All Stories

পৃথিবীর প্রতিটি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে আজ প্রাণ প্রতিষ্ঠিত কিন্তু পৃথিবী যখন সৃষ্টি হয় তখন পৃথিবী ছিল মৃত উষর গলিত পাথর। তাহলে কীভাবে জীবনের শুরু? সচারচার এমন প্রশ্ন খুবই কম লোকেই জিজ্ঞেস করে থাকে। মানব ইতিহাসের বেশিরভাগ পাতা জুড়ে লেখা আছে এবং প্রায় সবাই বিশ্বাস করে কোন না কোন ঈশ্বর আমাদের অতিপ্রিয় জীবনটা এক ফুঁৎকারে বানিয়ে দিয়েছেন। কিছুদিন আগেও ঈশ্বরব্যতীত অন্যকোন ব্যাখ্যা ছিল মানুষের চিন্তারও বাইরে।

ঈশ্বর জীবনের জন্ম দিয়েছেন কথাটা এখন আর সত্য নয়। বিগত শতাব্দী ধরে কিছু বিজ্ঞানী কীভাবে প্রথম প্রাণের বিকাশ হয়েছিল খুঁজতে নিরন্তর গবেষণা করে গেছেন এবং গবেষণা বর্তমানেও চলছে। এমনকি বিজ্ঞানীগণ পরীক্ষাগারে সৃষ্টির আদিতে যেমন পরিবেশ ছিল কৃত্রিমভাবে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করে নিঃস্ব অবস্থা থেকে সম্পুর্ণ নতুন প্রাণের জন্ম দিয়েছেন।

যাকিছু অগ্রগতি হয়েছে সেটা কোন একক প্রচেষ্টা নয় কিন্তু আমরা দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এসেছি। আজকে অনেক বিজ্ঞানীই প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে অধ্যয়ন করছেন এবং তারা আত্মবিশ্বাসী যে তারা সঠিক পথেই আছেন এবং তাদের আত্মবিশ্বাস দাঁড়িয়ে আছে বহুদিনের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। এটা হলো আমাদের উৎপত্তির প্রকৃত উৎস আবিস্কারের কাহিনী। আধুনিক বিজ্ঞানের কিছু যুগান্তকারী আবিষ্কারকে ঘিরে আবর্তিত প্রাণের সৃষ্টি রহস্য গল্পটি মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ, সংগ্রাম এবং অসাধারণ সৃষ্টিশীলতায় পরিপূর্ণ। প্রাণের সৃষ্টিলগ্ন খুঁজতে মানব মানবীকে যেতে হয়েছে আমাদের পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় কোনায় এবং সহ্য করতে হয়েছে অবর্ণনীয় কষ্ট। কিছু বিজ্ঞানী নিযুক্ত ছিলেন অতি দানবীয় গবেষণা এবং পরিশ্রমে, পক্ষান্তরে কোন কোন বিজ্ঞানীকে কাজ করতে হয়েছে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী সরকারের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে।  

প্রথম পর্ব

পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তির গল্প

Dinosaurs actually lived quite recently (Credit: Oleksiy Maksymenko/Alamy)

প্রাণ অনেক পুরনো। ডায়নোসর সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত বিলুপ্ত প্রাণী এবং প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে তারা দোর্দণ্ড প্রতাপে টিকে ছিল। কিন্তু প্রাণের জন্ম খুঁজতে আরও সুদূর অতীতে যেতে হবে। আমাদের চেনাজানা সবচেয়ে পুরনো জীবাশ্মের বয়স প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন বছর যা কিনা সবচেয়ে পুরনো ডায়নোসরের থেকেও ১৪ গুণ বেশি পুরনো। কিন্তু জীবাশ্মের প্রাপ্ত বয়স হয়ত আরও অতীতের হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ২০১৬ সালের আগস্টে গবেষকগণ ৩.৭ বিলিয়ন বছর আগের আণুবীক্ষণিক অনুজীবের ফসিলের সন্ধান পেয়েছেন।

পৃথিবী নিজে এত বেশি পুরনো নয়, এইতো গঠিত হয়েছিল ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে। যদি আমরা ধারণা করি প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল এই পৃথিবীতেই তাহলে সেটা যুক্তিপূর্ণ এবং অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়। আমাদের জানামতে আমরা অন্যকোথাও প্রাণের অস্তিত্ব পাইনি। সংরক্ষিত পুরনো জীবাশ্ম পরীক্ষা করে বোঝা যায় যা কিছু ঘটেছে সেটা পৃথিবী গঠনের পরে এবং ৪.৫ বিলিয়ন বছরের মধ্যে। একই সাথে আমরা যদি প্রাণের বিকাশ মুহুর্তের কাছাকাছি চলে যাই তাহলে প্রকৃতপক্ষেই সৃষ্টিলগ্নে কেমন ছিল তার আধুনিক ধারণা পাবো।

The tree of life: most of the branches are bacteria (Credit: Hug, Banfield et al, Nature Microbiology)

১৯ শতক থেকেই জীববিজ্ঞানীগণ জানেন সব ধরণের জীবিতস্বত্বাই ‘কোষ’ দ্বারা গঠিত যা মূলত বিভিন্ন রকম এবং আকারের অতি ক্ষুদ্র জীবিত বস্তুকণার সমষ্টি। ১৭ শতকে আধুনিক অনুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের পরে প্রথম কোষের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু কোষ থেকেই জীবনের উৎপত্তি সেটা বুঝতে প্রায় এক শতাব্দী সময় লেগেছে। বিজ্ঞানীগণ জানতে পেরেছেন আমাদেরকে একটা কোষ সৃষ্টি করতে হলে ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর পরিবেশগত অবস্থা এবং উপাদান লাগবে।

একজন মানুষ হয়ত দেখতে একটা কইমাছ বা টাইরানোসোরাস রেক্স এর মত নয় কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের গভীর পর্যবেক্ষণে আমরা দেখতে পাবো সবপ্রাণীর দেহ প্রায় একই রকম কোষদ্বারা গঠিত। এমনকি বৃক্ষলতা, অণুজীব বা মাশরুম ইত্যাদি একই উপাদানে তৈরি। প্রাণীজগতের বেশিরভাগ প্রাণীই আণুবীক্ষণিক যাদের প্রায় সবাই একটা মাত্র কোষ দিয়ে গঠিত। ব্যাকটেরিয়া এককোষী প্রাণীদের মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত অতিপ্রজ এবং পৃথিবীর সর্বত্র পাওয়া যায়।

২০১৬ সালের এপ্রিলে বিজ্ঞানীগণ একটা সেমিনারে ‘প্রাণের বংশলতিকা’র’ সর্বশেষ আধুনিক সংস্করণ উপস্থাপন করেন যেখানে সব ধরণের জীবিত প্রাণীকে বংশলতিকায় পর্বের মাধ্যমে দেখানো হয়। প্রাণীপর্বের প্রায় সব শাখাতেই ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য। তদুপরি, প্রাণীর বংশলতিকা দেখে মনে হয় সব জীবের আদিপিতা হলো ব্যাকটেরিয়া। অন্যভাবে বলা প্রতিটি জীবিত প্রাণ এমনকি আপনি নিজেও প্রকৃতপক্ষে ব্যাকটেরিয়ার বংশধর। অর্থাৎ, আমরা এখন জীবনের উৎস কোথায় এই প্রশ্নের আরও যথাযথা উত্তর নিশ্চিত করতে পারবো। একটা কোষ তৈরি করতে আমাদের প্রয়োজন হবে ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগেকার পৃথিবীর উপাদান এবং প্রাণ বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ। তাহলে, প্রাণ সৃষ্টি কত দুরূহ ব্যাপার হবে?

A complete living cell (Credit: Equinox Graphics Ltd)

প্রথম অধ্যায়ঃ প্রথম গবেষণামূলক পরীক্ষা 

সমগ্র ইতিহাসজুড়ে, প্রাণের বিকাশ কীভাবে শুরু হয়েছিল এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনীয়তা কখনো বিবেচিত হয়নি। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে উত্তর তো আগে থেকেই সুনির্দিষ্ট। ১৮০০ শতকের আগে মানুষ বিশ্বাস করতো, প্রাণের উৎস এবং বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে তার পুর্ব শারীরিক এবং রাসায়নিক শক্তির মিথস্ক্রিয়া। এটি ছিল মানুষের সহজাত ধারণা যে সমস্ত জীবন্ত অস্তিত্ব সর্বশক্তিমানের একটি বিশেষ উপহার এবং অলৌকিকতার সাথে সম্পৃক্ত ছিল যা তৈরি হয়েছিল কোন প্রাণহীন পদার্থ থেকে। জীবন সৃষ্টিকারী রাসায়নিক উপাদানগুলো সবই সরল রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়াতে জন্ম নিলেও জীবনের সাথে সেই রাসায়নিক উপাদানগুলোর কোন সম্পর্ক নেই। অলৌকিকভাবে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে এই বিশ্বাস ধর্মবিশ্বাসের সাথে মিলে মিশে ফুলে ফলে পল্লবে শাখায় শাখায় বিকশিত হয়েছে। বাইবেলে বলা হয়েছে প্রথম মানবকে জীবন দান করতে ঈশ্বর তার মুখে ফুঁ দিয়েছিলেন এবং চির অজর অমর আত্মা প্রাণীর দেহে অলৌকিকভাবে বিরাজিত থাকে।

ধর্মীয় তত্ত্বের একটাই সমস্যা ছিল। অলৌকিকতা হলো নির্জলা ভুল ধারণা। ১৮০০ শতকের শুরুর দিকে বিজ্ঞানীগণ এমন কিছু বস্তুর সন্ধান পেলেন যেগুলো মনে হচ্ছিল জীবনের জন্য অনন্য উপাদান। সেইসব উপাদানের মধ্যে ইউরিয়া অন্যতম যা পাওয়া গিয়েছিল মূত্রের মধ্যে এবং ১৭৯৯ সালে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানের যা কিছু অর্জন ছিল সেটা অলৌকিকতার সাথে বেশি মানানসই। শুধু জীবিত প্রাণই এই ধরণের রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন করতে পারে সুতরাং ধারণা করা হয় ইউরিয়ার মধ্যে জীবনের শক্তি সঞ্চিত ছিল এবং এই কারণেই সেই বস্তুগুলো ছিল অন্যদের তুলনায় বিশেষ কিছু।

The German chemist Friedrich Wöhler, in a lithograph by Rudolf Hoffmann from 1856

কিন্তু ১৮২৮ সালে জার্মান রসায়নবিদ ফ্রেডরিখ ভোলার একটা সাধারণ রাসায়নিক দ্রব্য আমোনিয়াম সায়ানেট থেকে ইউরিয়া উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন যার সাথে জীবিত প্রাণের কোন যোগসূত্রতাই ছিল না। অন্যান্য বিজ্ঞানীগণও এগিয়ে এলেন ফ্রেডরিখ ভোলারের পথ অনুসরণ করে এবং কিছুদিনের মধ্যেই বিজ্ঞানীগণ বুঝতে পারলেন, প্রাণের সাথে কোন সম্পর্ক নাই এমন সাধারণ নিরীহ রাসায়নিক দ্রব্য দিয়েও রসায়নে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

বিজ্ঞানের গবেষণায় প্রাণ বিকাশে অলৌকিকতার স্থান এখানেই সমাপ্তি। কিন্তু মানুষ মনের গভীরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রাণ বিকাশের ঐশ্বরিক ধারণা এত সহজে দূর করতে পারে না। অনেকেই বলতে থাকে, রসায়ন থেকে প্রাণ সৃষ্টির মধ্যে বিশেষত্ব কিছু নেই বরং তাদের কাছে মনে হয় রোবটে প্রাণের মত ইন্দ্রজাল যা আমাদেরকে আসতে আসতে যন্ত্রে পরিণত করছে। এবং এটা অবশ্যই বাইবেলের সাথে সাংঘর্ষিক।

দশকের পর দশক জীবনের উৎস কোথায় এই রহস্য অবহেলিত থেকে গেছে। এমনকি বিজ্ঞানীগণ পর্যন্ত প্রাণ সৃষ্টির অলৌকিকত্বকে রক্ষা করতে রীতিমত মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন। যেমন ১৯১৩ সালের শেষ নাগাদ ব্রিটিশ জৈবরসায়নবিদ বেঞ্জামিন মূর ‘জৈব শক্তি’ নামে একটা তত্ত্বের অবতারণা করেন যেটা আসলে নতুন মোড়কে অলৌকিকতা প্রচারের প্রবল চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়। বেঞ্জামিন মূরের ‘জৈব শক্তি’ তত্ত্বে আবেগের প্রাধান্যও যথেষ্ট ছিল। বর্তমানে মূরের ‘জৈব শক্তি’ তত্ত্ব অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন বহু বহু বিজ্ঞানের কল্প-গল্পে দেখা যায় একজন মানুষের জীবনী শক্তি বাড়ানো সম্ভব অথবা জীবনী শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। ইংল্যান্ডের একটা টিভি সিরিয়াল ‘ডক্টর হু’ এর মধ্যে একটা চরিত্র টাইম লর্ডস জীবনী শক্তি নবায়নের চিন্তা করেন যেখানে দেখা যায় শক্তি বাড়ানো হচ্ছে, যদি ধীরেও প্রবাহিত হয় তবুও সে শীর্ষে পৌঁছে যাবে। বৈজ্ঞানিক কল্প-গল্পটিকে অভিনব মনে হলেও বাস্তবে এটা অতিপুরনো একটা অলিক ধারণা মাত্র।

তারপরেও ১৮২৮ সালের পর থেকেই দেবত্ববিহীন প্রাণের বিকাশ প্রথম কীভাবে ঘটেছিলে তার যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজতে থাকেন বিজ্ঞানীগণ। কিন্তু তারা কোন উপায় অন্তর খুঁজে পাননা। যদিও প্রাণ বিকাশের উৎস রহস্যে ঢাকা কিন্তু দশকের পর দশক অবহেলিত ছিল, তবুও তখন বিজ্ঞানীদের মনে হতে লাগল প্রাণের বিকাশ কীভাবে ঘটেছিল তা অবশ্যই আবিষ্কার করার বিষয়। সম্ভবত তখনকার প্রায় সবাই সৃষ্টিতত্ত্বের প্রশ্নে অলৌকিকতাবাদে আবেগের আতিশয্যে এমনভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িত ছিল যে তারা আবিষ্কারের পরবর্তী পদক্ষেপ শুরুই করতে পারছিল না।


Charles Darwin 

পূর্বের অচলাবস্থার পরিবর্তে ১৯ শতকে চার্লস ডারউইন এবং সহযোগীদের চেষ্টায় গড়ে তোলা বিবর্তন তত্ত্বের সুবাদে  জীববিজ্ঞানে নব নব আবিষ্কারের হাতছানি দেখা দেয়। চার্লস ডারউইন জানতেন কীভাবে প্রাণের বিকাশ হয়েছে এটা খুবই গভীর চিন্তা ও আবেগ মেশানো প্রশ্ন। চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের সূচনা হয় ১৮৫৯ সালে পৃথিবী তোলপাড় করা ‘অন দ্য ওরিজিন অফ স্পিসিজ’ বইটি প্রকাশের মাধ্যমে। বিবর্তনবাদে তিনি ব্যাখ্যা করে দেখান কীভাবে এই বিপুলা পৃথিবীর ততোধিক বিপুল পরিমাণ বিচিত্র প্রাণী জগতের উদ্ভব হয়েছে একটা সাধারণ এককোষের আদিপিতা থেকে। এই প্রথম কেউ বললেন ঈশ্বর প্রতিটি জীবকে আলাদা আলাদা করে সৃষ্টি করেননি। প্রাণিজগৎ সৃষ্টি হয়েছে কোটি কোটি বছর আগেকার পৃথিবীর প্রাথমিক জৈব উপাদান থেকে। প্রাণী জগতের সবাই সেই এককোষী আদিপিতার বংশধর।

চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ চারিদিকে বিতর্কের হৈচৈ ফেলে দিলো এবং বাইবেলের সাথে সাংঘর্ষিক তত্ত্বের জন্য বিতর্কিত হয়। বিশেষত উগ্র ধর্মান্ধ খ্রিস্টান সম্প্রদায় থেকে ডারউইন এবং তার বিবর্তনবাদ ভয়ানক হিংস্র আক্রমণের শিকার হলো। কিন্তু বিবর্তনবাদের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি কীভাবে প্রথম প্রাণের বিকাশ সম্ভব হয়।


Darwin wondered if life began in a “warm little pond” (Credit: Linda Reinink-Smith/Alamy)

ডারউইন জানতেন প্রশ্নটা অতীব গুরুতর, কিন্তু তিনি যথাসম্ভব সতর্কভাবে শুরু করেছিলেন তবুও চার্চের সাথে দ্বন্দ্ব এড়ানো সম্ভব হলো না। ১৮৭১ সালে লেখা এক চিঠিতে তিনি বিবর্তনবাদ নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। আবেগমথিত ভাষায় তিনি বলতে চেয়েছিলেন, প্রাণের উৎপত্তি কীভাবে এই তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর তিনি জানেন। প্রাণ বিকাশের প্রথম অনুকল্পটি উদ্ভূত হয়েছিল একটি সর্বগ্রাসী বাকস্বাধীনতাহীন দেশে। কিন্তু যদি (ওহহ কী বিশাল একটা যদি) আমরা বুঝতে পারি তবে দেখতে পাবো একটা ছোট উষ্ণ পুকুরে থাকে পর্যাপ্ত এমোনিয়া এবং ফসফরাস লবণ সেই সাথে আলো, উত্তাপ, বিদ্যুৎ এবং রাসায়নিকভাবে স্বয়ং উদ্ভূত আমিষের জটিলযৌগ আরও জটিল পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

ভিন্নভাবে বলা যেতে পারে, কী ঘটেছিল যখন দীর্ঘদিন সাধারণ জৈব উপাদান একটা ছোট জলাভূমিতে সূর্যালোকে নিমজ্জিত ছিল। কিছু জৈব উপাদান হয়ত মিলেমিশে প্রাণের সদৃশ কোন বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছিল। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় সেখানে সৃষ্টি হয়েছিল আমিষ এবং আমিষ আরও জটিল কোন বস্তুতে পরিণত হচ্ছিল। হতে পারে অস্পষ্ট ধারণামাত্র। কিন্তু ভবিষ্যতে এই অস্পষ্ট ধারণার উপর ভিত্তি করে অনুমান করা সম্ভব প্রথম কীভাবে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল।

এই ধারণার আত্মপ্রকাশ ঘটে সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত স্থানে। আপনি হয়ত ভাবতে পারেন ঈশ্বরবিহীন প্রাণ বিকাশের মত সাহসী চিন্তা বিকশিত হয়েছে একটা গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে মানুষের বাক স্বাধীনতা সামাজিক ঐতিহ্যের অংশ। হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র? কিন্তু না, বাস্তব ঘটনা হলো অলৌকিকতাকে পাশ কাটিয়ে জীবনের উৎপত্তি নিয়ে প্রথম অনুমান করেন নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে যেখানে মুক্তিচিন্তা নিষিদ্ধ। তখন স্ট্যালিনের রাশিয়াতে সবকিছু রাস্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে। মানুষের চিন্তা, এমনকি পঠন পাঠনের বিষয় যা কিছু কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় সেটাও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। ওপারিন কল্পনা করতেন কেমন ছিল পৃথিবী যখন সবেমাত্র সৃষ্টি হলো?

সবথেকে আলোচিত ঘটনা ছিল স্ট্যালিন জীনতত্ত্বের প্রচলিত পঠন পাঠনের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের আরেক জীববিজ্ঞানী এবং কৃষিবিদ ট্রোফিম ডেনিশোভিচ লিসেঙ্কো জোসেফ মেন্ডেলের জিনতত্ত্ব এবং ডারউইনের বিবর্তনবাদকে বাতিল করে বংশপরম্পরার উপর জোর দেন। তিনি মনে করতেন প্রাণী তার জীবনের অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে সঞ্চারিত করে যায়। লিসেঙ্কো দেখালেন উন্নতজাতের গম থেকে উন্নত এবং অধিকফলনশীল কিভাবে উৎপাদন করা যায়। স্ট্যালিন কমিউনিস্ট ভাবধারার সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ ট্রোফিম ডেনিশোভিচ লিসেঙ্কোর মতবাদকে চাপিয়ে দেন। জীনতত্ত্ব নিয়ে যেসব বিজ্ঞানীরা কাজ করছিলেন তাদেরকে জনসাধারণের কাছে লিসেঙ্কোর মতবাদকে সমর্থন এবং প্রচার করতে বাধ্য করা হয়। অন্যথায় তাদের স্থান হতো লেবার ক্যাম্পে।

Alexander Oparin lived and worked in the USSR (Credit: Sputnik/Science Photo Library)

স্ট্যালিনের দমন নিপীড়নের শাসনের মধ্যেই আলেক্সান্ডার ওপারিন চালিয়ে যেতে লাগলেন তার জৈবরাসায়নিক গবেষণা। ওপারিন নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন কারণ তার কমিউনিজমের প্রতি সন্দেহাতীত আনুগত্য। ওপারিন লিসেঙ্কোর তত্ত্বকে সমর্থন দিলেন এবং দেশের সেবা করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের “অর্ডার অফ লেনিন” সর্বোচ্চ পুরষ্কারে ভূষিত হন।

১৯২৪ ওপারিন প্রকাশ করলেন “দ্য ওরিজিন অফ লাইফ” তার অমর গ্রন্থখানি। দ্য ওরিজিন অফ লাইফ বইতে ওপারিন প্রাণের বিকাশ অন্বেষণে যে প্রস্তবনা করেন সেটা ডারউইনের বিবর্তনবাদের “একটি ছোট উষ্ণ পুকুর” ধারণার সাথে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়। ওপারিন চিন্তা কল্পনা করেছিলেন কেমন ছিল সদ্য গঠিত পৃথিবীর চেহারা। পৃথিবীর উপরিভাগ ছিল কল্পনাতীত গরম, মহাকাশ থেকে খসে পড়া জ্বলন্ত পাথরের খণ্ড। পৃথিবী তখন ছিল বিভিন্ন ধরণের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থমিশ্রিত অর্ধগলিত পাথরের বিশৃঙ্খল স্তুপ। পদার্থগুলোর মধ্যে কার্বনের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশী।


Oceans formed once Earth had cooled down (Credit: Richard Bizley/Science Photo Library)

যদি আমরা অণুবীক্ষণযন্ত্রের নিচে কোয়াসারভেটিভ (জৈব রাসায়নিক দ্রবণ) পরীক্ষা করে দেখি তাহলে দেখব দ্রবণটি জীবিত কোষের মত আচরণ করছে। ধীরে ধীরে উত্তপ্ত পৃথিবী ঠাণ্ডা হচ্ছে, জলীয় বাস্প ঘনীভূত হয়ে প্রথম বৃষ্টি নামল পৃথিবীর বুকে, তরল পানিতে তলিয়ে গেল চরাচর। বৃষ্টি পড়ার আগেও সমুদ্র ছিল তবে সেটা প্রচণ্ড উত্তাপে গলিত কার্বননির্ভর ঘন তরল। এমতাবস্থায় দুইটা জিনিস ঘটতে পারে।

