১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে দাক্ষিনাত্যের সকল সুলতানী বাহিনী এক সঙ্গে বিজয়নগর আক্রমন করেন। ফলে সায়ানাচার্যের স্বপ্নের বিজয়নগরের গৌরবসূর্য তালিকোটার প্রান্তরে চিরতরে অস্তমিত হল। বিজয়ী মুসলমান সৈন্য বিজয়নগরে প্রবেশ করে দীর্ঘ পাচ মাস ধরে অবাধ লুন্ঠন চালালো। বুরহান-ই-মসির ও ফিরিস্তির বর্ণনা থেকে জানা যায়, কল্পনাতীত পরিমান মনি মুক্তা, ধন-দৌলত, অসংখ্য হাতি, ঘোড়া, উট, দাস-দাসী বিজয়ী সৈন্যগন কর্তৃক লুন্ঠিত হয়েছিল। বিজয়ী মুসলমান কেবলমাত্র মুল্যবান সামগ্রী লুন্ঠন করেই ক্ষন্ত ছিলেন না, বিজয়নগরকে তারা বিরাট ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে বিজয়নগরের ন্যায় সমৃদ্ধ নগরীর এইরূপ আকস্মিক ধ্বংস্তুপে পরিনত হওয়ার দ্ষ্টান্ত বিরল। নগরের যাবতীয় মন্দির, প্রাসাদ ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেও পরাজিতের প্রতি হিংসাপরণাতার অবসান হল না। অবশেষে লক্ষ লক্ষ হিন্দু নর-নারী এবং শিশু বৃদ্ধেরর রক্তে বিজয়নগরের ধুলি রঞ্জিত করে তারা লুন্ঠন যজ্ঞে পূর্ণাহতি দিল ।
ততকালীন অন্যান্য মুসলমান শাসকগনের মত শেরশাহও (১৫৪১) পাইকারী হারে হিন্দু হত্যা, হিন্দু সম্পত্তি লুট, হিন্দু নারী বলাতকার এবং হিন্দু মন্দির ধ্বংসের ব্যপারে সমান পটু ছিলেন। হিন্দুর সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করতে তার কোন দ্বিধা চিল না।
১৫৪০ খৃষ্টাব্দে বাদশাহ হবার পর ১৫৪৩ খৃষ্টাব্দে শেরশাহ রায়সিনের হিন্দু রাজা পুরনমলের দূর্গ আক্রমন করেন। পুরনমলের সৈন্যরা প্রথমে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করেন এবং পরে দূর্গের মধ্যে আশ্রয় নিলেন। প্রায় ৬ মাস দূর্গ অবরোধের পর শেরশাহ কামান দিয়ে দূর্গের ক্ষতি করতে থাকেন। পুরনমল তখন খবর পাঠালেন যে, তাকে ও তার লোকজনকে পালিয়ে যেতে দিলে তিনি দূর্গ ছেড়ে চলে যাবেন। শেরশাহ তাতে সম্মতি জানান। পুরনমলের লোকজন তখন দূর্গ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং শেরশাহের নির্দেশ মত দূর্গের বাইরে তাবু খাটিয়ে অবস্থান করতে থাকেন। ইতিমধ্যে শেরশাহ সবাইকে হত্যা করার গোপন পরিকল্পনা করে এবং পরদিন সকালে শেরশাহের সৈন্যরা তাদের ঘিরে ফেলে। অবস্থা বুঝতে পেরে পুরনমল তার স্ত্রী রত্নাবলীর মাথা তরোয়াল দিয়ে কেটে ফেলেন এবং অন্য সবাইকেও হুকুম দিলেন নিজ নিজ পরিবারের মহিলাদের মাথা কেটে ফেলতে। মুসলমানরা ইতিমধ্যে আক্রমন শুরু করে দিয়েছে।
আব্বাস-খা ইংরেজীতে ঘটনাটির যে বর্ণনা দিয়েছেন বাংলায় তা এরূপ---
"হিন্দুরা তাদের নিজ নিজ পরিবারের ও অন্যান্যদের (অর্থাৎ নাবালক ও শিশুদের) হত্যা করতে ব্যস্ত, ইত্যবসরে আফগানরা চর্তুদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলল এবং তাদের হত্যা করতে শুরু করলো । শুয়োর খানা-খন্দে পড়ে গেলে যেমন হয় হিন্দুরাও সেই রকম অসহায় হয়ে পড়লো। পুরনমল ও তার লোকেরা বীরত্ব ও বিক্রম দেখাতে চেষ্টা করল বটে, তবে চোখের পলকে আফগানরা সবাইকে কচু কাটা করে ফেলল।
যে সব নারী ও শিশুদের হিন্দুরা হত্যা করে উঠতে পারেনি, তাদের সবাইকে বন্ধী করা হল। তাদের মধ্য থেকে পুরনমলের এক কন্যা ও তার বড় ভাইয়ের তিন ছেলেকে জীবিত রেখে বাকি সকলকে হত্যা করা হল। শের খা পুরনমলের মেয়েকে কয়েকজন বাজীগরের হাতে তুলে দিল । যাতে তারা তাকে হাটে বাজারে নাচাতে পারে । আর ছেলে তিনটিকে খোজা বানাবার হুকুম দেওয়া হল যাতে অত্যাচারী হিন্দুরা বংশ বিস্তার করতে না পারে।


রোহতাস দূর্গের রাজা হরেকৃষ্ণ রায় শেরশাহের বন্ধু ছিলেন। ১৫৩৭ সালে হুমায়ন শেরশাহের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। সেই সময় শেরশাহের হারেমে ১০০০ রমনী ছিল এবং তারা সবাই চুনারগড় দূর্গে বাস করত। চুনার গড় দূর্গ ততটা সুরক্ষিত নয় তাই শেরশাহ রাজা হরেকৃষ্ণ রাহকে অনুরোধ করলেন হারেম শুদ্ধ তার পরিবারকে আশ্রয় এবার জন্য। এর আগে রাজা শেরশাহের ছোট ভাই মিয়া নিজাম ও তার পরিবারকে রোহিতাস দূর্গে আশ্রয় দিয়ে উপকার করেছিলেন। কিন্তু রাজা চট করে শেরশাহের প্রস্তাবে সম্মতি দিতে পারলেন না। তার ইতস্ততঃ ভাব দেখে শেরশাহ কোরান ছুয়ে শপথ করেন এবং এর ফলে রাজা রাজা তাকে আশ্রয় দিতে রাজী হন। কিন্তু সেই মূর্খ রাজার জানা ছিলনা যে, কোরান হিন্দু ধর্মগ্রন্থের মত নয়। কোরানে আল্লাহর নির্দেশ আছে, বিধর্মী অমুসলমান কাফেরদের সঙ্গে যেকোন রকম মিথ্যাচার, ছলনা ও বিশ্বাষঘাতকতা করা যায়। ফলে সেই রাতেই শেরশাহ রোহতাস দূর্গ দখলের ছক করে ফেললেন। ১২০০ ডুলি সাজানো হল এবং প্রত্যেক ডুলিতে দু'জন করে পাঠান সৈন্য বোরখা পরে অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে বসে রইল। প্রথম কয়েকটা ডুলিতে কিছু মহিলা ছিল । তাই দূর্গের রক্ষীরা প্রথম কয়টা ডুলি পরীক্ষা করে চক্রান্ত বুঝতে পারলো না। এদিকে শেরশাহ রাজার কাছে খবর পাঠালেন যে, তার রক্ষীরা ডুলি পরীক্ষা করে মুসলমান রমনীদের অসম্মান করছেন । কাজেই ডুলি পরীক্ষা বন্ধ হল এবং প্রায় আড়াই হাজার আফগান সৈন্য দূর্গের মধ্যে ডুকে পড়ল। মূহুর্তে আরা আক্রমন করে কারারক্ষীদের হত্যা করলো এবং দূর্গ দখল করে নিল। রাজা হরেকৃষ্ণ রায় কোন মতে গুপ্ত পথ দিয়ে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করলেন । [Elliot & J.Dowson, IV,p-361]
শেরশাহের বাল্য নাম ছিল ফরিদ খা। প্রথম জীবনে তিনি দস্যুদের নেতা ছিলেন। এই দস্যুবৃত্তির কাজ কিভাবে হত ? ঐতিহাসিক আব্বাসের বর্ণনা অনুসারে, "তিনি তার ঘোড়াসাওয়ারদের সর্বক্ষন গ্রামের চতুর্দিকে পাহারা দিতে বলেন। সমস্ত পুরুষদের হত্যা করতে এবং নারী ও শিশুদের বন্দী করতে হুকুম দিলেন। সমস্ত গরু-বাছুর তুলে আনতে চাষ-আবাদ বন্ধ করতে এবং ক্ষেতের ফসল বিনষ্ট করতে হুকুম দিলেন। গ্রামের কোন লোক পাশাপাশি কোন গ্রাম হতে কিছু যাতে না আনতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে আদেশ দিলেন।"
১৯৭১-এ বাংলাদেশে ইয়াহিয়া বাহিনী একই নীতি অনুসরণ করেছিল।
হাসান খার অধীনে অনেক আফগান চকরী করত। তাদের কোন জমি জায়গা বা জায়গীর ছিল না। প্রথমে ফরিদ খা সেই সব আফগানদের জায়গীরের প্রলোভন দেখিয়ে অন্যত্র করে ছোটখাট একটা দস্য দল গঠন করলেন। তখন বিহারে আরও অনেক আফগান বাস করত। ফরিদ খা সেই সব স্বজাতীয় আফগানদের আহ্বান জানান তার দলে যোগ দেবার জন্য---"যার ঘোড়া আছে সে ঘোড়ায় চড়ে এবং অন্যান্যরা পায়ে হেটে আমার দলে যোগ দাও ।"
জায়গীর ও লুটের মাল পাবার লোভে তারাও এসে যোগ দিল। এই দল নিয়ে ফরিদ খা জমিদার ও বিত্তশালী হিন্দুদের টাকা পয়সা সহায় সম্বল লুটপাট করতে শুরু করে দিল। এইরকম একটি আক্রমন বর্ণ্না করতে গিয়ে আব্বাস খা লিখেছেন-- " অতি প্রত্যুষে ফরিদ খা তার দল-বল নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে সেই সব জমিদারদের, ইসলামী মতে যারা অপরাধী তাদের আক্রমন করল। সব পুরুষদের হত্যা করা হল এবং বন্দী নারী ও শিশুদের ক্রীতদাস হিসেবে বেচে দিতে অথবা নিজের কাজে ব্যবহার করতে হুকুম দিল। অন্য মুসলমানদের সেখানে এনে বসতি করতে আদেশ জারি করলেন।"
সম্রাট বাবরের নাম সবাই জানেন। ফতেপুর সিক্রি আক্রমন সম্পর্কে এই বাবর তার আত্মজীবনী তে লিখেছেন,
" শত্রুকে পরাজিত করার পর আমরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলাম এবং ব্যপকভাবে হত্যা করতে থাকলাম। আমাদের শিবির থেকে প্রায় দুই ক্রোশ দূরে ছিল তাদের শিবির। সেখানে পৌঁছে আমি মুহাম্মদী ও আরও কয়েকজন সেনাপতিকে হুকুম দিলাম তাদের হত্যা করতে, কেটে দু'খানা করতে, যাতে তারা আবার একত্রিত হবার সুযোগ না পায়।"
কত হিন্দুকে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল তার হিসাব পাওয়া যায়না। বাবর হুকুম দিলেন, কাছাকাছি একটি পাহাড়ের কাছে সমস্ত নরমুন্ডকে জড়ো করে একটি স্তম্ভ তৈরী করতে।
"সেই টিলার উপর কাটা মুন্ডের একটি মিনার বানাতে হুকুম দিলাম। বিধর্মী (হিন্দু) ও ধর্মত্যাগীদের অসংখ্য মৃত দেহ পথে ঘাটে ছড়িয়ে ছিল। এমন কি দূর দেশ আলোয়ার, মেওয়াট ও বায়না যাবার পথেও বহু মৃত দেহ পড়ে থাকতে দেখা গেল।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড.রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, অন্যান্য মুসলমান হানাদারের মত বাবরও হিন্দু মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংস করার মত বহু সাক্ষর রখে গেছেন। বাবর সম্বল ও চান্দেরী মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ নির্মান করেন।
বাবরের আদেশে তার সেনাপতি মীর বাকি অযোধ্যার রাম জন্মভূমি মন্দির ভেঙ্গে তাতে প্রায় এক লক্ষ হিন্দুর রক্ত চুন বালিতে মিশ্রিত করে ইট গেঁথে বাবরের নামে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া গোয়ালিয়রের নিকট জৈন মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংস করেন। [R.C.Majumder. BVB, Vol. VII, p-307]
বাবরের পৈশাচিক নরহত্যা, বন্দী নারী ও শিশুদের চামড়ার চাবুক দিয়ে মারা এবং তাদের সাথে পশুর মত ব্যবহার করা ইত্যাদি আরো অনেক বর্বর কাজকর্ম গুরু নানক স্বচক্ষে প্রত্যাক্ষ করেছিলেন। ১৫২১ খৃষ্টাব্দে বাবর প্রথমে শিয়ালকোট ও পরে সৈয়দপুর দখল করে এক ব্যপক গনহত্যার আদেশ দিলেন। ফলে হাজার হাজার অসামরিক হিন্দু প্রজাকে হত্যা করা হল।
এসব দেখে গুরু নানক লিখেছেন--
"হে সৃষ্টিকর্তা ভগবান, জীবন্ত যম হিসেবে তুমি কি দানবরূপী এই বাবরকে পাঠিয়েছ ? অমানুষিক তার অত্যাচার, পৈশাচিক তার হত্যা লীলা, অত্যাচারিতের বুক ফাটা আর্তনাদ ও করুন ক্রন্দন তুমি কি শুনতে পাওনা? তাহলে তুমি কেমন দেবতা ?"
[R.C.Majumder. BVB, Vol. VII, p-307]
১৫২৭ সালের ১৭ই মার্চ বাবর ফতেপুর সিক্রীর অদূরে খানুয়ার প্রান্তরে রাণা সংগ্রাম সিংহের সাথে যুদ্ধে অবর্তীর্ণ হন। মুসলমানদের বিবরন অনুসারে, সেদিন দেড় থেকে দুই লক্ষ হিন্দু মুসলমানদের হাতে কাটা পড়েছিল এবং সেই কাটা মুণ্ড দিয়ে পাহাড় তৈরী করা হয়েছিল ।
হিন্দু হত্যা করে তিনি হলেন আকবর দ্যা গ্রেট
১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে ভাগ্যের পরিহাসে হিন্দু বীর বিক্রমাদিত্য হোমরাজ ওরফে হিমু বিজয়ের দোরগোড়ায় পৌছেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হলেন। অতিশয় রক্তক্ষরনের ম্ৃতপ্রায় সম্রাট হোমরাজকে বৈরাম খা হাত পা বাধা অবস্থায় আকবরের সামনে উপস্থিত করল। এই ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে সমকালীন মুসলমান ঐতিহাসিক আহম্মদ ইয়াদ্গার তারিখ-ই-আফগানা গ্রন্থে লিখেছেন- সম্রাট হোমরাজকে ঐভাবে হাত পা বাধা অবস্থায় আকবরের সামনে উপস্থিত করে বৈরাম খা বলল- আজ প্রথম সাফল্যের এই শুভ মুহূর্তে আমাদের ইচ্ছা সম্রাটের মহান হস্ত তরবারির সাহায্যে এই বিধর্মী কাফেরের মস্তক ছিন্ন করুক। সেই অনুসারে সম্রাট তার মস্তক অপবিত্র দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করলেন। [Elliot & J.Dowson, V,pp-65-66]
'আকবর দি গ্রেট' নামের মোঘল সম্রাট যে কতখানি নিষ্টুর ও নৃশংস ছিলেন, আর একটি ছোট্ট ঘটনার মধ্য দিয়ে তা আরো সুন্দর ভাবে ফুটে উঠে। - একদা আকবর বিকেলের নামাজ থেকে ফিরে চাকরদের ডাকাডাকি করতে লাগলেন। কিন্তু সাড়া দেবার মত কাছাকাছি কেউ ছিল না। আকবর খুব রেগে গেলেন। হঠাত তিনি দেখতে পেলেন যে, তার আসনের পাশে এক ছোকরা চাকর মেঝেতে শুয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আকবর পেয়াদাদের ডেকে হুকুম দিলেন "এক্ষুনি একে মিনারের উপর থেকে নিচে ফেলে দাও।" পেয়াদারা তখনি তাকে আগ্রা দূর্গের উপর থেকে নিচে ফেলে দিল। এই ঘটনা বর্ননা করে মুসলমান ঐতিহাসিক আসাদ বেগ তার 'বিকায়া' গ্রন্থে লিখেছেন, সিংহাসন ও কৌচের কাছে গিয়ে তিনি (আকবর) দেখতে পেলেন যে, বাতি জ্বালাবার এক হতভাগ্য চাকর কৌচের কাছে মেঝেতে সাপের মত কুন্ডুলি পাকিয়ে মরার মত গুমাচ্ছে। ক্রুদ্ধ আকবর সেই চাকরটাকেও মিনারের উপর থেকে নিচে ফেলে দিতে আদেশ দিলেন। তদনুসারে তাকে ছুড়ে ফেলা হল এবং তার শরীর হাজার টুকরা হয়ে গেল।
[Elliot & J.Dowson, VI,p-164]
ইনিই মহামতি আকবর, ইংরেজীতে বলা হয় 'Akbar The Great'
১৫৬৭ খৃষ্টাব্দে আকবর মেবারের রাণা উদয় সিংহের বিরুদ্ধে অভিযান করেন এবং চিতোর দূর্গে অবরোধ করে দূর্গের দেওয়ালের নিকট বারূদ জমা করে প্রবল বিষ্ফোরণ ঘটানো হল। এতে প্রচীরের অংশ বিশেষ ধ্বংস হয়ে গেল। দূর্গ রক্ষার আর কোন উপায় না দেখে সেদিনই রাজপুত নারীরা জহর ব্রত অনুষ্টান করলেন। প্রায় ৩০০ রাজপুত নারী জ্বলন্ত আগুনে আত্মাহুতি দিলেন। দূর্গের মধ্যে তখন মাত্র ৮০০০ রাজপুত সৈন্য অবশিষ্ট ছিল। তারা প্রবল বিক্রমে যুদ্দ করে সকলেই প্রাণ দিলেন। সব মিটে গেলে পরদিন সকালে বিজয়ী আকবর হাতিতে চড়ে দূর্গে প্রবেশ করলেন। তখন দূর্গের মধ্যে ছিল ৪০ হাজার অসামরিক প্রজা। আশ্রয় নেওয়া ৪০ হাজার রাজপুত ক্ৃষক প্রজার ভাগ্যে কি ঘটলো ?
ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ লিখেছেন---
'দূর্গ অবরোধের সময় ঐ ৪০ হাজার (অসামরিক) ক্ৃষক প্রজা রাজপুত বাহিনীর ৮০০০ সৈন্যকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছিলেন। সে কারনে সম্রাট তাদের হত্যার আদেশ দিলেন। ফলে সেদিন ৩০ হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছিল।
ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, সেদিন কত রাজপুত মারা পড়েছিল তার সঠিক সংখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়। আবুল ফজল যে ৩০ হাজার সংখ্যা বলেছেন তা তো শোনা কথা, দেখা নয়, প্রক্ৃত সংখ্যা ৫০ হাজার, ৮০ হাজার, এক লাখ বা তারও বেশি হওয়া বিচিত্র নয়।
সব থেকে মজার ব্যপার হল, এই ঘটনার শেষাংশ আমাদের সকল ঐতিহাসিকই সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। কত রাজপুত সেদিন মারা পড়েছিল তা জানতে সম্রাটের খুব ইচ্ছা হয়। কিন্তু অত মৃতদেহ গুনবে কে ? সেষে সম্রাটের আদেশে সব মৃত দেহের পৈতা খুলে আনা হল এবং দাড়িপাল্লায় ওজন কয়া হলে মোট ওজন দাড়ালো সাড়ে চুয়াত্তর মণ ।
ভিনসেন্ট স্মিথ লিখেছেন "The recorded amount was 74.50 mans of about eight ounce each. (V.A. Smith, ibid-91)"
কাজেই প্রতিটি পৈতার ওজন ৮ আউন্স হলে কত হাজার বা কত লক্ষ পৈতা জড়ো করলে সাড়ে চুয়াত্তর মণ হয় তা অনুমান করা কঠিন কাজ নয় । এর সঙ্গে যোগ করতে হবে মহিলা ও শিশু, যাদের পৈতা ছিল না।
পরবর্তী কালে সম্রাট আওরঙ্গজেব হুকুম জারী করেন যে, প্রত্যেক দিন এমন সংখ্যক হিন্দু হত্যা করতে হবে যাতে তাদের পৈতা জড়ো করলে সোয়া এক মন হয় এবং এই পরিমাণ পৈতা এনে রোজ তাকে দেখাতে হবে। উত্তর ভারতে প্রতিটি পৌতার ওজন তিন আউন্স। সে হিসেবে প্রতিদিন ২৪ হাজার হিন্দু হত্যা করা হত।
সম্রাট আকবরের ঔরসে ও তার হিন্দু স্ত্রীর গর্ভের সন্তানের নাম সেলিম। তিনি সম্রাট আকবরের পর 'নুর উদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ গাজী' উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে বসেন। তার স্ত্রীও ছিলেন হিন্দু, অথচ তিনি গাজী (কাফের হত্যাকারী) উপাধি ধারণ করে তার রাজ্যে মন্দির নির্মান নিষিদ্ধ করেছিলেন।
আমাদের কোন কোন লেখক আকবরের হিন্দু কন্য বিবাহ ও তার পুত্র এবং উজির-নাজির সহ কর্মচারীদের হিন্দু কন্যা বিবাহে পুলকিত হয়ে উচ্ছ্বসিত প্রসংসা করেছেন। কেউ কেউ আকবরকে ধর্মনিরপেক্ষতার অবতার বানিয়ে ছেড়েছেন। কিন্তু যে সব মেয়েকে মোঘল হারেমে যেতে হয়েছে, সেই সব হতভাগ্যদের জন্মদাতা পিতারাই জানেন আকবরের সঠিক অবস্থান কোথায় ছিল।
সম্রাট আকবর প্রতিটি অভিজাত হিন্দু পরিবার থেকে কন্য সংগ্রহ করেছেন। তার হারেমে ৫০০০ হিন্দু কন্যা ছিল। হিন্দু মেয়ে সংগ্রহ করে তিনি উদার হয়েছিলেন; কিন্তু কোন মুসলমান মেয়ে হিন্দু পরিবারে বিয়ে দিয়ে উদারতা দেখাননি। হিন্দু পরিবারের ভিত নষ্ট করে তাদের এআত্মগরিমা ধ্বংস করে তাদের ইসলামে টেনে আনাই ছিল তার উদ্দেশ্য। আর এ কারনেই সম্রাট আকবর তার সারা জীবনে যতগুলি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন আর সবগুলিই ছিল হিন্দু রাজাদের বিরুদ্ধে। নবীজীই এই বিধান দিয়ে গেছেন।
আমাদের এক আহম্মক লেখক দীনেশচন্দ্র সেন হিন্দু কন্য মুসলমানদের ভোগে লাগায় উচ্ছ্বাসিত প্রশাংসা করে বলেছেন, এতে মুসলমান ও হিন্দর মধ্যে মেল বন্ধন দ্ৃঢ় হয় । কিন্তু মূর্খটা ইতিহাস পড়েনি; পড়লে জানতেন আকবরের ছেলে জাহাঙ্গীর হিন্দু মায়ের সন্তান হয়েও গুরু অর্জুনকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করেছিলেন। তার-- "মনের বাসনা হয় যত হিন্দু পাই, সুন্নত দেওয়াই আর কলেমা পড়াই।"
(চৈতন্য ভাগবত, ২য় ভাগ, পৃ-১৮৮)
সম্রাট শাহজাহান প্রায় অন্যান্য ধর্মে সাধু-সন্তদের ধর্মকথা শোনার নাম করে আগ্রায় ডেকে আনতেন। কিন্তু শাহজাহানের ফাদে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাদের মুসলমান হবার হুকুম দিতেন। যারা ঐ হুকুম মেনে নিয়ে মুসলমান হতেন তারা বেচে যেতেন। বাকীদের পরদিন সকালেই নানা রকম পৈশাচিক অত্যাচার করে হত্যা করা হত। সব থেকে বেশী অবাধ্যদের হাতির পায়ের তলায় পিষে মারা হত। [Trans-Arc. Soc. Agra. 1978. Jan-June, VIII-IX]
Keene লিখেছেন, একবার শাহজাহান ফতেপুর সিক্রী অবরোধ করে নির্মম অত্যাচারে মধ্য দিয়ে হিন্দু প্রজাদের সর্বস্ব লুট করেন এবং অভিজাত রমনীদের বলাতকার ও স্তন কেটে ফেলেন। হামদ লাহোরী তার বাদশাহ নামায় লিখেছেন, "একদা বাদশাহের গোচরে আনা হল যে, তার পিতার(জাহিঙ্গীর) আমলে বিধর্মী কাফেরদের শক্ত ঘাটি বারাণসীতে অনেক পুতুল পুজার মন্দির তৈরী শুরু হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত অসমাপ্তই থেকে যায়। কিন্তু বর্তমানে কাফেরদের দল সেই সব মন্দির তৈরীর কাজ সম্পূর্ণ করায় উদ্যোগ নিয়েছে। শুনে ধর্মের রক্ষক মহানুভব সম্রাট আদেশ জারি করলেন যে, বারাণসীসহ তার রাজ্যের যেখানে যেখানে আধা আধি মন্দির খাড়া হয়েছে তা সব ভেঙে ফেলতে হবে। অধুনা খবর এসেছে যে, তার আদেশ বলে এলাহবাদ প্রদেশের বারাণসী জেলায় ৭৬ টি মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছে।
