এক বিষ বৃক্ষের সূচনা -অন্তিম পর্ব
মুখবন্ধ বা নিজের কিছু কথা : এই লেখার শেষ পর্বে দাঁড়িয়ে কোনো একটি পর্বে এক পাঠকের কথা মনে পড়ছে। তিনি সৌদি সংস্কার বা ধর্মীয় মৌলবাদের রাস্তা ত্যাগ করে অন্য পথে যেতে পারে তা নস্যাৎ করেছিলেন কোনো যুক্তি না দিয়েই। আংশিক বিরক্ত হলেও পরবর্তীতে বিষয়টি ভাবলাম , দেখলাম ,এই ধরণের নীতি নির্ধারকরা নানান দেশে অতীব সফল হয় এই কারণেই। আমরা মূল উদ্দেশ্য দেখি না তাই অতীব সহজে একটা বিভাজন নিয়ে এসে আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভাঙা অতি সহজ হয়। কোনো রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধর্মের ধ্বজা ধরে নিজেদের স্বার্থ পূরণের জন্য যা আমরা ভুলে যাই। একই ভাবে ধর্মের বিরুদ্ধে সরব নানান স্বঘোষিত পক্ষ আবার এর উল্টো স্রোতের সুযোগ নেয় সেই একই কারণে। নীরবে কাজ করে মানুষের একমুখী অগ্রগতি।আমরা অনেকেই জানি না যে ওই সময়ে মানে এই ঘটনার আগে পর্যন্ত ওই দেশে বাকি আর পাঁচটা মধ্য প্রাচ্যের তুলনামূলক সংস্কার পন্থী দেশের মতো ওই সময় মেয়েরা গাড়ি চালাতেন বা সিনেমা হল ইত্যাদি চালু ছিল।এই ঘটনার পরেই সব শেষ হয়ে যায়।যাইহোক,ইতিহাস স্বাক্ষী,কিছু সময়ের জন্য মানুষ পথভ্রষ্ট হয়েছে তবে সামগ্রিক মানব উত্তরণ আটকে দেওয়া কারোর সাধ্যে নেই।নিজের কথা রাখি,আসুন দেখি বিষবৃক্ষের রোপন এবং কালের নিয়মে এর অপসারণ কি ভাবে হচ্ছে।
বিষবৃক্ষের রোপন এবং তাঁর বৃদ্ধি:
সৌদি রাজতন্ত্রর কাছে গদি বড় দায় তাই কোনো ঝুকি না নিয়ে একদম মোল্লাতন্ত্র চালুর পথে যেতে পুরো একটা উল্টো দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এরা।পাশের ইরানের মোল্লাতন্ত্র সৌদি রাজাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল,ইসলামের মূল ধারকের গদি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয় এবং নিজেদের টিকে থাকার একটা কারণ একেবারে ঘড়ির কাটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার মানসিকতা তৈরী করলো।শুধু নিজের দেশেই না,গোটা পৃথিবীতেই এই গোড়া মানসিকতা এবং নিজেদের মতে চলার মতো করে একটি ভাবনা বা আজকের পরিচিত ওয়াহাবী মতের প্রসার শুরু করলো পেট্রো ডলার এর অনুদান দিয়ে।এক কথায়, নিজেদের মনমতো ইসলামের রপ্তানি একটি মূল লক্ষ্য হয়ে উঠলো।
শুনলে অবাক হবেন এই জুহাইমান এবং এদের দলের নানান দাবি মেনে নেওয়া হয়।এর মধ্যে ফুটবল খেলা ,টিভিতে বিনোদনের নানান অনুষ্ঠান বা মেয়েদের দেখানো ইত্যাদি যা কিছু নিয়ে প্রশ্ন করেছিল সব বন্ধ হয়ে গেলো।পশ্চিমের সভ্যতার পথে চলা সৌদি আরব মধ্যযুগের মোল্লাতন্ত্রের পথে চলা শুরু করলো। ইতিহাসের কি পরিহাস, একই ঘটনা শুরু হয়ে গিয়েছিল কয়েক মাস আগে এদের প্রবল বৈরী শিয়া পথের ইরানেও।একই সঙ্গে মেয়েদের চাকরিতে নিষেধাজ্ঞা,এমনকি মেয়েদের ছবি পত্রিকা ইত্যাদিতে ছাপানো সবই নিষিদ্ধ হয়ে গেলো।