প্রথমত, বিভিন্ন রাসায়নিক নিজেদের মাঝে বিক্রিয়া করে অসংখ্য নতুন জটিল যৌগ সৃষ্টি করতে পারে। তাদের মধ্যে কিছু যৌগ আরও জটিল যৌগে পরিণত হবে। আলেক্সান্ডার ওপারিন ধারণা করেন রাসায়নিক দ্রব্যের ক্ষুদ্র মৌলগুলি প্রাণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। চিনি এবং এমাইনো এসিড পৃথিবীর পানি থেকেই উৎপত্তি হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, কিছু রাসায়নিক দ্রব্য নতুন আণুবীক্ষণিক অণুজীবের কাঠামো তৈরি করতে শুরু করে। কিছু অণুজীবের জৈবরাসায়নিক উপাদান পানিতে দ্রবীভূত হয় না। যেমন তেল পানির উপর আস্তরণ সৃষ্টি করে ভেসে থাকে। কিন্তু যখন কিছু জৈবরাসায়নিক উপাদান পানির সাথে মিশে যায় তখন গোলাকার “কোয়াসারভেটিভ” বস্তুর রূপ ধারণ করে যেগুলো আয়তনে .০১ সেমি বা (.০০৪) ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। অণুজীব বেড়ে ওঠে, তারা অবয়ব পরিবর্তন করে এমনকি মাঝেমাঝে তারা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তারা চারপাশের পানির রাসায়নিক দ্রব্যের সাথে বিক্রিয়ায় অংশ নেয়। এভাবেই জীবনসদৃশ রাসায়নিক উপাদান নিজেদের মাঝে সংগঠিত হতে থাকে। ওপারিন প্রস্তাব করেন কোয়াসারভেটিভ হলো আধুনিক জীবিত কোষের পূর্বপুরুষ।

ওপারিনের মতবাদে দেখা যাচ্ছে জীবিত অনুজীবের জন্ম হয়েছে পুরোপুরি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এখানে কোন ঈশ্বরের হাত নেই। এমনকি অলৌকিকভাবে জীবনী শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে এমন চিন্তাও প্রথাগত যার কোন ভিত্তি নেই।

পাঁচ বছর পরে ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী জন বারডন স্যান্ডারসন হালডেন একই মতবাদ নিয়ে র‍্যাশনালিস্ট অ্যানুয়াল জার্নালে একটা ছোট প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। হালডেন ইতিমধ্যেই বিবর্তনবাদে প্রভূত অবদান রেখে ফেলেছেন। তিনি ডারউইনের মতবাদকে বিকাশমান জীনতত্ত্বের আলোকে আরও সংহত করে।

রঙ্গমঞ্চে হালডেন তার জীবনের থেকেও বড় চরিত্র। একবার তিনি কানের পর্দায় ছিদ্রের চিকিৎসায় ডিকম্প্রেসন চেম্বারের অভিজ্ঞতার জন্য ডাক্তারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। কিন্তু পরে তিনি রম্য করে লিখেছিলেন, “কানের পর্দা সাধারণত প্রাকৃতিকভাবেই সুস্থ হয়ে যায়। যদি পর্দায় ছিদ্র থেকেই যায় এবং তারফলে কেউ যদি বধির হয়ে যায় তাহলে সে কারো ভ্রূক্ষেপ না করেই বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে পারবে যেটা হবে একটা সামাজিক অর্জন”।

ওপারিনের মত হালডেনও মতবাদ প্রচার করলেন, সমুদ্র প্রাথমিক অবস্থা থেকে স্থিতিশীল গরম ঘন তরলে পরিণত হলে কিভাবে সেখানের পানিতে রাসায়নিক অনুজীব নিজে থেকেই সৃষ্ট হতে পারে। পৃথিবীর এরকম পরিবেশে প্রথম জন্ম নেয় জীবনের অণুজীব অথবা অর্ধজীবন্ত বস্তু আর এরপরের স্তরে সৃষ্টি হয় স্বচ্ছ তেলতেলে জেলির মত থকথকে বস্তু।

কথিত আছে ওপারিন এবং হালডেন যে তত্ত্বের অবতারণা করেন পৃথিবীর সমস্ত জীববিজ্ঞানী সেগুলো ব্যক্ত করেন মাত্র। প্রাণের প্রথম বিকাশ ঘটেছে পুরোপুরি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এখানে কোন ঈশ্বরের হাত নেই। ডারউইনের বিবর্তনবাদের আগেও পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। ডারউইন সেটাকে যুক্তিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করেছেন কিন্তু এই তত্ত্ব খ্রিস্টবাদের ভিত্তিমূলে চরম কুঠারাঘাত।

ডারউইনের বিবর্তনবাদের একটাই সমস্যা ছিল। তার প্রচারিত বিবর্তনবাদকে নির্ভুল প্রমাণ করতে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার নিরিখে কোন প্রমাণ নাই। ঈশ্বরবিহীন সৃষ্টিতত্ত্ব সোভিয়েত ইউনিয়নে কোন সমস্যা নয় কারণ কমিউনিস্ট শাসিত সোভিয়েত রাষ্ট্রীয়ভাবেই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। সেজন্যই কমিউনিস্ট নেতারা প্রাণের উৎপত্তি গবেষণায় বস্তবাদী ব্যাখ্যাকে অকুন্ঠ সমর্থন জানায়। হাল্ডেন নিজেও ছিলেন একজন নাস্তিক এবং কমিউনিজমের কড়া সমর্থক।

তখনকার সময়ে বিবর্তনবাদ গৃহীত হবে নাকি বাতিল করবে সেটা নির্ভর করত প্রধানত ব্যক্তির ধর্ম বিশ্বাসী ব্যক্তিত্বের উপর। জীবনের উৎস অনুসন্ধান করা বিশেষজ্ঞ জীববিজ্ঞানী জার্মানির ওসনাব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আরমেন মালকিদজানিয়ান বলেন, বিবর্তনবাদ গৃহীত হবে কি হবে না নির্ভর করে মানুষেরা কি ধর্মে বিশ্বাস করে নাকি বাম ধারার কমিউনিজম সমর্থন করে সেটার উপর। সোভিয়েত ইউনিয়নে বিবর্তনবাদ সাদরে গৃহীত হয়েছে কারণ সেখানে ঈশ্বরের প্রয়োজন ছিল না। যদি পশ্চিমাবিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব সেখানের মানুষেরা অনেক বস্তুবাদী। তাদের চিন্তা বাম ঘেঁষা কমিউনিস্ট বা উদারপন্থার দিকে ধাবিত।

প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আদিম জৈবরাসায়নিক ঘন তরল সহযোগে এই ধারণাটি ওপারিন-হালডেন তত্ত্ব বলে ব্যাপক পরিচিত পেয়ে গেল। ওপারিন-হালডেন তত্ত্ব যুক্তির বিচারে গ্রহণযোগ্য হলেও তত্ত্বটির একটা সমস্যা ছিল। ওপারিন-হালডেন তত্ত্বকেও নির্ভুল করার স্বপক্ষে কোন গবেষণালব্ধ প্রমাণ নেই। পচিশ বছর পার হয়ে গেলেও তত্ত্বটির স্বপক্ষে কোন প্রমাণ দাড় করানো যায়নি।


The English geneticist J. B. S. Haldane (Credit: Science Photo Library)

সময়ের সাথে প্রাণের উদ্ভব গবেষণায় যোগ দেন ১৯৩৪ সালে রসায়নে নোবেল বিজয়ী আমেরিকান রসায়নবিদ। হ্যারল্ড উরে পারমাণবিক বোমা বানানোর দলেও কাজ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ম্যানহাটান প্রকল্পে পারমাণবিক বোমার অতি প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম ২৩৫ সমৃদ্ধ করতেন। যুদ্ধের পরে তিনি নিউক্লিয়ার প্রযুক্তিকে সুশীল সমাজের নিয়ন্ত্রণে দেয়ার জন্য আন্দোলন করেন। প্রফেসর উরে ধারণা করেছিলেন, আমদের পৃথিবী আদিম অবস্থায় সম্ভবত অ্যামোনিয়া, মিথেন এবং হাইড্রোজেনের মিশেলে পিণ্ডাকৃতির ছিল। এই মিশ্রণকে যদি বৈদ্যুতিক বিস্ফোরণ এবং পানির সংস্পর্শে আনা যায় তাহলে অ্যামাইনো এসিড উৎপন্ন করা সম্ভব। এটা সর্বজন বিদিত যে, অ্যামাইনো এসিড হলো জীবনের প্রথম উপাদান।

উরে এই সময়ে পৃথিবীর বাইরে মহাকাশ এবং মহাকাশের ভাসমান বস্তুকণার রসায়ন নিয়ে আগ্রহী হন বিশেষকরে দেখতে চেয়েছিলেন সৌরজগৎ যখন সবে সৃষ্টি হলো তখন ঠিক কী ঘটছিল। একদিন তিনি ক্লাসে বললেন সৃষ্টিলগ্নে পৃথিবীর বায়ুস্তরে সম্ভবত অক্সিজেনের অস্তিত্ব ছিল না। রাসায়নিক বিক্রিয়ার সংস্পর্শে অক্সিজেন হয়ত ধ্বংস হয়ে গেছে। উরের ক্লাস লেকচারের প্রস্তাবিত ‘অক্সিজেনবিহীন পৃথিবী’ ওপারিন এবং হালডেনের আদিম জৈবরাসায়নিক ঘন তরল ধারণাকে আরও বেগবান করে। প্রফেসর হ্যারল্ড উরের ক্লাসে উপস্থিত ছিলেন পিএইচডি’র গবেষণারত ছাত্র স্ট্যানলি মিলার। মিলার প্রফেসর উরেকে প্রস্তাব দেন পরীক্ষা করে দেখার আসলেই কেমন ছিল সেদিনের সৌরজগতের পরিবেশ। উরে নিজের ক্লাস লেকচারের উপর কিছুটা সন্দেহ পোষণ করলেও মিলার অক্সিজেনবিহীন পৃথিবীর চিন্তায় মনোনিবেশ করলেন। তাদের মাঝে বিস্তর আলোচনার পরে ১৯৫২ সালে প্রফেসর উরে এবং তার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্ট্যানলি লয়েড মিলার যৌথভাবে প্রথমবারের মত প্রাণের খোঁজে বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাত ‘উরে-মিলার এক্সপেরিমেন্ট’ পরীক্ষা শুরু করলেন।

The Miller-Urey experiment (Credit: Francis Leroy, Biocosmos/Science Photo Library)

পরীক্ষার যন্ত্রপাতি খুব সাধারণ। মিলার পূর্বের আলোচিত ধারণা অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্নের চারটি রাসায়নিক উপাদান গরম পানি, হাইড্রোজেন গ্যাস, অ্যামোনিয়া এবং মিথেন চারটি কাঁচের জারে পূর্ণ করে তাদের মাঝে সংযোগ করে দিলেন। কাঁচের গ্লাসের মাঝে মিলার বারবার তড়িৎপ্রবাহ দিতে লাগলেন যাতে বজ্রপাত ঘটে। আদিকালে পৃথিবীতে বজ্রপাতের ঘটনা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক।  এই পরীক্ষার মাধ্যমে খুব সাধারন পরিবেশেই প্রচুর পরিমাণ জৈব অনু উৎপাদন সম্ভব। মিলার দেখতে পেলেন প্রথমদিনেই কাঁচের জারের মধ্যকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গোলাপী আভা ধারন করেছে এবং সপ্তাহ শেষে ঘন তরল দ্রবণটি গাঢ় লাল হয়ে গেল। পরিষ্কার বোঝা গেল জারে জৈব রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ তৈরি হয়েছে।

মিলার পরীক্ষাগারে বিশ্লেষণ করে মিশ্রণটিতে গ্লাইসিন এবং আলানাইন নামে দুইটা অ্যামাইনো এসিড পেলেন। অ্যামাইনো এসিডকে জীবন সৃষ্টির প্রাথমিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং অ্যামাইনো এসিড আমিষ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আমিষ আমাদের শরীরের শারীরবৃত্তিক এবং জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মিলার গবেষণাগারে জন্ম দিলেন প্রাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।  মিলারের গবেষণার ফলাফল বিখ্যাত সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হলো ১৯৫৩ সালে। প্রাণের বিকাশ অভিযানে ‘উরে-মিলার এক্সপেরিমেন্ট’ স্মরণীয় ঘটনা। উদার প্রফেসর উরে এই গবেষণার সমুদয় কৃতিত্ব মিলারকে দিয়ে আর্টিকেল থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞানের গবেষক জন সাদারল্যান্ড বলেন, “উরে-মিলার পরীক্ষার শক্তি এখানেই যে, আপনি সাধারণ পরিবেশে প্রচুর অণুজীব সৃষ্টি করতে পারবেন”। জীবন আরও জটিল যা আমরা চিন্তা করি তার থেকেও বেশি।

পরবর্তীতে আরও গবেষণায় পৃথিবী সৃষ্টির আদিতে অন্যান্য গ্যাসের মিশ্রণও ছিল আবিষ্কারের কারণে আগের গবেষণা ভুল প্রমানিত হয়। কিন্তু সেটা নিয়ে সম্পূরক আলোচনা হতে পারে। জন সাদারল্যান্ড বলেন, “উরে-মিলার পরীক্ষা ছিল দৃষ্টান্ত, তারা মানুষের কল্পনা জাগাতে পেরেছিলেন এবং প্রাণের উৎস সন্ধানে ব্যাপকভাবে চর্চা করতে থাকে”। মিলারের পরীক্ষার প্রভাবে অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও এগিয়ে এলেন ভিন্ন ভিন্ন মৌল থেকে অনুজীব সৃষ্টির গবেষণা করে প্রাণের উৎস সন্ধানে। প্রাণের রহস্য উন্মোচনের হাতছানি মনে হয় সন্নিকটে। এতদিনে পরিষ্কার হওয়া গেছে জীবন এত জটিল যে আমাদের চিন্তাকে বিহ্বল করে দেয়। অবশেষে জানা গেল জীবন্ত কোষ শুধুমাত্র কিছু রসায়নের জটিল যৌগ নয় জীবন হলো সূক্ষ্ম শিল্পিত যন্ত্রবিশেষ। হঠাৎ করে সম্পর্কহীন বস্তু থেকে নিজেকে সৃষ্টি করে নিজেই আবার বড় বাধা অতিক্রম করে ছুটে যায় নতুন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানীদের বুঝে ওঠার আগেই।


The machinery inside cells is unbelievably intricate (Credit: Equinox Graphics Ltd)

দ্বিতীয় পর্ব

বিজ্ঞান সভায় বিভাজন

১৯৫০ সালের শুরুর দিকে বিজ্ঞানীগণ আমাদের জীবন ঈশ্বরের দান বহুদিনের পুরনো বাসি ধারণা থেকে সরে আসতে থাকে। তার পরিবর্তে তারা সম্ভাবনাময় জীবন কীভাবে নিজে নিজেই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হলো সেই রহস্য উন্মোচনে আগ্রহী হয়ে উঠল। এবং যুগান্তকারী পরীক্ষার জন্য অবশ্যই স্ট্যানলি মিলারকে ধন্যবাদ। বিজ্ঞানীগণ জীবন অন্বেষণে মিলারের পরীক্ষা থেকে ভবিষ্যৎ গবেষণার রশদ পেয়ে গেলেন।

মিলার যখন ভিন্ন ভিন্ন বস্তু থেকে জীবনের উপাদান বানাতে ব্যস্ত তখন কিছু বিজ্ঞানী জীন  কিসের তৈরি খুঁজতে গবেষণারত। ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানীগণ অনেকগুলো অনুজীবকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। চিনি, চর্বি, আমিষ, নিউক্লিক এসিড যেমন ডিঅক্সিরিবোনিউক্লিক এসিড বা সংক্ষেপে ডিএনএ আবিষ্কার হয়ে গেছে এতদিনে। ২০শতক হলো আবিষ্কারের স্বর্ণযুগ। বিজ্ঞানের বড় বড় আবিষ্কারগুলো এই শতাব্দীতেই ঘটেছে।

আজকে আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি ডিএনএ আমাদের জীন বহন করে। কিন্তু ডিএনএ আবিষ্কার ১৯৫০ দশকের বিজ্ঞানীদের জন্য একটা আঘাত কারণ আমিষের জটিল গঠন দেখে তারা আমিষকেই জীন ভেবেছিলেন। ১৯৫২ সালে আলফ্রেড হারশে এবং মার্থা চেস বিজ্ঞানীদের ভুল ভেঙ্গে দেন। তারা ওয়াশিংটনের কার্নেজি ইনস্টিটিউটে শুধু প্রোটিন আর ডিএনএ বহনকারী ক্ষুদ্র ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন। পুনোরুৎপাদনের জন্য ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার মাঝে সংক্রামিত হয়। পরীক্ষায় আলফ্রেড হারশে এবং মার্থা চেস জানতে পারলেন সংক্রামক ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে প্রবেশ করেছে কিন্তু প্রোটিন বাইরেই রয়ে গেল। পরিষ্কার বুঝা গেল, ডিএনএ হলো জীনের উপাদান।

হারশে এবং মার্থা চেস’র পরীক্ষার ফলাফল ডিএনএ কীভাবে কাজ করে এবং কেমন তার গঠন আবিষ্কারের গবেষণায় তোলপাড় সৃষ্টি করে দিলো। পরের বছর ডিএনএ রহস্যের সমাধান করে ফেললেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ফ্রান্সিস ক্রিক এবং জেমট ওয়াটসন। দীর্ঘ পরিশ্রমসাধ্য গবেষণায় তাদেরকে সাহায্য করে রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন। ২০শতকের আবিষ্কারগুলো জীবনের উৎস অন্বেষণের পথে নতুন মাত্রা যোগ করে। আবিষ্কৃত হতে থাকে জীবন্ত কোষের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা অবিশ্বাস্য জটিলতা।


James Watson and Francis Crick with their model of DNA (Credit: A. Barrington-Brown/Gonville and Caius College/Science Photo Library)

ক্রিক এবং ওয়াটসন বুঝতে পেরেছিলেন ডিএনএ হলো দুইটা প্যাচানো মইয়ের সদৃশ বস্তু যারা আবার নিজেদের মধ্যেও সর্পিল আকৃতিতে জড়িয়ে থাকে। প্যাচানো মইয়ের দুই প্রান্ত নিউক্লিওটাইড নামের মলিকিউল দ্বারা গঠিত। আমার আপনার এবং আমাদের সবার জীন এসেছে ব্যাকটেরিয়া নামের আদিপিতা থেকে। ডিএনএ’র গঠন ব্যাখ্যা করে কিভাবে আমাদেরকে কোষ ডিএনএকে অনুসরণ করে। অন্যভাবে বলা যায়, ডিএনএ উন্মোচন করে কিভাবে বাবা-মা তাদের জীনের প্রতিলিপি তৈরি করে এবং পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। এখানের মূল আলোচ্য বিষয় হলো, এখন প্যাচানো দুই সর্পিল মইয়ের রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব। তখন আমরা জানতে পারি জীবের বংশগতির ধারা যা তৈরি হয়েছে জীবের বংশপরম্পরায়। বংশগতির ধারাকে আমরা এ, টি সি এবং জি দিয়ে চিহ্নিত করতে পারি। বংশগতির ভিত্তি সাধারণত ডিএনএ’র সর্পিল মইয়ের মধ্যে সুরক্ষিত অবস্থায় থাকে এবং প্রতিলিপি তৈরির প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।

এই একই প্রক্রিয়ায় বংশগতি জীবনের শুরু থেকেই বাবা-মা তাদের সন্তানদের মাঝে জীবনের বৈশিষ্ট্য প্রবাহিত করতে থাকে। ক্রিক এবং ওয়াটসন আবিষ্কার করেন ব্যাকটেরিয়া থেকে কিভাবে ধাপে ধাপে বংশগতির প্রতিলিপি তৈরি করে প্রাণী আজকের অবস্থানে চলে এসেছে।

ক্রিক এবং ওয়াটসন ১৯৫৩ সালে তাদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান “নেচার”বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করেন। ক্রিক এবং ওয়াটসনের আবিষ্কারের ফলে পরের বছরগুলোতে জৈবরাসায়নিক বিজ্ঞানীগণ ডিএনএ ঠিক কী তথ্য বহন করে সেটার আদ্যপান্ত খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তারা দেখতে চাইলেন কীভাবে DNA তে সংরক্ষিত তথ্য জীবন্ত কোষে ব্যবহৃত হয়। জীবনের অভ্যন্তরে লুকায়িত গোপন খবর প্রথমবারের মত প্রকাশের পথে। তখন হঠাৎ করে বিজ্ঞানীদের কাছে ওপারিনের ধারণাকে মামুলি সাদাসিধা।

আবিষ্কার হয়ে গেল DNA ’র মাত্র একটাই কাজ। আপনার ডিএনএ আপনার কোষদেরকে বলে দেয় কীভাবে প্রোটিন তৈরি করতে হবে। প্রোটিন সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে মলিকিউল। প্রোটিন ছাড়া আপনি খাদ্য হজম করতে পারবেন না, আপনার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাবে এবং আপনি নিশ্বাস নিতে পারবেন না।

DNA থেকে প্রোটিন উৎপন্নের জটিল প্রক্রিয়া দেখলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। যে কারো পক্ষে জীবনের উৎস কী ব্যাখ্যা করতে যাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ল কারণ এত জটিল প্রক্রিয়া কীভাবে একা একা শুরু হয়েছিল সেটা বিজ্ঞানীগণের চিন্তার জন্যও দুরূহ। প্রতিটি প্রোটিনই মূলত অ্যামাইনো এসিডের বিশাল শিকল একটা বিশেষ শৃঙ্খলার বাঁধনে তারা পারস্পারিক আবদ্ধ। অ্যামাইনো এসিডের ক্রম নির্ধারণ করে দেয় প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক আকার এবং এভাবেই প্রোটিন কাজ করে। সর্পিল DNA’র অভ্যন্তরে প্রাণের প্রয়োজনীয় তথ্য সাংকেতিক আকারে লিপিবদ্ধ থাকে। সুতরাং যখন একটা কোষকে কোন নির্দিষ্ট প্রোটিন সৃষ্টি করতে হয় তখন সে অ্যামাইনো এসিডের শিকলের নাগাল পেতে DNA’র মধ্যে সংরক্ষিত জীন থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য বিশ্লেষণ করতে শুরু করে।

কিন্তু এখানেও একটা প্যাচ আছে। DNA জীবনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই কোষ DNA কে সংরক্ষণ করতে নিরাপদে জমিয়ে রাখে। এই কারণে কোষ DNA’র তথ্যকে প্রতিলিপি করে RNA (রাইবোনিউক্লিক এসিড) মলিকিউলে স্থানান্তর করে। DNA যদি পাঠাগারের বই ধরি তাহলে RNA  হবে গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ লেখা ছেঁড়া কাগজের সমষ্টি। DNA’র তুলনায় RNA ছোট। সর্পিল মইতে RNA’র একটামাত্র সুতোর মত প্রান্ত। এপর্যায়ে RNA’র মধ্যে সংরক্ষিত তথ্য প্রোটিনে পরিণত হয় এবং প্রচুর পরিমাণ ‘রাইবোসোম’ মলিকিউল গঠন করে।

প্রতিটি জীবিত কোষে এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এমনকি অতি সাধারণ ব্যাকটেরিয়াও এই প্রক্রিয়ার বাইরে নয়। খাদ্যগ্রহণ এবং অবিরাম নিঃশ্বাস প্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়া জীবনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রাণের উৎস ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদের অবশ্যই DNA, RNA, রাইবোসোম এই তিন প্রোটিনের জটিল মিথস্ক্রিয়া বুঝতে হবে। কীভাবে তাদের উৎপত্তি হলো, কেমন করেই বা তারা পরস্পর কাজ শুরু করে।


Cells can become enormously intricate (Credit: Russell Kightley/Science Photo Library)

হঠাৎ করেই ওপারিন এবং হালডেনের ধারণা নিতান্ত সাদামাটা প্রতীয়মান হয়ে গেল। একই সাথে মিলারের যে যুগান্তকারী পরীক্ষার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়েছিল অ্যামাইনো এসিড যা দিয়ে প্রোটিন সৃষ্টি সম্ভব সেটাকেও মনে হলো অসম্পূর্ণ এবং ভাসাভাসা। কীভাবে জীবন সৃষ্টি হয়েছিল সেই প্রশ্নের উত্তর থেকে এখনো আমরা অনেক দূরে। মিলারের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ছিল সৃষ্টি রহস্য উন্মোচনের দীর্ঘ যাত্রাপথের সূচনামাত্র। জীবন গঠিত হয়েছিল RNA দিয়ে এই ধারণা এখন প্রভূত প্রমাণিত এবং বিজ্ঞানে খুব প্রভাবশালী তত্ত্ব।

জন সাদারল্যান্ড বলেন, “DNA সৃষ্টি করে RNA এবং RNA সৃষ্টি করে প্রোটিন যা লিপিড হিসেবে মুখ আটকানো রসায়নের থলের মধ্যে থাকে। আপনি যদি DNA, RNA এবং লিপিডের দিকে তাকাই তাহলে এর জটিলতা দেখে বিস্ময়ে আপনার মুখ হা হয়ে যাবে। কীভাবে আমরা খুঁজে পাবো

অন্যান্য বিজ্ঞানীগণকে যদি ধরি প্রাণের উৎস গবেষণার রাস্তা তৈরি করেছেন তাহলে ব্রিটিশ রসায়নবিদ লেজলি ওরগেলকে বলতে হবে প্রথম বিজ্ঞানী যিনি সেই রাস্তায় যাত্রা শুরু করেন। লেজলি ওরগেলই প্রথম ক্রিক এবং ওয়াটসনের DNA’র মডেল নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পরে তিনি মঙ্গলগ্রহে রোবটিক যান পাঠাতে নাসা’র ভাইকিং প্রোগ্রামে সাহায্য করেছিলেন। ওরগেল প্রাণের উৎস কী এই বৈজ্ঞানিক জিজ্ঞাসাকে চিহ্নিত করলেন। ১৯৬৮ সালে লিখিত এক গবেষণাপত্রে তিনি দাবি করেন জীবনের শুরুতে প্রোটিন বা DNA কিছুই ছিলনা। জীবন সৃষ্টি হয়েছিল পুরোপুরি RNA দিয়ে এবং ফ্রান্সিস ক্রিক ওরগেলের এই দাবীকে সমর্থন দেন।

ওরগেলের দাবী যদি সঠিক হয় তাহলে আদিম RNA মলিকিউলকে অবশ্যই অভিযোজন ক্ষমতা থাকতে হবে এবং তারা নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করবে। ধারণা করা হচ্ছে সম্ভবত DNA  একই প্রক্রিয়া কাজ করে।

জীবন গঠিত হয়েছিল RNA দিয়ে এই ধারণা এখন প্রভূত প্রমাণিত হয়েছে এবং বিজ্ঞানে খুব প্রভাবশালী তত্ত্ব। কিন্তু জন্ম দিয়েছে বৈজ্ঞানিক তর্কযুদ্ধের যা অবধি চলছে।

জীবন শুরু হয়েছিল RNA দিয়ে দাবী করেই ওরগেল ক্ষান্ত হননি, তিনিই সবার আগে প্রস্তাব করেন RNA নিজেকে নিজেই পুনরুৎপাদন করতে পারে যা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। অন্যভাবে বলা যায় তিনি শুধু জীবন কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল সেটাই বলেননি, জীবন কী এই প্রশ্নেরই সমাধান তিনি করে ফেলেছেন। এ পর্যায়ে বিজ্ঞানীগন প্রাণের জন্ম রহস্য নিয়ে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেলেন।


DNA is at the heart of almost every living thing (Credit: Equinox Graphics Ltd)

অনেক জীববিজ্ঞানী ওরগেলের ‘প্রাণ নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করে’ দাবীর সাথে সহমত পোষণ করলেন। ডারউইনের বিবর্তনবাদের সারাংশ ছিল নিজের অসংখ্য প্রতিলিপি বা সন্তান জন্মদানের মাধ্যমেই শুধু প্রাণী নিজের বংশ রক্ষা করতে পারে। কিন্তু জীবনের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো যেমন জীবন বেঁচে থাকার জন্য একটি জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে ঘটতে থাকা রাসায়নিক প্রক্রিয়া। বেঁচে থাকতে হলে চারিপাশের পরিবেশ থেকে শক্তি সঞ্চয় করতে হয়। অনেক জীববিজ্ঞানী মনে করেন জীবনের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো জীবনের অভ্যন্তরীণ চলমান রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং জীবের নিজের প্রতিলিপি উদ্ভব হয়েছে অনেক পরে। এখানেই বিতর্কের শুরু। ১৯৬০ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীগণ জীবনের উত্থান গবেষণায় দুই সলে বিভক্ত। সাদারল্যান্ড বলেন, “জীবনের অভ্যন্তরীণ চলমান রাসায়নিক প্রক্রিয়া নাকি বংশগতি প্রথম” প্রশ্নই বিজ্ঞানীগণের নতুন দুই প্রান্তে বিভাজন। তাই বিজ্ঞান সভা মাঝে মাঝেই দ্বিধা বিভাজনের তর্কে পর্যবসিত হয়। ততদিনে তৃতীয় একদল বিজ্ঞানী প্রচার করলেন প্রথমে মলিকিউলের ধারকের জন্ম হয়েছে কারণ তারা ছিল তখন ভাসমান। জীবন সৃষ্টিতে কোষের উপাদানগুলোকে জড়ো করতে হয়েছে। কোষের উপাদানগুলো ছাড়া অভ্যন্তরীণ চলমান রাসায়নিক প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব নয়। সাদারল্যান্ড বলেন, প্রাণ সৃষ্টিতে কোষের প্রয়োজন যে কথা ওপারিন এবং হালডেন কয়েক দশক আগেই জোরালোভাবে বলে গেছেন। সম্ভবত জীবনের প্রথম কোষ চর্বি জাতীয় স্বচ্ছ তরল পর্দায় আবৃত ছিল।

জীবন বিকাশের এই তিনটা গবেষণা এবং তর্কালোচনার স্বপক্ষে বিপক্ষে অনেক বিজ্ঞানী আছেন এবং অদ্যাবধি আলোচনা চলছে। বিজ্ঞানীগণ নিজেদের ধারণার স্বপক্ষে নিরন্তর গবেষণা করেছেন এমনকি অনেক সময় অন্ধভাবে স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করছে। প্রায়ই দেখা যায় একদন বিজ্ঞানী আত্মপক্ষ সমর্থন করে অন্য বিজ্ঞানীগণকে নির্বোধ বলতেও দ্বিধা করছে না। ফলে জীবনের উৎস নিয়ে বিজ্ঞান সভার বিতর্ক সাংবাদিকদের পত্রিকার চটকদার কলাম আর সাধারণ পাঠকদের মুখরোচক গল্পে পরিণত হয়েছে। ওরগেলকে ধন্যবাদ। তিনি প্রথম ধারণা দিলেন বংশগতি নয় বরং জীবন গঠিত হয়েছিল RNA দিয়ে। তারপর এলো ১৯৮০ দশক, বিজ্ঞানের চমক লাগানো আবিষ্কারের যুগ এবং পাওয়া হওয়া গেল কীভাবে জীবনের জন্ম প্রশ্নের অমীমাংসিত উত্তর।


RNA could be the key to life’s beginning (Credit: Equinox Graphics Ltd)

চলবে…

অনুবাদক – বিকাশ মজুমদার 

মূল প্রবন্ধ: The secret of how life on earth began




পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি -প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব

পৃথিবীর প্রতিটি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে আজ প্রাণ প্রতিষ্ঠিত কিন্তু পৃথিবী যখন সৃষ্টি হয় তখন পৃথিবী ছিল মৃত উষর গলিত পাথর। তাহলে কীভাবে জীবনের শুরু? সচারচার এমন প্রশ্ন খুবই কম লোকেই জিজ্ঞেস করে থাকে। মানব ইতিহাসের বেশিরভাগ পাতা জুড়ে লেখা আছে এবং প্রায় সবাই বিশ্বাস করে কোন না কোন ঈশ্বর আমাদের অতিপ্রিয় জীবনটা এক ফুঁৎকারে বানিয়ে দিয়েছেন। কিছুদিন আগেও ঈশ্বরব্যতীত অন্যকোন ব্যাখ্যা ছিল মানুষের চিন্তারও বাইরে।

ঈশ্বর জীবনের জন্ম দিয়েছেন কথাটা এখন আর সত্য নয়। বিগত শতাব্দী ধরে কিছু বিজ্ঞানী কীভাবে প্রথম প্রাণের বিকাশ হয়েছিল খুঁজতে নিরন্তর গবেষণা করে গেছেন এবং গবেষণা বর্তমানেও চলছে। এমনকি বিজ্ঞানীগণ পরীক্ষাগারে সৃষ্টির আদিতে যেমন পরিবেশ ছিল কৃত্রিমভাবে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করে নিঃস্ব অবস্থা থেকে সম্পুর্ণ নতুন প্রাণের জন্ম দিয়েছেন।

যাকিছু অগ্রগতি হয়েছে সেটা কোন একক প্রচেষ্টা নয় কিন্তু আমরা দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এসেছি। আজকে অনেক বিজ্ঞানীই প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে অধ্যয়ন করছেন এবং তারা আত্মবিশ্বাসী যে তারা সঠিক পথেই আছেন এবং তাদের আত্মবিশ্বাস দাঁড়িয়ে আছে বহুদিনের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। এটা হলো আমাদের উৎপত্তির প্রকৃত উৎস আবিস্কারের কাহিনী। আধুনিক বিজ্ঞানের কিছু যুগান্তকারী আবিষ্কারকে ঘিরে আবর্তিত প্রাণের সৃষ্টি রহস্য গল্পটি মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ, সংগ্রাম এবং অসাধারণ সৃষ্টিশীলতায় পরিপূর্ণ। প্রাণের সৃষ্টিলগ্ন খুঁজতে মানব মানবীকে যেতে হয়েছে আমাদের পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় কোনায় এবং সহ্য করতে হয়েছে অবর্ণনীয় কষ্ট। কিছু বিজ্ঞানী নিযুক্ত ছিলেন অতি দানবীয় গবেষণা এবং পরিশ্রমে, পক্ষান্তরে কোন কোন বিজ্ঞানীকে কাজ করতে হয়েছে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী সরকারের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে।  

প্রথম পর্ব

পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তির গল্প

Dinosaurs actually lived quite recently (Credit: Oleksiy Maksymenko/Alamy)

প্রাণ অনেক পুরনো। ডায়নোসর সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত বিলুপ্ত প্রাণী এবং প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে তারা দোর্দণ্ড প্রতাপে টিকে ছিল। কিন্তু প্রাণের জন্ম খুঁজতে আরও সুদূর অতীতে যেতে হবে। আমাদের চেনাজানা সবচেয়ে পুরনো জীবাশ্মের বয়স প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন বছর যা কিনা সবচেয়ে পুরনো ডায়নোসরের থেকেও ১৪ গুণ বেশি পুরনো। কিন্তু জীবাশ্মের প্রাপ্ত বয়স হয়ত আরও অতীতের হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ২০১৬ সালের আগস্টে গবেষকগণ ৩.৭ বিলিয়ন বছর আগের আণুবীক্ষণিক অনুজীবের ফসিলের সন্ধান পেয়েছেন।

পৃথিবী নিজে এত বেশি পুরনো নয়, এইতো গঠিত হয়েছিল ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে। যদি আমরা ধারণা করি প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল এই পৃথিবীতেই তাহলে সেটা যুক্তিপূর্ণ এবং অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়। আমাদের জানামতে আমরা অন্যকোথাও প্রাণের অস্তিত্ব পাইনি। সংরক্ষিত পুরনো জীবাশ্ম পরীক্ষা করে বোঝা যায় যা কিছু ঘটেছে সেটা পৃথিবী গঠনের পরে এবং ৪.৫ বিলিয়ন বছরের মধ্যে। একই সাথে আমরা যদি প্রাণের বিকাশ মুহুর্তের কাছাকাছি চলে যাই তাহলে প্রকৃতপক্ষেই সৃষ্টিলগ্নে কেমন ছিল তার আধুনিক ধারণা পাবো।

The tree of life: most of the branches are bacteria (Credit: Hug, Banfield et al, Nature Microbiology)

১৯ শতক থেকেই জীববিজ্ঞানীগণ জানেন সব ধরণের জীবিতস্বত্বাই ‘কোষ’ দ্বারা গঠিত যা মূলত বিভিন্ন রকম এবং আকারের অতি ক্ষুদ্র জীবিত বস্তুকণার সমষ্টি। ১৭ শতকে আধুনিক অনুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের পরে প্রথম কোষের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু কোষ থেকেই জীবনের উৎপত্তি সেটা বুঝতে প্রায় এক শতাব্দী সময় লেগেছে। বিজ্ঞানীগণ জানতে পেরেছেন আমাদেরকে একটা কোষ সৃষ্টি করতে হলে ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর পরিবেশগত অবস্থা এবং উপাদান লাগবে।

একজন মানুষ হয়ত দেখতে একটা কইমাছ বা টাইরানোসোরাস রেক্স এর মত নয় কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের গভীর পর্যবেক্ষণে আমরা দেখতে পাবো সবপ্রাণীর দেহ প্রায় একই রকম কোষদ্বারা গঠিত। এমনকি বৃক্ষলতা, অণুজীব বা মাশরুম ইত্যাদি একই উপাদানে তৈরি। প্রাণীজগতের বেশিরভাগ প্রাণীই আণুবীক্ষণিক যাদের প্রায় সবাই একটা মাত্র কোষ দিয়ে গঠিত। ব্যাকটেরিয়া এককোষী প্রাণীদের মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত অতিপ্রজ এবং পৃথিবীর সর্বত্র পাওয়া যায়।

২০১৬ সালের এপ্রিলে বিজ্ঞানীগণ একটা সেমিনারে ‘প্রাণের বংশলতিকা’র’ সর্বশেষ আধুনিক সংস্করণ উপস্থাপন করেন যেখানে সব ধরণের জীবিত প্রাণীকে বংশলতিকায় পর্বের মাধ্যমে দেখানো হয়। প্রাণীপর্বের প্রায় সব শাখাতেই ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য। তদুপরি, প্রাণীর বংশলতিকা দেখে মনে হয় সব জীবের আদিপিতা হলো ব্যাকটেরিয়া। অন্যভাবে বলা প্রতিটি জীবিত প্রাণ এমনকি আপনি নিজেও প্রকৃতপক্ষে ব্যাকটেরিয়ার বংশধর। অর্থাৎ, আমরা এখন জীবনের উৎস কোথায় এই প্রশ্নের আরও যথাযথা উত্তর নিশ্চিত করতে পারবো। একটা কোষ তৈরি করতে আমাদের প্রয়োজন হবে ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগেকার পৃথিবীর উপাদান এবং প্রাণ বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ। তাহলে, প্রাণ সৃষ্টি কত দুরূহ ব্যাপার হবে?

A complete living cell (Credit: Equinox Graphics Ltd)

প্রথম অধ্যায়ঃ প্রথম গবেষণামূলক পরীক্ষা 

সমগ্র ইতিহাসজুড়ে, প্রাণের বিকাশ কীভাবে শুরু হয়েছিল এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনীয়তা কখনো বিবেচিত হয়নি। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে উত্তর তো আগে থেকেই সুনির্দিষ্ট। ১৮০০ শতকের আগে মানুষ বিশ্বাস করতো, প্রাণের উৎস এবং বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে তার পুর্ব শারীরিক এবং রাসায়নিক শক্তির মিথস্ক্রিয়া। এটি ছিল মানুষের সহজাত ধারণা যে সমস্ত জীবন্ত অস্তিত্ব সর্বশক্তিমানের একটি বিশেষ উপহার এবং অলৌকিকতার সাথে সম্পৃক্ত ছিল যা তৈরি হয়েছিল কোন প্রাণহীন পদার্থ থেকে। জীবন সৃষ্টিকারী রাসায়নিক উপাদানগুলো সবই সরল রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়াতে জন্ম নিলেও জীবনের সাথে সেই রাসায়নিক উপাদানগুলোর কোন সম্পর্ক নেই। অলৌকিকভাবে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে এই বিশ্বাস ধর্মবিশ্বাসের সাথে মিলে মিশে ফুলে ফলে পল্লবে শাখায় শাখায় বিকশিত হয়েছে। বাইবেলে বলা হয়েছে প্রথম মানবকে জীবন দান করতে ঈশ্বর তার মুখে ফুঁ দিয়েছিলেন এবং চির অজর অমর আত্মা প্রাণীর দেহে অলৌকিকভাবে বিরাজিত থাকে।

ধর্মীয় তত্ত্বের একটাই সমস্যা ছিল। অলৌকিকতা হলো নির্জলা ভুল ধারণা। ১৮০০ শতকের শুরুর দিকে বিজ্ঞানীগণ এমন কিছু বস্তুর সন্ধান পেলেন যেগুলো মনে হচ্ছিল জীবনের জন্য অনন্য উপাদান। সেইসব উপাদানের মধ্যে ইউরিয়া অন্যতম যা পাওয়া গিয়েছিল মূত্রের মধ্যে এবং ১৭৯৯ সালে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানের যা কিছু অর্জন ছিল সেটা অলৌকিকতার সাথে বেশি মানানসই। শুধু জীবিত প্রাণই এই ধরণের রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন করতে পারে সুতরাং ধারণা করা হয় ইউরিয়ার মধ্যে জীবনের শক্তি সঞ্চিত ছিল এবং এই কারণেই সেই বস্তুগুলো ছিল অন্যদের তুলনায় বিশেষ কিছু।

The German chemist Friedrich Wöhler, in a lithograph by Rudolf Hoffmann from 1856

কিন্তু ১৮২৮ সালে জার্মান রসায়নবিদ ফ্রেডরিখ ভোলার একটা সাধারণ রাসায়নিক দ্রব্য আমোনিয়াম সায়ানেট থেকে ইউরিয়া উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন যার সাথে জীবিত প্রাণের কোন যোগসূত্রতাই ছিল না। অন্যান্য বিজ্ঞানীগণও এগিয়ে এলেন ফ্রেডরিখ ভোলারের পথ অনুসরণ করে এবং কিছুদিনের মধ্যেই বিজ্ঞানীগণ বুঝতে পারলেন, প্রাণের সাথে কোন সম্পর্ক নাই এমন সাধারণ নিরীহ রাসায়নিক দ্রব্য দিয়েও রসায়নে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

বিজ্ঞানের গবেষণায় প্রাণ বিকাশে অলৌকিকতার স্থান এখানেই সমাপ্তি। কিন্তু মানুষ মনের গভীরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রাণ বিকাশের ঐশ্বরিক ধারণা এত সহজে দূর করতে পারে না। অনেকেই বলতে থাকে, রসায়ন থেকে প্রাণ সৃষ্টির মধ্যে বিশেষত্ব কিছু নেই বরং তাদের কাছে মনে হয় রোবটে প্রাণের মত ইন্দ্রজাল যা আমাদেরকে আসতে আসতে যন্ত্রে পরিণত করছে। এবং এটা অবশ্যই বাইবেলের সাথে সাংঘর্ষিক।

দশকের পর দশক জীবনের উৎস কোথায় এই রহস্য অবহেলিত থেকে গেছে। এমনকি বিজ্ঞানীগণ পর্যন্ত প্রাণ সৃষ্টির অলৌকিকত্বকে রক্ষা করতে রীতিমত মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন। যেমন ১৯১৩ সালের শেষ নাগাদ ব্রিটিশ জৈবরসায়নবিদ বেঞ্জামিন মূর ‘জৈব শক্তি’ নামে একটা তত্ত্বের অবতারণা করেন যেটা আসলে নতুন মোড়কে অলৌকিকতা প্রচারের প্রবল চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়। বেঞ্জামিন মূরের ‘জৈব শক্তি’ তত্ত্বে আবেগের প্রাধান্যও যথেষ্ট ছিল। বর্তমানে মূরের ‘জৈব শক্তি’ তত্ত্ব অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন বহু বহু বিজ্ঞানের কল্প-গল্পে দেখা যায় একজন মানুষের জীবনী শক্তি বাড়ানো সম্ভব অথবা জীবনী শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। ইংল্যান্ডের একটা টিভি সিরিয়াল ‘ডক্টর হু’ এর মধ্যে একটা চরিত্র টাইম লর্ডস জীবনী শক্তি নবায়নের চিন্তা করেন যেখানে দেখা যায় শক্তি বাড়ানো হচ্ছে, যদি ধীরেও প্রবাহিত হয় তবুও সে শীর্ষে পৌঁছে যাবে। বৈজ্ঞানিক কল্প-গল্পটিকে অভিনব মনে হলেও বাস্তবে এটা অতিপুরনো একটা অলিক ধারণা মাত্র।

তারপরেও ১৮২৮ সালের পর থেকেই দেবত্ববিহীন প্রাণের বিকাশ প্রথম কীভাবে ঘটেছিলে তার যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজতে থাকেন বিজ্ঞানীগণ। কিন্তু তারা কোন উপায় অন্তর খুঁজে পাননা। যদিও প্রাণ বিকাশের উৎস রহস্যে ঢাকা কিন্তু দশকের পর দশক অবহেলিত ছিল, তবুও তখন বিজ্ঞানীদের মনে হতে লাগল প্রাণের বিকাশ কীভাবে ঘটেছিল তা অবশ্যই আবিষ্কার করার বিষয়। সম্ভবত তখনকার প্রায় সবাই সৃষ্টিতত্ত্বের প্রশ্নে অলৌকিকতাবাদে আবেগের আতিশয্যে এমনভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িত ছিল যে তারা আবিষ্কারের পরবর্তী পদক্ষেপ শুরুই করতে পারছিল না।


Charles Darwin 

পূর্বের অচলাবস্থার পরিবর্তে ১৯ শতকে চার্লস ডারউইন এবং সহযোগীদের চেষ্টায় গড়ে তোলা বিবর্তন তত্ত্বের সুবাদে  জীববিজ্ঞানে নব নব আবিষ্কারের হাতছানি দেখা দেয়। চার্লস ডারউইন জানতেন কীভাবে প্রাণের বিকাশ হয়েছে এটা খুবই গভীর চিন্তা ও আবেগ মেশানো প্রশ্ন। চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের সূচনা হয় ১৮৫৯ সালে পৃথিবী তোলপাড় করা ‘অন দ্য ওরিজিন অফ স্পিসিজ’ বইটি প্রকাশের মাধ্যমে। বিবর্তনবাদে তিনি ব্যাখ্যা করে দেখান কীভাবে এই বিপুলা পৃথিবীর ততোধিক বিপুল পরিমাণ বিচিত্র প্রাণী জগতের উদ্ভব হয়েছে একটা সাধারণ এককোষের আদিপিতা থেকে। এই প্রথম কেউ বললেন ঈশ্বর প্রতিটি জীবকে আলাদা আলাদা করে সৃষ্টি করেননি। প্রাণিজগৎ সৃষ্টি হয়েছে কোটি কোটি বছর আগেকার পৃথিবীর প্রাথমিক জৈব উপাদান থেকে। প্রাণী জগতের সবাই সেই এককোষী আদিপিতার বংশধর।

চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ চারিদিকে বিতর্কের হৈচৈ ফেলে দিলো এবং বাইবেলের সাথে সাংঘর্ষিক তত্ত্বের জন্য বিতর্কিত হয়। বিশেষত উগ্র ধর্মান্ধ খ্রিস্টান সম্প্রদায় থেকে ডারউইন এবং তার বিবর্তনবাদ ভয়ানক হিংস্র আক্রমণের শিকার হলো। কিন্তু বিবর্তনবাদের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি কীভাবে প্রথম প্রাণের বিকাশ সম্ভব হয়।


Darwin wondered if life began in a “warm little pond” (Credit: Linda Reinink-Smith/Alamy)

ডারউইন জানতেন প্রশ্নটা অতীব গুরুতর, কিন্তু তিনি যথাসম্ভব সতর্কভাবে শুরু করেছিলেন তবুও চার্চের সাথে দ্বন্দ্ব এড়ানো সম্ভব হলো না। ১৮৭১ সালে লেখা এক চিঠিতে তিনি বিবর্তনবাদ নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। আবেগমথিত ভাষায় তিনি বলতে চেয়েছিলেন, প্রাণের উৎপত্তি কীভাবে এই তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর তিনি জানেন। প্রাণ বিকাশের প্রথম অনুকল্পটি উদ্ভূত হয়েছিল একটি সর্বগ্রাসী বাকস্বাধীনতাহীন দেশে। কিন্তু যদি (ওহহ কী বিশাল একটা যদি) আমরা বুঝতে পারি তবে দেখতে পাবো একটা ছোট উষ্ণ পুকুরে থাকে পর্যাপ্ত এমোনিয়া এবং ফসফরাস লবণ সেই সাথে আলো, উত্তাপ, বিদ্যুৎ এবং রাসায়নিকভাবে স্বয়ং উদ্ভূত আমিষের জটিলযৌগ আরও জটিল পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

ভিন্নভাবে বলা যেতে পারে, কী ঘটেছিল যখন দীর্ঘদিন সাধারণ জৈব উপাদান একটা ছোট জলাভূমিতে সূর্যালোকে নিমজ্জিত ছিল। কিছু জৈব উপাদান হয়ত মিলেমিশে প্রাণের সদৃশ কোন বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছিল। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় সেখানে সৃষ্টি হয়েছিল আমিষ এবং আমিষ আরও জটিল কোন বস্তুতে পরিণত হচ্ছিল। হতে পারে অস্পষ্ট ধারণামাত্র। কিন্তু ভবিষ্যতে এই অস্পষ্ট ধারণার উপর ভিত্তি করে অনুমান করা সম্ভব প্রথম কীভাবে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল।

এই ধারণার আত্মপ্রকাশ ঘটে সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত স্থানে। আপনি হয়ত ভাবতে পারেন ঈশ্বরবিহীন প্রাণ বিকাশের মত সাহসী চিন্তা বিকশিত হয়েছে একটা গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে মানুষের বাক স্বাধীনতা সামাজিক ঐতিহ্যের অংশ। হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র? কিন্তু না, বাস্তব ঘটনা হলো অলৌকিকতাকে পাশ কাটিয়ে জীবনের উৎপত্তি নিয়ে প্রথম অনুমান করেন নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে যেখানে মুক্তিচিন্তা নিষিদ্ধ। তখন স্ট্যালিনের রাশিয়াতে সবকিছু রাস্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে। মানুষের চিন্তা, এমনকি পঠন পাঠনের বিষয় যা কিছু কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় সেটাও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। ওপারিন কল্পনা করতেন কেমন ছিল পৃথিবী যখন সবেমাত্র সৃষ্টি হলো?

সবথেকে আলোচিত ঘটনা ছিল স্ট্যালিন জীনতত্ত্বের প্রচলিত পঠন পাঠনের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের আরেক জীববিজ্ঞানী এবং কৃষিবিদ ট্রোফিম ডেনিশোভিচ লিসেঙ্কো জোসেফ মেন্ডেলের জিনতত্ত্ব এবং ডারউইনের বিবর্তনবাদকে বাতিল করে বংশপরম্পরার উপর জোর দেন। তিনি মনে করতেন প্রাণী তার জীবনের অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে সঞ্চারিত করে যায়। লিসেঙ্কো দেখালেন উন্নতজাতের গম থেকে উন্নত এবং অধিকফলনশীল কিভাবে উৎপাদন করা যায়। স্ট্যালিন কমিউনিস্ট ভাবধারার সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ ট্রোফিম ডেনিশোভিচ লিসেঙ্কোর মতবাদকে চাপিয়ে দেন। জীনতত্ত্ব নিয়ে যেসব বিজ্ঞানীরা কাজ করছিলেন তাদেরকে জনসাধারণের কাছে লিসেঙ্কোর মতবাদকে সমর্থন এবং প্রচার করতে বাধ্য করা হয়। অন্যথায় তাদের স্থান হতো লেবার ক্যাম্পে।

Alexander Oparin lived and worked in the USSR (Credit: Sputnik/Science Photo Library)

স্ট্যালিনের দমন নিপীড়নের শাসনের মধ্যেই আলেক্সান্ডার ওপারিন চালিয়ে যেতে লাগলেন তার জৈবরাসায়নিক গবেষণা। ওপারিন নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন কারণ তার কমিউনিজমের প্রতি সন্দেহাতীত আনুগত্য। ওপারিন লিসেঙ্কোর তত্ত্বকে সমর্থন দিলেন এবং দেশের সেবা করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের “অর্ডার অফ লেনিন” সর্বোচ্চ পুরষ্কারে ভূষিত হন।

১৯২৪ ওপারিন প্রকাশ করলেন “দ্য ওরিজিন অফ লাইফ” তার অমর গ্রন্থখানি। দ্য ওরিজিন অফ লাইফ বইতে ওপারিন প্রাণের বিকাশ অন্বেষণে যে প্রস্তবনা করেন সেটা ডারউইনের বিবর্তনবাদের “একটি ছোট উষ্ণ পুকুর” ধারণার সাথে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়। ওপারিন চিন্তা কল্পনা করেছিলেন কেমন ছিল সদ্য গঠিত পৃথিবীর চেহারা। পৃথিবীর উপরিভাগ ছিল কল্পনাতীত গরম, মহাকাশ থেকে খসে পড়া জ্বলন্ত পাথরের খণ্ড। পৃথিবী তখন ছিল বিভিন্ন ধরণের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থমিশ্রিত অর্ধগলিত পাথরের বিশৃঙ্খল স্তুপ। পদার্থগুলোর মধ্যে কার্বনের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশী।


Oceans formed once Earth had cooled down (Credit: Richard Bizley/Science Photo Library)

যদি আমরা অণুবীক্ষণযন্ত্রের নিচে কোয়াসারভেটিভ (জৈব রাসায়নিক দ্রবণ) পরীক্ষা করে দেখি তাহলে দেখব দ্রবণটি জীবিত কোষের মত আচরণ করছে। ধীরে ধীরে উত্তপ্ত পৃথিবী ঠাণ্ডা হচ্ছে, জলীয় বাস্প ঘনীভূত হয়ে প্রথম বৃষ্টি নামল পৃথিবীর বুকে, তরল পানিতে তলিয়ে গেল চরাচর। বৃষ্টি পড়ার আগেও সমুদ্র ছিল তবে সেটা প্রচণ্ড উত্তাপে গলিত কার্বননির্ভর ঘন তরল। এমতাবস্থায় দুইটা জিনিস ঘটতে পারে।

প্রথমত, বিভিন্ন রাসায়নিক নিজেদের মাঝে বিক্রিয়া করে অসংখ্য নতুন জটিল যৌগ সৃষ্টি করতে পারে। তাদের মধ্যে কিছু যৌগ আরও জটিল যৌগে পরিণত হবে। আলেক্সান্ডার ওপারিন ধারণা করেন রাসায়নিক দ্রব্যের ক্ষুদ্র মৌলগুলি প্রাণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। চিনি এবং এমাইনো এসিড পৃথিবীর পানি থেকেই উৎপত্তি হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, কিছু রাসায়নিক দ্রব্য নতুন আণুবীক্ষণিক অণুজীবের কাঠামো তৈরি করতে শুরু করে। কিছু অণুজীবের জৈবরাসায়নিক উপাদান পানিতে দ্রবীভূত হয় না। যেমন তেল পানির উপর আস্তরণ সৃষ্টি করে ভেসে থাকে। কিন্তু যখন কিছু জৈবরাসায়নিক উপাদান পানির সাথে মিশে যায় তখন গোলাকার “কোয়াসারভেটিভ” বস্তুর রূপ ধারণ করে যেগুলো আয়তনে .০১ সেমি বা (.০০৪) ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। অণুজীব বেড়ে ওঠে, তারা অবয়ব পরিবর্তন করে এমনকি মাঝেমাঝে তারা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তারা চারপাশের পানির রাসায়নিক দ্রব্যের সাথে বিক্রিয়ায় অংশ নেয়। এভাবেই জীবনসদৃশ রাসায়নিক উপাদান নিজেদের মাঝে সংগঠিত হতে থাকে। ওপারিন প্রস্তাব করেন কোয়াসারভেটিভ হলো আধুনিক জীবিত কোষের পূর্বপুরুষ।

ওপারিনের মতবাদে দেখা যাচ্ছে জীবিত অনুজীবের জন্ম হয়েছে পুরোপুরি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এখানে কোন ঈশ্বরের হাত নেই। এমনকি অলৌকিকভাবে জীবনী শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে এমন চিন্তাও প্রথাগত যার কোন ভিত্তি নেই।

পাঁচ বছর পরে ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী জন বারডন স্যান্ডারসন হালডেন একই মতবাদ নিয়ে র‍্যাশনালিস্ট অ্যানুয়াল জার্নালে একটা ছোট প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। হালডেন ইতিমধ্যেই বিবর্তনবাদে প্রভূত অবদান রেখে ফেলেছেন। তিনি ডারউইনের মতবাদকে বিকাশমান জীনতত্ত্বের আলোকে আরও সংহত করে।

রঙ্গমঞ্চে হালডেন তার জীবনের থেকেও বড় চরিত্র। একবার তিনি কানের পর্দায় ছিদ্রের চিকিৎসায় ডিকম্প্রেসন চেম্বারের অভিজ্ঞতার জন্য ডাক্তারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। কিন্তু পরে তিনি রম্য করে লিখেছিলেন, “কানের পর্দা সাধারণত প্রাকৃতিকভাবেই সুস্থ হয়ে যায়। যদি পর্দায় ছিদ্র থেকেই যায় এবং তারফলে কেউ যদি বধির হয়ে যায় তাহলে সে কারো ভ্রূক্ষেপ না করেই বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে পারবে যেটা হবে একটা সামাজিক অর্জন”।

ওপারিনের মত হালডেনও মতবাদ প্রচার করলেন, সমুদ্র প্রাথমিক অবস্থা থেকে স্থিতিশীল গরম ঘন তরলে পরিণত হলে কিভাবে সেখানের পানিতে রাসায়নিক অনুজীব নিজে থেকেই সৃষ্ট হতে পারে। পৃথিবীর এরকম পরিবেশে প্রথম জন্ম নেয় জীবনের অণুজীব অথবা অর্ধজীবন্ত বস্তু আর এরপরের স্তরে সৃষ্টি হয় স্বচ্ছ তেলতেলে জেলির মত থকথকে বস্তু।

কথিত আছে ওপারিন এবং হালডেন যে তত্ত্বের অবতারণা করেন পৃথিবীর সমস্ত জীববিজ্ঞানী সেগুলো ব্যক্ত করেন মাত্র। প্রাণের প্রথম বিকাশ ঘটেছে পুরোপুরি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এখানে কোন ঈশ্বরের হাত নেই। ডারউইনের বিবর্তনবাদের আগেও পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। ডারউইন সেটাকে যুক্তিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করেছেন কিন্তু এই তত্ত্ব খ্রিস্টবাদের ভিত্তিমূলে চরম কুঠারাঘাত।

ডারউইনের বিবর্তনবাদের একটাই সমস্যা ছিল। তার প্রচারিত বিবর্তনবাদকে নির্ভুল প্রমাণ করতে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার নিরিখে কোন প্রমাণ নাই। ঈশ্বরবিহীন সৃষ্টিতত্ত্ব সোভিয়েত ইউনিয়নে কোন সমস্যা নয় কারণ কমিউনিস্ট শাসিত সোভিয়েত রাষ্ট্রীয়ভাবেই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। সেজন্যই কমিউনিস্ট নেতারা প্রাণের উৎপত্তি গবেষণায় বস্তবাদী ব্যাখ্যাকে অকুন্ঠ সমর্থন জানায়। হাল্ডেন নিজেও ছিলেন একজন নাস্তিক এবং কমিউনিজমের কড়া সমর্থক।

তখনকার সময়ে বিবর্তনবাদ গৃহীত হবে নাকি বাতিল করবে সেটা নির্ভর করত প্রধানত ব্যক্তির ধর্ম বিশ্বাসী ব্যক্তিত্বের উপর। জীবনের উৎস অনুসন্ধান করা বিশেষজ্ঞ জীববিজ্ঞানী জার্মানির ওসনাব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আরমেন মালকিদজানিয়ান বলেন, বিবর্তনবাদ গৃহীত হবে কি হবে না নির্ভর করে মানুষেরা কি ধর্মে বিশ্বাস করে নাকি বাম ধারার কমিউনিজম সমর্থন করে সেটার উপর। সোভিয়েত ইউনিয়নে বিবর্তনবাদ সাদরে গৃহীত হয়েছে কারণ সেখানে ঈশ্বরের প্রয়োজন ছিল না। যদি পশ্চিমাবিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব সেখানের মানুষেরা অনেক বস্তুবাদী। তাদের চিন্তা বাম ঘেঁষা কমিউনিস্ট বা উদারপন্থার দিকে ধাবিত।

প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আদিম জৈবরাসায়নিক ঘন তরল সহযোগে এই ধারণাটি ওপারিন-হালডেন তত্ত্ব বলে ব্যাপক পরিচিত পেয়ে গেল। ওপারিন-হালডেন তত্ত্ব যুক্তির বিচারে গ্রহণযোগ্য হলেও তত্ত্বটির একটা সমস্যা ছিল। ওপারিন-হালডেন তত্ত্বকেও নির্ভুল করার স্বপক্ষে কোন গবেষণালব্ধ প্রমাণ নেই। পচিশ বছর পার হয়ে গেলেও তত্ত্বটির স্বপক্ষে কোন প্রমাণ দাড় করানো যায়নি।


The English geneticist J. B. S. Haldane (Credit: Science Photo Library)

সময়ের সাথে প্রাণের উদ্ভব গবেষণায় যোগ দেন ১৯৩৪ সালে রসায়নে নোবেল বিজয়ী আমেরিকান রসায়নবিদ। হ্যারল্ড উরে পারমাণবিক বোমা বানানোর দলেও কাজ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ম্যানহাটান প্রকল্পে পারমাণবিক বোমার অতি প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম ২৩৫ সমৃদ্ধ করতেন। যুদ্ধের পরে তিনি নিউক্লিয়ার প্রযুক্তিকে সুশীল সমাজের নিয়ন্ত্রণে দেয়ার জন্য আন্দোলন করেন। প্রফেসর উরে ধারণা করেছিলেন, আমদের পৃথিবী আদিম অবস্থায় সম্ভবত অ্যামোনিয়া, মিথেন এবং হাইড্রোজেনের মিশেলে পিণ্ডাকৃতির ছিল। এই মিশ্রণকে যদি বৈদ্যুতিক বিস্ফোরণ এবং পানির সংস্পর্শে আনা যায় তাহলে অ্যামাইনো এসিড উৎপন্ন করা সম্ভব। এটা সর্বজন বিদিত যে, অ্যামাইনো এসিড হলো জীবনের প্রথম উপাদান।

উরে এই সময়ে পৃথিবীর বাইরে মহাকাশ এবং মহাকাশের ভাসমান বস্তুকণার রসায়ন নিয়ে আগ্রহী হন বিশেষকরে দেখতে চেয়েছিলেন সৌরজগৎ যখন সবে সৃষ্টি হলো তখন ঠিক কী ঘটছিল। একদিন তিনি ক্লাসে বললেন সৃষ্টিলগ্নে পৃথিবীর বায়ুস্তরে সম্ভবত অক্সিজেনের অস্তিত্ব ছিল না। রাসায়নিক বিক্রিয়ার সংস্পর্শে অক্সিজেন হয়ত ধ্বংস হয়ে গেছে। উরের ক্লাস লেকচারের প্রস্তাবিত ‘অক্সিজেনবিহীন পৃথিবী’ ওপারিন এবং হালডেনের আদিম জৈবরাসায়নিক ঘন তরল ধারণাকে আরও বেগবান করে। প্রফেসর হ্যারল্ড উরের ক্লাসে উপস্থিত ছিলেন পিএইচডি’র গবেষণারত ছাত্র স্ট্যানলি মিলার। মিলার প্রফেসর উরেকে প্রস্তাব দেন পরীক্ষা করে দেখার আসলেই কেমন ছিল সেদিনের সৌরজগতের পরিবেশ। উরে নিজের ক্লাস লেকচারের উপর কিছুটা সন্দেহ পোষণ করলেও মিলার অক্সিজেনবিহীন পৃথিবীর চিন্তায় মনোনিবেশ করলেন। তাদের মাঝে বিস্তর আলোচনার পরে ১৯৫২ সালে প্রফেসর উরে এবং তার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্ট্যানলি লয়েড মিলার যৌথভাবে প্রথমবারের মত প্রাণের খোঁজে বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাত ‘উরে-মিলার এক্সপেরিমেন্ট’ পরীক্ষা শুরু করলেন।

The Miller-Urey experiment (Credit: Francis Leroy, Biocosmos/Science Photo Library)

পরীক্ষার যন্ত্রপাতি খুব সাধারণ। মিলার পূর্বের আলোচিত ধারণা অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্নের চারটি রাসায়নিক উপাদান গরম পানি, হাইড্রোজেন গ্যাস, অ্যামোনিয়া এবং মিথেন চারটি কাঁচের জারে পূর্ণ করে তাদের মাঝে সংযোগ করে দিলেন। কাঁচের গ্লাসের মাঝে মিলার বারবার তড়িৎপ্রবাহ দিতে লাগলেন যাতে বজ্রপাত ঘটে। আদিকালে পৃথিবীতে বজ্রপাতের ঘটনা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক।  এই পরীক্ষার মাধ্যমে খুব সাধারন পরিবেশেই প্রচুর পরিমাণ জৈব অনু উৎপাদন সম্ভব। মিলার দেখতে পেলেন প্রথমদিনেই কাঁচের জারের মধ্যকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গোলাপী আভা ধারন করেছে এবং সপ্তাহ শেষে ঘন তরল দ্রবণটি গাঢ় লাল হয়ে গেল। পরিষ্কার বোঝা গেল জারে জৈব রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ তৈরি হয়েছে।

মিলার পরীক্ষাগারে বিশ্লেষণ করে মিশ্রণটিতে গ্লাইসিন এবং আলানাইন নামে দুইটা অ্যামাইনো এসিড পেলেন। অ্যামাইনো এসিডকে জীবন সৃষ্টির প্রাথমিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং অ্যামাইনো এসিড আমিষ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আমিষ আমাদের শরীরের শারীরবৃত্তিক এবং জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মিলার গবেষণাগারে জন্ম দিলেন প্রাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।  মিলারের গবেষণার ফলাফল বিখ্যাত সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হলো ১৯৫৩ সালে। প্রাণের বিকাশ অভিযানে ‘উরে-মিলার এক্সপেরিমেন্ট’ স্মরণীয় ঘটনা। উদার প্রফেসর উরে এই গবেষণার সমুদয় কৃতিত্ব মিলারকে দিয়ে আর্টিকেল থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞানের গবেষক জন সাদারল্যান্ড বলেন, “উরে-মিলার পরীক্ষার শক্তি এখানেই যে, আপনি সাধারণ পরিবেশে প্রচুর অণুজীব সৃষ্টি করতে পারবেন”। জীবন আরও জটিল যা আমরা চিন্তা করি তার থেকেও বেশি।

পরবর্তীতে আরও গবেষণায় পৃথিবী সৃষ্টির আদিতে অন্যান্য গ্যাসের মিশ্রণও ছিল আবিষ্কারের কারণে আগের গবেষণা ভুল প্রমানিত হয়। কিন্তু সেটা নিয়ে সম্পূরক আলোচনা হতে পারে। জন সাদারল্যান্ড বলেন, “উরে-মিলার পরীক্ষা ছিল দৃষ্টান্ত, তারা মানুষের কল্পনা জাগাতে পেরেছিলেন এবং প্রাণের উৎস সন্ধানে ব্যাপকভাবে চর্চা করতে থাকে”। মিলারের পরীক্ষার প্রভাবে অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও এগিয়ে এলেন ভিন্ন ভিন্ন মৌল থেকে অনুজীব সৃষ্টির গবেষণা করে প্রাণের উৎস সন্ধানে। প্রাণের রহস্য উন্মোচনের হাতছানি মনে হয় সন্নিকটে। এতদিনে পরিষ্কার হওয়া গেছে জীবন এত জটিল যে আমাদের চিন্তাকে বিহ্বল করে দেয়। অবশেষে জানা গেল জীবন্ত কোষ শুধুমাত্র কিছু রসায়নের জটিল যৌগ নয় জীবন হলো সূক্ষ্ম শিল্পিত যন্ত্রবিশেষ। হঠাৎ করে সম্পর্কহীন বস্তু থেকে নিজেকে সৃষ্টি করে নিজেই আবার বড় বাধা অতিক্রম করে ছুটে যায় নতুন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানীদের বুঝে ওঠার আগেই।