শ্রীকানোয়ার লাল এর মতে শাহজাহান ছিলেন একজন গোড়া সুন্নী মুসলমান। তার পত্নী মমতাদের পরামর্শে তিনি নতুন করে হিন্দু মন্দির ভাঙার কাজ শুরু করেন। মুসলমান হিসাবে শাহজাহান কতখানি উগ্র ও গোড়া ছিলেন তা আর একটি ঘটনার মাধ্য দিয়ে ভালভাবে বোঝা যাবে। ১৬৩২ খ্ৃষ্টাব্দে কাস্মীর থেকে ফেরার পথে সম্রাটের নজরে আনা হল যে, রাজৌরী, ভিম্বর ও গুজরাটের কোন কোন স্থানে হিন্দুরা 'নও মুসলমান মহিলাদের'(বাধ্য হয়ে ধর্মান্তরিত হওয়া) পত্নীরূপে গ্রহন করেছে এবং বিবাহ করার পর সেই সব মুসলমান মহিলাদের আবার হিন্দু করছে। শুনে সম্রাটের ভীষণ ক্রোধ হল। সম্রাটের আদেশে সেই সকল হিন্দুদের ধরে আনা হল এবং বিরাট অঙ্কের টাকা জরিমানা ধার্য করা হল। প্রথমে এত বেশী জরিমানা করা হল যে, যাতে কেউ দিতে না পারে। তখন তাদের বলা হল যে, একমাত্র ইসলাম গ্রহন করলেই তাদের মুক্তি দেওয়া হবে। অন্যথায় মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত করা হবে। প্রায় সকলেই ধর্ম গ্রহনে অস্বীক্ৃতি জানালে তাদের হত্যা করা হল এবং ৪৫০০ মহিলাকে পুনরায় মুসলমান করা হল। [R.C.Majumder. BVB, Vol. VII. P-312]
ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথের মথে আকবরের হারেমে ৫০০০ রমনী ছিল। পিতার মৃত্যুর পর বাদশা হয়ে জাহাঙ্গীর ঐ হারেমের মালিক হন এবং রমনী সংখ্যা ১০০০ বাড়িয়ে ৬০০০ করেন। সাধারনত হিন্দু পরিবারের মেয়েদের ধরে এনে এই অভিশপ্ত হারেমে রাখা হত।
কারন ইসলামের নিয়ম হল--
১। হানা দিয়ে সকল পুরুষকে হত্যা করতে হবে।
২। নারী ও শিশুদের ভাগ বাটোয়ারা করে নিতে হবে, পছন্দ মত ভোগ করতে হবে, বিক্রি করতে হবে।
৩। অমুসলমানের সমস্ত সম্পত্তি (গনিমতের মাল) ভোগ দখল করতে হবে।
নতুন নতুন রমনীর দ্বারা হারেমের নবীকরন করা হত এবং পুরনো ও বয়স্কদের তাড়িয়ে দেওয়া হত। নূরজাহানের পিতা ইদমত-উদ-দৌলার মতে এইসব হতভাগিনী হারেম্বাসিনীদের কন্যা সন্তান জন্মালে তাদের হারেমেই রাখা হত এবং বড় হলে বাদশাহদের ভোগে লাগত। আর পুত্র সন্তান হলে সারা জীবনের জন্য কারাগারে নিক্ষেপ করা হত, খোজা করা হত বা হত্যা করা হত। [ P.N Oak, Tajmahal-The true story, p-207]
ইউরোপীয় পর্যটক বার্ণিয়ের তার ভ্রমন কাহিনী 'Travels in the Moghal Empire' -এ লিখেছেন, "প্রাসাদের মধ্যে ঘন ঘন মিনা বাজার বসিয়ে সেখানে জোর করে ধরে আনা শত শত হিন্দু রমনীদের বেচা-কেনা , সম্রাটের জন্য ধরে আনা শত শত হিন্দু রমনীকে উপহার হিসেবে গ্রহন করা, সরকারী খরচে বেশ কয়েক শ ন্ৃত্য পটিয়সী বেশ্যার বরণপোশণ, হারেম সুরক্ষার জন্য কয়েক শ, খোজা প্রহরী ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কামুক শাহজাহান তার কামনা ও লালসা চরিতার্থ করতেন।
পর্যটক পিটার মুন্ডি লিখেছেন, শাহজাহানের ছোট মেয়ে চিমনি বেগমের সাথে শাহজাহানের অবৈধ সম্পর্ক ছিল। বড় মেয়ে জাহানারার সঙ্গেও শাহজাহানের অবৈধ সম্পর্ক ছিল। এ ব্যাপারে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই একমত। শাহজাহান তার সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যেই বলতেন এবং যুক্তি দেখাতেন যে, গাছে ফল ধরলে বাগানের মালিরই অধিকার সবার আগে স্বাদ গ্রহন করার।
১৫৭৬ সালে রানা প্রাতাপের সঙ্গে হলদীঘাটের যুদ্ধের সময় বদায়ুনী নামে এক সেনাপতি আসাফ খার কাছে অভিযোগ করল যে, শত্রু ও মিত্র পক্ষের রাজপুতদের ঠিকমত চেনা যাচ্ছে না তাই তীর চালাতে অসুবিধা হচ্ছে। তখন আসফ খা তাকে বললেন, অত বাছ বিচার দরকার নেই। তীর চলালাতে থাক। কোন পক্ষের রাজপুত মারা গেল তা দেখার দরকার নেই। যে পক্ষের ই রাজপুত মরুক না কেন তাতেই ইসলামের লাভ। [R.C.Majumdar, B.V.B, p-132]
মোঘোল আমলে প্রায়ই ভয়াবহ আকাল হতো। ১৫৭৩-১৫৯৫ সালের মধ্যে পাচবার আকাল হয়। ১৫৯৫ সালের আকাল পাচ বছর ধরে চলতে থাকে। ১৬১৪ -১৬৬০ সালের মধ্যে মোট ১৩-বার আকাল হয়। শাহজাহানের আমলে ১৬৩০-৩১ সালে যে আকাল হয় তা সর্বাপেক্ষা বয়াবহ। সমস্ত দাক্ষিণাত্য ও গুজরাট অঞ্চলে আকাল ছড়িয়ে পড়ে। এই আকাল সম্বন্ধে হামিদ লাহোরী তার বাদশাহনামায় লিখেছেন, দাক্ষিণাত্যা ও গুজরাট এই দুই প্রদেশের মানুষের অবস্থা খুবই শোচনীয় অবস্থায় পৌছেছিল। লোকেরা এক খানা রুটির জন্য সারা জীবন দাসত্ব করতে রাজী ছিল, কিন্তু ক্রেতা ছিল না। এক টুকরো রুটির বললে একদল মানুষ কেনা যেত; কিন্তু সেই সুযোগ নেবার লোক ছিল না। অনেকদিন ধরে কুকুরের মাংস বিক্রি হল। হাড়ের গুড়া ময়দার সাথে মিশিয়ে বিক্রি করা হল।
ক্রমে দুর্দশা এমন পর্যায়ে পৌচলো যে, মানুষ মানুষের মাংস খেতে শুরু করল। পিতা মাতার কাছে সন্তানের স্নেহ ভালবাসা থেকে তার শরীরের মাংসই বেশী প্রিয় হয়ে উঠল।
এমন দূর্ভিক্ষ হওয়ার কারন কি ? কারণ, এর আগেই লক্ষ লক্ষ হিন্দু কৃষকদের মুসলমান না হওয়ার অপরাধে হত্যা করা হয়েছে, ফলে চাষ আবাদ করবে কে? মুসমানদের এই দুর্ভিক্ষ স্পর্শ করেনি। কারন হিন্দু বাড়ী লুটপাট। এই আকালে অনাহারে এত লোক মারা যায় যে, মৃত দেহের স্তুপে রাস্তা ঘাটে চলাচল অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। এইভাবে এক অতি উর্বর শস্য শ্যামল দেশ শ্মশানে পরিণত হয়েছিল।
ইংরেজ পর্যটক পিটার মান্ডি নিজের চোখে এই বীভস্য দৃশ্য দেখেছিলেন। তার রচনায়ও অনুরূপ বিবরণ পাওয়া যায়। হতভাগ্যরা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে পিটার মান্ডি একটি তাবু খাটাবার মত স্থানও পান নাই। একাধিক ইউরোপীয় পর্যটক ও ঐতিহাসিক শাহজাহানকে অত্যাচারী নিষ্টুর, বিলাসপ্রিয় ও ব্যভিচারী বলে চিহ্নিত করেছেন। টমাস রো, চেরী বার্নিয়ে, ডিলিয়ে, প্রভৃতি ইউরোপীয় পর্যটক ও যাজকদের বর্ণনার উপর ভিত্তিকরে ড. স্মিতও অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। শাহজাহান খ্ৃষ্টান, হিন্দু, ও পর্তুগিজদের উপর নির্যাতন করতেন এবং হিন্দু মন্দির ধ্বংস ও নতুন মন্দির নির্মানে বাধা দিতেন। তিনি হিন্দুদের উপর তীর্থকর পুনরায় প্রবর্তন করেছিলেন।