যে জেদ্দা শহরে মেয়েরা স্বচ্ছন্দে সিনেমায় যেতে পারতো তা নিষিদ্ধ হলো। বিশেষ বস্তার বোরখা সার্বিক হলো।আজকে অবাক লাগতে পারে , ওই সময়ে সৌদি টিভি তে বা রেডিওতে পুরুষ এবং নারী উভয়েই অংশ গ্রহণ করতো।এরপরে ? সব বন্ধ হয়ে গেলো।শুধু দেশের না , আশেপাশের বিখ্যাত গায়ক গায়িকা যেমন লেবাননের ফাইরুজ বা সামিরা আগে প্রায় নিয়মিত মুখ ছিল ওই দেশের টিভিতে।যে দেশ সংগীতপ্রেমী ছিল তাঁদের জন্য এরপরের দশকগুলো কেবল অন্ধকার ছেয়ে গিয়েছিল।
এতেই শেষ না , এসে গেলো ধর্মীয় এক ষাঁড়ের দল মানে নীতি পুলিশ।নাগরিকের জীবনের সর্বত্র এদের হস্তক্ষেপ শুরু হয়ে গেলো।এই অন্ধকারের দিনের জন্য দায়ী সৌদি রাজ্ পরিবার আর তাদের গোষ্ঠী।সোজা কথায়, অপরিণত এই অশিক্ষিত মৌলবাদী শ্রেণীকে তোষণ এবং এদের নিজেদের শিবিরে নিয়ে আসতে পুরো ভোল পাল্টে ফেলার কাজ করেছিল সৌদি রাজতন্ত্র।
প্রিন্স তুর্কির ভাষায়, তাঁরা ইসলাম যে একটি রাজনৈতিক দর্শন ওটা উপলব্ধি করে এর ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র সাজিয়ে ফেলেছিল যাতে আর এই ধরণের কোনো প্রতিষ্ঠান বিরোধী কাজ না হয়। ঈমাম এবং বশংবদ উলেমাদের সামনে রেখে একটি আবরণ তৈরী করলেই যে রাজত্ব অনেক সহজ হয় ওই উপলব্ধি হয়েছিল তা পরিষ্কার।আধুনিক চিন্তার বদলে এই ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার দোকান খুলে বরং এই ভাবধারা আরো প্রসার করা হয়ে উঠলো মুখ্য লক্ষ্য। রপ্তানি করা শুরু করলো নিজেদের ওয়াহাবি তত্বের পথ যতদিন না বুঝতে পারলো বোতলের দৈত্য ভয়ংকর হয়ে উঠছে।
বোধদয়ের পালা:
আইসিস এবং আল কায়দার উত্থান এদের আবার ভাবতে বাধ্য করেছে যে এই ভাবে কিছু হবে না। একই সাথে তেলের বিকল্প নিয়ে গোটা পৃথিবী রাস্তা খুঁজে বের করছে।সোজা কথায় এই ২০৩০ এর সময়ের কিছু আগে বা পরে এই তেলের মুফতে খাওয়ার দিন শেষ হতে চলেছে।তাই এরপরে ওই গোড়া মনঃবৃত্তি নিয়ে চললে দেশের আয়ের তিন ভাগের এক ভাগের রোজগার যা আসে এই হ্বজ বা ওমরা থেকে তাতে ভাটা আসতে পারে।
মহম্মদ বিন সালমান মানে আজকের মূল ক্ষমতার অধিকারীর কথা এক অর্থে আশার বাণী মনে হয় ,তিনি আগামী তিরিশ বছরের এই ধ্বংসের যন্ত্রনা না বহন করে এখনই এই ভাবনা চিন্তা গুলো শেষ করতে চাইছেন।অন্ততঃ রিয়াদে তিন বছর আগের একটি বিনিয়োগ সম্মেলনে তাই বলেছেন।একই ভাবে পরের বছর সেই কালান্তক সময়ের থেকে দেশে যে অসহ এক লৌহ বর্মের অবস্থান আর মধ্যযুগের আইন চলছে তার অবসান ও চেয়েছেন তিনি।বাস্তবিক দিক থেকে খুব ভুল বলেন নি।ষাটের বা সত্তরের দশকের সৌদি আরব কিন্তু এক ভিন্ন পরিবেশ বহন করে চলতো। এই বিষয়ে বিবিধ সূত্র ধরে যা দেখছি তাতে এই ধর্মান্ধের কারবার যে কি পরিমান ক্ষতি করেছে তার প্রাসঙ্গিক কিছু ছবি দেখলেই বুঝতে পারবেন ,সঙ্গে দিয়ে দিলাম।