The machinery inside cells is unbelievably intricate (Credit: Equinox Graphics Ltd)

দ্বিতীয় পর্ব

বিজ্ঞান সভায় বিভাজন

১৯৫০ সালের শুরুর দিকে বিজ্ঞানীগণ আমাদের জীবন ঈশ্বরের দান বহুদিনের পুরনো বাসি ধারণা থেকে সরে আসতে থাকে। তার পরিবর্তে তারা সম্ভাবনাময় জীবন কীভাবে নিজে নিজেই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হলো সেই রহস্য উন্মোচনে আগ্রহী হয়ে উঠল। এবং যুগান্তকারী পরীক্ষার জন্য অবশ্যই স্ট্যানলি মিলারকে ধন্যবাদ। বিজ্ঞানীগণ জীবন অন্বেষণে মিলারের পরীক্ষা থেকে ভবিষ্যৎ গবেষণার রশদ পেয়ে গেলেন।

মিলার যখন ভিন্ন ভিন্ন বস্তু থেকে জীবনের উপাদান বানাতে ব্যস্ত তখন কিছু বিজ্ঞানী জীন  কিসের তৈরি খুঁজতে গবেষণারত। ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানীগণ অনেকগুলো অনুজীবকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। চিনি, চর্বি, আমিষ, নিউক্লিক এসিড যেমন ডিঅক্সিরিবোনিউক্লিক এসিড বা সংক্ষেপে ডিএনএ আবিষ্কার হয়ে গেছে এতদিনে। ২০শতক হলো আবিষ্কারের স্বর্ণযুগ। বিজ্ঞানের বড় বড় আবিষ্কারগুলো এই শতাব্দীতেই ঘটেছে।

আজকে আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি ডিএনএ আমাদের জীন বহন করে। কিন্তু ডিএনএ আবিষ্কার ১৯৫০ দশকের বিজ্ঞানীদের জন্য একটা আঘাত কারণ আমিষের জটিল গঠন দেখে তারা আমিষকেই জীন ভেবেছিলেন। ১৯৫২ সালে আলফ্রেড হারশে এবং মার্থা চেস বিজ্ঞানীদের ভুল ভেঙ্গে দেন। তারা ওয়াশিংটনের কার্নেজি ইনস্টিটিউটে শুধু প্রোটিন আর ডিএনএ বহনকারী ক্ষুদ্র ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন। পুনোরুৎপাদনের জন্য ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার মাঝে সংক্রামিত হয়। পরীক্ষায় আলফ্রেড হারশে এবং মার্থা চেস জানতে পারলেন সংক্রামক ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে প্রবেশ করেছে কিন্তু প্রোটিন বাইরেই রয়ে গেল। পরিষ্কার বুঝা গেল, ডিএনএ হলো জীনের উপাদান।

হারশে এবং মার্থা চেস’র পরীক্ষার ফলাফল ডিএনএ কীভাবে কাজ করে এবং কেমন তার গঠন আবিষ্কারের গবেষণায় তোলপাড় সৃষ্টি করে দিলো। পরের বছর ডিএনএ রহস্যের সমাধান করে ফেললেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ফ্রান্সিস ক্রিক এবং জেমট ওয়াটসন। দীর্ঘ পরিশ্রমসাধ্য গবেষণায় তাদেরকে সাহায্য করে রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন। ২০শতকের আবিষ্কারগুলো জীবনের উৎস অন্বেষণের পথে নতুন মাত্রা যোগ করে। আবিষ্কৃত হতে থাকে জীবন্ত কোষের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা অবিশ্বাস্য জটিলতা।


James Watson and Francis Crick with their model of DNA (Credit: A. Barrington-Brown/Gonville and Caius College/Science Photo Library)

ক্রিক এবং ওয়াটসন বুঝতে পেরেছিলেন ডিএনএ হলো দুইটা প্যাচানো মইয়ের সদৃশ বস্তু যারা আবার নিজেদের মধ্যেও সর্পিল আকৃতিতে জড়িয়ে থাকে। প্যাচানো মইয়ের দুই প্রান্ত নিউক্লিওটাইড নামের মলিকিউল দ্বারা গঠিত। আমার আপনার এবং আমাদের সবার জীন এসেছে ব্যাকটেরিয়া নামের আদিপিতা থেকে। ডিএনএ’র গঠন ব্যাখ্যা করে কিভাবে আমাদেরকে কোষ ডিএনএকে অনুসরণ করে। অন্যভাবে বলা যায়, ডিএনএ উন্মোচন করে কিভাবে বাবা-মা তাদের জীনের প্রতিলিপি তৈরি করে এবং পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। এখানের মূল আলোচ্য বিষয় হলো, এখন প্যাচানো দুই সর্পিল মইয়ের রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব। তখন আমরা জানতে পারি জীবের বংশগতির ধারা যা তৈরি হয়েছে জীবের বংশপরম্পরায়। বংশগতির ধারাকে আমরা এ, টি সি এবং জি দিয়ে চিহ্নিত করতে পারি। বংশগতির ভিত্তি সাধারণত ডিএনএ’র সর্পিল মইয়ের মধ্যে সুরক্ষিত অবস্থায় থাকে এবং প্রতিলিপি তৈরির প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।

এই একই প্রক্রিয়ায় বংশগতি জীবনের শুরু থেকেই বাবা-মা তাদের সন্তানদের মাঝে জীবনের বৈশিষ্ট্য প্রবাহিত করতে থাকে। ক্রিক এবং ওয়াটসন আবিষ্কার করেন ব্যাকটেরিয়া থেকে কিভাবে ধাপে ধাপে বংশগতির প্রতিলিপি তৈরি করে প্রাণী আজকের অবস্থানে চলে এসেছে।

ক্রিক এবং ওয়াটসন ১৯৫৩ সালে তাদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান “নেচার”বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করেন। ক্রিক এবং ওয়াটসনের আবিষ্কারের ফলে পরের বছরগুলোতে জৈবরাসায়নিক বিজ্ঞানীগণ ডিএনএ ঠিক কী তথ্য বহন করে সেটার আদ্যপান্ত খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তারা দেখতে চাইলেন কীভাবে DNA তে সংরক্ষিত তথ্য জীবন্ত কোষে ব্যবহৃত হয়। জীবনের অভ্যন্তরে লুকায়িত গোপন খবর প্রথমবারের মত প্রকাশের পথে। তখন হঠাৎ করে বিজ্ঞানীদের কাছে ওপারিনের ধারণাকে মামুলি সাদাসিধা।

আবিষ্কার হয়ে গেল DNA ’র মাত্র একটাই কাজ। আপনার ডিএনএ আপনার কোষদেরকে বলে দেয় কীভাবে প্রোটিন তৈরি করতে হবে। প্রোটিন সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে মলিকিউল। প্রোটিন ছাড়া আপনি খাদ্য হজম করতে পারবেন না, আপনার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাবে এবং আপনি নিশ্বাস নিতে পারবেন না।

DNA থেকে প্রোটিন উৎপন্নের জটিল প্রক্রিয়া দেখলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। যে কারো পক্ষে জীবনের উৎস কী ব্যাখ্যা করতে যাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ল কারণ এত জটিল প্রক্রিয়া কীভাবে একা একা শুরু হয়েছিল সেটা বিজ্ঞানীগণের চিন্তার জন্যও দুরূহ। প্রতিটি প্রোটিনই মূলত অ্যামাইনো এসিডের বিশাল শিকল একটা বিশেষ শৃঙ্খলার বাঁধনে তারা পারস্পারিক আবদ্ধ। অ্যামাইনো এসিডের ক্রম নির্ধারণ করে দেয় প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক আকার এবং এভাবেই প্রোটিন কাজ করে। সর্পিল DNA’র অভ্যন্তরে প্রাণের প্রয়োজনীয় তথ্য সাংকেতিক আকারে লিপিবদ্ধ থাকে। সুতরাং যখন একটা কোষকে কোন নির্দিষ্ট প্রোটিন সৃষ্টি করতে হয় তখন সে অ্যামাইনো এসিডের শিকলের নাগাল পেতে DNA’র মধ্যে সংরক্ষিত জীন থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য বিশ্লেষণ করতে শুরু করে।

কিন্তু এখানেও একটা প্যাচ আছে। DNA জীবনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই কোষ DNA কে সংরক্ষণ করতে নিরাপদে জমিয়ে রাখে। এই কারণে কোষ DNA’র তথ্যকে প্রতিলিপি করে RNA (রাইবোনিউক্লিক এসিড) মলিকিউলে স্থানান্তর করে। DNA যদি পাঠাগারের বই ধরি তাহলে RNA  হবে গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ লেখা ছেঁড়া কাগজের সমষ্টি। DNA’র তুলনায় RNA ছোট। সর্পিল মইতে RNA’র একটামাত্র সুতোর মত প্রান্ত। এপর্যায়ে RNA’র মধ্যে সংরক্ষিত তথ্য প্রোটিনে পরিণত হয় এবং প্রচুর পরিমাণ ‘রাইবোসোম’ মলিকিউল গঠন করে।

প্রতিটি জীবিত কোষে এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এমনকি অতি সাধারণ ব্যাকটেরিয়াও এই প্রক্রিয়ার বাইরে নয়। খাদ্যগ্রহণ এবং অবিরাম নিঃশ্বাস প্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়া জীবনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রাণের উৎস ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদের অবশ্যই DNA, RNA, রাইবোসোম এই তিন প্রোটিনের জটিল মিথস্ক্রিয়া বুঝতে হবে। কীভাবে তাদের উৎপত্তি হলো, কেমন করেই বা তারা পরস্পর কাজ শুরু করে।


Cells can become enormously intricate (Credit: Russell Kightley/Science Photo Library)

হঠাৎ করেই ওপারিন এবং হালডেনের ধারণা নিতান্ত সাদামাটা প্রতীয়মান হয়ে গেল। একই সাথে মিলারের যে যুগান্তকারী পরীক্ষার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়েছিল অ্যামাইনো এসিড যা দিয়ে প্রোটিন সৃষ্টি সম্ভব সেটাকেও মনে হলো অসম্পূর্ণ এবং ভাসাভাসা। কীভাবে জীবন সৃষ্টি হয়েছিল সেই প্রশ্নের উত্তর থেকে এখনো আমরা অনেক দূরে। মিলারের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ছিল সৃষ্টি রহস্য উন্মোচনের দীর্ঘ যাত্রাপথের সূচনামাত্র। জীবন গঠিত হয়েছিল RNA দিয়ে এই ধারণা এখন প্রভূত প্রমাণিত এবং বিজ্ঞানে খুব প্রভাবশালী তত্ত্ব।

জন সাদারল্যান্ড বলেন, “DNA সৃষ্টি করে RNA এবং RNA সৃষ্টি করে প্রোটিন যা লিপিড হিসেবে মুখ আটকানো রসায়নের থলের মধ্যে থাকে। আপনি যদি DNA, RNA এবং লিপিডের দিকে তাকাই তাহলে এর জটিলতা দেখে বিস্ময়ে আপনার মুখ হা হয়ে যাবে। কীভাবে আমরা খুঁজে পাবো

অন্যান্য বিজ্ঞানীগণকে যদি ধরি প্রাণের উৎস গবেষণার রাস্তা তৈরি করেছেন তাহলে ব্রিটিশ রসায়নবিদ লেজলি ওরগেলকে বলতে হবে প্রথম বিজ্ঞানী যিনি সেই রাস্তায় যাত্রা শুরু করেন। লেজলি ওরগেলই প্রথম ক্রিক এবং ওয়াটসনের DNA’র মডেল নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পরে তিনি মঙ্গলগ্রহে রোবটিক যান পাঠাতে নাসা’র ভাইকিং প্রোগ্রামে সাহায্য করেছিলেন। ওরগেল প্রাণের উৎস কী এই বৈজ্ঞানিক জিজ্ঞাসাকে চিহ্নিত করলেন। ১৯৬৮ সালে লিখিত এক গবেষণাপত্রে তিনি দাবি করেন জীবনের শুরুতে প্রোটিন বা DNA কিছুই ছিলনা। জীবন সৃষ্টি হয়েছিল পুরোপুরি RNA দিয়ে এবং ফ্রান্সিস ক্রিক ওরগেলের এই দাবীকে সমর্থন দেন।

ওরগেলের দাবী যদি সঠিক হয় তাহলে আদিম RNA মলিকিউলকে অবশ্যই অভিযোজন ক্ষমতা থাকতে হবে এবং তারা নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করবে। ধারণা করা হচ্ছে সম্ভবত DNA  একই প্রক্রিয়া কাজ করে।

জীবন গঠিত হয়েছিল RNA দিয়ে এই ধারণা এখন প্রভূত প্রমাণিত হয়েছে এবং বিজ্ঞানে খুব প্রভাবশালী তত্ত্ব। কিন্তু জন্ম দিয়েছে বৈজ্ঞানিক তর্কযুদ্ধের যা অবধি চলছে।

জীবন শুরু হয়েছিল RNA দিয়ে দাবী করেই ওরগেল ক্ষান্ত হননি, তিনিই সবার আগে প্রস্তাব করেন RNA নিজেকে নিজেই পুনরুৎপাদন করতে পারে যা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। অন্যভাবে বলা যায় তিনি শুধু জীবন কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল সেটাই বলেননি, জীবন কী এই প্রশ্নেরই সমাধান তিনি করে ফেলেছেন। এ পর্যায়ে বিজ্ঞানীগন প্রাণের জন্ম রহস্য নিয়ে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেলেন।


DNA is at the heart of almost every living thing (Credit: Equinox Graphics Ltd)

অনেক জীববিজ্ঞানী ওরগেলের ‘প্রাণ নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করে’ দাবীর সাথে সহমত পোষণ করলেন। ডারউইনের বিবর্তনবাদের সারাংশ ছিল নিজের অসংখ্য প্রতিলিপি বা সন্তান জন্মদানের মাধ্যমেই শুধু প্রাণী নিজের বংশ রক্ষা করতে পারে। কিন্তু জীবনের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো যেমন জীবন বেঁচে থাকার জন্য একটি জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে ঘটতে থাকা রাসায়নিক প্রক্রিয়া। বেঁচে থাকতে হলে চারিপাশের পরিবেশ থেকে শক্তি সঞ্চয় করতে হয়। অনেক জীববিজ্ঞানী মনে করেন জীবনের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো জীবনের অভ্যন্তরীণ চলমান রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং জীবের নিজের প্রতিলিপি উদ্ভব হয়েছে অনেক পরে। এখানেই বিতর্কের শুরু। ১৯৬০ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীগণ জীবনের উত্থান গবেষণায় দুই সলে বিভক্ত। সাদারল্যান্ড বলেন, “জীবনের অভ্যন্তরীণ চলমান রাসায়নিক প্রক্রিয়া নাকি বংশগতি প্রথম” প্রশ্নই বিজ্ঞানীগণের নতুন দুই প্রান্তে বিভাজন। তাই বিজ্ঞান সভা মাঝে মাঝেই দ্বিধা বিভাজনের তর্কে পর্যবসিত হয়। ততদিনে তৃতীয় একদল বিজ্ঞানী প্রচার করলেন প্রথমে মলিকিউলের ধারকের জন্ম হয়েছে কারণ তারা ছিল তখন ভাসমান। জীবন সৃষ্টিতে কোষের উপাদানগুলোকে জড়ো করতে হয়েছে। কোষের উপাদানগুলো ছাড়া অভ্যন্তরীণ চলমান রাসায়নিক প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব নয়। সাদারল্যান্ড বলেন, প্রাণ সৃষ্টিতে কোষের প্রয়োজন যে কথা ওপারিন এবং হালডেন কয়েক দশক আগেই জোরালোভাবে বলে গেছেন। সম্ভবত জীবনের প্রথম কোষ চর্বি জাতীয় স্বচ্ছ তরল পর্দায় আবৃত ছিল।

জীবন বিকাশের এই তিনটা গবেষণা এবং তর্কালোচনার স্বপক্ষে বিপক্ষে অনেক বিজ্ঞানী আছেন এবং অদ্যাবধি আলোচনা চলছে। বিজ্ঞানীগণ নিজেদের ধারণার স্বপক্ষে নিরন্তর গবেষণা করেছেন এমনকি অনেক সময় অন্ধভাবে স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করছে। প্রায়ই দেখা যায় একদন বিজ্ঞানী আত্মপক্ষ সমর্থন করে অন্য বিজ্ঞানীগণকে নির্বোধ বলতেও দ্বিধা করছে না। ফলে জীবনের উৎস নিয়ে বিজ্ঞান সভার বিতর্ক সাংবাদিকদের পত্রিকার চটকদার কলাম আর সাধারণ পাঠকদের মুখরোচক গল্পে পরিণত হয়েছে। ওরগেলকে ধন্যবাদ। তিনি প্রথম ধারণা দিলেন বংশগতি নয় বরং জীবন গঠিত হয়েছিল RNA দিয়ে। তারপর এলো ১৯৮০ দশক, বিজ্ঞানের চমক লাগানো আবিষ্কারের যুগ এবং পাওয়া হওয়া গেল কীভাবে জীবনের জন্ম প্রশ্নের অমীমাংসিত উত্তর।


RNA could be the key to life’s beginning (Credit: Equinox Graphics Ltd)

চলবে…

অনুবাদক – বিকাশ মজুমদার 

মূল প্রবন্ধ: The secret of how life on earth began




Posted at March 06, 2018 |  by Arya ঋষি
............প্রথম পর্বের পর(https://aryarishidot.blogspot.com/2017/11/blog-post.html)
পর্ব-২

"হে সৃষ্টিকর্তা ভগবান, 

জীবন্ত যম হিসেবে তুমি কি দানবরূপী 
এই বাবরকে পাঠিয়েছ ?
অমানুষিক তার অত্যাচার, পৈশাচিক তার হত্যা লীলা, 
অত্যাচারিতের বুক ফাটা আর্তনাদ ও করুন ক্রন্দন 
তুমি কি শুনতে পাওনা? 
তাহলে তুমি কেমন দেবতা ?"
ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী ১১৯৯ সালে দক্ষিন বিহার অঞ্চলে ওদাত্তপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও বিখ্যাত নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আক্রমন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় তিন হাজার উচ্চতম ডিগ্রিধারী শিক্ষক এবং প্রায় বিশ হাজার ছাত্র ছাত্রীকে হত্যা করেন । (History of Bengal, Dhaka University, Vol.II,p-3)


শামস উদ্দিন ইলিয়াস শাহ ১৩৪৬ খৃষ্টাব্দে নেপাল আক্রমন করে স্বয়ম্ভুনাথ স্তুপ ও শাক্য মুনির পবিত্র ধ্বজা ভস্মীভুত করেন।
 মোহাম্মদ শাহ (১ম, ১৩৫৮-৭৭) বিজয়নগর সাম্রাজ্য অতর্কিতে আক্রমন করে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে চার লক্ষ হিন্দুর প্রাণনাশ করেছিলেন এবং বিজয়নগর সাম্রাজ্য লন্ডভন্ড করেন। এমন হত্যাকান্ড পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আর নেই ।
তাজ উদ্দিন ফিরোজ শাহ বিজয়নগর সাম্রাজ্য লুন্ঠন করেন এবং একজন রাজকন্যাকে নিজ হারেমের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। বাহমনী সুলতান ফিরোজ শাহ বিজয়নগরের রাজা দেব রায়কে পরাজিত করেন এবং রাজ কন্যাকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে বাধ্য করেন। এই অপমানে বিজয়নগরের জনগন প্রতিশোধের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। ফলে ফিরোজশাহ পুনরায় আক্রমন করে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। ফিরোজ শাহ এই পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে ম্ৃত্যু মুখে পতিত হন।

১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে দাক্ষিনাত্যের সকল সুলতানী বাহিনী এক সঙ্গে বিজয়নগর আক্রমন করেন। ফলে সায়ানাচার্যের স্বপ্নের বিজয়নগরের গৌরবসূর্য তালিকোটার প্রান্তরে চিরতরে অস্তমিত হল। বিজয়ী মুসলমান সৈন্য বিজয়নগরে প্রবেশ করে দীর্ঘ পাচ মাস ধরে অবাধ লুন্ঠন চালালো। বুরহান-ই-মসির ও ফিরিস্তির বর্ণনা থেকে জানা যায়, কল্পনাতীত পরিমান মনি মুক্তা, ধন-দৌলত, অসংখ্য হাতি, ঘোড়া, উট, দাস-দাসী বিজয়ী সৈন্যগন কর্তৃক লুন্ঠিত হয়েছিল। বিজয়ী মুসলমান কেবলমাত্র মুল্যবান সামগ্রী লুন্ঠন করেই ক্ষন্ত ছিলেন না, বিজয়নগরকে তারা বিরাট ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে বিজয়নগরের ন্যায় সমৃদ্ধ নগরীর এইরূপ আকস্মিক ধ্বংস্তুপে পরিনত হওয়ার দ্ষ্টান্ত বিরল। নগরের যাবতীয় মন্দির, প্রাসাদ ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেও পরাজিতের প্রতি হিংসাপরণাতার অবসান হল না। অবশেষে লক্ষ লক্ষ হিন্দু নর-নারী এবং শিশু বৃদ্ধেরর রক্তে বিজয়নগরের ধুলি রঞ্জিত করে তারা লুন্ঠন যজ্ঞে পূর্ণাহতি দিল ।

স্ত্রী সন্তানের মাথা কেটে দিল হিন্দু রাজা
ততকালীন অন্যান্য মুসলমান শাসকগনের মত শেরশাহও (১৫৪১পাইকারী হারে হিন্দু হত্যাহিন্দু সম্পত্তি লুটহিন্দু নারী বলাতকার এবং হিন্দু মন্দির ধ্বংসের ব্যপারে সমান পটু ছিলেন। হিন্দুর সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করতে তার কোন দ্বিধা চিল না।
১৫৪০ খৃষ্টাব্দে বাদশাহ হবার পর ১৫৪৩  খৃষ্টাব্দে শেরশাহ রায়সিনের হিন্দু রাজা পুরনমলের দূর্গ আক্রমন করেন।  পুরনমলের সৈন্যরা প্রথমে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করেন এবং পরে দূর্গের মধ্যে আশ্রয় নিলেন। প্রায় ৬ মাস দূর্গ অবরোধের পর শেরশাহ কামান দিয়ে দূর্গের ক্ষতি করতে থাকেন। পুরনমল তখন খবর পাঠালেন যেতাকে ও তার লোকজনকে পালিয়ে যেতে দিলে তিনি দূর্গ ছেড়ে চলে যাবেন। শেরশাহ তাতে সম্মতি জানান। পুরনমলের লোকজন তখন দূর্গ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং শেরশাহের নির্দেশ মত দূর্গের বাইরে তাবু খাটিয়ে অবস্থান করতে থাকেন। ইতিমধ্যে শেরশাহ সবাইকে হত্যা করার গোপন পরিকল্পনা করে এবং পরদিন সকালে শেরশাহের  সৈন্যরা তাদের ঘিরে ফেলে। অবস্থা বুঝতে পেরে পুরনমল তার স্ত্রী রত্নাবলীর মাথা তরোয়াল দিয়ে কেটে ফেলেন এবং অন্য সবাইকেও হুকুম দিলেন নিজ নিজ পরিবারের মহিলাদের মাথা কেটে ফেলতে। মুসলমানরা ইতিমধ্যে আক্রমন শুরু করে দিয়েছে। 
আব্বাস-খা ইংরেজীতে ঘটনাটির যে বর্ণনা দিয়েছেন বাংলায় তা এরূপ---

"হিন্দুরা তাদের নিজ নিজ পরিবারের ও অন্যান্যদের (অর্থাৎ নাবালক ও শিশুদেরহত্যা করতে ব্যস্তইত্যবসরে আফগানরা চর্তুদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলল এবং তাদের হত্যা করতে শুরু করলো । শুয়োর খানা-খন্দে পড়ে গেলে যেমন হয় হিন্দুরাও সেই রকম অসহায় হয়ে পড়লো। পুরনমল ও তার লোকেরা বীরত্ব ও বিক্রম দেখাতে চেষ্টা করল বটে, তবে চোখের পলকে আফগানরা সবাইকে কচু কাটা করে ফেলল।
যে সব নারী ও শিশুদের হিন্দুরা হত্যা করে উঠতে পারেনি, তাদের সবাইকে বন্ধী করা হল। তাদের মধ্য থেকে পুরনমলের এক কন্যা ও তার বড় ভাইয়ের তিন ছেলেকে জীবিত রেখে বাকি সকলকে হত্যা করা হল। শের খা পুরনমলের মেয়েকে কয়েকজন বাজীগরের হাতে তুলে দিল । যাতে তারা তাকে হাটে বাজারে নাচাতে পারে । আর ছেলে তিনটিকে খোজা বানাবার হুকুম দেওয়া হল যাতে অত্যাচারী হিন্দুরা বংশ বিস্তার করতে না পারে।
রোহতাস দূর্গের রাজা হরেকৃষ্ণ রায় শেরশাহের বন্ধু ছিলেন। ১৫৩৭ সালে হুমায়ন শেরশাহের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। সেই সময় শেরশাহের হারেমে ১০০০ রমনী ছিল এবং তারা সবাই চুনারগড় দূর্গে বাস করত। চুনার গড় দূর্গ ততটা সুরক্ষিত নয় তাই শেরশাহ রাজা হরেকৃষ্ণ রাহকে অনুরোধ করলেন হারেম শুদ্ধ তার পরিবারকে আশ্রয় এবার জন্য। এর আগে রাজা শেরশাহের ছোট ভাই মিয়া নিজাম ও তার পরিবারকে রোহিতাস দূর্গে আশ্রয় দিয়ে উপকার করেছিলেন। কিন্তু রাজা চট করে শেরশাহের প্রস্তাবে সম্মতি দিতে পারলেন না। তার ইতস্ততঃ ভাব দেখে শেরশাহ কোরান ছুয়ে শপথ করেন এবং এর ফলে রাজা রাজা তাকে আশ্রয় দিতে রাজী হন। কিন্তু সেই মূর্খ রাজার জানা ছিলনা যেকোরান হিন্দু ধর্মগ্রন্থের মত নয়। কোরানে আল্লাহর নির্দেশ আছেবিধর্মী অমুসলমান কাফেরদের সঙ্গে যেকোন রকম মিথ্যাচারছলনা ও বিশ্বাষঘাতকতা করা যায়। ফলে সেই রাতেই শেরশাহ রোহতাস দূর্গ দখলের ছক করে ফেললেন। ১২০০ ডুলি সাজানো হল এবং প্রত্যেক ডুলিতে দু'জন করে পাঠান সৈন্য বোরখা পরে অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে বসে রইল। প্রথম কয়েকটা ডুলিতে কিছু মহিলা ছিল । তাই দূর্গের রক্ষীরা প্রথম কয়টা ডুলি পরীক্ষা করে চক্রান্ত বুঝতে পারলো না। এদিকে শেরশাহ রাজার কাছে খবর পাঠালেন যেতার রক্ষীরা ডুলি পরীক্ষা করে মুসলমান রমনীদের অসম্মান করছেন । কাজেই ডুলি পরীক্ষা বন্ধ হল এবং প্রায় আড়াই হাজার আফগান সৈন্য দূর্গের মধ্যে ডুকে পড়ল। মূহুর্তে আরা আক্রমন করে কারারক্ষীদের হত্যা করলো এবং দূর্গ দখল করে নিল। রাজা হরেকৃষ্ণ রায় কোন মতে গুপ্ত পথ দিয়ে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করলেন । [Elliot & J.Dowson, IV,p-361]

শেরশাহের বাল্য নাম ছিল ফরিদ খা। প্রথম জীবনে তিনি দস্যুদের নেতা ছিলেন। এই দস্যুবৃত্তির কাজ কিভাবে হত ? ঐতিহাসিক আব্বাসের বর্ণনা অনুসারে, "তিনি তার ঘোড়াসাওয়ারদের সর্বক্ষন গ্রামের চতুর্দিকে পাহারা দিতে বলেন। সমস্ত পুরুষদের হত্যা করতে এবং নারী ও শিশুদের বন্দী করতে হুকুম দিলেন। সমস্ত গরু-বাছুর তুলে আনতে চাষ-আবাদ বন্ধ করতে এবং ক্ষেতের ফসল বিনষ্ট করতে হুকুম দিলেন। গ্রামের কোন লোক পাশাপাশি কোন গ্রাম হতে কিছু যাতে না আনতে পারেসে ব্যবস্থা করতে আদেশ দিলেন।"
১৯৭১-এ বাংলাদেশে ইয়াহিয়া বাহিনী একই নীতি অনুসরণ করেছিল।
হাসান খার অধীনে অনেক আফগান চকরী করত। তাদের কোন জমি জায়গা বা জায়গীর ছিল না। প্রথমে ফরিদ খা সেই সব আফগানদের জায়গীরের প্রলোভন দেখিয়ে অন্যত্র করে ছোটখাট একটা দস্য দল গঠন করলেন। তখন বিহারে আরও অনেক আফগান বাস করত। ফরিদ খা সেই সব স্বজাতীয় আফগানদের আহ্বান জানান তার দলে যোগ দেবার জন্য---"যার ঘোড়া আছে সে ঘোড়ায় চড়ে এবং অন্যান্যরা পায়ে হেটে আমার দলে যোগ দাও "
জায়গীর ও লুটের মাল পাবার লোভে তারাও এসে যোগ দিল। এই দল নিয়ে ফরিদ খা জমিদার ও বিত্তশালী হিন্দুদের টাকা পয়সা সহায় সম্বল লুটপাট করতে শুরু করে দিল। এইরকম একটি আক্রমন বর্ণ্না করতে গিয়ে আব্বাস খা লিখেছেন-- " অতি প্রত্যুষে ফরিদ খা তার দল-বল নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে সেই সব জমিদারদেরইসলামী মতে যারা অপরাধী তাদের আক্রমন করল। সব পুরুষদের হত্যা করা হল এবং বন্দী নারী ও শিশুদের ক্রীতদাস হিসেবে বেচে দিতে অথবা নিজের কাজে ব্যবহার করতে হুকুম দিল। অন্য মুসলমানদের সেখানে এনে বসতি করতে আদেশ জারি করলেন।"

সম্রাট বাবরের  নাম সবাই জানেন। ফতেপুর সিক্রি আক্রমন সম্পর্কে এই বাবর তার আত্মজীবনী তে লিখেছেন

" শত্রুকে পরাজিত করার পর আমরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলাম এবং ব্যপকভাবে হত্যা করতে থাকলাম। আমাদের শিবির থেকে প্রায় দুই ক্রোশ দূরে ছিল তাদের শিবির। সেখানে পৌঁছে আমি মুহাম্মদী ও আরও কয়েকজন সেনাপতিকে হুকুম দিলাম তাদের হত্যা করতেকেটে দু'খানা করতেযাতে তারা আবার একত্রিত হবার সুযোগ না পায়।"

কত হিন্দুকে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল তার হিসাব পাওয়া যায়না। বাবর হুকুম দিলেন, কাছাকাছি একটি পাহাড়ের কাছে সমস্ত নরমুন্ডকে জড়ো করে একটি স্তম্ভ তৈরী করতে।

"সেই টিলার উপর কাটা মুন্ডের একটি মিনার বানাতে হুকুম দিলাম। বিধর্মী (হিন্দু) ও ধর্মত্যাগীদের অসংখ্য মৃত দেহ পথে ঘাটে ছড়িয়ে ছিল। এমন কি দূর দেশ আলোয়ার, মেওয়াট ও বায়না যাবার পথেও বহু মৃত দেহ পড়ে থাকতে দেখা গেল।"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড.রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, অন্যান্য মুসলমান হানাদারের মত বাবরও হিন্দু মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংস করার মত বহু সাক্ষর রখে গেছেন। বাবর সম্বল ও চান্দেরী মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ নির্মান করেন। 
বাবরের আদেশে তার সেনাপতি মীর বাকি অযোধ্যার রাম জন্মভূমি মন্দির ভেঙ্গে তাতে প্রায় এক লক্ষ হিন্দুর রক্ত চুন বালিতে মিশ্রিত করে ইট গেঁথে বাবরের নামে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া গোয়ালিয়রের নিকট জৈন মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংস করেন। [R.C.Majumder. BVB, Vol. VII, p-307]

বাবরের পৈশাচিক নরহত্যা, বন্দী নারী ও শিশুদের চামড়ার চাবুক দিয়ে মারা এবং তাদের সাথে পশুর মত ব্যবহার করা ইত্যাদি আরো অনেক বর্বর কাজকর্ম গুরু নানক স্বচক্ষে প্রত্যাক্ষ করেছিলেন। ১৫২১ খৃষ্টাব্দে বাবর প্রথমে শিয়ালকোট ও পরে সৈয়দপুর দখল করে এক ব্যপক গনহত্যার আদেশ দিলেন। ফলে হাজার হাজার অসামরিক হিন্দু প্রজাকে হত্যা করা হল।


এসব দেখে গুরু নানক লিখেছেন--

"হে সৃষ্টিকর্তা ভগবান, জীবন্ত যম হিসেবে তুমি কি দানবরূপী এই বাবরকে পাঠিয়েছ ? অমানুষিক তার অত্যাচার, পৈশাচিক তার হত্যা লীলা, অত্যাচারিতের বুক ফাটা আর্তনাদ ও করুন ক্রন্দন তুমি কি শুনতে পাওনা? তাহলে তুমি কেমন দেবতা ?" 
[R.C.Majumder. BVB, Vol. VII, p-307]

১৫২৭ সালের ১৭ই মার্চ বাবর ফতেপুর সিক্রীর অদূরে খানুয়ার প্রান্তরে রাণা সংগ্রাম সিংহের সাথে যুদ্ধে অবর্তীর্ণ হন। মুসলমানদের বিবরন অনুসারে, সেদিন দেড় থেকে দুই লক্ষ হিন্দু মুসলমানদের হাতে কাটা পড়েছিল এবং সেই কাটা মুণ্ড দিয়ে পাহাড় তৈরী করা হয়েছিল ।
হিন্দু হত্যা করে তিনি হলেন আকবর দ্যা গ্রেট

১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে ভাগ্যের পরিহাসে হিন্দু বীর বিক্রমাদিত্য হোমরাজ ওরফে হিমু বিজয়ের দোরগোড়ায় পৌছেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হলেন। অতিশয় রক্তক্ষরনের ম্ৃতপ্রায় সম্রাট হোমরাজকে বৈরাম খা হাত পা বাধা অবস্থায় আকবরের সামনে উপস্থিত করল। এই ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে সমকালীন মুসলমান ঐতিহাসিক আহম্মদ ইয়াদ্গার তারিখ--আফগানা গ্রন্থে লিখেছেনসম্রাট হোমরাজকে ঐভাবে হাত পা বাধা অবস্থায় আকবরের সামনে উপস্থিত করে বৈরাম খা বললআজ প্রথম সাফল্যের এই শুভ মুহূর্তে আমাদের ইচ্ছা সম্রাটের মহান হস্ত তরবারির সাহায্যে এই বিধর্মী কাফেরের মস্তক ছিন্ন করুক। সেই অনুসারে সম্রাট তার মস্তক অপবিত্র দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করলেন। [Elliot & J.Dowson, V,pp-65-66]

'আকবর দি গ্রেটনামের মোঘল সম্রাট যে কতখানি নিষ্টুর ও নৃশংস ছিলেনআর একটি ছোট্ট ঘটনার মধ্য দিয়ে তা আরো সুন্দর ভাবে ফুটে উঠে। - একদা আকবর বিকেলের নামাজ থেকে ফিরে চাকরদের ডাকাডাকি করতে লাগলেন। কিন্তু সাড়া দেবার মত কাছাকাছি কেউ ছিল না। আকবর খুব রেগে গেলেন। হঠাত তিনি দেখতে পেলেন যেতার আসনের পাশে এক ছোকরা চাকর মেঝেতে শুয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আকবর পেয়াদাদের ডেকে হুকুম দিলেন "এক্ষুনি একে মিনারের উপর থেকে নিচে ফেলে দাও।পেয়াদারা তখনি তাকে আগ্রা দূর্গের উপর থেকে নিচে ফেলে দিল। এই ঘটনা বর্ননা করে মুসলমান ঐতিহাসিক আসাদ বেগ তার 'বিকায়াগ্রন্থে লিখেছেনসিংহাসন ও কৌচের কাছে গিয়ে তিনি (আকবরদেখতে পেলেন যেবাতি জ্বালাবার এক হতভাগ্য চাকর কৌচের কাছে মেঝেতে সাপের মত কুন্ডুলি পাকিয়ে মরার মত গুমাচ্ছে। ক্রুদ্ধ আকবর সেই চাকরটাকেও মিনারের উপর থেকে নিচে ফেলে দিতে আদেশ দিলেন। তদনুসারে তাকে ছুড়ে ফেলা হল এবং তার শরীর হাজার টুকরা হয়ে গেল।
[Elliot & J.Dowson, VI,p-164]
ইনিই মহামতি আকবরইংরেজীতে বলা হয় 'Akbar The Great'

১৫৬৭ খৃষ্টাব্দে আকবর মেবারের রাণা উদয় সিংহের বিরুদ্ধে অভিযান করেন এবং চিতোর দূর্গে অবরোধ করে দূর্গের দেওয়ালের নিকট বারূদ জমা করে প্রবল বিষ্ফোরণ ঘটানো হল। এতে প্রচীরের অংশ বিশেষ ধ্বংস হয়ে গেল। দূর্গ রক্ষার আর কোন উপায় না দেখে সেদিনই রাজপুত নারীরা জহর ব্রত অনুষ্টান করলেন। প্রায় ৩০০ রাজপুত নারী জ্বলন্ত আগুনে আত্মাহুতি দিলেন। দূর্গের মধ্যে তখন মাত্র ৮০০০ রাজপুত সৈন্য অবশিষ্ট ছিল।  তারা প্রবল বিক্রমে যুদ্দ করে সকলেই প্রাণ দিলেন। সব মিটে গেলে পরদিন সকালে বিজয়ী আকবর হাতিতে চড়ে দূর্গে প্রবেশ করলেন। তখন দূর্গের মধ্যে ছিল ৪০ হাজার অসামরিক প্রজা। আশ্রয় নেওয়া ৪০ হাজার রাজপুত ক্ৃষক প্রজার ভাগ্যে কি ঘটলো ?
ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ লিখেছেন---
'দূর্গ অবরোধের সময় ঐ ৪০ হাজার (অসামরিক) ক্ৃষক প্রজা রাজপুত বাহিনীর ৮০০০ সৈন্যকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছিলেন। সে কারনে সম্রাট তাদের হত্যার আদেশ দিলেন। ফলে সেদিন ৩০ হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছিল।


. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, সেদিন কত রাজপুত মারা পড়েছিল তার সঠিক সংখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়। আবুল ফজল যে ৩০ হাজার সংখ্যা বলেছেন তা তো শোনা কথা, দেখা নয়, প্রক্ৃত সংখ্যা ৫০ হাজার, ৮০ হাজার, এক লাখ বা তারও বেশি হওয়া বিচিত্র নয়।
সব থেকে মজার ব্যপার হল, এই ঘটনার শেষাংশ আমাদের সকল ঐতিহাসিকই সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। কত রাজপুত সেদিন মারা পড়েছিল তা জানতে সম্রাটের খুব ইচ্ছা হয়। কিন্তু অত মৃতদেহ গুনবে কে ? সেষে সম্রাটের আদেশে সব মৃত দেহের পৈতা খুলে আনা হল এবং দাড়িপাল্লায় ওজন কয়া হলে মোট ওজন দাড়ালো সাড়ে চুয়াত্তর মণ ।

ভিনসেন্ট স্মিথ লিখেছেন "The recorded amount was 74.50 mans of about eight ounce each. (V.A. Smith, ibid-91)"
কাজেই প্রতিটি পৈতার ওজন ৮ আউন্স হলে কত হাজার বা কত লক্ষ পৈতা জড়ো করলে সাড়ে চুয়াত্তর মণ হয় তা অনুমান করা কঠিন কাজ নয় । এর সঙ্গে যোগ করতে হবে মহিলা ও শিশু, যাদের পৈতা ছিল না।
পরবর্তী কালে সম্রাট আওরঙ্গজেব হুকুম জারী করেন যে, প্রত্যেক দিন এমন সংখ্যক হিন্দু হত্যা করতে হবে যাতে তাদের পৈতা জড়ো করলে সোয়া এক মন হয় এবং এই পরিমাণ পৈতা এনে রোজ তাকে দেখাতে হবে। উত্তর ভারতে প্রতিটি পৌতার ওজন তিন আউন্স। সে হিসেবে প্রতিদিন ২৪ হাজার হিন্দু হত্যা করা হত।

সম্রাট আকবরের ঔরসে ও তার হিন্দু স্ত্রীর গর্ভের সন্তানের নাম সেলিম। তিনি সম্রাট আকবরের পর 'নুর উদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ গাজী' উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে বসেন। তার স্ত্রীও ছিলেন হিন্দু, অথচ তিনি গাজী (কাফের হত্যাকারী) উপাধি ধারণ করে তার রাজ্যে মন্দির নির্মান নিষিদ্ধ করেছিলেন।
আমাদের কোন কোন লেখক আকবরের হিন্দু কন্য বিবাহ ও তার পুত্র এবং উজির-নাজির সহ কর্মচারীদের হিন্দু কন্যা বিবাহে পুলকিত হয়ে উচ্ছ্বসিত প্রসংসা করেছেন। কেউ কেউ আকবরকে ধর্মনিরপেক্ষতার অবতার বানিয়ে ছেড়েছেন। কিন্তু যে সব মেয়েকে মোঘল হারেমে যেতে হয়েছে, সেই সব হতভাগ্যদের জন্মদাতা পিতারাই জানেন আকবরের সঠিক অবস্থান কোথায় ছিল।

সম্রাট আকবর প্রতিটি অভিজাত হিন্দু পরিবার থেকে কন্য সংগ্রহ করেছেন। তার হারেমে ৫০০০ হিন্দু কন্যা ছিল। হিন্দু মেয়ে সংগ্রহ করে তিনি উদার হয়েছিলেন; কিন্তু কোন মুসলমান মেয়ে হিন্দু পরিবারে বিয়ে দিয়ে উদারতা দেখাননি। হিন্দু পরিবারের ভিত নষ্ট করে তাদের এআত্মগরিমা ধ্বংস করে তাদের ইসলামে টেনে আনাই ছিল তার উদ্দেশ্য। আর এ কারনেই সম্রাট আকবর তার সারা জীবনে যতগুলি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন আর সবগুলিই ছিল হিন্দু রাজাদের বিরুদ্ধে। নবীজীই এই বিধান দিয়ে গেছেন।
আমাদের এক আহম্মক লেখক দীনেশচন্দ্র সেন হিন্দু কন্য মুসলমানদের ভোগে লাগায় উচ্ছ্বাসিত প্রশাংসা করে বলেছেন, এতে মুসলমান ও হিন্দর মধ্যে মেল বন্ধন দ্ৃঢ় হয় । কিন্তু মূর্খটা ইতিহাস পড়েনি; পড়লে জানতেন আকবরের ছেলে জাহাঙ্গীর হিন্দু মায়ের সন্তান হয়েও গুরু অর্জুনকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করেছিলেন। তার-- "মনের বাসনা হয় যত হিন্দু পাই, সুন্নত দেওয়াই আর কলেমা পড়াই।"
(চৈতন্য ভাগবত, ২য় ভাগ, পৃ-১৮৮)
সম্রাট শাহজাহান প্রায় অন্যান্য ধর্মে সাধু-সন্তদের ধর্মকথা শোনার নাম করে আগ্রায়  ডেকে আনতেন। কিন্তু শাহজাহানের ফাদে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাদের মুসলমান হবার হুকুম দিতেন। যারা ঐ হুকুম মেনে নিয়ে মুসলমান হতেন তারা বেচে যেতেন। বাকীদের পরদিন সকালেই নানা রকম পৈশাচিক অত্যাচার করে হত্যা করা হত। সব থেকে বেশী অবাধ্যদের হাতির পায়ের তলায় পিষে মারা হত। [Trans-Arc. Soc. Agra. 1978. Jan-June, VIII-IX]


Keene লিখেছেনএকবার শাহজাহান ফতেপুর সিক্রী অবরোধ করে নির্মম অত্যাচারে মধ্য দিয়ে হিন্দু প্রজাদের সর্বস্ব লুট করেন এবং অভিজাত রমনীদের বলাতকার ও স্তন কেটে ফেলেন। হামদ লাহোরী তার বাদশাহ নামায় লিখেছেন, "একদা বাদশাহের গোচরে আনা হল যেতার পিতার(জাহিঙ্গীরআমলে বিধর্মী কাফেরদের শক্ত ঘাটি বারাণসীতে অনেক পুতুল পুজার মন্দির তৈরী শুরু হয়েছিলযা শেষ পর্যন্ত অসমাপ্তই থেকে যায়। কিন্তু বর্তমানে কাফেরদের দল সেই সব মন্দির তৈরীর কাজ সম্পূর্ণ করায় উদ্যোগ নিয়েছে। শুনে ধর্মের রক্ষক মহানুভব সম্রাট আদেশ জারি করলেন যেবারাণসীসহ তার রাজ্যের যেখানে যেখানে আধা আধি মন্দির খাড়া হয়েছে তা সব ভেঙে ফেলতে হবে। অধুনা খবর এসেছে যেতার আদেশ বলে এলাহবাদ প্রদেশের বারাণসী জেলায় ৭৬ টি মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছে।


শ্রীকানোয়ার লাল এর মতে শাহজাহান ছিলেন একজন গোড়া সুন্নী মুসলমান। তার পত্নী মমতাদের পরামর্শে তিনি নতুন করে হিন্দু মন্দির ভাঙার কাজ শুরু করেন। মুসলমান হিসাবে শাহজাহান কতখানি উগ্র ও গোড়া ছিলেন তা আর একটি ঘটনার মাধ্য দিয়ে ভালভাবে বোঝা যাবে। ১৬৩২ খ্ৃষ্টাব্দে কাস্মীর থেকে ফেরার পথে সম্রাটের নজরে আনা হল যে, রাজৌরী, ভিম্বর ও গুজরাটের কোন কোন স্থানে হিন্দুরা 'নও মুসলমান মহিলাদের'(বাধ্য হয়ে ধর্মান্তরিত হওয়া) পত্নীরূপে গ্রহন করেছে এবং বিবাহ করার পর সেই সব মুসলমান মহিলাদের আবার হিন্দু করছে। শুনে সম্রাটের ভীষণ ক্রোধ হল। সম্রাটের আদেশে সেই সকল হিন্দুদের ধরে আনা হল এবং বিরাট অঙ্কের টাকা জরিমানা ধার্য করা হল। প্রথমে এত বেশী জরিমানা করা হল যে, যাতে কেউ দিতে না পারে। তখন তাদের বলা হল যে, একমাত্র ইসলাম গ্রহন করলেই তাদের মুক্তি দেওয়া হবে। অন্যথায় মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত করা হবে। প্রায় সকলেই ধর্ম গ্রহনে অস্বীক্ৃতি জানালে তাদের হত্যা করা হল এবং ৪৫০০ মহিলাকে পুনরায় মুসলমান করা হল। [R.C.Majumder. BVB, Vol. VII. P-312]

ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথের মথে আকবরের হারেমে ৫০০০ রমনী ছিল। পিতার মৃত্যুর পর বাদশা হয়ে জাহাঙ্গীর ঐ হারেমের মালিক হন এবং রমনী সংখ্যা ১০০০ বাড়িয়ে ৬০০০ করেন। সাধারনত হিন্দু পরিবারের মেয়েদের ধরে এনে এই অভিশপ্ত হারেমে রাখা হত।
কারন ইসলামের নিয়ম হল--
১। হানা দিয়ে সকল পুরুষকে হত্যা করতে হবে।
২। নারী ও শিশুদের ভাগ বাটোয়ারা করে নিতে হবে, পছন্দ মত ভোগ করতে হবে, বিক্রি করতে হবে।
৩। অমুসলমানের সমস্ত সম্পত্তি (গনিমতের মাল) ভোগ দখল করতে হবে। 
নতুন নতুন রমনীর দ্বারা হারেমের নবীকরন করা হত এবং পুরনো ও বয়স্কদের তাড়িয়ে দেওয়া হত। নূরজাহানের পিতা ইদমত-উদ-দৌলার মতে এইসব হতভাগিনী হারেম্বাসিনীদের কন্যা সন্তান জন্মালে তাদের হারেমেই রাখা হত এবং বড় হলে বাদশাহদের ভোগে লাগত। আর পুত্র সন্তান হলে সারা জীবনের জন্য কারাগারে নিক্ষেপ করা হত, খোজা করা হত বা হত্যা করা হত। [ P.N Oak, Tajmahal-The true story, p-207]

ইউরোপীয় পর্যটক বার্ণিয়ের তার ভ্রমন কাহিনী 'Travels in the Moghal Empire' -এ লিখেছেন, "প্রাসাদের মধ্যে ঘন ঘন মিনা বাজার বসিয়ে সেখানে জোর করে ধরে আনা শত শত হিন্দু রমনীদের বেচা-কেনা , সম্রাটের জন্য ধরে আনা শত শত হিন্দু রমনীকে উপহার হিসেবে গ্রহন করা, সরকারী খরচে বেশ কয়েক শ ন্ৃত্য পটিয়সী বেশ্যার বরণপোশণ, হারেম সুরক্ষার জন্য কয়েক শ, খোজা প্রহরী ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কামুক শাহজাহান তার কামনা ও লালসা চরিতার্থ করতেন।
পর্যটক পিটার মুন্ডি লিখেছেন, শাহজাহানের ছোট মেয়ে চিমনি বেগমের সাথে শাহজাহানের অবৈধ সম্পর্ক ছিল। বড় মেয়ে জাহানারার সঙ্গেও শাহজাহানের অবৈধ সম্পর্ক ছিল। এ ব্যাপারে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই একমত। শাহজাহান তার সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যেই বলতেন এবং যুক্তি দেখাতেন যে, গাছে ফল ধরলে বাগানের মালিরই অধিকার সবার আগে স্বাদ গ্রহন করার।

১৫৭৬ সালে রানা প্রাতাপের সঙ্গে হলদীঘাটের যুদ্ধের সময় বদায়ুনী নামে এক সেনাপতি আসাফ খার কাছে অভিযোগ করল যে, শত্রু ও মিত্র পক্ষের রাজপুতদের ঠিকমত চেনা যাচ্ছে না তাই তীর চালাতে অসুবিধা হচ্ছে। তখন আসফ খা তাকে বললেন, অত বাছ বিচার দরকার নেই। তীর চলালাতে থাক। কোন পক্ষের রাজপুত মারা গেল তা দেখার দরকার নেই। যে পক্ষের ই রাজপুত মরুক না কেন তাতেই ইসলামের লাভ। [R.C.Majumdar, B.V.B, p-132]

মোঘোল আমলে প্রায়ই ভয়াবহ আকাল হতো। ১৫৭৩-১৫৯৫ সালের মধ্যে পাচবার আকাল হয়। ১৫৯৫ সালের আকাল পাচ বছর ধরে চলতে থাকে। ১৬১৪ -১৬৬০ সালের মধ্যে মোট ১৩-বার আকাল হয়। শাহজাহানের আমলে ১৬৩০-৩১ সালে যে আকাল হয় তা সর্বাপেক্ষা বয়াবহ। সমস্ত দাক্ষিণাত্য ও গুজরাট অঞ্চলে আকাল ছড়িয়ে পড়ে। এই আকাল সম্বন্ধে হামিদ লাহোরী তার বাদশাহনামায় লিখেছেন, দাক্ষিণাত্যা ও গুজরাট এই দুই প্রদেশের মানুষের অবস্থা খুবই শোচনীয় অবস্থায় পৌছেছিল। লোকেরা এক  খানা রুটির জন্য সারা জীবন দাসত্ব করতে রাজী ছিল, কিন্তু ক্রেতা ছিল না। এক টুকরো রুটির বললে একদল মানুষ কেনা যেত; কিন্তু সেই সুযোগ নেবার লোক ছিল না। অনেকদিন ধরে কুকুরের মাংস বিক্রি হল। হাড়ের গুড়া ময়দার সাথে মিশিয়ে বিক্রি করা হল।
ক্রমে দুর্দশা এমন পর্যায়ে পৌচলো যে, মানুষ মানুষের মাংস খেতে শুরু করল। পিতা মাতার কাছে সন্তানের স্নেহ ভালবাসা থেকে তার শরীরের মাংসই বেশী প্রিয় হয়ে উঠল।

এমন দূর্ভিক্ষ হওয়ার কারন কি ? কারণ, এর আগেই লক্ষ লক্ষ হিন্দু কৃষকদের মুসলমান না হওয়ার  অপরাধে হত্যা করা হয়েছে, ফলে চাষ আবাদ করবে কে? মুসমানদের এই দুর্ভিক্ষ স্পর্শ করেনি। কারন হিন্দু বাড়ী লুটপাট। এই আকালে অনাহারে এত লোক মারা যায় যে, মৃত দেহের স্তুপে রাস্তা ঘাটে চলাচল অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। এইভাবে এক অতি উর্বর শস্য শ্যামল দেশ শ্মশানে পরিণত হয়েছিল।
ইংরেজ পর্যটক পিটার মান্ডি নিজের চোখে এই বীভস্য দৃশ্য দেখেছিলেন। তার রচনায়ও অনুরূপ বিবরণ পাওয়া যায়। হতভাগ্যরা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে পিটার মান্ডি একটি তাবু খাটাবার মত স্থানও পান নাই। একাধিক ইউরোপীয় পর্যটক ও ঐতিহাসিক শাহজাহানকে অত্যাচারী নিষ্টুর, বিলাসপ্রিয় ও ব্যভিচারী বলে চিহ্নিত করেছেন। টমাস রো, চেরী বার্নিয়ে, ডিলিয়ে, প্রভৃতি ইউরোপীয় পর্যটক ও যাজকদের বর্ণনার উপর ভিত্তিকরে ড. স্মিতও অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। শাহজাহান খ্ৃষ্টান, হিন্দু, ও পর্তুগিজদের উপর নির্যাতন করতেন এবং হিন্দু মন্দির ধ্বংস ও নতুন মন্দির নির্মানে বাধা দিতেন। তিনি হিন্দুদের উপর তীর্থকর পুনরায় প্রবর্তন করেছিলেন।


ইসলামি শান্তি ও বিধর্মী সংহার-পর্ব~২

............প্রথম পর্বের পর(https://aryarishidot.blogspot.com/2017/11/blog-post.html)
পর্ব-২

"হে সৃষ্টিকর্তা ভগবান, 

জীবন্ত যম হিসেবে তুমি কি দানবরূপী 
এই বাবরকে পাঠিয়েছ ?
অমানুষিক তার অত্যাচার, পৈশাচিক তার হত্যা লীলা, 
অত্যাচারিতের বুক ফাটা আর্তনাদ ও করুন ক্রন্দন 
তুমি কি শুনতে পাওনা? 
তাহলে তুমি কেমন দেবতা ?"
ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী ১১৯৯ সালে দক্ষিন বিহার অঞ্চলে ওদাত্তপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও বিখ্যাত নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আক্রমন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় তিন হাজার উচ্চতম ডিগ্রিধারী শিক্ষক এবং প্রায় বিশ হাজার ছাত্র ছাত্রীকে হত্যা করেন । (History of Bengal, Dhaka University, Vol.II,p-3)


শামস উদ্দিন ইলিয়াস শাহ ১৩৪৬ খৃষ্টাব্দে নেপাল আক্রমন করে স্বয়ম্ভুনাথ স্তুপ ও শাক্য মুনির পবিত্র ধ্বজা ভস্মীভুত করেন।
 মোহাম্মদ শাহ (১ম, ১৩৫৮-৭৭) বিজয়নগর সাম্রাজ্য অতর্কিতে আক্রমন করে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে চার লক্ষ হিন্দুর প্রাণনাশ করেছিলেন এবং বিজয়নগর সাম্রাজ্য লন্ডভন্ড করেন। এমন হত্যাকান্ড পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আর নেই ।
তাজ উদ্দিন ফিরোজ শাহ বিজয়নগর সাম্রাজ্য লুন্ঠন করেন এবং একজন রাজকন্যাকে নিজ হারেমের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। বাহমনী সুলতান ফিরোজ শাহ বিজয়নগরের রাজা দেব রায়কে পরাজিত করেন এবং রাজ কন্যাকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে বাধ্য করেন। এই অপমানে বিজয়নগরের জনগন প্রতিশোধের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। ফলে ফিরোজশাহ পুনরায় আক্রমন করে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। ফিরোজ শাহ এই পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে ম্ৃত্যু মুখে পতিত হন।

১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে দাক্ষিনাত্যের সকল সুলতানী বাহিনী এক সঙ্গে বিজয়নগর আক্রমন করেন। ফলে সায়ানাচার্যের স্বপ্নের বিজয়নগরের গৌরবসূর্য তালিকোটার প্রান্তরে চিরতরে অস্তমিত হল। বিজয়ী মুসলমান সৈন্য বিজয়নগরে প্রবেশ করে দীর্ঘ পাচ মাস ধরে অবাধ লুন্ঠন চালালো। বুরহান-ই-মসির ও ফিরিস্তির বর্ণনা থেকে জানা যায়, কল্পনাতীত পরিমান মনি মুক্তা, ধন-দৌলত, অসংখ্য হাতি, ঘোড়া, উট, দাস-দাসী বিজয়ী সৈন্যগন কর্তৃক লুন্ঠিত হয়েছিল। বিজয়ী মুসলমান কেবলমাত্র মুল্যবান সামগ্রী লুন্ঠন করেই ক্ষন্ত ছিলেন না, বিজয়নগরকে তারা বিরাট ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে বিজয়নগরের ন্যায় সমৃদ্ধ নগরীর এইরূপ আকস্মিক ধ্বংস্তুপে পরিনত হওয়ার দ্ষ্টান্ত বিরল। নগরের যাবতীয় মন্দির, প্রাসাদ ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেও পরাজিতের প্রতি হিংসাপরণাতার অবসান হল না। অবশেষে লক্ষ লক্ষ হিন্দু নর-নারী এবং শিশু বৃদ্ধেরর রক্তে বিজয়নগরের ধুলি রঞ্জিত করে তারা লুন্ঠন যজ্ঞে পূর্ণাহতি দিল ।

স্ত্রী সন্তানের মাথা কেটে দিল হিন্দু রাজা
ততকালীন অন্যান্য মুসলমান শাসকগনের মত শেরশাহও (১৫৪১পাইকারী হারে হিন্দু হত্যাহিন্দু সম্পত্তি লুটহিন্দু নারী বলাতকার এবং হিন্দু মন্দির ধ্বংসের ব্যপারে সমান পটু ছিলেন। হিন্দুর সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করতে তার কোন দ্বিধা চিল না।
১৫৪০ খৃষ্টাব্দে বাদশাহ হবার পর ১৫৪৩  খৃষ্টাব্দে শেরশাহ রায়সিনের হিন্দু রাজা পুরনমলের দূর্গ আক্রমন করেন।  পুরনমলের সৈন্যরা প্রথমে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করেন এবং পরে দূর্গের মধ্যে আশ্রয় নিলেন। প্রায় ৬ মাস দূর্গ অবরোধের পর শেরশাহ কামান দিয়ে দূর্গের ক্ষতি করতে থাকেন। পুরনমল তখন খবর পাঠালেন যেতাকে ও তার লোকজনকে পালিয়ে যেতে দিলে তিনি দূর্গ ছেড়ে চলে যাবেন। শেরশাহ তাতে সম্মতি জানান। পুরনমলের লোকজন তখন দূর্গ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং শেরশাহের নির্দেশ মত দূর্গের বাইরে তাবু খাটিয়ে অবস্থান করতে থাকেন। ইতিমধ্যে শেরশাহ সবাইকে হত্যা করার গোপন পরিকল্পনা করে এবং পরদিন সকালে শেরশাহের  সৈন্যরা তাদের ঘিরে ফেলে। অবস্থা বুঝতে পেরে পুরনমল তার স্ত্রী রত্নাবলীর মাথা তরোয়াল দিয়ে কেটে ফেলেন এবং অন্য সবাইকেও হুকুম দিলেন নিজ নিজ পরিবারের মহিলাদের মাথা কেটে ফেলতে। মুসলমানরা ইতিমধ্যে আক্রমন শুরু করে দিয়েছে। 
আব্বাস-খা ইংরেজীতে ঘটনাটির যে বর্ণনা দিয়েছেন বাংলায় তা এরূপ---

"হিন্দুরা তাদের নিজ নিজ পরিবারের ও অন্যান্যদের (অর্থাৎ নাবালক ও শিশুদেরহত্যা করতে ব্যস্তইত্যবসরে আফগানরা চর্তুদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলল এবং তাদের হত্যা করতে শুরু করলো । শুয়োর খানা-খন্দে পড়ে গেলে যেমন হয় হিন্দুরাও সেই রকম অসহায় হয়ে পড়লো। পুরনমল ও তার লোকেরা বীরত্ব ও বিক্রম দেখাতে চেষ্টা করল বটে, তবে চোখের পলকে আফগানরা সবাইকে কচু কাটা করে ফেলল।
যে সব নারী ও শিশুদের হিন্দুরা হত্যা করে উঠতে পারেনি, তাদের সবাইকে বন্ধী করা হল। তাদের মধ্য থেকে পুরনমলের এক কন্যা ও তার বড় ভাইয়ের তিন ছেলেকে জীবিত রেখে বাকি সকলকে হত্যা করা হল। শের খা পুরনমলের মেয়েকে কয়েকজন বাজীগরের হাতে তুলে দিল । যাতে তারা তাকে হাটে বাজারে নাচাতে পারে । আর ছেলে তিনটিকে খোজা বানাবার হুকুম দেওয়া হল যাতে অত্যাচারী হিন্দুরা বংশ বিস্তার করতে না পারে।
রোহতাস দূর্গের রাজা হরেকৃষ্ণ রায় শেরশাহের বন্ধু ছিলেন। ১৫৩৭ সালে হুমায়ন শেরশাহের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। সেই সময় শেরশাহের হারেমে ১০০০ রমনী ছিল এবং তারা সবাই চুনারগড় দূর্গে বাস করত। চুনার গড় দূর্গ ততটা সুরক্ষিত নয় তাই শেরশাহ রাজা হরেকৃষ্ণ রাহকে অনুরোধ করলেন হারেম শুদ্ধ তার পরিবারকে আশ্রয় এবার জন্য। এর আগে রাজা শেরশাহের ছোট ভাই মিয়া নিজাম ও তার পরিবারকে রোহিতাস দূর্গে আশ্রয় দিয়ে উপকার করেছিলেন। কিন্তু রাজা চট করে শেরশাহের প্রস্তাবে সম্মতি দিতে পারলেন না। তার ইতস্ততঃ ভাব দেখে শেরশাহ কোরান ছুয়ে শপথ করেন এবং এর ফলে রাজা রাজা তাকে আশ্রয় দিতে রাজী হন। কিন্তু সেই মূর্খ রাজার জানা ছিলনা যেকোরান হিন্দু ধর্মগ্রন্থের মত নয়। কোরানে আল্লাহর নির্দেশ আছেবিধর্মী অমুসলমান কাফেরদের সঙ্গে যেকোন রকম মিথ্যাচারছলনা ও বিশ্বাষঘাতকতা করা যায়। ফলে সেই রাতেই শেরশাহ রোহতাস দূর্গ দখলের ছক করে ফেললেন। ১২০০ ডুলি সাজানো হল এবং প্রত্যেক ডুলিতে দু'জন করে পাঠান সৈন্য বোরখা পরে অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে বসে রইল। প্রথম কয়েকটা ডুলিতে কিছু মহিলা ছিল । তাই দূর্গের রক্ষীরা প্রথম কয়টা ডুলি পরীক্ষা করে চক্রান্ত বুঝতে পারলো না। এদিকে শেরশাহ রাজার কাছে খবর পাঠালেন যেতার রক্ষীরা ডুলি পরীক্ষা করে মুসলমান রমনীদের অসম্মান করছেন । কাজেই ডুলি পরীক্ষা বন্ধ হল এবং প্রায় আড়াই হাজার আফগান সৈন্য দূর্গের মধ্যে ডুকে পড়ল। মূহুর্তে আরা আক্রমন করে কারারক্ষীদের হত্যা করলো এবং দূর্গ দখল করে নিল। রাজা হরেকৃষ্ণ রায় কোন মতে গুপ্ত পথ দিয়ে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করলেন । [Elliot & J.Dowson, IV,p-361]

শেরশাহের বাল্য নাম ছিল ফরিদ খা। প্রথম জীবনে তিনি দস্যুদের নেতা ছিলেন। এই দস্যুবৃত্তির কাজ কিভাবে হত ? ঐতিহাসিক আব্বাসের বর্ণনা অনুসারে, "তিনি তার ঘোড়াসাওয়ারদের সর্বক্ষন গ্রামের চতুর্দিকে পাহারা দিতে বলেন। সমস্ত পুরুষদের হত্যা করতে এবং নারী ও শিশুদের বন্দী করতে হুকুম দিলেন। সমস্ত গরু-বাছুর তুলে আনতে চাষ-আবাদ বন্ধ করতে এবং ক্ষেতের ফসল বিনষ্ট করতে হুকুম দিলেন। গ্রামের কোন লোক পাশাপাশি কোন গ্রাম হতে কিছু যাতে না আনতে পারেসে ব্যবস্থা করতে আদেশ দিলেন।"
১৯৭১-এ বাংলাদেশে ইয়াহিয়া বাহিনী একই নীতি অনুসরণ করেছিল।
হাসান খার অধীনে অনেক আফগান চকরী করত। তাদের কোন জমি জায়গা বা জায়গীর ছিল না। প্রথমে ফরিদ খা সেই সব আফগানদের জায়গীরের প্রলোভন দেখিয়ে অন্যত্র করে ছোটখাট একটা দস্য দল গঠন করলেন। তখন বিহারে আরও অনেক আফগান বাস করত। ফরিদ খা সেই সব স্বজাতীয় আফগানদের আহ্বান জানান তার দলে যোগ দেবার জন্য---"যার ঘোড়া আছে সে ঘোড়ায় চড়ে এবং অন্যান্যরা পায়ে হেটে আমার দলে যোগ দাও "
জায়গীর ও লুটের মাল পাবার লোভে তারাও এসে যোগ দিল। এই দল নিয়ে ফরিদ খা জমিদার ও বিত্তশালী হিন্দুদের টাকা পয়সা সহায় সম্বল লুটপাট করতে শুরু করে দিল। এইরকম একটি আক্রমন বর্ণ্না করতে গিয়ে আব্বাস খা লিখেছেন-- " অতি প্রত্যুষে ফরিদ খা তার দল-বল নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে সেই সব জমিদারদেরইসলামী মতে যারা অপরাধী তাদের আক্রমন করল। সব পুরুষদের হত্যা করা হল এবং বন্দী নারী ও শিশুদের ক্রীতদাস হিসেবে বেচে দিতে অথবা নিজের কাজে ব্যবহার করতে হুকুম দিল। অন্য মুসলমানদের সেখানে এনে বসতি করতে আদেশ জারি করলেন।"

সম্রাট বাবরের  নাম সবাই জানেন। ফতেপুর সিক্রি আক্রমন সম্পর্কে এই বাবর তার আত্মজীবনী তে লিখেছেন

" শত্রুকে পরাজিত করার পর আমরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলাম এবং ব্যপকভাবে হত্যা করতে থাকলাম। আমাদের শিবির থেকে প্রায় দুই ক্রোশ দূরে ছিল তাদের শিবির। সেখানে পৌঁছে আমি মুহাম্মদী ও আরও কয়েকজন সেনাপতিকে হুকুম দিলাম তাদের হত্যা করতেকেটে দু'খানা করতেযাতে তারা আবার একত্রিত হবার সুযোগ না পায়।"

কত হিন্দুকে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল তার হিসাব পাওয়া যায়না। বাবর হুকুম দিলেন, কাছাকাছি একটি পাহাড়ের কাছে সমস্ত নরমুন্ডকে জড়ো করে একটি স্তম্ভ তৈরী করতে।

"সেই টিলার উপর কাটা মুন্ডের একটি মিনার বানাতে হুকুম দিলাম। বিধর্মী (হিন্দু) ও ধর্মত্যাগীদের অসংখ্য মৃত দেহ পথে ঘাটে ছড়িয়ে ছিল। এমন কি দূর দেশ আলোয়ার, মেওয়াট ও বায়না যাবার পথেও বহু মৃত দেহ পড়ে থাকতে দেখা গেল।"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড.রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, অন্যান্য মুসলমান হানাদারের মত বাবরও হিন্দু মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংস করার মত বহু সাক্ষর রখে গেছেন। বাবর সম্বল ও চান্দেরী মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ নির্মান করেন। 
বাবরের আদেশে তার সেনাপতি মীর বাকি অযোধ্যার রাম জন্মভূমি মন্দির ভেঙ্গে তাতে প্রায় এক লক্ষ হিন্দুর রক্ত চুন বালিতে মিশ্রিত করে ইট গেঁথে বাবরের নামে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া গোয়ালিয়রের নিকট জৈন মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংস করেন। [R.C.Majumder. BVB, Vol. VII, p-307]

বাবরের পৈশাচিক নরহত্যা, বন্দী নারী ও শিশুদের চামড়ার চাবুক দিয়ে মারা এবং তাদের সাথে পশুর মত ব্যবহার করা ইত্যাদি আরো অনেক বর্বর কাজকর্ম গুরু নানক স্বচক্ষে প্রত্যাক্ষ করেছিলেন। ১৫২১ খৃষ্টাব্দে বাবর প্রথমে শিয়ালকোট ও পরে সৈয়দপুর দখল করে এক ব্যপক গনহত্যার আদেশ দিলেন। ফলে হাজার হাজার অসামরিক হিন্দু প্রজাকে হত্যা করা হল।


এসব দেখে গুরু নানক লিখেছেন--

"হে সৃষ্টিকর্তা ভগবান, জীবন্ত যম হিসেবে তুমি কি দানবরূপী এই বাবরকে পাঠিয়েছ ? অমানুষিক তার অত্যাচার, পৈশাচিক তার হত্যা লীলা, অত্যাচারিতের বুক ফাটা আর্তনাদ ও করুন ক্রন্দন তুমি কি শুনতে পাওনা? তাহলে তুমি কেমন দেবতা ?" 
[R.C.Majumder. BVB, Vol. VII, p-307]

১৫২৭ সালের ১৭ই মার্চ বাবর ফতেপুর সিক্রীর অদূরে খানুয়ার প্রান্তরে রাণা সংগ্রাম সিংহের সাথে যুদ্ধে অবর্তীর্ণ হন। মুসলমানদের বিবরন অনুসারে, সেদিন দেড় থেকে দুই লক্ষ হিন্দু মুসলমানদের হাতে কাটা পড়েছিল এবং সেই কাটা মুণ্ড দিয়ে পাহাড় তৈরী করা হয়েছিল ।
হিন্দু হত্যা করে তিনি হলেন আকবর দ্যা গ্রেট

১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে ভাগ্যের পরিহাসে হিন্দু বীর বিক্রমাদিত্য হোমরাজ ওরফে হিমু বিজয়ের দোরগোড়ায় পৌছেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হলেন। অতিশয় রক্তক্ষরনের ম্ৃতপ্রায় সম্রাট হোমরাজকে বৈরাম খা হাত পা বাধা অবস্থায় আকবরের সামনে উপস্থিত করল। এই ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে সমকালীন মুসলমান ঐতিহাসিক আহম্মদ ইয়াদ্গার তারিখ--আফগানা গ্রন্থে লিখেছেনসম্রাট হোমরাজকে ঐভাবে হাত পা বাধা অবস্থায় আকবরের সামনে উপস্থিত করে বৈরাম খা বললআজ প্রথম সাফল্যের এই শুভ মুহূর্তে আমাদের ইচ্ছা সম্রাটের মহান হস্ত তরবারির সাহায্যে এই বিধর্মী কাফেরের মস্তক ছিন্ন করুক। সেই অনুসারে সম্রাট তার মস্তক অপবিত্র দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করলেন। [Elliot & J.Dowson, V,pp-65-66]

'আকবর দি গ্রেটনামের মোঘল সম্রাট যে কতখানি নিষ্টুর ও নৃশংস ছিলেনআর একটি ছোট্ট ঘটনার মধ্য দিয়ে তা আরো সুন্দর ভাবে ফুটে উঠে। - একদা আকবর বিকেলের নামাজ থেকে ফিরে চাকরদের ডাকাডাকি করতে লাগলেন। কিন্তু সাড়া দেবার মত কাছাকাছি কেউ ছিল না। আকবর খুব রেগে গেলেন। হঠাত তিনি দেখতে পেলেন যেতার আসনের পাশে এক ছোকরা চাকর মেঝেতে শুয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আকবর পেয়াদাদের ডেকে হুকুম দিলেন "এক্ষুনি একে মিনারের উপর থেকে নিচে ফেলে দাও।পেয়াদারা তখনি তাকে আগ্রা দূর্গের উপর থেকে নিচে ফেলে দিল। এই ঘটনা বর্ননা করে মুসলমান ঐতিহাসিক আসাদ বেগ তার 'বিকায়াগ্রন্থে লিখেছেনসিংহাসন ও কৌচের কাছে গিয়ে তিনি (আকবরদেখতে পেলেন যেবাতি জ্বালাবার এক হতভাগ্য চাকর কৌচের কাছে মেঝেতে সাপের মত কুন্ডুলি পাকিয়ে মরার মত গুমাচ্ছে। ক্রুদ্ধ আকবর সেই চাকরটাকেও মিনারের উপর থেকে নিচে ফেলে দিতে আদেশ দিলেন। তদনুসারে তাকে ছুড়ে ফেলা হল এবং তার শরীর হাজার টুকরা হয়ে গেল।
[Elliot & J.Dowson, VI,p-164]
ইনিই মহামতি আকবরইংরেজীতে বলা হয় 'Akbar The Great'

১৫৬৭ খৃষ্টাব্দে আকবর মেবারের রাণা উদয় সিংহের বিরুদ্ধে অভিযান করেন এবং চিতোর দূর্গে অবরোধ করে দূর্গের দেওয়ালের নিকট বারূদ জমা করে প্রবল বিষ্ফোরণ ঘটানো হল। এতে প্রচীরের অংশ বিশেষ ধ্বংস হয়ে গেল। দূর্গ রক্ষার আর কোন উপায় না দেখে সেদিনই রাজপুত নারীরা জহর ব্রত অনুষ্টান করলেন। প্রায় ৩০০ রাজপুত নারী জ্বলন্ত আগুনে আত্মাহুতি দিলেন। দূর্গের মধ্যে তখন মাত্র ৮০০০ রাজপুত সৈন্য অবশিষ্ট ছিল।  তারা প্রবল বিক্রমে যুদ্দ করে সকলেই প্রাণ দিলেন। সব মিটে গেলে পরদিন সকালে বিজয়ী আকবর হাতিতে চড়ে দূর্গে প্রবেশ করলেন। তখন দূর্গের মধ্যে ছিল ৪০ হাজার অসামরিক প্রজা। আশ্রয় নেওয়া ৪০ হাজার রাজপুত ক্ৃষক প্রজার ভাগ্যে কি ঘটলো ?
ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ লিখেছেন---
'দূর্গ অবরোধের সময় ঐ ৪০ হাজার (অসামরিক) ক্ৃষক প্রজা রাজপুত বাহিনীর ৮০০০ সৈন্যকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছিলেন। সে কারনে সম্রাট তাদের হত্যার আদেশ দিলেন। ফলে সেদিন ৩০ হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছিল।


. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, সেদিন কত রাজপুত মারা পড়েছিল তার সঠিক সংখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়। আবুল ফজল যে ৩০ হাজার সংখ্যা বলেছেন তা তো শোনা কথা, দেখা নয়, প্রক্ৃত সংখ্যা ৫০ হাজার, ৮০ হাজার, এক লাখ বা তারও বেশি হওয়া বিচিত্র নয়।
সব থেকে মজার ব্যপার হল, এই ঘটনার শেষাংশ আমাদের সকল ঐতিহাসিকই সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। কত রাজপুত সেদিন মারা পড়েছিল তা জানতে সম্রাটের খুব ইচ্ছা হয়। কিন্তু অত মৃতদেহ গুনবে কে ? সেষে সম্রাটের আদেশে সব মৃত দেহের পৈতা খুলে আনা হল এবং দাড়িপাল্লায় ওজন কয়া হলে মোট ওজন দাড়ালো সাড়ে চুয়াত্তর মণ ।

ভিনসেন্ট স্মিথ লিখেছেন "The recorded amount was 74.50 mans of about eight ounce each. (V.A. Smith, ibid-91)"
কাজেই প্রতিটি পৈতার ওজন ৮ আউন্স হলে কত হাজার বা কত লক্ষ পৈতা জড়ো করলে সাড়ে চুয়াত্তর মণ হয় তা অনুমান করা কঠিন কাজ নয় । এর সঙ্গে যোগ করতে হবে মহিলা ও শিশু, যাদের পৈতা ছিল না।
পরবর্তী কালে সম্রাট আওরঙ্গজেব হুকুম জারী করেন যে, প্রত্যেক দিন এমন সংখ্যক হিন্দু হত্যা করতে হবে যাতে তাদের পৈতা জড়ো করলে সোয়া এক মন হয় এবং এই পরিমাণ পৈতা এনে রোজ তাকে দেখাতে হবে। উত্তর ভারতে প্রতিটি পৌতার ওজন তিন আউন্স। সে হিসেবে প্রতিদিন ২৪ হাজার হিন্দু হত্যা করা হত।

সম্রাট আকবরের ঔরসে ও তার হিন্দু স্ত্রীর গর্ভের সন্তানের নাম সেলিম। তিনি সম্রাট আকবরের পর 'নুর উদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ গাজী' উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে বসেন। তার স্ত্রীও ছিলেন হিন্দু, অথচ তিনি গাজী (কাফের হত্যাকারী) উপাধি ধারণ করে তার রাজ্যে মন্দির নির্মান নিষিদ্ধ করেছিলেন।
আমাদের কোন কোন লেখক আকবরের হিন্দু কন্য বিবাহ ও তার পুত্র এবং উজির-নাজির সহ কর্মচারীদের হিন্দু কন্যা বিবাহে পুলকিত হয়ে উচ্ছ্বসিত প্রসংসা করেছেন। কেউ কেউ আকবরকে ধর্মনিরপেক্ষতার অবতার বানিয়ে ছেড়েছেন। কিন্তু যে সব মেয়েকে মোঘল হারেমে যেতে হয়েছে, সেই সব হতভাগ্যদের জন্মদাতা পিতারাই জানেন আকবরের সঠিক অবস্থান কোথায় ছিল।

সম্রাট আকবর প্রতিটি অভিজাত হিন্দু পরিবার থেকে কন্য সংগ্রহ করেছেন। তার হারেমে ৫০০০ হিন্দু কন্যা ছিল। হিন্দু মেয়ে সংগ্রহ করে তিনি উদার হয়েছিলেন; কিন্তু কোন মুসলমান মেয়ে হিন্দু পরিবারে বিয়ে দিয়ে উদারতা দেখাননি। হিন্দু পরিবারের ভিত নষ্ট করে তাদের এআত্মগরিমা ধ্বংস করে তাদের ইসলামে টেনে আনাই ছিল তার উদ্দেশ্য। আর এ কারনেই সম্রাট আকবর তার সারা জীবনে যতগুলি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন আর সবগুলিই ছিল হিন্দু রাজাদের বিরুদ্ধে। নবীজীই এই বিধান দিয়ে গেছেন।
আমাদের এক আহম্মক লেখক দীনেশচন্দ্র সেন হিন্দু কন্য মুসলমানদের ভোগে লাগায় উচ্ছ্বাসিত প্রশাংসা করে বলেছেন, এতে মুসলমান ও হিন্দর মধ্যে মেল বন্ধন দ্ৃঢ় হয় । কিন্তু মূর্খটা ইতিহাস পড়েনি; পড়লে জানতেন আকবরের ছেলে জাহাঙ্গীর হিন্দু মায়ের সন্তান হয়েও গুরু অর্জুনকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করেছিলেন। তার-- "মনের বাসনা হয় যত হিন্দু পাই, সুন্নত দেওয়াই আর কলেমা পড়াই।"
(চৈতন্য ভাগবত, ২য় ভাগ, পৃ-১৮৮)
সম্রাট শাহজাহান প্রায় অন্যান্য ধর্মে সাধু-সন্তদের ধর্মকথা শোনার নাম করে আগ্রায়  ডেকে আনতেন। কিন্তু শাহজাহানের ফাদে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাদের মুসলমান হবার হুকুম দিতেন। যারা ঐ হুকুম মেনে নিয়ে মুসলমান হতেন তারা বেচে যেতেন। বাকীদের পরদিন সকালেই নানা রকম পৈশাচিক অত্যাচার করে হত্যা করা হত। সব থেকে বেশী অবাধ্যদের হাতির পায়ের তলায় পিষে মারা হত। [Trans-Arc. Soc. Agra. 1978. Jan-June, VIII-IX]


Keene লিখেছেনএকবার শাহজাহান ফতেপুর সিক্রী অবরোধ করে নির্মম অত্যাচারে মধ্য দিয়ে হিন্দু প্রজাদের সর্বস্ব লুট করেন এবং অভিজাত রমনীদের বলাতকার ও স্তন কেটে ফেলেন। হামদ লাহোরী তার বাদশাহ নামায় লিখেছেন, "একদা বাদশাহের গোচরে আনা হল যেতার পিতার(জাহিঙ্গীরআমলে বিধর্মী কাফেরদের শক্ত ঘাটি বারাণসীতে অনেক পুতুল পুজার মন্দির তৈরী শুরু হয়েছিলযা শেষ পর্যন্ত অসমাপ্তই থেকে যায়। কিন্তু বর্তমানে কাফেরদের দল সেই সব মন্দির তৈরীর কাজ সম্পূর্ণ করায় উদ্যোগ নিয়েছে। শুনে ধর্মের রক্ষক মহানুভব সম্রাট আদেশ জারি করলেন যেবারাণসীসহ তার রাজ্যের যেখানে যেখানে আধা আধি মন্দির খাড়া হয়েছে তা সব ভেঙে ফেলতে হবে। অধুনা খবর এসেছে যেতার আদেশ বলে এলাহবাদ প্রদেশের বারাণসী জেলায় ৭৬ টি মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছে।


শ্রীকানোয়ার লাল এর মতে শাহজাহান ছিলেন একজন গোড়া সুন্নী মুসলমান। তার পত্নী মমতাদের পরামর্শে তিনি নতুন করে হিন্দু মন্দির ভাঙার কাজ শুরু করেন। মুসলমান হিসাবে শাহজাহান কতখানি উগ্র ও গোড়া ছিলেন তা আর একটি ঘটনার মাধ্য দিয়ে ভালভাবে বোঝা যাবে। ১৬৩২ খ্ৃষ্টাব্দে কাস্মীর থেকে ফেরার পথে সম্রাটের নজরে আনা হল যে, রাজৌরী, ভিম্বর ও গুজরাটের কোন কোন স্থানে হিন্দুরা 'নও মুসলমান মহিলাদের'(বাধ্য হয়ে ধর্মান্তরিত হওয়া) পত্নীরূপে গ্রহন করেছে এবং বিবাহ করার পর সেই সব মুসলমান মহিলাদের আবার হিন্দু করছে। শুনে সম্রাটের ভীষণ ক্রোধ হল। সম্রাটের আদেশে সেই সকল হিন্দুদের ধরে আনা হল এবং বিরাট অঙ্কের টাকা জরিমানা ধার্য করা হল। প্রথমে এত বেশী জরিমানা করা হল যে, যাতে কেউ দিতে না পারে। তখন তাদের বলা হল যে, একমাত্র ইসলাম গ্রহন করলেই তাদের মুক্তি দেওয়া হবে। অন্যথায় মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত করা হবে। প্রায় সকলেই ধর্ম গ্রহনে অস্বীক্ৃতি জানালে তাদের হত্যা করা হল এবং ৪৫০০ মহিলাকে পুনরায় মুসলমান করা হল। [R.C.Majumder. BVB, Vol. VII. P-312]

ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথের মথে আকবরের হারেমে ৫০০০ রমনী ছিল। পিতার মৃত্যুর পর বাদশা হয়ে জাহাঙ্গীর ঐ হারেমের মালিক হন এবং রমনী সংখ্যা ১০০০ বাড়িয়ে ৬০০০ করেন। সাধারনত হিন্দু পরিবারের মেয়েদের ধরে এনে এই অভিশপ্ত হারেমে রাখা হত।
কারন ইসলামের নিয়ম হল--
১। হানা দিয়ে সকল পুরুষকে হত্যা করতে হবে।
২। নারী ও শিশুদের ভাগ বাটোয়ারা করে নিতে হবে, পছন্দ মত ভোগ করতে হবে, বিক্রি করতে হবে।
৩। অমুসলমানের সমস্ত সম্পত্তি (গনিমতের মাল) ভোগ দখল করতে হবে। 
নতুন নতুন রমনীর দ্বারা হারেমের নবীকরন করা হত এবং পুরনো ও বয়স্কদের তাড়িয়ে দেওয়া হত। নূরজাহানের পিতা ইদমত-উদ-দৌলার মতে এইসব হতভাগিনী হারেম্বাসিনীদের কন্যা সন্তান জন্মালে তাদের হারেমেই রাখা হত এবং বড় হলে বাদশাহদের ভোগে লাগত। আর পুত্র সন্তান হলে সারা জীবনের জন্য কারাগারে নিক্ষেপ করা হত, খোজা করা হত বা হত্যা করা হত। [ P.N Oak, Tajmahal-The true story, p-207]

ইউরোপীয় পর্যটক বার্ণিয়ের তার ভ্রমন কাহিনী 'Travels in the Moghal Empire' -এ লিখেছেন, "প্রাসাদের মধ্যে ঘন ঘন মিনা বাজার বসিয়ে সেখানে জোর করে ধরে আনা শত শত হিন্দু রমনীদের বেচা-কেনা , সম্রাটের জন্য ধরে আনা শত শত হিন্দু রমনীকে উপহার হিসেবে গ্রহন করা, সরকারী খরচে বেশ কয়েক শ ন্ৃত্য পটিয়সী বেশ্যার বরণপোশণ, হারেম সুরক্ষার জন্য কয়েক শ, খোজা প্রহরী ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কামুক শাহজাহান তার কামনা ও লালসা চরিতার্থ করতেন।
পর্যটক পিটার মুন্ডি লিখেছেন, শাহজাহানের ছোট মেয়ে চিমনি বেগমের সাথে শাহজাহানের অবৈধ সম্পর্ক ছিল। বড় মেয়ে জাহানারার সঙ্গেও শাহজাহানের অবৈধ সম্পর্ক ছিল। এ ব্যাপারে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই একমত। শাহজাহান তার সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যেই বলতেন এবং যুক্তি দেখাতেন যে, গাছে ফল ধরলে বাগানের মালিরই অধিকার সবার আগে স্বাদ গ্রহন করার।

১৫৭৬ সালে রানা প্রাতাপের সঙ্গে হলদীঘাটের যুদ্ধের সময় বদায়ুনী নামে এক সেনাপতি আসাফ খার কাছে অভিযোগ করল যে, শত্রু ও মিত্র পক্ষের রাজপুতদের ঠিকমত চেনা যাচ্ছে না তাই তীর চালাতে অসুবিধা হচ্ছে। তখন আসফ খা তাকে বললেন, অত বাছ বিচার দরকার নেই। তীর চলালাতে থাক। কোন পক্ষের রাজপুত মারা গেল তা দেখার দরকার নেই। যে পক্ষের ই রাজপুত মরুক না কেন তাতেই ইসলামের লাভ। [R.C.Majumdar, B.V.B, p-132]

মোঘোল আমলে প্রায়ই ভয়াবহ আকাল হতো। ১৫৭৩-১৫৯৫ সালের মধ্যে পাচবার আকাল হয়। ১৫৯৫ সালের আকাল পাচ বছর ধরে চলতে থাকে। ১৬১৪ -১৬৬০ সালের মধ্যে মোট ১৩-বার আকাল হয়। শাহজাহানের আমলে ১৬৩০-৩১ সালে যে আকাল হয় তা সর্বাপেক্ষা বয়াবহ। সমস্ত দাক্ষিণাত্য ও গুজরাট অঞ্চলে আকাল ছড়িয়ে পড়ে। এই আকাল সম্বন্ধে হামিদ লাহোরী তার বাদশাহনামায় লিখেছেন, দাক্ষিণাত্যা ও গুজরাট এই দুই প্রদেশের মানুষের অবস্থা খুবই শোচনীয় অবস্থায় পৌছেছিল। লোকেরা এক  খানা রুটির জন্য সারা জীবন দাসত্ব করতে রাজী ছিল, কিন্তু ক্রেতা ছিল না। এক টুকরো রুটির বললে একদল মানুষ কেনা যেত; কিন্তু সেই সুযোগ নেবার লোক ছিল না। অনেকদিন ধরে কুকুরের মাংস বিক্রি হল। হাড়ের গুড়া ময়দার সাথে মিশিয়ে বিক্রি করা হল।
ক্রমে দুর্দশা এমন পর্যায়ে পৌচলো যে, মানুষ মানুষের মাংস খেতে শুরু করল। পিতা মাতার কাছে সন্তানের স্নেহ ভালবাসা থেকে তার শরীরের মাংসই বেশী প্রিয় হয়ে উঠল।

এমন দূর্ভিক্ষ হওয়ার কারন কি ? কারণ, এর আগেই লক্ষ লক্ষ হিন্দু কৃষকদের মুসলমান না হওয়ার  অপরাধে হত্যা করা হয়েছে, ফলে চাষ আবাদ করবে কে? মুসমানদের এই দুর্ভিক্ষ স্পর্শ করেনি। কারন হিন্দু বাড়ী লুটপাট। এই আকালে অনাহারে এত লোক মারা যায় যে, মৃত দেহের স্তুপে রাস্তা ঘাটে চলাচল অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। এইভাবে এক অতি উর্বর শস্য শ্যামল দেশ শ্মশানে পরিণত হয়েছিল।
ইংরেজ পর্যটক পিটার মান্ডি নিজের চোখে এই বীভস্য দৃশ্য দেখেছিলেন। তার রচনায়ও অনুরূপ বিবরণ পাওয়া যায়। হতভাগ্যরা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে পিটার মান্ডি একটি তাবু খাটাবার মত স্থানও পান নাই। একাধিক ইউরোপীয় পর্যটক ও ঐতিহাসিক শাহজাহানকে অত্যাচারী নিষ্টুর, বিলাসপ্রিয় ও ব্যভিচারী বলে চিহ্নিত করেছেন। টমাস রো, চেরী বার্নিয়ে, ডিলিয়ে, প্রভৃতি ইউরোপীয় পর্যটক ও যাজকদের বর্ণনার উপর ভিত্তিকরে ড. স্মিতও অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। শাহজাহান খ্ৃষ্টান, হিন্দু, ও পর্তুগিজদের উপর নির্যাতন করতেন এবং হিন্দু মন্দির ধ্বংস ও নতুন মন্দির নির্মানে বাধা দিতেন। তিনি হিন্দুদের উপর তীর্থকর পুনরায় প্রবর্তন করেছিলেন।


Posted at November 15, 2017 |  by Arya ঋষি

Tags

Text Widget

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipisicing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation test link ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat.

Blog Archive

© 2013 Arya Rishi. WP Theme-junkie converted by Bloggertheme9Published..Blogger Templates
Blogger templates. Proudly Powered by Blogger.
back to top