রাণের উৎস গবেষণার রাস্তা তৈরি করেছেন তাহলে ব্রিটিশ রসায়নবিদ লেজলি ওরগেলকে বলতে হবে প্রথম বিজ্ঞানী যিনি সেই রাস্তায় যাত্রা শুরু করেন। লেজলি ওরগেলই প্রথম ক্রিক এবং ওয়াটসনের DNA’র মডেল নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পরে তিনি মঙ্গলগ্রহে রোবটিক যান পাঠাতে নাসা’র ভাইকিং প্রোগ্রামে সাহায্য করেছিলেন। ওরগেল প্রাণের উৎস কী এই বৈজ্ঞানিক জিজ্ঞাসাকে চিহ্নিত করলেন। ১৯৬৮ সালে লিখিত এক গবেষণাপত্রে তিনি দাবি করেন জীবনের শুরুতে প্রোটিন বা DNA কিছুই ছিলনা। জীবন সৃষ্টি হয়েছিল পুরোপুরি RNA দিয়ে এবং ফ্রান্সিস ক্রিক ওরগেলের এই দাবীকে সমর্থন দেন।

ওরগেলের দাবী যদি সঠিক হয় তাহলে আদিম RNA মলিকিউলকে অবশ্যই অভিযোজন ক্ষমতা থাকতে হবে এবং তারা নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করবে। ধারণা করা হচ্ছে সম্ভবত DNA  একই প্রক্রিয়া কাজ করে।

জীবন গঠিত হয়েছিল RNA দিয়ে এই ধারণা এখন প্রভূত প্রমাণিত হয়েছে এবং বিজ্ঞানে খুব প্রভাবশালী তত্ত্ব। কিন্তু জন্ম দিয়েছে বৈজ্ঞানিক তর্কযুদ্ধের যা অবধি চলছে।

জীবন শুরু হয়েছিল RNA দিয়ে দাবী করেই ওরগেল ক্ষান্ত হননি, তিনিই সবার আগে প্রস্তাব করেন RNA নিজেকে নিজেই পুনরুৎপাদন করতে পারে যা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। অন্যভাবে বলা যায় তিনি শুধু জীবন কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল সেটাই বলেননি, জীবন কী এই প্রশ্নেরই সমাধান তিনি করে ফেলেছেন। এ পর্যায়ে বিজ্ঞানীগন প্রাণের জন্ম রহস্য নিয়ে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেলেন।


DNA is at the heart of almost every living thing (Credit: Equinox Graphics Ltd)

অনেক জীববিজ্ঞানী ওরগেলের ‘প্রাণ নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করে’ দাবীর সাথে সহমত পোষণ করলেন। ডারউইনের বিবর্তনবাদের সারাংশ ছিল নিজের অসংখ্য প্রতিলিপি বা সন্তান জন্মদানের মাধ্যমেই শুধু প্রাণী নিজের বংশ রক্ষা করতে পারে। কিন্তু জীবনের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো যেমন জীবন বেঁচে থাকার জন্য একটি জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে ঘটতে থাকা রাসায়নিক প্রক্রিয়া। বেঁচে থাকতে হলে চারিপাশের পরিবেশ থেকে শক্তি সঞ্চয় করতে হয়। অনেক জীববিজ্ঞানী মনে করেন জীবনের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো জীবনের অভ্যন্তরীণ চলমান রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং জীবের নিজের প্রতিলিপি উদ্ভব হয়েছে অনেক পরে। এখানেই বিতর্কের শুরু। ১৯৬০ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীগণ জীবনের উত্থান গবেষণায় দুই সলে বিভক্ত। সাদারল্যান্ড বলেন, “জীবনের অভ্যন্তরীণ চলমান রাসায়নিক প্রক্রিয়া নাকি বংশগতি প্রথম” প্রশ্নই বিজ্ঞানীগণের নতুন দুই প্রান্তে বিভাজন। তাই বিজ্ঞান সভা মাঝে মাঝেই দ্বিধা বিভাজনের তর্কে পর্যবসিত হয়। ততদিনে তৃতীয় একদল বিজ্ঞানী প্রচার করলেন প্রথমে মলিকিউলের ধারকের জন্ম হয়েছে কারণ তারা ছিল তখন ভাসমান। জীবন সৃষ্টিতে কোষের উপাদানগুলোকে জড়ো করতে হয়েছে। কোষের উপাদানগুলো ছাড়া অভ্যন্তরীণ চলমান রাসায়নিক প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব নয়। সাদারল্যান্ড বলেন, প্রাণ সৃষ্টিতে কোষের প্রয়োজন যে কথা ওপারিন এবং হালডেন কয়েক দশক আগেই জোরালোভাবে বলে গেছেন। সম্ভবত জীবনের প্রথম কোষ চর্বি জাতীয় স্বচ্ছ তরল পর্দায় আবৃত ছিল।

জীবন বিকাশের এই তিনটা গবেষণা এবং তর্কালোচনার স্বপক্ষে বিপক্ষে অনেক বিজ্ঞানী আছেন এবং অদ্যাবধি আলোচনা চলছে। বিজ্ঞানীগণ নিজেদের ধারণার স্বপক্ষে নিরন্তর গবেষণা করেছেন এমনকি অনেক সময় অন্ধভাবে স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করছে। প্রায়ই দেখা যায় একদন বিজ্ঞানী আত্মপক্ষ সমর্থন করে অন্য বিজ্ঞানীগণকে নির্বোধ বলতেও দ্বিধা করছে না। ফলে জীবনের উৎস নিয়ে বিজ্ঞান সভার বিতর্ক সাংবাদিকদের পত্রিকার চটকদার কলাম আর সাধারণ পাঠকদের মুখরোচক গল্পে পরিণত হয়েছে। ওরগেলকে ধন্যবাদ। তিনি প্রথম ধারণা দিলেন বংশগতি নয় বরং জীবন গঠিত হয়েছিল RNA দিয়ে। তারপর এলো ১৯৮০ দশক, বিজ্ঞানের চমক লাগানো আবিষ্কারের যুগ এবং পাওয়া হওয়া গেল কীভাবে জীবনের জন্ম প্রশ্নের অমীমাংসিত উত্তর।


RNA could be the key to life’s beginning (Credit: Equinox Graphics Ltd)

চলবে…

অনুবাদক – বিকাশ মজুমদার 

মূল প্রবন্ধ: The secret of how life on earth began




Posted at March 06, 2018 |  by Arya ঋষি

Tags

Text Widget

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipisicing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation test link ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat.

Blog Archive

© 2013 Arya Rishi. WP Theme-junkie converted by Bloggertheme9Published..Blogger Templates
Blogger templates. Proudly Powered by Blogger.
back to top