অনেক গুলো কাজ ইতিমধ্যেই করেও ফেলেছেন।যা সংস্কার হয়েছে এই পর্যন্ত,তার প্রধান কিছু নিচে দিলাম:
১.একদম শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত স্বাধীন মত প্রকাশ করা ব্লগার বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে শাস্তির বিশেষতঃ অতীব গুরুতর অপরাধ ছাড়া প্রকাশ্যে বেত্রাঘাতের ফরমান তুলে নেওয়া হয়েছে।
২.সৌদি মহিলাদের কাজের পরিধিতে আগে শতকরা ২২ ভাগ অংশগ্রহণের ধার্যকৃত অংশের বৃদ্ধি করে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে অর্থাৎ মহিলাদের স্বনির্ভর হওয়ার পথে চলছে দেশটি।
৩.সবচেয়ে আলোচতি যে বিষয়টি আমরা সবাই জেনেছি তা হলো মেয়েদের এই অভিশপ্ত সময়ের আগে রাস্তায় গাড়ি চালানোর যে স্বাধীনতা ছিল তা আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে ২০১৮ তে।
৪.আগের মতো চাকরি করতে যাওয়ার সময়ে কোনো মহিলাকে তার তথাকথিত পুরুষ অভিভাবকের থেকে অনুমতি নিতে হতো।কোনো ক্ষেত্রে তার স্বামী,কখনো বাবা বা ভাই ইত্যাদি।এই বিষয়টি রদ করা হয়েছে ,আর এর দরকার হবে না।একই ভাবে কোনো উচ্চশিক্ষার জন্য এমনকি কোনো শল্য চিকিৎসার ক্ষেত্রেও একেই কুৎসিত এই আইনের রদ হয়েছে।আজ এই সব ক্ষেত্রে মেয়েরা একক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
৫. পরিবর্তিত আইনে এখন মেয়েরা সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করা , বিয়ে/ বিবাহ বিচ্ছিন্নতা সংক্রান্ত নিবন্ধন করা এমনকি কোনো নাবালক /নাবালিকার অভিভাবিকা হতে পারবেন।আগে এর একটিও অধিকার তাঁদের ছিল না।
৬. আগের কালা কানুন বিদেশ গমন বা পাসপোর্ট তৈরির আগে পুরুষ অভিভাবকের অনুমতির আইন ও বাতিল হয়েছে।
৭. সিনেমা বা আগের সেই সংগীত ইত্যাদির কনসার্ট আবার চালু হয়েছে।একই সাথে দোকান বা ব্যবসার অনেক ক্ষেত্র এখন ২৪ঘন্টা খুলে রাখার অনুমতি ও দেওয়া হয়েছে আর পাঁচটি আধুনিক সমাজের মতো।
৮. ফৌজে মেয়েদের যোগ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং ফুটবল ইত্যাদি খেলার পুনরায় প্রচলন আর মাঠে দর্শক হিসেবে মেয়েদের প্রবেশের অনুমতি ও দেওয়া হয়েছে।
৯. নীতি পুলিশ নামের কুৎসিত এক চাপিয়ে দেওয়ার বাহিনী কে প্রত্যাহার করা হয়েছে।এরা মানুষের জীবন অতিষ্ট করে তুলছিল এই কয়েক দশক ধরে।
১০. স্রেফ ধর্মীয় দু একটি জায়গা বাদে দেশের অন্য সর্বত্র অমুসলিম এবং বিদেশী পর্যটকের জন্য অবাধ প্রবেশের ব্যবস্থা হয়েছে।
১১. শিক্ষা ব্যবস্থা কে আধুনিক করে সৌদি নতুন প্রজন্ম কে মূল ধারার বাকি পৃথিবীর সাথে সংযুক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে।
আজকে বিদেশী মেয়েরা সৌদির রাস্তায় বোরখা ইত্যাদি ছাড়াই ঘুরে বেড়াতে পারে এবং একই সুযোগ নিচ্ছে সৌদি মেয়েরাও,অন্তত যারা একটু সাহসী।প্রসঙ্গত এই নানান কাজ গুলো আগে পর্দার আড়ালে হতো যা আজ বৈধতা প্রাপ্ত হয়েছে।রেস্তেরা বা অন্য সামাজিক জায়গায় নারী পুরুষের এক সাথে থাকা বা এই মুক্ত হওয়ার কারণে অবশ্যই প্রবীন বা ধর্মীয় ভাবধারায় চলা এক দল লোকের মাথা ব্যথার কারণ হয়েছে।ভয় একটাই,এদের নিয়ন্ত্রন যেন গুরুত্ব সহকারে করা হয়।এর কারণ,যে কোনো পরিবর্তন কেই প্রতিরোধ করা মানুষের একটি স্বাভাবিক ধর্ম বিশেষত মনন যদি একটি ধাঁচে আগেই তৈরী হয়ে যায়।একটু ধীরে ধীরে সংস্কার গুলো করে যাওয়া আর তাকে আরো কিছু দশক বহাল রাখার কাজ হলেই আবার দেশটি আধুনিক পথে চালিত হবে।
এই চমক লাগানো সংস্কারের জন্য আলোচ্য মোহাম্মদ বিন সালমান এর মূল শক্তির একটি জায়গা হলো বর্তমান সৌদি আরবের জনসংখ্যার প্রায় ৬৭ শতাংশ ৩৪ বছরের কম বয়েসী বলে। এক অর্থে রাজতন্ত্রের এই শাসকের এই ক্ষেত্রে অন্ততঃ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন আছে ভাবতে পারেন।
না,আমি মোটেই বলছি না যে এই লোকটি একটি সজ্জন।তবু , যদি বড় অংশের সংস্কার হয় আর তাতে যদি পৃথিবীর চেহারা একটু অন্য হয় তবে ক্ষতি কি ? মূল বইটির লেখক এবং বাকি আরো অনেকেই যা বলেছে তার প্রতিধ্বনি করে বলা যায় জুহাইমান ওই লড়াইয়ে হেরে গেলেও বৃহৎ রণাঙ্গনে কিন্তু জিতেছিল।আজ সঙ্গত কারণে,দুর্জন হলেও সলমান স্বাগত তার এই কাজগুলোর জন্য অন্তত আমার কাছে।
আশার আরো কথা আছে , রাহা মোহার্রাক বলে এক প্রথম সৌদি মহিলা পর্বতারোহী উঠেছেন মাউন্ট এভারেস্ট এ ২০১৩ তে আরো অনেক চূড়াতে উঠবে এই আরব নারীকুল।আমরা সবাই তা দেখবো , কোনো অলীক কল্পনা না ,এটি আমার যুক্তিভিত্তিক চিন্তা।
শেষ করছি,আবার অশেষ রবীন্দ্রনাথ কে স্মরন করে,তিনি এক দল স্বঘোষিত আলোকপ্রাপ্ত মানুষের অস্বস্থি বাড়িয়ে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন সেই সময়ের তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’ নিবন্ধে,একটু ওই জায়গাটি তুলে ধরার সাধ হলো,তিনি বলেছিলেন “এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই তা বলি নে; গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে--কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না--সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিম্বা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।“ –অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছিল,সেই সময়ের সেভিয়েত ইউনিয়নে,একই ফলাফল হবে অন্য দেশেও যদি বাকি রাষ্ট্রনায়করা তা না বুঝতে পারে।অমিত শক্তির মানুষ ছাঁচে ফেলার প্রাণী না।
0 Comments: