All Stories

তিহাসে এমন প্রমাণ ও লিখিত দলিল রয়েছে যার ভিত্তিতে এটি প্রমাণ করা যায় যে কুতুব মিনার সনাতন ইমারত, বিষ্ণু স্তম্ভ বা ধ্রুব স্তম্ভ।
এম এস ভাটনগর এই স্তম্ভের মূল উৎস, নাম এবং সামগ্রিক ইতিহাস সম্পর্কে দুটি নিবন্ধ লিখেছেন। এতে, প্রচলিত সমস্ত তথ্যগুলি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে, যা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে বা সাধারণত এটি সম্পর্কে কথিত হয়ে থাকে।
আরবীতে ‘কুতুব’ শব্দের অর্থ ‘অক্ষ’ বা ‘কেন্দ্রবিন্দু’। ‘কুতুব’ শব্দ আরবীতে মহাকাশ সংক্রান্ত গণনাতে বা জ্যোতির্বিজ্ঞানে ব্যবহার করা হতো। সুতরাং, কুতুব মিনার যে জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত স্তম্ভ বা মিনার সেটা বলা যেতেই পারে। সুলতান যুগে এ নামটি উল্লিখিত হয়। পরে একই নামে আদালতের নথিপত্রেও এর উল্লেখ দেখা যায়। পরবর্তীকালে, এর নাম সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবকের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় এবং মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে এটি কুতুবউদ্দিন আইবক দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।
প্রোফেসর এমএস ভাটনগর, গাজিয়াবাদ এই অনন্য ইমারতের ঐতিহাসিক সত্যতা সম্পর্কে আলোকপাত করেন এবং দিল্লির মুঘল রাজা এবং কিছু প্রত্নতাত্ত্বিকদের সমস্ত বিভ্রান্তিমূলক তথ্য, বিপরীত ব্যাখ্যা এবং ভুল তথ্যের পর্দাফাঁস করেন।
প্রথমেই দেখা যাক এই এই ‘মিনার’ তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রচলিত ইতিহাস কি বলছে? উত্তর হলো এটি একটি বিজয় স্তম্ভ। কাকে হারিয়ে কে জিতলেন? মোহাম্মদ ঘোরি রাই পিথোরা (পৃথ্বীরাজ) -কে পরাজিত করেছিলেন। যুদ্ধের ময়দান কোথায় ছিল? পানিপথের কাছে তরাইনে। তাহলে এই বিজয় স্তম্ভটি কেন দিল্লিতে তৈরি হয়েছিল? এর উত্তর প্রচলিত ইতিহাস আপনাকে দেবে এই বলে, ঘোরি বিজয় স্তম্ভ দিল্লিতে বানানো শুরু করেন কারণ দিল্লি নাকি তাঁর রাজধানী ছিল। তবে যারা ইতিহাস সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন তাঁরা জানেন ঘোরি কখনই দিল্লিকে তাঁর রাজধানী বানাননি! কারণ ইতিহাস সাক্ষী তিনি ফিরে গিয়েছিলেন নিজের দেশে। তাঁর রাজধানী ছিল গজনী। তাহলে এতো বড় বিজয়ের উদযাপন করতে স্তম্ভ দিল্লিতে তৈরির কী কারণ ছিল?
প্রচলিত_ইতিহাস_সম্পর্কে_যা_জানি_আমরা:--
প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক এই মিনার তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রচলিত ইতিহাস কি বলছে।
উত্তর হল এটি একটি বিজয়স্তম্ভ
●১) তাহলে কাকে হারিয়ে কে জিতে ছিলেন ?
মোহাম্মদ ঘোরি রাই ,শ্রীমান পৃথ্বীরাজ চৌহান কে পরাজিত করেছিলেন।
●২) যুদ্ধের ময়দান কোথায় ছিল ??
পানিপথের কাছে তরাইন। এটা আমরা সকলেই জানি ।
●৩) তাহলে এই বিজয় স্তম্ভ দিল্লিতে তৈরি হয়েছিল কিভাবে ??
মোহাম্মদ ঘোরি , বিজয় স্তম্ভ দিল্লিতে বানানো শুরু করেন কারণ দিল্লি নাকি তার রাজধানী ছিল। তবে এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি যারা ইতিহাস সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন তারা জানেন মোহাম্মদ ঘোরি কখনোই দিল্লিকে তার রাজধানী বানাননি ,কারণ ইতিহাস সাক্ষী তিনি ফিরে গিয়েছিলেন নিজের দেশে আর তার রাজধানী ছিল গজনী।
●৪) তাহলে এত বড় বিজয় উদযাপন করতে স্তম্ভ দিল্লিতে তৈরীর কারণ কি?
বিজয়স্তম্ভ যদি মোহাম্মদ ঘোরি শুরু করেন তবে এর নামকরণ তো হওয়া উচিত ছিল ঘোরি_মিনার, কুতুবমিনার নয় ।
●৫)তবে কেন একে কুতুবমিনার বলা হবে ??
প্রামাণ্য ইতিহাস রচয়িতা দের বক্তব্য কুতুবউদ্দিন আইবক নাকি এই বিজয় স্তম্ভ নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন এবং তিনি যেহেতু মোহাম্মদ ঘোরির দাসানুদাস ছিলেন তাই তার মালিকের নামে নামকরণ করেছিলেন বিজয়স্তম্ভে।
●৬) যদি এই যুক্তি সঠিক হয় তবে তিনি কেন বিজয়স্তম্ভে জন্য দিল্লি কে বেছে নিয়েছিলেন ?
এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক এর একটা খুব সোজা উত্তর আছে কুতুবউদ্দিন আইবক এর রাজধানী ছিল দিল্লিতে।
●৭) এখন প্রশ্ন হলো ঘোরির জীবদ্দশায় যদি এই মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হয় অর্থাৎ তখন তিনি তো জীবিত ছিলেন তাহলে তার দাসানুদাসের সাহস কিভাবে হয় যে মালিকের রাজধানী গজনী থেকে দিল্লিতে পরিবর্তন করার?
লক্ষণীয় বিষয় হলো মোহাম্মদ ঘোরি মারা যাওয়ার পরে কুতুবউদ্দিন আইবককে লাহোরের_সুলতান নির্বাচিত করা হয়। তিনি দিল্লীতে বসে রাজকার্য চালাতেন না কখনো।
এবং তিনি লাহোর থেকেই শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতেন আর শেষ পর্যন্ত তিনি মারা যান লাহোরেই।
লাহোর তার রাজধানীর হবার সত্বেও কেন তিনি দিল্লীতে বিজয় স্তম্ভ তৈরি করেছিলেন অনেকের মতে মিনারটি আসলে কোন বিজয় স্তম্ভ নয় বরং একটি মজিনা।
একটি মসজিদের মুয়াজ্জিন আজান দেওয়ার জন্য মিনার থাকে এবং এই স্তম্ভ নাকি কুয়াত-উল-ইসলাম মসজিদের মজীনা।
তবে ভারতের সমসাময়িক ইতিহাসে কুয়াত-উল-ইসলাম মসজিদ বলে কোন মসজিদের উল্লেখ নেই।
উনিশ শতকে এই কুতুবমিনার টার্মটি প্রথম কায়েম করেন স্যার সৈয়দ আহমেদ খান।
এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে ভারতীয় ইতিহাসে কুতুবমিনার এর মত কোন শব্দই তখনও অব্দি ছিলনা। সাম্প্রতিক সময়ে একটি অনুমানমূলক যুক্তি যে এই মিনারটি মুয়াজ্জিনের মিনার যদি তাই হয় তবে মসজিদের প্রাথমিক গুরুত্ব রয়েছে এবং মিনারের গুরুত্ব তত নয়।
দুর্ভাগ্যজনক যে এর নিকটবর্তী মসজিদ বর্তমানে ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে তবে তারপরে মুয়াজ্জিনের মিনার কিভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এ প্রশ্নের কোন উত্তর নেই বাস্তব বিষয় হলো মসজিদ এবং মজিনা একটি সম্পূর্ণ মন ভরা গল্প।
তথাকথিত কুতুবমিনার এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত জামে মসজিদ এবং মিনার নির্মাণকারী সমসাময়িক ব্যক্তি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ।
কুতুবমিনার অনেক পুরনো একটি স্তম্ভ ।
●৮) তাহলে কুরআনের আয়াত কেন এর গায়ে খোদাই করা আছে ??
ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন মিনারের গায়ের খোদাই করা কুরআনের আয়াত গুলি হল হিন্দু নকশার সুন্দর চিত্রের উপরে জোর করে লেখা প্রাণহীন কয়েকটি ছত্র ।
অন্যান্য মসজিদের কুরআনের আয়াত এরকম নকশার ওপরে কখনোই খোদাই করা থাকে না।
●●জেনে_নিন_আসল_সত্যি:--
এখন প্রশ্ন হল এই মিনারটি আসলে কি।
◆১) হ্যাঁ এটি হলো ধ্রুবস্তম্ভ বা প্রাচীন হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণের অন্যতম প্রধান পর্যবেক্ষণ স্তম্ভ।
হক_আই_ভিউ থেকে দেখলে এই স্তম্ভে চব্বিশটি (২৪) পাপড়ির পদ্মফুল দেখা যায় এর প্রত্যেকটি পাপড়ি আসলে দিনের ২৪ ঘন্টা পরিমাপের মাপকাঠি চিহ্ন।
২৪ টি পাপড়ি সহ পদ্ম ফুলের আকৃতির স্তম্ভ সম্পূর্ণরূপে একটি সনাতন ধারণা ।
এটি পশ্চিম এশিয়ার শুষ্ক অংশের দর্শনের ধারক চিহ্ন নয়, কারণ পদ্মফুল পৃথিবীর ওই অংশে জন্মায় না ।
যা তারা কখনো দেখেননি ,এ দেশে পদার্পণ করা মাত্রই সেই আকৃতির মিনার বানিয়ে ফেলবেন কল্পনা করাও কষ্টকর।
◆২) এই স্তম্ভের উলম্ব প্রজেকশন রেখাগুলি প্রতিটি তলের উপর দিয়ে সূক্ষ্ম কারিগরের মধ্য দিয়ে গিয়ে শীর্ষে যে এক সমান মাপের পাপড়িওয়ালা পদ্ম ফুল তৈরি করে তা খুবই সূক্ষ্ম কারিগরির পরিনাম ।
পদ্ম আকৃতির ধ্রুবস্তম্ভ যে অতীতের কোনো সাধারণ স্থপতি বানিয়েছে এটা ভাবতে গেলে অনেক সন্দেহের অবকাশ আছে।
◆৩) ধ্রুব স্তম্ভ কে মোহাম্মদ ঘোরি বা কুতুবউদ্দিন আইবক এর সৃষ্টি বলে চিন্তা করা যায় না ।
সুলতানরা হয়তো যার নাম স্তম্ভ তৈরিতে যুক্ত তার শিলালেখ ধ্বংস করে দেন ।
পাথর গুলিতে মানুষ বা প্রাণী গুলির আকার খোদিত ছিল তার উপরেই আরবিতে লিপি খোদিত যে হয়নি তারও কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই ।
প্রকৃতপক্ষে মিনার তৈরিতে সুলতানদের কোন হাত ছিল না কারণ এটি শুরু করার সময়কার কোন শিলালিপি বা কোনরকম চিহ্ন কিন্তু পাওয়া যায়নি।
কুতুব মিনার সম্পর্কে অনেক প্রমান রয়েছে যে এটি কুতুবুদ্দিনের ভারত ভূখণ্ড পদার্পণের বহু বছর আগেই ছিল ।
কুতুব মিনারের কাছের বসতির নাম মেহরৌলি
এটি মিহির_আবেলি নামে একটি সংস্কৃত শব্দ।
এই শহর সম্পর্কে কথিত আছে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির ( যিনি বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন এর মধ্যে একজন অন্যতম রত্ন )এখানে থাকতেন । তাঁর সঙ্গে এই অঞ্চলে বাস করতেন তার সহকারি গণিতবিদ ও প্রযুক্তিবিদরাও ।
তারা এই তথাকথিত কুতুবমিনার কে জ্যোতির্বিদ্যার গণনা অধ্যায়নের জন্য ব্যবহার করতেন।
এই স্তম্ভের চারিপাশে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান গণনা করার রাশিচক্রে উৎসর্গীকৃত সাতাশটি (২৭) নক্ষত্রের জন্য মণ্ডপ বা গম্বুজযুক্ত ভবন ছিল। কুতুবুদ্দিনের সমসাময়িক ঐতিহাসিক বর্ণনাতে আছে তিনি এই সমস্ত মণ্ডপগুলি বা গম্বুজযুক্ত ভবনগুলি ধ্বংস করে দিয়েছেন, তবে কোথাও এটা লেখা ছিল না তিনি একটি মিনার তৈরি করেন ।
তথাকথিত কুতুব মিনার থেকে উত্তোলিত পাথরের এক পাশে ছিল হিন্দু মূর্তি অন্যদিকে আরবি অক্ষর বর্তমান। এই পাথরগুলি বর্তমানে মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে।
এটি প্রমাণ করে যে আক্রমণকারীরা মন্দিরের দেওয়ালের মূর্তি ইত্যাদি নষ্ট করত এবং আরবিতে লিখিত সামনের অংশটি তৈরি করার জন্য প্রতিমার মুখের বা সম্মুখের অংশের পরিবর্তন করতো। অনেকগুলি কমপ্লেক্সের স্তম্ভ এবং দেওয়ালে সংস্কৃত বিবরণ কিন্তু এখনো আপনি কুতুব মিনারের গেলেই চোখে পড়বে।
কার্নিশে অনেক মূর্তি দেখা যায়, তবে নাক চোখ এবং সূক্ষ্ম কারুকার্য্য গুলি ভেঙে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
এটা চিন্তা করা কঠিন যে পূর্ববর্তী হিন্দু ভবন গুলির চারপাশে যথেষ্ট জায়গা ছিল এবং কুতুবউদ্দিন এসে সেখানে একটি মিনার তৈরি করেছিলেন স্তম্ভটির অলংকৃত শৈলীতে প্রমাণিত হয় যে এটি একটি সনাতন স্থাপত্য।
মুসলিম মিনার গুলির বহির্ভাগ সম্পূর্ণ সমতল হয়। যারা যুক্তি দিয়েছিলেন যে এই মিনারটি মুসলিমদের আজান দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো ,তাদের এই তথ্য এজন্যই ব্যর্থ যে এত উঁচুতে উঠে আজান দিলে মিনারের নিচে দাঁড়িয়ে কেউ শুনতে পাবে না, আর সে সময় তো মাইক আবিষ্কার হয়নি ।আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো টাওয়ারের প্রবেশপথটি অন্য ইসলামিক স্থাপত্য পশ্চিমে নয় উত্তর দিকে ।
যখন ইসলামী ধর্ম তত্ত্ব এবং ঐতিহ্য মোতাবেক পশ্চিম দিকে গুরুত্ব রয়েছে।
প্রবেশপথের এক পাশে একটি পাথরের পদ্মফুল রয়েছে। মধ্যযুগীয় ইমারত গুলিতে পাথরের পদ্ম ফুল তৈরি করা একটি সনাতন ঐতিহ্য, আরবী রীতিতে কখনও ভবন নির্মাণের সময় এই জাতীয় ফুল তৈরি করা হতো না ।
মিনারের গায়ে খোদিত নমুনা গুলিতে বহু ভেজাল রয়েছে, পদ্ম কুঁড়ির মত সনাতন মোটিফের মাঝে আরবি মোটিফ ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ২৪ সংখ্যাটি বৈদিক ঐতিহ্যে পবিত্র হিসেবে বিবেচিত হয় কারণ এটি ৮ এর গুণফল।
লৌহ_স্তম্ভ / গরুর_ধ্বজ:--
নিকটে অবস্থিত কখনো মরিচা না পড়া লোহার স্তম্ভের উপরে, সংস্কৃত ভাষায় ব্রাহ্মীলিপিতে খোদিত আছে বিষ্ণুর স্তম্ভটি বিষ্ণুপদ নামে একটি পাহাড়ের নির্মিত হয়েছিল।
এই বর্ণনা থেকে এটি পরিষ্কার যে মিনারটির মাঝখানে অবস্থিত মন্দিরে শুয়ে থাকা বিষ্ণুর মূর্তিটি মোহাম্মদ ঘোরি এবং তার দাসানুদাস কুতুবউদ্দিন আইবক ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।
মিনারটিতে সাতটি তলা ছিল যা এক সপ্তাহের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এখন টাওয়ার থেকে কেবল পাঁচটি তল রয়েছে ।
ষষ্ঠ তলা থেকে উপরের অংশ মাটিতে ফেলে দেওয়া হয় এবং সংলগ্ন মাটিতে পুনরায় স্থাপন করা হয়।
লোহার স্তম্ভটিকে গরুর ধ্বজা গরুর স্তম্ভ বলা হত। এটি যে কোনো বিষ্ণু মন্দিরের প্রধান স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হতো।
এটি একদিকে ২৭ নক্ষত্রের মন্দিরগুলির ডিম্বাকৃতি চারপাশের অংশ ছিল ।
লাল পাথরের একটি বিশাল অলংকৃত দরজা নক্ষত্রমন্ডল নামে পরিচিত ছিল সুতরাং ঐতিহ্যগতভাবেই প্রধান ফটকটি আলয় দ্বার হিসাবে পরিচিত ছিল।
কানিংহামের মত ঐতিহাসিকরা সুলতান আলাউদ্দিন এর সঙ্গে এই দরজার নাম জুড়ে দেন যদিও আলাউদ্দিন স্বয়ং এরকম কোনো দাবি করেননি।
প্রশ্ন হল আলাউদ্দিনের সময় কালে এই স্থানটি পুরোপুরি ধ্বংস স্তুপে রূপান্তরিত হয়েছিল এমন পরিস্থিতিতে আলাউদ্দিনকে কেন এমন কোন জায়গার অলংকৃত দরজা তৈরি করবেন ?এটিকে মুয়াজ্জিনের মিনার বলাও একটি নির্জলা মিথ্যা কথা ।
কোনও মোয়াজ্জিন এমনকি একদিনের জন্যেও কি ৩৬৫ টি সংকীর্ণ এবং অন্ধকার সিঁড়ি ওঠার সাহস পাবে !!
স্তম্ভের পরিধি যথাযথভাবে ২৪ মোড়ের সমন্বয়ে গঠিত এবং এর মধ্যে বৃত্তের আকার এবং ত্রিভুজের আকার পর্যায়ক্রমে আসে।
এতে আলো আসার জন্য সাতাশটি গর্ত রয়েছে। এই সাতাশটি যদি সাতাশটি নক্ষত্রমন্ডল এর সঙ্গে যুক্ত বলে বিবেচনা করা হয় তবে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে স্তম্ভটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য পর্যবেক্ষণ স্তম্ভ ছিল।
তথাকথিত কুতুব মিনার এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত জাম-এ-মসজিদ এবং মিনার নির্মাণকারী সমসাময়িক ব্যক্তি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কুতুব মিনার অনেক পুরনো একটি স্তম্ভ। তাহলে কুরআনের আয়াত কেন এর গায়ে খোদাই করা আছে, এ প্রশ্ন ওটা স্বাভাবিক।
ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, মিনারের গায়ে খোদাই করা কুরআনের আয়াতগুলি হ’ ল হিন্দু নকশার সুন্দর চিত্রবল্লরীর নকশার উপরে জোর করে লেখা প্রাণহীন কয়েকটি ছত্র। অন্যান্য মসজিদে কুর আনের আয়াত এরকম নকশার উপর খোদাই করা থাকে না।
এখন প্রশ্ন হলো তাহলে এই মিনারটি আসলে কি? এটি হলো ধ্রুব স্তম্ভ বা প্রাচীন হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণের অন্যতম প্রধান পর্যবেক্ষণ স্তম্ভ। ‘হক আই ভিউ’ থেকে দেখলে এই স্তম্ভে ২৪ পাপড়ির পদ্ম ফুল দেখা যায়। এর প্রত্যেক পাপড়ি আসলে দিনের ২৪ ঘন্টা পরিমাপের মাপকাঠি চিহ্ন। চব্বিশটি পাপড়ি সহ পদ্ম ফুলের আকৃতির স্তম্ভ সম্পূর্ণরূপে একটি সনাতন ধারণা। এটি পশ্চিম এশিয়ার শুষ্ক অংশের দর্শনের ধারক চিহ্ন নয়। কারণ পদ্মফুল পৃথিবীর ঐ অংশে জন্মায় না! যা তাঁরা কখনো দেখেননি, এদেশে পদার্পণ মাত্রই সেই আকৃতির মিনার বানিয়ে ফেলবেন এ তো কল্পনা করাও কষ্টকর।

এই স্তম্ভের উল্লম্ব প্রজেকশন রেখাগুলি, প্রতিটি তলের উপর দিয়ে সূক্ষ্ম কারিগরীর মধ্যে দিয়ে গিয়ে শীর্ষে যে এক সমান মাপের পাপড়িওয়ালা পদ্ম ফুল তৈরি করে, তা খুবই সূক্ষ্ম কারিগরির পরিণাম। পদ্ম আকৃতির ধ্রুব স্তম্ভ যে অতীতের কোনও সাধারণ স্থপতি বানিয়েছে, এটা ভাবতে গেলে অনেক সন্দেহের অবকাশ আছে। ধ্রুব স্তম্ভকে মোহাম্মদ ঘোরি বা কুতুবুদ্দিন আইবকের সৃষ্টি বলে চিন্তা করতে অনেক সন্দেহের কারণ আছে। সুলতানরা হয়তো যার নাম এই স্তম্ভ তৈরিতে যুক্ত তার শিলালেখ ধ্বংস করে দেন, পাথরগুলিতে মানুষ বা প্রাণীগুলির আকার খোদিত ছিলো, তার উপরই আরবিতে লিপি খোদিত যে হয় নি, তারও কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। প্রকৃতপক্ষে, মিনার তৈরিতে সুলতানদের কোনো হাত ছিলো? কারণ এটি শুরু করার সময়কার কোনো শিলালিপি বা কোনোরকম চিহ্ন কিন্তু পাওয়া যায় নি।
কুতুব মিনার সম্পর্কে অনেক প্রমাণ রয়েছে যে এটি কুতুবুদ্দিনের ভারত ভূখন্ডে পদার্পণের বহু বছর পূর্ব থেকেই ছিলো। কুতুব মিনারের কাছের বসতির নাম মেহরৌলি। এটি মিহির-আবেলি নামে একটি সংস্কৃত শব্দ। এই শহর সম্পর্কে কথিত আছে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ মিহির (যিনি বিক্রমাদিত্যের দরবারে নবরত্নের একজন) এখানে থাকতেন। তাঁর সঙ্গে এই অঞ্চলে বাস করতেন তাঁর সহকারী, গণিতবিদ ও প্রযুক্তিবিদরাও। তারা এই তথাকথিত কুতুব মিনারকে জ্যোতির্বিদ্যার গণনা, অধ্যয়নের জন্য ব্যবহার করতেন।
এই স্তম্ভের চারপাশে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান গণনা করার রাশিচক্রকে উৎসর্গীকৃত ২৭ টি নক্ষত্রের জন্য মন্ডপ বা গম্বুজযুক্ত ভবন ছিল। কুতুবুদ্দিনের সমসাময়িক ঐতিহাসিক বর্ণনাতে আছে তিনি এই সমস্ত মণ্ডপগুলি বা গম্বুজযুক্ত ভবনগুলি ধ্বংস করে দিয়েছেন, তবে কোথাও এটা লেখা ছিলো না তিনি একটি মিনার তৈরি করেন। তথাকথিত কুতুব মিনার থেকে উত্তোলিত পাথরের একপাশে ছিল হিন্দু মূর্তি, অন্যদিকে আরবি অক্ষর বর্তমান। এই পাথরগুলি বর্তমানে মিউজিয়ামে রক্ষিত
এটি প্রমাণ করে যে আক্রমণকারীরা মন্দিরের দেওয়ালের মূর্তি ইত্যাদি নষ্ট করতো এবং আরবীতে লিখিত সামনের অংশটি তৈরি করার জন্য প্রতিমার মুখের বা সম্মুখ অংশটির পরিবর্তন করতো। অনেকগুলি কমপ্লেক্সের স্তম্ভ এবং দেয়ালে সংস্কৃত বিবরণ এখনও পড়া যায়। কার্নিসে অনেক মূর্তি দেখা যায় তবে নাক চোখ ও সূক্ষ্ম কারুকাজ ভেঙে নষ্ট করা হয়েছে।
এটা চিন্তা করা কঠিন যে পূর্ববর্তী হিন্দু ভবনগুলির চারপাশে যথেষ্ট জায়গা ছিল এবং কুতুবুদ্দিন এসে সেখানে একটি মিনার তৈরি করেছিলেন। স্তম্ভটির অলঙ্কৃত শৈলীতে প্রমাণিত হয় যে এটি একটি সনাতন স্থাপত্য। মুসলিম মিনারগুলির বহির্ভাগ সম্পূর্ণ সমতল হয়। যারা যুক্তি দিয়েছিলেন যে এই মিনারটি মুসলিমদের আজানের জন্য ব্যবহৃত হতো, তাঁদের তত্ত্ব এজন্য ব্যর্থ যে এতো উঁচুতে উঠে আজান দিলে মিনারের নীচে দাঁড়িয়েই কেউ শুনতে পাবে না, সেসময় কিন্তু মাইকও আবিষ্কার হয় নি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ’ ল টাওয়ারের প্রবেশ পথটি অন্য ইসলামিক স্থাপত্যের মতো পশ্চিমে নয়, উত্তর দিকে, যখন ইসলামী ধর্মতত্ত্ব এবং ঐতিহ্য মোতাবেক পশ্চিম দিকের গুরুত্ব রয়েছে।

প্রবেশ পথের একপাশে একটি পাথরের পদ্ম ফুল রয়েছে। মধ্যযুগীয় ইমারতগুলিতে পাথরের ফুল তৈরি করা একটি সনাতন ঐতিহ্য। আরবী রীতিতে কখনও ভবন নির্মাণের সময় এ জাতীয় ফুল তৈরি করা হতো না। মিনারের গায়ে খোদিত নমুনাগুলিতে বহু ভেজাল রয়েছে, পদ্ম কুঁড়ির মতো সনাতন মোটিফের মাঝে আরবি মোটিফ ছড়িয়ে পড়েছে।

নিকটে অবস্থিত কখনো মরিচা না পড়া লোহার স্তম্ভের উপরে, সংস্কৃত ভাষায় ব্রাহ্মী লিপিতে খোদিত আছে বিষ্ণুর এই স্তম্ভটি বিষ্ণুপদ গিরি নামে একটি পাহাড়ে নির্মিত হয়েছিল। এই বর্ণনা থেকে এটি পরিষ্কার যে মিনারটির মাঝখানে অবস্থিত মন্দিরে শুয়ে থাকা বিষ্ণুর মূর্তিটি মোহাম্মদ ঘোরি এবং তাঁর দাস কুতুবউদ্দিন হয়তো ধ্বংস করেছিলেন।
মিনারটিতে সাতটি তলা ছিল যা এক সপ্তাহের প্রতিনিধিত্ব করে, তবে এখন টাওয়ারটিতে কেবল পাঁচটি তলা রয়েছে। ষষ্ঠ তলা থেকে উপরের অংশ মাটিতে ফেলে দেওয়া হয় এবং সংলগ্ন মাটিতে পুনরায় স্থাপন করা হয়েছিল।
লোহার স্তম্ভটিকে গরুড় ধ্বজ বা গরুড় স্তম্ভ বলা হত। এটি বিষ্ণুর মন্দিরের প্রহরী স্তম্ভ হিসাবে বিবেচিত হত। একদিকে ২৭ নক্ষত্রের মন্দিরগুলির ডিম্বাকৃতির চারপাশের অংশ ছিল। লাল পাথরের একটি বিশাল, অলঙ্কৃত দরজা নক্ষত্রমণ্ডল নামে পরিচিত ছিলো। সুতরাং ঐতিহ্যগতভাবে, প্রধান ফটকটি আলয় দ্বার হিসাবে পরিচিত ছিল। কানিংহামের মতো ঐতিহাসিকরা সুলতান আলাউদ্দিনের সঙ্গে এই দরজার নাম জুড়ে দেন। যদিও আলাউদ্দিন স্বয়ং এরকম কোনও দাবি করেননি।
প্রশ্নটি হ’ ল আলাউদ্দিনের সময়কালে এই স্থানটি পুরোপুরি ধ্বংসস্তুপে রূপান্তরিত হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে আলাউদ্দিনকে কেন এমন কোনও জায়গায় অলঙ্কৃত দরজা তৈরি করবেন? এটিকে মুয়াজ্জিনের মিনার বলাও একটি নির্জলা মিথ্যা। কোনও মুয়াজ্জিন এমনকি একদিনের জন্যও কি ৩৬৫ টি সংকীর্ণ এবং অন্ধকার সিঁড়ি ওঠার সাহস পাবে?
স্তম্ভের পরিধি যথাযথভাবে ২৪ মোড়ের সমন্বয়ে গঠিত এবং এর মধ্যে বৃত্তের আকার এবং ত্রিভুজের আকার পর্যায়ক্রমে আসে। এতে আলো আসার জন্য ২৭ টি গর্ত রয়েছে। এই জিনিসটি যদি ২৭ টি নক্ষত্রমণ্ডলগুলির সঙ্গে যুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়, তবে কোনও সন্দেহ হয়তো থাকে না যে স্তম্ভটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য পর্যবেক্ষণ স্তম্ভ ছিল।

এইরকম আরো অনেক সনাতনী স্থাপত্য আছে যেগুলো গায়ের জোরে ধ্বংস করা হয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাস আসলে গৌরবের ইতিহাস, যাকে নির্দিষ্ঠ কিছু রাজনৈতিক দল, তাদের রাজনৈতিক উদ্যেশ্য চরিতার্থ করার জন্যে বিকৃত করেছে, এবং সেই আসল তথ্য কখনোই সামনে আনতে দেয়নি।
ক্রমান্বয়ে আমি সেই সমস্ত তথ্য আপনাদের সামনে তুলে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করবো।
আপনারা সবাই শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন আসল সত্য।

কুতুব মিনার-DNA

তিহাসে এমন প্রমাণ ও লিখিত দলিল রয়েছে যার ভিত্তিতে এটি প্রমাণ করা যায় যে কুতুব মিনার সনাতন ইমারত, বিষ্ণু স্তম্ভ বা ধ্রুব স্তম্ভ।
এম এস ভাটনগর এই স্তম্ভের মূল উৎস, নাম এবং সামগ্রিক ইতিহাস সম্পর্কে দুটি নিবন্ধ লিখেছেন। এতে, প্রচলিত সমস্ত তথ্যগুলি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে, যা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে বা সাধারণত এটি সম্পর্কে কথিত হয়ে থাকে।
আরবীতে ‘কুতুব’ শব্দের অর্থ ‘অক্ষ’ বা ‘কেন্দ্রবিন্দু’। ‘কুতুব’ শব্দ আরবীতে মহাকাশ সংক্রান্ত গণনাতে বা জ্যোতির্বিজ্ঞানে ব্যবহার করা হতো। সুতরাং, কুতুব মিনার যে জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত স্তম্ভ বা মিনার সেটা বলা যেতেই পারে। সুলতান যুগে এ নামটি উল্লিখিত হয়। পরে একই নামে আদালতের নথিপত্রেও এর উল্লেখ দেখা যায়। পরবর্তীকালে, এর নাম সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবকের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় এবং মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে এটি কুতুবউদ্দিন আইবক দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।
প্রোফেসর এমএস ভাটনগর, গাজিয়াবাদ এই অনন্য ইমারতের ঐতিহাসিক সত্যতা সম্পর্কে আলোকপাত করেন এবং দিল্লির মুঘল রাজা এবং কিছু প্রত্নতাত্ত্বিকদের সমস্ত বিভ্রান্তিমূলক তথ্য, বিপরীত ব্যাখ্যা এবং ভুল তথ্যের পর্দাফাঁস করেন।
প্রথমেই দেখা যাক এই এই ‘মিনার’ তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রচলিত ইতিহাস কি বলছে? উত্তর হলো এটি একটি বিজয় স্তম্ভ। কাকে হারিয়ে কে জিতলেন? মোহাম্মদ ঘোরি রাই পিথোরা (পৃথ্বীরাজ) -কে পরাজিত করেছিলেন। যুদ্ধের ময়দান কোথায় ছিল? পানিপথের কাছে তরাইনে। তাহলে এই বিজয় স্তম্ভটি কেন দিল্লিতে তৈরি হয়েছিল? এর উত্তর প্রচলিত ইতিহাস আপনাকে দেবে এই বলে, ঘোরি বিজয় স্তম্ভ দিল্লিতে বানানো শুরু করেন কারণ দিল্লি নাকি তাঁর রাজধানী ছিল। তবে যারা ইতিহাস সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন তাঁরা জানেন ঘোরি কখনই দিল্লিকে তাঁর রাজধানী বানাননি! কারণ ইতিহাস সাক্ষী তিনি ফিরে গিয়েছিলেন নিজের দেশে। তাঁর রাজধানী ছিল গজনী। তাহলে এতো বড় বিজয়ের উদযাপন করতে স্তম্ভ দিল্লিতে তৈরির কী কারণ ছিল?
প্রচলিত_ইতিহাস_সম্পর্কে_যা_জানি_আমরা:--
প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক এই মিনার তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রচলিত ইতিহাস কি বলছে।
উত্তর হল এটি একটি বিজয়স্তম্ভ
●১) তাহলে কাকে হারিয়ে কে জিতে ছিলেন ?
মোহাম্মদ ঘোরি রাই ,শ্রীমান পৃথ্বীরাজ চৌহান কে পরাজিত করেছিলেন।
●২) যুদ্ধের ময়দান কোথায় ছিল ??
পানিপথের কাছে তরাইন। এটা আমরা সকলেই জানি ।
●৩) তাহলে এই বিজয় স্তম্ভ দিল্লিতে তৈরি হয়েছিল কিভাবে ??
মোহাম্মদ ঘোরি , বিজয় স্তম্ভ দিল্লিতে বানানো শুরু করেন কারণ দিল্লি নাকি তার রাজধানী ছিল। তবে এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি যারা ইতিহাস সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন তারা জানেন মোহাম্মদ ঘোরি কখনোই দিল্লিকে তার রাজধানী বানাননি ,কারণ ইতিহাস সাক্ষী তিনি ফিরে গিয়েছিলেন নিজের দেশে আর তার রাজধানী ছিল গজনী।
●৪) তাহলে এত বড় বিজয় উদযাপন করতে স্তম্ভ দিল্লিতে তৈরীর কারণ কি?
বিজয়স্তম্ভ যদি মোহাম্মদ ঘোরি শুরু করেন তবে এর নামকরণ তো হওয়া উচিত ছিল ঘোরি_মিনার, কুতুবমিনার নয় ।
●৫)তবে কেন একে কুতুবমিনার বলা হবে ??
প্রামাণ্য ইতিহাস রচয়িতা দের বক্তব্য কুতুবউদ্দিন আইবক নাকি এই বিজয় স্তম্ভ নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন এবং তিনি যেহেতু মোহাম্মদ ঘোরির দাসানুদাস ছিলেন তাই তার মালিকের নামে নামকরণ করেছিলেন বিজয়স্তম্ভে।
●৬) যদি এই যুক্তি সঠিক হয় তবে তিনি কেন বিজয়স্তম্ভে জন্য দিল্লি কে বেছে নিয়েছিলেন ?
এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক এর একটা খুব সোজা উত্তর আছে কুতুবউদ্দিন আইবক এর রাজধানী ছিল দিল্লিতে।
●৭) এখন প্রশ্ন হলো ঘোরির জীবদ্দশায় যদি এই মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হয় অর্থাৎ তখন তিনি তো জীবিত ছিলেন তাহলে তার দাসানুদাসের সাহস কিভাবে হয় যে মালিকের রাজধানী গজনী থেকে দিল্লিতে পরিবর্তন করার?
লক্ষণীয় বিষয় হলো মোহাম্মদ ঘোরি মারা যাওয়ার পরে কুতুবউদ্দিন আইবককে লাহোরের_সুলতান নির্বাচিত করা হয়। তিনি দিল্লীতে বসে রাজকার্য চালাতেন না কখনো।
এবং তিনি লাহোর থেকেই শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতেন আর শেষ পর্যন্ত তিনি মারা যান লাহোরেই।
লাহোর তার রাজধানীর হবার সত্বেও কেন তিনি দিল্লীতে বিজয় স্তম্ভ তৈরি করেছিলেন অনেকের মতে মিনারটি আসলে কোন বিজয় স্তম্ভ নয় বরং একটি মজিনা।
একটি মসজিদের মুয়াজ্জিন আজান দেওয়ার জন্য মিনার থাকে এবং এই স্তম্ভ নাকি কুয়াত-উল-ইসলাম মসজিদের মজীনা।
তবে ভারতের সমসাময়িক ইতিহাসে কুয়াত-উল-ইসলাম মসজিদ বলে কোন মসজিদের উল্লেখ নেই।
উনিশ শতকে এই কুতুবমিনার টার্মটি প্রথম কায়েম করেন স্যার সৈয়দ আহমেদ খান।
এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে ভারতীয় ইতিহাসে কুতুবমিনার এর মত কোন শব্দই তখনও অব্দি ছিলনা। সাম্প্রতিক সময়ে একটি অনুমানমূলক যুক্তি যে এই মিনারটি মুয়াজ্জিনের মিনার যদি তাই হয় তবে মসজিদের প্রাথমিক গুরুত্ব রয়েছে এবং মিনারের গুরুত্ব তত নয়।
দুর্ভাগ্যজনক যে এর নিকটবর্তী মসজিদ বর্তমানে ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে তবে তারপরে মুয়াজ্জিনের মিনার কিভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এ প্রশ্নের কোন উত্তর নেই বাস্তব বিষয় হলো মসজিদ এবং মজিনা একটি সম্পূর্ণ মন ভরা গল্প।
তথাকথিত কুতুবমিনার এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত জামে মসজিদ এবং মিনার নির্মাণকারী সমসাময়িক ব্যক্তি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ।
কুতুবমিনার অনেক পুরনো একটি স্তম্ভ ।
●৮) তাহলে কুরআনের আয়াত কেন এর গায়ে খোদাই করা আছে ??
ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন মিনারের গায়ের খোদাই করা কুরআনের আয়াত গুলি হল হিন্দু নকশার সুন্দর চিত্রের উপরে জোর করে লেখা প্রাণহীন কয়েকটি ছত্র ।
অন্যান্য মসজিদের কুরআনের আয়াত এরকম নকশার ওপরে কখনোই খোদাই করা থাকে না।
●●জেনে_নিন_আসল_সত্যি:--
এখন প্রশ্ন হল এই মিনারটি আসলে কি।
◆১) হ্যাঁ এটি হলো ধ্রুবস্তম্ভ বা প্রাচীন হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণের অন্যতম প্রধান পর্যবেক্ষণ স্তম্ভ।
হক_আই_ভিউ থেকে দেখলে এই স্তম্ভে চব্বিশটি (২৪) পাপড়ির পদ্মফুল দেখা যায় এর প্রত্যেকটি পাপড়ি আসলে দিনের ২৪ ঘন্টা পরিমাপের মাপকাঠি চিহ্ন।
২৪ টি পাপড়ি সহ পদ্ম ফুলের আকৃতির স্তম্ভ সম্পূর্ণরূপে একটি সনাতন ধারণা ।
এটি পশ্চিম এশিয়ার শুষ্ক অংশের দর্শনের ধারক চিহ্ন নয়, কারণ পদ্মফুল পৃথিবীর ওই অংশে জন্মায় না ।
যা তারা কখনো দেখেননি ,এ দেশে পদার্পণ করা মাত্রই সেই আকৃতির মিনার বানিয়ে ফেলবেন কল্পনা করাও কষ্টকর।
◆২) এই স্তম্ভের উলম্ব প্রজেকশন রেখাগুলি প্রতিটি তলের উপর দিয়ে সূক্ষ্ম কারিগরের মধ্য দিয়ে গিয়ে শীর্ষে যে এক সমান মাপের পাপড়িওয়ালা পদ্ম ফুল তৈরি করে তা খুবই সূক্ষ্ম কারিগরির পরিনাম ।
পদ্ম আকৃতির ধ্রুবস্তম্ভ যে অতীতের কোনো সাধারণ স্থপতি বানিয়েছে এটা ভাবতে গেলে অনেক সন্দেহের অবকাশ আছে।
◆৩) ধ্রুব স্তম্ভ কে মোহাম্মদ ঘোরি বা কুতুবউদ্দিন আইবক এর সৃষ্টি বলে চিন্তা করা যায় না ।
সুলতানরা হয়তো যার নাম স্তম্ভ তৈরিতে যুক্ত তার শিলালেখ ধ্বংস করে দেন ।
পাথর গুলিতে মানুষ বা প্রাণী গুলির আকার খোদিত ছিল তার উপরেই আরবিতে লিপি খোদিত যে হয়নি তারও কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই ।
প্রকৃতপক্ষে মিনার তৈরিতে সুলতানদের কোন হাত ছিল না কারণ এটি শুরু করার সময়কার কোন শিলালিপি বা কোনরকম চিহ্ন কিন্তু পাওয়া যায়নি।
কুতুব মিনার সম্পর্কে অনেক প্রমান রয়েছে যে এটি কুতুবুদ্দিনের ভারত ভূখণ্ড পদার্পণের বহু বছর আগেই ছিল ।
কুতুব মিনারের কাছের বসতির নাম মেহরৌলি
এটি মিহির_আবেলি নামে একটি সংস্কৃত শব্দ।
এই শহর সম্পর্কে কথিত আছে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির ( যিনি বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন এর মধ্যে একজন অন্যতম রত্ন )এখানে থাকতেন । তাঁর সঙ্গে এই অঞ্চলে বাস করতেন তার সহকারি গণিতবিদ ও প্রযুক্তিবিদরাও ।
তারা এই তথাকথিত কুতুবমিনার কে জ্যোতির্বিদ্যার গণনা অধ্যায়নের জন্য ব্যবহার করতেন।
এই স্তম্ভের চারিপাশে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান গণনা করার রাশিচক্রে উৎসর্গীকৃত সাতাশটি (২৭) নক্ষত্রের জন্য মণ্ডপ বা গম্বুজযুক্ত ভবন ছিল। কুতুবুদ্দিনের সমসাময়িক ঐতিহাসিক বর্ণনাতে আছে তিনি এই সমস্ত মণ্ডপগুলি বা গম্বুজযুক্ত ভবনগুলি ধ্বংস করে দিয়েছেন, তবে কোথাও এটা লেখা ছিল না তিনি একটি মিনার তৈরি করেন ।
তথাকথিত কুতুব মিনার থেকে উত্তোলিত পাথরের এক পাশে ছিল হিন্দু মূর্তি অন্যদিকে আরবি অক্ষর বর্তমান। এই পাথরগুলি বর্তমানে মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে।
এটি প্রমাণ করে যে আক্রমণকারীরা মন্দিরের দেওয়ালের মূর্তি ইত্যাদি নষ্ট করত এবং আরবিতে লিখিত সামনের অংশটি তৈরি করার জন্য প্রতিমার মুখের বা সম্মুখের অংশের পরিবর্তন করতো। অনেকগুলি কমপ্লেক্সের স্তম্ভ এবং দেওয়ালে সংস্কৃত বিবরণ কিন্তু এখনো আপনি কুতুব মিনারের গেলেই চোখে পড়বে।
কার্নিশে অনেক মূর্তি দেখা যায়, তবে নাক চোখ এবং সূক্ষ্ম কারুকার্য্য গুলি ভেঙে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
এটা চিন্তা করা কঠিন যে পূর্ববর্তী হিন্দু ভবন গুলির চারপাশে যথেষ্ট জায়গা ছিল এবং কুতুবউদ্দিন এসে সেখানে একটি মিনার তৈরি করেছিলেন স্তম্ভটির অলংকৃত শৈলীতে প্রমাণিত হয় যে এটি একটি সনাতন স্থাপত্য।
মুসলিম মিনার গুলির বহির্ভাগ সম্পূর্ণ সমতল হয়। যারা যুক্তি দিয়েছিলেন যে এই মিনারটি মুসলিমদের আজান দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো ,তাদের এই তথ্য এজন্যই ব্যর্থ যে এত উঁচুতে উঠে আজান দিলে মিনারের নিচে দাঁড়িয়ে কেউ শুনতে পাবে না, আর সে সময় তো মাইক আবিষ্কার হয়নি ।আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো টাওয়ারের প্রবেশপথটি অন্য ইসলামিক স্থাপত্য পশ্চিমে নয় উত্তর দিকে ।
যখন ইসলামী ধর্ম তত্ত্ব এবং ঐতিহ্য মোতাবেক পশ্চিম দিকে গুরুত্ব রয়েছে।
প্রবেশপথের এক পাশে একটি পাথরের পদ্মফুল রয়েছে। মধ্যযুগীয় ইমারত গুলিতে পাথরের পদ্ম ফুল তৈরি করা একটি সনাতন ঐতিহ্য, আরবী রীতিতে কখনও ভবন নির্মাণের সময় এই জাতীয় ফুল তৈরি করা হতো না ।
মিনারের গায়ে খোদিত নমুনা গুলিতে বহু ভেজাল রয়েছে, পদ্ম কুঁড়ির মত সনাতন মোটিফের মাঝে আরবি মোটিফ ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ২৪ সংখ্যাটি বৈদিক ঐতিহ্যে পবিত্র হিসেবে বিবেচিত হয় কারণ এটি ৮ এর গুণফল।
লৌহ_স্তম্ভ / গরুর_ধ্বজ:--
নিকটে অবস্থিত কখনো মরিচা না পড়া লোহার স্তম্ভের উপরে, সংস্কৃত ভাষায় ব্রাহ্মীলিপিতে খোদিত আছে বিষ্ণুর স্তম্ভটি বিষ্ণুপদ নামে একটি পাহাড়ের নির্মিত হয়েছিল।
এই বর্ণনা থেকে এটি পরিষ্কার যে মিনারটির মাঝখানে অবস্থিত মন্দিরে শুয়ে থাকা বিষ্ণুর মূর্তিটি মোহাম্মদ ঘোরি এবং তার দাসানুদাস কুতুবউদ্দিন আইবক ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।
মিনারটিতে সাতটি তলা ছিল যা এক সপ্তাহের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এখন টাওয়ার থেকে কেবল পাঁচটি তল রয়েছে ।
ষষ্ঠ তলা থেকে উপরের অংশ মাটিতে ফেলে দেওয়া হয় এবং সংলগ্ন মাটিতে পুনরায় স্থাপন করা হয়।
লোহার স্তম্ভটিকে গরুর ধ্বজা গরুর স্তম্ভ বলা হত। এটি যে কোনো বিষ্ণু মন্দিরের প্রধান স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হতো।
এটি একদিকে ২৭ নক্ষত্রের মন্দিরগুলির ডিম্বাকৃতি চারপাশের অংশ ছিল ।
লাল পাথরের একটি বিশাল অলংকৃত দরজা নক্ষত্রমন্ডল নামে পরিচিত ছিল সুতরাং ঐতিহ্যগতভাবেই প্রধান ফটকটি আলয় দ্বার হিসাবে পরিচিত ছিল।
কানিংহামের মত ঐতিহাসিকরা সুলতান আলাউদ্দিন এর সঙ্গে এই দরজার নাম জুড়ে দেন যদিও আলাউদ্দিন স্বয়ং এরকম কোনো দাবি করেননি।
প্রশ্ন হল আলাউদ্দিনের সময় কালে এই স্থানটি পুরোপুরি ধ্বংস স্তুপে রূপান্তরিত হয়েছিল এমন পরিস্থিতিতে আলাউদ্দিনকে কেন এমন কোন জায়গার অলংকৃত দরজা তৈরি করবেন ?এটিকে মুয়াজ্জিনের মিনার বলাও একটি নির্জলা মিথ্যা কথা ।
কোনও মোয়াজ্জিন এমনকি একদিনের জন্যেও কি ৩৬৫ টি সংকীর্ণ এবং অন্ধকার সিঁড়ি ওঠার সাহস পাবে !!
স্তম্ভের পরিধি যথাযথভাবে ২৪ মোড়ের সমন্বয়ে গঠিত এবং এর মধ্যে বৃত্তের আকার এবং ত্রিভুজের আকার পর্যায়ক্রমে আসে।
এতে আলো আসার জন্য সাতাশটি গর্ত রয়েছে। এই সাতাশটি যদি সাতাশটি নক্ষত্রমন্ডল এর সঙ্গে যুক্ত বলে বিবেচনা করা হয় তবে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে স্তম্ভটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য পর্যবেক্ষণ স্তম্ভ ছিল।
তথাকথিত কুতুব মিনার এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত জাম-এ-মসজিদ এবং মিনার নির্মাণকারী সমসাময়িক ব্যক্তি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কুতুব মিনার অনেক পুরনো একটি স্তম্ভ। তাহলে কুরআনের আয়াত কেন এর গায়ে খোদাই করা আছে, এ প্রশ্ন ওটা স্বাভাবিক।
ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, মিনারের গায়ে খোদাই করা কুরআনের আয়াতগুলি হ’ ল হিন্দু নকশার সুন্দর চিত্রবল্লরীর নকশার উপরে জোর করে লেখা প্রাণহীন কয়েকটি ছত্র। অন্যান্য মসজিদে কুর আনের আয়াত এরকম নকশার উপর খোদাই করা থাকে না।
এখন প্রশ্ন হলো তাহলে এই মিনারটি আসলে কি? এটি হলো ধ্রুব স্তম্ভ বা প্রাচীন হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণের অন্যতম প্রধান পর্যবেক্ষণ স্তম্ভ। ‘হক আই ভিউ’ থেকে দেখলে এই স্তম্ভে ২৪ পাপড়ির পদ্ম ফুল দেখা যায়। এর প্রত্যেক পাপড়ি আসলে দিনের ২৪ ঘন্টা পরিমাপের মাপকাঠি চিহ্ন। চব্বিশটি পাপড়ি সহ পদ্ম ফুলের আকৃতির স্তম্ভ সম্পূর্ণরূপে একটি সনাতন ধারণা। এটি পশ্চিম এশিয়ার শুষ্ক অংশের দর্শনের ধারক চিহ্ন নয়। কারণ পদ্মফুল পৃথিবীর ঐ অংশে জন্মায় না! যা তাঁরা কখনো দেখেননি, এদেশে পদার্পণ মাত্রই সেই আকৃতির মিনার বানিয়ে ফেলবেন এ তো কল্পনা করাও কষ্টকর।

এই স্তম্ভের উল্লম্ব প্রজেকশন রেখাগুলি, প্রতিটি তলের উপর দিয়ে সূক্ষ্ম কারিগরীর মধ্যে দিয়ে গিয়ে শীর্ষে যে এক সমান মাপের পাপড়িওয়ালা পদ্ম ফুল তৈরি করে, তা খুবই সূক্ষ্ম কারিগরির পরিণাম। পদ্ম আকৃতির ধ্রুব স্তম্ভ যে অতীতের কোনও সাধারণ স্থপতি বানিয়েছে, এটা ভাবতে গেলে অনেক সন্দেহের অবকাশ আছে। ধ্রুব স্তম্ভকে মোহাম্মদ ঘোরি বা কুতুবুদ্দিন আইবকের সৃষ্টি বলে চিন্তা করতে অনেক সন্দেহের কারণ আছে। সুলতানরা হয়তো যার নাম এই স্তম্ভ তৈরিতে যুক্ত তার শিলালেখ ধ্বংস করে দেন, পাথরগুলিতে মানুষ বা প্রাণীগুলির আকার খোদিত ছিলো, তার উপরই আরবিতে লিপি খোদিত যে হয় নি, তারও কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। প্রকৃতপক্ষে, মিনার তৈরিতে সুলতানদের কোনো হাত ছিলো? কারণ এটি শুরু করার সময়কার কোনো শিলালিপি বা কোনোরকম চিহ্ন কিন্তু পাওয়া যায় নি।
কুতুব মিনার সম্পর্কে অনেক প্রমাণ রয়েছে যে এটি কুতুবুদ্দিনের ভারত ভূখন্ডে পদার্পণের বহু বছর পূর্ব থেকেই ছিলো। কুতুব মিনারের কাছের বসতির নাম মেহরৌলি। এটি মিহির-আবেলি নামে একটি সংস্কৃত শব্দ। এই শহর সম্পর্কে কথিত আছে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ মিহির (যিনি বিক্রমাদিত্যের দরবারে নবরত্নের একজন) এখানে থাকতেন। তাঁর সঙ্গে এই অঞ্চলে বাস করতেন তাঁর সহকারী, গণিতবিদ ও প্রযুক্তিবিদরাও। তারা এই তথাকথিত কুতুব মিনারকে জ্যোতির্বিদ্যার গণনা, অধ্যয়নের জন্য ব্যবহার করতেন।
এই স্তম্ভের চারপাশে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান গণনা করার রাশিচক্রকে উৎসর্গীকৃত ২৭ টি নক্ষত্রের জন্য মন্ডপ বা গম্বুজযুক্ত ভবন ছিল। কুতুবুদ্দিনের সমসাময়িক ঐতিহাসিক বর্ণনাতে আছে তিনি এই সমস্ত মণ্ডপগুলি বা গম্বুজযুক্ত ভবনগুলি ধ্বংস করে দিয়েছেন, তবে কোথাও এটা লেখা ছিলো না তিনি একটি মিনার তৈরি করেন। তথাকথিত কুতুব মিনার থেকে উত্তোলিত পাথরের একপাশে ছিল হিন্দু মূর্তি, অন্যদিকে আরবি অক্ষর বর্তমান। এই পাথরগুলি বর্তমানে মিউজিয়ামে রক্ষিত
এটি প্রমাণ করে যে আক্রমণকারীরা মন্দিরের দেওয়ালের মূর্তি ইত্যাদি নষ্ট করতো এবং আরবীতে লিখিত সামনের অংশটি তৈরি করার জন্য প্রতিমার মুখের বা সম্মুখ অংশটির পরিবর্তন করতো। অনেকগুলি কমপ্লেক্সের স্তম্ভ এবং দেয়ালে সংস্কৃত বিবরণ এখনও পড়া যায়। কার্নিসে অনেক মূর্তি দেখা যায় তবে নাক চোখ ও সূক্ষ্ম কারুকাজ ভেঙে নষ্ট করা হয়েছে।
এটা চিন্তা করা কঠিন যে পূর্ববর্তী হিন্দু ভবনগুলির চারপাশে যথেষ্ট জায়গা ছিল এবং কুতুবুদ্দিন এসে সেখানে একটি মিনার তৈরি করেছিলেন। স্তম্ভটির অলঙ্কৃত শৈলীতে প্রমাণিত হয় যে এটি একটি সনাতন স্থাপত্য। মুসলিম মিনারগুলির বহির্ভাগ সম্পূর্ণ সমতল হয়। যারা যুক্তি দিয়েছিলেন যে এই মিনারটি মুসলিমদের আজানের জন্য ব্যবহৃত হতো, তাঁদের তত্ত্ব এজন্য ব্যর্থ যে এতো উঁচুতে উঠে আজান দিলে মিনারের নীচে দাঁড়িয়েই কেউ শুনতে পাবে না, সেসময় কিন্তু মাইকও আবিষ্কার হয় নি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ’ ল টাওয়ারের প্রবেশ পথটি অন্য ইসলামিক স্থাপত্যের মতো পশ্চিমে নয়, উত্তর দিকে, যখন ইসলামী ধর্মতত্ত্ব এবং ঐতিহ্য মোতাবেক পশ্চিম দিকের গুরুত্ব রয়েছে।

প্রবেশ পথের একপাশে একটি পাথরের পদ্ম ফুল রয়েছে। মধ্যযুগীয় ইমারতগুলিতে পাথরের ফুল তৈরি করা একটি সনাতন ঐতিহ্য। আরবী রীতিতে কখনও ভবন নির্মাণের সময় এ জাতীয় ফুল তৈরি করা হতো না। মিনারের গায়ে খোদিত নমুনাগুলিতে বহু ভেজাল রয়েছে, পদ্ম কুঁড়ির মতো সনাতন মোটিফের মাঝে আরবি মোটিফ ছড়িয়ে পড়েছে।

নিকটে অবস্থিত কখনো মরিচা না পড়া লোহার স্তম্ভের উপরে, সংস্কৃত ভাষায় ব্রাহ্মী লিপিতে খোদিত আছে বিষ্ণুর এই স্তম্ভটি বিষ্ণুপদ গিরি নামে একটি পাহাড়ে নির্মিত হয়েছিল। এই বর্ণনা থেকে এটি পরিষ্কার যে মিনারটির মাঝখানে অবস্থিত মন্দিরে শুয়ে থাকা বিষ্ণুর মূর্তিটি মোহাম্মদ ঘোরি এবং তাঁর দাস কুতুবউদ্দিন হয়তো ধ্বংস করেছিলেন।
মিনারটিতে সাতটি তলা ছিল যা এক সপ্তাহের প্রতিনিধিত্ব করে, তবে এখন টাওয়ারটিতে কেবল পাঁচটি তলা রয়েছে। ষষ্ঠ তলা থেকে উপরের অংশ মাটিতে ফেলে দেওয়া হয় এবং সংলগ্ন মাটিতে পুনরায় স্থাপন করা হয়েছিল।
লোহার স্তম্ভটিকে গরুড় ধ্বজ বা গরুড় স্তম্ভ বলা হত। এটি বিষ্ণুর মন্দিরের প্রহরী স্তম্ভ হিসাবে বিবেচিত হত। একদিকে ২৭ নক্ষত্রের মন্দিরগুলির ডিম্বাকৃতির চারপাশের অংশ ছিল। লাল পাথরের একটি বিশাল, অলঙ্কৃত দরজা নক্ষত্রমণ্ডল নামে পরিচিত ছিলো। সুতরাং ঐতিহ্যগতভাবে, প্রধান ফটকটি আলয় দ্বার হিসাবে পরিচিত ছিল। কানিংহামের মতো ঐতিহাসিকরা সুলতান আলাউদ্দিনের সঙ্গে এই দরজার নাম জুড়ে দেন। যদিও আলাউদ্দিন স্বয়ং এরকম কোনও দাবি করেননি।
প্রশ্নটি হ’ ল আলাউদ্দিনের সময়কালে এই স্থানটি পুরোপুরি ধ্বংসস্তুপে রূপান্তরিত হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে আলাউদ্দিনকে কেন এমন কোনও জায়গায় অলঙ্কৃত দরজা তৈরি করবেন? এটিকে মুয়াজ্জিনের মিনার বলাও একটি নির্জলা মিথ্যা। কোনও মুয়াজ্জিন এমনকি একদিনের জন্যও কি ৩৬৫ টি সংকীর্ণ এবং অন্ধকার সিঁড়ি ওঠার সাহস পাবে?
স্তম্ভের পরিধি যথাযথভাবে ২৪ মোড়ের সমন্বয়ে গঠিত এবং এর মধ্যে বৃত্তের আকার এবং ত্রিভুজের আকার পর্যায়ক্রমে আসে। এতে আলো আসার জন্য ২৭ টি গর্ত রয়েছে। এই জিনিসটি যদি ২৭ টি নক্ষত্রমণ্ডলগুলির সঙ্গে যুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়, তবে কোনও সন্দেহ হয়তো থাকে না যে স্তম্ভটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য পর্যবেক্ষণ স্তম্ভ ছিল।

এইরকম আরো অনেক সনাতনী স্থাপত্য আছে যেগুলো গায়ের জোরে ধ্বংস করা হয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাস আসলে গৌরবের ইতিহাস, যাকে নির্দিষ্ঠ কিছু রাজনৈতিক দল, তাদের রাজনৈতিক উদ্যেশ্য চরিতার্থ করার জন্যে বিকৃত করেছে, এবং সেই আসল তথ্য কখনোই সামনে আনতে দেয়নি।
ক্রমান্বয়ে আমি সেই সমস্ত তথ্য আপনাদের সামনে তুলে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করবো।
আপনারা সবাই শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন আসল সত্য।

Posted at December 28, 2020 |  by Arya ঋষি

                     
ষোড়শ মহাজনপদ• ৭০০-৩০০খ্রীষ্টপূর্ব
• মগধ সাম্রাজ্য• ৫৪৫খ্রীষ্টপূর্ব
• মৌর্য সাম্রাজ্য• ৩২১-১৮৪খ্রীষ্টপূর্ব
মধ্যকালীন রাজ্যসমূহ২৫০খ্রীষ্টপূর্ব
• চোল সাম্রাজ্য• ২৫০খ্রীষ্টপূর্ব
• সাতবাহন সাম্রাজ্য• ২৩০খ্রীষ্টপূর্ব
• কুষাণ সাম্রাজ্য• ৬০-২৪০ খ্রীষ্টাব্দ
• বাকাটক সাম্রাজ্য• ২৫০-৫০০ খ্রীষ্টাব্দ
সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অধীনে গুপ্ত সাম্রাজ্য (৩৭৫-৪১৫ খ্রিষ্টাব্দ)


পাল সাম্রাজ্য• ৭৫০-১১৭৪ খ্রীষ্টাব্দ
 রাষ্ট্রকুট• ৭৫৩-৯৮২
-রাষ্ট্রকূট রাজবংশ হল খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ থেকে দশম শতাব্দীতে ভারতে রাজত্বকারী একটি রাজবংশ।ভারতের ইতিহাসে রাষ্ট্রকূট রাজবংশের উৎপত্তি একটি বিতর্কিত বিষয়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে রাষ্ট্রকূটদের আদিপুরুষদের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে রাষ্ট্রকূটদের বিভিন্ন গোষ্ঠী ছোটো ছোটো রাজ্য শাসন করত। এই রাষ্ট্রকূট গোষ্ঠীগুলি সঙ্গে সবচেয়ে বিখ্যাত রাজবংশ মান্যখেতের (অধুনা কর্ণাটক রাজ্যের গুলবার্গ জেলার মালখেদ অঞ্চল) রাষ্ট্রকূটদের সম্পর্ক নিয়েও বিতর্ক আছে।(Altekar (1934), pp1–32.. Reu (1933), pp6–9, pp47–53)
 রাষ্ট্রকূটদের সবচেয়ে পুরনো যে লেখটি এখনও পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে, সেটি হল সপ্তম শতাব্দীর। এই তাম্রলিপি থেকে জানা যায়, আধুনিক মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের মালওয়া অঞ্চলের মানপুর তাঁরা শাসন করতেন। অন্যান্য কয়েকটি লেখ থেকে সমসাময়িক আরও কয়েকটি রাষ্ট্রকূট শাসকগোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এঁরা হলেন অচলপুর (অধুনা মহারাষ্ট্র রাজ্যের এলিচপুর) ও কনৌজের রাজা। রাষ্ট্রকূটদের উৎপত্তি, আদি নিবাস ও ভাষা নিয়ে একাধিক বিতর্কিত মত প্রচলিত আছে।

প্রথম দিকের রাষ্ট্রকূট রাজারা ছিলেন হিন্দু। পরবর্তীকালে তাঁরা জৈনধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন।

রাষ্ট্রকূট শাসনকালে জৈন গণিতবিদ ও পণ্ডিতেরা কন্নড় ও সংস্কৃত ভাষায় বহু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা প্রথম অমোঘবর্ষ কবিরাজমার্গ নামে একটি বিখ্যাত কন্নড় গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। দ্রাবিড় স্থাপত্য রাষ্ট্রকূট রাজত্বে বিশেষ উন্নতি লাভ করেছিল। এই স্থাপত্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল ইলোরা গুহার কৈলাসনাথ মন্দির (অধুনা মহারাষ্ট্র রাজ্যে), কাশীবিশ্বনাথ মন্দির ও জৈন নারায়ণ মন্দির (অধুনা কর্ণাটক রাজ্যে)। এই সবকটিই এখন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।

ইলোরা কৈলাসনাথ মন্দির, মহারাষ্ট্র

রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল প্রায় সমগ্র কর্ণাটকমহারাষ্ট্র এবং অন্ধ্রপ্রদেশের কিছু অংশ। অন্ধ্রের ঐ অঞ্চলে রাষ্ট্রকূটদের ২০০ বছরের শাসন ছিল।সামানগড় তাম্রলিপি (৭৫৩) থেকে জানা যায়, বেরারের (অধুনা মহারাষ্ট্রের এলিচপুর) অচলপুরের সামন্ত রাজা দন্তিদূর্গ ৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে বাদামির চালুক্য রাজা দ্বিতীয় কীর্তিবর্মণকে পরাজিত করে চালুক্য সাম্রাজ্যের উত্তরাঞ্চল জয় করে নেন। পরে তিনি তাঁর শ্বশুর পল্লব রাজা নন্দীবর্মণকে চালুক্যদের হাত থেকে কাঞ্চী উদ্ধার করতে সাহায্য করেন। তিনি মালওয়ার গুর্জরদের পরাস্ত করেন এবং কলিঙ্গকোশল ও শ্রীশৈলম জয় করেন।
দাক্ষিণাত্যের স্থাপত্য ঐতিহ্যে রাষ্ট্রকূট রাজবংশের অবদান অপরিসীম।রাষ্ট্রকূটরা বৌদ্ধ গুহাগুলির সংস্কার করে প্রস্তরখোদিত বেদিগুলি পুনরায় উৎসর্গ করেন। প্রথম অমোঘবর্ষ ছিলেন জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষক। তাঁর রাজত্বকালে ইলোরায় পাঁচটি জৈন গুহামন্দির নির্মিত হয়েছিল। ইলোরায় রাষ্ট্রকূটদের সবচেয়ে বড়ো ও উল্লেখযোগ্য কীর্তিটি হল একশিলায় খোদিত কৈলাসনাথ মন্দির

'অষ্টম শতাব্দীতে মুহাম্মদ বিন কাশিমের মাধ্যমে ইসলামের ভারত বিজয়ের পর ভারতে ইসলামি সাম্রাজ্য শুরু হয়। ইসলামি সভ্যতা ভারতীয় উপমহাদেশের বেলুচিস্তান(পূর্বে মুলতান) এবং সিন্ধু অঞ্চলে উপস্থিত হয়। ইসলামি সভ্যতা আসার পর দশম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত দিল্লী সুলতান ও মুঘল সাম্রাজ্য উত্তর ভারতে শাসন করে।


 সুলতানী আমল• ১২০৬-১৫৯৬
দিল্লী সালতানাত বলতে মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনকালকে বুঝানো হয়। ১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতে রাজত্বকারী একাধিক মুসলিম রাজ্য ও সাম্রাজ্যগুলি দিল্লী সালতানাত নামে অভিহিত।( "Delhi sultanate | Muslim kingdom, India"। Encyclopedia Britannica (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০২-১৮। Schimmel, Annemarie (১৯৮০)। Islam in the Indian Subcontinent (ইংরেজি ভাষায়)। BRILL।আইএসবিএন 978-90-04-06117-0)
 এই সময় বিভিন্ন তুর্কি ও আফগান রাজবংশ দিল্লি শাসন করে। এই রাজ্য ও সাম্রাজ্যগুলি হল: মামলুক সুলতান (১২০৬-৯০)খিলজি রাজবংশ (১২৯০-১৩২০), তুঘলক রাজবংশ (১৩২০-১৪১৩), সৈয়দ রাজবংশ (১৪১৩-৫১) এবং লোদি রাজবংশ (১৪৫১-১৫২৬)।

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম বিজয় শুরু হয় প্রধানত ১২শ থেকে ১৬শ শতাব্দীতে। তবে ৮ম শতাব্দীতে মুসলমানেরা রাজপুত সাম্রাজ্যে (বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে) কিছু কিছু হামলা চালিয়েছিল। দিল্লি সালতানাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলাম উপমহাদেশের বড় অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজি বাংলা জয় করেন যা ছিল তৎকালে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে উত্তর প্রান্ত।

১৪ শতকে খিলজি বংশের, আলাউদ্দিন খিলজি তার সাম্রাজ্যের সীমানা দক্ষিণে গুজরাত,রাজস্থান ও দাক্ষিণাত্য মালভূমি এবং তুগলক রাজবংশ তাদের সীমানা তামিলনাড়ু পর্যন্ত বাড়ায়। কিন্তু দিল্লি সালতানাত ভেংগে গেলে ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে অনেক গুলো নতুন সালতানাতে আবির্ভাব ঘটে, যার মধ্যে গুজরাত সালতানাত, মালওয়া সালতানাত, তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাণিজ্য পথের অধিকারী বাংলা সালতানাত

মারাঠা সাম্রাজ্য ও ব্রিটিশ রাজত্বের পূর্বে মুসলিম মুঘল সাম্রাজ্য ভারতের অধিকাংশ রাজ্যকে দখল বা দমন করতে সক্ষম হয়। তবে কিছু প্রান্তিক রাজ্য তারা দখল করতে পারেনি, যেমন - হিমালয়ের উপরাংশে হিমাচল প্রদেশ, উত্তরখণ্ড, সিকিম, নেপাল ও ভুটান; দক্ষিণ ভারতে ট্রাভাঙ্কর ও তামিলনাড়ু এবং পূর্বে আসামের আহোম সাম্রাজ্য।আরব উপদ্বীপে ইসলামের উৎপত্তি ও বিস্তৃতির অল্পকালের মধ্যেই তা আরব বণিক, সুফি ও ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সমুদ্র-উপকূলবর্তী অঞ্চল সিন্ধ, বাংলা, গুজরাট, কেরালা এবং সিলনে। মুসলিমরা এসব স্থানে বসতি করেন এবং স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করেন। ৬৪৩ খ্রীষ্টাব্দে খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়ে আরব বিশ্ব প্রথম নৌপথে ভারত উপমহাদেশে আক্রমণ করে, স্থলপথে আক্রমণ করে তার অনেক পরে।

ছবিটা বদলে গেল সুলতান সবুক্তগীনের ভারত আক্রমণের (৯৮৬–৯৮৭) সমসময়ে, এবং আরও বেশি করে তাঁর পুত্র সুলতান মাহ্‌মুদের উপর্যুপরি ভারত-লুণ্ঠনে।সবুক্তগিন বা সেবুক তিগিন জন্ম ৯৪২ খ্রিস্টাব্দ (সম্ভবত) - মৃত্যু আগস্ট, ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন গজনভি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তার পুরো নাম ছিল আবু মনসুর সবুক্তগিন । ৯৭৭ থেকে ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেন। তার পুত্র ও উত্তরাধিকারী ছিলেন মাহমুদ গজনভি,ইয়ামিনউদ্দৌলা আবুল কাসিম মাহমুদ ইবনে সবুক্তগিন সাধারণভাবে মাহমুদ গজনভি;  ২ নভেম্বর ৯৭১ – ৩০ এপ্রিল ১০৩০), সুলতান মাহমুদ ও মাহমুদে জাবুলি বলে পরিচিত, ছিলেন গজনভি সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাসক।

পিতাসবুক্তগিন
ধর্মসুন্নি ইসলাম
সুলতান মাহমুদ ৯৭১ সালের নভেম্বরে বর্তমান আফগানিস্তানের (সাবেক জাবালিস্তান) গজনী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সবুক্তগীন ছিলেন তুর্কি ক্রীতদাস এবং সেনাপতি যিনি ৯৭৭ সালে গজনভী রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।খোরাসান এবং ট্রান্সঅক্সিয়ানার সামানি রাজবংশের প্রতিনিধি হিসেবে শাসনকাজ পরিচালনা করেন।

 যিনি গজনির সুলতান মামুদ নামে ইতিহাসে বিখ্যাত। নিজ শাসনামলে তিনি ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন।(T. A. Heathcote, The Military in British India: The Development of British Forces in South Asia:1600-1947, (Manchester University Press, 1995), 6.৯৯৭ থেকে ১০৩০ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পূর্ব ইরানিয় ভূমি এবং ভারত উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম অংশ (বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তান) জয় করেন। সুলতান মাহমুদ সাবেক প্রাদেশিক রাজধানী গজনিকে এক বৃহৎ সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধশালী রাজধানীতে পরিণত করেন। তার সাম্রাজ্য বর্তমান আফগানিস্তান, পূর্ব ইরান ও পাকিস্তানের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে ছিল।

১৮৪৮ সনে সুলতান মাহমুদ গজনবীর সমাধি

 দশম শতকে উত্তর-পশ্চিম ভারতের ছোট ছোট রাজ্যগুলির দুর্বলতার সুযোগে ভারতের সঞ্চিত ঐশ্বর্যের প্রলোভনে গজনীর সুলতান সবুক্তগীন পাঞ্জাবের শাহী রাজ্য আক্রমণ করেন। সবুক্তগীন বিশেষ সাফল্যলাভ না-করলেও ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর পুত্র সুলতান মামুদ ১০০০ থেকে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অন্তত সতেরো-বার ভারত আক্রমণ করেছিলেন। ১০০১ খ্রীষ্টাব্দে ভারতীয় হিন্দু রাজা জয়পাল পরাজিত হলেন; ১০২৫–২৬ খ্রিস্টাব্দে মামুদ সোমনাথের মন্দির লুণ্ঠনের জন্য দুবার অভিযান করেন। তবু উত্তর-পশ্চিম বাদে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে তখনও ইস্‌লাম ছায়াপাত করেনি। আরও প্রায় দু’শ বছর পরে গজনীর সুলতান মহম্মদ বিন সাম—যাঁর সহজ পরিচয় ‘মহম্মদ ঘোরী’, এলেন উপর্যুপরি ভারত-লুন্ঠনের ধারণা নিয়ে; ১১৯২ খ্রীষ্টাব্দে তরাই-এর যুদ্ধ থেকে দিল্লী অঞ্চলে হিন্দু রাজত্বের অবসান হল বলে ধরে নেওয়া যায়।

মুইজউদ্দিন মুহাম্মাদ , জন্মনাম শিহাবউদ্দিন (১১৪৯ – মার্চ ১৫, ১২০৬), (মুহাম্মাদ ঘুরি বলেও পরিচিত) ছিলেন ঘুরি সাম্রাজ্যের সুলতান। তার ভাই গিয়াসউদ্দিন মুহাম্মাদের সাথে তিনি ১১৭৩ থেকে ১২০২ পর্যন্ত শাসন করেন। এরপর ১২০২ থেকে ১২০৬ পর্যন্ত তিনি সর্বো‌চ্চ শাসক হিসেবে শাসন করেন।

মহম্মদ ঘোরীর হাতে চৌহান বংশীয় পৃথ্বীরাজ—যাঁর রাজধানী ছিল দিল্লির লাটকোট অঞ্চলেভারত জয় করে মহম্মদ ঘোরী কোন উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে যাননি। তাঁর কোন পুত্রসন্তান ছিল না।১২১০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি যখন নিহত হলেন তখন কির্মানের শাসনকর্তা তাজউদ্‌দীন য়ীলদিজ্ উঠে বসলেন গজনীর মসনদে এবং কুৎবউদ্‌দীন আইবক পেলেন ভারত শাসনের অধিকার।অচিরেই দুজনের সংঘাত বাধল এবং সে গৃহযুদ্ধে বিজয়ী হলেন কুৎবউদ্‌দীন। উঠে বসলেন গজনীর মসনদে।কুৎববউদ্‌দীন আইবক দিল্লীতে এসে নতুন বংশের প্রতিষ্ঠা করলেন—যার প্রচলিত নাম ‘দাস বংশ’

মামলুক সালতানাত
মামলুক সালতানাত ১২০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্য এশিয়ার তুর্কি সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবেক মামলুকদের উত্তর ভারতে নিয়ে আসেন। দিল্লি সালতানাত শাসনকারী পাঁচটি রাজবংশের মধ্যে মামলুক রাজবংশ প্রথম। এর শাসনকাল ছিল ১২০৬ থেকে ১২৯০ সাল পর্যন্ত। ঘুরি রাজবংশের প্রতিনিধি শাসক হিসেবে কুতুবুদ্দিন আইবেক ১১৯২ থেকে ১২০৬ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। এসময় তিনি গাঙ্গেয় অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেন এবং নতুন অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।

তৈমুর বিন তারাগাই বারলাস (১৩৩৬ - ফেব্রুয়ারি, ১৪০৫) ১৪শ শতকের একজন তুর্কী-মোঙ্গল সেনাধ্যক্ষতিনি পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজ দখলে এনে তৈমুরি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৩৭০ থেকে ১৪০৫ সাল পর্যন্ত নেতৃত্বে আসীন ছিল।

মামলুকরা ছিল ইসলাম গ্রহণকারী দাস বংশোদ্ভূত সৈনিক। ৯ম শতাব্দী থেকে এই ধারা শুরু হয়ে মামলুকরা ধীরে ধীরে শক্তিশালী সামরিক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। বিশেষত মিশর এবং এর পাশাপাশি লেভান্ট, ইরাক ও ভারতে মামলুকরা রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিল।

১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ ঘুরি নিহত হন।তার কোনো সন্তান না থাকায় তার সাম্রাজ্য বিভিন্ন সালতানাতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তার প্রাক্তন মামলুক সেনাপতিরা এসব সালতানাতের নেতৃত্ব লাভ করেন। তাজউদ্দিন ইলদিজ, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি, নাসিরউদ্দিন কাবাচা ও কুতুবউদ্দিন আইবেক যথাক্রমে গজনি, বাংলা, মুলতান ও দিল্লির শাসক হন। এর মাধ্যমে মামলুকদের শাসন শুরু হয়।

তার উচ্চপদস্থ মুইজউদ্দিন মুহাম্মদ নিহত হওয়ার পর আইবেক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। আইবেকের শাসন স্বল্পস্থায়ী ছিল। ১২১০ সালে তিনি মারা যান। তার ছেলে আরাম শাহ ক্ষমতা লাভ করেন। ১২১১ সালে তিনি ইলতুতমিশের হাতে নিহত হন।

ইলতুতমিশ তার সালতানাতের সাথে আব্বাসীয় খিলাফতের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি চেঙ্গিস খান ও তার বংশধরদের আক্রমণ থেকে ভারতকে রক্ষা করতে সফল হয়েছিলেন। গিয়াসউদ্দিন বলবন চাগতাই খানাত ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহীদের থেকে সালতানাতকে সুরক্ষিত করতে সফল হন।জালালউদ্দিন ফিরোজ খিলজি কর্তৃক সর্বশেষ মামলুক শাসক ও বলবনের নাতি মুইজউদিন কায়কোবাদ ক্ষমতাচ্যুত হলে খিলজি রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়।

জালালউদ্দিন খিলজি (শাসনকাল ১২৯০-১২৯৬; মৃত্যু ১৯শে জুলাই ১২৯৬) ছিলেন খিলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম সুলতান, এই বংশ ১২৯০ থেকে ১৩২০ সাল পর্যন্ত দিল্লির সুলতানি শাসন করেছিল। ফিরুজ নামে পরিচিত, জালালউদ্দিন মামলুক রাজবংশের আধিকারিক হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তিনি সুলতান মুইজউদ্দীন কায়কাবাদের রাজসভায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ অধিকার করেছিলেন। কায়কাবাদ পক্ষাঘাতগ্রস্থ হওয়ার পরে একদল গণ্যমান্য ব্যক্তি তাঁর নবজাত পুত্র শামসুদ্দীন কয়ুমারসকে নতুন সুলতান হিসাবে নিয়োগ করে জালালউদ্দিনকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। পরিবর্তে, জালালউদ্দিন তাদের হত্যা করে নিজে বকলমে শাসক হয়ে বসেছিলেন। কয়েক মাস পরে, তিনি কয়ুমারস কে সরিয়ে নিজে নতুন সুলতান হয়ে বসেন।জালালউদ্দিন খিলজি উপজাতির একজন তুর্ক মানুষ ছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা তুর্কিস্তান থেকে বর্তমান আফগানিস্তানে চলে এসেছিলেন, যেখানে তাঁরা ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হেলমান্দ এবং লাঘমান প্রদেশে বাস করছিলেন। তাঁরা সেখানে স্থানীয় আফগানদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আফগানিস্তানের রীতিনীতি ও আচার ব্যবহার গ্রহণ করেছিলেন। এ কারণেই, যখন তাঁর পরিবার ভারতে পাড়ি জমায়, তখন দিল্লির তুর্কি অভিজাতরা তাঁদের আফগান বলে মনে করেছিলেন। সিংহাসনে আরোহণের আগে জালালউদ্দিন পরিচিত ছিলেন মালিক ফিরুজ নামে। তিনি এবং তাঁর ভাই শিহাবুদ্দিন (আলাউদ্দিন খিলজির পিতা) বেশ কয়েক বছর ধরে দিল্লির সুলতান বলবনের সেবা করেছিলেন। ১২৮৭ সালে বলবনের মৃত্যুর পরে, দিল্লির কোতোয়াল মালিক আল-উমারা ফখরুদ্দিন, বলবনের কিশোর নাতি মুইজউদ্দিন কায়কাবাদকে (বা কায়কুবাদ) সরিয়ে সিংহাসন দখল করেন। কায়কাবাদ একজন দুর্বল শাসক ছিলেন, এবং প্রশাসন মূলত তাঁর আধিকারিক মালিক নিজামুদ্দিন পরিচালনা করতেন।

সুলতান হিসাবে, তিনি একটি মঙ্গোল আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন, এবং অনেক মঙ্গোলকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পরে ভারতে বসতি স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিলেন। মঙ্গলরা পাঁচবার ভারত আক্রমন করেছিল, ১২২১ সালে গ্রেট খান (চেঙ্গিস) তিনি ভারত সিমান্ত থেকে ফিরে যান জালাল উদ্দিন আত্মরক্ষার জন্য পাঞ্জাবে পালিয়ে যাওয়ায়, মোঙ্গলদের নীতি অনুযায়ী তারা সাম্রাজ্য সোজা বিস্তার করতো ও ১২৯২ সালে আব্দুল্লাহ তাকে পরাজিত করে আলাউদ্দিন খলজি ..১২৯৯সালে দবাখাঁ আবার কিন্তু জাফর খাঁ যুদ্ধে নিহত হন ও মঙ্গলদের বিতারিত করেন। ১৩০৫ সালে আলিবেগ কে গাজী মালিক প্রতিহত করে ১৩০৭ সালে ইকবাল মন্দ তা আলাউদ্দিন প্রতিহত করেছিল .., তা কোন বাহাদুরী নয় সে সময় মোঘল রা ভারতের নানা স্থানে শাসন করতো তাদের সাথে যুদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক.. কিন্তু তখন মোঙ্গলরা ওতো শক্তিশালী ছিল না কারন ১২৫৯ সালে মঙ্গু খানের মৃত্যু হয়। ১২৯৪ সালের মধ্যে তাদের সাম্রাজ্য চারভাগে বিভক্ত হয়- ১. ইউয়ান সাম্রাজ্য ২। চাগতাই খানাত ৩. সোনালি সাম্রাজ্য, ৪। ইলখানদের এলাকা।

মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে তাতার বাহিনী নামে পরিচিত ছিল মোঙ্গল বাহিনী। ১২০৬ সালে চেঙ্গিস খানকে মঙ্গোলিয়ার স্তেপের একচ্ছত্র অধিপতি বা গ্রেট খান হিসাবে ঘোষণা করার পর মোঙ্গল বাহিনী একে একে জয় করে নিয়েছিল এশিয়া ও ইউরোপ বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের মালিক ছিল মোঙ্গলরা। চেঙ্গিসখানের সময় থেকে শুরু হওয়া মোঙ্গলদের জয়যাত্রা অব্যাহত ছিল পরবর্তী গ্রেট খানদের সময়ও। ভাবতে অবাক লাগে ১২০৬ সাল থেকে ১২৬০ সাল এই অর্ধশত বছরে তাঁরা  একটি যুদ্ধেও হারেন নি। বাগদাদ, সমরখন্দ, বেইজিং, বুখারা, আলেপ্পোর মত বড় বড় শহর তাতারি হামলায় মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল। কি পূর্ব কি পশ্চিম এমন একটিও রাজ্য ছিলনা যারা মোঙ্গলদের গতি পথে বিন্দুমাত্র বাঁধা সৃষ্টি করতে পেরেছিল। বিশ্বজয়ের যে আকাঙ্খা অপূর্ণ রেখে মারা গিয়েছিলেন চেঙ্গিস খান, তার পুত্র ও পৌত্ররা সেইটার যেন সত্য করতে যাচ্ছিলেন। তাঁদের বর্বরতায় ইউরোপ ও এশিয়ার কোটি কোটি নিরীহ মানুষ প্রাণ দিয়েছ অনেকটা বিনা প্রতিরোধে। তাই সারা দুনিয়ার মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল মোঙ্গলদের  থামানো বোধ হয় অসম্ভব। কিন্তু ১২৬০ সালে হঠাৎই থেমে গেল অপ্রতিরোধ্য মোঙ্গলদের জয়রথ। এক অসাধ্য সাধন হল ফিলিস্তিনের গাজার অদূরে আইন জালুত প্রান্তরে। মোঙ্গল প্রথম পরাজয়ে সেই অবিশ্বাস্য কাহিনী নিয়ে লেখা হয়েছে এই প্রতিবেদনটি।


মোঙ্গলদের উত্থানের যুগে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো বেশ কয়েকটি ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন রাজ্যে বিভক্ত ছিল যেটা ইসলামের উত্থানের শুরু থেকে তখন পর্যন্ত ৬০০ বছরের ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। ইসলামী খিলাফত তখন আব্বাসীয়দের হাতে। নাম মাত্র আব্বাসীয় খলিফাদের রাজধানী ছিল বাগদাদে। খলিফা হারুন উর রশিদ, খলিফা মুহতাসিম বিল্লাহ কিংবা খলিফা মামুন, মনসুর ও মুন্তাসিরদের পরাক্রম তখন কেবলই কিংবন্তি। বাস্তবের আব্বাসীয় শাসকরা আধ্যাত্নিক কিংবা সামরিক কোন ক্ষেত্রেই পূর্বসুরীদের ধারের কাছেও ছিলেন না। আব্বাসীয় খিলাফত তখন অন্তর কোন্দল এবং ভোগবিলাসে মত্ত। এরকম অবস্থায় মোঙ্গলদের গ্রেট খান ছিলেন মঙ্গে খান। তাঁরই ভাই হালাকু তখন মধ্যপ্রাচ্যে মোঙ্গল বাহিনীর দায়িত্বে। বৌদ্ধধর্মে দিক্ষিত হালাকু খান ধর্মীয় কারণে সুনজরে দেখতেন না বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতকে। তার উপর আব্বাসীয় খিলাফিতের সঞ্চিত রাশি রাশি ধন ভান্ডার হালাকু খানকে প্ররোচিত করেছিল বাগদাদ আক্রমণে। হালাকু খানের আক্রমণে মাটির সাথে মিশে যায় বাগদাদ। ইতিহাসের নজিরবিহীন বর্বরতায় বাগদাদে প্রাণ হারান প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ।

শুধু বাগদাদ ধ্বংস করেই হালাকু খানের বাহিনী থেমে থাকেনি। ইরাক থেকে সিরিয়া হয়ে তাঁরা এগিয়ে চলছিলেন মিশরের দিকে। পথে সিরিয়ার দামেস্ক ও আলেপ্পোর পতন হয় তাঁদের হাতে। সেই শহরের মানুষগুলোকেও বরণ করতে হয়েছিল বাগদাদবাসীর মত ভয়াবহ পরিণতি। মোঙ্গলদের ভয়ে সিরিয়া থেকে পালিয়ে তখন দলে দলে মানুষ আশ্রয় নিচ্ছিল মিশরে। এদিকে হালাকুর পরবর্তী পরিকল্পনা ছিল মিশর দখল করা। কেননা তখনকার সময়ে মিশর জয় করার অর্থ সমগ্র উত্তর আফ্রিকা জয় করে ফেলা। আর উত্তর আফ্রিকা থেকে জিব্রাল্টার হয়ে একবার স্পেনে ঢোকার মানে হল নিমিষেই ইউরোপকে পদানত করা। সেটি করতে পারলেই পূর্ণ হবে পিতামহ চেঙ্গিসের বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন। তাই মোঙ্গলদের বিশ্ব জয়ের স্বপ্নে একমাত্র বাঁধা তখন মিশরের তরুণ মামলুক  সুলতান সাইফউদ্দিন কুতুজ।

মিশর আক্রমণ

সিরিয়া থেকে মিশর আক্রমণের পূর্বে হালাকু খান মোঙ্গলদের স্বভাব সুলভ “হয় আত্মসমর্পণ নয় ভয়াবহ মৃত্যু” এই হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠালেন মিশরের সুলতানের কাছে। সেই চিঠির ভাষা এতটাই ভয়ঙ্কর যে চিঠিটি প্রিয় পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে দেওয়া হল যাতে বোঝা যায় মোঙ্গলদের হুমকি আসলে কতটা পিলে চমকানো।

আমাদের তরবারির ভয়ে পালিয়ে যাওয়া মিশরের মামলুক সুলতান কুতুজের প্রতি পূর্ব ও পশ্চিমের সকল রাজার রাজাধিরাজ বিশ্বধিপতি খানের ফরমান–

“অন্যদেশগুলোর ভাগ্যে কী ঘটেছিল তোমার সেটা চিন্তা করে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করা উচিত। তুমি শুনেছ কীভাবে আমরা বিশাল বিশাল সাম্রাজ্য জয় করেছি এবং বিশৃখলাময় দূষিত পৃথিবীকে পরিশুদ্ধ করেছি। আমরা বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড জয় করে সেখানকার সব মানুষকে হত্যা করেছি। তাই আমাদের আতংকের হাত থেকে তুমিও পালিয়ে বাঁচতে পারবে না।

তুমি কোথায় লুকাবে? কোন রাস্তায় দিয়ে পালিয়ে যাবে? আমাদের ঘোড়াগুলো যেমন তেজী, আমাদের শরগুলোও তেমন তীক্ষ্ণ। আমাদের তরবারিগুলো বজ্রের মত আর আমাদের হৃদয় পর্বতের মত শক্ত। মরুবালুকার মত আমাদের সৈন্যসংখ্যাও গুণে শেষ করা যাবে না। না কোন দুর্গ আমাদের আটকাতে পারবে, না কোন সৈন্যদল পারবে আমাদের রুখতে। তোমার আল্লাহর কাছে তোমাদের ফরিয়াদ আমাদের বিরুদ্ধে কোন কাজেই আসবে না। কোন শোকের মাতম আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারবেনা, না অশ্রু গলাতে পারবে আমাদের মন। শুধু যারা প্রাণ ভিক্ষা চাইবে তারাই আমাদের হাত থেকে বাঁচতে পারবে।

যুদ্ধের দাবানল ছড়িয়ে পড়ার আগেই তোমার উত্তর পাঠিয়ে দিও। কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলে তার ফল হবে ভয়ঙ্করতম। আমরা তোমাদের মসজিদগুলো ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলব আর তোমাদের রবের দুর্বলতা সবার সমানে প্রকাশ করব তারপর তোমাদের শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাইকে হত্যা করব। মনে রেখ এই মুহুর্তে তোমরা আমদের একমাত্র শত্রু”।

সাইফউদ্দিন কুতুজ ভালভাবেই জানতেন ইতিপূর্বে যারা বিনা যুদ্ধে মোঙ্গলদের ভয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল তাঁদের কী করুণ পরিণতি হয়েছিল। তাই কাপুরুষের মত বিনা যুদ্ধে অপমানের সাথে মারা পড়ার চেয়ে তিনি চাইলেন এই বর্বর বাহিনীকে মোকাবেলা করতে। উপরে উল্লেখ করা চিঠির উত্তরটা সুলতান কুতুজ দিয়েছিলেন মোঙ্গল দূতের শিরশ্ছেদ করে। এর ফলাফলটা সকলের কাছেই নিশ্চয়ই অনুমেয়

অবধারিতভাবে বেঁধে গেল যুদ্ধ। সুলতান কুতুজ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মোঙ্গলদের মোকাবেলা করার। ঠিক সেই সময়ে মিশরে মস্ত বড় ইসলামিক স্কলার ছিলেন শেখ ইজ্জউদ্দিন আব্দুস সালাম । তিনি তার বক্তব্যে সুপষ্টভাবে সুলতান কুতুজের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানালেন এবং জনগণকে দলে দলে কুতুজের বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আহ্বান করলেন। এছাড়া সিরিয়া থেকে আরেক কিংবদন্তী কমান্ডার জহির উদ্দিন বাইবার্স কুতুজের সাথে যোগ দিলেন। এদিকে যাত্রা পথে হালাকু খবর পেলেন তাঁর ভাই গ্রেট খান মঙ্গে মারা গেছেন। তাই ৬ লক্ষ সৈন্যের প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ নিজের সাথে নিয়ে তিনি মংগোলিয়া ফিরে গেলেন গ্রেট খানের শেষকৃত্যে যোগ দিতে। বাকিদের তিনি রেখে গেলেন তাঁর বিশ্বস্ত ও দক্ষ সেনাপতি কিতবুকার অধীনে মিশর আক্রমণের জন্য।

যুদ্ধের অসাধারণ কৌশল

দুর্ধর্ষ মোঙ্গল বাহিনীর মূল শক্তি ছিল তাঁদের ক্ষিপ্রতা এবং দ্রুতগামী ঘোড়াগুলো। এছাড়া ঘোড়ার উপর থেকে তীর ছুড়ে মারার বিশেষ দক্ষতা ছিল তাঁদের যা ইউরোপ ও এশিয়ার সেনাবাহিনীগুলোর ছিলনা। মোঙ্গল ধনুকগুলো ছিল হালকা কিন্তু অসম্ভব শক্তিশালী।  হালকা কিন্তু পাল্লা বেশী হওয়ায় ঘোড়ার উপর চড়েও ব্যবহার যেত ধনুকগুলো।

মোঙ্গলরাদের আরেকটি স্ট্র্যাটেজি ছিল পর পর অনেকগুলো সারিতে বিন্যস্ত না হয়েই যতটা সম্ভব পাশাপাশি দাড়িয়ে হামলা চালানো যাতে সুযোগ বুঝে শত্রু বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা যায়। সুলতান কুতুজ বুঝতে পারলেন চওড়া প্রান্তরে মোঙ্গলদের মুখোমুখি হওয়া মানে সাক্ষাৎ ধ্বংস ঢেকে আনা। তিনি মোঙ্গলদের আগে যুদ্ধ ক্ষেত্র পছন্দ করার সুযোগই দিতে চাইলেন না বরং নিজেই সৈন্য নিয়ে এগিয়ে গেলেন তাঁদের মোকাবেলা করার জন্য এবং বেছে নিলেন ফিলিস্তিনের তাবারিয়ার আইনজালুত প্রান্তর।আইন জালুত প্রান্তরটি এর আগে থেকেই ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত। কারণ ওল্ড টেস্টামেন্টে ডেভিড ও গোলিয়াথের যে যুদ্ধের কথা বলা আছে সেটাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই প্রান্তরেই।

কুতুজ শুরুতেই তার সব সৈন্যদের দিয়ে আক্রমণ করালেন না বরং প্রথমে ছোট একটি দল পাঠিয়ে মোঙ্গল প্ররোচিত করলেন আগে হামলা করার। শুধু তাই নয় তিনি জানতেন তাঁর সিরীয় সৈন্যরা আগেও একবার মোঙ্গলদের কাছে হেরে পালিয়ে এসেছে তাই বিপদে পড়লে এরা আবারও পালাবে। যাতে পালাতে না পারে সেজন্য তিনি এদের রাখলেন সবার সামনে।

যুদ্ধের বর্ণনা

শুরুতে মোঙ্গলদের প্রবল আক্রমণের মুখে কুতুজের সৈন্যদের অবস্থা  ছিল টালমাটাল। তখন সুলতান নিজে শিরস্ত্রাণ খুলে উঁচু জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সৈন্যদের সাহস যোগালেন আর নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন সাধারণ সৈন্যদের মাঝে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য। যেহেতু প্রান্তরটি সরু তাই মোঙ্গলরা তাঁদের পুরনো সেই ট্যাক্টিক্স ব্যবহার করতে পারলনা। উপরন্তু সিরীয় সৈন্যদের ভেদকরে কুতুজের ব্যূহের ভেতরে প্রবেশ করার পর তারা মুখোমুখি হল কুতুজের এলিট বাহিনীর। এদিকে সামনের সারির সিরীয় সৈন্যদের জন্য তাঁরা পিছিয়েও আসতে পারছিলনা। সাথে সাথে দুই পাশ থেকে মোঙ্গলদের উপর নেমে আসল তীর বৃষ্টি। এক পর্যায়ে তাঁদের সেনাপতি কিতবুকা মারা যান। তারপরই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে মোঙ্গল সেনাবাহিনী। পালিয়ে যেতে থাকে দিগ্বিদিক বিক্ষিপ্ত মোঙ্গলরা। কুতুজের সৈন্যরা প্রায় ৬০০ কিলোমিটার তাড়িয়ে শেষ হানাদার সৈন্যটিকেও হত্যা করে। এভাবেই মামলুক সৈন্যদের কাছে পরাজয় ঘটে অহংকারী, বর্বর ও জালিম হালাকু বাহিনীর। নিমিষেই চূর্ণ হয়ে যায় তাঁদের আকাশছোঁয়া দম্ভ।

কেন আইন জালুতের যুদ্ধ এত গুরুত্বপূর্ণ

আইনজালুতের ঐতিহাসিক প্রান্তরে অবসান হয় মোঙ্গলদের অপরাজেয় মিথের। তাঁদের ভয়ে স্বদেশ থেকে পালিয়ে যেতে থাকা হাজার হাজার মানুষ একে একে আবার ফিরে আসতে শুরু করল। এই পরাজয়ের পরও মোঙ্গলরা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল কিন্তু আর কখনই আগের মত সেই মনোবল ফিরে পায়নি তারা। শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নয় পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটি হল আইন জালুতের যুদ্ধ কেননা এই যুদ্ধে সুলতান কুতুজ হেরে গেল উত্তর আফ্রিকা, স্পেন ও ইউরোপ পরিণত হত বাগদাদ, সমরখন্দ ও বেইজিং এর মত বধ্যভুমিতে। আদৌ মানব সভ্যতার ঐ ক্ষত সেরে উঠত কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। তবে বর্বর মোঙ্গল বাহিনীকে রুখে দেওয়ার অনন্য কীর্তির প্রতিদান হিসাবে যে বিশ্ববাসী চিরকাল সুলতান সাইফউদ্দিন কুতুজকে মনে রাখবে সেটা বলে দেওয়া যায় নিঃসন্দেহে।সে সময় মোঘল রা ভারতের নানা স্থানে শাসন করতো তাদের সাথে যুদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক.. কিন্তু তখন মোঙ্গলরা ওতো শক্তিশালী ছিল না কারন ১২৫৯ সালে মঙ্গু খানের মৃত্যু হয়। ১২৯৪ সালের মধ্যে তাদের সাম্রাজ্য চারভাগে বিভক্ত হয়- ১. ইউয়ান সাম্রাজ্য ২। চাগতাই খানাত ৩. সোনালি সাম্রাজ্য, ৪। ইলখানদের এলাকা।

দাক্ষিনাত্যের সুলতান ১৪৯০-১৫৯৬
হৈসল সাম্রাজ্য১০৪০-১৩৪৬
কাকতীয় সাম্রাজ্য১০৮৩-১৩২৩
আহমন সাম্রাজ্য১২২৮-১৮২৬
বিজয়নগর সাম্রাজ্য১৩৩৬-১৬৪৬
মুঘল সাম্রাজ্য১৫২৬-১৮৫৮
পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইবরাহিম লোদির বিরুদ্ধে বাবরের জয়ের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। মির্জা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর সাধারণত বাবরবাবুর নামেই বেশি পরিচিত (ফেব্রুয়ারি ১৪, ১৪৮৩ - ডিসেম্বর ২৬, ১৫৩০) 
রাজত্বকাল২৭শে এপ্রিল ১৫২৬– ৫ই জানুয়ারি ১৫৩১
বাবর একজন গোঁড়া সুন্নি মুসলিম ছিল। সে তার শিয়া মুসলিমদের অপছন্দ করাকে কখনও কখনও ব্যক্ত করেছিল " তাদের বিচ্যুতি " বলে ।যদিও ধর্ম বাবরের জীবনের এক প্রধান স্থান ছিল এবং তার সহযোগী রাজারা ইসলামকে হালকা ভাবে গ্রহণ করেছিল। বাবর তার সমকালীন এক কবির কবিতার একটি লাইন প্রায় উদ্ধৃত করতেন:" আমি মাতাল, আধিকারিক।আমাকে শাস্তি দিন যখন আমি সংযমি। " বাবরের সহযোগী রাজারা মদ পান করতেন এবং প্রাচুর্য্য পূর্ণ ভাবে জীবন যাপন করতেন, তারা বাজারের ছেলের সঙ্গে প্রেমে পড়েছিল এবং তারা হিংস্র এবং নির্মম ছিলেন।বাবরের এক কাকার মতে "অধর্ম এবং পাপকার্জে সে আসক্ত হয়েছিল। সে সমকামিতেও আসক্ত হয়ে পড়েছিল। তার এলাকাতে, যখনই শান্ত কোনো যুবক তার সামনে এসেছে, তাকে পাবার জন্য সে সবকিছু সে করেছিল। তার সময় এই ধরনের সমকামিতা প্রচলিত ছিল এবং সেটা একটি গুণহিসাবে বিবেচনা করা হোতো। । " সে তার মৃত্যূর দুই বছর আগে সুরাপান ত্যাগ করেছিলেন এবং তিনি তার রাজসভায় সকলকে একই কাজ করার দাবী করেছিলেন। কিন্তু সে নিজে আফিং এর নেশা ছাড়তে পারেননি।এবং তার কি বোধ হারানি। বাবর লিখেছিলেন: " সবাই সুরাপান পছন্দ করে ,পান করার জন্য শপথ নেয়,আমি শপথ নিয়েছিলাম এবং অনুতাপ করেছিলাম। "

আবু সা'ইদ ছিলেন তাইমুরের বড় নাতী,মিরান শাহ'র নাতী এবং উলুঘ বেগের ভাগ্নে। তিনি ছিলেন তার ছেলে উমার শেখ মির্জার পুত্র দক্ষিণ এশিয়ায় মুঘল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের দাদা।

                                                                তৈমুরের মৃত্যুকালে তৈমুরি সাম্রাজ্য (১৪০৫)

উমর শেখ মির্জা (১৪৫৬-১৪৯৪ খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত তিনি ফরগনার শাসক ছিলেন। তিনি তৈমুরী সাম্রাজ্যের সুলতান আবু সাঈদ মির্জার চতুর্থ পুত্র ছিলেন তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য ভাগ হয়ে যায় তার চার পুত্রের মধ্যে। তৈমুরী সাম্রাজ্যের কাজাখস্তান এর দ্বায়িত্ব পান ওমর সাঈখ মির্জা , উজবেকিস্তান, ইরান এবং আফগানিস্তান প্রদেশ ছিলো অন্যান্য ভাইদের কাছে। তার প্রথম স্ত্রী ও প্রধান রানী ছিল কুতলুগ নিগার খানম, তিনি ছিলেন চাগাতাই খানাতে রাজকুমারী এবং মঙ্গলীয় শাসক ইউনূস খান এর কন্যা। উমর আরো দুই স্ত্রী ও তিন পুত্র ছিলো ও পাঁচ কন্যা তার স্ত্রী কুতলগ নিগার খানম এর কাছে প্রথম সন্তান হয়েছিল তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মির্জা বাবর তার স্ত্রীদের থেকে কুতলগ নিগার খানম অন্য দুই স্ত্রীর মাধ্যমে দুই সন্তান ছিল, তারা হলো জাহাঙ্গীর মির্জা  নাসির মির্জা তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মির্জা বাবর ভারতভর্ষে ১৫২৫সনে মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন।

তিনি মধ্য এশিয়ার মুসলমান সম্রাট ছিলেন। তার জন্ম উজবেকিস্তান। তিনি ভারত উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট। তিনি তৈমুর লঙ্গ-এর সরাসরি বংশধর এবং মাতার দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। তিনি মির্জা ওমর সাঈখ বেগ এর পুত্র, এবংতৈমুরী শাসক উলুগ বেগ এর প্রপৌত্র ছিলেন। তিনি পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লীর লোদি রাজবংশের সুলতান ইবরাহিম লোদিকে পরাজিত করে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র মির্জা হুমায়ুন সিংহাসনে আরোহণ করেন। পানি পথের যুদ্ধে তিনিই প্রথম কামানের ব্যবহার করেন। তার প্রখর রণকৌশলের কাছে হার মানে ইবরাহিম লোদি।জহির উদ্দিন মোহাম্মদ জন্মেছিলেন ১৪৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ফারগানা প্রদেশের আনদিজান শহরে। ফারগানা বর্তমানে উজবেকিস্তান নামে পরিচিত। তিনি ফারগানা প্রদেশের শাসনকর্তা ওমর মির্জার বড় পুত্র ছিলেন। তার স্ত্রী কুতলুক নিগার আনাম ইউনূস খান এর কন্যা ছিলেন। মঙ্গলদের থেকে উদ্ধুত বারলাস উপজাতিতে বেড়ে উঠলেও বাবরের জাতিতে তুর্কি ও পারস্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ছিল।
এই অঞ্চলগুলো পরবর্তীতে ইসলামিক জাতিতে পরিণত হয় এবং তুরক এস্থান এবং খোরাসান নামে পরিচিত লাভ করে বাবরের মাতৃভাষা ছিল চাঘাতাই যা তার কাছে তুর্কি ভাষা নামে পরিচিত ছিল।
মুঘল সম্রাটরা ছিলেন মধ্য এশিয়ার টার্কো-মঙ্গোল বংশোদ্ভূত। তারা চাগতাই খান ও তৈমুরের মাধ্যমে চেঙ্গিস খানের বংশধর। ১৫৫৬ সালে আকবরের ক্ষমতারোহণের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্রূপদী যুগ শুরু হয়। আকবর ও তারছেলে জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ভারতে অর্থনৈতিক প্রগতি বহুদূর অগ্রসর হয়।


মারাঠা সাম্রাজ্য১৬৭৪-১৮১৮
শিখ রাষ্ট্র১৭১৬-১৮৪৯
শিখ সাম্রাজ্য১৭৯৯-১৮৪৯
ব্রিটিশ ভারত১৮৫৮–১৯৪৭
ভারত ভাগ১৯৪৭–বর্তমান

মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বো‌চ্চ সীমানা, (১৭০৭ সালে)

পোর্ট্রে‌টঅলংকারিক নামজন্ম নামজন্মশাসনকালমৃত্যুটীকা
Babur of India.jpgবাবর
بابر
জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ
ظہیر الدین محمد
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৪৮৩৩০ এপ্রিল ১৫২৬ – ২৬ ডিসেম্বর ১৫৩০২৬ ডিসেম্বর ১৫৩০ (৪৭ বছর)বাবা ও মায়ের দিক থেকে যথাক্রমে তৈমুর লং ও চেঙ্গিস খানের বংশধর। বাবর মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
Humayun of India.jpgহুমায়ুন
ہمایوں
নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন
نصیر الدین محمد ہمایوں
১৭ মার্চ ১৫০৮২৬ ডিসেম্বর ১৫৩০ – ১৭ মে ১৫৪০ এবং ২২ ফেব্রুয়ারি ১৫৫৫ - ২৭ জানুয়ারি ১৫৫৬২৭ জানুয়ারি ১৫৫৬ (৪৭ বছর)সুরি সম্রাট শের শাহ সুরির হাতে ক্ষমতাচ্যুত হন। ১৫৫৫ সালে পুনরায় ক্ষমতাদখলে সক্ষম হন। এর অল্পকাল পর দুর্ঘটনায় মারা যান।
Akbar Shah I of India.jpgআকবর-এ-আজম
اکبر اعظم
জালালউদ্দিন মুহাম্মদ
جلال الدین محمد اکبر
১৪ অক্টোবর ১৫৪২২৭ জানুয়ারি ১৫৫৬ – ২৭ অক্টোবর ১৬০৫২৭ অক্টোবর ১৬০৫ (৬৩ বছর)আকবর ও বৈরাম খান পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করেন। চিতোরগড় অবরোধে আকবর সফল হন। আকবর সাম্রাজ্যকে বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন এবং মুঘল শাসকদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিবেচিত হন। রাজপুত রাজকন্যা মরিয়ম উজ জামানিকে আকবর বিয়ে করেছিলেন। লাহোর দুর্গ আকবরের সময় নির্মিত অন্যতম বিখ্যাত স্থাপনা।তিনি দ্বীন-ই-ইলাহি ধর্মের প্রবর্তক।
Jahangir of India.jpgজাহাঙ্গীর
جہانگیر
নুরউদ্দিন মুহাম্মদ সেলিম
نور الدین محمد سلیم
২০ সেপ্টেম্বর ১৫৬৯১৫ অক্টোবর ১৬০৫ – ৮ নভেম্বর ১৬২৭৮ নভেম্বর ১৬২৭ (৫৮ বছর)মুঘল সম্রাটদের মধ্যে জাহাঙ্গীর সর্বপ্রথম পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি মদ্যপ ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়। তার স্ত্রী সম্রাজ্ঞী নূর জাহান এসময় মূল ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেন।
Shah Jahan I of India.jpgশাহজাহান-এ-আজম
شاہ جہان اعظم
শাহাবউদিন মুহাম্মদ খুররম
شہاب الدین محمد خرم
৫ জানুয়ারি ১৫৯২৮ নভেম্বর ১৬২৭ – ২ আগস্ট ১৬৫৮২২ জানুয়ারি ১৬৬৬ (৭৪ বছর)শাহজাহানের যুগে মুঘল শিল্প ও স্থাপত্য সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌছায়। তিনি তাজমহলদিল্লি জামে মসজিদলালকেল্লাজাহাঙ্গীরের মাজারশালিমার বাগান নির্মাণ করেছেন।
Alamgir I of India.jpgআলমগীর
عالمگیر
মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব
محی الدین محمداورنگزیب
৪ নভেম্বর ১৬১৮৩১ জুলাই ১৬৫৮ – ৩ মার্চ ১৭০৭৩ মার্চ ১৭০৭ (৮৮ বছর)আওরঙ্গজেব শরিয়া আইনের প্রচলন পুনরায় শুরু করেন। ফতোয়া-ই-আলমগীরি নামক আইন সংকলন তার সময় প্রণীত হয়। গোলকুন্ডা সালতানাতের হীরার খনি তিনি জয় করেছিলেন। জীবনের শেষ ২৭ বছরের অধিকাংশ সময় আওরঙ্গজেব বিদ্রোহী মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন। তার শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা সর্বো‌চ্চ পর্যায়ে পৌছায়। ব্যাপক বিস্তৃত সাম্রাজ্য মনসবদারদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হত। তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য বিভিন্ন দিক থেকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। নিজের হাতে কুরআন লিপিবদ্ধ করার জন্য আওরঙ্গজেব অধিক পরিচিত। দক্ষিণাত্যে মারাঠাদের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় তিনি মারা যান।
Muhammad Azam of India.jpgআজম শাহআবুল ফাইজ কুতুবউদ্দিন মুহাম্মদ আজম২৮ জুন ১৬৫৩১৪ মার্চ ১৭০৭ – ৮ জুন ১৭০৭৮ জুন ১৭০৭ (৫৩ বছর)
Bahadur Shah I of India.jpgবাহাদুর শাহকুতুবউদ্দিন মুহাম্মদ মুয়াজ্জম১৪ অক্টোবর ১৬৪৩১৯ জুন ১৭০৭ – ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৭১২২৭ ফেব্রুয়ারি ১৭১২ (৬৮ বছর)তিনি মারাঠাদের সাথে সমঝোতা করেন, রাজপুতদের শান্ত করেন এবং পাঞ্জাবের শিখদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থানে আসেন।
Jahandar Shah of India.jpgজাহানদার শাহমাআজউদ্দিন জাহানদার শাহ বাহাদুর৯ মে ১৬৬১২৭ ফেব্রুয়ারি ১৭১২ – ১১ ফেব্রুয়ারি ১৭১৩১২ ফেব্রুয়ারি ১৭১৩ (৫১ বছর)
Farrukhsiyar of India.jpgফররুখসিয়ারফর‌রুখসিয়ার২০ আগস্ট ১৬৮৫১১ জানুয়ারি ১৭১৩ – ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৭১৯২৯ এপ্রিল ১৭১৯ (৩৩ বছর)১৭১৭ সালে একটি ফরমানের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে শুল্ক ছাড়া বাংলায় বাণিজ্য করার অনুমতি দেন। সৈয়দ ভাইরা তার সময়ে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে।
Rafi ud-Darajat of India.jpgরাফি উল-দারজাতরাফি উল-দারজাত৩০ নভেম্বর ১৬৯৯২৮ ফেব্রুয়ারি – ৬ জুন ১৭১৯৯ জুন ১৭১৯ (১৯ বছর)
Shah Jahan II of India.jpgদ্বিতীয় শাহজাহানরাফি উদ-দৌলতজুন ১৬৯৬৬ জুন ১৭১৯ – ১৯ সেপ্টেম্বর ১৭১৯১৯ সেপ্টেম্বর ১৭১৯ (২৩ বছর)----
Muhammad Shah of India.jpgমুহাম্মদ শাহরোশান আখতার বাহাদুর১৭ আগস্ট ১৭০২২৭ সেপ্টেম্বর ১৭১৯ – ২৬ এপ্রিল ১৭৪৮২৬ এপ্রিল ১৭৪৮ (৪৫ বছর)সৈয়দ ভাইদের হাত থেকে নিস্কৃতি পান। মারাঠাদের সাথে দীর্ঘ লড়াইয়ে দক্ষিণাত্য ও মালওয়া হারান। শাসনামলে নাদির শাহের আক্রমণ হয়। সাম্রাজ্যের উপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম শেষ সম্রাট।
আহমেদ শাহ বাহাদুরআহমেদ শাহ বাহাদুর২৩ ডিসেম্বর ১৭২৫২৬ এপ্রিল ১৭৪৮ – ২ জুন ১৭১ জানুয়ারি ১৭৭৫ (৪৯ বছর)সিকান্দারাবাদের যুদ্ধে মারাঠাদের বিপক্ষে মুঘলদের পরাজয়
Alamgir II of India.jpgদ্বিতীয় আলমগীরআজিজউদ্দিন৬ জুন ১৬৯৯২ জুন ১৭৫৪ – ২৯ নভেম্বর ১৭৫৯২৯ নভেম্বর ১৭৫৯ (৬০ বছর)উজির গাজিউদ্দিন খান ফিরোজ জঙের আধিপত্য
Sin foto.svgতৃতীয় শাহজাহানমুহিউল মিল্লাত১৭১১১০ ডিসেম্বর ১৭৫৯ – ১০ অক্টোবর ১৭৬০১৭৭২
Ali Gauhar of India.jpgদ্বিতীয় শাহ আলমআলি গওহর২৫ জুন ১৭২৮২৪ ডিসেম্বর ১৭৫৯ – ১৯ নভেম্বর ১৮০৬ (৪৬ বছর, ৩৩০ তিন)১৯ নভেম্বর ১৮০৬ (৭৮ বছর)মারাঠারা তাকে মুঘল সম্রাট হিসেবে মেনে নেয়।[৩৩] পরে ১৭৬১ সালে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পর আহমেদ শাহ দুররানি কর্তৃক ভারতের সম্রাট স্বীকৃত হন।[৩৪] ১৭৬৪ সালে মুঘল সম্রাট, আওধের নবাব এবং বাংলা ও বিহারের নবাবের সম্মিলিত শক্তি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হয়। যুদ্ধে পরাজয়ের পর দ্বিতীয় শাহ আলম এলাহাবাদের উদ্দেশ্যে দিল্লি ত্যাগ করেন। এলাহাবাদের চুক্তির মাধ্যমে হানাহানি বন্ধ হয়। ১৭৭২ সালে মারাঠা নিরাপত্তায় তাকে মুঘল সিংহাসনে বসানো হয়।[৩৫] তার শাসনামলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় মুঘল নিজামত বিলুপ্ত করে।
Akbar Shah II of India.jpgদ্বিতীয় আকবর শাহমির্জা আকবর২২ এপ্রিল ১৭৬০১৯ নভেম্বর ১৮০৬ – ২৮ সেপ্টেম্বর ১৮৩৭২৮ সেপ্টেম্বর ১৮৩৭ (৭৭ বছর)ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের পর দ্বিতীয় আকবর শাহ ব্রিটিশ পেনশনভোগী হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ নিরাপত্তায় তিনি আনুষ্ঠানিক প্রধান ছিলেন।
Bahadur Shah II of India.jpgদ্বিতীয় বাহাদুর শাহআবু জাফর সিরাজউদ্দিন মুহাম্মদ বাহাদুর শাহ জাফর২৪ অক্টোবর ১৭৭৫২৮ সেপ্টেম্বর ১৮৩৭ – ১৪ সেপ্টেম্বর ১৮৫৭ (১৯ বছর ৩৫১ দিন)৭ নভেম্বর ১৮৬২শেষ মুঘল সম্রাট। সিপাহী বিদ্রোহের পর তাকে বন্দী করে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেয়া হয়। এর মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘটে। তিনি রেঙ্গুনে মারা যান।

আক্রমণে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র

বেশিরভাগ অশ্বারোহী সৈনিকগণ কাছাকাছি দূরত্বে যুদ্ধ করার জন্য মূলত খাটো অস্ত্রশস্ত্রের (kotah-yaraq) উপর নির্ভরশীল ছিল। এই খাটো অস্ত্রসমূহ মূলত ৫টি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল: ঢাল-তলোয়ার, গদা, যুদ্ধ-কুঠার, বল্লম এবং খঞ্জর। বেশি দূরত্বের আক্রমণের জন্য ব্যবহৃত হতো তীর-কামান, বন্দুক বা তিফাংক এবং পিস্তল। গোলন্দাজ (তোপখানা) বাহিনীতে ব্যবহৃত হতো ক্ষেপণাস্ত্র। স্বাভাবিকভাবেই কোনো ব্যক্তিই একা এসব অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে যেত না বরং একটি বিশাল সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অংশে এসকল অস্ত্রই কারো না কারো দ্বারা ব্যবহৃত হতো। যে পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র একজন মুঘল সেনা ব্যবহার করতো তার বর্ণনা পাওয়া যায় ফ্লিটজক্ল্যারেন্সের জবানিতে। ফ্লিটজক্ল্যারেন্স ছিলেন নিজামের সেনাবাহিনীর একজন ক্ষুদ্র প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা।

তিনি তার প্রতিরক্ষা সহচরকে বলেন:

“চমৎকার অশ্বসজ্জাবিশিষ্ট দুইটি অতীব দৃষ্টিনন্দন ঘোড়া আছে এই জমাদারের, যে কিনা নিজে সোনার লেস দেয়া সবুজ ইংলিশ ব্রড কাপড়ের (দ্বিগুণ চওড়া উন্নতমানের পশমি বস্ত্র) তৈরি পোশাকে শোভিত ছিল এবং তার পরনে আরও ছিল খুবই জাঁকালো কারুকার্যখচিত বেল্ট। মহিষের চামড়ায় তৈরি ও স্বর্ণমণ্ডিত গম্বুজের ন্যায় প্রতিরক্ষাংশযুক্ত একটি ঢাল ছিল তার পিঠে, তার হাতে অস্ত্রহিসেবে ছিল দুইটি তরবারি ও একটি খঞ্জর, ইংলিশ পিস্তল (রিভলভার) রাখার অস্ত্রবন্ধনী, এবং তার বন্দুকটি তার নফরের দ্বারা তার সামনে পরিবাহিত হচ্ছিল।”


তরবারি- 'জুলফিকার'

তরবারি রাখার কোমরবন্ধনীসমূহগুলো সাধারণত ছিল চওড়া এবং খুব সুন্দরভাবে কারুকাজ করা। মুঘল যুগের প্রকৃত সৌন্দর্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ এর তরবারিগুলো। অশ্বারোহীরা কাঁধে ঝোলানো বেল্টের মাধ্যমে তরবারি বহন করতো। তবে বাকীরা তাদের তরবারি তিনটি ফিতেওয়ালা একটি কোমরবন্ধনীতে করেই বহন করতো।

বিভিন্ন রকমের ফলা (ব্লেড)

শাহ্‍জাদা দারা শেকোর তরবারি ও তরবারির খাপ (৮ নং), লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এন্ড আলবার্টস মিউজিয়ামে রাখা।

শমশের- এটি অনেকটা নিমচার (আরব, পারসিক ও তুর্কীদের পুরনো আমলের খাটো, বাঁকা একধারী তলোয়ারবিশেষ ) ন্যায় একটি বাঁকানো অস্ত্র। এর আকৃতি ও এটির হাতলের ক্ষুদ্রাকারই নির্দেশ করে এটি পুরোপুরিই কাটাকাটির উপযুক্ত একটি অস্ত্র। এটি তৈরি হতো স্টিল দিয়ে।

ধূপ- ধূপ একপ্রকার সোজা তরবারি। দক্ষিণাঞ্চল এর এই তরবারিকে মুঘলবাহিনীতে স্থান দেয়া হয়। এই তরবারিটি প্রায় চার ফুট লম্বা এবং বেশ চওড়া ফলার অধিকারী ছিল এবং এর হাতল এর দুইদিকে ছিল আনুভূমিক অতিরিক্ত অংশ যার জন্য এটিকে অনেকটা ক্রসের মতো দেখাতো। সার্বভৌমত্ব ও উচ্চমর্যাদার প্রতীক এই অস্ত্রটিকে নানান রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত করা হতো, যেখানে একজন মানুষ তার মনিবের সামনে মখমলে মোড়া এই তলোয়ারটিকে উঁচুতে তুলে ধরে রাখতো। এছাড়াও দরবারে আসীন ক্ষমতাশালী ব্যক্তির বালিশেও শোভা পেত এই তরবারিটি। এই ধরনের তরবারি সফল সৈনিক, মহান ও অভিজাত ব্যক্তি এবং দরবারের প্রিয়পাত্রদের জন্য উচ্চমর্যাদার বিষয় ছিল। এটিও স্টিল দিয়ে তৈরি ছিল।

  • খান্দাঃ খান্দা একপ্রকার সোজা তরবারি। এটি প্রায় ধূপের ন্যায় দেখতে।
  • সিরোহিঃ এটিও একপ্রকার নিমচাসদৃশ তরবারি। ভারতীয় এই তলোয়ারের ধারাল ফলা দিয়ে কারো মাথায় উল্লম্বভাবে আঘাত করা হলে তা শরীরকে কোমর পর্যন্ত ফালি করে দিতো এবং শরীরে আঘাত করা হলে তা শরীরকে দ্বিখন্ডিত করে দিতে সক্ষম ছিল। এই তরবারির ফলা অনেকটা দামেস্কে ব্যবহৃত ফলার ন্যায় আকৃতির এবং কিছুটা বাঁকানো, সাধারণ তরবারির চেয়ে এটি ছিল হালকা এবং অপেক্ষাকৃত সরু। দামেস্কের ইস্পাত দিয়ে সিরোহী নামক স্থানে এই তরবারিটি তৈরি হতো।
  • পাটাঃ পাটা একপ্রকার সরু ফলাযুক্ত, সোজা তরবারি। এর হাতলের ভেতরে রাখা ক্রসবারের মাধ্যমে এটি ধরতে হতো এবং এর বাহিরের আবরণ ধাতব দস্তানার ন্যায় সুরক্ষা দিতো। এটিও ইস্পাতের তৈরি। মুহররম শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের এখন এ তলোয়ার ঘোরাতে দেখা যায়।
  • গুপ্তিঃ গুপ্তি একপ্রকার সোজা তরবারি যা হাঁটতে সহায়ক লাঠির আবরণের ন্যায় খাপে পুরে রাখা হতো। এটি ছিল তিন ফুট লম্বা এবং এই তরবারির হাতল ও মাথা সুফিদের ব্যবহৃত অস্ত্র ‘ফকিরস ক্রাচ’ এর সাথে মিলসম্পন্ন ছিল। পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের শক্তিমন্ত বিনম্রতার প্রতীক হিসেবে স্টিলনির্মিত এই অস্ত্রটি ব্যবহৃত হতো।
মুঘল ঢালসমূহ
রয়্যাল অন্টারিও মিউজিয়ামে রাখা ইস্পাত, সোনা, সিল্ক . চামড়ার তৈরি সপ্তদশ শতকে প্রস্তুতকৃত মুঘল ঢাল যা উত্তর ভারতে ব্যবহৃত হতো।- DSC04543

একজন তলোয়ারবাজের সরঞ্জামাদির অবিচ্ছেদ্য অংশ তরবারি ও এর সঙ্গী ঢাল। যুদ্ধের সময় বাম হাতে ধরা ঢাল এর এই ব্যবহার শেষ হলে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো। সাধারণত ঢালগুলো চামড়া কিংবা ইস্পাতের তৈরি এবং এর ব্যাস ছিল ১৭-২৪ ইঞ্চির (৪৩০-৬১০ মিলিমিটার) মধ্যে। ইস্পাতের তৈরি ঢালগুলো খুবই জমকালো কারুকার্যপূর্ণ ছিল এবং এই কাজগুলো ছিল সোনা দিয়ে করা। অপরপক্ষে চামড়ার তৈরি ঢালগুলোয় স্বর্ণ ও রৌপ্যমণ্ডিত উঁচু অংশ, অর্ধচন্দ্র অথবা তারকা আকৃতির উঁচু অংশ বসানো থাকতো।কিছু কছু ঢাল সাম্বার হরিণ, মহিষ, নিলগাই, হাতি অথবা গণ্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরি হতো যার মধ্যে গণ্ডারের চামড়ানির্মিত ঢালই বেশি মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত ছিল। ব্রাহ্মণ সেনারা নানান রঙ করা ৪০-৫০ পরত চওড়া সিল্কের তৈরি ঢাল ব্যবহার করতো।

ঢালের নানান প্রকারভেদঃ

  • চিরওয়াহ এবং তিলওয়াহ- এই ঢালগুলো সেসব তলোয়ারবাজ (শমশেরবাজ) অথবা যোদ্ধাবাহিনীর দ্বারা ব্যবহৃত হতো যারা মুঘল সম্রাট আকবরের (১৫৪২-১৬০৫) যুদ্ধযাত্রার সময় তার সঙ্গী হতো।
  • তরবারিযুদ্ধে ব্যবহৃত ঢাল

ছোট গোলাকৃতির এর ঢালগুলি কঞ্চি অথবা বাঁশের তৈরি। এর আকৃতি অনেকটা মসুরডাল এর হওয়ায় এটিকে ডাল হিসেবে ডাকা হতো এটিকে ডাল হিসেবে ডাকা হতো। এছাড়াও মারু বা সিংগৌটা নামক অদ্ভুতুড়ে ঢালগুলো তৈরি হতো কৃষ্ণসার হরিণের শিং ও ইস্পাত সহযোগে। হরিণের শিং মোড়া হতো ইস্পাতে এবং শিংদুটো মিলিত হতো এর ভোঁতা প্রান্তভাগে। সাইন্তি একপ্রকার ঢাল যা অসিযুদ্ধে প্রতিপক্ষের আঘাত ঠেকাতে ব্যবহৃত হতো।

আনুষ্ঠানিক গদা

চোব নামক আনুষ্ঠানিক গদা।
  • গুর্জঃ এটি একপ্রকার খাটো হাতলের গদা যার শেষে তিনটি বড় গোলাকৃতি বল রয়েছে এবং এই অস্ত্রটি সাধারণত বেশ গণ্যমান্য পদমর্যাদার মুঘলযোদ্ধার অস্ত্রাগারের অংশ ছিল।
  • শ্বাসবুরঃ এরই আরেকটি প্রকরণ হলো- শ্বাসবুর তথা ফুসফুসভেদী (ফুসফুস ছিন্নকারী)। এটির অনেকটা গুর্জেরই মতো গোলাকার মাথা ছিল। এছাড়াও এসদৃশ আরো কিছু গদা হচ্ছে- ধারা, গারগাজ এবং খান্ডলি ফাঁসি।
  • ধারাঃ কোলহাপুর থেকে আগত ধারা নামক গদাটির ছয়টি ফলাযুক্ত মাথা এবং অস্টভুজাকৃতির ইস্পাতের সরু-হাতল ছিল। এটি লম্বায় ছিল দু ফুট (০.৬১ মিটার)।
  • গারগাজঃ এটি ছিল ৮ অথবা ৭টি ফলাযুক্ত মাথাবিশিষ্ট এবং এর হাতলের চারিপাশ ঘেরা ছিল ঝুড়ির মতোন অংশে (basket hilt) যা জাতকে সুরক্ষা দিতো। এটি দৈর্ঘ্যে ২.৪-২.১০ ইঞ্চি (৬১-৫৩ মিলিমিটার) ছিল।
  • খুন্ডলি ফাঁসিঃ এটি এটি এক ইঞ্চি (২৫ মিলিমিটার) লম্বা ছিল এবং এর হাতলের মাথা ছিল ফাঁকা ধাতবকারুকাজসম্পন্ন।
  • কস্তনীঃ এটি এমন একপ্রকার অস্ত্র যা পুস্ত-খার (পিঠ খামচে আহতকারো অস্ত্র) এর ন্যায় গদা শ্রেণীভুক্ত। হাতের আকৃতিতে বানানো এই অস্ত্রটি ইস্পাতের তৈরি।
  • খার-ই-মাছই বা ‘মাছের মেরুদন্ডীয় কাঁটাঃ এই গদার সোজা মাথার দুপাশ থেকে ইস্পাতনির্মিত কণ্টকের ন্যায় ধারালো অংশ বেরিয়ে থাকতো।
  • গুজবাগঃ গুজবাগ নামক অস্ত্রটি ছিল হাতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রশিক্ষণ দেবার কাজে ব্যবহৃত এক প্রকার অস্ত্র (অঙ্কুশ)।
যুদ্ধ-কুঠার
১) লাঠির ভেতরে লুকিয়ে রাখা ছোরা (Dagger Crutch বা fakir's crutch) বা ভিক্ষুকের ক্রাচ তথা লাঠি, ২) তাবার (যুদ্ধকুঠার), ৩) অষ্টফলাযুক্ত ঢেউ খেলানো গদা, ৪) তাবার নামক যুদ্ধকুঠার, ৫) জাঘনাল (যুদ্ধকুঠার), ৬) লাঠির ন্যায় তরবারি (মুঘল আমলের)
  • সূঁচাল মাথা এবং দুইধারবিশিষ্ট ফলাওয়ালা কুঠারের নাম ছিল 'জাঘনল' তথা কাকের চঞ্চু।
  • দ্বিমাথাযুক্ত কুঠার যার হাতলের একপাশে চওড়া ফলাবিশিষ্ট এবং অন্যপাশে তীক্ষ্ণ ফলাবিশিষ্ট ব্লেড থাকলে তাকে তাবার জাঘনল বলা হতো।
  • লম্বা হাতলযুক্ত 'তারানগালাহ' নামক আরও একপ্রকারের কুঠারও ব্যবহৃত হতো। তাবারের হাতল ছিল সাধারণ ১৭-২৩ ইঞ্চি (৪৩০-৫৮০ মিলিমিটার) লম্বা এবং এর মাথা ছিল একদিকে ৫-৬ ইঞ্চি (১৩০-১৫০ মিলিমিটার) ও অন্যদিকে ৩-৫ ইঞ্চি (৭৬-১২৭ মিলিমিটার) দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট। কিছু কিছু কুঠারের মাথা ছিল অর্ধচন্দ্রাকৃতির এবং তার হাতলের একটি অংশ ছোরা লুকিয়ে রাখার জন্য ফাঁপা রাখা হতো।
  • ‘বাসোলাহ’ নামক কুঠারটি ছিল অনেকটা বাটালির ন্যায় দেখতে এবং প্রচুর কারুকার্যপূর্ণ রূপোর কুঠারগুলো সভাসদবৃন্দ দরবারে প্রদর্শনার্থে বহন করতেন।
বর্শা
মুঘল আমলের রাইফেল, বর্শা এবং হাতলযুক্ত বাঁকা ফলকওয়ালা ভারী তলোয়ার যা অশ্বারোহীদের দ্বারা ব্যবহৃত হতো।

এই ধরনের অস্ত্রের নানান ধরনের প্রকরণ ছিল। অশ্বারোহী সেনারা সাধারণত ঘোড়সওয়ারদের বিশেষ শর ব্যবহার করতো এবং পদাতিক সেনা ও সম্রাটের দরবার ঘিরে থাকা রক্ষীরা অন্য ধরনের বর্শা ব্যবহার করতো। এছাড়াও জ্যাভেলিন বা খাটো বর্শা, যা ছুঁড়ে মারা যেতো, তারও ব্যবহার থাকার প্রমাণ মিলেছে, বিশেষত মারাঠাদের মধ্যে।

  • নেজাহ্ঃ নেজাহ্ ছোট ইস্পাতনির্মিত মাথা ও লম্বা বাঁশের তৈরি হাতলযুক্ত একপ্রকার অশ্বারোহী সেনার বর্শা যা কিনা নেজাহ্-বাজান (বর্শা-নিক্ষেপক) এ করে বহন করা হতো। মারাঠা অস্ত্রশস্ত্রের ভাণ্ডারেই এই অস্ত্রটি বেশি দেখা যেতো এবং বলা হয় কোনো শত্রুপক্ষের অশ্বসেনাবাহিনীই এগুলোর মুখোমুখি হলে টিকে থাকতে সক্ষম ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রায় ২০,০০০-৩০,০০০ বর্শা শত্রুসেনার উদ্দেশ্যে তৈরি রাখা হতো এবং এগুলোকে এমন আঁটসাঁটভাবে প্রস্তুত রাখা হতো যেন শরবিদ্ধ মানুষের সারির মাঝে কোনো স্থান ফাঁকা (যেখানে বর্শা পৌঁছয়নি) না থাকে। যদি অশ্বারোহী সেনারা এই সকল বর্শা-নিক্ষেপকের ওপর দিয়ে একে অতিক্রম করার চেষ্টা করতো তাহলে এগুলোয় থাকা বর্শার ফলা ও আগুয়ান সেনাদের মাঝে সংঘর্ষ ঘটিত হয়ে সেনারা অশ্বচ্যুত হয়ে যেতো। অশ্বসেনা আক্রমণের সময় যদি নেজাহ্ এর সহিত শত্রুসেনার অস্ত্রের সংঘর্ষ হতো তাহলে তার পরিণামস্বরূপ এতো বেশি জোরে শদব হতো যে প্রতিপক্ষের ঘোড়াগুলো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উল্টো ঘুরে গিয়ে প্রচণ্ড বেগে দৌড়ে পালাতো। সাধারণত অশ্বারোহী একজন মানুষ তার মাথার ওপরে তুলে হাতের বাহুর সাথে সমান্তরালে বর্শা ধরতেন। বাঁশ ও ইস্পাত সহযোগে অস্ত্রটি তৈরি হতো।
  • বার্ছাহ্ঃ বার্ছাহ্‍ও একপ্রকার মুঘল অস্ত্র যা কিনা মারাঠাদের দ্বারাও ব্যবহৃত হতো। লৌহ বা ইস্পাতনির্মিত মাথা ও হাতলযুক্ত এই ভারী বর্শাটি পদাতিক সৈন্যদের দ্বারাই ব্যবহৃত হতো, কেননা, ঘোড়সওয়ারদের ব্যবহারের জন্য এটি বেশ ভারী ছিল।
  • সাঙঃ সাঙ ছিল পুরোপুরি লৌহনির্মিত বর্শা যা সাধারণত বার্ছাহ্ এর চেয়ে খাটো হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা ৭.১১ ফুট (২.১৭ মিটার) পর্যন্তও লম্বা হতো এবং এই লম্বা বর্শাগুলোর মাথার দৈর্ঘ্য ছিল ২.৬ ফুট (০.৭৯ মিটার)। অস্ত্রটির ছিল লম্বা, সরু তিন থেকে চারটি মাথা, ইস্পাতের হাতল এবং এর হাত দিয়ে ধরবার অংশটি ছিল মখমলমোড়া।
  • সাইন্থিঃ এর হাতল ছিল সাঙ এর চেয়ে খাটো আকৃতির।
  • সেলারাহ্ঃ সাইন্থির চেয়ে চেয়ে লম্বা কিন্তু সাঙ এর চেয়ে খাটো মাথা ও হাতলবিশিষ্ট এই বর্শা।
  • বল্লমঃ এই বর্শা তথা শরগুলো ক্রমশ বেঁকে তীক্ষ্ণ হওয়া মাথা ও কাষ্ঠনির্মিত হাতলযুক্ত এবং এগুলো লম্বায় ছিল ৫.১১ ফুট (১.৫৬ মিটার), যার মধ্যে ১৮ ইঞ্চি (৪৬০ মিলিমিটার) ছিলো এর ফলার দৈর্ঘ্য। পদাতিক সৈন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত বল্লম ছিল চওড়া মাথাযুক্ত এক খাটো আকারের বর্শা।
  • পান্ডি-বল্লমঃ শূকর শিকারে ব্যবহৃত এই বর্শাটি অনেকটা Aspidistra elatior গাছের পাতার ন্যায় দেখতে ফলা এবং বাঁশের হাতলে তৈরি ছিল। বর্শাটির সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছিল ৮.৩ ফুট (২.৫ মিটার) যার মধ্যে ফলার দৈর্ঘ্য ছিল ২.৩ ফুট (০.৭০ মিটার)।
  • পাঞ্জমুখঃ পাঁচটি মাথাবিশিষ্ট এই বর্শাটি গুজরাটের লোকেরা ব্যবহার করতো।
  • লাঙ্গেঃ এই একপ্রকার মুঘল শর যা চারটি চারকোনে থাকা মাথা ও একটি ফাঁপা হাতলযুক্ত ছিল।
  • গার্হিয়াঃ এটি ছিল সম্ভবত দীর্ঘ শূলাকৃতির বল্লম, জাভেলিন কিংবা বর্শাশ্রেণীর অস্ত্র।
  • আলমঃ এটি একপ্রকার বর্শা (সুচারুরূপে নিখুঁত বা চমৎকার)।
  • কন্টঃ এক প্রকারের বর্শা।
  • গান্দাসাঃ এটি বড়শির ন্যায় বাঁকানো বর্শা কিংবা প্রান্তভাগে ফলাযুক্ত কুঠার যার ইস্পাতের ফলা লম্বাকৃতির দণ্ডের অগ্রভাগে লাগাবো থাকতো। গ্রামের চৌকিদার বা গ্রাম্য রক্ষীর দ্বারা এটি ব্যবহৃত হতো।
খঞ্জর এবং ছুরি

এগুলো ছিলো নানান আকৃতি ও প্রকারের, যার প্রত্যেকটিই পৃথক পৃথক নামে অভিহিত ছিল।

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে ব্যবহৃত মুঘল সাম্রাজ্যের ছোরা, যার রয়েছে পানির ন্যায় অবয়বযুক্ত ইস্পাতের ফলা এবং নেফ্রাইটের হাতল। হাতলে সোনা, চুনি এবং পান্নাখচিত কারুকার্য রয়েছে। অবস্থান: ফ্রিয়ার গ্যালারি অফ আর্ট- DSC05186
  • কাটারা তথা কাটারিঃ এটি হালকা ওজনবিশিষ্ট আক্রমণে ব্যবহার্য ছোরা যা কিনা অনেকটা ফরাসী poignard (ছোট সরু আকৃতির ছোরাবিশেষ) এর সমতুল্য এবং ভারতে কিছুটা বিচিত্রও বটে। এর হাতলের দুইটি অংশ হাত এবং বাহুর কিঞ্চিৎ অংশকে সুরক্ষা দেবার জন্য বাহু বরাবর দুই পাশে প্রসারিত। এই অস্ত্রটির মোটা ফলা এবং দ্বিমুখী ধারালো কাটার অংশ রয়েছে যা হাতল অংশে প্রস্থে ৩ ইঞ্চি (৭৬ মিলিমিটার) এবং ফলাযুক্ত দৃঢ় অংশে ১ ইঞ্চি (২৫ মিলিমিটার)। এর ফলাটিকে বাঁকানো যেতো না এবং এটি এতটাই শক্ত ছিলো যে ধাতবনির্মিত শক্ত বর্ম ব্যতীত অন্য কোনো কিছুই এটিকে আটকাতে পারতো না। একটি কাটারার পুরো দৈর্ঘ্য ২২ ইঞ্চি (৫৬০ মিলিমিটার) পর্যন্ত হতে পারে যার অর্ধাংশ জুড়েই এর ফলার উপস্থিতি। ফলার ডানদিকে হাতলটির সাথে একটি ক্রসবার যুক্ত ছিল যার মাধ্যমে অস্ত্রটিকে এমনভাবে ধরা যেতো যাতে এটিকে শুধুমাত্র সম্মুখভাগে আঘাত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়।

এই অস্ত্রগুলির কিছু কিছু ছিল হালকা বাঁকানো আবার কিছু ছিলো কাঁটাচামচের ন্যায় ভাগ করা অংশযুক্ত কিংবা দুইটি ফলাযুক্ত। ফলাগুলি হতো নানান রকমের যার দৈর্ঘ্য ৯-১৭.৫ ইঞ্চির (২৩০-৪৪০ মিলিমিটার) এর মধ্যে হতো।

  • জমাধারঃ এগুলির কাটারার ন্যায় একই হাতল থাকলেও এদের ফলাগুলো ছিল চওড়া ও সোজা, যেখানে কাটারার ফলা সোজা বা বাঁকানো উভয় রকমই হতো। জমাধার কাটারির সোজা ফলা এবং তরবারি কিংবা সাধারণ চাকুর ন্যায় হাতল ছিল।
  • খঞ্জরঃ এটিও পয়েগনার্ডের ন্যায় ছোরাবিশেষ যার হাতল ছিল তরবারির ন্যায় এবং এর ফলাগুলো ছিলো দ্বি-বাঁকযুক্ত। অস্ত্রটি ছিল ১২ ইঞ্চি (৩০০ মিলিমিটার) লম্বা। অস্ত্রটির উদ্ভব হয় তুর্কিদের কাছে, তারা এটিকে উঁচু করে তুলে ধরে কিংবা তাদের ডানপাশে বহন করতো। তবে মাঝে মাঝে পারস্যদেশীয় লোকজন ও ভারতীয়রাও এটি পরিধান করতো এবং ভারতীয়রা বাঁ পাশে এটিকে বহন করতো। এগুলো ছিলো চার প্রকারের্: জামহাক, ঝাম্বওয়াহ্, বাঙ্ক এবং নরসিং মথ। এগুলোর প্রতিটিই প্রায় খঞ্জরের ন্যায় দেখতে ছিল যদিও কিছু খোটখাটো ব্যতিক্রম পাওয়া যেতো। প্রধানত তুর্কিরা ব্যবহার করতো, কখনো কখনো পারস্যদেশীয় ও ভারতীয়রাও।
  • বিছুয়া এবং খাপওয়াহ্ঃ বিছুয়া অর্থ বিচ্ছু, এই ধরনের ছুরিগুলোর বেশ ঢেউয়ের ন্যায় বাঁকা ফলা ছিল, অপরপক্ষে, খাপওয়াহ্ ছিলো একধরনের ছোরা। এটি দেখতে মারাঠাদের ব্যবহৃত জাম্বওয়াহান্দ এর ন্যায় প্রায় একইরকম ছিল।
  • পেশকাজঃ এটি একপ্রকার চোখা পারস্যের ছোরা যার ফলার ধারালো অংশটি বাঁকানো কিন্তু অন্যপার্শ্ব সোজা (straight back) এবং কোনোপ্রকার আচ্ছাদনবিহীন সোজা হাতলযুক্ত। তবে কখনো কখনো এর ফলা বাঁকানো কিংবা দুবার বাঁকানো থাকতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাতলে সুরক্ষা আচ্ছাদনও থাকতো।
  • কারুদঃ কারুদের আগমন আফগানদের হাত ধরে- এটি অনেকটা কসাইয়ের ছুরির ন্যায় দেখতে এবং এটি খাপে পুরে রাখা হতো। কারুদের সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছিল ২.৬ ফুট (০.৭৯ মিটার), যার মধ্যে এর ফলার দৈর্ঘ্যই ছিল ২ ফুট (০.৬১ মিটার)। ‘গুপ্তি-কারুদ’ নামক ছুরিটি লাঠিতে পুরে লুকিয়ে রাখা হতো এবং কামচি-কারুদ ছিলো চাবুকাকৃতির স্থিতিস্থাপক ছুরি। চাকু বাঁকিয়ে লুকিয়ে রাখা যায় এমন ছুরিবিশেষ (clasp knife) ছিল পাঞ্জাবিদের দ্বারা যুদ্ধে ব্যবহৃত একপ্রকার অস্ত্র।
  • সাইলাবাহ্-ই-ক্বালমাকিঃ কাশঘরের মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত ছুরিবিশেষ। এটি তরবারির ন্যায় লম্বা এবং শের-মাহি নামক (lion-fish) মাছের হাড় দিয়ে তৈরি হাতল বিশিষ্ট এই ধারালো অস্ত্রটি ‘আসোব’ তথা কাঁধ থেকে ঝোলানো বেল্টে ঝুলিয়ে বহন করা হতো। এই যুদ্ধ-ছুরিটি কাশঘরের লোকেরা ব্যবহার করতো।

ক্ষেপণাস্ত্রসমূহ

তীর-ধনুক, ম্যাচলক বন্দুক, পিস্তল এবং কামানসহ চার ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের অস্তিত্ব ছিল। অশ্বারোহী সৈন্যদের কাছে প্রধানত ধনুক থাকতো কেননা মুঘল অশ্বারোহী সেনারা তাদের ধনুর্বিদ্যার জন্য সর্বজনবিদিত ছিল। কথিত কিংবদন্তী আছে যে, তীর ও ধনুক সরাসরি জান্নাত থেকে ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল (আ.) এর মাধ্যমে আনিত হয় এবং তিনি সেটি হযরত আদম (আ.) কে দেন। ব্যক্তিগত অস্ত্রগুলো পদমর্যাদার বলে ছিলো এরূপে নিম্ন থেকে উচ্চস্তরে বিভক্ত ছিল: ছোরা, তরবারি, বর্শা এবং সর্বোচ্চ মর্যাদার অস্ত্র তীর-ধনুকবিশিষ্ট সেনা।

যদিও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার তখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, তীর-ধনুকের ব্যবহার এর চমৎকার নির্মাণ কাঠামো ও সহজে ব্যবহার্যতার দরুণ অস্টাদশ শতাব্দী জুড়ে বিরাজ করেছিল। ১৮৫৭ সালে ভারতীয় বিপ্লবের (সিপাহী বিদ্রোহ) সময় বিপ্লবীরা বেশমাত্রায় তীর-ধনুকের ব্যবহার করেছিল।

ম্যাচলক- এটি একপ্রকার ভারী এবং নিঃসন্দেহে কার্যকরী সমরাস্ত্র যা পদাতিক সৈন্যের জন্য বরাদ্দ ছিল যেখানে পিস্তলের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।

মুঘল গোলন্দাজ যুদ্ধাঙ্গনবাহিনী- যদিও এর খরচাপাতির অঙ্কটা অনেক বেশি ছিল তবুও শত্রুপক্ষের লড়াকু যুদ্ধহাতির বিরুদ্ধে এটি অত্যন্ত কার্যকরী ছিল এবং এটির ব্যবহার অনেকগুলি দোদুল্যমান বিজয়কে নিশ্চিত করেছিল। বাবুরের গোলন্দাজবাহিনী ষোড়শ শতাব্দীতে ইব্রাহীম লোদীর সেনাবাহিনীকে পরাভূত করার পর থেকে পরবর্তী মুঘল সম্রাটগণ যুদ্ধাঙ্গনে গোলন্দাজবাহিনীর ব্যবহারকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানসূচক রণাস্ত্র হিসেবে দেখতে শুরু করেন।

তীর-ধনুক
তীর-ধনুক ও হুক্কা-পাইপ হাতে ধরা অবস্থায় মুহম্মদ শাহ্‍ এর দণ্ডায়মান চিত্র।

নিজস্ব অস্ত্রচালনায় পারদর্শী হিসেবে সুবিদিত মুঘল অশ্বসেনারা তীর-ধনুকে সজ্জিতাবস্থায় বন্দুকধারী সৈন্যদের চেয়ে নিক্ষেপক অস্ত্রছোঁড়ায় প্রায় তিনগুণ দ্রুত ছিলেন।

আদর্শ মুঘল তীর-কামান (ধনুক) ছিল প্রায় ৪ ফুট (১.২ মিটার) লম্বা এবং দ্বিবাঁকযুক্ত আকৃতির, যার হাতে ধরার স্থল ছিল মখমলে মোড়া। প্রাণীর শিং, কাঠ, বাঁশ, হাতির দাঁত এবং কখনো কখনো ইস্পাত দিয়েও এটি তৈরি করা হতো।

কয়েক ছড়া মোটা তার দিয়ে টানা হতো মুঘল ধনুকের অবতল পার্শ্ব (টানাবস্থায় উত্তল) যেন তা স্থিতিস্থাপকতা ও বলের যোগান দেয়। তীরের পেটের অংশটি ছিলো সুন্দরভাবে ঘন কালো রঙে পালিশ করা মহিষ কিংবা জংলি ছাগলের শিং দিয়ে তৈরি। এর সাথে শক্ত কাঠের পাতলা পাতের ন্যায় অংশ আঠা দিয়ে লাগানো থাকতো। ধনুকের অগ্র ও পশ্চাত্‍ শীর্ষে চল অনুসারে সাপের মাথার আকৃতি দেয়া হতো, শিং এর তৈরি অংশটিতে কোনো কারুকার্য করা হতো না এবং কাঠের তৈরি পিঠের অংশ সোনায় মোড়ানো পাখি, ফুল-ফল, লতাপাতা ইত্যাদির চিত্রবিচিত্র বক্ররেখা-বিজাড়িত অলংকরণে শোভিত ছিল। পর্যটকদের বহনকৃত ভারতীয় ধনুক প্রদর্শনী কিংবা বিনোদনকার্যে ব্যবহৃত হতো। এই ধরনের ধনুকগুলো মহিষের শিং দিয়ে তৈরি হতো, দুইটি একই রকমভাবে বাঁকা শিং বাঁকিয়ে এটি তৈরি করা হতো যার প্রতিটির বাইরের দিকের প্রান্তভাগে কাঠের তৈরি সূক্ষ অগ্রভাগ ছিল জ্যা পরাবার কাজে ব্যবহারের জন্য। শিং দুটির অপর প্রান্তভাগের অংশদুটি একসাথে এনে শক্ত কাঠের টুকরোর সাথে কষে বেঁধে ফেলা হতো। এই কাঠের টুকরোটি ধনুকের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতো এবং এটিকে বাম হাত দিয়ে ধরা হতো। ধনুক তৈরির পর এগুলোকে মাপমতো প্রাণীজ তন্তুওতে মোড়ানো হতো এবং তার ওপর মিহি দড়ি মুড়ে পাতলা আবরণ দেয়া হতো অন্তিম কার্য হিসেবে রঙ ও বার্নিশের চূড়ান্ত প্রলেপ দেয়ার পূর্বে। ধনুর্গুণ বা জ্যাগুলো কখনো কখনো সাদা সিল্কের শক্তিশালী সুতো দিয়ে তৈরি হতো যা পরষ্পর পেঁচিয়ে ১.২৫ সেন্টিমিটার (০.৪৯ ইঞ্চি) ব্যাসার্ধের সিলিন্ডারের ন্যায় আকৃতি তৈরি করতো। একই বস্তু দ্বারা মধ্যিখানে তিন থেকে চার ইঞ্চি পেঁচানো হতো এবং এই মধ্যভাগেই রক্তাভ লাল কিংবা অন্যরঙের বড় বড় ফাঁসযুক্ত বস্তু জটিল গিঁটের মাধ্যমে যুক্ত থাকতো। এই জাঁকালো ফাঁসগুলো তখন সাদা সিল্কের বিপরীতে লক্ষণীয় রঙবৈচিত্র্য প্রকাশ করতো।

ধনুকের জ্যা যেখানে লাগানো হতো সেই অংশটি মূল্যবান রত্নপাথরখচিত বড় রিং আকৃতির হতো এবং এই মূল্যবান রত্নটি পদমর্যাদার পদাধিকারবল অনুসারে নানাবিধ হতো যেমন: স্ফটিক, জেডপাথর, হাতির দাঁত, শিং, মাছের কাঁটা/হাড়, সোনা কিংবা লৌহ।

বিশেষায়িত ধনুক
  • চার্খঃ এটি একপ্রকার আড়ধনুক যা চার্খ গোত্রীয় মানুষেরা ব্যবহার করতো।
  • তক্ষ কামানঃ এটি একপ্রকার ছোট ধনুক।
  • কামান-ই-গুরোহাহ্ঃ এটি আধুনিক গুলতির ন্যায় ছোট ছোট গুলি ছোঁড়ার ধনুক যা ছোট ছেলেরা পরিণতপ্রায় ফসলের থেকে পাখি তাড়াতে ব্যবহার করতো।
  • গোভানঃ এগুলোও গুলতির ন্যায় যেগুলো বানদাহ্ এর নেতৃত্বে শিখদের ১৭১০ সালে করা আক্রমণ থেকে জালালাবাদ শহরের প্রতিরক্ষাকল্পে গ্রামবাসী সমবেত হবার সময় সাথে এনেছিল।
  • কামথাহ্ঃ মধ্যভারতের ভীল জনগোষ্ঠীর দ্বারা ব্যবহৃত লম্বা ধনুকবিশেষ। এরা ধনুকটিকে তাদের পা দিয়ে ধরে ধনুর্গুণ (চিল্লাহ্) হাত দিয়ে টেনে ধরে এবং এতটাই শক্তি দিয়ে তীর ছুঁড়তে পারে যে তা হাতির চামড়া পর্যন্ত ভেদ করে যেতে পারে। ভীলদের প্রধান অস্ত্র ছিল কাম্পতি তথা বাঁশের ধনুক, যার জ্যা ছিল বাঁশের স্থিতিস্থাপক ছালের তৈরি পাতলা অংশ। ৬০টি কাঁটাযুক্ত তীর যা তূণীর ভেতর একগজ লম্বা, এবং যেগুলি মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত হতো সেগুলোয় হাতলের সাথে চোখা মাথাযুক্ত ছিল যেটি মাছের গায়ে আঘাত করতো। তীরের মাথা এবং হাতল লম্বা সূত্রের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকতো যেন পানির পৃষ্ঠদেশে হাতলটি ভেসে থাকে।
  • নওয়াকঃ এটি একপ্রকার চোঙবিশেষ যার মধ্য দিয়ে তীর ছোঁড়া হতো, নওয়াক পাখি মারার কাজে ব্যবহার করা হতো। এটি হয় একটি আড়ধনুকের ন্যায় কিংবা কিছুটা সাধারণ ধনুকের অংশবিশেষের ন্যায় দেখতে। এটি মালয়দের তৈরি ফুঁ দিয়ে বিষাক্ত তীর ছোড়ার ফুঁ-চোঙ নয়। এটির চোঙের বিভিন্ন নমুনা থেকে এর দৈর্ঘ্য পাওয়া গেছে ৬.৬-৭.৬ ফুট (২-২.৩ মিটার) এবং এতে তারা একফুট লম্বা তীর ব্যবহার করতো।
  • তুফাক-ই-দাহানঃ এটি একপ্রকার ফুঁ-চোঙ যা ফাঁপা চোঙাকৃতির অংশ দিয়ে দম তথা বাতাসের জোরে কাদামাটির ছোট বল ছুঁড়তে ব্যবহৃত হতো।

তীরগুলো ছিল দুই প্রকৃতির: সাধারণকার্যে ব্যবহার্যগুলি তৈরির নিমিত্তে নলখাগড়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং যেগুলো বাঘের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতো সেগুলি ছিলো কাঠের হাতলবিশিষ্ট। নলখাগড়াভিত্তিক তীরগুলির মাথা রজনের মাধ্যমে হাতলে লাগানো থাকতো এবং কাঠের হাতলযুক্ত তীরের ক্ষেত্রে হাতলে ছিদ্র করে লোহিত-তপ্ত তীরের মাথা সেখানে বলপূর্বক ঢুকিয়ে দেয়া হতো। ভারতীয় জাদুঘরের কিছু কিছু তীর. (ব্যাখ্যা প্রয়োজন কোনগুলির) ২.৪ ফুট (০.৭৩ মিটার) লম্বা, একটি উদাহরণস্বরূপ, ১৮৫৭ সালে লখনৌতে পাওয়া একটি তীর, ছয় ফুট (১.৮ মিটার) পর্যন্ত লম্বা ছিল এবং এর জন্য স্বাভাবিক গড়পড়তা ধনুকের চেয়ে বড় আকৃতির ধনুক প্রয়োজন ছিল। তীরে যে পালকগুলি ব্যবহার করা হতো তা প্রায়শই কালো সাদার মিশেলে হতো (আবলাক), যেখানে তীরের মাথা বা ফলা হতো সাধারণত ইস্পাতের যদিও ভীলরা হাড়নির্মিত তীরের মাথা ব্যবহার করতো।

ম্যাচলক বন্দুক
বৃহৎ আকৃতির ম্যাচলক বন্দুক নিয়ে মুঘল সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা

তুংফাং হিসেবে পরিচিত ম্যাচলক বন্দুকটির আদি অবস্থা থেকে তার প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেন মুঘল সম্রাট আকবর। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এটিকে তীর ধনুকের চেয়ে কম গুরুত্বের চোখে দেখা হতো। ম্যাচলক বন্দুক সাধারণত পদাতিক সেনার এখতিয়ারাধীনই রাখা হতো, যারা কিনা মুঘল সেনাপতিদের তথ্যানুসারে ঘোড়সওয়ার সেনাদের তুলনায় নিম্নস্তরভুক্ত সৈন্য হিসেবে বিবেচিত ছিল। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগের পূর্বে যতদিন না ফরাসী এবং ইংরেজ সেনারা পদাতিক সেনাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং শৃঙ্খলাচর্চা উন্নতির পদক্ষেপ নিলে সেটিকে পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করে ভারতেও এর চল শুরু হয়। সম্রাট আকবরের ম্যাচলক বন্দুকগুলোর দুটি ব্যারেলের দৈর্ঘ্য ছিল দু দুরকম: ৬৬ ইঞ্চি (১,৭০০ মিলিমিটার) এবং ৪১ ইঞ্চি (১,০০০ মিলিমিটার)। গোটানো ইস্পাতের পাত দুইপ্রান্ত ঝালাইয়ের মাধ্যমে একত্রিত করে এগুলোকে তৈরি করা হতো। সম্ভবত এরও আগে দাক্ষিণাত্য মালভূমিতে ফরাসি ও ইংরেজদের সংসর্গে আসার জন্য ফ্লিন্ট-লক অস্ত্র ব্যবহারের সূচনা হয়েছিল।

ম্যাচলকের ব্যারেলগুলোর ধাতব শরীর আরো বিশদ স্বর্ণ ও রৌপ্যের কারুকাজপূর্ণ ছিল, যে অংশটি শরীরে ভর দিয়ে রেখে তা চালাতে হতো (অস্ত্রের হাতল কিংবা ভিত্তি) সেখানে ধাতব নকশা খচিত ছিল কিংবা বার্ণিশ, রঙ কিংবা বিভিন্ন জিনিসের টুকরো দিয়ে তা সাজানো হতো। কখনো কখনো অস্ত্রটির ভিত্তিতে সোনার স্ফীত অংশ খচিত বা শোভিত থাকতো কিংবা পেছনভাগে হাতির দাঁত অথবা আবলুস কাঠের ঢাকনির ন্যায় আবরণ লাগানো থাকতো। ব্যারেল সাধারণত হাতলের সাথে ধাতব চওড়া বন্ধনী কিংবা ইস্পাত, পিতল, রূপা অথবা স্বর্ণের তারের মাধ্যমে যুক্ত থাকতো। চওড়া বন্ধনীগুলো অনেকসময় হতো ছিদ্রযুক্ত কিংবা কখনোবা তাতে খোদাইয়ের কাজ করা থাকতো। ভিত্তি কিংবা হাতলগুলো হতো দুই ধরনের: প্রথমত, সরু, কিঞ্চিত বাঁকা এবং সকল অংশেই সমান প্রস্থযুক্ত এবং দ্বিতীয়ত, নিখুঁতভাবে অনেকটা বাঁকানো এবং হাতে ধরার স্থানে সরু, তবে পশ্চাত্‍ভাগে কিছুটা চওড়া। ব্যবহার ব্যতিরেকে ম্যাচলকগুলোকে রক্তলাল কিংবা সবুজরঙা খোলসে ভরে বহন করা হতো।

পুরো সরঞ্জামাদির সেটটিতে থাকতো একটি পাউডার ধারক, গুলি রাখার থলে, যুদ্ধশিঙা (সিঙ্গরা), পোড়াবার দড়ি, চকমকি পাথর এবং ইস্পাত যেখানে সবমিলিয়ে সম্পূর্ণ জিনিসটি প্রায়শই একটি মখমলের বেল্টে রাখা হতো যাতে করা থাকতো সোনার সূচিকর্ম। যেসব আধারে করে পাউডার এবং মাস্কেট বলসমূহ (একপ্রকারের গুলি) বহন করা হতো সেগুলো ছিল বেশ ভারী এবং তাই বহনের পক্ষে বেশ কস্টকর, এবং যেহেতু মুঘলসেনারা কখনোই কার্তুজ ব্যবহার করেনি তাদের অস্ত্র লোড করতে অপেক্ষাকৃত দেরী হতো। কোনো কোনো সৈন্য একাই প্রায় বিশ গজেরও বেশি আগুন ধরাবার ফিতে বা দড়ি বহন করতো যা কিনা দেখতে অনেকটা প্যাঁচানো সুতোর বলের মতো ছিল।

বিশেষায়িত বন্দুকসমূহ
  • ক্যাইলেটকঃ এক অদ্ভুত ও অত্যন্ত লম্বা এবং ভারী ম্যাচলক বন্দুক। এই বন্দুকটিকে প্রায়ই হাতের বাহুর নিচে পরিবহন করা হতো।
  • জাযাইল বা জাযাইরঃ এগুলো ছিল দুর্গদেয়ালে ব্যবহৃত বন্দুক কিংবা কাঠামোর সাহায্যে বিভিন্নদিকে ঘুরিয়ে ব্যবহার করা যায় এমন তোপ যেগুলো কিনা যুদ্ধসেনাদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলন্দাজবাহিনীর দ্বারা ব্যবহৃত কামানের মাঝামাঝি অস্ত্রবিশেষ এবং এতে এ দুই ধরনের অস্ত্রেরই বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ বিদ্যমান ছিল। জাযাইলের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৭-৮ ফুট (২.১-২.৪ মিটার)। বিভিন্ন ক্যালিবারের (বন্দুকের ব্যারেলের ছিদ্রের ব্যাস) ম্যাচলকগুলো ভারতের স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা দেয়ালে ব্যবহার্য যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো, এগুলো সহজেই ঘুরানো বা নাড়ানো যায় এমন কব্জার ওপর বসানো থাকতো এবং এগুলো থেকে প্রায় এক পাউন্ডেরও (০.৪৫ কেজি) কম ওজনের গোলা ছোঁড়া হতো। যুদ্ধ ময়দানে কখনো কখনো এগুলোকে উটের পিঠে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। দুই বা ততোধিক আউন্স ওজনধারী হতো ভারতীয় জাযাইলের গোলাগুলি।

জিনযাল বা ভারী ম্যাচলক আগ্নেয়াস্ত্রগুলি সাধারণত দুর্গ প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহৃত হতো। এগুলো এক থেকে তিন আউন্স ওজনের গোলা বহনে সক্ষম ছিল। এগুলোর ব্যারেল বা নলগুলো ছিল বৃহদাকার, মধ্যবর্তী কালক্ষেপন ব্যতীত একেবারে ব্যবহার করার পক্ষে বেশ ভারী। অনেকগুলিরই লোহার তৈরি প্রায় এক ফুট লম্বা দাঁড়ার ন্যায় অংশ ছিল, যা সরু মুখনলের অদূরে ক্ষুদ্র পিভটের ওপর যুক্ত ছিল। দেয়াল, ঝোপ কিংবা মাটি যেখানেই রাখা হোক না কেনো এটি ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কাজ করতো। মাটিনির্মিত দুর্গ বিশেষত বুন্দেলখন্ডে, অবরুদ্ধ সেনারা অসাধারণ করদক্ষতার সাথে কাজ করেছিল, এমনকি বেশ অনেক দূরত্বও তারা প্রায় নির্ভুলভাবে মাথায় কিংবা হৃদপিণ্ডের নিকটে নিশানাবিদ্ধ করেছিল যা প্রায় লক্ষ্যচ্যুত হয়নি বললেই চলে। ভারতীয়দের ব্যবহৃত সকল আগ্নেয়াস্ত্রের ছোট বেলনাকৃতির প্রকোষ্ঠ ছিল এবং সেগুলোর ছিদ্র হতো ছোট, বল আকৃতির গুলিগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভরবেগপ্রাপ্ত হতো।

ঘোর-দাহান এক ধরনের জাযাইলের প্রকরণ। এই নাম এর নলের উল্টানো কিংবা চওড়াকৃত মুখকেই নির্দেশ করে।

পিস্তল

পিস্তলগুলিকে ‘তামানচাহ্’ নামে ডাকা হতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে পিস্তল ভারতে ব্যবহৃত হতো, কিছুক্ষেত্রে যে কোনো মূল্যে এর ব্যবহারই প্রচলিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৭২০ সালের অক্টোবর মাসে হুসেইন আলি খানের আত্মীয়- এক তরুণ সৈয়দ, তাঁরই হত্যার উদ্দেশ্যে প্রেরিত এক গুপ্তঘাতককে পিস্তলের এক গুলিতে হত্যা করেন। পিস্তল উচ্চপদস্থ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, খুব কম সংখ্যক সৈন্যেরই ইউরোপীয় পিস্তল এবং তাবানচাহ্ ব্যবহারের সুযোগ ছিল।

  • শেরবাচাহ্ঃ এই ছোট বন্দুক তথা ব্লান্ডারবাস বন্দুকের আগমন ঘটে পিস্তলের পর। সম্ভবত নাদির শাহ্ এর সৈন্যবাহিনী (১৭৩৮) কিংবা আহমাদ শাহ্ আবদালী এর সেনাবাহিনীর (১৭৪৮-১৭৬১) হাত ধরে ভারতবর্ষে এর আগমন ঘটে। অষ্টাদশ শতকের শেষের এক-চতুর্থাংশে লখনৌ এর কার্যে এক দল পারসিক ঘোড়া নিয়োজিত ছিল যেগুলোকে একত্রে ডাকা হতো- ‘শেরবাচাহ্’ নামে। সম্ভবত তারা এই যুদ্ধাস্ত্র থেকেই এই নাম দিয়েছিল, যা দিয়ে তাদের অস্ত্রসজ্জিত করা হতো। কিংবা এই নামের পেছনে তাদের সম্ভাব্য হিংস্রতা এবং শত্রুপক্ষের রক্তের জন্য তাদের রক্তপিপাসু মনোভাবও দায়ী হতে পারে।

গোলন্দাজবাহিনী

রত্নাম্ভর দুর্গ আক্রমণের সময় বলদ কর্তৃক পাহাড়ের ওপরে টেনে তোলা হচ্ছে অবরোধ বন্দুক। Fort[১]

মুঘল সৈন্যবাহিনী বেশ বড় পরিসরের গান পাউডার বা বারুদভিত্তিক অস্ত্র ব্যবহার করতো যেগুলো ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের চেয়ে বড় ছিল। এর মধ্যে রকেট ক্ষেপণাস্ত্র থেকে শুরু করে চলমান বন্দুক এমনকি চৌদ্দ ফুটেরও (৪.৩ মিটার) বেশি লম্বা সুবিশাল কামানও ছিল যা কিনা একদা "বিশ্বের সর্বাধিক বিশালকায় অস্ত্র"[২] হিসেবে বিবেচিত ছিল। এই ধরনের অস্ত্রসস্ত্রসমূহ ভারী এবং হালকা গোলন্দাজবাহিনী আকারে বিভক্ত ছিল।[৩]

যুদ্ধময়দানে ব্যবহৃত চলমান গোলন্দাজবাহিনীকে কিছু কিছু ইতিহাসবিদ মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় সামরিক শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং এসকল সেনাদলকে তাদের অধিকাংশ প্রতিপক্ষের তুলনায় অনন্যভাবে আলাদা হিসেবে গণ্য করেছেন। এছাড়াও এটি ছিল সম্রাটের পদমর্যাদার প্রতীক, তাই সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ যাত্রাগুলোতে গোলন্দাজবাহিনীর একাংশ সর্বদা মুঘল সম্রাটের সঙ্গে সঙ্গে চলতো।[৪] প্রতিপক্ষের হাতিসমূহ যেগুলো কিনা ভারতীয় উপমহাদেশের যুদ্ধগুলোতে অত্যধিক পরিমাণে দেখা যেতো, সেগুলোর মোকাবেলায় মুঘলরা মূলত যুদ্ধক্ষেত্রে গোলন্দাজ সেনাদের ব্যবহার করতো। তবে যদিও কামানের নিশানাভেদ আরো নিখুঁত করার উদ্দেশ্যে সম্রাট আকবর নিজেই ব্যক্তিগতভাবে তার কামানবাহী রথসমূহের নকশা করেন, তবুও মুঘল গোলন্দাজবাহিনীর ছোঁড়া গোলাসমূহ সবচেয়ে কার্যকরী ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের হাতিগুলোকে ভয় দেখাতেই। প্রতিপক্ষ সৈন্যদলে এভাবে সৃষ্টি হওয়া বিশৃঙ্খলাই মুঘল সেনাবাহিনীকে তাদের শত্রুর ওপর বিজয় হাসিলে ভূমিকা রাখতো। প্রাণীজ-উত্‍স থেকে তৈরি কব্জাসমৃদ্ধ ঘুরানো-বাঁকানোয় সক্ষম তোপগুলো মুঘল যুদ্ধবিগ্রহের একটি বৈশিষ্ট্যে পরিণত হতেছিল যার ভিত্তি ছিল ৬.৭ ফুটেরও (২ মিটার) বেশি লম্বা দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট, যা থেকে ছোঁড়া গোলার ব্যাস ৩.৮-৪.৭ ইঞ্চি (৯৯-১১৯ মিলিমিটার)।

                  

 রাজস্থানের মহাযুদ্ধ 

======================
সম্রাট নাগভট্টের পত্র
================
৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমার্ধ। আরব ভূমির উমেদ খলিফার দ্বারা নিয়োজিত তাঁর ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান হামিরা আল হাকামের পত্র এসে উপস্থিত হলো গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট প্রথম নাগভট্টের রাজপ্রাসাদে। পত্রে লিখিত রয়েছে আরব খলিফার সেই বহু পুরাতন আদেশনামা, “হয় পবিত্র আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মহামান্য খলিফার প্রভুত্ব স্বীকার করে ভারতবর্ষে নিজ সাম্রাজ্য যেমন শাসন করছিলেন তেমনই শাসন করো, নতুবা খলিফা বাহিনীর তরবারির নিকট নিজ মাতৃভূমি, ধর্ম আর সংস্কৃতির ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করো”


খলিফার প্রধান সেনাপতির পত্র পাঠ করে যারপরনাই ক্ষিপ্ত হলেন সম্রাট প্রথম নাগভট্ট। সদুর আরবের ধুসর মরুভূমির অধিবাসী এক বিদেশি যবন হামিরার এতো স্পর্ধা যে স্বয়ং ইস্কভাকু সাম্রাজ্যের অধিপতি রঘুপতি রামচন্দ্রের স্মৃতিধন্য বহু শতাব্দী প্রাচীন ভারতবর্ষের ভূমিতে পদার্পণ করে সেই ভূমিরই সনাতন ধর্মাবলম্বী আদি অধিবাসীদের ভীতি প্রদর্শন করে নির্দেশ দান করছেন তাঁদের যবন ধর্ম গ্রহণ করে আরবের যবন খলিফার পদতলে আত্মসমর্পণ করবার। আল হাকামের পত্রটি পাঠ করবার পরে ক্ষিপ্ত সম্রাট নাগভট্ট নিজে পত্র প্রেরণ করলেন উত্তর ও মধ্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের শক্তিশালি সামন্ত এবং অনান্য স্বতন্ত্র রাজাদের। সেই ঐতিহাসিক পত্রে তিনি লিখলেন, ““শ্রবণ করুন আর্যগণ, আর্যবর্তের উত্তর আর পশ্চিম সীমান্তে বহুদূরের মরুভূমিবাসী বর্বর স্মেচ্ছ আরব জাতি বারবার আমাদের পবিত্র ভূমিতে উপদ্রব করছে। সিন্ধ, দেবল, সৌরাষ্ট্র, ভীনমল ও কান্যকুব্জের একাংশ সহ বহু ভারতীয় রাজার রাজত্ব বলপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে সেখানে সনাতন ধর্মের অবলুপ্তি ঘটিয়ে তারা তাঁদের স্মেচ্ছ ধর্মের প্রসার করছে, স্মেচ্ছরা আমাদের নারীহরণ করছে, আমাদের শতাব্দী প্রাচীন সভ্যতা আর সংস্কৃতির পরিচায়ক মন্দিরগুলি দূষিত করছে। আসুন আমার নেতৃত্বে আপনারা সকলে একত্রিত হয়ে এই বর্বর বিজাতীয় আরবদের, আরব সাগরের পরপারে খেঁদিয়ে দিয়ে আসি। আসুন আমরা সকলে একত্রিত হয়ে আর্তত্রান রূপ ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করে ভারতবর্ষের পবিত্রতা আর স্বতন্ত্রতা রক্ষা করি। বিজাতীয় আরবদের দেখিয়ে দেই ভারতীয় অসির শক্তি।”

সম্রাট নাগভট্টের এহেন আবেগপূর্ণ পত্র লাভ করে মানসিকভাবে উদবুদ্ধ হয়ে নিজেদের বিশাল সেনা সমেত অবন্তী নগরে সম্রাটের রাজসভায় এসে উপস্থিত হলেন শাকম্ভরীর সামন্তরাজ প্রথম বিগ্রহরাজ চৌহান (পৃথ্বীরাজ চৌহানের পূর্বপুরুষ), অবন্তির সামন্তরাজ জয়সিংহ বর্মা এবং চিতোরের মৌর্য বংশের রাজাদের সামন্ত সর্দার বাপ্পাদিত্য রাওয়াল (মেবারের গুহিলট রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা)।


বাপ্পা রাওয়ালের উত্থান
================
৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দের গ্রীষ্মকাল। বর্তমান মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নি নগরী। সেই গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কাল থেকেই ইতিহাসের পাতায় প্রসিদ্ধি লাভ করেছে সমৃদ্ধশালী এই প্রাচীন নগরী। উজ্জয়িনি নগরের উত্তরপ্রান্তে সুবিশাল উচ্চতার প্রস্তর দ্বারা নির্মিত শক্তিশালি প্রাকার দ্বারা বেষ্টিত সম্রাট নাগভট্টের সুরম্য শ্বেতপ্রস্তরের রাজপ্রাসাদ। সেই অতিকায় অট্টালিকার মোহনগৃহের অভ্যন্তরে একাধিক মশালের আলোয় আলোকিত সম্রাটের গুপ্ত মন্ত্রণা কক্ষে নিজ নিজ আসনে আসীন সব সামন্ত রাজারা বিধর্মী আরব খলিফার শক্তিশালি আগ্রাসনকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজেদের আসন্ন যুদ্ধাভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। একটি বিখ্যাত বাংলা প্রবাদ বাক্যে রয়েছে, অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। ক্রমে সামন্ত রাজাদের সেই আলোচনা, বাক-বিতণ্ডায় পরিণত হলো। বিজাতীয় বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানের পরিকল্পনা করবার পরিবর্তে ভারতের হিন্দু রাজন্যগণ নিজেরাই নিজেদের মধ্য তীব্র কলহ, বৈরিতা আর দোষারোপে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ঠিক এহেন সময়ে শিঙা ফুঁকে দুই স্বসস্ত্র দ্বাররক্ষী সম্রাট নাগভট্টের আগমনের কথা ঘোষণা করলেন।

ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্ত্রণাকক্ষে প্রবেশ করলেন সম্রাট। সম্রাটের দেহের রঙ শ্যামবর্ণ, মস্তক থেকে কাঁধ পর্যন্ত বিস্তৃত কুঞ্চিত ঘন কেশদাম, ওষ্ঠাধরের উপরে পুরুষ্টু বক্র গোঁফের রেখা, দুই কর্ণযুগলে দুলছে হীরক খচিত সুবর্ণ কুণ্ডল, কণ্ঠে মহার্ঘ্য রত্নহার। সম্রাটের সুদীর্ঘ দেহ সৌষ্ঠবের পুরু কবচের উপরে আচ্ছাদিত লৌহ জালিকা ভেদ করে তাঁর বলিষ্ঠ যৌবনের উদ্দাম শক্তি সমূহ যুক্ত মাংস পেশিগুলো যেন ঠেলে বাইরে উন্মুক্ত হতে চাইছে। সম্রাটের বাম হস্তের অঙ্গুলিগুলো সুদৃঢ় রূপে আঁকড়ে ধরে রয়েছে তাঁর কোমরবন্ধনীতে আবদ্ধ বিশালকায় তীক্ষ্ণধার অসির স্বর্ণখোচিত হাতল।


কক্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সম্রাট নিজের দক্ষিণ হস্ত উপরে উত্থোলিত করে বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বরে কক্ষে বাদানুবাদে ব্যস্ত সকল সামন্তরাজাদের শান্ত হবার আহ্বান জানালেন। কি যেন এক সম্মোহীনি জাদুমন্ত্র ছিল সম্রাটের আদেশে। মুহূর্তের মধ্যেই নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো মন্ত্রণাকক্ষ। এবারে সম্রাট নিজের সিংহাসনে আসীন হয়ে গুরু গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আর্যগণ আপনারা যদি এইভাবে প্রকাশ্যে নিজেদের মধ্যেই বৈরিতা, মনোমালিন্য আর উষ্মা প্রকাশ করেন তাহলে গুপ্তচর মারফৎ একবার আপনাদের এই অনৈক্যের সংবাদ স্মেচ্ছ যবন শিবিরে পৌঁছলে এর কি পরিনাম হবে সেটা উপলব্ধি করতে পারছেন ? আপনাদের অবস্থাও রাজা রাসিল, রাজা দাহির শাহ, হুলি শাহ আর উত্তর ভারতের অনান্য রাজনদের অনুরূপ হবে। আরব ভূমির বিধর্মী স্মেচ্ছদের ক্রীতদাসে পরিণত হবে রাজা রামচন্দ্রের স্মৃতিধন্য ভারতবর্ষ। আপনারা কি আরবের স্মেচ্ছ খলিফা বাহিনীর হাতে নিজ মাতৃভূমিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় দেখতে চান ?”


সম্রাটের প্রশ্ন শুনে নিজের আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন বিশ বছর বর্ষীয় এক তরুণ তরতাজা যুবক। তিনি নতমস্তকে সম্রাটকে অভিবাদন জানিয়ে বিনম্র কণ্ঠে বললেন, “আপনি সম্পূর্ণ সঠিক কথা বলেছেন মহামান্য সম্রাট। আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করছি। আপনি যদি এই অধমকে অভয় দান করেন তাহলে স্মেচ্ছদের বিরুদ্ধে আসন্ন মহাযুদ্ধের জন্য এমন এক পরিকল্পনার কথা জানাতে পারি যার সঠিক রুপায়নে হলে বিধর্মী স্মেচ্ছরা শোচনীয় রূপে পরাজিত হয়ে জীবিত অবস্থায় হয়ে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে পলায়ন মার্গের সন্ধান পাবে না।”

যুবকের দিকে ফিরে তাকালেন সম্রাট নাগভট্ট। যুবকের সুঠাম দেহ, তেজদৃপ্ত চাহনি আর পুরুষ্টু গুম্ফের অন্তরালে তাঁর ইস্পাতকঠিন মুখমণ্ডল দেখলে সহজেই উপলব্ধি হয় ইনি কোন সাধারন যুবা নন। নিশ্চিতরূপে ইনি একজন সুদক্ষ বীর যোদ্ধা। সম্রাট সেই যুবার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “কে আপনি ? নিজের পরিচয় দান করুন।” সম্রাটের প্রশ্নের জবাবে যুবা বিনম্র কণ্ঠে বললেন, “মহামান্য সম্রাট, এই অধমের নাম বাপ্পাদিত্য রাওয়াল। রঘুপতি রামচন্দ্রের সূর্যবংশীয় জাত গুহিলট বংশের ক্ষত্রিয় সন্তান আমি। যুদ্ধ আমার ধমনীর রক্তে প্রবাহিত হয়। বর্তমানে চিত্রকূট দুর্গের (চিতোর কেল্লা) অধিপতি মৌর্য (সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের মৌর্য বংশ নয়, রাজস্থানের মোরি বংশ) বংশের মহারাজ মনুরাজের প্রধান সেনাপতি হিসাবে কর্তব্যরত আমি। মহারাজের নির্দেশে আমি এখানে উপস্থিত হয়েছি স্মেচ্ছদের বিরুদ্ধে আসন্ন মহাযুদ্ধে আপনাকে সাহায্য দান করে ভারত ভূমিতে ধর্মের রক্ষার জন্য।”


সেনাপতি বাপ্পা রাওয়ালের বক্তব্য শ্রবণ করে সম্রাট নাগভট্ট প্রসন্ন চিত্তে বলে উঠলেন, “উত্তম, অতি উত্তম হে বীর যুবা। আপনি পেশ করুন আপনার যুদ্ধের পরিকল্পনা।” স্বয়ং সম্রাটের অভয়বাণী শুনে এবারে বাপ্পা রাওয়াল সর্ব সমক্ষে পেশ করলেন আসন্ন যুদ্ধে নিজের যুদ্ধের পরিকল্পনার কথা। সেই পরিকল্পনা ছিল একেবারে অপ্রচলিত। বাপ্পা রাওয়ালের এহেন যুদ্ধ পরিকল্পনা ইতিপূর্বে গ্রহণ করেননি সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বিখ্যাত মৌর্য রাজবংশ থেকে শুরু করে সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের গুপ্ত সাম্রাজ্য, সম্রাট গৌতমীপুত্র শতকার্নির সাতবাহন সাম্রাজ্য থেকে ভারতবর্ষের অনান্য পরিচিত এবং অপরিচিত রাজা এবং সম্রাটরা। বাপ্পা রাওয়ালের পরিকল্পনা শুনে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে পড়লেন স্বয়ং সম্রাট নাগভট্ট।


বাপ্পা রাওয়ালের যুদ্ধ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠলেন সভায় উপস্থিত অনান্য সামন্ত রাজারা। শাকম্ভরীর সামন্তরাজ প্রথম বিগ্রহরাজ চৌহান নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তীব্র অসন্তোষভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, “চিত্রকূটের সেনাপতির এহেন রণনীতি মেনে নেওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব মহামান্য সম্রাট। এই রণনীতি একেবারে ক্ষাত্রধর্মের বিপরীত। রামায়ণ আর মহাভারত আমাদের শত্রুর সম্মুখে দণ্ডায়মান হয়ে বীরের ন্যায় বুক চিতিয়ে লড়তে আর মরতে শিখিয়েছে। এইভাবে কাপুরুষের মতো অন্তরালে থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত করতে শেখায়নি। ক্ষমা করবেন সম্রাট চিত্রকূটের একজন সামান্য সেনাপতির এহেন কাপুরুষচিত রণনীতি গ্রহণ করতে আমরা অপারগ।”
বিগ্রহরাজ চৌহানের বক্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করে সমস্বরে প্রতিবাদে জানালেন সভায় উপস্থিত অনান্য সামন্তরাজারাও। সম্রাট নাগভট্ট পড়লেন ধর্ম সঙ্কটে। একদিকে চিত্রকূটের তরুণ সেনাপতি বাপ্পা রাওয়ালের এই অভূতপূর্ব রণনীতি তাঁর অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে, কিন্তু অপরদিকে বাপ্পা রাওয়ালের এই রণনীতির বিরুদ্ধে রয়েছে তাঁর সামন্ত রাজাদের তীব্র অসন্তোষ। সামন্ত রাজাদের অসন্তোষ আর ক্ষোভ প্রশমিত করে সকলকে একসূত্রে আবদ্ধ করতে এক নয়া কূটনৈতিক চাল গ্রহণ করলেন তিনি।



মৃগয়া ভূমিতে নয়া যুদ্ধনীতির ঘোষণা
==========================
এই ঘটনার দিন কয়েক পরে দেখা গেল উজ্জয়িনির প্রাসাদে অবস্থানরত সকল সামন্ত রাজা আর সেনাপতিদের নিয়ে সম্রাট যাত্রা করলেন মৃগয়া অভিযানে। তৎকালীন সময়ে এহেন রাজকীয় মৃগয়া যাত্রা খুবই স্বাভাবিক ব্যপার ছিল। জঙ্গলে শিকার অভিযানের সময় এক অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হলেন তাঁরা। একরাতে বাঘ শিকারের উদ্দেশ্যে গহন অরণ্যের অভ্যন্তরে একটি বিশাল বৃক্ষের উপর মাচা বেঁধে মশালের আলোয় তির ধনুক হস্তে শিকারের উদ্দেশ্যে নীরবে অপেক্ষারত ছিলেন সম্রাট নাগভট্ট, রাজা বিগ্রহরাজ এবং জয়সিংহ বর্মা। কিছুক্ষণ পরেই সামনের ঝোপগুলো প্রবলভাবে দুলতে শুরু করলো। হিংস্র নরখাদক শার্দূলের উপস্থিতি টের পেয়ে সজাগ হলেন শিকারিগণ। এমন সময় তাঁদের বিস্ময়াচকিত করে ঝোপের অন্তরাল থেকে দ্রুতগতিতে আত্মপ্রকাশ করলো এক শজারু। শজারুটি বাঁদিকের ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে ডান দিকের ঝোপের দিকে ছুটতে শুরু করলো। কিন্তু শজারুটি তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনোর পূর্বেই বজ্রের ন্যায় ভয়ানক গর্জন করে ঝোপের মধ্যে থেকে এক বিশাল লম্ফ প্রদর্শন করে আত্মপ্রকাশ করলো একটি বিশালকায় ব্যাঘ্র। বাঘটি শজারুর পথরোধ করে দাঁড়িয়ে তাকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি নিতে লাগলো। ঠিক এমন সময় উল্টোদিকের ঝোপের মধ্যে থেকে একটি শম্বর হরিণের মৃদু ধ্বনির আওয়াজ শুনতে পেয়ে শজারুর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সেইদিকে নিজ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বাঘ মহাশয়। বাঘটির এইটুকু অন্যমনস্কতার সুযোগের সম্পূর্ণ সদবহার করে বিপদগ্রস্ত শজারুটি ধনুকের ছিলা থেকে নিক্ষিপ্ত তিরের ন্যায় দ্রুতগতিতে তার প্রবল শত্রুর দিকে ধেয়ে গিয়ে নিজের সর্বশক্তি একত্রিত করে তীক্ষ্ণধার কণ্টকাকীর্ণ শরীরের সাহায্যে প্রবলবেগে আঘাত করলো বাঘের শরীরে। রক্তাক্ত হয়ে উঠলো বাঘের শরীর। এরপর শজারুটি উপরর্যপুরি আরও বার দুয়েক আঘাত করতেই রক্তাক্ত ও আহত বাঘটি কিছুটা ভীত ও বিস্মিত হয়ে আপাতত রণে ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন করলো।


এই দুর্লভ ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে বিস্মিত হলেন শিকারিগণ। ঠিক তখনই নিজের সিদ্ধান্ত স্থির করে নিলেন সম্রাট। পরেরদিন নিজেদের অরন্যে শিবিরের সভায় বসে সম্রাট নাগভট্ট তাঁর সামন্ত রাজাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “আশাকরি আপনারা কাল রাতে বাঘ আর শজারুর অসম যুদ্ধযাত্রা প্রত্যক্ষ করেছেন। এই অসম দ্বন্দ্বযুদ্ধ থেকে কি শিক্ষা গ্রহণ করলেন আপনারা ?” সম্রাটের প্রশ্নের কোন যুৎসই জবাব দান করতে পারলেন না তাঁর সামন্তরাজারা। শেষে সম্রাট নিজেই বলে উঠলেন, “গতকালের বাঘ বনাম শজারুর দ্বন্দ্বযুদ্ধ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে ক্ষাত্র ধর্ম পালন করে সবসময় প্রবল শত্রুর বিপক্ষে সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে আসীন হলে জয়লাভ সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু শজারুর ন্যায় কূট এবং কৌশলী অপ্রচলিত রণনীতি গ্রহণ করে শত্রুকে তার অসতর্ক মুহূর্তে আক্রমণ করলে, নিজে অতিরিক্ত ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন না হয়েও প্রবল শত্রুকে অনায়াসে পরাজিত ও বিতাড়িত করা সম্ভব। এমনকি সেদিন আপনারা যে রামায়ণ, মহাভারতের যুদ্ধনীতির অজুহাত প্রদর্শন করছিলেন সেই রামায়ণ আর মহাভারতেই নির্দেশিত রয়েছে যদুপতি দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণের সেই অমোঘ বাণী, অধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে ধর্মের সংস্থাপনা করবার জন্য সাম-ধাম-দণ্ডভেদ যে কোনো রণনীতিই গ্রহণ করা সম্পূর্ণ বৈধ। শ্রীকৃষ্ণের এই অমোঘ বানীরই প্রতিরূপ আমরা খুঁজে পাই বিখ্যাত মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রতিষ্ঠাপক আচার্য চাণক্যের অর্থশাস্ত্রেও। আমি গুহিলট সেনাপতি বাপ্পা রাওয়ালের নয়া রণনীতির সাথে সম্পূর্ণ একমত। এই মুহূর্তেই আরবের স্মেচ্ছদের বিরুদ্ধে আসন্ন মহাযুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত ভারতীয় বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসাবে আমি বাপ্পা রাওয়ালের নাম ঘোষণা করছি। এবারে আপনারা বলুন আপনাদের কি মতামত ?”
সম্রাটের বক্তব্যের পর চোখ খুলে গেল সকলের। এরপর সর্ব সম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হলো বাপ্পা রাওয়ালের নয়া রণনীতি আর সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসাবেও নিযুক্ত হলেন তিনি।


খলিফা শিবিরে মতভেদ
=================
৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসের মাঝামাঝি সময়। সমগ্র রাজস্থান জুড়ে গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহে অস্থির স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দ থেকে ভূস্বামী আর রাজন্যবর্গও। ঠিক এহেন সময়ে সিন্ধ প্রদেশের পূর্ববর্তী রাজধানি বামনাবাদ বা ব্রাহ্মণ্যবাদের নগরে রাজা দাহির শাহের অধিকৃত রাজপ্রাসাদে অবস্থানরত উমেদ খলিফার তিন প্রধান আরবি হামিরা তামিম-ইবান-জইদ-আল-উঠবি, জুনেদ-ইবান-আবদুল্লা-রেহমান-আল-মুয়ারি আর আল-হাকাম ইবান-আওয়ানা শিবিরে এসে পৌঁছল গুর্জর-প্রতিহার সম্রাট নাগভট্টের জবাবি পত্র। সেই পত্রে লিখিত রয়েছে, “আরবের ভিনদেশি বিধর্মী স্মেচ্ছ যবনদের প্রতি গুর্জর সম্রাট নাগভট্টের কঠোর আদেশ। নিজেদের প্রাণ এবং সম্মান রক্ষা করতে ইচ্ছুক হলে এই পত্র আপনাদের শিবিরে পৌঁছনোর সাথে সাথেই অবিলম্বে নিজেদের শিবির ভঙ্গ করে ভারতবর্ষের পবিত্র ভূমি পরিত্যাগ করে আরব সাগরের পরপারে নিজেদের ধূলি ধূসরিত মরুপ্রান্তরে প্রত্যাবর্তন করুন, অন্যথায় আদেশ অমান্য করলে বেদনাদায়ক মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করুন। আদেশ পালনের জন্য আরবের স্মেচ্ছদের দুই মাস সময়দান করা হলো।”

সম্রাট নাগভট্টের এই পত্র পাঠ করবার পর মতান্তর দেখা দিল আরব শিবিরে। নিজেদের পরিচিত ভূমি থেকে সহস্র মাইল দূরে ভারতবর্ষের অজানা প্রান্তরে এই প্রবল গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যে অপরিচিত প্রবল শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার বিরুদ্ধে অনীহা প্রকাশ করলেন আরব সেনাপতি তামিম-ইবান-জইদ-আল-উঠবি। কিন্তু ভারতবর্ষের বুক থেকে বহু শতাব্দী প্রাচীন সনাতন ধর্ম আর সভ্যতাকে উপড়ে ফেলে ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠা করে উমেদ খলিফার শাসন কায়েম করবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আল-হাকাম ইবান-আওয়ানা বেঁকে বসলেন। তাঁকে সমর্থন করে বসলেন আরেক আরব সেনাপতি জুনেদ-ইবান-আবদুল্লা-রেহমান-আল-মুয়ারি। শেষপর্যন্ত হামিরা আল হাকামের নেতৃত্বে আরব বাহিনী সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্তই গ্রহণ করে আরেকটি পাল্টা পত্র প্রেরণ করলেন উজ্জয়িনিতে সম্রাটের দরবারে।


“হিন্দের কাফের সম্রাটের প্রতি মহামান্য খলিফার সমাচার। আপনি খলিফার আদেশ অমান্য করে নিজেকে মহামান্য আল্লাহর নিকটে সমর্পণ না করে সমগ্র হিন্দের অবস্থা ঘোর সঙ্কটাপন্ন করে তুললেন। এবারে আল্লাহর রোষানলে সম্পূর্ণ রূপে ভস্মীভূত হবে আপনার সাম্রাজ্য। সেই পবিত্র দিনের আর অধিক বিলম্ব নেই যেদিন খলিফার বাহিনী আপনার রাজধানি উজ্জয়নি নগরে প্রবেশ করে আপনার শিরচ্ছেদ করে আপনারই রাজমহলের শীর্ষদেশে খলিফা সাম্রাজ্যের অর্ধ চন্দ্র অঙ্কিত শ্যামবর্ণ ধ্বজ উড্ডীন করবে আর আপনাদের প্রধান উপাসনাস্থল মহাকালেশ্বর মন্দিরকে একটি প্রসিদ্ধ মসজিদে রূপান্তরিত করবে।”
আরব সেনাপতিদের প্রেরিত চরম ওৌধত্বপূর্ণ পত্রটি পাঠ করে সম্রাট নাগভট্ট বুঝতে পারলেন বিনাযুদ্ধে এক সুচাগ্র মেদিনীও ছাড়বে না আরবদেশের স্মেচ্ছ যবনরা। অতএব তিনি এবারে পূর্ণদমে শুরু করলেন আসন্ন মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি।


অল্প কিছুদিনের ব্যবধানেই দেখা গেল সম্রাট নাগভট্টের গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্যের ধ্বজের প্রতিক তলে গুহিলট সেনাপতি বাপ্পা রাওয়ালের নেতৃত্বে সমবেত হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার সেনার এক সুবিশাল চতুরঙ্গ সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনী। সংযুক্ত বাহিনীর প্রথম স্থরে ছিল ধনুকধারী তিরন্দাজ বাহিনী, দ্বিতীয় স্থরে ছিল অসি আর বিশালকায় ভল্লধারী অগ্রিমপন্থী পদাতিক সেনা, তৃতীয় স্থরে ছিল দ্রুতগামীর অশ্বারোহী বাহিনী এবং অন্তিম স্থরে ছিল দৈত্যাকার রণহস্তীর পৃষ্ঠে আসীন গজবাহিনী। যুদ্ধযাত্রার পূর্ববর্তী রাতে উজ্জয়িনি নগরে মশালের আলোয় প্রজ্বলিত সম্রাটের রাজপ্রাসাদের গুপ্ত মন্ত্রণাকক্ষে এসে উপস্থিত হলেন এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। কক্ষে প্রবেশ করে তিনি যুক্তকর হস্তে সম্রাটকে শ্রদ্ধাপূর্বক প্রণাম নিবেদন করলেন। সম্রাট নাগভট্ট সেই ব্যক্তির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রসন্ন চিত্তে বলে উঠলেন, “বলো গুপ্তচর মিহিরভট্ট আরবের স্মেচ্ছ বাহিনীর গতিবিধি সম্বন্ধে কি সংবাদ এনেছো।”


গুপ্তচর মিহিরভট্ট বিনম্র কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আজ্ঞে সম্রাট আরবের খলিফা বাহিনীর তিন প্রধান হামিরা জুনেদ-ইবান-আবদুল্লা, আল-হাকাম ইবান-আওয়ানা আর রেহমান-আল-মুয়ারির মধ্যে তীব্র মত পার্থক্য দেখা গিয়েছে। হামিরা তামিম-ইবান-জইদ-আল-উঠবি এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি তাঁর বিশ হাজার খলিফা সেনা সমেত বামনাবাদ নগরেই অবস্থান করবেন। অপরদিকে বাকি দুই হামিরা আল-হাকাম ইবান-আওয়ানা আর জুনেদ-ইবান-আবদুল্লা-রেহমান-আল-মুয়ারি তাঁদের অবশিষ্ট সেনা সমেত মুলতান হয়ে গুর্জরাত্র রাষ্ট্রের (বর্তমান রাজস্থান আর গুজরাট) দিকে অগ্রসর হবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।”

গুপ্তচরের সংবাদ শুনে সম্রাট নাগভট্ট পুনরায় প্রশ্ন করলেন, “এই মুহূর্তে খলিফার স্মেচ্ছ বাহিনীর সেনা সংখ্যা কত ?”
সম্রাটের প্রশ্নের উত্তরে মিহিরভট্ট বলে উঠলেন, “হুজুর স্মেচ্ছ বাহিনীতে রণহস্তী সম্বলিত কোন গজবাহিনীর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু হামিরা তামিম-ইবান-জইদ তাঁর সেনা সমেত এই যুদ্ধে অংশহগ্রহন না করলেও বাকি দুই হামিরার পদাতিক, তিরন্দাজ আর অশ্বারোহী বাহিনী মিলিয়ে খলিফা বাহিনীর সংখ্যা কমকরেও ৫৫-৬০ হাজারের মতো হবে।”


গুপ্তচরের মুখ নিঃসৃত সংবাদ শুনে সম্রাট যারপরনাই খুশি হয়ে বলে উঠলেন, “উত্তম, অতি উত্তম সংবাদ। রাজপ্রহরী অবিলম্বে গুপ্তচর মিহিরভট্টকে তাঁর মহামূল্যবান সংবাদের জন্য এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার প্রদান করে রাজ অতিথিশালায় ওনার বিশ্রামের ব্যবস্থা করো।”
সম্রাটের খুশি হবার কারণ হলো তাঁর প্রধান সেনাপতি বাপ্পা রাওয়ালের রণ পরিকল্পনা অনুযায়ীই সবকিছু চলছে। ইতিমধ্যেই রণনীতির প্রথম ধাপ অনুসরণ করে সম্রাট নাগভট্টের নির্দেশে গুর্জররাত্রের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের সমস্ত জনপদ লোকশূন্য করে সেখানকার অধিবাসী প্রজাগণকে উজ্জয়নি আর নিকটবর্তী সংলগ্ন এলাকায় সসম্মানে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে। গুর্জররাত্রের জনশূন্য উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের সমস্ত জলাশয়ে মিশ্রিত করা হয়েছে প্রাণঘাতী ভয়ানক বিষ। সম্রাটের সেনারা জনপদের সব খাদ্যভাণ্ডার শূন্য করে সমস্ত শস্য আর খাদ্যদ্রব্য অনত্র স্থান্তরিত করেছে। অগ্নি সংযোগ করে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দেওয়া হয়েছে শস্য-ক্ষেত।
#SR

বেজে উঠলো যুদ্ধের দামামা
====================
পরেরদিন প্রত্যূষে দেখা গেল উজ্জয়নি নগরীর প্রাসাদ কেল্লার অনতিদূরে অস্ত্রশস্ত্র সমেত যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে আরবের খলিফা বাহিনীর বিরুদ্ধে আসন্ন মহাযুদ্ধের যাত্রায় জন্য প্রস্তুত ভারতবর্ষের সুবিশাল সংযুক্ত বাহিনী। কিছুক্ষণের মধ্যেই সংযুক্ত সেনাবাহিনীর সম্মুখে ঢোলক বাজাতে বাজাতে এসে হাজির হলো রাজকীয় বাদ্যকারের দল, তাঁদের পেছনে নিজের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী দ্বারা পরিবৃত হয়ে লৌহপাত আর বর্ম দ্বারা আচ্ছাদিত রাজকীয় রণহস্তীর পৃষ্ঠের হাওদায় আসীন হয়ে উপস্থিত হলেন সম্রাট নাগভট্ট। সম্রাটকে দেখতে পেয়ে প্রধান সেনাপতি বাপ্পা রাওয়াল তাঁর কোষবদ্ধ তরবারি উন্মুক্ত করে শূন্যে উত্থোলিত করে ব্যাঘ্র গর্জনে “হর হর মহাদেব” রণহুংকার দিয়ে উঠলেন। সূর্যালোকে ঝলমল করে উঠলো বাপ্পা রাওয়ালের তরবারির তীক্ষ্ণধার ফলা। প্রধান সেনাপতিকে অনুসরণ করে অবশিষ্ট সৈন্যগণও বজ্র কণ্ঠে “হর হর মহাদেব” শ্লোগান দিয়ে উঠলেন।


নিজের রণহস্তীর পৃষ্ঠদেশ থেকে ভূমিতে অবতরণ করে সম্রাট নাগভট্ট এবারে সংযুক্ত বাহিনীর দিকে নিজের তেজদৃপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বজ্রকঠিন কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আমার প্রিয় সেনাপতি, সামন্ত রাজণগণ আর সেনারা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সম্ভবত ভারতবর্ষের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এক যুদ্ধযাত্রা শুরু করতে চলেছি। শ্রবণ করুন প্রিয় আর্যগণ, ইতিপূর্বেও আপনারা হয়তো নিজ নিজ রাজ্যের বাহিনীর হয়ে একাধিকবার বিভিন্ন যুদ্ধযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু সেসব যুদ্ধযাত্রা ছিল নেহাতই আপনাদের নিজ নিজ রাজ্যের স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে, নিজ নিজ রাজ্যের সীমানার পরিধি বৃদ্ধি আর ক্ষমতা প্রদর্শনের তাগিদে। কিন্তু আজ আপনারা সদুর আরবদেশের এক বহিরাগত শক্তিশালি স্মেচ্ছ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চলেছেন অখণ্ড ভারতবর্ষের বহু শতাব্দী প্রাচীন সনাতন বৈদিক সভ্যতা, ধর্ম আর সংস্কৃতির রক্ষার জন্য, নিজের মাতৃভূমির স্বতন্ত্রতা রক্ষার জন্য, অখণ্ড ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক স্বর্ণোজ্বল যুগ উপহার দেবার জন্য। আর্তত্রানের এই মহাযুদ্ধে আপনাদের নিজ নিজ জাতিসত্ত্বা বিস্মৃত হয়ে ভারতবর্ষের পবিত্র ভূমি থেকে বিধর্মীদের বিনাশ করে ধর্মের স্থাপনা করে লক্ষ লক্ষ অসহায় দেশবাসীকে উদ্ধার করতে হবে আরবের স্মেচ্ছদের অন্যায় আর উৎপীড়নের হাত থেকে, বৈদিক সভ্যতাকে রক্ষা করতে হবে বিনাশের হাত থেকে। আসুন এইক্ষণে আমরা সকলে মিলে প্রতিজ্ঞা করি যে এই আসন্ন মহাযুদ্ধে আরবের খলিফা বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে খেঁদিয়ে দিয়ে আসবো বিস্তীর্ণ আরব সাগরের পরপারে ওদের ধূলি ধূসরিত মরুপ্রান্তরে।” এই পর্যন্ত বলে সম্রাট নাগভট্ট নিজের অসি কোষমুক্ত করে শূন্যে উত্থোলিত করে গর্জন করে উঠলেন, “হর হর মহাদেব।”
সম্রাটকে অনুসরণ করে সংযুক্ত বাহিনীর সেনারাও ভৈরব কণ্ঠে "হর হর মহাদেব" রবে রণহুংকার দিয়ে উঠলো।


খলিফা বাহিনীর যুদ্ধযাত্রা এবং ভারতীয় বাহিনীর ফাঁদ
======================================
এদিকে ভরা গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যে খলিফা বাহিনী মুলতান হয়ে প্রবেশ করলো গুর্জররাত্র প্রদেশে। ক্রমে তাঁরা এসে উপস্থিত হলো মাউন্ট আবুর নিকটে এক বর্ধিষ্ণু জনপদে। দীর্ঘ পথশ্রম আর তীব্র দাবদাহে ইতিমধ্যেই বেশ পরিশ্রান্ত হয়ে উঠেছে খলিফা বাহিনী। খলিফা বাহিনীর রসদে দেখা দিয়েছে জল আর খাদ্যের অভাব। হামিরা আল-হাকাম মনে মনে ভেবেছিলেন এইসব স্থানীয় জনপদের মধ্যে প্রবেশ করে নিজের সেনা দ্বারা বলপূর্বক লুণ্ঠন করবেন স্থানীয় কাফের অধিবাসীদের শস্যভাণ্ডার আর যাবতীয় ধন সম্পদ। কিন্তু এতো একেবারে বিধিবাম। পুরোপুরি জনশূন্য জনপদ একেবারে খাঁখাঁ করছে। লোকালয়ের আবাসনগুলিও একেবারে শূন্য, রসুইখানা এবং ভাঁড়ার ঘরে মজুদ নেই কোন খাদ্য শস্য, আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে ক্ষেত-খামার। এমনকি জনপদে অস্তিত্ব নেই কোন গবাদি পশুরও। ব্যপারটা প্রত্যক্ষ করে বেশ হতাশ হয়েই সেই নিঃস্ব আর রিক্ত জনপদ ত্যাগ করতে বাধ্য হলো খলিফা বাহিনী। এগিয়ে চললো উদয়পুরের দিকে। পথে পড়লো আরেকটি জনপদ। কিন্তু খলিফা বাহিনী সেই জনপদের ভেতরেও প্রবেশ করে দেখতে পেলো পূর্বের ন্যায় অনুরূপ দৃশ্যাবলী। এবারে নিরুপায় হয়ে পড়লো ক্ষুধার্ত আর প্রবল তৃষ্ণার্ত খলিফা সেনারা। সেনাবাহিনীর জনাকয়েক রক্ষী সেই পরিত্যাক্ত জনপদের একপ্রান্তে অবস্থিত একটি বিশাল সরোবর দেখতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। মনপ্রান ভরে আকণ্ঠ পান করলো সরোবরের পানীয় জল। কিন্তু জলপানের অল্প বিলম্বে তাদের শরীরে দেখা দিল তীব্র বিষের ক্রিয়া। সরোবরের জলে মিশ্রিত বিষের প্রভাবে মৃত্যুর মুখে পতিত হলো সেই রক্ষীরা। পানীয় জলের সন্ধান পাবার পর উৎফুল্ল খলিফা বাহিনীর উল্লাস কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিণত হলো বিষাদে। খলিফা বাহিনীর এক বরিষ্ঠ পদাধিকারি সেনা সন্ত্রস্তভাবে দুই হামিরা আল-হাকাম আর রেহমান-আল-মুয়ারির নিকটে এসে আবেদন জানালেন সিন্ধে ফিরে যাবার। কিন্তু সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে পবিত্র ইসলামিক সাম্রাজ্য স্থাপনের খোয়াব দেখা আল-হাকাম তীব্র ভর্ৎসনা করে তাঁকে নিরস্ত্র করে ভারতবর্ষের আরও দক্ষিণপ্রান্তে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন।


কায়দারার গিরিঘাটে প্রথম সংঘর্ষ
========================
ক্ষুধা আর তৃষ্ণা নিয়েই আল-হাকাম আর রেহমান-আল-মুয়ারির নির্দেশে তাঁরা যাত্রা শুরু করলেন গুর্জররাত্রের আরও দক্ষিণ প্রান্তে। সর্বাগ্রে চলেছে ঢোলক আর শিঙাধারী বাদ্যকার দ্বারা পরিবেষ্টিত চাঁদ-তাঁরা অঙ্কিত শ্যামবর্ণ ঝাণ্ডা আর শ্বেতকায় হরফে কলমা অঙ্কিত কৃষ্ণবর্ণ ধ্বজধারী অগণিত পদাতিক বাহিনী, তারপরের সারিতে অশ্বের পৃষ্ঠে আসীন দুই হামিরা সহ ঈদের চাঁদের ন্যায় বক্র তরবারি আর বিশাল ভল্লধারী ঘোড়সওয়ার বাহিনী আর অন্তিম সারিতে রয়েছে তিরন্দাজ বাহিনী। “আল্লাহ-আকবর” ধ্বনিতে চতুর্দিক আলোড়িত করতে করতে একসময় খলিফা বাহিনী তাঁদের সুবিশাল লস্কর সমেত মন্দ্র গতিতে এসে উপস্থিত হলো মাউন্ট আবুর পাদদেশে কায়দারা নামক এক সঙ্কীর্ণ গিরিঘাটে। অতি সন্তর্পণে খলিফা বাহিনী যখন কায়দারা গিরিঘাট অতিক্রম করছে ঠিক এহেন সময়েই গিরিঘাটের দুই বিপরীত প্রান্ত থেকে উঠলো প্রবল ভৈরবধ্বনি, “হর হর মহাদেব, জয় একলিঙ্গনাথ”। তারপরেই গিরিঘাটের দুই প্রান্ত থেকে ধেয়ে এলো কাতারে কাতারে তির। সেইসব তীক্ষ্ণধার শরশয্যার আঘাতে মুহূর্তের মধ্যেই রক্তাপ্লুত অবস্থায় ধরাশায়ী হলো ইসলাম আর খলিফা সাম্রাজের ঝাণ্ডাবাহী বেশ কিছু আরবি সেনা আর বাদ্যকর, ভূলুণ্ঠিত হলো অর্ধ চন্দ্র আর কলমা অঙ্কিত ঝাণ্ডা। এছাড়াও তিরের আঘাতে গুরুতর আহত ও নিহত হলো খলিফা বাহিনীর আরও বহু পদাতিক সেনা। এরপর প্রাথমিক আঘাতটা সামলে নিয়ে খলিফা সেনারা নিজেদের বর্মাবৃত শরীরকে শক্তিশালি লৌহ ঢালের অন্তরালে আত্মগোপন করলো। এদিকে বাপ্পা রাওয়ালের রণ পরিকল্পনা অনুযায়ী খলিফা বাহিনীকে মধ্যপথে স্বাগত জানানোর জন্য, কায়দারা গিরিঘাটের দুই প্রান্তে আরাবল্লি পাহাড়ের অন্তরালে নিজের সেনা সমেত আত্মগোপন করে অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত ছিল সামন্তরাজ জয়সিংহ বর্মা। খলিফা বাহিনীকে এই পথে অগ্রসর হতে দেখে তিনি তাঁর তিরন্দাজদের নির্দেশ দিলেন তির বর্ষণের। জয়সিংহের তিরন্দাজ বাহিনীর শরাঘাতে বিস্ময়ে হতচকিত আরব বাহিনী যখন কিংকর্তব্য বিমুঢ় হয়ে পড়েছে তখন আপাদমস্তক পুরু লৌহবর্ম দ্বারা আবৃত, লৌহ শিরস্ত্রাণ পরিহিত রাজা জয়সিংহ একটি দ্রুতগতির অশ্বেপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে নিজের তরবারি শূন্যে উত্থোলিত করে “জয় একলিঙ্গনাথ” রবে সরব হয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তিরবেগে ধেয়ে গেলেন নিচে খলিফা বাহিনীর দিকে। রাজা জয়সিংহকে অনুসরণ করে তাঁর অবশিষ্ট অশ্বারোহী বাহিনীও প্রবলবেগে ধেয়ে গেলেন খলিফা বাহিনীর দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গিরিঘাটে শুরু হলো রাজপুত বাহিনী এবং খলিফা বাহিনীর এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। জয়সিংহ আর তাঁর দুর্দমনীয় বাহিনীর অসির আঘাতে মৃত্যুমুখে পতিত হলো বেশকিছু খলিফা সেনা। এদিকে ক্ষুদ্র রাজপুত বাহিনীর প্রাথমিক আঘাতটা সামলে নিয়ে এবারে পাল্টা প্রত্যাঘাত শুরু করলো খলিফা বাহিনীও। কিন্তু ততক্ষণে রণ পরিকল্পনা সফল হয়েছে জয়সিংহের। তিনি তাঁর বাহিনীর উদ্দেশ্যে সঙ্কেত দিলেন রণে ভঙ্গ দিয়ে পিছু হটার। জয়সিংহের নির্দেশ পেয়েই তাঁর বাহিনী দ্রুতগতিতে অশ্ব চালনা করে পিছিয়ে গেলেন আরও দক্ষিণপ্রান্তে।


এদিকে রাজা জয়সিংহের এই কৌশলী পশ্চাৎপশরনকে হিন্দুস্থানের কাফের বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজেদের বিজয় বলে ভ্রম করে প্রবল উত্তেজিত হয়ে হামিরা আল-হাকাম জোরালো কণ্ঠে আদেশদান করলেন, “পিছু ধাওয়া করো শয়তান কাফের বাহিনীর। একজন কাফেরও যেন জীবিত পালাতে না পারে।” আল-হাকামের আদেশ শুনে জয়সিংহ আর তাঁর পলাতক বাহিনীর পিছু ধাওয়া করলো খলিফা বাহিনী। কিছুক্ষণের মধ্যেই খলিফা বাহিনী এসে উপস্থিত হলো বর্তমান উদয়পুর শহরের নিকটে দুই দিকে আরাবল্লি পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত একটি বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তরে। এদিকে সূর্য তখন পশ্চিমপ্রান্তের দিকচক্রবালে ঢলে পড়ছে। সন্ধ্যে নামতে আর অধিক বিলম্ব নেই। সম্পূর্ণ অপরিচিত শত্রুভূমিতে আর অগ্রসর হওয়া উচিত হবে না উপলব্ধি করতে পেরে সেই উন্মুক্ত প্রান্তর থেকে কিছুটা দূরে নিজেদের শিবির স্থাপন করলো খলিফা বাহিনী।


খলিফা বাহিনীর দুঃস্বপ্নের রাত
======================
এদিকে সেই প্রান্তরের ওপরদিকে নিজেদের শিবির স্থাপন করে খলিফা বাহিনীকে স্বাগত জানানোর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল সম্রাট নাগভট্টের বাহিনী। সন্ধ্যের মুখে রাজা জয়সিংহ যুদ্ধের পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁর প্রাথমিক কর্তব্য সম্পন্ন করে ফিরে এলেন সম্রাট নাগভট্টের সেনা শিবিরে। তাঁর মুখে সম্রাট আর সেনাপতি বাপ্পা রাওয়াল শুনলেন সব বিবরণ। এরপর শুরু হলো সংযুক্ত বাহিনীর দ্বিতীয় পরিকল্পনার রুপায়ন। সন্ধ্যে নামবার সাথে সাথেই সম্রাটের তাঁর সংযুক্ত বাহিনীর রাজকীয় বাদ্যকারদের নির্দেশ দিলেন প্রবল ধ্বনি সহকারে শুরু করলো ঢাক-ঢোল বাজানোর আর শিঙা ফোঁকার। এদিকে বাপ্পা রাওয়ালের নির্দেশে তাঁর চিত্রকূটি সেনারা খলিফা বাহিনীর শিবিরের নিকটে অরন্য থেকে প্রচুর পরিমাণে সংগ্রহ করে আনা শুকনো ঘাসপাতা আর কাঠ জ্বালিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তীব্র কৃষ্ণবর্ণ কটু ধূম্ররাশিতে ছেয়ে গেল খলিফা বাহিনীর শিবিরের চতুর্দিক। এমনিতেই গ্রীষ্মের নিদারুণ দাবদাহে পানীয় জলের অভাবে চাতকপাখির ন্যায় যারপরনাই তৃষ্ণার্ত ছিল খলিফা বাহিনী, এরপর রাজপুত বাহিনীর দ্বারা সৃষ্ট অগ্নিকুণ্ডের ধূম্ররাশির প্রভাবে তাঁদের অবস্থা হয়ে উঠলো আরও মর্মন্তুদ। কণ্ঠনালি শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেল, নিশ্বাস-প্রশ্বাস নিতে অসম্ভব পিড়া বোধ হচ্ছিল আর সেইসাথে শুরু হলো শুকনো কাশির জালা। কোনরকমে বস্ত্রখণ্ড দিয়ে নিজেদের মুখমণ্ডল আবৃত করে শিবির ত্যাগ করে বাইরে বেরিয়ে এলো দুই হামিরা সহ খলিফা বাহিনীর সেনারা। এমন সময় সম্রাট নাগভট্টের নির্দেশে তাঁর সেনাবাহিনীর রাজকীয় বাদ্যকররা শুরু করলো ভৈরব ধ্বনিতে ঢাক-ঢোল বাজানো আর শিঙা ফোঁকা। সারারাত ধরে চললো কর্ণ বিদারক সেই বাদ্যকরদের তাণ্ডব লীলা। খলিফা বাহিনীর অবস্থা হলো অনেকটা খাঁচায় বন্দি অসহায় পশুর ন্যায়।
#SR

সারারাত ধরে সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর তাণ্ডবে নিদ্রাহীন খলিফা বাহিনীর শিবিরে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠলো। তাঁরা আল্লাহর নিকট সনির্বদ্ধ রূপে প্রার্থনা করতে লাগলেন সূর্য উদয়ের। পরেরদিন ভোরের আলো প্রস্ফুটিত হবার সাথে সাথেই হামিরা আল-হাকাম আর রাহমান-আল-মুয়ারি মরিয়া হয়ে তাঁদের বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন হিন্দের কাফের বাহিনীকে আক্রমণ করবার। এদিকে ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত আর নিদ্রাহীন খলিফা বাহিনীর অবস্থা তখন রীতিমতো শোচনীয়। তবুও হামিরাদের নির্দেশে সম্মুখপানে অগ্রসর হলো খলিফা বাহিনী। কিছুদূর গিয়ে তিনদিক আরাবল্লি পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত সেই উন্মুক্ত প্রান্তরে উপস্থিত হয়ে খলিফা বাহিনী দেখতে পেলো তাঁদের স্বাগত জানানোর জন্য সেখানে অপেক্ষা করছে এক বিশাল ভারতীয় বাহিনী। সংযুক্ত বাহিনীর প্রথমভাগের পদাতিক সেনাদের সাথে রয়েছে বেশ কয়েকটা বিশালাকৃতি দড়ির কপিকল। তাঁদের নেতৃত্বদান করছেন শাকম্ভরীর সামন্তরাজ প্রথম বিগ্রহরাজ চৌহান আর কায়দারা গিরিপথের অতর্কিত আক্রমণকারী অবন্তির সামন্তরাজ জয়সিংহ। রাজা জয়সিংহকে দেখেই যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়ে হামিরা আল-হাকাম তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে হামলা করার।

রাজস্থানের মহাযুদ্ধ শুরু
==================
ভারতীয় বাহিনীর বাদ্যকররাও তুড়ি, ভেড়ি আর দুন্দুভি বাজিয়ে মহাযুদ্ধের আরম্ভের ঘোষণা করলেন। জোরালো শব্দে “আল্লাহ-আকবর” ধ্বনিতে চতুর্দিক আন্দোলিত করে ভারতীয় বাহিনীর দিকে ধেয়ে এলো খলিফা বাহিনীর পদাতিক সেনারা। খলিফা বাহিনীর পদাতিক সেনাদের ধেয়ে আসতে দেখেই নিজের সেনাদের উদ্দেশ্যে ইশারা করলেন রাজা জয়সিংহ। তাঁরা দড়ির কপিকলগুলো ধরে টান মারতেই সামনের প্রান্তরের উপর থেকে সরে গেল ঘাসপাতা। মুহূর্তের মধ্যেই উন্মুক্ত হয়ে পড়লো বেশ কয়েকটা প্রমাণ সাইজের সুগভীর গড্ডালিকা। সম্মুখপানে প্রবলবেগে ধেয়ে আসা খলিফা বাহিনীর অগণিত পদাতিক সেনা অন্তিম মুহূর্তে নিজেদের গতিবেগ রোধ করতে না পেরে সেই গড্ডালিকাগুলোর মধ্যে হুড়মুড় করে আছড়ে পড়লো। পরমুহূর্তেই গড্ডালিকাগুলোর নিচে অবস্থিত তীক্ষ্ণধার ভল্লের ফলায় বিদ্ধ হয়ে তীব্র যাতনায় ছটফট করতে করতে মৃত্যু হলো তাঁদের। পদাতিক বাহিনীর অবশিষ্ট সেনারা সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর আরও নিকটে আসতেই রাজা বিগ্রহরাজ চৌহানের নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তিরন্দাজরা নির্বিচারে শুরু করলো মুহুর্মুহু তিরের বর্ষণ। অন্তরীক্ষ ছেয়ে গেল অগণিত শরশয্যায়। শরাঘাতে বিদ্ধ হয়ে রক্তাপ্লুত অবস্থায় ভূপাতিত হয়ে মৃত্যু হলো আরও অগণিত খলিফা সেনার। এরপর অবশিষ্ট পদাতিক বাহিনী সন্ত্রস্ত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হলো।


যুদ্ধের পরিনতি ক্রমশ নিজেদের বিপরীতে যাচ্ছে দেখতে পেয়ে এবারে দুই হামিরা নিজেদের বাহিনীকে দুইভাগে বিভক্ত করে দুই প্রান্ত থেকে ভারতীয় বাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। আল-হাকাম আর রেহেমান-আল-মুয়ারি তাঁদের দ্রুতগতির অশ্বারোহী বাহিনী সমেত প্রবল বেগে ধেয়ে এলেন ভারতীয় বাহিনীর দিকে। এদিকে খলিফা বাহিনীর অশ্বারোহী বাহিনীকে বাধাদান করতে রাজা বিগ্রহরাজ চৌহান আর রাজা জয়সিংহও নিজ নিজ অশ্বারোহী বাহিনী সমেত ভল্ল আর ঢাল-তরবারি হস্তে মার মার রবে ধেয়ে গেলেন শত্রু বাহিনীর দিকে। শুরু হলো এক ভয়ানক যুদ্ধ। একদিকে ফাঁদে বন্দি মরিয়া খলিফা বাহিনী অপরদিকে আরবের ভিনদেশি স্মেচ্ছ যবন দস্যুদের ভারতবর্ষের পবিত্র ভূমি থেকে বিতাড়িত করে নিজ ধর্ম, সভ্যতা আর সংস্কৃতির রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর ভারতীয় বাহিনী। ক্রমে সকাল থেকে দুপুর হলো, দুপুর থেকে বিকেল। বিকেলের শুরুতে দুই বীর রাজপুত সামন্তরাজ বিগ্রহরাজ চৌহান আর জয়সিংহের তরবারি আর ভল্লের আঘাতে কচুকাটা হতে থাকা খলিফা বাহিনী কিছুটা হতোদ্যম হয়ে আপাতত পশ্চাৎপশরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে পিছিয়ে আসবার প্রয়াস করতেই আচমকা কিছুদূর থেকে ভেসে এলো বাদ্যকরদের তুড়ি, ভেড়ি আর দুন্দুভির ধ্বনি, হটাতই যেন ভূমিকম্পের ন্যায় মুহুর্মুহু কম্পিত হতে থাকল ধরিত্রী, মেঘ গর্জনের গুড়গুড় আওয়াজের ন্যায় ভেসে আসতে লাগলো একাধিক হস্তীর বৃহণ ধ্বনি। সম্পূর্ণ অপরিচিত শত্রু ভূমিতে অবস্থিত খলিফা বাহিনী ব্যপারটা কি ঘটতে চলেছে তা কিছুটা অনুধাবন করতে পেরে শঙ্কিত হয়ে পড়লো। এরপরই হামিরা আল-হাকাম আর রেহমান-আল-মুয়ারি সভয়ে দেখতে পেলেন নিজেদের সুবিশাল পদতলের চাপে ধরিত্রীকে কম্পিত করে তাঁদের দিকে ধেয়ে আসছে সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর অতিকায় রণহস্তী বাহিনী। সেই বাহিনীর সর্বাগ্রে মধ্যমণির ন্যায় অবস্থান করছে একটি দুর্ভেদ্য বর্ম পরিহিত রণহস্তী আর সেই রণহস্তীর পৃষ্ঠে স্বর্ণ হাওদার উপর দুর্ভেদ্য লৌহজালিকা আর শিরস্ত্রাণ পরিহিত হয়ে আসীন মহাপরাক্রমশালী বীরনারায়ণ স্বয়ং সম্রাট প্রথম নাগভট্ট। সম্রাটের দক্ষিণ হস্তে শোভা পাচ্ছে বিশালকায় ভল্ল আর বাম হস্তে গর্বের সাথে উড্ডীন প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি আর সনাতন ধর্মের প্রতিক এক বিশাল গৈরিক ধ্বজ। বহু দূর থেকে সূর্যালোকে ঝলমল করছে গুর্জর-প্রতিহার অধিপতির হীরক খোচিত রাজ উষ্ণীষ। সেই মুহূর্তে রণহস্তীর পৃষ্ঠে আসীন ভল্লধারী সম্রাটকে অবিকল রুদ্ররূপি নটরাজের ন্যায় প্রতীত হচ্ছিল। ইতিপূর্বেও সিন্ধের রাজা দাহির শাহের বাহিনীর রণহস্তীর সম্মুখীন হয়েছে আরবের খলিফা বাহিনী। কিন্তু বামনাবাদের সেই যুদ্ধেও রাজা দাহির শাহের ক্ষুদ্রকায় সিন্ধী বাহিনীর রণহস্তীর সম্মুখে রীতিমতো পর্যুদস্ত হতে হয়েছিল হামিরা মহম্মদ বিন কাশিমের নেতৃত্বাধিন খলিফা বাহিনীকে। নেহাত প্রবল সংখ্যা গরিষ্ঠ আর মহম্মদ কাশিমের কুশল নেতৃত্ব আর ছলনার সাহায্যে সে যাত্রা পার পেয়েছিল খলিফা বাহিনী। কিন্তু আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এমনিতেই সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর চতুর আর কৌশলী রণনীতির সম্মুখীন হয়ে ছন্নছাড়া অবস্থা খলিফা বাহিনীর তার উপর গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার ন্যায় অতিকায় রণহস্তী বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ।


ভারতীয় বাহিনীর নির্ণায়ক বিজয়গাথা
===========================
কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্রাট নাগভট্টের নেতৃত্বাধীন রণহস্তী বাহিনী প্রবলবেগে হামলা করলো খলিফা বাহিনীকে। রণহস্তীদের পদতলে পিষ্ট হয়ে মারা পড়লো বহু খলিফা সেনা। এছাড়াও হস্তী পৃষ্ঠে আসীন যোদ্ধাদের নিক্ষিপ্ত তির আর ভল্লের আঘাতে জন্নত আর জাহান্নমগামী হলো আরও বহু সেনা। যুদ্ধে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী উপলব্ধি করতে পেরে হামিরা রেহেমান-আল-মুয়ারি মরিয়া হয়ে সম্রাট নাগভট্টকে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে রাজপুতদের সাম্মানিক যুদ্ধনীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁকে সরাসরি দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালেন। রেহেমান-আল-মুয়ারির আহ্বান গ্রহণ করে তৎক্ষণাৎ ভল্লধারী সম্রাট হস্তীপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করলেন। আল-মুয়ারিও তাঁর অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করে ভল্ল হস্তে সম্রাটের দিকে এগিয়ে এলেন। শুরু হলো এক ভয়ানক দ্বন্দ্বযুদ্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্রাট নাগভট্টের ভল্লের আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে ধরাশায়ী হলেন রেহমান-আল-মুয়ারি। নিরস্ত্র আর গুরুতর আহত আল-মুয়ারি নিরুপায় হয়ে প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন সম্রাটের নিকটে। ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি আর ধর্মের বিনাশ করতে আসা ভূপাতিত যবন শত্রুর প্রতি কোনরকম অনুকম্পা বা ক্ষমা প্রদর্শনের রাজপুতীয় ভুল করলেন না সম্রাট নাগভট্ট। তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে “হর হর মহাদেব” ধ্বনিতে চতুর্দিক আন্দোলিত করে নিজের হস্তধারী ভল্লের তীক্ষ্ণধার ফলাটি আমূল বিদ্ধ করলেন হামিরা রেহেমান-আল-মুয়ারির বুকে।


এদিকে নিজেদের চোখের সামনে হামিরা রেহেমান-আল-মুয়ারির জাহান্নম যাত্রা দর্শন করে কম্পিত আর সন্ত্রস্ত অবশিষ্ট খলিফা বাহিনী তাঁদের আরেক হামিরা আল-হাকামের নির্দেশে তিরবেগে নিজেদের শিবিরের দিকে পলায়ন করলো। কিন্তু কিছুদূর ধাবিত হয়েই তাঁরা সভয়ে দেখতে পেলো যে তাঁদের শিবিরে যাবার পথ রুদ্ধ করে খলিফা বাহিনীকে স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে দুই সামন্তরাজ বিগ্রহরাজ চৌহান আর জয়সিংহের বাহিনী। এবারে সন্ত্রস্ত আল-হাকামের নজর পড়লো পূর্বের আরাবল্লির পর্বত শ্রেণীর দিকে। এদিকে তখন সন্ধ্যাকাল প্রায় আসন্ন। আল-হাকাম তাঁর অবশিষ্ট বাহিনীকে নিয়ে পলায়ন করলেন সেইদিকে। তিনি মনে মনে ভেবেছিলেন সন্ধ্যার আধারের আশ্রয় নিয়ে আরাবল্লি পর্বতের অন্তরালে আপাতত আশ্রয় গ্রহণ করবেন। এদিকে নিজেদের রাজপুতী যুদ্ধনীতি অনুসারে রাতের আধারে তাঁদের উপর আর হামলা চালাবে না নাগভট্টের সংযুক্ত বাহিনী। রাজপুতদের যুদ্ধ বিরামের সহায়তা নিয়ে রাত থাকতে থাকতেই কোনমতে গাঢাকা দিয়ে বধ্যভূমি ত্যাগ করে সিন্ধের উদ্দেশ্যে পলায়ন করবে খলিফা বাহিনী। কিন্তু বিধি বাম। পূর্ব প্রান্তের পর্বতশ্রেণীর নিকটে উপস্থিত হতেই হাজার হাজার জ্বলন্ত মশাল হস্তে অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে ভৈরব কণ্ঠে “জয় একলিঙ্গনাথ” ধ্বনিতে চতুর্দিক অনুরণিত করে তিরবেগে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে খলিফা বাহিনীর দিকে সুনামির ঢেউের ন্যায় ধেয়ে এলো সেনাপতি বাপ্পাদিত্য রাওয়ালের নেতৃত্বাধীন চিত্রকূট (চিতোরী) বাহিনী। নিজেদের প্রচলিত রণনীতি অগ্রাহ্য করে রাতের আধারের মধ্যেই অসি আর ভল্ল হস্তে মধ্যেই খলিফা বাহিনীকে জল্লাদের ন্যায় কচুকাটা করতে লাগলেন গুহিলট সেনাপতি বীরনারায়ণ বাপ্পাদিত্য রাওয়াল আর তাঁর চিতোরী সেনা। পলায়ন করা অসম্ভব অনুধাবন করতে পেরে হামিরা আল-হাকাম তাঁর বক্র তরবারি হস্তে ঘোড়া ছুটিয়ে মুখোমুখি হলেন বাপ্পা রাওয়ালের। তরবারির দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানালেন। অসি চালনার দক্ষতায় বাপ্পা রাওয়ালের নিকটে আল-হাকাম ছিলেন নিতান্তই এক শিক্ষা নবিশ। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাপ্পা রাওয়ালের তরবারির আঘাতে আল-হাকামের হাত থেকে তাঁর অসি খসে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো। এরপর বাপ্পা রাওয়ালের তরবারির আরেক সুনিপুণ আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ভূপাতিত হলেন আল-হাকাম। ভূপাতিত হয়ে তিনিও যথারীতি করলেন নিজের প্রাণ ভিক্ষা। কিন্তু এবারেও কোনরকম অনুকম্পা বা মার্জনা প্রদর্শন করলেন না বাপ্পা রাওয়াল। নিজের অসির এক সুনিপুণ আঘাতে আরবের ধূলি ধূসরিত মরুপ্রান্তর থেকে আগত বর্বর স্মেচ্ছ যবন হামিরার শিরচ্ছেদ করলেন তিনি। এরপর সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর সাঁড়াশি হামলায় শোচনীয়ভাবে পরাজিত আর নিহত হলো অবশিষ্ট খলিফা বাহিনী। রাজস্থানের বধ্যভূমিতে ক্রমশ স্তব্ধ হয়ে পড়লো আল্লাহ-আকবর ধ্বনি। চতুর্দিক থেকে ভৈরব কণ্ঠে অনুরণিত হতে থাকলো বিজয়ী সংযুক্ত বাহিনীর উল্লসিত “হর হর মহাদেব” ধ্বনি।

খলিফা বাহিনীকে পদপিষ্ট করে সম্রাট নাগভট্টের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনী বিজয় গর্বে গৈরিক ধ্বজ উড্ডীন করে যাত্রা শুরু করলো ভারতবর্ষে খলিফা বাহিনীর প্রধান কার্যালয় সিন্ধের উদ্দেশ্যে।


খলিফা বাহিনীর দাক্ষিণাত্য অভিযান
==========================
এদিকে গুপ্তচর মারফৎ আল-হাকাম আর রেহেমান-আল-মুয়ারির বাহিনীর মর্মান্তিক পরিণতি আর সংযুক্ত ভারতীয় সেনার অগ্রসরের সমাচার পেয়ে সন্ত্রস্ত তৃতীয় হামিরা তামিম-ইবান-জইদ-আল-উঠবি তাঁর অবশিষ্ট বাহিনী নিয়ে সিন্ধ পরিত্যাগ করে আরব সাগরের পথে রণতরীতে আসীন হয়ে পাড়ি জমালেন ভারতবর্ষের দক্ষিণাপথে। তাঁর ইচ্ছা ছিল দাক্ষিণাত্যের জলপথে আপাতত কিছুকাল আত্মগোপন করে থাকা। আল-হাকাম আর রেহেমান-আল-মুয়ারির বাহিনীর শোচনীয় পরিণতির কথা জানিয়ে তিনি পত্র প্রেরণ করেছিলেন খলিফাকে। সেই পত্রে হিন্দের শক্তিশালি কাফের বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য আরও সেনা প্রেরণের সনির্বদ্ধ অনুরোধও জানিয়েছিলেন। কিন্তু খলিফা কোন এক অজ্ঞাত কারণ বশত তামিম-ইবান-জইদ-আল-উঠবির যাবতীয় দাবি দাওয়া নস্যাৎ করে তাঁকে নির্দেশ প্রেরণ করলেন জলপথে দাক্ষিণাত্যের কাফের রাজাদের আক্রমণ করে সেখানে খলিফা সাম্রাজ্য আর ইসলামের ধ্বজ স্থাপন করবার। আদেশ অমান্য করলে হামিরা তামিম-ইবান-জইদকে চরম দণ্ডে দণ্ডিত করবার ভীতিও প্রদর্শন করলেন।


খলিফার নির্দেশ পেয়ে নিরুপায় তামিম-ইবান-জইদ তাঁর নৌবাহিনী নিয়ে বর্তমান গুজরাটের গালফ অফ খাম্বাট দিয়ে দাক্ষিণাত্যের মাহি নদিপথে প্রবেশ করে সন্তর্পণে নভসরী বন্দর নগরের দিকে এগিয়ে চললেন। সেই সময় মাহি নদির তটবর্তী নভসরী বন্দর নগর কর্ণাটকের অমিত শক্তিধর বাদামি চালুক্য সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। সম্রাট নাগভট্টের গুপ্তচরদের নিকট থেকে জলপথে আরবের খলিফা বাহিনীর সাম্ভাব্য হামলার সংবাদ পেয়ে ভিনদেশি স্মেচ্ছ যবন বাহিনীকে উপযুক্ত শিক্ষাদানের জন্য চালুক্য সম্রাট দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের নির্দেশে তাঁর নৌবাহিনীর প্রধান সেনাপতি (অ্যাডমিরাল) তথা তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা অবনীজনাশ্রয় পুলকেশি আর তাঁর প্রধান সামন্ত রাজা রাষ্ট্রকূট রাজবংশের যুবরাজ দান্তিদুর্গ তাঁদের শক্তিশালি সুবিশাল সংযুক্ত নৌবাহিনী সমেত নভসরীর বন্দর শহরের পোতের নিকট অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত ছিলেন।


মাহি নদীর খাঁড়িতে ঐতিহাসিক নৌযুদ্ধ
============================
অবশেষে এক ভোরে হামিরা তামিম-ইবান-জইদ তাঁর নৌবাহিনী সমেত মাহি নদির সঙ্কীর্ণ খাঁড়িপথে প্রবেশ করে নভসরী নগরীর দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। কিন্তু কিছুদূরে গিয়েই তামিম-ইবান-জইদ আচমকা দেখতে পেলেন তাঁদের পথরোধ করে খাঁড়ির সম্মুখপ্রান্তের মুখে দণ্ডায়মান চালুক্য নৌবাহিনীর রণতরী। এবারে তামিম-ইবান-জইদ পশ্চাৎপশরন করতে চাইলেন। কিন্তু সেখানেও বিপদ অপেক্ষা করছিল খলিফা বাহিনীর জন্য। খাঁড়ির অপরপ্রান্তেও সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের ন্যায় দণ্ডায়মান রাষ্ট্রকূট নৌসেনার আরেকটি বিশাল রণতরী। পলায়নের পথ রুদ্ধ দেখে অবশেষে মরিয়া হামিরা তামিম-ইবান-জইদ আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই চালুক্য রণতরী গুলি থেকে কাষ্ঠ নির্মিত বিশাল গুলতি দ্বারা নিক্ষিপ্ত লৌহ নির্মিত ভারি ন্যাপথা বল, অগ্নিবাণ আর অগ্নিগোলকের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়লো খলিফা বাহিনীর রণতরীগুলি। এরপর দুর্ভেদ্য লৌহপাত দ্বারা আবৃত চালুক্য রণতরীর শক্তিশালের হালের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে একে একে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে সলিল সমাধিপ্রাপ্ত হলো খলিফা বাহিনীর সমস্ত রণতরী। নিজের রণতরীর সাথেই খাঁড়ির জলে ডুবে জাহান্নমে গমন করলেন হামিরা হামিরা তামিম-ইবান-জইদ-আল-উঠবি। চালুক্য আর রাষ্ট্রকূটদের রণতরী গুলি থেকে ভৈরব গর্জনে “জয় বরাহদেব” শব্দে মুহুর্মুহু ভেসে আসতে লাগলো বিজয় ধ্বনি। মাহি নদির খাঁড়িপথের এই নৌযুদ্ধে আরবের স্মেচ্ছ ভিনদেশি বর্বর খলিফা বাহিনীর বিরুদ্ধে এই নির্ণায়ক নৌযুদ্ধে অভূতপূর্ব সাফল্যলাভের পর চালুক্য সম্রাট দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য যারপরনাই খুশি হয়ে নৌযুদ্ধের নায়ক তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা অবনীজনাশ্রয় পুলকেশিকে “দক্ষিণাপথ সধরা” খেতাবে ভূষিত করলেন। এই খেতাবের অর্থ হলো দাক্ষিণাত্যের মহাশক্তিশালি অটুট স্তম্ভ। আর তাঁর দ্বিতীয় সহকারি রাষ্ট্রকূট যুবরাজ দান্তিদুর্গকে “অনিবর্তক নিভারাত্রাত্রির” খেতাবে ভূষিত করেলেন। এই খেতাবের অর্থ হলো অপরাজেয় দুর্দমনীয় বীর।


যুদ্ধ পরবর্তী ভারতবর্ষের পরিণাম
========================
প্রথমে স্থলপথে রাজস্থানের মহাযুদ্ধে এবং পরে জলপথে মাহিনদীর যুদ্ধে খলিফা বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় এবং আল-হাকাম সহ তিন শক্তিশালি হামিরার (আমির) মৃত্যুর পর ভারতবর্ষের মাটিতে আরবদের যাবতীয় প্রতিরোধ ধূলিসাৎ হলো। সম্রাট নাগভট্টের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত রাজপুত বাহিনীর তাড়া খেয়ে আরবের খলিফা বাহিনী তখনকার মতো পলায়ন করলো সিন্ধু নদীর অপরপ্রান্তে। সিন্ধু নদীর দক্ষিণ প্রান্তের সীমানা পর্যন্ত যাবতীয় ভারতীয় ভূখণ্ড ভারতীয় বাহিনীর অন্তর্গত হলো। পরবর্তীকালে আরবের দুর্বল খলিফা নৌবাহিনী হামিরা আমীর-বিন-মহম্মদ-বিন--আল-কাশিমের-আল-তাকাফির নেতৃত্বে মূলত ব্যস্ত ছিল সিন্ধের সাগরপথে সফররত ভারতীয় রাজাদের রণতরীগুলোকে চোরাগোপ্তাভাবে আচমকা আক্রমণ করে অন্তত সিন্ধে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে। আরেক শক্তিশালি গুর্জর-প্রতিহার সম্রাট মিহিরভোজের পাল্টা আক্রমণে ভারতবর্ষের মাটিতে চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায় আরবের খলিফা বাহিনীর আক্রমণ। কিন্তু সাফারিদ ইসলামিক তুর্কি বাহিনী ভারতবর্ষের নতুন বিপদ হিসাবে দেখা দেয় উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের আফগানিস্থানের হিন্দুকুশ পর্বত প্রান্তে।


এদিকে কালের নিয়মে সেদিনের একতায় চিড় ধরে ভারতবর্ষের হিন্দু রাজাদের মধ্যে। দক্ষিণে চালুক্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজেদের স্বাধীন সাম্রাজ্য স্থাপন করলো রাষ্ট্রকূট রাজবংশ। উত্তরে সাম্রাজ্য বিস্তারের লোভে রাষ্ট্রকূট বাহিনী সংঘাতে জড়ালো সম্রাট নাগভট্টের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজের বিরুদ্ধে। অপরদিকে চিতোরের মৌর্য রাজা মনুরাজাকে হত্যা করে বলপূর্বক চিতোরের রাজসিংহাসন অধিকার করলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজপুত সেনাপতি বাপ্পাদিত্য রাওয়াল। চিতোরের কেল্লায় স্থাপন করলেন গুহিলট রাজবংশ, পরবর্তীকালে আলাউদ্দিন খিলজির চিতোর হামলায় মহারাওয়াল রতন সিংহের প্রয়াণের সাথে সাথে যেই রাজবংশের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে শিশোদিয়া রাজবংশের স্থাপনা করেছিলেন মহারানা হামির সিংহ। এদিকে রাষ্ট্রকূটদের মতোই কিছুকাল পরে গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজেদের স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করলেন শাকম্ভরীর সামন্তরাজ প্রথম বিগ্রহরাজ চৌহানের বংশধররাও। পরবর্তীকালে ১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে তরাইনের প্রান্তরে বাপ্পা রাওয়ালের আধুনিক যুদ্ধনীতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ শাকম্ভরীর চৌহান রাজবংশের অযোগ্য উত্তরসূরি পৃথ্বীরাজ চৌহানকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে তাঁর রাজধানি দিল্লি নগর অধিকার করে বহুকাল পরে ভারতবর্ষের পবিত্র ভূমিতে স্থায়ীভাবে পদার্পণ করে ইসলামের বিজয় নির্ঘোষ ঘোষণা করে রাজস্থানের ঐতিহাসিক মহাযুদ্ধে নিহত হামির আল-হাকামের অসমাপ্ত স্বপ্ন পূর্ণ করে, ভারতবর্ষের ভূমিতে সনাতন ধর্ম, সভ্যতা আর সংস্কৃতির পতন ঘটিয়ে, সম্রাট নাগভট্ট, সেনাপতি বাপ্পা রাওয়াল আর সম্রাট বিক্রমাদিত্য চালুক্যের সেদিনের ঐতিহাসিক বিজয়ের যাবতীয় গৌরবগাথা পরাজয়ের গ্লানিতে ম্লান করে ইতিহাসের পাতায় প্রায় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে দিয়েছিলেন ঘুরের তুর্কি সুলতান মহম্মদ ঘোরী।
#SR #Battle_of_Rajasthan


তথ্যসূত্রঃ
১) Crawford, Peter (2013). The War of the Three Gods: Romans, Persians and the Rise of Islam. Barnsley, Great Britain: Pen & Sword Books. p. 216
২) Sandhu, Gurcharn Singh (2000). A Military History of Ancient India. Vision Books. p. 402
৩) Sailendra Nath Sen (1 January 1999). Ancient Indian History and Civilization. New Age International. pp. 343–344
৪) Kumar, Amit (2012). "Maritime History of India: An Overview". Maritime Affairs:Journal of the National Maritime Foundation of India. 8 (1): 93–115. In 776 AD, Arabs tried to invade Sind again but were defeated by the Saindhava naval fleet. A Saindhava inscription provides information about these naval actions.
৫) Majumdar, R. C. (1977). Ancient India (Eighth ed.). Delhi: Motilal Banarsidass.
তরাইনের প্রথম যুদ্ধ
===============
মহম্মদ ঘোরীর পুনরুত্থান
===================
আগের পর্বে আপনারা পড়েছেন কিভাবে ১১৭৮ খ্রিষ্টাব্দে মাউন্ট আবুর নিকটে কায়দারার গিরিঘাটে যুদ্ধে চালুক্য রানি নাইকি দেবীর কুশল রণনীতির সম্মুখে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েও পুনরায় জিহাদের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ভারতবর্ষের ভূমিতে এক বিশাল ইসলামিক সাম্রাজ্য স্থাপনের লক্ষ্যে ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন আফগানিস্থানের ঘুর সুলতানতের অধিপতি মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। এরপর ১১৮৬ খ্রিষ্টাব্দে লাহোরের যুদ্ধে ঘোরীর জিহাদি বাহিনীর নিকটে ধস্ত হয়েছিল তার প্রতিদ্বন্দ্বী সেলজুক তুর্কি সুলতান খুস্রু মালিক আর খোকারদের মিলিত বাহিনী। এরপর ঘোরী শিয়ালকোট আর রাওলপিণ্ডি কব্জা করলেন। মামুদ গজনীর অন্তিম বংশধর খুস্রু মালিক পরাজিত ও বন্দি হবার পর একদিকে সম্পূর্ণ আফগানিস্থানে কণ্টকশূন্য হলো ঘোরী সাম্রাজ্য, অপরদিকে তুর্কি ঘোরী সাম্রাজ্য আর হিন্দুস্থানের সনাতনি চৌহান সাম্রাজ্যর সীমান্তরেখা একে অপরকে স্পর্শ করলো।

আজমির আর দিল্লিকে দুই কেন্দ্রস্থল করে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত শাকম্ভরির চৌহান রাজবংশ তখন উত্তর ও মধ্য ভারতের অন্যতম এক শক্তিশালী হিন্দু সাম্রাজ্য। তখন দিল্লির রাজসিংহাসনে আসীন চৌহান রাজবংশের ৩১ তম সদস্য মহারাজ পৃথ্বীরাজ চৌহান তৃতীয়। ভারতবর্ষের ইতিহাসের পাতায় মতে স্বাধীন ভারতবর্ষ এবং দিল্লির অন্তিম সনাতনি ভারতীয় শাসক হিসাবে চির অমর হয়ে রয়েছেন রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুর্কিদের দ্বারা হরণ হয় ভারতবর্ষের এক বিশাল অঞ্চলের স্বাধীনতা এবং দিল্লির বুকে উড্ডীন হয় অর্ধচন্দ্র আর তাঁরা অঙ্কিত বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুর্কিদের সবুজ ঝাণ্ডা। বর্ণময় এই যুবা রাজাকে নিয়ে যবন তুর্কি ও সনাতনি ভারতীয় ঐতিহাসিক আর কবিদের দ্বারা রচিত ও প্রচারিত হয়েছে নানান লোকগাথা, হরেক কিংবদন্তী আর অত্যাশ্চর্য সব ঘটনার কাহিনী। সেগুলোর মধ্যে কোনটা ঐতিহাসিক রূপে সত্যি আর কোনটা শুধুই কিংবদন্তী আর নিছকই গল্পকথা তা আজও তর্ক সাপেক্ষ। ব্রিটিশ শাসনকালে এবং কংগ্রেস শাসনাধীন স্বাধীনতাত্তোর ভারতে পৃথ্বীরাজের সভাকবি চাঁদ বারদাই দ্বারা রচিত “পৃথ্বীরাজ রাসো” নামক কাব্যগ্রন্থটিকে সর্বচ্চো মান্যতা দান করা হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে রাজস্থান আর গুজরাটের বহু প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিকগণ সন, তারিখ ও নিখুঁত তথ্য সহ প্রমান করেছেন যে “পৃথ্বীরাজ রাসোতে” বর্ণিত ৮৫% ঘটনাই কাল্পনিক ও অতিরঞ্জিত। বাস্তবের ইতিহাসের সহিত এই কাব্যগ্রন্থে বর্ণিত ঘটনাবলির কোন মিল নেই। অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে পৃথ্বীরাজের সভায় উপস্থিত কাশ্মীরি কবি তথা ঐতিহাসিক জয়নাক দ্বারা রচিত কাব্যগ্রন্থ “পৃথ্বীরাজ বিজয়” ঐতিহাসিক রূপে অনেক অধিক নির্ভুল। তরাইনের প্রথম যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণের পূর্বে আসুন জেনে নেওয়া যাক দিল্লির অন্তিম হিন্দু রাজা সম্বন্ধে “পৃথ্বীরাজ বিজয়” গ্রন্থে বর্ণিত কিছু তথ্য।

চৌহান রাজবংশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পর্ব
=============================
কবি জয়নাক তাঁর কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন চৌহান বংশের তৃতীয় শক্তিশালী রাজা আর্নোরাজ চৌহান ঘোরী সাম্রাজ্যের (মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরীর পূর্বজরাও একাধিকবার ভারত আক্রমণ করেছিলেন) এক বিশাল তুর্কি বাহিনীকে আজমিরের নিকটে শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও বিতাড়িত করবার পর সহস্র স্মেচ্ছ তুর্কি দস্যুদের রক্তে শিক্ত যুদ্ধভূমিকে শুদ্ধ করবার জন্য ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতগণের পরামর্শে সেই স্থানে এক বিশাল সরোবর খনন করলেন। নিকটবর্তী চন্দ্রা নদী থেকে পরিখা খনন করে সরোবর জলে পরিপূর্ণ করা হলো। সরোবরের টলটলে নির্মল জল দেখে পুলকিত হলেন চৌহান অধিপতি। যোগ্য করে আর পূজাদান করে সরোবরকে বিশুদ্ধ করলেন আজমিরের পুরোহিত আর ব্রাহ্মণগণ। রাজা আর্ণোরাজ খুশি হয়ে সরোবরের নাম রাখলেন “আনাসাগর হ্রদ” (বর্তমানে আজমিরের অন্যতম প্রধান পর্যটন স্থল হলো এই আনাসাগর হ্রদ)। হ্রদের সম্মুখে শ্বেত মর্মর সুরম্য পারিবারিক রাজপ্রাসাদের মুখোমুখি এলাকায় এক বিশাল শিব মন্দির নির্মাণ করলেন রাজা আর্ণোরাজ। মন্দিরের নাম দিলেন সোমেশ্বর মন্দির। তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে এই নির্ণায়ক বিজয়ের মাস দুয়েক পরে গুজরাটের চালুক্য রাজবংশের শাসক মহারাজ জয়সীমা সিদ্ধরাজের জ্যৈষ্ঠ কন্যা রাজকুমারী কাঞ্চনাদেবীর সাথে দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন রাজা আর্ণোরাজ। বৎসরকাল অতিবাহিত হতে না হতেই গর্ভবতী হলেন রানি কাঞ্চনাদেবী। তিনি জন্মদান করলেন এক পুত্র সন্তানের। মহারাজ আর্ণোরাজ নিজের নির্মিত সোমেশ্বর দেবের মন্দিরের নামাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর সেই পুত্রের নাম রাখলেন সোমেশ্বর চৌহান। পরবর্তীকালে ১১৫০ খ্রিষ্টাব্দে এক মৃগয়াভূমিতে ষড়যন্ত্র করে যবন বিতারনকারী মহারাজ আর্ণোরাজকে বিষাক্ত তির দ্বারা বিদ্ধ করে হত্যা করলেন তাঁরই জ্যৈষ্ঠ পুত্র জগৎদেব চৌহান।

এরপর আজমিরের রাজসিংহাসনের দখল নিলেন তিনি। এরই মধ্যে আজমিরের রাজজ্যোতিষী গণনা করে ঘোষণা করলেন যে অতি শীঘ্র শাসন ক্ষমতা হারাতে চলেছেন তিনি আর তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা সোমেশ্বর লাভ করতে চলেছেন এক বীরপুত্র সন্তান। তাঁর দ্বিতীয় ভ্রাতা এবং সোমেশ্বর চৌহানের পুত্রের বলিষ্ঠ তরবারির জোরে চৌহান রাজ্য এক বিশাল সাম্রাজ্যের রূপ নিতে চলেছে। রাজজ্যোতিষীর এই ঘোষণা শুনেই ভীত ও সন্ত্রস্ত্র জগৎদেব হত্যার আদেশ দিলেন তাঁর দুই ভ্রাতা বিগ্রহরাজ এবং সোমেশ্বরকে। দুজনেই গোপনে আজমির ত্যাগ করে গুজরাটে পলায়ন করলেন। তাঁদের আশ্রয়দান করলেন চালুক্য নৃপতি জয়সীমা সিদ্ধরাজ। এরপর চালুক্য বাহিনীর সাহায্যে জগৎদেবকে আক্রমণ ও হত্যা করে আজমিরের রাজসিংহাসনের আসীন হলেন চতুর্থ বিগ্রহরাজ। জগৎদেবের অত্যাচার আর শোষণে দীর্ণ চৌহান রাজ্যে পুনরায় শান্তি ও শৃঙ্খলার সুদিন ফিরিয়ে আনলেন চতুর্থ বিগ্রহরাজ। ললিত বিগ্রহরাজ নাটক আর প্রবন্ধ চিন্তামনির বর্ণনা অনুসারে ঘোরী সুলতানদের যবন তুর্কি বাহিনীকে দিল্লির যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে, দিল্লির রাজা অনঙ্গপাল তোমারের কন্যা দেশালাদেবীকে বিবাহ করে পুত্র সন্তানহীন বৃদ্ধ রাজা অনঙ্গপাল তোমারের নিকট থেকে দিল্লি রাজ্য যৌতুক হিসাবে পেয়েছিলেন তিনি। ইতিহাসের পাতায় ইনিই চৌহান বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক।

চৌহান-চালুক্য বংশের মিত্রতা আর বৈরিতার ইতিহাস
=====================================
এদিকে গুজরাটের রাজধানি আনহিলওয়াড়ার প্রাসাদে রাজা জয়সীমা তাঁর রাজজ্যোতিষীর নিকটে পেলেন আরেকটি অদ্ভুত সংবাদ। রাজজ্যোতিষীর মুখে তিনি জানতে পারলেন আজমিরের রাজকুমার সোমেশ্বর চৌহানের পুত্র হিসাবে পৃথিবীর বুকে পুনরায় পুনর্জন্ম লাভ করতে চলেছেন স্বয়ং অযোধ্যা নরেশ রাজা রামচন্দ্র। এই সংবাদ শুনে যারপরনাই পুলকিত হয়ে ত্রিপুরির রাজা তেজালার কন্যা রাজকুমারী কর্পূরদেবীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন সোমেশ্বর চৌহান। রাজা জয়সীমার মৃত্যুর পরে গুজরাটের রাজসিংহাসনে আসীন হলেন তাঁর পুত্র রাজা কুমারপাল। যদিও তিনি সোমেশ্বরকে পছন্দ করতেন, কিন্তু তাঁর শাসনকাল থেকেই সাম্রাজ্য বিস্তার নিয়ে দিল্লি-আজমিরের রাজা চতুর্থ বিগ্রহরাজের সাথে বৈরিতা শুরু হয়। অপরদিকে ১১৬৬ সালে সন্তান সম্ভবা হলেন রাজকুমারী কর্পূরদেবী। এই ঘটনার মাসখানেক ব্যবধানে এক পুত্র সন্তানের জন্মদান করলেন তিনি। স্বয়ং অযোধ্যা নরেশ রঘুপতি রামচন্দ্র সোমেশ্বরের পুত্রের রূপধারন করে পুনরায় ভূমিষ্ঠ হয়েছেন মনে করে আনহিলওয়াড়ার রাজপ্রাসাদে আনন্দ ও উৎসবের তরঙ্গস্রোত প্রবাহিত হলো। ভবিষ্যৎকালে, সমগ্র পৃথিবীর বুকে (আসলে ভারতবর্ষ) নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করে সনাতন ধর্ম আর সভ্যতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে পুনরায় রামরাজ্যের সেই স্বর্ণময় গৌরবশালী দিনগুলি ফিরিয়ে আনবেন এই প্রার্থনা করে সোমেশ্বর তাঁর শিশু পুত্রের নাম রাখলেন পৃথ্বীরাজ।

গুজরাটের রাজধানি আনহিলওয়াড়ায় যখন এই নাটক সংগঠিত হচ্ছে, তখন আজমিরেও ঘটে চলেছে নানান ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত। ১১৬৪ সালে এক যুদ্ধে আহত হয়ে প্রয়াত হলেন সম্রাট চতুর্থ বিগ্রহরাজ। তিনি পুত্র সন্তান হীন হওয়াও তাঁর প্রয়ানের পর দিল্লি-আজমিরের রাজসিংহাসনে আসীন হলেন কুচক্রী জগৎদেবের পুত্র দ্বিতীয় পৃথ্বীরাজ। মাত্র সাড়ে চার বৎসরকাল রাজত্ব করতে পেরেছিলেন তিনি। গুজরাটের সাথে আজমিরের বৈরিতা তখন তুঙ্গে। ১১৬৯ সালে গুজরাটের রাজা কুমারপালের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে নিহত হলেন রাজা দ্বিতীয় পৃথ্বীরাজ। এর ফলে উত্তরাধিকারীহীন হয়ে পড়লো দিল্লি-আজমিরের সিংহাসন। তখন আজমিরের অমাত্যগণ গুজরাট নিবাসি রাজকুমার সোমেশ্বরকে সনির্বদ্ধ আহ্বান জানালেন আজমিরে প্রত্যাবর্তন করে রাজ্য সামলানোর। যুবাকালে গুজরাটের চালুক্য রাজবংশের হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও ১১৬৯ সালে পুনরায় আজমিরে প্রত্যাবর্তন করলেন তিনি। দিল্লি-আজমিরের রাজা হবার পর রাজ্যের সাম্রাজ্য বিস্তারের যুদ্ধে কিছুকালের মধ্যেই একদা পরম মিত্র রাজ্য গুজরাট হয়ে উঠলো রাজা সোমেশ্বর চৌহানের চরম শত্রু রাজ্য। ১১৭৫ সালে গুজরাটের বিরুদ্ধে আজমিরের বাহিনীর এক যুদ্ধে নিহত হলেন তৎকালীন গুজরাট নরেশ রাজা অজয়পাল (কুমারপালের পুত্র)। সেই সময় রাজা অজয়পালের দুই পুত্র সন্তান দ্বিতীয় মুলারাজ আর দ্বিতীয় ভীমদেব মাত্র ৬-৭ বৎসরের বালক। এদিকে ১১৭৮ সালের প্রারম্ভে সেই গুজরাটের বিরুদ্ধেই এক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সম্মান খুইয়ে ভগ্ন হৃদয়ে মৃত্যুবরন করলেন আজমির নরেশ রাজা সোমেশ্বর। ঘটনাবহুল ১১৭৮ সালের মধ্যভাগে গোমাল গিরিবর্ত্ম অতিক্রম করে গুজরাট আক্রমণ করলেন স্মেচ্ছ তুর্কি সুলতান মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। কিন্তু কায়দারার যুদ্ধে প্রয়াত রাজা অজয়পালের বিধবা স্ত্রী রানি নাইকিদেবীর চতুর রণনীতির বিরুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে কোনমতে গজনীতে পশ্চাৎপশরন করলেন তিনি।

কায়দারার ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাসকয়েক পরেই কোন এক অজ্ঞাত দুর্ঘটনায় নিহত হলেন বালক গুজরাট নরেশ দ্বিতীয় মুলারাজ। মুলারাজের মৃত্যুর পর গুজরাটের রাজসিংহাসনে আসীন হলেন ভীমদেব। এদিকে পুত্রশোকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন গুজরাটের বিধবা রাজমাতা রানি নাইকিদেবী। সম্ভবত আরও মাসখানেক পরে ১১৭৯ সালের প্রথমার্ধে ভগ্ন হৃদয়ে অন্তিম নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতবর্ষের বীরাঙ্গনা রমণী রানি নাইকিদেবী। পিতার পর মাতাকেও হারিয়ে রাজা ভীমদেবের সমস্ত ক্রোধ পুঞ্জিভূত হয় আজমিরের উপর। একে তো আজমিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন তাঁর পিতা রাজা অজয়পাল। তার উপর কায়দারার গিরিঘাটে তুর্কি দস্যুদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে তাঁর মাতা রানি নাইকিদেবীকে কোনরকম সামরিক সহায়তা প্রদান করেনি আজমির নরেশ তৃতীয় পৃথ্বীরাজ। নাইকিদেবীর মৃত্যুর পরেই রাজা ভীমদেব যুদ্ধ ঘোষণা করলেন পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিরুদ্ধে।

পৃথ্বীরাজ-জয়চাঁদের বৈরিতা পর্ব
=======================
অপরদিকে  নিজেকে রাজপুতানার সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতি হিসাবে দেখবার বাসনায় অশ্বমেধ যোগ্য পালন করে মহা সারম্ভরে দিগ্বিজয় ঘোষণা করলেন কান্যকুব্জের রাজা জয়চাঁদ গাহারওয়াল। জেজাকভুক্তি (বর্তমান বুন্দেলখণ্ড), পারমার, পাট্টান রাজ্য ভ্রমণ করে অবশেষে জয়চাঁদের অশ্বমেধের রথ এসে উপস্থিত হল দিল্লিতে রাজা পৃথ্বীরাজের রাজদরবারে। কান্যকুব্জের অশ্বমেধ রথের আগমনী সংবাদ শুনে নিজের ধমনীর ক্ষত্রিয় রক্ত তপ্ত হয়ে উঠল দিল্লিশ্বর চৌহান বীরের। তিনি নিজের রাজসিংহাসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে কনৌজের রাজদূত ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন, “কি এতো স্পর্ধা কান্যকুব্জের নৃপতির ? চৌহান রাজবংশকে নিজের পদানত করতে চান তিনি ? রাজপুত ক্ষাত্র ধর্ম অনুসারে দূত অবধ্য। তাই আপনাকে হত্যা না করে অক্ষত শরীরে কান্যকুব্জে প্রত্যাবর্তন করবার সুযোগ দিচ্ছি। আপনি অবিলম্বে নিজ রাজ্যে ফিরে গিয়ে আপনার রাজাকে জানান পৃথ্বীরাজকে পদানত করতে হলে তাঁকে সসৈন্যে যুদ্ধ ভূমিতে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। অদূর ভবিষ্যতে কান্যকুব্জের রাজা নন, আর্যাবর্তের রাজচক্রবর্তী সম্রাট হতে চলেছেন দিল্লির অধিপতি পৃথ্বীরাজ চৌহান।” পরবর্তীকালে দূতের মুখে পৃথ্বীরাজের বার্তা শ্রবণ করে যারপরনাই ক্রুদ্ধ হলেন কান্যকুব্জের রাজা জয়চাঁদও। তিনি ক্রধোন্মত্ত হয়ে মুহূর্তের মধ্যে নিজ কটিদেশের বাম প্রান্তে রক্ষিত কোষ থেকে অসি বের করে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “কি সেদিনের শিশুপুত্র পৃথ্বীরাজ, যার দুধের দন্ত আজও বিরাজমান, সে আজ শুধুমাত্র ভাগ্যের সহায়তায় আজমির আর দিল্লির অধিপতি হয়ে নিজেকে এতটাই মহান বীর মনে করছে যে কান্যকুব্জের রাজার অশ্বমেধের রথকে রুখে দিয়ে চূড়ান্ত অপমানিত করে নিজেকে আর্যাবর্তের ভবিষ্যতের রাজচক্রবর্তী সম্রাট ঘোষণা করে ফেরৎ পাঠিয়ে আমাকে যুদ্ধের আহবান জানিয়েছে। উত্তম সমরভূমিতেই আমি পৃথ্বীরাজকে ওর ঔদ্ধত্যের যোগ্য আর সমুচিত জবাব দেবো। অতি শীঘ্রই কনৌজের সামরিক শক্তির পরিচয় পাবে শিশুপুত্র পৃথ্বীরাজ।”ফলে শুরু হলো এক দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর অনৈক্যের অধ্যায়। ১১৯২ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে এই ভারতীয় রাজাদের এই আভ্যন্তরীণ কলহ, বৈরিতা আর অনৈক্যই বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুর্কি বাহিনীর দাসত্ব আর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছিল সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অখণ্ড ভারতবর্ষকে।

তরাইনের প্রথম যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
=======================
এদিকে ১১৯০ সালের অন্তিমলগ্নে ভারতবর্ষের মাটিতে ইসলামিক সাম্রাজ্য বিস্তারের অদম্য লক্ষ্য বুকে নিয়ে খাইবার পাস অতিক্রম করে পাঞ্জাবের ভাতিণ্ডা অঞ্চল দিয়ে রাহুর ন্যায় পুনরায় মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করলেন মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। এবারের অভিযানেও কায়দারার যুদ্ধের সময়ের দুই বিশ্বস্ত সেনাপতি নাসিরউদ্দিন কুবাচা আর তাজউদ্দিন ইয়ালদুজ, মহম্মদ ঘোরীর সাথে সামিল হয়েছিল। সেই সাথে ঘোরী বাহিনীর এবারের ভারত অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল এক তরুন তুর্কি যোদ্ধা, যার নাম পরে জানা যাবে। সেই সময় ভাতিণ্ডা ছিল আজমিরের অন্তর্গত। পৃথ্বীরাজ চৌহানের বাল্যসখা তথা অন্যতম প্রিয় সেনাপতি চাঁদ পুন্দিরের উপর ন্যস্ত ছিল ভাতিণ্ডা অঞ্চলের শাসনের দায়িত্ব। রাজ্য সুরক্ষিত রাখবার প্রয়োজনে চাঁদ পুন্দির ভাতিণ্ডা আর পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলে নির্মাণ করেছিলেন এক কেল্লা। এক নিশুতি রাতে নৈশভোজ সম্পন্ন করে চাঁদ পুন্দিরের নেতৃত্বাধীন আজমির বাহিনী যখন বিশ্রামরত ছিল ঠিক সেই সময় এক বিশ্বাসঘাতকের সহায়তায় গুপ্ত সুড়ঙ্গপথে কেল্লায় প্রবেশ করলো ঘোরী বাহিনী। কেল্লার ভেতরে প্রবেশ করেই নিদ্রিত আজমির বাহিনীকে নির্মম ও নির্দয়ভাবে সংহার করে কেল্লার দখল নিলো তুর্কি সেনা। তারপর কেল্লার বুরুজে উড্ডীন আজমিরের ধ্বজ প্রত্যাহার করে লটকানো হলো অর্ধচন্দ্র আর কলমা অঙ্কিত ঘুরের ঝাণ্ডা। কেল্লা অধিকারের দিনকয়েক পরে দিল্লি-আজমিরের শাসক পৃথ্বীরাজ চৌহানকে ঘৃণ্য কাফের আখ্যা দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে দিল্লি অধিকার করবার লক্ষ্যে নিজ লস্কর সমেত সেদিকে অগ্রসর হলেন মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী।

নিজ রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের অক্ষপটলে যখন ঘনিয়ে আসছে বর্বর বিজাতীয় তুর্কি আগ্রাসনের করাল কালো ছায়া, ঠিক সেই সময় ব্যক্তিগত প্রতিশোধ গ্রহনের লক্ষ্যে পৃথ্বীরাজকে আক্রমণ করলেন গুজরাটের রাজা ভীমদেব সোলাঙ্কি। কায়দারার নিকটেই এক উন্মুক্ত প্রান্তরে মুখোমুখি হলো চৌহান আর চালুক্য বাহিনী। শুরু হলো এক শক্তিক্ষয়ী অহেতুক যুদ্ধ। ভীমদেবকে তাঁর আগ্রাসনের সমুচিত জবাবদানের লক্ষ্যে নিজের সেনাপতি উদয়রাজের সাথে নিজের হস্তীবাহিনী সমেত কায়দারা অভিমুখে যাত্রা করলেন ক্রুদ্ধ পৃথ্বীরাজ। সেনাপতি উদয়রাজ গৌড়ীয় রাজপুত ছিলেন। বহু পূর্বে বাংলার পাল রাজবংশের শাসনকালের অন্তিম লগ্নে বঙ্গের গৌড় রাজ্যের জনা কয়েক ক্ষত্রিয় পরিবার রাজপুতানার অন্তর্গত মেবার আর আজমিরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীকালে আজমিরের শাকম্ভরি চৌহানদের অন্যতম প্রধান সামন্ত রাজার পদে নিযুক্ত হন গৌড় রাজপুত যোদ্ধা ঈশ্বরদাস। রাজা ঈশ্বরদাসের জ্যৈষ্ঠ পুত্র ছিলেন উদয়রাজ।

প্রথমদিনের যাত্রাশেষে শেষে তখন সন্ধ্যাকালে প্রায় আসন্ন। সূর্য ঢলে পড়েছে দিকচক্রবালের পশ্চিমপ্রান্তে। গোধূলি লগ্নের নরম স্বর্ণজ্বল আলোকছটায় বিচ্ছুরিত প্রান্তরভূমি যেন সেই অতীতকালের সোনার চিড়িয়া ভারতবর্ষের ছবিই অঙ্কিত করছিল তাঁর অদৃশ্য চিত্রপটে। দিনান্তের অন্তিমলগ্নের আলোয় দেখা যাচ্ছিল সসৈন্যে রাজধানি দিল্লি ত্যাগ করে গুজরাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায় যাচ্ছেন দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ। তাঁর বিশাল বাহিনীর একেবারে সম্মুখভাগে আজমিরের রাজকীয় পতাকাবাহী পদাতিক বাহিনী, এর পরবর্তী সারিতে সেনাপতি উদয়রাজের নেতৃত্বাধীন বাদ্যকারের দল আর কবচ আচ্ছাদিত অশ্বারোহী বাহিনী, অন্তিম সূর্যালোকের স্বর্ণালি আলোকরশ্মিতে ঝলমল করছে তাঁদের হস্তে ধরা ভল্ল আর তরবারি। এরপর চলেছে দৈত্যাকার বিশালদেহী হস্তী বাহিনী। হস্তী বাহিনীর মধ্যভাগে ব্যক্তিগত দেহরক্ষী পরিবৃত লৌহপাত আর বর্ম আচ্ছাদিত দিল্লিশ্বরের রাজহস্তি। সেই হস্তি পৃষ্ঠে স্বর্ণ হাওদায় বসে আছেন লৌহবর্ম, লৌহজালিকা আর লৌহ শিরস্ত্রাণ পরিহিত যোদ্ধার বেশে সজ্জিত পরাক্রমশালী ২৫ বছর বর্ষীয় দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ চৌহান। যুবা রাজার বাম হস্তে শোভা পাচ্ছে রাজপুত আভূষণ কোষবদ্ধ তরবারি। বহু দূর থেকে সূর্যালোকে ঝলমল করছে দিল্লিশ্বরের হীরক খোচিত রাজ উষ্ণীষ। ক্রমে দীর্ঘ পথযাত্রার শেষে সূর্য অস্তাচলে গেল, সন্ধ্যার ঘন পুরু আধারে আচ্ছাদিত হয়ে পড়ল সমগ্র চরাচর। সেদিনের মত পথযাত্রায় ক্ষান্ত দিয়ে একটি জনপদের নিকটে শিবির স্থাপন করল চৌহান বাহিনী। তখন মধ্যরাত। নিজের সুসজ্জিত তাঁবুতে নিদ্রামগ্ন দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ। নিস্তব্ধ নিশুতি রাতে মশাল আর অস্ত্র হাতে অতন্দ্র প্রহরায় রত চৌহান বাহিনীর রক্ষীগণ আচমকা শ্রবণ করলেন এক অশ্বের খুঁড়ের ধ্বনি। রাতের নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে এক অজানা সুরের তালে তাল মিলিয়ে ক্রমে চৌহান শিবিরের দিকেই যেন এগিয়ে আসছিল সেই অশ্বখুঁড়ের ছন্দময় খট-খটা-খট ধ্বনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আজমিরের রক্ষীরা মশালের আলোয় দেখতে পেলেন এক রহস্যময় অজ্ঞাত পরিচয় অশ্বারোহীকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অশ্বারোহী দ্রুতগতিতে এসে প্রবেশ করলো আজমিরের সেনা শিবিরের মধ্যে। সাথে সাথেই সাবধান হয়ে উঠলো আজমির বাহিনী। শুরু হলো প্রবল কোলাহল। নিজের তরবারি হস্তে রক্ষী সমেত অশ্বারোহীর দিকে ধেয়ে এলেন সেনাপতি উদয়রাজ। অশ্বারোহীর দিকে তরবারি উঁচিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, “দাঁড়াও যাত্রী, বিনা অনুমতিতে আরেক এক পা অগ্রসর হলে নিজের পৈতৃক প্রাণটা হারাবে তুমি। অবিলম্বে নিজের পরিচয় দাও।”
অশ্বারোহী দাঁড়িয়ে পড়ে ক্লান্ত অবসন্ন কণ্ঠে বলে উঠলেন, “সেনাপতি উদয়রাজ আমিও আজমির বাহিনীর এক সংবাদবাহক দূত। সদুর ভাতিণ্ডা থেকে এসেছি, সেনাপতি চাঁদ পুন্দিরের নির্দেশে মাননীয় মহারাজকে এক অতীব দুঃসংবাদ প্রেরন করতে।”

ততক্ষণে বাইরে কোলাহলের শব্দে নিদ্রাভগ্ন হয়েছে মহারাজ পৃথ্বীরাজের। এরপর উদয়রাজ সেই দূতকে নিয়ে এলেন তাঁর তাঁবুতে। দূতের মুখে পৃথ্বীরাজ শুনলেন স্মেচ্ছ তুর্কি বাহিনীর দ্বারা তাঁর রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ভয়াবহ আগ্রাসনের সংবাদ। একদিকে চালুক্য নরেশ ভীমদেব, অপরদিকে বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুর্কি দস্যু মহম্মদ ঘোরী। বিপন্ন ও ক্ষুব্ধ পৃথ্বীরাজ তাঁর রণনীতি ও কর্তব্য স্থির করতে না পেরে সেই রাতেই দিল্লির রাজজ্যোতিষী আচার্য আদিত্যনারায়ণের শরণাপন্ন হবার জন্য গুজরাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা স্থগিত রেখে সেই মুহূর্তেই দিল্লি ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। পরেরদিন দিল্লির লালকোটে (বর্তমানে কুতুব কমপ্লেক্স) নিজের রাজমহলে পৌঁছলেন পৃথ্বীরাজ। পৃথ্বীরাজের মুখে দ্বাদশ বর্ষকাল পরে পুনরায় ভারতভূমিতে যবন আগ্রাসনের সংবাদ শুনে দিল্লির ভীত অমাত্য প্রধান কইমস পূর্বের ন্যায় এবারেরও রাজাকে পরামর্শ দিলেন ঘোরী বাহিনীর সাথে সন্ধি আলোচনা প্রস্তাবের। এরপর রাজজ্যোতিষী আদিত্যনারায়ণের সাথে সাক্ষাৎ করলেন চিন্তান্বিত মহারাজ। পৃথ্বীরাজের মুখে সব শুনে রাজজ্যোতিষী আদিত্যনারায়ণ শান্ত ও সৌম্য কণ্ঠে বললেন, “মহারাজ, বর্তমানে দিল্লি দ্বিমুখী শত্রু দ্বারা আক্রান্ত। তবে প্রতিবেশি চালুক্য নরেশের থেকেও এই মুহূর্তে দিল্লি তথা সমগ্র ভারতবর্ষের জন্য অধিক সঙ্কটজনক হলো উত্তর-পশ্চিমের পর্বত আর রুক্ষ মরুপ্রান্তর দ্বারা অবরুদ্ধ লুণ্ঠকদের ভূমি (আফগানিস্থান) থেকে আগত বর্বর স্মেচ্ছ যবন দস্যুগণ। বর্তমানে যেই গুজরাট নরেশ আপনার শত্রু আজ থেকে ১২ বছর পূর্বে তাঁদের রাজ্যেও হানা দিয়েছিল এই তুরস্কজাত এই স্মেচ্ছ মরুদস্যরা। এই বিধর্মীরা গোমাংস ভক্ষণকারী বর্বর উৎপীড়ক। ইতিপূর্বে বহুবার এদের হাতে আক্রান্ত ও লুণ্ঠিত হয়েছে আমাদের সনাতন ধর্ম আর সভ্যতা, লাঞ্ছিত ও ধ্বস্ত হয়েছে আমাদের একাধিক দেবালয়, এদের তরবারির আঘাতে পীড়াদায়ক নিষ্ঠুর মৃত্যুর শিকার হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা, বন্দি ও ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছেন বহু সনাতন ভারতবাসী আর এদের যৌন লালসার শিকার হয়েছেন অগণিত ভারতীয় ললনা। আজ থেকে দ্বাদশ বর্ষ পূর্বেও তুরস্কজাত যবন দস্যু সর্দার মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী আমাদের মাতৃভূমিকে বিনষ্ট করবার অভিপ্রায়ে গুজরাট সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান গুজরাট নরেশের রাজমাতার তরবারির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছিলেন সেবারে। এতো বছর পরে আবার ফিরে এসেছে যবন অসুররা। আপনি ধর্ম রক্ষা করুন মহারাজ। এই মুহূর্তে যবনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করুন। অবিলম্বে ওদের পরাজিত না করতে পারলে বিগত সহস্র বৎসরকাল ধরে আমাদের মহান পূর্বজদের দ্বারা নির্মিত সোনার ভারতবর্ষ বিনষ্ট হবে। লুপ্ত হবে বৈদিক সভ্যতা আর সংস্কৃতি।”

দিল্লির প্রস্তুতি পর্ব
=============
রাজজ্যোতিষীর পরামর্শ শুনে পৃথ্বীরাজ নিজের কোষবদ্ধ অসি উন্মুক্ত করে দেবাদিদেব সোমেশ্বরের (মহাদেব, পৃথ্বীরাজের পিতা নন) নামে শপথ করলেন গোমাংস ভক্ষনকারী গর্জিনীর ঘোরী বাহিনীকে পূর্বের কায়দারার রণাঙ্গনের ন্যায় পুনরায় পর্যুদস্ত করে ধুলোয় মিশিয়ে ভারতবর্ষের ভূমি থেকে বিতাড়িত করবার। এরপর পূর্বের ৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দের রাজস্থানের ধর্মযুদ্ধ আর ১০৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ভারুচের ধর্মযুদ্ধের পদাঙ্ক অনুসরন করে সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনী গঠন করবার অভিপ্রায়ে সামরিক সহায়তা চেয়ে পত্র প্রেরন করলেন চতুর্দিকে। কিন্তু ১১৭৮ খ্রিষ্টাব্দের রানি নাইকিদেবীর ন্যায় পৃথ্বীরাজকেও হতাশ হতে হলো। বঙ্গ অধিপতি লক্ষণসেন, কনৌজ অধিপতি জয়চাঁদ, চান্দেল অধিপতি, পারমার অধিপতি সহ হিন্দুস্থানের নিকটবর্তী সমস্ত শক্তিশালী রাজারাই স্বভাবসিদ্ধ ঔদ্ধত্যে দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ চৌহানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন। পৃথ্বীরাজের পত্র নিয়ে দিল্লির দূত উপস্থিত হলেন আনহিলওয়াড়ার রাজপ্রাসাদেও।

গুজরাট নরেশ ভীমদেব সোলাঙ্কি পত্র পাঠ করেই তাচ্ছিল্যপূর্ণ স্বরে দিল্লির রাজদূতকে বললেন, “আজ থেকে দ্বাদশ বর্ষ পূর্বে ঠিক এরকমই সঙ্কটজনক ছিল গুজরাটের পরিস্থিতি। সেই সময় আমার মাতাশ্রী প্রয়াত মহারানি নাইকিদেবীও সামরিক সহায়তা প্রার্থনা করে দূত মারফৎ পত্র প্রেরন করেছিলেন আপনাদের রাজদরবারে। কিন্তু উদ্ধত দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ তাচ্ছিল্যভরে সেই প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, আর আজ অদৃষ্টের কি করুন পরিহাস। দিল্লি আজ নিজেই স্মেচ্ছ তুর্কি দস্যুদের হাতে আক্রান্ত হয়ে সেনা সহায়তার ভিক্ষা চেয়ে পত্র প্রেরন করেছে। দিল্লি ফিরে গিয়ে আপনাদের মহারাজ পৃথ্বীরাজকে জানিয়ে দিন গুজরাট কোনরকম সামরিক সহায়তা প্রদান করবে না দিল্লিকে। তবে বিজাতীয় স্মেচ্ছ যবন দস্যুদের পরাজিত করে ধর্মের রক্ষার প্রয়োজনে এই মুহূর্তে গুজরাটের তরফ থেকে দিল্লির বিরুদ্ধে যাবতীয় যুদ্ধযাত্রা স্থগিত রাখবার কথা ঘোষণা করলাম আমি।”
গুজরাটের তরফ থেকে আগ্রাসনের আশঙ্কা নির্মূল হবার পরে নিজের দৈত্যসম হস্তী বাহিনী নিয়ে ঘোরী বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করলেন পৃথ্বীরাজ।

ভারতীয় ক্রুসেড পর্বঃ তরাইনের প্রথম যুদ্ধ (দ্বিতীয় ভাগ)
=========================================
দিল্লির মন্ত্রনাকক্ষে কাপুরুষ কইমসের মুখোমুখি পৃথ্বীরাজ
========================================
ধর্ম রক্ষার স্বার্থে গুজরাটের রাজা দ্বিতীয় ভীমদেব আপাতত আজমিরের বিরুদ্ধে আক্রমন স্থগিত রাখবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। আক্রমনের শঙ্কা স্থিমিত হবার সংবাদ শ্রবণের সাথে সাথেই দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ নির্ণয় নিলেন স্মেচ্ছ ঘোরী বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ভারতমাতাকে শঙ্কা মুক্ত করবার। সেইমতো তিনি লালকোটের মন্ত্রণা সভায় সকল সভাসদ আর অমাত্যদের এক আপাতকালীন জরুরি সভায় ডেকে পাঠালেন। সভায় দিল্লির দুই সেনাপতি উদয়রাজ আর চামুণ্ডা রায় আর সামন্ত রাজ অর্জুন রায় গোমাংস ভক্ষনকারী দুর্বৃত্ত স্মেচ্ছ ঘোরী বাহিনীকে যথোচিত শিক্ষা প্রদানের জন্য তুর্কিদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে যুদ্ধ ঘোষণা করবার পক্ষে মতদান দিলেন। কিন্তু কাপুরুষ অমাত্য প্রধান কইমস এবারেও পৃথ্বীরাজের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “ক্ষমা করবেন মহারাজ, আপনি এবং আপনার সেনাপতি ও সামন্ত রাজারা বয়সে তরুন। আপনাদের ধমনী দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে উষ্ণ রক্তস্রোতের তাজা ধারা। শত্রুর বিরুদ্ধে খুব অল্পেতেই উত্তেজিত হয়ে যুদ্ধের পথ বেছে নেন আপনারা। কিন্তু যুদ্ধনীতি ও রাজনীতিতে আপনারা এখনও অনভিজ্ঞ। আমাদের মনে রাখতে হবে এই মুহূর্তে আমাদের শত্রু রাজা ভীমদেব বা রাজা জয়চাঁদের ন্যায় আর্যবর্ত্মের কোন অতি পরিচিত প্রতিবেশী রাজ্য নয়, আমাদের শত্রু সদুর গর্জিনীর রক্ষ মরুপ্রান্তর আর বন্ধুর গিরিকান্তর প্রদেশ থেকে আগত গোমাংসভোগী স্মেচ্ছ যবন বাহিনী। যবনদের ধর্ম, সংস্কৃতি আর যুদ্ধনীতি আমাদের সম্পূর্ণ অপরিচিত। এর আগেও একাধিকবার ওরা আমাদের মাতৃভূমিতে হামলা চালিয়ে আমাদের রাজাদের পরাজিত করে অবাধে লুণ্ঠনপর্ব সম্পন্ন করেছে। খুব সম্ভবত এবারেও ওদের লক্ষ্য শুধুমাত্র ভারতবর্ষের ধনসম্পদ লুণ্ঠন। আমার মত যদি গ্রহণ করেন মহারাজ, তাহলে অজানা বর্বর বিজাতীয় যবন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায় না গিয়ে তাদের প্রচুর পরিমানে রত্নরাজি উপঢৌকন প্রেরন করে মহম্মদ ঘোরীর সহিত সন্ধি চুক্তি সাক্ষরিত করুন। এতে অজানা শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধযাত্রা এড়ানো সম্ভব হবে, আবার তুর্কি আগ্রাসনের হাত থেকে দিল্লি-আজমিরকে রক্ষা করাও সম্ভব হবে। মহারাজ শাস্ত্রেই লিপিবদ্ধ রয়েছে, শত্রুর শত্রু আমার মিত্র। অতএব যবনদের সহিত সন্ধি চুক্তির সময় আপনি তাঁদের সামরিক সহায়তা নিয়ে আপনার দুই প্রবল শত্রু রাজা জয়চাঁদ আর রাজা ভীমদেবকেও পরাজিত করবার সুযোগ পাবেন।”

অমাত্য কইমসের মুখে এহেন কাপুরুষোচিত পরামর্শ শুনে যারপরনাই ক্ষিপ্ত হলেন মহারাজ পৃথ্বীরাজ চৌহান। তিনি বিদ্যুৎ গতিতে নিজের রাজসিংহাসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের অসি কোষমুক্ত করে কইমসের সামনে এগিয়ে এসে তাঁর কণ্ঠনালিতে নিজের তরবারির ফলা স্পর্শ করে ক্ষুব্ধ স্বরে বলে উঠলেন, “অবিলম্বে আপনার বাক্য সম্বরন করুন অমাত্য প্রধান কইমস। আপনি নিজে একজন রাজপুত ক্ষত্রিয় হয়েও আরেক রাজপুতকে পরামর্শ দান করছেন বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুর্কি দস্যুদের বিরুদ্ধে শান্তি ক্রয় করবার ? আজ থেকে দ্বাদশ বর্ষ পূর্বেও কায়দারার যুদ্ধের সময় আমার নিজের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র আপনার কাপুরুষোচিত পরামর্শ শুনে গুজরাটের রাজমাতা রানি নাইকিদেবীকে কোনরূপ সহায়তা প্রদান করতে পারিনি। কিন্তু তখন আমি বালক ছিলাম, দুর্বল ছিলাম। একক সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা আমার ছিল না। আপনার সেদিনের সেই কাপুরুষোচিত পরামর্শের কারনেই আজ রাজা ভীমদেব দিল্লির শত্রু। কিন্তু আজ আমি যুবা ও এক শক্তিশালী নরপতি। আপনি বোধহয় বিস্মৃত হয়েছেন যে, রাজপুত ক্ষত্রিয়দের নিকট যুদ্ধ হলো তাঁদের অন্যতম প্রিয় ক্রীড়া আর নিজের প্রান দিয়ে মাতৃভূমি আর প্রজাগণের সম্মান, প্রান আর সম্ভ্রম রক্ষা করা হলো ক্ষত্রিয়ের পরম কর্তব্য। ক্ষত্রিয়রা প্রয়োজনে নিজের মস্তক বিসর্জন দেয়, কিন্তু কখনও শত্রুর সম্মুখে মাথানত করে না, আমি এই মুহূর্তে বিজাতীয় স্মেচ্ছ ঘোরী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছি। হয় রণাঙ্গনে তুর্কি দুর্বৃত্ত বাহিনীকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে, আর্যবর্ত্মকে সম্মানিত করে বিজয়ীর বেশে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করবো, নতুবা যুদ্ধভূমিতেই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে প্রান বিসর্জন দেবো। জয় সোমেশ্বর।”

পৃথ্বীরাজের যুদ্ধযাত্রা
===============
পৃথ্বীরাজের সিদ্ধান্ত শুনে মন্ত্রণাকক্ষে উপস্থিত অবশিষ্ট সেনাপতি ও সামন্তরাজরা একত্রে তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে “হর হর মহাদেব” ধ্বনিতে মন্ত্রণাকক্ষ আন্দোলিত করে তুললেন। পরেরদিন ঊষার প্রথম কিরণ প্রস্ফুটিত হবার সাথে সাথেই দেখা গেল পৃথ্বীরাজ সুদ্ধ বসনে লালকোট প্রাসাদ সংলগ্ন কুঞ্জবনের পশ্চাৎভাগে অবস্থিত সরোবরে স্নান পর্ব সম্পন্ন করে প্রাসাদের ঈশানকোনে অবস্থিত সুবিশাল সোমেশ্বর দেবের মন্দিরে প্রবেশ করে ভক্তিভরে তরবারি পূজো সম্পন্ন করে, বিধর্মীদের বিরুদ্ধে আসন্ন যুদ্ধে বিজয়লাভের প্রার্থনা করলেন। এরপর প্রাসাদে ফিরে এসে যুদ্ধের আভূষণে সজ্জিত হয়ে নিজের মাতা রানি কর্পূরদেবীর সম্মুখে এসে উপস্থিত হয়ে মায়ের পদস্পর্শ করে প্রনাম করলেন। তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে আসন্ন মহারণে নিজের জ্যৈষ্ঠ পুত্রের সাফল্য কামনা করে লালকোট প্রাসাদ চত্বরে অবস্থিত ২৭ টি বিগ্রহ মন্দিরে পূজা সম্পন্ন করে তার জন্য পদ্মপুষ্প নিয়ে এসেছিলেন। রানি কর্পূর দেবী প্রথমে পৃথ্বীরাজের ললাটে পূজোর পদ্মপুষ্প স্পর্শ করিয়ে তারপর চিরাচরিত রাজপুত প্রথা অনুসারে বিজয়তিলক অঙ্কিত করে আবেগপূর্ণ বাষ্পরুদ্ধ স্বরে বললেন, “বিজয়ী ভব, আশীর্বাদ করছি আজ থেকে দ্বাদশ বর্ষ পূর্বে গুজরাটের রাজমাতা নাইকি দেবীর ন্যায় তুমিও বিজাতীয় স্মেচ্ছ বাহিনীকে ভারতবর্ষের পবিত্র ভূমি থেকে বিতাড়িত করে সফল হয়ে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করবে।” এরপর নিজের মাতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পৃথ্বীরাজের কনিষ্ঠ ভগিনী রাজকুমারী পৃথাও তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় দাদাভাইয়ের ললাটে বিজয় তিলক অঙ্কিত করলেন। তারপর রাজপ্রাসাদের বাইরে এসে হস্তী বাহিনীর সম্মুখেভাগে আপাদমস্তক লৌহপাত আর লৌহ বর্ম দ্বারা আচ্ছাদিত একটি বিশেষ হস্তীর সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন রাজা পৃথ্বীরাজ। হস্তীর পৃষ্ঠদেশে সুকঠিন কাষ্ঠ নির্মিত একটি চতুষ্কোণ হাওদা। হাওদার চারপাশ কেল্লার বুরুজের মতো করে নির্মিত। ওই হাওদার বহির্বিভাগের চারিপাশে একাধিক সুকঠিন লৌহ ঢাল লাগিয়ে আরও মজবুত করা হয়েছে। হস্তী বাহিনীর অনান্য রণহস্তীগুলোও একইরকমভাবে সজ্জিত। তৎকালীন মধ্যযুগীয় ভারতীয় যুদ্ধের প্রথা অনুযায়ী হাওদার অভ্যন্তরে আপাত নিরাপদ স্থানেই আসন গ্রহণ করবেন দিল্লিশ্বর। হাওদার ভেতরেই থরে থরে সজ্জিত রয়েছে তুন ভর্তি তির আর একাধিক ভল্ল। এছাড়া মহারাজের কটিদেশের বাম প্রান্তে স্বর্ণকোষে ঝলমল করেছে তাঁর তরবারি আর পৃষ্ঠদেশে অবস্থান করছে তাঁর ধনুক। হাওদার সম্মুখে রয়েছেন মাহুত। নিজের প্রিয় মনিবকে দেখতে পেয়েই হাতিটি মহাখুশি হয়ে শূন্যে শুঁড় উত্থলিত করে সজোরে বৃংহণ ধ্বনি দিয়ে উঠলো। রাজাও যারপরনাই পুলকিত হয়ে তাঁর প্রিয় রণহস্তীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “উত্তম, অতি উত্তম গজরাজ।” এরপর গজরাজের পৃষ্ঠে আসীন হয়ে রাজা পৃথ্বীরাজ তাঁর অসি কোষমুক্ত করে নিজের সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে ভৈরবধ্বনিতে সিংহ গর্জন করে উঠলেন, “জয় সোমেশ্বর! হর হর মহাদেব।” প্রত্যুত্তরে দিল্লির সেনাবাহিনীও পাল্টা গর্জন করে জবাব দিলো, “হর হর মহাদেব”। এরপর শুরু হলো ভাতিণ্ডার উদ্দেশ্যে যুদ্ধযাত্রা।

যুদ্ধের প্রস্তুতি মইজুদ্দিন ঘোরীর
=======================
অপরদিকে সদুর পাঞ্জাবে ছল চাতুরির সাহায্যে ভাতিণ্ডা কেল্লা অধিকার করবার পর সেই কেল্লার ভেতরে অবস্থিত দিল্লি-আজমিরের সমস্ত বন্দি রক্ষীদের নির্মমভাবে হত্যা করলেন মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। তুর্কি অধিপতির হৃদয়ের অভ্যন্তরে তখনও যেন তীক্ষ্ণ শলাকার ন্যায় বিদ্ধ হচ্ছিল দ্বাদশ বর্ষ পূর্বে কায়দারার যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের স্মৃতি। এরপর কেল্লার ভেতরে অবস্থিত সুপ্রাচীন বারোটি মন্দির রাজি সম্পূর্ণ রূপে ধ্বস্ত করে সেগুলোর মালমশলা দিয়ে একটি অতিকায় মসজিদ নির্মাণ করা হলো ঘোরী আর তাঁর বাহিনীর নমাজ পাঠের জন্য। এরপর তুর্কি বাহিনীর রক্ষীরা কেল্লার ভেতরেই শিবির স্থাপন করে গোমাংস ভক্ষন আর সুরাপান করে দিন কতক সেখানেই আনন্দ উৎসব করলো। তারপর এক সন্ধ্যায় দৈনন্দিন নামাজপাঠের পর নিজের বাহিনীর রক্ষীদের এক জরুরি সভায় ডেকে পাঠালেন মইজুদ্দিন ঘোরী। সর্দারের নির্দেশ পেয়ে ভাতিণ্ডা কেল্লার ভেতরে অবস্থিত এক বিশাল প্রাঙ্গনে এসে জমায়েত হলো তুর্কি সেনারা। প্রাঙ্গনের অপর প্রান্তে কেল্লার উঁচু প্রাকারের উপর দণ্ডায়মান স্বয়ং মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। দীর্ঘ দ্বাদশ বছরের ব্যবধানে কায়দারার রণাঙ্গনের যুবা তুর্কি অধিপতি আজ রণকৌশলে পারদর্শী এক মধ্য বয়স্ক প্রবীণ ব্যক্তি। একাধিক মশালের আলোয় ঘোরীর দুই চক্ষুর ক্রূর দৃষ্টি থেকে যেন বিষধর সর্পের ন্যায় যেন দ্বেষপূর্ণ বিষাক্ত গরল নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। রক্ষীরা দেখতে পেলো, ঘোরীর বাম হস্তে বস্ত্রখণ্ডে নির্মিত একটি মানচিত্র আর দক্ষিন হস্তের মুষ্টিতে ধরা একটি তীক্ষ্ণধার ছুরিকা। নিজের সেনাদের উদ্দেশ্যে ঘোরী সর্পের ন্যায় হিমশীতল স্বরে বলে উঠলেন যে বিশ্রাম আর ফুর্তি অনেক হলো, এবারে সময় হয়েছে হিন্দুস্থানের মুল ভূখণ্ডে আক্রমন করে পৌত্তলিক কাফেরদের নির্ণায়কভাবে পরাজিত করে হিন্দুস্থানের বুকে এক বিশাল ইসলামিক সাম্রাজ্য স্থাপনের। সেই উদ্দেশ্যে তার প্রাথমিক লক্ষ্য হবে দিল্লি আর আজমির অধিকার। তারপর ঘোরী নিজের মুষ্টিতে ধরা মানচিত্রটি সর্ব সম্মুখে তুলে ধরে ছুরিকার ফলা দিয়ে একটি বিশেষ স্থান নির্দেশিত করে সেনাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন যে ওই জায়গাটি বর্তমান আজমির নরেশ পৃথ্বীরাজ চৌহানের রাজধানি রাজধানি দিল্লি নগর। এরপর মানচিত্রটি সামনের একটি উঁচু প্রস্তরখণ্ডের উপর রেখে ছুরিকার ফলা দ্বারা দিল্লি নগরের চিত্রকে বিদ্ধ করে হিমশীতল স্বরে বলে উঠলেন, “ইনশাল্লা, অদূর ভবিষ্যতে এই দিল্লি নগরই হতে চলেছে হিন্দুস্থানে বুকে আমার দ্বারা নবগঠিত ইসলামিক সাম্রাজ্যের রাজধানি। তোমরা সকলে তৈরি হও দিল্লি অধিকারের জন্য। এবারে আর দ্বাদশ বর্ষ পূর্বের কায়দারার যুদ্ধের ন্যায় ভুল করলে চলবে না আমাদের। ছলে, বলে আর কৌশলে কাফের রাজা রায় পিথোরার (পৃথ্বীরাজ) হাত থেকে দিল্লি ছিনিয়ে নেবো আমরা। আল্লাহ-আকবর”
ঘোরীর ভাষণ শেষ হবার সাথে সাথেই তুর্কি বাহিনী সমস্বরে গর্জন করে উঠলো, “আল্লাহ-আকবর”। এরপর ঘোরী সিদ্ধান্ত নিলেন আগামীকাল ভোরে দিল্লির উদ্দেশ্যে শুরু করবেন যুদ্ধযাত্রা।

তুর্কি শিবিরে এক অদ্ভুত ফকিরের আগমন
===============================
তখন প্রায় শেষরাত। নিজের তাঁবুতে নিদ্রামগ্ন মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। এমন সময় আচমকা তাঁবুর বাইরে এক তীব্র কোলাহলে নিদ্রা ভগ্ন হলো তার। যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয়ে ঘোরী ডেকে পাঠালেন তার দেহরক্ষীদের। বক্র অসি হস্তে পাগড়ি পরিহিত দুই ছাগল দাড়িওয়ালা রক্ষী সন্ত্রস্ত ভাবে এসে উপস্থিত হলেন সিপাহী সালারের তাঁবুর ভেতরে। তাদের নিকটে কোলাহলের কারন জানতে চাইলেন ক্রুদ্ধ ঘোরী। দুই রক্ষী কোনমতে ভীত কম্পিত স্বরে বলে উঠলেন ফকির গোছের এক অদ্ভুত আধা উন্মাদ ব্যক্তি আচমকা এসে উপস্থিত হয়েছে তাদের শিবিরে। তিনি অবিলম্বে সিপাহী সালারের সাক্ষাৎ প্রার্থী। তিনি দাবি করেছেন যে সর্দারের প্রতি একটি বিশেষ ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ এনেছেন তিনি। মইজুদ্দিন মহম্মদ
ঘোরী সামরিক বিদ্যা আর ছল-চাতুরিতে পারদর্শী হলেও যথেষ্ট কুসংস্কারগ্রস্ত মনভাবাপন্ন ব্যক্তি ছিলেন। এছাড়া পূর্বের কায়দারার যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি তখনও যেন তাকে এক দুঃস্বপ্নের ন্যায় তাড়া করে বেরাচ্ছিল। অজ্ঞাত পরিচয় কোন এক ফকির নিজে এই শেষরাতে তার সাথে দেখা করতে এসেছেন শুনে বিন্দুমাত্র কালবিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ তাঁকে ভেতরে নিয়ে আসবার অনুমতি দিলেন।

কিছুক্ষণ পরেই রক্ষীদের নজরবন্দি হয়ে ঘোরীর তাঁবুতে প্রবেশ করলেন এক মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি। বয়স তার আন্দাজ পঞ্চাস ছুঁইছুঁই। তিনি গুম্ফহীন হলেও তার গাল ভর্তি শুভ্র পরিপক্ক দাড়ি। তার মস্তক জুড়ে বিশাল সফেদ পাগড়ি আর পরনের পদযুগলের পাতা পর্যন্ত বিস্তৃত সফেদ আলখাল্লা। তাঁবুর ভেতরে প্রবেশ করেই তিনি কুর্নিশ করে বলে উঠলেন, “সুলতান-এ-ঘুর, জাহাঁপনা এতো রাতে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য মাফি চাইছি। এই অধমের নাম চিস্তি-মইন-আলদিন-হাসান-সিজ্জি। যদিও মইনউদ্দিন চিস্তি নামে অধিক পরিচিত। আমি এক সামান্য ফকির। আমি এসেছি সদুর হিরাট থেকে আপনাকে একটি বিশেষ বার্তা দানের জন্য।”
ঘোরী ফকির মইনউদ্দিন চিস্তিকে আসন গ্রহণ করতে বলে ভক্তিপূর্ণ স্বরে ফকিরের হিন্দুস্থান আগমনের হেতু জানতে চাইলেন। উত্তরে ফকির কিছুক্ষণ নীরব থেকে অবশেষে মন্দ্র স্বরে বলে উঠলেন, “কসুর নেবেন না সুলতান। আমি কিছুদিন আগে এক স্বপ্নে দেখলাম আপনার এই হিন্দুস্থান অভিযান অভিশপ্ত। গতবারের ন্যায় এবারেও নাকামিয়াব হতে চলেছেন আপনি। এবারেও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছেন। তাই এই বান্দার সবিনয় নিবেদন অবিলম্বে গজনী ফিরে যান আপনি। এরপর আমি নিজে গণনা করে আপনাকে হিন্দুস্থানে হামলার শুভ সময় আর তারিখ জানাবো।”

ফকিরের এহেন কথা শুনে বিস্ময়ে স্তভিত হয়ে পড়লেন ঘোরী। তিনি ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, “বেততমিজ তুমি নিজে একজন তুর্কি হয়েও আমার সিখস্ত কামনা করছো ? এছাড়া তুমি আমাকে সুলতান বলে সম্বোধন করছ কেন ? তুমি কি জানো না এই মুহূর্তে ঘুরের সুলতান আমার অগ্রজ ঘিয়াতউদ্দিন মহম্মদ ঘোরী ?”
মইজুদ্দিনের প্রশ্নের জবাবে ফকির মৃদু হেসে রহস্যময় কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আজ্ঞে জনাব, আমি স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখতে পারি। আমি স্বপ্নে দেখেছি বহুৎ জলদি আপনি ঘুর আর হিন্দুস্থানের সুলতান হবেন, তবে আমি স্বপ্নেও এও দেখেছি যে আপনার এইবারের হিন্দুস্থান অভিযান পূর্বের ন্যায় ব্যর্থ হবে। তাই আপনাকে কাতর মিনতি করছি মাননীয় সুলতান-এ-হজরত, আপনি গজনী ফিরে যান।”
এবারে ঘোরী যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয়ে তার রক্ষীদের নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে ইতর ফকির মইনউদ্দিন চিস্তিকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে তার শিবির থেকে তাড়িয়ে দেবার।

তুর্কি বাহিনীর যুদ্ধযাত্রা আর সৈন্য বিন্যাস
==============================
পরেরদিন ভোরে সেজে উঠলো তুর্কি বাহিনী। ঘোরী বাহিনীর সেনা সংখ্যা কত ছিল সে বিষয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। মিনহাজ- সিরাজের তাবাকত আই নাসিরি আর হাসান নিজামির তাজ-উল-মাসিরের মতে তুর্কি বাহিনীর সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৫০ হাজারের মতো। আবার জামি-উল-হিকায়ার মতে ঘোরী বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৪০ হাজারের আশেপাশে। অপরদিকে পৃথ্বীরাজ প্রবন্ধ, প্রবন্ধকোষা আর প্রবন্ধ চিন্তামনির মতো সমসাময়িক সংস্কৃত গ্রন্থ অনুসারে তুর্কি বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৮০ থেকে প্রায় ৯০ হাজারের মতো আর চাঁদ বারদাইয়ের কাব্যগ্রন্থ পৃথ্বীরাজ রাসো ও জয়নাকের কাব্যগ্রন্থ পৃথ্বীরাজ বিজয়ের মতে তুর্কি বাহিনীর সংখ্যা ছিল এক লাখের আশেপাশে। তুর্কি সেনাধ্যক্ষ জিয়াউদ্দিন আর তার ১২০০ অশ্বারোহী বাহিনীকে ভাতিণ্ডা কেল্লার দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে যুদ্ধযাত্রা শুরু করলো ঘোরী বাহিনী। তাদের সম্মুখ সারিতে অবস্থানরত বাদ্যকারদের দল তুড়ি, ভেড়ি আর দুন্দুভি বাজাতে বাজাতে, কলমা আর অর্ধ চন্দ্র অঙ্কিত সবুজ ঝাণ্ডা উড্ডীন করে যুদ্ধ যাত্রা শুরু করলো। বাদ্যকারদের পেছনের ভাগে বক্র অসি, তীক্ষ্ণধার কুঠার আর হাল্কা অজনের লৌহদণ্ড হস্তে দুলকি চালে চলেছে তুর্কি শিবিরের হাল্কা অশ্বারোহী বাহিনী। ফার্সি ভাষায় তাদের পোশাকি নাম আকিঞ্জি। তাদের পেছনের সারিতে পায়ে পা মিলিয়ে চলেছে বিশাল পদাতিক বাহিনী আজাপ। আজাপদের হাতে শোভিত হচ্ছে সুবিশাল তীক্ষ্ণধার ভল্ল, ভারি তরবারি, তির-ধনুক, অতিকায় কুঠার আর লৌহ নির্মিত ভারি ঢাল। তাদের পশ্চাৎভাগে মেদিনিতে অশ্বখুড়ে ধুলো উড়িয়ে চলেছে ভারি অশ্বারোহী বাহিনী। ফার্সি ভাষায় তাদের পোশাকি নাম সিপাহী। সিপাহীরা সজ্জিত মাঝারি মাপের ভল্ল, তরবারি আর ক্রসবো ধরনের তির-ধনুক দ্বারা। সবার পেছনের সারিতে রয়েছে হিন্দুস্থানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বলপূর্বক বন্দি করে আনা ধর্মান্তরিত অসহায় ভারতীয় কৃষক আর সাধারন প্রজাদের দল। এরা সজ্জিত ছিল তির-ধনুক, লৌহ দণ্ড আর অসি সহ বিভিন্ন অস্ত্র দ্বারা। মইজুদ্দিন ঘোরীর হুকুম অমান্য করলে পৈতৃক প্রানটা বেঘোরে খোয়াতে হবে এদের।

মইজুদ্দিন ঘোরীর থানেশ্বর নগর লুণ্ঠন
===========================
পূর্বের সেলজুক সুলতান মামুদ গজনীর দেখানো পথ অনুসরণ করে দিন দুয়েক যাত্রা শেষে সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম পবিত্র স্থান সুপ্রাচীন থানেশ্বর নগরে এসে উপস্থিত হলো ঘোরী বাহিনী। মামুদের ন্যায় সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন আর প্রভাস পট্টন নগর ধ্বংসের বাসনা ইতিপূর্বেই ধূলিসাৎ হয়েছে মহারানি নাইকি দেবীর পরাক্রমের ফলে। কিন্তু এবারে সম্পূর্ণ অরক্ষিত থানেশ্বর নগর লুণ্ঠন আর ধ্বস্ত করে মামুদের কীর্তিতে ভাগ বসানোর এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করলেন না ঘোরী। তার নির্দেশে “আল্লাহ আকবর” রবে এক ক্ষুধার্ত নেকড়ের ন্যায় সমৃদ্ধশালী থানেশ্বর নগরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো মামেলুক তুর্কি বাহিনী। তুর্কি তরবারি আর ভল্লের আঘাতে মুহূর্তের মধ্যেই থানেশ্বর নগর পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো অসহায় নগরবাসীর ক্ষতবিক্ষত মরদেহের স্থুপে। ধ্বস্ত হলো সুপ্রাচীন নগরের অগণিত মন্দিররাজি। এরপর মইজুদ্দিন ঘোরী নিজে তার ব্যক্তিগত রক্ষীবাহিনী সমেত উপস্থিত হলেন থানেশ্বরের বিখ্যাত যোগসোমার মন্দিরে। মন্দিরে প্রবেশ করে ঘোরীর নির্দেশে মুহূর্তের মধ্যে তুর্কি বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করলো সমস্ত অসহায় ভক্তবৃন্দ আর পুরোহিতগণকে। তারপর মন্দিরের যাবতীয় রত্নরাজি লুণ্ঠন করে, যোগসোমার বিগ্রহের বহুমূল্য রুবি ছিনিয়ে নিয়ে সম্পূর্ণ বিগ্রহটি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে সমগ্র মন্দির পরিসর কাফের পৌত্তলিকদের রক্তে শিক্ত করে রক্ষী সমেত বাইরে বেরিয়ে এলেন ঘোরী। প্রাচীন পবিত্র সরস্বতী নদীর সাথে যুক্ত থানেশ্বর নগরের সন্নিহিত সরোবরের জল রক্তিমবর্ণ ধারন করলো তুর্কি দস্যুদের অস্ত্রের আঘাতে নিহত নগরবাসীর রক্তে।

তরাইনের প্রান্তরে চিন্তিত চাঁদ পুন্দিরের বাহিনী
=================================
এহেন মর্মান্তিক গনহত্যা যখন সংগঠিত হচ্ছিল, ঠিক তখন থানেশ্বর থেকে কিছুদূরে তরারি বা তরাইন নামক এক বিশাল ময়দানের সম্মুখে নিজেদের সেনা শিবির স্থাপন করেছিল ভাতিণ্ডার সামন্তরাজ চাঁদ পুন্দির। পুন্দিরের সাথে উপস্থিত ছিলেন দুই সেনাপতি স্কন্ধ আর ভুবনায়ক মাল্লা। সেই সময় আজমির, গুজরাট, কনৌজ, দেবগিরি, বাংলা, কাকাতিয়া সহ সমগ্র ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মাবলম্বী রাজারা মৌর্য আর গুপ্ত সাম্রাজ্যের ন্যায় চতুরঙ্গ বাহিনী প্রতিপালন করতেন। সমসাময়িক ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মতে সেই সময় পুন্দিরের বাহিনীর সেনা সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৩০ হাজারের মতো। তাঁদের বাহিনী বিভক্ত ছিল অশ্বারোহী, তিরন্দাজ আর পদাতিক বাহিনীতে। কোন হস্তী বাহিনীর অস্তিত্ব ছিল না পুন্দিরের বাহিনীতে। এই বাহিনী দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ চৌহানের মূল বাহিনীর মাত্র এক তৃতীয়াংশ। হস্তী বাহিনী সহ অবশিষ্ট ৬০ হাজার বাহিনীই ছিল মহারাজ পৃথ্বীরাজ আর তাঁর খুড়তুতো ভ্রাতা গোবিন্দরাজ চৌহানের নিকটে। এহেন পরিস্থিতিতে চাঁদ পুন্দির যখন গুপ্তচরের মুখে স্মেচ্ছ ঘোরী বাহিনী দ্বারা নিকটবর্তী থানেশ্বর নগর ধ্বংসের সংবাদ পেলেন তখন রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে পড়লেও সাহস হারালেন না। তিনি একটি পত্র লিখে মহারাজ পৃথ্বীরাজকে যত দ্রুত সম্ভব তরাইনের যুদ্ধভূমিতে আসবার অনুরোধ জানিয়ে পুনরায় সংবাদ প্রেরন করলেন।

তারপর নিজের দুই সেনানায়কের সাথে এক জরুরি আলোচনা সভায় বসলেন। সেখানে সামন্তরাজ তথা সেনাপতি পুন্দির তাঁর সেনানায়কদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নির্ভীক স্বরে বলে উঠলেন, “প্রিয় মিত্রগণ, স্মেচ্ছ যবন দস্যুরা আমাদের মাতৃভূমিতে অনুপ্রবেশ করে ছলনার সাহায্যে ভাতিণ্ডার কেল্লা অধিগ্রহন করেছে, অত্যন্ত বর্বরতা আর নিষ্ঠুরতার সহিত পবিত্র থানেশ্বর নগর ধ্বংস করেছে। এবারে ওদের লক্ষ্য দিল্লি আর আজমির নগর। মহারাজ পৃথ্বীরাজ আমাকে নিযুক্ত করেছেন রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত শত্রু হানার হাত থেকে সুরক্ষিত রাখবার জন্য। মহারাজের আদেশ পালন করতে আমি বদ্ধপরিকর। কিন্তু এই মুহূর্তে যবন বাহিনী আমার বাহিনীর থেকে সংখ্যায় প্রায় তিনগুনেরও অধিক। নিজের অন্তিম নিঃশ্বাস পর্যন্ত বিজাতীয় স্মেচ্ছ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে আমি অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও, আপনাদের জীবন বিপন্ন করবার কোন অধিকার নেই আমার। অতএব আমি আপনাদের নিকট বিকল্প পেশ করছি। আপনারা চাইলে আমার সাথে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে স্মেচ্ছ দস্যু বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারেন, অথবা চাইলে আপনারা এই মুহূর্তে যুদ্ধভূমি ত্যাগ করে দিল্লির নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যেতে পারেন। বলুন আপনারা কি চান ?”
সেনাপতি পুন্দিরের প্রশ্নের উত্তরে সেনাপতি স্কন্ধ নিজের আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে নিজের কোষবদ্ধ অসি উন্মুক্ত করে শূন্যে উত্থলিত করে সিংহনাদ করে উঠলেন, “রাজা পুন্দির, আপনার ন্যায় মাতৃভূমির সম্মান রক্ষার্থে আমিও বহু পূর্বেই নিজের জীবন সমর্পিত করেছি। অতএব তরাইনের যুদ্ধভূমিতে দাঁড়িয়ে আপনার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত আমি।” স্কন্ধের বক্তব্য শেষ হতে না হতেই সেনাপতি ভুবনায়ক মাল্লাও উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, “রাজা পুন্দির, আমি এক ক্ষত্রিয় রাজপুত। আর কোন রাজপুত শত্রুর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে যুদ্ধভূমি ত্যাগ করে কাপুরুষের ন্যায় পলায়ন করেন না। তরাইনের প্রান্তরে বিজাতীয় তুর্কিদের অপবিত্র রক্তে নিজের তরবারি শিক্ত করে মাতৃভূমির জন্য উৎসর্গ করবো নিজের প্রান। তারপর সেনাপতি মাল্লা নিজের কোষবদ্ধ অসি শূন্যে উত্থলিত করে গর্জন করে উঠলেন, “হর হর মহাদেব”। সাথে সাথেই তরাইনের প্রাঙ্গনে দাঁড়ানো অবশিষ্ট সেনারাও গলা মিলিয়ে সমস্বরে গর্জন করে উঠলো, “হর হর মহাদেব”। সামন্তরাজ পুন্দির নিজের দুই নির্ভীক সেনানায়কের সম্মুখে এগিয়ে এসে তাঁদের সহিত আবেগপূর্ণ ভাবে আলিঙ্গনবদ্ধ হলেন।

পরেরদিন প্রত্যুষে সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই তরাইনের রণাঙ্গনে মুখোমুখি হলো মইজুদ্দিন ঘোরীর ভিনদেশি তুর্কি বাহিনী আর চাঁদ পুন্দিরের নেতৃত্বাধীন চৌহান বাহিনী। তরাইনের রণাঙ্গনের উন্মুক্ত ময়দানের দুই প্রান্তে ছিল ঘন অরন্য। মইজুদ্দিন ঘোরী তাঁর সাগরের জলরাশির ন্যায় সুবিশাল বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করলেন। বাম প্রান্তে নিজের বাহিনী সমেত অবস্থান নিলেন সেনাধ্যক্ষ নাসিরুদ্দিন কুবাচা আর দক্ষিন প্রান্তে নিজ বাহিনী সমেত অবস্থান নিলেন দ্বিতীয় তুর্কি সেনাধ্যক্ষ তাজউদ্দিন ইয়ালদুজ। দুজনেই নিজেদের বাহিনীর পদাতিক ধনুর্ধর রক্ষীদের একেবারে সম্মুখপ্রান্তে রাখলেন, তারপর অবস্থান নিল কৃতদাস বাহিনী, তার পরের সারিতে রইলো হাল্কা অশ্বারোহী বাহিনী। সবশেষে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত তুর্কি পদাতিক বাহিনী।
অপরদিকে মইজুদ্দিন ঘোরী নিজে তাঁর এক নতুন সেনাপতি সহ রণাঙ্গনের মধ্যপ্রান্তে অবস্থান নিলেন। প্রথমের সারিতে রাখলেন কৃতদাস বাহিনী, তারপরের সারিতে ভারি অশ্বারোহী বাহিনী এবং সবশেষে পদাতিক সেনা।

চাঁদ পুন্দিরের যুদ্ধের প্রস্তুতি
====================
সুবিশাল ঘোরী বাহিনীর সেনাসংখ্যা দর্শন করে কম্পিত হলো চৌহান সেনাপতি ভুবনায়ক মাল্লার হৃদয়। তিনি অশ্ব চালনা করে পুন্দিরের সম্মুখে এসে মৃদু স্বরে জিগ্যেস করলেন, “সামন্তরাজ পুন্দির, আপনার প্রেরিত পত্র কি পৌঁছেছে মহারাজ পৃথ্বীরাজের নিকটে ? যদি মহারাজ তাঁর বাহিনী সমেত সঠিক সময়ে রণাঙ্গনে পৌঁছতে না পারেন, তাহলে এক লহমায় শেষ হয়ে যাবে সবকিছু। গোমাংস ভক্ষণকারী বিদেশি স্মেচ্ছ দস্যুদের নিকটে সর্বস্ব হারাবে ভারতবর্ষ। নিজভূমেই সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়বে বহু শতাব্দী প্রাচীন বৈদিক ধর্ম আর সভ্যতার অস্তিত্ব।”
ভুবনায়ক মাল্লার প্রশ্নের জবাবে সামন্তরাজ পুন্দির তাঁর সেনাপতির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নির্ভীক ও দৃপ্ত স্বরে বলে উঠলেন, “সাহস হারাবেন না সেনাপতি মাল্লা। ইতিপূর্বে আমাদের মতোই কম সংখ্যক বাহিনী নিয়েও কায়দারার রণাঙ্গনে সুবিশাল ঘোরী বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেছিলেন মহারানি নাইকিদেবী। এছাড়াও আমার দৃঢ় বিশ্বাস মহারাজ পৃথ্বীরাজ সঠিক সময়েই তাঁর বিশাল বাহিনী সমেত রণাঙ্গনে উপস্থিত হবেন আর এই ধর্ম যুদ্ধে বর্বর স্মেচ্ছদের নির্ণায়কভাবে পরাজিত করে নিজ স্বাধীনতা, বৈদিক ধর্ম আর সভ্যতা রক্ষা করতে সফল হবো আমরা।

এরপর সামন্তরাজ পুন্দিরও তুর্কিদের ন্যায় নিজের বাহিনী তিন ভাগে বিভক্ত করলেন। দক্ষিন দিকের দায়িত্বে রইলেন সেনাপতি স্কন্ধ, বামপ্রান্তে সেনাপতি মাল্লা আর মধ্যভাগে চাঁদ পুন্দির। চৌহান বাহিনীর মুখ্য অস্ত্র ছিল ভারি তরবারি, বিশালকায় দণ্ড যুক্ত ভল্ল, চিরাচরিত কাষ্ঠ নির্মিত লম্বা ধনুক আর ওজনদার লৌহ ঢাল। যুদ্ধের বেশে সজ্জিত হয়ে নিজের অশ্বপৃষ্ঠে আসীন হয়ে অশ্বচালনা করে সেনাবাহিনীর সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন চাঁদ পুন্দির। তারপর নিজের অসি উন্মুক্ত করে সম্মুখ প্রান্তে এগিয়ে ধরে উদ্দাত্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন,
“ধন ধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা,
ওসে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সেদেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সেযে আমার জন্মভূমি,
সে যে আমার জন্মভূমি, সেযে আমার জন্মভূমি।”
গান সমাপ্ত করে নিজের সেনাদের উদ্দেশ্যে নির্ভীক স্বরে বলে উঠলেন, “আমার প্রিয় সেনারা, বিজাতীয় স্মেচ্ছ দস্যু বাহিনীর সাথে আমাদের পার্থক্য কি সেটা আপনারা জানেন ? ওদের সর্দার মইজুদ্দিন ঘোরী সদুর ঘোর থেকে আর্যাবর্ত্মে যুদ্ধ করতে এসেছে শুধুমাত্র ধনসম্পদ লুণ্ঠন আর সাম্রাজ্য বিস্তারের লোভে। ঘোরী বাহিনীর অধিকাংশ সেনাই ভাড়াটে। শুধুমাত্র ধন সম্পদ, সুরা আর রূপবতী রমণীর লোভ দেখিয়ে তাদের যুদ্ধভূমিতে নিয়ে এসেছে স্মেচ্ছ সর্দার ঘোরী। কিন্তু আমরা ধন সম্পদ লুণ্ঠন বা সাম্রাজ্য বিস্তারের লালসায় যুদ্ধ করছি না। আমরা আজ নিজেদের সর্বস্ব পন করে যুদ্ধ করছি শুধুমাত্র নিজ মাতৃভূমির সম্মান রক্ষা করতে, নিজ মাতৃভূমিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা করতে, হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সমৃদ্ধশালী বৈদিক ধর্ম আর সভ্যতাকে রক্ষা করতে, আজমির আর দিল্লির সহস্র নিরপরাধ ও নিরস্ত্র প্রজাদের প্রান রক্ষা করতে। হর হর মহাদেব।”
সাথে সাথে চৌহান বাহিনীও গর্জন করে উঠলো।

ভারতীয় ক্রুসেড পর্বঃ তরাইনের প্রথম যুদ্ধ (তৃতীয় পর্ব)
=======================================
বেজে উঠলো তরাইনের প্রথম যুদ্ধের শঙ্খধ্বনি
=================================
তরারির প্রান্তরে কাজল নদীর তীরে
তরবারি হস্তে উন্নত শিরে
দেখিতে দেখিতে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার মন্ত্রে
জাগিয়া উঠেছে রাজপুত ক্ষত্রিয়
নির্মম নির্ভীক।
হাজার কণ্ঠে আর্যাবর্ত্মের জয়
ধ্বনিতে আলোড়িত চতুর্দিক।
দেশপ্রেমের মন্ত্রে জাগিয়া উঠে ভারতবাসী বীর
নূতন উষার সূর্যের পানে
চাহিল নির্নিমিখ।
"হর হর মহাদেব”
মহারব উঠে বন্ধন টুটে
করে ভয়ভঞ্জন।
বক্ষের পাশে ঘন উল্লাসে
অসি বাজে ঝন্‌ঝন্‌।
দিল্লি আজি গরজি উঠিল,
"হর হর মহাদেব!'

তরারির প্রান্তরে চাঁদ পুন্দির তাঁর নেতৃত্বাধীন দিল্লি বাহিনীকে ত্রিশূল ব্যূহে সজ্জিত করলেন। মধ্যপ্রান্তে একদম সম্মুখভাগে নিজে তাঁর অশ্বারোহী আর ধনুর্ধর পদাতিক বাহিনী নিয়ে দণ্ডায়মান রইলেন, বাম প্রান্তে নিজের বাহিনী সমেত উপস্থিত রইলেন সেনাপতি ভুবনায়ক মাল্লা আর ডান প্রান্তে রইলেন দ্বিতীয় সেনাপতি স্কন্ধ। ব্যূহ রচনার পর চাঁদ পুন্দির তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন কোনমতেই তাঁরা যেন প্রথমেই ঘোরী বাহিনীকে আক্রমন না করেন।

অপরদিকে তুর্কি অধিপতি ঘোরী তাঁর বাহিনীকে অর্ধচন্দ্র ব্যূহে সজ্জিত করলেন। অর্ধচন্দ্রের মধ্যপ্রান্তে ঘোরী নিজে তাঁর নতুন ক্রীতদাস সেনাপতিকে নিয়ে রইলেন, বাম প্রান্তে রাখলেন সেনাধ্যক্ষ নাসিরুদ্দিন কুবাচাকে আর ডান প্রান্তে দ্বিতীয় তুর্কি সেনাধ্যক্ষ তাজউদ্দিন ইয়ালদুজ। পূর্ব দিগন্তের ধূসর প্রান্তরে সূর্যের আলো প্রস্ফুটিত হবার সাথে সাথেই ঘোরী বাহিনীর তুর্কি বাদ্যকাররা বাদ্য বাজিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। ঘোরীর পরিকল্পনা অনুসারে প্রথমে ১০০০ তুর্কি তিরন্দাজ, দিল্লির সেনাবাহিনীর দিকে অগ্রসর হয়ে প্ররোচনা মূলক তির বর্ষণ শুরু করলো। তৎক্ষণাৎ চাঁদ পুন্দিরের বাহিনী নিজেদের বিশালকায় লৌহ ঢাল সম্মুখপ্রান্তে বাড়িয়ে ধরলো। তুর্কি তিরন্দাজদের আক্রমন দিল্লি বাহিনীর ঢালে প্রত্যাঘাত হয়ে নিষ্ফলা হলো। এরপর উত্তেজিত নাসিরউদ্দিন তাঁর বাহিনীর সম্মুখভাগে থাকা হাল্কা ঘোড়সওয়ার বাহিনীকে নির্দেশদান করে বললেন, “যাও কাফেরদের খতম করে এসো।”


সেনাপতি স্কন্ধের বীরত্ব
================
সেনাপতির নির্দেশ পেতেই “আল্লাহ-আকবর” রবে তরবারি আর ভল্ল উঁচিয়ে অশ্বখুঁড়ে ধুলো উড়িয়ে চাঁদ পুন্দিরের বাহিনীর দিকে দ্রুতবেগে ধাবমান হলো তুর্কি বাহিনী। অস্ত্র হাতে নগ্ন পদে তাদের অনুসরণ করলো ধর্মান্তরিত ক্রীতদাস বাহিনী। এদিকে তুর্কি সেনাদের ধেয়ে আসতে দেখে সেনাপতি স্কন্ধ তাঁর ধনুর্ধরদের নির্দেশ দিলেন তির বর্ষণের। চৌহান বাহিনীর তির দ্রুতগতির তুর্কি অশ্বারোহীদের গতি রুদ্ধ সক্ষম না হলেও তাঁদের নিক্ষিপ্ত তিরের তীক্ষ্ণ ফলার আঘাতে নিহত হলো বেশকিছু ক্রীতদাস পদাতিক বাহিনীর সেনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কন্ধের বাহিনীর একেবারে সম্মুখে এসে পড়লো নাসিরের তুর্কি অশ্বারোহীগণ। এবারে সেনাপতি স্কন্ধ নিজের অশ্বপৃষ্ঠে আসীন হয়ে নিজের ডান হাতে ধরা ভল্ল শূন্যে উত্থলিত করে বলে নিজের বাহিনীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “মিত্রগণ স্মেচ্ছ যবন দস্যুরা আমাদের সম্মুখে উপস্থিত। এবারে সময় এসেছে ওদের রাজপুত শক্তি, পরাক্রম, শৌর্য আর দেশপ্রেমের সাথে অবগত করানোর। মাতৃভূমিকে শপথ করে বলছি আজ একজনও স্মেচ্ছ দস্যু আমাদের তীক্ষ্ণধার অস্ত্রের আঘাত থেকে রক্ষা পাবে না। আজ তুর্কি দস্যুদের রক্তে মোরা শিক্ত করে পবিত্র করবো তরারির প্রান্তর। তোমরা পাল্টা আক্রমন করো। হর হর মহাদেব”

সেনাপতি স্কন্ধের নির্দেশ পেতেই “হর হর মহাদেব” ধ্বনিতে চতুর্দিক আলোড়িত করে পাল্টা ভয়ানক আক্রমন শানালো তাঁর নেতৃত্বাধীন দিল্লির অশ্বারোহী আর পদাতিক বাহিনী। তরবারির ঝনঝনানি, ভল্লের আস্ফালন, অশ্বের হেস্রাধ্বনি আর দুই পক্ষের সেনাদের কোলাহলে শুরু হলো ধুন্ধুমার যুদ্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই দিল্লির সেনাদের পাল্টা ভয়ানক আক্রমনে নিহত হলো নাসিরের অধিকাংশ ক্রীতদাস পদাতিক বাহিনী। স্কন্ধের বাহিনীর অস্ত্রের নির্মম আঘাতে মৃত্যুর মিছিল দেখা গেল তুর্কি অশ্বারোহী বাহিনীতেও। চৌহান বাহিনীর রুদ্ররোষ দর্শন করে কম্পিত তুর্কি অশ্বারোহী বাহিনী এবারে পিছু হটলো। তারা দ্রুতগতিতে ফিরে যেতে লাগলো সেনাপতি নাসিরের দিকে। এদিকে পলায়নরত তুর্কিদের পিছু ধাওয়া করলো স্কন্ধের বাহিনী।

সেনাপতি ভুবনায়ক মাল্লার বীরগতি
=========================
অপরদিকে দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দ্বিতীয় তুর্কি সেনাপতি তাজউদ্দিন এবারে নিজের নেতৃত্বাধীন অশ্বারোহী আর পদাতিক সেনাদের আক্রমনের নির্দেশ দিলো। নির্দেশ পেয়েই মার মার রবে দ্রুতগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে ভুবনায়ক মাল্লার বাহিনীর দিকে ধেয়ে এলো তাজের বাহিনী। সেনাপতি মাল্লাও “জয় সোমেশ্বর” ধ্বনিতে গর্জন করে উঠে তাঁর বাহিনীকে পাল্টা আক্রমনের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু এযাত্রা স্কন্ধের ন্যায় সৌভাগ্য হলো না মাল্লার। কারন মাল্লার বাহিনীকে আক্রমনকারী তুর্কি বাহিনীর যোদ্ধারা ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পদাতিক আর ভারি অশ্বারোহী বাহিনী। এছাড়াও আক্রমনকারী তুর্কি বাহিনী সংখ্যার দিক থেকেও অনেক অধিক ছিল মাল্লার চৌহান বাহিনীর তুলনায়। পরাজয় সুনিশ্চিত জেনেও রাজপুত প্রথা অনুযায়ী বীরের ন্যায় নিজের অন্তিম নিঃশ্বাস বিন্দু পর্যন্ত তুল্যমূল্য যুদ্ধ করলেন সেনাপতি মাল্লা আর তাঁর বাহিনী। কিন্তু তুর্কি বাহিনীর অস্ত্রের আঘাতে একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে লাগলো তাঁর বাহিনীর সেনারা। একসময় সেনাপতি মাল্লাকে চতুর্দিক থেকে অবরুদ্ধ করলো তাজউদ্দিন আর তার ঘোড়সওয়ার বাহিনী। একদিকে ভল্ল হস্তে নিজের অশ্বপৃষ্ঠে আসীন একাকি সেনাপতি ভুবনায়ক মাল্লা, অপরদিকে তাজউদ্দিন সহ কমকরেও জনা চল্লিশেক তুর্কি অশ্বারোহী। শুরু হলো এক অসম যুদ্ধ। আত্মসমর্পণ করলেন না মাল্লা। মাল্লার ভল্লের আঘাতে আহত হয়ে নিজের অশ্বপৃষ্ঠ থেকে মাটিতে ভূপাতিত হলো তাজউদ্দিন নিজে, ঘায়েল হলো আরও জনা আটেক তুর্কি ঘোড়সওয়ার। শেষে একাধিক তুর্কি বাহিনীর নির্মম তরবারির আঘাতে রক্তাক্ত হলেন মাল্লা। গুরুতর আহত হয়ে নিজের অশ্বের পিঠ থেকে পড়ে গেলেন তরারির ভূমিতে। মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়া গুরুতর আহত মাল্লা সেই অবস্থাতেও কোনমতে নিজের দক্ষিন হস্তের মুষ্টি দিয়ে তুলে নিলেন একখণ্ড মাটি। তারপর পরম যত্ন সহকারে সেই মাটি নিজের ললাটে লাগিয়ে কোনমতে অস্ফুট ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলেন, “জয় মাতৃভূমি”। এমন সময় তাঁর পেছনে উপস্থিত হওয়া এক তুর্কি সেনার ভল্লের ফলা আহত মাল্লার ঘাড় আর কণ্ঠনালি ভেদ করলো নির্মমভাবে।

চাঁদ পুন্দিরের শৌর্য
==============
ওদিকে নাসিরের পলায়নরত বাহিনীকে ধাওয়া করে তুর্কি শিবিরে উপস্থিত হতেই নিজেদের ভুল আর চতুর রণনায়ক মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরীর ছলনাময় তুর্কি চাল উপলব্ধি করতে পারলো স্কন্ধ আর তাঁর বাহিনী। এবারে তাঁদের মোকাবিলা করবার জন্য উপস্থিত হলো নাসিরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভারি অশ্বারোহী বাহিনী। তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এবারে প্রবল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলেন সেনাপতি স্কন্ধ। অপরদিকে নিজের এক সেনাপতি মাল্লাকে শহীদ হতে দেখে এবং দ্বিতীয় সেনাপতি স্কন্ধকেও তুর্কি চক্রব্যূহে আক্রান্ত হতে দেখে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না সামন্তরাজ চাঁদ পুন্দির। তিনি এবারে “হর হর মহাদেব” ধ্বনিতে তাঁর বাহিনীকে আক্রমনের নির্দেশ দিয়ে ঘোড়া ছোটালেন নাসিরের বাহিনীর দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুন্দিরের বাহিনী তুর্কি শিবিরে উপস্থিত হয়ে প্রানপন আক্রমন শুরু করলেন। রাজপুত বাহিনীর অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যু হলো অধিকাংশ তুর্কি সেনার। চাঁদ পুন্দির নিজে ব্যক্তিগতভাবে মুখোমুখি হলেন নাসিরের সাথে। নাসির তাচ্ছিল্যপূর্ণ স্বরে পুন্দিরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “এখনও ওয়াক্ত আছে কাফের। তুমি যদি তোমার পৌত্তলিক ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম কবুল করে খলিফা-এ-দিল্লি রায় পিথোরার (পৃথ্বীরাজ চৌহান) বিরুদ্ধে আমাদের এয়নাত করো তাহলে আমাদের সিপাহী শালার তোমার জান বক্স করে দেবে”

জবাবে পুন্দির নাসিরের দিকে ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাচ্ছিল্যপূর্ণ স্বরে বলে উঠলেন, “তোমাদের মতো বিজাতীয় স্মেচ্ছদের নিকট ধর্ম শব্দের অর্থ কি সেটা আমার জানা নেই। কিন্তু আমাদের মতো রাজপুতদের নিকট বৈদিক ধর্ম কোন মামুলি ধর্ম নয়, আমাদের নিকটে ধর্ম হলো একটি আস্থা, যা অর্থ আর প্রাচুজ্যের লোভ দেখিয়ে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, আমাদের নিকট ধর্ম হলো সহস্র শতাব্দী প্রাচীন এক মহান সভ্যতা যা পেশি শক্তির আস্ফালন করে পরিবর্তন করা অসম্ভব। চাঁদ পুন্দির হাজার বার মৃত্যুবরণ আর হাজার বার জন্মগ্রহণ করতে প্রস্তুত, কিন্তু কখনও ধর্ম ত্যাগ করবে না। আর এক রাজপুতের নিকট বিশ্বাসযোগ্যতা আর মিত্রতা হলো এমন একটি প্রতিজ্ঞা, যা শত অত্যাচার করে বা শত প্রলোভন দেখিয়েও বদলানো সম্ভব নয়। দিল্লির মহারাজ তথা আমার পরম মিত্র পৃথ্বীরাজের প্রতি আমৃত্যুকাল পর্যন্ত বিশ্বস্ত থাকতে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এবারে নিজে মরবার জন্য প্রস্তুত হও বর্বর স্মেচ্ছ যবন।”

এরপর দুই সেনাপতি ভল্ল উঁচিয়ে তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে একে অপরের দিকে ধেয়ে এলেন। শুরু হলো দ্বন্দ্বযুদ্ধ। ঝনাৎ, ঠনাৎ শব্দে বার কয়েক একে অপরের ভল্ল ঠোকাঠুকি হলো। একসময় মরিয়া হয়ে নাসির দ্রুতবেগে অশ্ব ছুটিয়ে ধেয়ে এলো পুন্দিরের দিকে, তারপর পুন্দিরের শরীর লক্ষ্য করে সজোরে ভল্ল দিয়ে আঘাত হানলো। পুন্দিরের দক্ষিণ বাহু শত্রুর ভল্লের আঘাতে আহত হলেও, দ্রুত নিজের শরীর পেছনদিকে বেঁকিয়ে প্রাণঘাতী আঘাত থেকে কোনমতে নিজেকে রক্ষা করে পাল্টা নিজের ভল্ল দিয়ে সজোরে আঘাত হানলেন নাসিরের শরীর লক্ষ্য করে। পুন্দিরের ভল্লের ফলা নাসিরের বর্মের পুরু আস্তরন ভেদ করে তুর্কি সেনাপতির বক্ষের বামদিকে জোরালো আঘাত হানলো। টাল সামলাতে না পেরে আহত হয়ে অশ্বের পিঠ থেকে নিচে পড়ে গেলেন নাসির। এরপর পুন্দির এক লম্ফে নিজের অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরন করে এগিয়ে এলেন ভূপাতিত নাসিরের দিকে।

ঠিক এহেন সময় নিজের অন্যতম প্রিয় সেনাপতিকে রক্ষার জন্য অর্ধচন্দ্র ব্যূহের মধ্যভাগে অবস্থানরত মইজুদ্দিন ঘোরী তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন পুন্দিরকে হামলা করবার। তুর্কি তিরন্দাজগণ নিজেদের ক্রসবো উঁচিয়ে আল্লাহ আকবর রবে ধ্বনি দিয়ে পেছন থেকে কাপুরুষের ন্যায় তির বর্ষণ শুরু করলো চাঁদ পুন্দিরকে লক্ষ্য করে। একঝাঁক ঘাতক তির এসে বিদ্ধ করলো পুন্দিরকে। তিনি গুরুতর আহত হয়ে রক্তাক্ত দেহে ভূপাতিত হলেন তরারির (তরাইন) প্রান্তরে। প্রধান সেনাপতি তথা সামন্তরাজকে বিপদমুক্ত করবার জন্য স্কন্ধের নির্দেশে পাল্টা তির বর্ষণ শুরু করলো তাঁর নেতৃত্বাধীন বাহিনী। দিল্লি বাহিনীর তিরের আঘাত থেকে রক্ষা পেতে সাময়িকভাবে পিছু হটলো ঘোরী বাহিনী। এরপর নিজের রক্ষীদের নিয়ে রক্তাপ্লুত পুন্দিরের নিকটে ছুটে এলেন স্কন্ধ। মরনাপন্ন পুন্দির নিজের রক্তমাখা অশীতিপর হস্ত দিয়ে স্কন্ধের হাত চেপে ধরে আবেগপূর্ণ ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলেন, “আমরা এই যুদ্ধে পরাজিত হয়েছি সেনাপতি স্কন্ধ। ইতিপূর্বেই বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছেন সেনাপতি ভুবনায়ক মাল্লা, গুরুতর আহত আমি। মইজুদ্দিন ঘোরীর নেতৃত্বাধীন বিশাল স্মেচ্ছ যবন বাহিনী দ্রুত এগিয়ে আসছে এই দিকে। এই মুহূর্তে দিল্লির অন্তিম ভরসা কেবলমাত্র আপনি। আপনি অবিলম্বে নিজের অবশিষ্ট সেনাদের নিয়ে দ্রুত রণভূমি ত্যাগ করে দিল্লি ফিরে গিয়ে মহারাজ আর তাঁর অনান্য সামন্তদের বিস্তারিত বিবরণ দিন।”
স্কন্ধ বাস্পরুদ্ধ স্বরে বলে উঠলেন, “হে সামন্তরাজ, আপনাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে অনত্র পলায়ন করা রাজপুত ক্ষত্রিয় ধর্ম বিরোধী। হয় আমি আপনাকে রক্ষা করে একসাথে ফিরে যাবো, নতুবা তরারির প্রান্তরে স্মেচ্ছ দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতেই প্রান বিসর্জন দেবো।”

জবাবে পুন্দির বলে উঠলেন, “আপনি ভুলে যাচ্ছেন সেনাপতি স্কন্ধ,
মুক্তির মন্দির সোপানতলে
কত প্রাণ হলো বলিদান,
লেখা আছে অশ্রুজলে।।
কত বীর যোদ্ধার রক্তে রাঙা
বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙ্গা
তাঁরা কি ফিরিবে আজ সুপ্রভাতে
যত তরুণ যোদ্ধা গেছেন অস্তাচলে।।
যাঁরা স্বর্গগত তাঁরা এখনও জানেন
স্বর্গের চেয়ে প্রিয় এই জন্মভূমি
আসুন মোরা স্বদেশ ব্রতের মহা দীক্ষা লভি
সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ আমরা।
আজি রক্ত কমলে গাঁথা মাল্যখানি
বিজয় লক্ষ্মী দেবে তাঁদেরই গলে।।
শত্রুর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে জয়ী না হলে, বীরের ন্যায় লড়তে লড়তে মৃত্যু বরণ করাই এক রাজপুত ক্ষত্রিয়ের পরম ধর্ম আর আকাঙ্ক্ষা। আজ সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হতে চলেছে আমার। কিন্তু এই মুহূর্তে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করার দায়িত্ব সম্পূর্ণ রূপে নির্ভর করছে আপনার স্কন্ধের উপর সেনাপতি স্কন্ধ। আপনি অবিলম্বে অবশিষ্ট সেনাদের নিয়ে দিল্লি ফিরে গিয়ে মহারাজকে রণভুমির সবিস্তার বর্ণনা দিন আর হ্যাঁ মহারাজকে জানাবেন যে তাঁর বাল্য সখা তথা ভাতিণ্ডার সামন্তরাজ চাঁদ পুন্দির তরাইনের রণাঙ্গনে এক বীরের ন্যায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এটাই আমার নির্দেশ।
এরপর অশ্রুশিক্ত চোখে নিদারুন অনিচ্ছার সাথে সেনাপতি স্কন্ধ দিল্লির অবশিষ্ট জীবিত সেনাদের নিয়ে রণভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। অবশেষে পৌত্তলিক কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নির্ণায়ক ফতে (বিজয়লাভ) হাসিল করা গিয়েছে ভ্রম করে রক্তের নেশায় তুর্কি বাহিনী হারে রে রে রবে পিছু ধাওয়া করলো পলায়নরত সেনাপতি স্কন্ধ আর তাঁর অবশিষ্ট বাহিনীর।


পৃথ্বীরাজের যুদ্ধযাত্রা
===============
"বিজাতীয় তুর্কি দস্যু আসিছে রে ওই,
করো করো সবে সাজ'
পিথোরা গড়ে কহিলা হাঁকিয়া
দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ।
বেলা দু'পহরে যে যাহার ঘরে
সেঁকিছে জোয়ারি রুটি,
দুর্গতোরণে নাকাড়া বাজিছে
বাহিরে আসিল ছুটি।
প্রাকারে চড়িয়া দেখিল চাহিয়া
দুর্গের দক্ষিণে কিছুটা দূরে
আকাশ জুড়িয়া উড়িয়াছে ধুলা
দিল্লির হস্তীবাহিনীর বৃংহণ ধ্বনি আর অশ্বারোহীদের অশ্বখুরে।
"তুর্কিরা যত পতঙ্গপাল
কৃপাণ-অনলে আজ
ঝাঁপ দিয়া পড়ি ফিরে নাকো যেন'
গর্জিলা পৃথ্বীরাজ।”

একদিকে তরাইনের প্রান্তরে যখন নিদারুণ সংখ্যালঘু সেনা বাহিনী নিয়ে তুর্কি দস্যুদের বিরুদ্ধে বাঘ্র বিক্রমে যুদ্ধ করেও পরাজয়ের সম্মুখে দিল্লি বাহিনী, ঠিক সেই সময় যুদ্ধভূমি থেকে কিছুটা দূরে গভীর অরন্যপথে নিজ হস্তী বাহিনী সমেত দ্রুতগতিতে তরারির প্রান্তরে এগিয়ে চলেছেন দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ চৌহান। যবন দস্যুদের নগ্ন আগ্রাসন থেকে মাতৃভূমির সম্ভ্রম রক্ষার জন্য চিন্তিত পৃথ্বীরাজ, বিশাল বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুরস্ক দস্যু বাহিনীর আক্রমনের নাগপাশে আবদ্ধ নিজ বাল্যবন্ধু চাঁদ পুন্দির সহ অনান্য দুই সেনাপতির প্রান রক্ষায় চিন্তিত পৃথ্বীরাজ, যুদ্ধযাত্রায় নিজের বীর বৈমাত্রেয় ভ্রাতা গোবিন্দরাজ চৌহানের অনুপস্থিতির জন্যও তিনি চিন্তিত আজ। গোবিন্দরাজের অনুপস্থিতির কারনে তাঁর বাহিনী সংখ্যা এখন ৩০ হাজারের মতো। আরও ৩০ হাজার চৌহান সেনা রয়েছে গোবিন্দরাজের নেতৃত্বে। তবুও মাতৃভূমির স্বতন্ত্রতা, সম্মান আর সম্ভ্রম রক্ষায় অনড় পৃথ্বীরাজ অবিচলভাবে এগিয়ে চলেছেন তরারির রণাঙ্গনের দিকে।

ক্রমে দিন শেষ হয়ে এলো, সূর্যদেব অস্তাচলে গেলেন। ঘোর অমাবস্যার তমশাছন্ন রাতের গাড় আধার গ্রাস করলো বিশ্ব চরাচর। ক্লান্ত দিল্লির সেনাবাহিনী, পরিশ্রান্ত মহারাজ পৃথ্বীরাজ নিজেও। কিন্তু সঠিক সময়ে রণাঙ্গনে উপস্থিত হয়ে বাল্যবন্ধু পুন্দিরের জীবন রক্ষার জন্য মরিয়া পৃথ্বীরাজ রাতেও তাঁর যুদ্ধযাত্রা অব্যাহত রেখেছেন। একসময় তিনি উদ্বিগ্ন স্বরে তাঁর মাহুতের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “গজরাজের গতি এতো শ্লথ হয়ে পড়েছে কেন ? দ্রুত আরও দ্রুত তাঁকে পরিচালনা করুন। আগামীকাল প্রত্যুষে সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই আমাদের তরারির প্রান্তরে যেভাবেই হোক পৌঁছতেই হবে।”

দুই ভ্রাতার মিলনপর্ব
===============
এমন সময় জঙ্গলের গভীরে বাম প্রান্ত থেকে শোনা গেল বহু অশ্বের হেস্রাধ্বনি, ভূকম্পনধারী রণহস্তীর পদশব্দ আর বৃংহণ ধ্বনি আর অগণিত সেনার কোলাহল। শঙ্কিত হলেন পৃথ্বীরাজ। মনে মনে ভাবতে লাগলেন, কে ওরা ? ওরা কি গুজরাটের শত্রু রাজ ভীমদেব সোলাঙ্কির সেনাবাহিনী, নাকি কনৌজের শত্রুরাজ জয়চাঁদের বাহিনী ? দিল্লির এহেন বিপদজনক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কাপুরুষের ন্যায় অতর্কিতে আক্রমন করতে এসেছে। ধিক সেইসব ভারতবাসীদের।

এমন সময় কিছুটা দূর থেকে এক অতি পরিচিত কণ্ঠে শোনা গেল এক অতি পরিচিত কবিতা,
“দুশমন সে লোহা লেনে কো,
ডাঁটে হুয়ে হ্যায় রণ (যুদ্ধ) ম্যায় বীর,
হিলা না পায়ে পথ সে উনকো,
হো চাহে ভালে (ভল্ল) ইয়া তির,

টুট পড়ে হ্যায় শত্রু পে,
ও গিরতে হ্যায় মুহ কি বল,
ভাগ রাহে হ্যায় দুশমন,
চারো আউর মাচি হ্যায় এক হালচাল,
কই করতব কাম না আয়া
দুশমন কি হোশ উড়া
আউর নিকল গেয়ি সারি অভিমান
জয় জয় জয় পৃথ্বীরাজ চৌহান
জয় জয় জয় পৃথ্বীরাজ চৌহান”

এরপর হাজারো মশালের আলোয় আলোকিত অরন্যপথের মধ্যে থেকে রণহস্তীর পৃষ্ঠে আসীন হয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন পৃথ্বীরাজের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা তথা দিল্লির প্রধান বীর সেনাপতি গোবিন্দরাজ চৌহান। গোবিন্দরাজকে দেখে আনন্দের আথিসজ্জে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো পৃথ্বীরাজের দুই চোখ। তিনি অবিলম্বে তাঁর মাহুতকে নির্দেশ দিলেন গজরাজকে দাঁড় করানোর। তারপর দুই ভ্রাতা নিজ নিজ হস্তী পৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করে একে অপরকে আলিঙ্গনবদ্ধ করলেন। এরপর গোবিন্দরাজ, দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজের দুইহাত আঁকড়ে ধরে স্মিত হাস্যমুখে আবেগপূর্ণ স্বরে বলে উঠলেন, “চলুন ভ্রাতা মহারাজ, আমরা দুই ভাই এবারে একত্রে তরাইনের রণাঙ্গনে বিজাতীয় স্মেচ্ছ দস্যুদের উপর তুফানের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ধ্বংস করি যবন বাহিনীকে। হর হর মহাদেব।” জবাবে পৃথ্বীরাজও বলে উঠলেন, “জয় সোমেশ্বর”।

ভারতীয় ক্রুসেড পর্বঃ তরাইনের প্রথম যুদ্ধ (চতুর্থ এবং শেষ পর্ব)
=============================================
পৃথ্বীরাজের প্রবল প্রতি আক্রমণ
=======================
কায়দারার যুদ্ধের ১৩ বছর পর, ১১৯১ খ্রিষ্টাব্দে থানেশ্বরের নিকটে তরারি বা তরাইনের প্রান্তরে ঘোরের বিশাল তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুখোমুখি হলো ভাতিণ্ডার চৌহান সামন্তরাজ চাঁদ পুন্দিরের নেতৃত্বাধীন ক্ষুদ্র রাজপুত বাহিনী। সারাদিন ভয়াবহ যুদ্ধের পর নিহত হলো বহু তুর্কি সেনা। অপরদিকে যুদ্ধে বীরগতিপ্রাপ্ত হলেন চৌহান সেনাপতি ভুবনায়ক মাল্লা আর গুরুতর আহত হয়ে ধরাশায়ী হলেন সামন্তরাজ চাঁদ পুন্দির। রনাঙ্গনের অন্তিম শয্যায় শায়িত হয়ে তিনি তাঁর বাহিনির অন্তিম সেনাপতি স্কন্ধকে নির্দেশ দিলেন অবশিষ্ট বাহিনী সমেত রনাঙ্গন ত্যাগ করে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তনের। অপরদিকে সেই সময় নিজের রণহস্তী বাহিনী সমেত দ্রুতগতিতে তরাইনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন দিল্লির অন্তিম রাজপুত শাসক মহারাজ পৃথ্বীরাজ চৌহান। পথিমধ্যে নিজের বাহিনী সমেত পৃথ্বীরাজের বাহিনীতে যোগদান করলেন চৌহান বাহিনীর প্রধান সেনাপতি তথা পৃথ্বীরাজের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা গোবিন্দরাজ চৌহান।

পৃথ্বীরাজ আর গোবিন্দরাজের বাহিনী একত্রিত হয়ে এক বিশাল সেনা সমুদ্রের রূপ ধারন করলো। হামীরা মহাকাব্য আর প্রবন্ধ চিন্তামনি কাব্যগ্রন্থ অনুসারে দুই ভ্রাতার মিলিত বাহিনীতে দৈত্যাকার রণহস্তীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ এর নিকটে। এছাড়া অশ্বারোহী বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২০ হাজারের মতো আর অবশিষ্ট ৩২ হাজার পদাতিক আর ধনুর্ধর বাহিনী। দুই নিপুন রণনায়কের নেতৃত্বে তুফানের বেগে তরাইনের প্রান্তরের দিকে এগিয়ে চললো চৌহান বাহিনী।


অপরদিকে গুরুতর আহত ও সংজ্ঞাহীন সামন্তরাজ চাঁদ পুন্দিরকে রণভূমির তৃণশয্যার উপরেই পরম যত্ন সহকারে শায়িত অবস্থায় রেখে মৃত্যুপথ যাত্রী চাঁদ পুন্দিরের পাশে তাঁর অঙ্গসজ্জা হিসাবে সর্বদা নিজের কোষে বহনকারী প্রিয় অসিটা রেখে নিতান্ত অনিচ্ছা ভরা স্বরেই নিজের বাহিনীর অবশিষ্ট সেনাদের পশ্চাৎপশরনের নির্দেশ দিলেন স্কন্ধ। এরপর স্কন্ধের পরিকল্পনা অনুসারে তাঁর বাহিনীর ধনুর্ধররা ক্রমাগত তির বর্ষণ শুরু করলো তাঁদের দিকে অস্ত্র হাতে ধেয়ে আসা স্মেচ্ছ ঘোরী বাহিনীর উদ্দেশ্যে। তিরের আঘাতে সাময়িকভাবে পিছু হটলো তুর্কি বাহিনী। সেই সুযোগে এক লাফে নিজের অশ্বের উপর আসীন হয়ে দ্রুতগতিতে দিল্লির দিকে ধাবিত হলেন স্কন্ধ। সেনাপতিকে অনুসরণ করলো তাঁর বাহিনী। অপরদিকে স্কন্ধকে পালাতে দেখে তুর্কি অধিপতি মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী তাঁর বাহিনীর উদ্দেশ্যে উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন, “হে আমার জিহাদ-এ-লস্কর বাহিনী, আমার অকুতোভয় ফিদায়ে বাহিনী দেখো আজ তোমাদের আতঙ্কে সন্ত্রস্ত্র হয়ে কায়রের ন্যায় জঙ্গ-এ-ময়দান ত্যাগ করে পলায়ন করছে রায়-পিথোরার (পৃথ্বীরাজ) পরাজিত কাপুরুষ কাফের বাহিনী। হিন্দুস্থানের বুকে আল্লাহর পবিত্র স্বর্গরাজ্য দার-উল-ইসলামের স্থাপন আর মাত্র কিছুক্ষণের অপেক্ষা। তোমরা দাঁড়িয়ে না থেকে যাও ওদের পিছু ধাওয়া করো আর প্রত্যেক কাফেরকে হত্যা করে তোফা হিসাবে ওদের কাটা মস্তক নিয়ে এসো। মনে রেখো তোমাদের এই পবিত্র কর্মের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ তোমাদের প্রত্যেককে বেহশতে পাঠাবেন।”

ঘোরীর নির্দেশ পেয়ে আল্লাহ-আকবর রবে স্কন্ধের বাহিনীর পিছু ধাওয়া করলো তুর্কি বাহিনী। এদিকে কিছুক্ষণ যাত্রার পর তরারির মূল প্রাঙ্গণ পেরিয়ে অরন্য দ্বারা আবৃত যমুনা নদীর তটবর্তী এক বিশাল প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হলো স্কন্ধের বাহিনী। দক্ষ সেনাপতি স্কন্ধ উপলব্ধি করতে পারলেন আর পলায়নের চেষ্টা করা বৃথা। ভারতীয় অশ্বের চেয়ে আফগানিস্থান আর মধ্যপ্রাচ্যের অশ্ব অধিক বেশি দ্রুতগতি সম্পন্ন। তুর্কি অশ্বে সওয়ারি বিজাতীয় ইসলামিক সেনারা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘিরে ফেলবে তাঁদের। অতএব যমুনা নদীর তটে এই অরন্যে ঘেরা প্রান্তরের সাহায্য নিয়ে জীবনের অন্তিম সময় পর্যন্ত স্মেচ্ছ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সাকা পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন স্কন্ধ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেনাপতি স্কন্ধের চিন্তাকে বাস্তবে পরিণত করে তুর্কি বাহিনী চতুর্দিক থেকে বেষ্টিত করলো তাঁদের। তারপর আল্লাহ-আকবর রবে কোণঠাসা রাজপুত বাহিনীর দিকে ধেয়ে এসে আক্রমন শানালো তাঁদের। “জয় সোমেশ্বর” ধ্বনিতে চতুর্দিক আন্দোলিত করে পাল্টা প্রতি আক্রমণ করলো স্কন্ধের বাহিনী। কিন্তু বিশাল তুর্কি বাহিনীর সামনে কিছুক্ষণের মধ্যেই বধ্যভূমিতে পরিণত হলো যমুনার তট। অবশেষে নিজের অন্তিম যুদ্ধ লড়বার জন্য সেনাপতি স্কন্ধ নিজের অশ্ব থেকে অবতীর্ণ হয়ে বাম হস্তে একটি পুরু ঢাল আর দক্ষিণ হস্তে নিজের তরবারি নিয়ে “হর হর মহাদেব” রবে তুর্কি বাহিনীর দিকে ধেয়ে গেলেন। এরপর বীরবর স্কন্ধের তরবারির আঘাতে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত দেহে যুদ্ধভূমিতে লুটিয়ে পড়তে লাগলো একের পর এক তুর্কি সেনা। কিন্তু একাকি স্কন্ধ আর কতক্ষণ যুদ্ধ করবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুর্কি সেনাপতি তাজউদ্দিন আর তাঁর ঘাতক বাহিনী চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেললো স্কন্ধকে।

নিজের মৃত্যু আসন্ন বলে যখন ধরে নিয়েছেন স্কন্ধ। ঠিক সেই সময় রনাঙ্গনের ধরিত্রী যেন ভয়াবহ ভূকম্পনের ন্যায় কাঁপতে শুরু করলো, অনতিদূর থেকে ভেসে এলো একাধিক হস্তীর মদমত্ত বৃংহণ ধ্বনি, সেইসাথে গৌরিকুণ্ডের খরস্রোতা গঙ্গা নদীর ক্রুদ্ধ গর্জনধ্বনির ন্যায় ভেসে এলো অগনিত সেনার ভৈরব কণ্ঠের “হর হর মহাদেব”, “জয় সোমেশ্বর” কলধ্বনি। এক নতুন আশায় পুলকিত হয়ে পেছন ফিরে তাকালেন সেনাপতি স্কন্ধ। তিনি দেখতে পেলেন অবশেষে রনাঙ্গনে উপস্থিত হয়েছেন দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ চৌহান আর তাঁর ভ্রাতা গোবিন্দরাজ চৌহানের সুবিশাল সেনাবাহিনী। আনন্দে আত্মহারা স্কন্ধ বলে উঠলেন, “জয় মহারাজ পৃথ্বীরাজের জয়”। তাজউদ্দিন আর তাঁর নেতৃত্বাধীন তুর্কি বাহিনীও পেছন ফিরে পৃথ্বীরাজের বিশাল বাহিনী দর্শন করে তীব্র আতঙ্কে শিহরিত হয়ে উঠলো। তাজউদ্দিন ভীত-কম্পিত কণ্ঠস্বরে তাঁর বাহিনীকে পলায়নের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। দিল্লির বাহিনী এবারে ঘোরী বাহিনীকে চতুর্দিক থেকে বেষ্টন করলো। এরপর নিজের প্রিয় রণহস্তী গজরাজের পৃষ্ঠে আসীন পৃথ্বীরাজ নিজের অসি শূন্যে উত্থলিত করে বজ্রগম্ভীর স্বরে গর্জন করে বলে উঠলেন, “আক্রমণ”।

মহারাজের নির্দেশ পেয়ে দিল্লির বাহিনী দুইভাগে বিভক্ত হয়ে এক ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ের ন্যায় দুদিক থেকে সবেগে ধেয়ে এলো তুর্কি বাহিনীর দিকে। দিল্লির রণন্মাদ হস্তীবাহিনী তীব্র বৃংহণ ধ্বনি সহকারে ধেয়ে এলো তুর্কি বাহিনীর দিকে। তারপর তাদের বিশাল শুঁড়ে তুর্কি সেনাদের বেষ্টিত করে প্রথমে তাদের শূন্যে তুলে তারপর সবেগে মাটিতে আছাড় দিয়ে ফেলে আর তাদের বিশালকায় পা দিয়ে স্মেচ্ছ যবন দস্যুদের পদদলিত করে নির্মমভাবে হত্যা করতে লাগলো। অপরদিকে হস্তীপৃষ্ঠে আসীন দিল্লির দক্ষ তিরন্দাজরা নিপুনভাবে বিষাক্ত তির আর ভল্ল নিক্ষেপ করে নিধন করতে লাগলো ঘোরী বাহিনীকে। ভারতীয় বাহিনীর এহেন ভয়াবহ আক্রমনের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না তুরস্ক বাহিনী। অকেজো হয়ে গেল তাদের ঘোড়সওয়ার বাহিনী আর ক্রসবো ধারী হাল্কা ধনুর্ধর বাহিনী। কিছুক্ষণের মধ্যেই দিল্লির দৈত্যাকার রণহস্তী বাহিনীর আক্রমনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো বিজাতীয় স্মেচ্ছ বাহিনী। সেই সময় পৃথ্বীরাজ তাঁর বাহিনীর অবশিষ্ট ২০ হাজার অশ্বারোহী আর ৩২ হাজার পদাতিক সেনাকে নির্দেশ দিলেন আক্রমনের। এবারে রনাঙ্গনের দৃশ্যপট সম্পূর্ণরূপে বদলে গেল। রাজপুত বাহিনীর অস্ত্রের আঘাতে তুর্কি দস্যুদের বধ্যভূমিতে পরিণত হলো রনাঙ্গন। সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত ও বিধস্ত দুই তুর্কি সেনাপতি তাজউদ্দিন আর নাসিরউদ্দিন পরাজয় স্বীকার করে তীব্র আতঙ্কে রনে ভঙ্গ দিয়ে কাপুরুষের ন্যায় সাধারন অশ্বারোহী সেনার ছদ্মবেশ ধারন করে রণভূমি ত্যাগ করে পলায়ন করলো। পৃথ্বীরাজ আর তাঁর তুর্কি নাশক বিজয়ী বাহিনী গৈরিক ধ্বজ আন্দোলিত করে “হর হর মহাদেব” রবে তাদের পিছু ধাওয়া করলো।

গোবিন্দরাজের পরাক্রমের সম্মুখে নতনাজু মইজুদ্দিন ঘোরী
==========================================
অপরদিকে গোবিন্দরাজ তাঁর বাহিনী সমেত অগ্রসর হলেন তরাইনের মূল রনাঙ্গনের দিকে। এদিকে পৃথ্বীরাজের কাফের বাহিনীর বিরুদ্ধে তরাইনের যুদ্ধে জয়লাভ সম্পন্ন হয়েছে ভ্রম করে, তুর্কি অধিপতি মইজুদ্দিন ঘোরী তাঁর বাহিনীর অধিকাংশ সেনাকে পলায়নরত স্কন্ধের বাহিনীকে নিধন করবার জন্য প্রেরন করেছিলেন। তরারির প্রান্তরে ঘোরীর সাথে উপস্থিত ছিল তাঁর নতুন ক্রীতদাস সেনাপতি সহ মাত্র পাঁচশত তুর্কি অশ্বারোহী বাহিনী আর তাঁর দুইশত পদাতিক অঙ্গরক্ষক। নিজেদের ভল্লের ফলায় সেনাপতি স্কন্ধ আর তাঁর কাফের সেনাদের কাটা মুণ্ডু বিদ্ধ করে কখন বিজয়দর্পে তাঁর বীরপুঙ্গব তুর্কি সেনারা আল্লাহ-আকবর ধ্বনিতে কাফেরস্থান আন্দোলিত করে প্রত্যাবর্তন করবে এই চিন্তায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। এমন সময় তাঁর প্রিয় তুর্কি বাহিনীর পরিবর্তে তরাইনের প্রান্তরে বিশাল রাজপুত বাহিনী সমেত উপস্থিত হলেন দিল্লির সেনাপতি গোবিন্দরাজ। তরারির প্রান্তরে এসেই তিনি প্রবলবেগে আক্রমণ করলেন তীব্র বিস্ময়ে অভিভূত হতবাক মহম্মদ ঘোরীকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোবিন্দরাজের প্রবল আক্রমনের সম্মুখে খড়কুটোর মতো উড়ে গেল মুষ্টিমেয় ঘোরী বাহিনীর প্রতিরোধ। নিজের বাহিনীর নিধন রুখবার জন্য মইজুদ্দিন ঘোরী এবারে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে বসলেন গোবিন্দরাজকে। চতুর ঘোরী নিজের তরবারি ফেলে দিয়ে নিজের অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করে সম্পূর্ণ অস্ত্রহীন অবস্থায় গোবিন্দরাজের রণহস্তীর সম্মুখে এসে উদ্দেশ্যে তির্যক স্বরে বলে উঠলেন, “আমি শুনেছি তোমরা রাজপুতরা সম্মানযুদ্ধে বিশ্বাস করো আর নিরস্ত্র শত্রুকে আঘাত করো না। আমি ঘোরের প্রধান সিপাহী সালার মইজুদ্দিন মহম্মদ বিন সাম ঘোরী আজ সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় তোমার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তোমাকে এক বীরের ন্যায় তরবারির দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছি। যদি আমি বিজয়ী হই তাহলে তুমি পরাজয় স্বীকার করে আমাকে নিজের ওয়াতন ঘোরে ফিরে যেতে দেবে, আর যদি পরাজিত হই তাহলে আমাকে হত্যা করলেও অন্তত আমার সিপাহীদের মুক্তি দেবে। বল রাজি আছ এই শর্তে ?”

ঘোরীর দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান গোবিন্দরাজের ক্ষাত্রধর্মে আঘাত করলো। তিনিও তৎক্ষণাৎ নিজের অসি শূন্যে উত্থলিত করে বলে উঠলেন, “এর আগেও কায়দারার যুদ্ধে, রাজপুত ক্ষত্রিয় যোদ্ধাদের বীরত্ব, দেশ আর ধর্ম প্রেম আর আত্মত্যাগের পরিচয় তুমি পেয়েছিলে স্মেচ্ছ দস্যু সর্দার মইজুদ্দিন ঘোরী। এবারেও তুমি আরেকবার পরিচয় পাবে রাজপুতানার পরাক্রম আর শৌর্যের। আমি তোমার শর্তে রাজি ঘোরী।”
এরপর নিজের হস্তী পৃষ্ঠ থেকে অবতরন করে তরবারি হস্তে একটি অশ্বপৃষ্ঠে আসীন হলেন গোবিন্দরাজ। অপরদিকে ঘোরীও নিজের তরবারি নিয়ে পুনরায় নিজ অশ্বপৃষ্ঠে আসীন হলেন। তারপর তরবারি উঁচিয়ে ঘোরী আর গোবিন্দরাজ একে অপরের দিকে ধেয়ে এলেন। শুরু হলো এক ভয়ানক দ্বন্দ্বযুদ্ধ। দুই যুযুধান যোদ্ধার অসির ঝনঝনানি আওয়াজ আর দুজনের অশ্বের হেস্রাধ্বনিতে কম্পিত হতে লাগলো চতুর্দিক। একসময় নিজের থুতনিতে ঘোরীর তরবারির হাতলের আঘাত লেগে গুরুতর আহত হলেন গোবিন্দরাজ। তাঁর সম্মুখের পাটির গোটাদুয়েক দন্ত ভেঙে পড়লো। ওষ্ঠের কষ বেয়ে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগলো। আহত হয়ে তীব্র যন্ত্রণা আর নিদারুন ক্রোধে দ্রুতগতিতে ঘোরীর দিকে ধেয়ে এসে নিজের অসি দিয়ে ঘোরীর শিরস্ত্রাণ লক্ষ্য করে এক জোরালো আঘাত হানলেন গোবিন্দরাজ। গোবিন্দরাজের আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য নিজের অসি সুদ্ধ দক্ষিণ হস্ত মাথার উপরে তুললেন ঘোরী। গোবিন্দরাজের অসির তীক্ষ্ণধার ফলার আঘাত এসে নির্মমভাবে আছড়ে পড়লো ঘোরীর ডানহাতের বাহুতে। তৎক্ষণাৎ ঘোরীর হাত থেকে মাটিতে খসে পড়লো তাঁর তরবারি। আহত ও রক্তাক্ত ঘোরী অস্ফুট স্বরে আর্তনাদ করে রনে ভঙ্গ দিয়ে কোনমতে নিজের অশ্বের মুখ বিপরিত দিকে করে যন্ত্রণাক্লিষ্ট বিকৃত মুখে পলায়ন করলেন। হর হর মহাদেব রবে তাঁর পিছু ধাওয়া করলেন গোবিন্দরাজ। কিন্তু দ্রুতগামির তুর্কি অশ্বের সাথে গতি যুদ্ধে পরাজিত হলেন বীরবর গোবিন্দরাজ।

তরাইনের রনাঙ্গন ছেড়ে রাজপুত বাহিনীর নজর এড়িয়ে আরও কিছুদূর অগ্রসর হয়ে একসময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে তীব্র যন্ত্রণায় সংজ্ঞাহীন হয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলেন ঘোরী। ভারতবর্ষের দুর্ভাগ্য আর ঘোরীর সৌভাগ্য সেদিন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়লো। রাজপুত শিবির থেকে ভেসে এলো দিনান্তের যুদ্ধ বিরামের ঘোষণাকারী বিউগলের ধ্বনি।

পৃথ্বীরাজের বন্ধু বিচ্ছেদ আর ভাতিণ্ডা কেল্লা মুক্ত
==================================
অপরদিকে দ্রুতগামীর অশ্বের সহায়তায় মহারাজ পৃথ্বীরাজ আর তাঁর বাহিনীর নজর এড়িয়ে নিরাপদ দূরত্বে সফলভাবে পলায়ন করতে সফল হলো দুই তুর্কি সেনাপতি তাজউদ্দিন ইয়ালদুজ আর নাসিরউদ্দিন কুবাচা। আর্যাবর্ত্মের পবিত্র ভূমি থেকে বিজাতীয় স্মেচ্ছ যবন দস্যুদের সফলভাবে পরাজিত ও বিতাড়িত করে স্বগর্বে গৈরিক ধ্বজ উড্ডীন করে “জয় সোমেশ্বর” ধ্বনিতে চতুর্দিক আলোড়িত করে তরাইনের মূল রণাঙ্গনে ফিরে এলেন পৃথ্বীরাজ। সেখানে এসেই ভ্রাতা গোবিন্দরাজের নিকটে তিনি পেলেন মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরীর কাপুরুষচিত পলায়নের শুভ সংবাদ। দুই ভ্রাতা নিজেদের শিবিরে যখন যুদ্ধজয়ের আনন্দ উৎসব পালন করতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় এক রক্ষী এসে পৃথ্বীরাজকে জানালেন মৃত্যুপথযাত্রী ভাতিণ্ডার সামন্তরাজ তথা পৃথ্বীরাজের বাল্যসখা চাঁদ পুন্দির গুরুতর আহত অবস্থায় অদূরে অপেক্ষা করছেন মহারাজের অন্তিম সাক্ষাৎলাভের জন্য।

মুহূর্তের মধ্যে বিজয় উৎসব পরিণত হলো এক শোক যাত্রায়। প্রিয় বন্ধুর সংবাদ শুনে শোকাতুর পৃথ্বীরাজ তৎক্ষণাৎ তাঁর দেহরক্ষী সমেত ছুটে গেলেন তরাইনের প্রান্তরে যেখানে আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় অন্তিম শয্যায় শায়িত ছিলেন চাঁদ পুন্দির। পুন্দিরের কাছে গিয়ে শোকস্তব্ধ পৃথ্বীরাজ পরম যত্ন সহকারে তাঁর মাথাটা নিজের জানুদেশে তুলে নিয়ে গভীর মমতা সহকারে পুন্দিরের রক্তমাখা দক্ষিণ হস্তের পাতা নিজের ডান হাতের অঙ্গুলি দিয়ে আঁকড়ে ধরলেন। এরপর চাঁদ পুন্দিরের মুখের দিকে তাকিয়ে বাষ্পরুদ্ধ স্বরে বলে উঠলেন, “তোমার কিচ্ছু হবে না পুন্দির। আমরা যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি। রাজপুত শৌর্য আর পরাক্রমের সম্মুখে পুনরায় নত হয়েছে উদ্ধত স্মেচ্ছ তুর্কি দুর্বৃত্ত বাহিনী। এবারে তোমাকে দিল্লি ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। রাজবৈদ্যের চিকিৎসার সহায়তায় কিছুদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ রূপে সুস্থ হয়ে উঠবে তুমি। তারপর আবার আমরা একত্রে যুদ্ধাভিযানে গিয়ে নাশ করবো তুর্কি, কনৌজ আর গুজরাট সহ দিল্লির সমস্ত শত্রুদের।”

পৃথ্বীরাজের কথা শুনে তাঁর দিকে তাকিয়ে কোনমতে ক্ষীণ স্বরে পুন্দির বলে উঠলেন, “তা আর সম্ভব নয় মহারাজ। আমার অন্তিম সময় আসন্ন। আমি গর্বিত বিদেশি স্মেচ্ছ দস্যুদের বিরুদ্ধে এই নির্ণায়ক ধর্মযুদ্ধে মাতৃভূমির স্বতন্ত্রতা আর ধর্ম রক্ষার জন্য নিজের প্রান উৎসর্গ করতে পেরে। নিজের মনকে শক্ত করুন মহারাজ। আর আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করুন যে দিল্লি ফিরে গিয়ে আমার স্ত্রী আর পুত্রকে জানাবেন তাঁদের পতি আর পিতা চাঁদ পুন্দির এক প্রকৃত রাজপুত বীরের ন্যায় তরাইনের যুদ্ধভূমিতে স্মেচ্ছ বিজাতীয় দস্যু বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে বীরগতিপ্রাপ্ত হয়েছে।”
পৃথ্বীরাজ কোনমতে ক্ষীণ স্বরে বললেন, “কথা দিলাম মিত্র”। এরপরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে চিরঘুমের দেশে যাত্রা করলেন চাঁদ পুন্দির। প্রিয় বন্ধুকে হারানোর শোকে আর দুঃখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন পৃথ্বীরাজ। সেরাতে তরাইনের প্রান্তরে স্থাপিত শিবিরেই সেনাবাহিনী সহ রাত্রি যাপন করলেন মহারাজ পৃথ্বীরাজ। পরেরদিন নিকটবর্তী লোকালয় থেকে বেশ কয়েকজন পুরোহিত সমেত ভাতিণ্ডা কেল্লার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন মহারাজ পৃথ্বীরাজ। ভাতিণ্ডা কেল্লায় উপস্থিত হয়ে তিনি দেখতে পেলেন কাপুরুষ তুর্কি সিপাহী সালার জিয়াউদ্দিন কাজি কেল্লা পরিত্যাক্ত করে ইতিপূর্বেই তার বাহিনী সমেত গজনীর দিকে পলায়ন করেছেন। বিনা বাধায় ভাতিণ্ডা কেল্লা তুর্কি অধিকার মুক্ত করে পুরোহিতদের দিয়ে শুদ্ধিকরণ করালেন পৃথ্বীরাজ। তারপর কেল্লার বিভিন্ন প্রান্তে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে থাকা দিল্লির হতভাগ্য চৌহান রক্ষীদের ক্ষতবিক্ষত মরদেহগুলি পূর্ণ শ্রদ্ধা সহকারে দাহ করে ভাতিণ্ডা কেল্লার বুরুজে পুনরায় গৈরিক ধ্বজ উড্ডীন করে রাজধানি দিল্লির উদ্দেশ্যে প্রত্যাবর্তন যাত্রা শুরু করলেন পৃথ্বীরাজ।

ক্রীতদাস সেনাপতির সাহায্যে প্রাণ রক্ষা ঘোরীর
=================================
অপরদিকে তরাইনের রনাঙ্গন ছেড়ে মইজুদ্দিন ঘোরীর পলায়নের পর এক সময় রাত নেমে এলো। তরারির রনাঙ্গনের অদূরে এক অরন্যপ্রান্তরে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে রয়েছেন গুরুতর আহত তুর্কি অধিপতি মইজুদ্দিন ঘোরী। প্রভুর পাশে দণ্ডায়মান তাঁর বিশ্বস্ত অশ্বটি মাঝেমধ্যেই হেস্রাধ্বনি তুলে যেন বলতে চাইছে “ওহে কোন পথিক কি যাচ্ছ আশপাশ দিয়ে। কেউ সামনে উপস্থিত থাকলে একটু এদিকে এসে দয়া করে আমার প্রভুর জীবন রক্ষা করো।” এমন সময় জ্ঞান ফিরে পেলেন ঘোরী। তাঁর ডান হাত তীব্র যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে রয়েছে। তীব্র জ্বরের ঘোরে বিজাতীয় তুর্কি অধিপতির শরীরটা যেন ভেঙে পড়তে চাইছে। নড়াচড়া আর চিৎকার করবার  ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। যন্ত্রণা ক্লিষ্ট একটা মৃদু গোঙানির আওয়াজ যেন ছিটকে বেরিয়ে আসছিল হিন্দুস্থানের মাটিতে জিহাদের স্বপ্ন দেখা তুর্কি অধিপতির মুখ থেকে। এমন সময় হটাতই তাঁর ঘোড়াটা চিঁহিহি করে ডেকে উঠলো। সন্ত্রস্ত্র ঘোরী অদূরেই শুনতে পেলেন একাধিক অশ্বখুড়ের আওয়াজ আর দেখতে পেলেন একাধিক মশালের আলো। অশ্বারোহীরা যেন তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছিল। তীব্র আতঙ্কে কম্পিত হলো তুর্কি অধিপতির হৃদয়। মনে মনে ভাবলেন কে ওরা ? কাফেররাজা রায় পিথোরার ঘাতক বাহিনী নাকি ? কিন্তু ঘোরীর ভাবনাকে মিথ্যে প্রমানিত করে কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশিষ্ট দেহরক্ষী সমেত তাঁর সামনে এসে উপস্থিত হলো ঘোরীর নব্য নিযুক্ত সেই ক্রীতদাস সেনাপতি। ক্রীতদাস সেনাপতির দর্শনলাভ করে ঘোরী কোনমতে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন, “ইনশাল্লা, সুভানাল্লা কুতুবউদ্দিন, আল্লাহর অসীম কৃপায় অবশেষে তুমি সন্ধান পেয়েছে আমার। এবারে আমার প্রান রক্ষা করো। কসম খাচ্ছি যদি আমি কখনও হিন্দুস্থানের বুকে ইসলামের সাম্রাজ্য স্থাপন করতে পারি তাহলে তুমিই হবে হিন্দুস্থানের প্রথম তুর্কি সুলতান।”

এরপর তুর্কি সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবক, আহত ঘোরীকে পরম যত্ন সহকারে নিজের অশ্বশকটে তুলে নিয়ে ঘোরের রাজধানি গজনীর দিকে যাত্রা শুরু করলেন। দীর্ঘ যাত্রাপথে আবার সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন মইজুদ্দিন ঘোরী। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ঘোরী তাঁর সুপ্ত চেতনায় দেখতে পেলেন সেই অদ্ভুত ফকির মইনউদ্দিন চিস্তি যেন তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বলেছেন, “আপনাকে আগেই এই অশুভ যুদ্ধযাত্রা স্থগিত রাখবার অনুরোধ করেছিলাম জাহাঁপনা। কিন্তু আপনি আমার নিষেধাজ্ঞা না শুনে উল্টে আমাকেই আপনার শিবির থেকে বিতাড়িত করলেন।”

পৃথ্বীরাজের দিল্লি প্রত্যাবর্তন আর রাজা জয়চাঁদের শত্রুতা
=========================================
অপরদিকে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুর্কি দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে নির্ণায়ক জয়লাভ করে বিজয়ীর বেশে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করলেন মহারাজ পৃথ্বীরাজ চৌহান। বিজাতীয় স্মেচ্ছ দস্যু বাহিনীকে পরাভূত করে মাতৃভূমি আর বৈদিক ধর্মের রক্ষা করে দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজের রাজধানিতে প্রত্যাবর্তনের সংবাদ শুনে তাঁদের প্রিয় মহারাজকে শুভেচ্ছা বার্তা জানাবার জন্য দিল্লির চকবাজার থেকে লালকোটের কেল্লা-প্রাসাদ পর্যন্ত সমবেত হলেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দিল্লির প্রজাগণ। দিল্লির প্রশস্ত রাজপথ, কুঞ্জবন আর শ্বেত প্রস্তর নির্মিত সুবিশাল সুরম্য মন্দির আর দ্বিতল প্রাসাদগুলি সজ্জিত করা হলো একাধিক রংবেরঙের পুষ্প স্তবকের মোড়কে। দেহরক্ষী পরিবৃত হয়ে গজরাজের পৃষ্ঠে আসীন মহারাজ পৃথ্বীরাজ পুষ্প স্তবক দ্বারা সজ্জিত দিল্লি নগরীর প্রধান তোরণ দ্বার অতিক্রম করে নগরীর মধ্যে প্রবেশ করতেই প্রজারা তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিতে শুরু করলেন। দিল্লির অগনিত মন্দিরে বেজে উঠলো শঙ্খ আর কাসর-ঘণ্টার ধ্বনি। রাজপ্রাসাদের রাজকীয় বাদ্যকাররা তুড়ি, ভেড়ি, দুন্দুভি আর বিউগল বাজিয়ে তুর্কি নাশক দিল্লিশ্বরকে স্বাগত জানালেন। লালকোট কেল্লা প্রাসাদের সিংহ দুয়ার অতিক্রম করে কেল্লার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই চৌহান রাজবংশের নারীরা পুষ্পবৃষ্টি সহকারে রাজপ্রাসাদে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ চৌহানকে। পৃথ্বীরাজের মাতা রানি কর্পূরদেবী আর ভগিনী রাজকুমারী পৃথা বাঈ লালকোটের বিগ্রহরাজের মন্দিরে পূজাদান সম্পন্ন করে ফিরে এসে জয় তিলক অঙ্কিত করলেন যবন বিজয়ী দিল্লিশ্বরের ললাটে। অপরদিকে তুর্কিদের বিরুদ্ধে পৃথ্বীরাজের এই অভূতপূর্ব সাফল্যে প্রবল ঈর্ষান্বিত হয়ে চান্দেলরাজের সাথে হাত মিলিয়ে তাঁর সামন্ত রাজ্য নাগোর আক্রমণ করে বসলেন কনৌজের রাজা জয়চাঁদ গাহারওয়াল। রাজা জয়চাঁদ জানতেন না নাগররাজ চেত সিংহ, দিল্লি নরেশ পৃথ্বীরাজের সাথে তাঁর একমাত্র কন্যা রাজকুমারী ইন্দ্রাবতী দেবীর বিবাহ স্থির করেছেন। জয়চাঁদের এহেন দুঃসাহসিক স্পর্ধার পরিচয় পেয়ে যারপরনাই ক্রুদ্ধ হলেন পৃথ্বীরাজ। অপরদিকে দিল্লির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য পুনরায় অস্ত্রে শান দেওয়া শুরু করলেন গুজরাট নরেশ ভীমদেব সোলাঙ্কি। এদিকে গজনী প্রত্যাবর্তন করে শাহী হাকিমের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠে পুনরায় নবোদ্যমে হিন্দুস্থানের মাটিতে জিহাদের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন পরপর দুবার পরাজিত মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। তাকে সাহায্যের জন্য পুনরায় এগিয়ে এলেন ফকির মইনউদ্দিন চিস্তি। এবারে আর ফকিরকে ফেরালেন না মইজুদ্দিন ঘোরী।


বিঃদ্রঃ রাজস্থান আর গুজরাটের বহু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন তথ্য সহকারে প্রমান করেছেন যে কনৌজের রাজা তথা পৃথ্বীরাজের চিরশত্রু রাজা জয়চাঁদের কোন কন্যা সন্তান ছিল না। চাঁদ বারদাইয়ের দ্বারা রচিত “পৃথ্বীরাজ রাসো” কাব্যগ্রন্থে বর্ণিত দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ আর কনৌজের রাজকুমারী সংযোগীতার প্রণয় পর্ব সম্পূর্ণ মিথ্যা আর বিকৃত ইতিহাস। পৃথ্বীরাজের রাজমাতা রানি কর্পূরদেবী তাঁর পুত্রের সাথে নাগরের সামন্তরাজের কন্যা রাজকুমারী ইন্দ্রাবতী দেবীর বিবাহ স্থির করেছিলেন। কিন্তু তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের ফলে সেই বৈবাহিক সম্পর্ক আর স্থাপিত হয়নি।
১১৯২ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে দিল্লির রাজপুত শাসক সম্রাট পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরাজয় ও মৃত্যুর পর থেকেই ভিনদেশি বর্বর তুর্কি আক্রমণের প্রবল সম্ভাবনা কালবৈশাখীর ঝড়ের মতই ঘনিয়ে আসছিল সমৃদ্ধশালী বাংলার পশ্চিম প্রান্তে। যতদিন পৃথ্বীরাজ জীবিত আর মুক্ত ছিলেন ততদিন তাঁর দুই বলিষ্ঠ বাহু আর সুতীক্ষ্ণ তরবারি বিদেশি তুর্কি আগ্রাসনকারীদের ভারতের পবিত্র ভূমিতে পদার্পণ করতে দেয়নি আর একমাত্র পৃথ্বীরাজ ব্যতিত তৎকালীন উত্তর ও পূর্ব ভারতের অবশিষ্ট নৃপতিরাও আসন্ন তুর্কি আক্রমণ আর তাদের ধর্মীয় জিহাদের চিন্তা নিজেদের বহু দূরবর্তী চিন্তাতেও স্থান দেননি। তাঁদের ভাবখানা এমন ছিল যেন তুর্কি আক্রমণ কেবলমাত্র দিল্লি তথা পৃথ্বীরাজেরই সমস্যা, যদি তুর্কিদের বিরুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেন তবে বাকিরা মিলে পৃথ্বীরাজকে উচিত শিক্ষা দেবেন আর যুদ্ধে যদি পৃথ্বীরাজের পরাজয় হয় তবে তুর্কিদের সাথে তাঁরা সমঝোতা করে নেবেন। সম্ভবত তুর্কিদের বর্বরতা আর ইসলামের আসল পরিচয় সম্বন্ধে তাঁদের সম্যক জ্ঞান ছিল না বলেই তাঁদের এই অদূরদর্শিতা আর অনৈক্যই আর কিছুকালের মধ্যেই এক ভয়ানক সর্বনাশ ডেকে আনল ভারতের বুকে। তৎকালীন যুগের হিন্দু নৃপতিদের অপরিনামিতার মূল্য শুধু তৎকালীন যুগেই নয়, তাঁদের পরবর্তী বহু প্রজন্মমকেও চোকাতে হয়েছিল নিজেদের রক্ত দিয়ে। তবু প্রশ্নটা থেকেই যায় তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর বিদেশি তুর্কিরা অপ্রতিরোধ্যভাবে যখন একের পর এক হিন্দু রাজ্যগুলি অধিকার করে সেখানে ব্যপক গণহত্যা, লুণ্ঠন, মন্দির আর মঠ ধ্বংস আর ধরমান্তকরন করছিল এবং বক্তিয়ারের হাতে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের পর তুর্কি সর্পদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস যখন বঙ্গের দুয়ারে এসে উপস্থিত হয়েছিল তখনও সেন সাম্রাজ্য সেই ভয়ানক বিপদের প্রতি এত উদাসীন ছিল কেন ? এই প্রশ্ন আজও এক ঐতিহাসিক বিস্ময়। এর উত্তরের সন্ধান কেবলমাত্র একটি উপন্যাস বা পোস্টে সম্ভব নয়। তবুও আমার এই পোস্টে যতটা সম্ভব সেই বিস্ময়ের সমাধানের প্রয়াস করা হবে। এই ব্যপারে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করবার আগে আসুন জেনে নি বাংলার সেন সাম্রাজ্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

সেন রাজবংশের উৎপত্তিঃ
===================
আসল কাহিনী শুরু করবার আগে আসুন জেনে নেই সেন রাজবংশের উৎপত্তির ইতিহাস। সেনরাজবংশের পূর্বপুরুষরা দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটকের অধিবাসী ছিলেন। তাঁদের শিলালিপি অনুযায়ী তাঁরা চন্দ্রবংশীয় এবং ব্রহ্মক্ষত্রিয় ছিলেন। বাংলার প্রাচীন কুলুজীগ্রন্থে তাঁদের বৈদ্যজাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানকালের ঐতিহাসিকদের মতে তাঁরা ক্ষত্রিয়জাত। সেন রাজারা কিভাবে আর কোন সময়ে সদুর কর্ণাটক থেকে বাংলায় এসে রাজবংশ স্থাপন করেছিলেন সে বিষয়ে সেন রাজবংশের শিলালিপিতে দুটি উক্তি আছে। শ্রী বিজয়সেনের দেওপাড়া লিপিতে উল্লিখিত আছে যে সামন্তসেন রামেশ্বরমে রামসেতু পর্যন্ত বহু যুদ্ধাভিযান করে এবং দুর্বৃত্ত কর্ণাটলক্ষ্মী লুণ্ঠনকারী শত্রুকূলকে ধ্বংস করে গঙ্গাতটের সন্নিকটে এক পূর্ণাশ্রমে তাঁর শেষ জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। সুতরাং এই লিপি থেকে অনুমান করা যেতেই পারে যে সামন্তসেনই সর্বপ্রথম কর্ণাটক থেকে বাংলায় এসে গঙ্গাতীরে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু বল্লাল সেনের নৈহাটি তাম্রশাসন লিপি অনুযায়ী চন্দ্রবংশজাত বহু রাজপুত্র রাঢ়দেশের অলঙ্কারস্বরূপ ছিলেন এবং তাঁদের বংশেই সামন্তসেন ভূমিষ্ঠ হন। সুতরাং এই লিপি অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে সামন্তসেনের পূর্বপুরুষগন রাঢ়দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। এই দুই লিপির মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন করলে এটা অনুমান করা যায় যে কর্ণাটকের এক সেনবংশ বহুদিন ধরেই রাঢ় বাংলায় বাস করতেন এবং সেই বংশের সামন্তসেন যৌবনে দাক্ষিণাত্যে বহু যুদ্ধে নিজের শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়ে এই বংশের উন্নতির সূত্রপাত করেন এবং সম্ভবত এর ফলেই তাঁর পুত্র শ্রী হেমন্ত সেন রাঢ় বাংলায় এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন।

লক্ষণ সেনের বিজয় যাত্রার পরিচয়ঃ
---------------------------------------------
১১১৮ খ্রিষ্টাব্দে লক্ষণ সেন জন্মগ্রহণ করেন আর ১১৭৮ খ্রিষ্টাব্দে পিতৃ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর রাজ্যকালের আটটি তাম্রশাসন, তাঁর সভাকবিগণ রচিত কয়েকটি স্তুতিবাচক শ্লোক, তাঁর পুত্রদ্বয়ের তাম্রশাসন ও তুর্কি ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দিন রচিত তাবাকত-ই-নাসিরী নামক গ্রন্থ থেকে লক্ষণ সেনের রাজ্যের অনেক বিবরণ পাওয়া যায়। বাল্যকালে তিইনি পিতা বল্লাল সেন আর পিতামহ বিজয় সেনের সাথে সমরভূমিতে উপস্থিত হয়ে রণকুশলতার প্রভূত পরিচয় দিয়েছিলেন। রাজা লক্ষণ সেনের দুটি তাম্রশাসনে উক্ত হয়েছে যে তিনি কৌমারে উদ্ধত গৌড়েশ্বরের শ্রীহরণ আর কলিঙ্গ দেশে অভিযান করেছিলেন। তিনি দিল্লিস্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা না করলেও কাশীরাজকে পরাজিত করেছিলেন এবং ভীরু প্রাগ-জ্যোতিষের (অসমের কামরূপ) রাজা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন।

বিজয়সেন আর বল্লাল সেন উভয়েই তৎকালীন গৌড়েশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। সুতরাং খুব সম্ভবত রাজকুমার লক্ষণ সেন তাঁর পিতামহ বা পিতার রাজত্বকালে গৌড়ে যে সামরিক অভিযান করেছিলেন প্রসস্তিকায় তারও উল্লেখ রয়েছে। আবার প্রশস্তিকার অন্যত্র লেখা রয়েছে যে লক্ষণ সেন নিজভুজবলে সমর-সমুদ্র মন্থন করে গৌড়লক্ষ্মী লাভ করেছিলেন। অর্থাৎ খহুব সম্ভবত ব্বিজয় সেন গৌড়রাজকে দূরীভূত করলেও তাঁর শাসনকালে খুব সম্ভবত গৌড় বিজয়্য সম্পূর্ণ হয়নি। কারন এরপরেও গোবিন্দপাল গৌড়েশ্বর উপাধি ধারণ করেছিলেন এবং বল্লাল সেনকে পুনরায় গৌড় অভিযান করতে হয়েছিল। লক্ষণ সেনই সম্ভবত সম্পূর্ণরূপে গৌড়দেশ জয় করেছিলেন। কারন গৌড়ের রাজধানির নাম লক্ষণাবতী সম্ভবত লক্ষণ সেনের নাম অনুসারেই নামাঙ্কিত হয়েছিল এবং সর্বপ্রথম তাঁর তাম্রশাসনেই সেন নৃপতিদের নামের পূর্বে গৌড়েশ্বর উপাধি ব্যবহার করা হয়েছে।

লক্ষণ সেনের কামরূপ ও কলিঙ্গ জয়ও সম্ভবত তাঁর পিতামহের রাজ্যকালেই সংঘটিত হয়েছিল। কারন তাম্র শাসন অনুযায়ী বিজয় সেনের শাসনকালেই এই দুই দেশ বিজিত হয়েছিল। আবার এমনটাও হতে পারে যে বিজয় সেনের শাসনকালে গৌড়ের ন্যায় এই দুই রাজ্য জয়ও সম্পূর্ণরূপে সফল হয়নি। এরপরেও কুমার লক্ষণ সেনকে এই দুই রাজ্য বিজয় সম্পূর্ণ করতে পুনরায় যুদ্ধ করতে হয়েছিল। কারন লক্ষণ সেনের পুত্রদ্বয়ের তাম্র শাসনে দেখা গেছে যে তিনি সাগরপাড়ে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে, কাশীতে ও প্রয়াগে যজ্ঞযূপের সহ "সমরজয়স্তম্ভ" স্থাপিত করেছিলেন। এই সময়ে গঙ্গাবংশীয় রাজগণ কলিঙ্গ ও উৎকল উভয় দেশেই রাজত্ব করতেন। সম্ভবত লক্ষণ সেন কোন গঙ্গা বংশীয় রাজাকে পরাজিত করেই পুরিতে জয়স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন।

এদিকে কাশী ও প্রয়াগের জয়স্তম্ভ স্থাপন পশ্চিমপ্রান্তে গাহড়ওয়াল রাজার বিরুদ্ধে তাঁর বিজয়াভিজান সূচিত করেছে এবং এই অভিযানে দিল্লিস্বরের সাথে মিত্রতার উল্লেখ করেছে। ভারতের বিভিন্ন ঐতিহাসিক শিলালিপিতে পাল বংশের পতনের পূর্বেই যে গাহড়ওয়াল রাজবংশ যে মগধে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন তার উল্লেখ রয়েছে। বিজয়সেন তাঁর নৌবাহিনী প্রেরণ করেও কনৌজের গাহড়ওয়াল রাজবংশের বিরুদ্ধে বিশেষ সাফল্যলাভ করতে পারেননি। বল্লালসেন কিছুটা সফলতা লাভ করেছিলেন বটে তবে পরে তিনি গোবিন্দপালের রাজ্য হরণ করায় কনৌজের গাহড়ওয়াল রাজবংশ মগধে তাঁদের আধিপত্য বিস্তার করার আরও সুযোগ পেয়েছিলেন। দুই শক্তিশালি গাহড়ওয়াল নৃপতি বিজয়চন্দ্র আর জয়চন্দ্রের (জয়চাঁদ) লিপি থেকে প্রমানিত হয় যে ১১৬৯ থেকে ১১৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মগধের পশ্চিম ও মধ্যভাগ গাহড়ওয়াল রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। বঙ্গদেশের পশ্চিমপ্রান্তে এইভাবে কনৌজের গাহড়ওয়াল রাজবংশের সেনারা দ্রুত তাঁদের রাজ্য বিস্তার করতে থাকায় লক্ষণ সেনের সাথে জয়চাঁদের সামরিক সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল এবং হয়তো এই যুদ্ধে শক্তিশালি জয়চাঁদের বিরুদ্ধে জয়লাভের আশায় শত্রুর শত্রু আমার মিত্র বহু পুরাতন এই নীতি গ্রহণ করে লক্ষণ সেন গাহড়ওয়াল রাজবংশের ঘোরতর শত্রু দিল্লিস্বর পৃথ্বীরাজ চৌহানের সহিত মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন।

বিস্তৃত বিবরণ না থাকলেও কনৌজের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে লক্ষণ সেন যে প্রভূত সফলতা লাভ করেছিলেন সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। মগধের গয়া জেলায় লক্ষণ সেন যে রাজ্য বিস্তার করেছিলেন বৌদ্ধ গয়ায় প্রাপ্ত দুখানা লিপিতে তার স্পষ্ট প্রমান পাওয়া যায়। গাহড়ওয়াল রাজ জয়চাঁদের লিপি থেকে প্রমানিত হয় যে ১১৮২-১১৯২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিনি গয়ায় রাজত্ব করতেন। সুতরাং জয়চাঁদকে পরাজিত না করে লক্ষণ সেনের পক্ষে কখনই গয়ায় রাজ্য বিস্তার সম্ভব নয়। লক্ষণ সেনের বিরুদ্ধে জয়চাঁদের পরাজয়ের এইরূপ স্পষ্ট প্রমান বিদ্যমান থাকায় লক্ষণ সেন যে কাশী ও গয়ায় জয়স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন তাম্রশাসনের এই বিশিষ্ট উক্তি নিছক কল্পনা মনে করে হাস্যকৌতুকে উড়িয়ে দেবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

এইভাবে আমরা দেখতে পাই যে উত্তরে গৌড়, পূর্বে কামরূপ ও দক্ষিনে কলিঙ্গ রাজকে পরাজিত করে লক্ষণ সেন তাঁর পৈত্রিক রাজ্যকে অক্ষুণ্ণ ও সুদৃঢ় করতে সমর্থ হয়েছিলেন। পশ্চিমে তিনি কনৌজের বিরুদ্ধে তাঁর পিতামহ ও পিতার অপেক্ষা বহুগুণ অধিকতর সফলতা অর্জন করেছিলেন এবং মগধ (বর্তমান বিহার) পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। লক্ষণ সেনের তিরোধান আর সেন সাম্রাজ্যের ধ্বংসের বহু বছর পরেও মগধে তাঁর রাজ্যশেষ থেকে সংবৎসর গণনা করা হত। মগধ অর্থাৎ বিহারে যে লক্ষণ সেনের ক্ষমতা দৃঢ়ভভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়্যেছিল এটাই তার প্রকৃষ্ট প্রমান।

লক্ষণ সেনের দুই সভাকবি উমাপতিধর ও শরণ রচিত কয়েকটি শ্লোকে এক রাজার বিজয়গাথা বর্ণিত আছে। শ্লোকগুলোতে সেই রাজার নাম নেই ঠিকই কিন্তু সেই নৃপতি যে প্রাগজ্যোতিষ (কামরূপ), গৌড়, কলিঙ্গ, কাশী, মগধ প্রভৃতি জয় করেছিলেন এবং চেদি ও ম্লেচ্ছরাজকে পরাজিত করেছিলেন তার উল্লেখ রয়েছে। এই শ্লোক সমুদয় যে রাজা লক্ষণ সেনকে উদ্দেশ্যে করেই তাঁর দুই সভাকবি রচিত করেছিলেন এইরূপ সিদ্ধান্তে অনায়াসেই উপনীত হওয়া যেতে পারে। সুতরাং কামরূপ, কলিঙ্গ আর জয়চাঁদকে পরাজিত করা ছাড়াও লক্ষণ সেন যে চেদি (কলচুরি) ও কোন ম্লেচ্ছ শাসককে পরাজিত করেছিলেন এইরূপ অনুমান বিন্দুমাত্র অসঙ্গত নয়। রতনপুরের কলচুরিরাজের সামন্ত বল্লভরাজ গৌড় নৃপতিকে পরাজিত করেছিলেন, মধ্যপ্রদেশের একটি শিলালিপিতে এরকম উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং প্রতিশোধ নিতে কুলচুরিদের বিরুদ্ধে লক্ষণ সেনের সামরিক সংঘর্ষ সম্ভবত ঐতিহাসিক ঘটনা। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষই জয়ের দাবি করেছেন সুতরাং যুদ্ধের ফলাফল অনিশ্চিত বলেই গ্রহণ করতে হবে।

উল্লিখিত আলোচনা সমূহ থেকে আমরা দেখতে পাই যে লক্ষণ সেন তাঁর বাল্যকাল থেকে শুরু করে প্রায় সারা জীবনই যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত ছিলেন। ধর্মপাল আর দেবপালের পর বঙ্গে আর কোন নৃপতিই লক্ষণ সেনের ন্যায় বাংলার মূল সীমানার বাইরে যুদ্ধে এইরূপ অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করতে পারেননি। সুতরাং মাত্র ১৮ জন তুর্কি দস্যুদের আতঙ্কে ভীত হয়ে তিনি পলায়ন করেছিলেন এই তথ্য বেশ কিছুটা অতিরঞ্জিত বলেই সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক।

লক্ষণ সেন যখন পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন তখনই তাঁর বয়স প্রায় ষাট বছর। তখনকার সময় একালের মত ছিল না। বর্তমানকালের রাজনীতিবিদরা ৯০ বছর বয়সে অশীতিপর শরীর আর ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়েও প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সির অধিকারী হতে চান। কিন্তু সেকালের জনগন একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর পুণ্যলাভে বাণপ্রস্থে যেতেন। স্বয়ং দিগ্বিজয়ী সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যও নিজের জীবনের অন্তিম ১০ বছর কর্ণাটকের শ্রবণবেলগোলায় সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করেছিলেন। প্রায় ২০ বছর রাজত্ব করে অশীতিপর বৃদ্ধ ক্ষত্রিয় নৃপতি লক্ষণ সেন তাঁর পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে গঙ্গাতীরে নিজের জীবনের অন্তিমকাল অতিবাহিত করবার অভিপ্রায়ে নবদ্বীপে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনকালের এই অন্তিম সময়ে রাজ্যে আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের সূচনা হয়। ১১৯৬ খ্রিষ্টাব্দের একটি তাম্রশাসন থেকে জানা যায় ডোমনপাল নামধারি এক ব্যক্তি সুন্দরবনের খাঁড়ি পরগণায় বিদ্রোহী হয়ে এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিল।

লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে আর্যাবর্তের ভাগ্যাকাশে সূর্যাস্ত হয়েছিল। নয়শত বর্ষব্যাপী মহারাত্রি আসন্ন। পশ্চিম দিকপ্রান্তে রাক্ষসী বেলার রুধিরোৎসব আরম্ভ হয়েছে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী তুর্কি লুণ্ঠকদের দল অগনিত রক্তবীজের ন্যায় তাদের নেতা সুলতান মহম্মদ ঘোরীর নেতৃত্বে প্রথমে দিল্লিস্বর পৃথ্বীরাজ চৌহান ও তার অবহিতকাল পরেই কনৌজ অধিপতি জয়চাঁদকে পরাজিত করে ক্রমে ক্রমে আর্যাবর্তের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিধর্মী তুর্কিদের লুণ্ঠক সাম্রাজ্যের বিস্তার করেন। ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চান্দেরওয়ারের যুদ্ধে কনৌজ অধিপতি জয়চাঁদকে পরাজিত ও নিহত করে এবং ১১৯৫ খ্রিষ্টাব্দে মাউন্ট আবুর পাদদেশে কায়দারার দ্বিতীয় যুদ্ধে গুজরাতের চালুক্যরাজ ভীমদেব সোলাঙ্কিকে পরাজিত করবার পর (১১৭৮ খ্রিষ্টাব্দে কায়দারার প্রথম যুদ্ধে রানি নাইকি দেবির অসাধারন শৌর্য আর পরাক্রমের সামনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল মহম্মদ ঘোরীর তুর্কি বাহিনী) আর্যাবর্তের প্রসিদ্ধ রাজপুত রাজ্য্যগুলি একে একে তুর্কিদের পদানত হল। ক্রমে তুর্কিরা যুক্তপ্রদেশ অধিকার করে মগধ আর বাংলার সীমান্তে এক ঝঞ্ঝাবর্তের ন্যায় উপনীত হল।

এই ঘোর দুর্দিনে বঙ্গদেশের শাসক রাজা লক্ষণ সেন স্বীয় রাজ্য রক্ষার উদ্দেশ্যে কি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এত শতাব্দী পর তা আর জানবার কোন উপায় নেই। পরবর্তীকালে বাঙালি অথবা ভারতীয় কোন লেখক দ্বারা রচিত বাংলার এই দুর্যোগময় অন্ধকার যুগের সেরকম কোন বিবরণই পাওয়া যায়নি। সপ্ত শতাব্দীর আধারাছন্ন সময়ের কারাগারে আজ স্তব্ধ ও বন্দি সেই ইতিহাস। বক্তিয়ার খিলজির নবদ্বীপ লুণ্ঠনের অর্ধশতাব্দী পরে তুর্কি বিজেতা সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদের সভাসদ ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ তার স্বজাতীয় তুর্কি লুণ্ঠকদের মুখে সেনরাজ্য জয়ের যে কাহিনী শুনেছিলেন তাই তিনি তার পার্সি গ্রন্থ তবাকাত-ই-নাসিরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে এই তবাকত-ই-নাসিরি গ্রন্থকে অবলম্বন করেই প্রচারিত হয়েছিল বঙ্গের রাজা লক্ষণ সেনের কাপুরুষচিত পলায়ন আর মামুলি তুর্কি লুঠেরা বক্তিয়ার খিলজির সপ্তদশ অশ্বারোহী নিয়ে বাংলা বিজয়ের কাল্পনিক ও অতিরঞ্জিত কাহিনী। আর এই কাল্পনিক কাহিনীর ঐতিহাসিক সত্যতা আর বাস্তবসম্মত গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনা না করেই আজও সমগ্র ভারত ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের বহু ব্যক্তি লক্ষণ সেনকে কাপুরুষ বলে হতশ্রদ্ধা ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে আসছে।

তুর্কি আগ্রাসনকারী কর্তৃক গৌড় জয়ঃ
============================
তুর্কিদের গৌড় জয়ের ইতিহাস সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে হলে প্রথমেই আমাদের জেনে নিতে হবে বক্তিয়ার খিলজির আসল পরিচয়। বক্তিয়ার ছিল এক হুনদের মতই এক যাযাবর ভ্রাম্যমাণ তুর্কি লুণ্ঠনকারী দলের সদস্য। আফগানিস্থানের হিন্দুকুশ থেকে সিন্ধ ব্যাপী বিস্তীর্ণ প্রাচীন সিল্করুটের পাহাড়ি দুর্গম পথের গিরিকান্তরে দলবল সমেত আত্মগোপন করে থাকতো তাদের লুণ্ঠক বাহিনী। পাহাড়ি পথে ভ্রাম্যমাণ নিরস্ত্র সওাদাগরদের টুকরী দেখলেই আচমকা অস্ত্রসস্ত্র সমেত হামলা করে বিনা প্রতিরোধে সেই ব্যবসায়ীদের সর্বস্ব লুঠ করে তাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করে সমস্ত লুঠের মাল সেই সওদাগরদেরই অশ্বপৃষ্ঠে চাপিয়ে নিজেদের অস্থায়ী বাসস্থানে প্রত্যাবর্তন করে এক পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠত সেই তুর্কি লুণ্ঠকরা। সারা রাত ধরে মশালের আলোয় চলত তুর্কি যৌনদাসীদের নৃত্যকলা আর ছুটটো মদিরার ফোয়ারা। অপরদিকে অন্ধাকারাছন্ন সিল্করুটের পথের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে থাকতো তুর্কি তরবারির আঘাতে ছিন্ন হতভাগ্য সওদাগরদের রক্তাক্ত শবদেহ আর কর্তিত মুণ্ডু।

এদিকে বক্তিয়ারের এসব মামুলি লুণ্ঠন আর হত্যা একেবারেই ছিল না পসন্দ। বক্তিয়ার শৈশবকাল থেকেই ছিল প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষী। বক্তিয়ারের মনে হত এইসব মামুলি সওদাগরদের আক্রমন আর লুণ্ঠন আর নিধন করে আর কত ধনসম্পদের মালিক হওয়া যায় আর মামুদ গজনী বা মহম্মদ ঘোরী এমনকি নিদেনপক্ষে কুতুবউদ্দিন আইবকের মতও মহান কাফের হত্যাকারী হিসাবে নিজের নাম ইতিহাসের পাতায় কিছুতেই অমর করে রাখাও সম্ভব নয়। এই মামুলি লুণ্ঠন আর হত্যা তার কাজ নয়। তার জন্য অপেক্ষা করছে আরও বড় মঞ্চ। এবারে সময় এসেছে সোনার চিড়িয়া হিসাবে খ্যাত প্রসিদ্ধ কাফেরদের মুল্ক হিন্দুস্থানের ভূমিতে পদার্পণ করবার। নিজের ছোটবেলার স্থান পরিত্যাগ করবার বক্তিয়ারের এই বাসনার পিছনে আরেকটি কারনও অবশ্য ছিল। সেটি হল তার কদর্য স্থূলকায় চেহারা। তার এই বদদর্শন চেহারার কারনেই তুর্কিস্থানে প্রতিনিয়ত বক্তিয়ারকে তার পরিচিত ব্যক্তিদের রঙ্গ-তামাশার সম্মুখীন হতে হত। হয়তো বা নিজের এই কদর্য ও বিকৃত চেহারার দোষ স্খালন করবার অভিপ্রায়ের প্রচুর ক্ষমতা ও অতুল ঐশ্বর্যের আস্বাদ পেতে চেয়েছিল সে।

আনুমানিক ১১৮৫ থেকে ১১৮৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ঘুরের রাজধানি গজনী নগরে গিয়ে সুলতান গিয়াসউদ্দিন ঘোরীর রাজদরবারে প্রবেশ করে তুর্কি বাহিনীর যোদ্ধা হিসাবে কর্ম প্রার্থনা করেছিল বক্তিয়ার খিলজি। কিন্তু মন্দ ভাগ্য বক্তিয়ারের। তার স্থূলকায় চেহারার কারনেই সম্ভবত তাকে একজন যোদ্ধা হিসাবে গ্রহণ করেননি তুর্কি সুলতান। কিন্তু তাও নিজের উচ্চাশা ত্যাগ করল না বক্তিয়ার। এরপর অতিবাহিত হল আরও কয়েকটি বছর। তখন ১১৯৩ সাল। ভারতবর্ষ তথা তুর্কি বর্ণিত হিন্দুস্থানের উত্তরভাগের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তখন বিধর্মী পৌত্তলিক স্থানীয় আর্য কাফেরদের পরাজিত ও নিধন করে প্রবলভাবে কায়েম হয়েছে তুর্কিদের শরিয়তি শাসন। দিল্লির লালকোট তথা চৌহান রাজপরিবারের প্রাচীন কেল্লায় তখন কুতুবউদ্দিন আইবকের রাজপাট। সুলতান মহম্মদ ঘোরীর বিশ্বস্ত দাস হিসাবে ঘোরীর হয়ে তখন দিল্লি শাসন করছেন কুতুবউদ্দিনই। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বক্তিয়ার সোজা এসে হাজির হল কুতুবের দরবারে। মর্কটাকৃতি বক্তিয়ারের ভাগ্য এখানেও তার প্রতি সহায় হল না। স্রেফ সান্ত্রীদের মুখে বক্তিয়ারের বর্ণনা শুনে তার সাথে সাক্ষাৎ না করেই বক্তিয়ারকে ফিরিয়ে দিল কুতুবউদ্দিন। এদিকে দীর্ঘ যাত্রার ফলে বক্তিয়ার তখন নিদারুন অর্থকষ্টে ভুগছে। আরও যাত্রার জন্য ঘোড়া ক্রয় করবার অর্থও নেই তার কাছে। কিন্তু তবুও হাল ছাড়ল না সে। তাকেও মামুদ গজনী আর মহম্মদ ঘোরীর মতই মহান গাজী হতেই হবে যে। এরপর এক রাতের আঁধারে দিল্লির এক অশ্ব ব্যবসায়ীর আস্তাবল থেকে একটি হৃষ্টপুষ্ট ঘোড়া চুরি আর অস্ত্র চুরি করে দিল্লি ত্যাগ করে বদায়ু শহরের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালো সে। বক্তিয়ার খবর পেয়েছিল বদায়ু নগরের তুর্কি সুবেদার শিহাবউদ্দিন খিলজি তারই স্বজাতি। শিহাবের উপাধিও খিলজি। তাহলে এক তুর্কি খিলজি কি আরেক তুর্কি খিলজির দুর্দিনে তার পাশে দাঁড়াবে না, নিশ্চয়ই দাঁড়াবে। মনে এই আশা নিয়ে অবশেষে বক্তিয়ার এসে উপস্থিত হলেন বদায়ু শহরে।

এরপর শিহাবউদ্দিনের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করল বক্তিয়ার। পাঠান মুলুক থেকে তারই এক স্বজাতি তুর্কি এসেছে তার সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে এই অনুরোধ শুনে বক্তিয়ারের সাথে দেখা করতে রাজি হল শিহাবউদ্দিন। শিহাবের সভাকক্ষে প্রবেশ করে বক্তিয়ার কোনরূপ ভনিতা না করেই সটান বলে উঠল, "হুজুর, মালিক আমার আমি আপনারই স্বজাতি। ভাগ্যান্বেষণে আমি এসেছি সদুর তুর্কিস্থান থেকে এতদূরে। দয়া করে একটা জায়গীর উপহার দিন আমায়। আপনিও খিলজি জাত আর আমিও খিলজি জাত। এই দুর্দিনে আপনি আমাকে সাহায্য না করলে আর অন্য কোন তুর্কি আমাকে সাহায্য করবে ? আমি প্রতিজ্ঞা করছি খোদাবন্দ, আমি আপনাকে নিরাশ করব না।" বক্তিয়ারের এহেন আবেদন শুনে যারপরনাই বিস্মিত হল শিহাবউদ্দিন। তার মনেও আশঙ্কা জন্মাল এহেন স্থূলকায় কদর্য ব্যক্তির পক্ষে যুদ্ধজয় কি আদৌ সম্ভব। এর চেহারা দেখলেই তো অনান্য সহযোদ্ধারা হাসতে শুরু করবে। তবুও স্বজাতি বলে কথা। একেবারে নিরাশ করে ফেরানোটা মটেই উচিত কাজ হবে না। এরপর মাসিক ৬০ টি রৌপ্যমুদ্রার বেতনে তার বাহিনীর এক সর্দারের পদে বক্তিয়ারকে নিযুক্ত করল শিহাবউদ্দিন খিলজি।

বখতিয়ার খিলজির সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ =========================== মাসিক ৬০ টি রৌপ্যমুদ্রার বেতনে শিহাবউদ্দিন খিলজির বাহিনীর সর্দারের চাকরিতে যোগদান করল বখতিয়ার খিলজি। সেখানেই বেশ কয়েকমাস অতিবাহিত হল। শিহাবউদ্দিন খিলজির বাহিনীর সাথে ভিড়ে এই কয়েকমাস উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রাচীন লোকালয়ে বসবাসকারী কাফের আর্যদের বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযানে অংশগ্রহণ করল সে। বহু অসহায় আর নিরস্ত্র আর্য পুরুষদের নির্মমভাবে হত্যা করল আর আর্যা নারীদের বন্দি করে তুর্কিদের যৌনদাসী করবার অভিপ্রায়ে তাঁদের দিল্লি আর গজনীর দরবারে প্রেরণ করল। কিন্তু এখানেই যদি থেমে যেত বখতিয়ার তাহলে হয়তো বিহার আর বাংলার ইতিহাসটা একটু ভিন্ন ধরনের হত। কিন্তু প্রবাল উচ্চাকাঙ্ক্ষা যেন বারংবার বখতিয়ারের মনের অভ্যন্তরে বলে চলেছিল, এখানেই থেমে যেও না বখতিয়ার, এখানে তো তুমি কেবলমাত্র রূপো পেয়েছ, আরও পূর্ব দিগন্তে প্রসারিত হও। সেখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে ঘৃণ্য আর্যদের মহার্ঘ সোনা আর হিরে মানিক্য সহ আরও আরও বহুমুল্য ধনরত্ন, আর ভুলে যেও না বখতিয়ার এখনও তোমার সুলতান মামুদ গজনী আর মহম্মদ ঘোরীর মত পবিত্র গাজী উপাধি লাভ হয়নি। কিছু অর্থ জমানোর পর বখতিয়ার একদিন শিহাবউদ্দিন খিলজির দরবারে গিয়ে তাকে একটা মস্ত সেলাম ঠুকে বলল, "আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ হুজুর। মালিক আমি আপনার নমক খেয়েছে। আমার দুঃসময়ে আপনি আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। সারা জীবন আপনার এই দাস কখনও ভুলতে পারবে না আপনাকে। তবে এবারে আমি হিন্দুস্থানের আরও পূর্ব দিগন্তে গিয়ে আমার ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখতে চাই। আমাকে অনুমতি দিন হুজুর।" শিহাবউদ্দিন অনুমতি দিলেন। এরপর বখতিয়ার তার জমানো অর্থ ব্যায় করে একটা তেজি তুর্কি অশ্ব কিনে সেটায় আরোহণ করে এসে উপস্থিত হল আওধ রাজ্যে। সেখানকার জায়গীরদার তখন মালিক নাসিরুদ্দিন। নাসিরুদ্দিনের দরবারে হাজির হয়ে তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতেই তিনি তুরন্ত বখতিয়ারকে দুটো জায়গীর উপহার দিলেন। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। একসাথে দু-দুটো জায়গীর। পরে বখতিয়ার বুঝতে পারল যে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের স্মৃতিধন্য মগধ (বিহার) রাজ্যের যে জায়গীর দুটো তাকে উউপহার দেওয়া হয়েছে সেখানে বর্তমানে ঘৃণ্য আর্যরাই বসবাস আর শাসন করে। তুর্কি শাসনের কোন অস্তিত্বই নেই সেখানে। এ যেন রাজ্যহীন রাজার মত অবস্থা। জায়গীরদার হিসাবে বখতিয়ারের কোন মূল্যই নেই যতক্ষণ পর্যন্ত না বখতিয়ার তার তুর্কি বাহিনী সমেত নিজে সেখানে উপস্থিত হয়ে কাফের আর্যদের বধ করে নিজের তরবারির ফলা কাফেরদের রক্তে শাণিত করে ওই স্থানগুলো বলপূর্বক অধিকার করে সেখানকার শাসক হয়ে বসছেন। এরপর বখতিয়ার আর তার লুণ্ঠক বাহিনী মগধের (বিহার) চুনার জেলার ভুইলি আর ভাগবত নামক দুই স্থানে আচমকা হামলা চালিয়ে নিরস্ত্র ও অসহায় আর্য আর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নির্বিচারে গনহত্যা করে ওই স্থান বলপূর্বক অধিকার করে সেখানকার শাসক হয়ে বসল। বলাই বাহুল্য পৃথ্বীরাজ আর জয়চাঁদের পরাজয় ও মৃত্যুর পর উত্তর আর মধ্য ভারতে তুর্কিদের নির্বিচার গনহত্যা আর লুণ্ঠন রোধ করবার মত হাক্কা-বুক্কা বা কৃষ্ণদেব রায় বা ছত্রপতি শিবাজী বা পেশওয়া বাজিরাও বল্লালের মত কোন বিকল্প আর্য শক্তির তখনও উত্থান হয়নি। আর বঙ্গের সমসাময়িক বৃদ্ধ শাসক লক্ষণ সেন তখন বাংলা রক্ষা করতে ব্যস্ত। চর মারফৎ রাজা লক্ষণ সেনেরও কর্ণগোচর হয়েছিল মগধ পর্যন্ত তুর্কি আক্রমণকারীদের উন্মাদ যাত্রা। তৎকালীন মগধ রাজ্যে পূর্ববর্তী মৌর্য, গুপ্ত আর বাংলার পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে নালন্দা, ঔদন্তপুরী, বিক্রমশিলার মত অসংখ্য প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ আর বিদ্যালয়ে সজ্জিত ছিল। বখতিয়ার লক্ষ্য করল কাফেরদের সেইসব ধর্মীয় স্থানগুলিতে তুর্কিদের বাধাধান করবার মত সেরকম কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থাই নেই। অতএব শুরু হল বখতিয়ারের বিভিন্ন প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার আর বিদ্যালয়গুলি লুণ্ঠন আর সেই সকল বিদ্যালয়ের নিরস্ত্র কাফের সন্ন্যাসীদের নির্বিচারে হত্যালীলা। সে যুগে গনিমাতের মালের ব্যপক লুণ্ঠন আর নির্বিচারে নিরস্ত্র কাফের বধই ইসলামের সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রথম ধাপ হিসাবে গণ্য হত। এলাকা অধিকার করে দার-উল-ইসলাম স্থাপন করা দ্বিতীয় ধাপ। সেজন্যই শুধুমাত্র লুণ্ঠন আর গনহত্যা করেই সে যুগের তুর্কি আর একালের মুসলিম ঐতিহাসিকদের নিকটে বখতিয়ার আজ এক মহাবীরে পরিণত হয়েছে। এমনিতে মামুদ গজনী বা মহম্মদ ঘোরী বা আলাউদ্দিন খিলজির মত বিশাল ইসলামিক সাম্রাজ্য স্থাপন করবার মত সেনাবাহিনী, ছল-চাতুরী আর মানসিক জোর কোনটাই ছিল না বখতিয়ার খিলজির মত একটি মামুলি ডাকাতদলের সর্দারের। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ যুগে বাংলার বিশে ডাকাতদের মতই মামুলি লুণ্ঠক ছিল বখতিয়ার। ক্রমে বখতিয়ারের কানে এল বিহারের শতাব্দী প্রাচীন নালন্দা আর বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। সেখানে নাকি প্রচুর ধনসম্পদ গচ্ছিত করে রেখেছে বৌদ্ধ কাফেররা। নালন্দার তিনটি বিখ্যাত কক্ষের নামই তো রত্নদধি, রত্নসাগর আর রত্নরঞ্জক। না জানি কত সহস্র স্বর্ণমুদ্রা আর হীরকখণ্ড লুকনো রয়েছে সেখানে। এরপর গনিমতের মাল লুণ্ঠন ও আত্মসাৎ করে কাফের বধ করে গাজী উপাধি লাভের অভিপ্রায়ে একরাতে নালন্দা আক্রমন করল বখতিয়ার আর তার তুর্কি দস্যু বাহিনী। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে কক্ষগুলি ধনরত্ন ভর্তি থাকবে আশা করেছিল বখতিয়ার সেগুলি পরিপূর্ণ ছিল বজ্জাত কাফের বৌদ্ধ আর আর্যদের নানা প্রাচীন পুস্তকে। যাইহোক এরপর নালন্দা, বিক্রমশিলা, ঔদন্তপুরী সহ একাধিক বৌদ্ধ মঠ নির্বিচারে ধ্বংস করলেন বখতিয়ার। সেদিন বখতিয়ারের এই লুণ্ঠন আর কাফের হত্যাকে স্বীকৃতি দিতেই যেন আজ ঔদন্তপুরীর নাম বদলে বখতিয়ারপুর রেখেছে বিহার সরকার। বৌদ্ধ বিহারগুলি ধ্বংস করবার পিছনে আরেকটি অভিপ্রায় ছিল বখতিয়ারের। সেকালে পাল রাজাদের সৃষ্টি প্রচুর বৌদ্ধ বিহাররাজি ছিল মগধে। সেগুলো ধ্বংস আর লুণ্ঠন করে স্থানীয় অধিবাসীদের মনে সহজেই তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি করা আর একাধিক নিরস্ত্র কাফের বধ করে গাজী উপাধি লাভ করা। এরপর তুর্কি হামলাকারীদের মুখে মুখে মগধের নাম পরিবর্তন হহয়ে সেই রাজ্যের নয়া নামকরণ হয়ে গেল বিহার। এরপর বখতিয়ারের নজর পড়ল ধনধান্যে পুষ্পভরা বাংলার দিকে। অপপ্রচারের আলোয় লক্ষণ সেন ======================== এবারে পুনরায় ফিরে আসা যাক বাংলার তৎকালীন আর্য শাসক রাজা লক্ষণ সেনের প্রসঙ্গে। প্রবন্ধ কোষা, প্রবন্ধ চিন্তামনি আর আরও একাধিক সমসাময়িক হিন্দু আর জৈন ঐতিহাসিক গ্রন্থ অনুসারে তৎকালীন বাংলার শাসক তুর্কিদের অগ্রগতির সংবাদ বিলক্ষণ জানতেন এবং সেই অনুযায়ী স্বরাজ্যকে রক্ষা করতে যথা সম্ভব ব্যবস্থাও গ্রহন করেছিলেন। একথা নিজের গ্রন্থ তবাকত-ই-নাসিরিতে স্বীকার করেছিলেন তুর্কি ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজও। কিন্তু তারপর কি হল ? কিভাবে বাংলা অধিকার করেছিল বখতিয়ার খিলজি ? নাকি আদৌ বাংলা অধিকার করতে পারেনি বখতিয়ার, কেবলমাত্র ছদ্মবেশে আচমকা হামলা করে শুধুমাত্র নদিয়া লুণ্ঠন আর পশ্চিমবঙ্গের আড়াইখানা জেলা সাময়িকভাবে অধিকার করেছিল বখতিয়ার ? আজ এতকাল পরে এসবের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে জোর দিয়ে দাবি জানানোর মত কোন শক্ত প্রমানও নেই। আছে কেবলমাত্র কতিপয় তুর্কি আর হিন্দু ও জৈন ঐতিহাসিক কাব্য গ্রন্থ। তবাকাত-ই-নাসিরি গ্রন্থে তুর্কি লুঠেরা দ্বারা মগধ ও গৌড় জয়ের কিছুটা বিস্তারিত বিবরন পাওয়া যায় বটে, তবে গ্রন্থকার মিনহাজ-ই-সিরাজ ওরফে আবু ওসমান মিনহাজউদ্দিন বিন সিরাজউদ্দিন নিজে আফগানিস্থানের ঘোর রাজ্যের অধিবাসী ছিলেন। জন্মসূত্রেই তুর্কি মিনহাজ 1193 খ্রিষ্টাব্দে ঘোরের রাজধানি ফিরুজকু নগরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এরপর ১২২৭ সালে অনেকটা বখতিয়ার খিলজির মতই ভাগ্যান্বেষণে তিনি হিন্দুস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। প্রথমে মাসখানেক উচ রাজ্যে বসবাস করবার পর অবশেষে তিনি তুর্কি অধিকৃত দিল্লি নগরে পদার্পণ করেন। দিল্লির তৎকালীন সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ তার লেখা কবিতা ও কাহিনী পরে মুগ্ধ হয়ে মিনহাজ কে তার সভাকবি পদে নিযুক্ত করেন এবং সুলতান তার নিজের জীবন কাহিনী লিপিবদ্ধ করবার জন্য মিনহাজকে অনুরোধ করেন। সুলতানের অনুরোধ মেনে মিনহাজ তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ তবাকত-ই-নাসিরি লেখার কাজ শুরু করেন। অতএব একজন তুর্কি লেখকের পরাজিত কাফের আর্য জাতির প্রতি যে জন্মগত ঘৃণাবোধ থাকবে সেটা আশাকরি একজন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রেরও বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। এছাড়াও মিনহাজ দিল্লির সুলতানের অধীনে তার রাজসভায় উচ্চ আমলার পদে নিযুক্ত ছিলেন এবং রাজকার্য সম্পন্ন করবার জন্য মিনহাজকে নানা স্থানে ভ্রমণ করতে হত। এইরকমভাবে হিন্দুস্থানে নানান স্থানে ভ্রমণ করে স্থানীয় তুর্কি অধিবাসীদের নিকট থেকে তথ্য ও সংবাদ সংগ্রহ করে ১২৪২ সালের কিছু পরে এই ইতিহাস রচনা করেন। মগধ জয়ের প্রায় ৪০ বছর পরে লখনৌ নগরি ভ্রমণকালে মিনহাজের সাথে দুজন বৃদ্ধ তুর্কি সেনার সাথে দেখা হয়। ওরা দাবি করে যে ওরা ওই যুদ্ধে বখতিয়ার খিলজির তুর্কি বাহিনীতে ছিল এবং এই দুই বৃদ্ধ তুর্কি সেনার মুখ নিঃসৃত কাহিনী শুনেই মিনহাজ-ই-সিরাজ পরবর্তীকালে তাঁর গ্রন্থে বখতিয়ারের মাত্র ১৮ জন তুর্কি যোদ্ধা নিয়ে গৌড় বিজয়ের রূপকথার কাল্পনিক কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন। তুর্কিদের মগধ আর গৌড় বিজয়ের কোন সরকারি বিবরণ বা দলিলপত্রও মিনহাজের হস্তগত হয়নি। হয়তো বা বিজয়গর্বে দৃপ্ত, প্রভুত্বের উন্মাদনায় মত্ত হয়ে এক বিজিত ও ঘৃণ্য কাফের আর্য জাতির প্রতি সহজাত হতশ্রদ্ধা হয়ে শুধুমাত্র দুজন বৃদ্ধ তুর্কি সেনার মুখ নিঃসৃত বিবরণ শুনেই তিনি আজকালকার ঐতিহাসিক পটভূমিকা আর কল্পনার মিশ্রণে কালজয়ী উপন্যাস লেখা শ্রী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতই বখতিয়ারের নদিয়া বিজয় নিয়ে এক কাল্পনিক কাহিনী রচিত করেছিলেন।

বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের বিস্তারিত বর্ণনা কেবলমাত্র মিনহাজ-ই-সিরাজের লেখা তাবাকত-ই-নাসিরি পুস্তকে পাওয়া যায়। কিন্তু পরে জানা যায় বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয়ের প্রমান হিসাবে মিনহাজের নিকটে না ছিল কোন সরকারি বিবরণ আর দলিলপত্র না ছিল সেই যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারী কোন তুর্কি যোদ্ধার সাক্ষ্য। পরবর্তীকালে মিনহাজ তার পুস্তকে নিজেই লিখেছিলেন যে তিনি কেবলমাত্র কয়েকজন বিশ্বাসী ব্যক্তির (অবশ্যই তুর্কি) মুখ নিঃসৃত বর্ণনা শ্রবণ করেই বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয়ের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

এইভাবে কেবলমাত্র লোকমুখে শুনে ও তার সাথে নিজের কল্পনার রঙ চড়িয়ে মিনহাজ বখতিয়ারের মগধ ও গৌড় জয়ের যে বর্ণনা লিখেছিলেন তা বিখ্যাত বাঙালি ঐতিহাসিক শ্রী নিহাররঞ্জন রায় পরবর্তীকালে কিছুটা বঙ্গানুবাদ করেছিলেন। মিনহাজের লেখার বঙ্গানুবাদ নিচে দেওয়া হলঃ

"ইখতারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি নামক খিলজি বংশীয় একজন তুরস্ক সেনানায়ক উপযুক্ত কর্মানুসন্ধানে মহম্মদ ঘোরী ও কুতুবুদ্দিনের নিকট গিয়ে বিফল মনোরথ হয়ে অবশেষে অযোধ্যার বা আওধের মালিক নাসিরুদ্দিনের (বা হুসামুদ্দিন) অনুগ্রহে চুনারগড়ের নিকট দুটি পরগনার জায়গীর প্রাপ্ত হন। এখান থেকে বখতিয়ার দুবছর যাবৎ মগধের নানাস্থানে লুণ্ঠন করে এবং লুণ্ঠিত অর্থের দ্বারা সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে অবশেষে দুইশত অশ্বারোহী সৈন্যসহ হটাৎ আক্রমন করে একপ্রকার বিনা বাধায় "কিলা বিহার" অধিকার করেন। এর মুণ্ডিত মস্তক অধিবাসীদিগকে নিহত ও বিস্তর দ্রব্য লুণ্ঠন করবার পর আক্রমণকারীগন জানতে পারলেন যে এটি বস্তুত "কিলা" অর্থাৎ দুর্গ নহে। এটি একটি বিদ্যালয় মাত্র, এবং হিন্দুর ভাষায় একে "বিহার" বলে।
"কিলা বিহারের" লুণ্ঠিত ধনরত্ন সহ বখতিয়ার স্বয়ং দিল্লিতে গিয়ে কুতুবুদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বহু সম্মান প্রাপ্ত হন। দিল্লি থেকে ফিরে এসে তিনি বিহার প্রদেশ জয় করেন।

এই সময় রায় লখমনিয়া (রাজা লক্ষণ সেন) তাঁর রাজধানি নুদিয়াতে অবস্থান করছিলেন। তাঁর পিতার মৃত্যুর সময় তিনি মাতৃগর্ভে ছিলেন। তাঁর জন্মকালে দৈবজ্ঞগণ গননা করে বলেছিল যে যদি এই শিশুর এখনই জন্ম হয় তবে সে কখনই রাজা হবে না, কিন্তু আর দুঘণ্টা পরে জন্মালে সে ৮০ বছর রাজত্ব করবে। এই কথা শোনার পর রাজমাতার আদেশে তাঁর (রাজমাতার) দুই পা বেঁধে মাথা নিচের দিকে করে তাঁকে ঝুলিয়ে রাখা হল। অবশেষে শুভ মুহূর্ত উপস্থিত হলে তাঁকে মাটিতে নামানো হয়, কিন্তু পুত্র প্রসবের পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। এরপর রায় লখমনিয়া ৮০ বছরই রাজত্ব করেছিলেন এবং হিন্দুস্থানের একজন প্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন।

বখতিয়ার কর্ত্বিক বিহার জয়ের পরে তাঁর খ্যাতি নুদিয়ায় পৌঁছল। দৈবজ্ঞ, পণ্ডিত ও ব্রাহ্মণগণ রাজাকে বললেন, "শাস্ত্রে লেখা আছে তুরস্করা এই দেশ জয় করবে, এবং তাঁর অন্তিমকাল উপস্থিত। সুতরাং পলায়ন করাই সঙ্গত"। রাজার প্রশ্নের উত্তরে সেই বিশ্বাসঘাতক ব্রাহ্মণরা জানালেন যে তুরস্ক বিজয়ীর চেহারা কিরূপ তাহাও শাস্ত্রে লেখা আছে। ইতিমধ্যেই রায় লখমনিয়ার বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ কৈবর্ত গুপ্তচর প্রেরণ করে রাজদরবারের বিশ্বাসঘাতক ব্রাহ্মণরা বখতিয়ার খিলজির আকৃতির বিবরণ জেনে এসেছিল। রাজার প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা গুপ্তচর মারফৎ পাওয়া বখতিয়ারের আকৃতির বর্ণনা দিলেন। এরপর রাজা নিজে সন্দেহভাজনের জন্য বখতিয়ারের আকৃতির বর্ণনা জানতে গুপ্তচর প্রেরণ করলেন। রাজা রায় লখমনিয়ার গুপ্তচর যে বর্ণনা আনল স্বভাবতই তাঁর সাথে রাজদরবারের ব্রাহ্মণদের বর্ণনা মিলে গেল। তখন বহু ব্রাহ্মণ ও বনিকগণ রাজাকে ত্যাগ করেই স্বার্থপরের ন্যায় নুদিয়া থেকে পলায়ন করল। কিন্তু রাজা লখমনিয়া তাঁর রাজধানি ত্যাগ করতে স্বীকৃত হলেন না।

এর এক বছর পরে বখতিয়ার একদল সৈন্য সহ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিহার থেকে নুদিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। তিনি এতটাই দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে যখন অতর্কিতভাবে তিনি সহসা নুদিয়ায় পৌঁছলেন, তখন মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী তাঁর সাথে আসতে পেরেছিল। নগরদ্বারে উপস্থিত হয়ে তিনি কাউকে কিছু না বলে এমন ধীরেসুস্থে সঙ্গীগণ সহ নগরে প্রবেশ করলেন যে নুদিয়ার কাফের প্রজারা মনে করল যে সম্ভবত এরা একদল তুর্কি সওদাগর। অশ্ব বিক্রয় করতে এসেছে। এদিকে সেদিন নুদিয়ার রাজপ্রাসাদে কাফেরদের কোন ধর্মীয় উৎসব চলছিল। সেই উৎসবের ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী রাজা লখমনিয়া সহ অধিকাংশ রক্ষীরা নিরস্ত্র ছিলেন (হয়তো এটাও বিশ্বাসঘাতক ব্রাহ্মণদেরই কোন ষড়যন্ত্র হবে)। বখতিয়ার সশস্ত্র তুর্কি রক্ষী সমেত যখন রাজপ্রাসাদের দ্বারে উপনিত হলেন তখন সারাদিন উপবাস করে বৃদ্ধ রাজা রায় লখমনিয়া মধ্যাহ্ন ভোজন করতে বসেছিলেন। সহসা প্রাসাদ দ্বারে এবং নগরের অভ্যন্তর থেকে তুমুল কলরব শোনা গেল। লখমনিয়া এই কলরবের প্রকৃত জানতে পারবার পূর্বেই বখতিয়ার সদলে রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে প্রবেশ করে রাজঅনুচরদের নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করলেন। মুহূর্তের মধ্যেই রাজপুরীর চতুর্দিক কাফের আর্যদের রক্ত রুধিরে রঞ্জিত হয়ে উঠল আর ছিন্নভিন্ন মরদেহের স্তূপে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। পুরুষ, নারী, বৃদ্ধ ও শিশু, বখতিয়ার ও তাঁর সাথিদের তরবারির তীক্ষ্ণ ফলার মারন আঘাত থেকে নিষ্কৃতি পেলো না রাজপুরীর কেউই। এদিকে বৃদ্ধ রাজা রায় লখমনিয়া সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। এই অবস্থায় তিনি তাঁর কয়েকজন বিশেষ অঙ্গরক্ষকদের পরামর্শ মেনে নগ্নপদে প্রাসাদের পশ্চাৎ দ্বার দিয়ে বাইরে বেরিয়ে নৌকোযোগে রাজপ্রাসাদের পশ্চাতের নদীপথে পলায়ন করতে বাধ্য হলেন। এবারে বখতিয়ারের সমুদয় সেনা নুদিয়ায় প্রবেশ করে কাফের আর্যদের ওই ধর্মীয় নগরী আর তার চতুশ পার্শ্ববর্তী স্থান সমূহ অধিকার করল এবং সেখানেই তুর্কিদের নয়া বসতি স্থাপন করল। ওদিকে রায় লখমনিয়া সঙ্কনাৎ ও পূর্ববঙ্গের অভিমুখে প্রস্থান করলেন। তথায় অল্পদিন পরেই তাঁর রাজ্যকাল শেষ হল এবং তাঁর বংশধরগণ এখনও বঙ্গদেশে রাজত্ব করছেন।

রায় লখমনিয়ার রাজধানি অধিকার করবার পর বখতিয়ার তাঁর তরবারির সাহায্যে নুদিয়াকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে কাফেরদের রক্তে স্নাত হয়ে ধ্বংসপ্রায় নুদিয়া ত্যাগ করে বর্তমানে যে স্থান লক্ষণাবতী নামে পরিচিত সেইখানে নিজের রাজধানি স্থাপন করলেন।"

এখানেই শেষ হয়েছে মিনহাজ-ই-সিরাজের বর্ণনা। বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক বাংলা জয় সম্বন্ধে যত কাহিনী ও মতবাদ প্রচলিত আছে সবই মিনহাজের উল্লিখিত বিবরণের উপর প্রতিষ্ঠিত। কারন এই বিষয়ে অন্য কোন সমসাময়িক হিন্দু বা জৈন ঐতিহাসিকের বিবরণ পাওয়া যায়নি। মিনহাজের বিবরণ সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক সত্য বলে কখনই গ্রহণযোগ্য নহে এবং তর্কের খাতিরে তা গ্রহন করলেও প্রচলিত বিশ্বাস অনেক পরিমাণে ভ্রান্ত বলেই প্রতিপন্ন হবে। প্রথমত "সপ্তদশ অশ্বারোহীর যবনের ডরে" কাপুরুষ লক্ষণ সেন তাঁর "সোনার বাংলা" রাজ্য বিসর্জন দিয়েছিলেন, কবিবর নবীনচন্দ্রের এই উক্তি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বখতিয়ার যখন নদীয়ার নগরদ্বারে উপস্থিত হয়েছিল তখন তিনি তুর্কি অশ্বারোহীর ছদ্মবেশে ছিলেন এবং ছদ্মবেশের প্রয়োজনেই সেই সময় তাঁর সাথে মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী সেনা ছিল। কিন্তু চতুর বখতিয়ার তাঁর অবশিষ্ট সেনাদের নদীয়া নগরের বাইরেই লুকিয়ে রেখেছিল। তাদের কাছে নির্দেশ ছিল সঙ্কেত পাওয়া মাত্রই সদলবলে অরক্ষিত নদীয়া নগরে সশস্ত্রে ঝাঁপিয়ে পরে কাফের হত্যালিলায় যোগদান করবার। সম্ভবত লক্ষণ সেনের রাজদরবারের কোন বিশ্বাসঘাতক ব্রাহ্মণ বা কৈবর্ত শূদ্র গুপ্তচরের নিকট থেকে থেকে বখতিয়ার আগে থেকেই সংবাদ পেয়েছিলেন যে সেদিন এক বিশেষ ধর্মীয় উৎসবের কারনে রাজা সহ রাজপুরীর অধিকাংশ রক্ষীরা নিরস্ত্র থাকবে। এর ফলে বখতিয়ার তাঁর ১৮ জন তুর্কি সেনা সমেত নির্ভয়ে রাজপ্রাসাদে যায়, নিজেদের তুর্কি অশ্বারোহীর পরিচয় দিয়ে রাজার সাথে সাক্ষাৎ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করে, এবং প্রাসাদের রক্ষীরাও কোনরূপ সন্দেহ প্রকাশ না করেই তাঁদের প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ কবার অনুমতি দেয়। প্রাসাদে প্রবেশ করেই বখতিয়ার ও তাঁর সেনারা স্বমূর্তি ধারন করে এবং নিজেদের অসি দিয়ে রাজপুরীর অভ্যন্তরে নির্বিচারে হত্যালিলা শুরু করে। এদিকে বখতিয়ার যখন রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রাসাদের রক্ষী আর দাসদাসীদের গনহত্যা করছিল ঠিক সেই সময়ই সঙ্কেত পেয়ে বখতিয়ারের অবশিষ্ট সেনাদল সদম্ভে "আল্লাহু আকবর" ধ্বনিতে চতুর্দিক কম্পিত করে অরক্ষিত নদীয়া নগরে প্রবেশ করে নিরস্ত্র ও অসহায় হিন্দু প্রজাদের নির্বিচারে নির্মমভাবে গনহত্যা শুরু করে। প্রাসাদের অন্দরমহলে মধ্যাহ্নভোজনে বসে বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেন মিনহাজ বর্ণিত যে বিশাল হইহট্টগোল শ্রবণ করেছিলেন সম্ভবত সেটা বখতিয়ারের অবশিষ্ট বিশাল তুর্কি সেনাদলের হাতে গনহত্যার শিকার তাঁরই রাজ্যের রাজধানির নিরীহ প্রজাদের আর্তনাদ ছিল। অতএব এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় রাজা লক্ষণ সেন যখন রাজপুরীর পশ্চাৎদ্বার দিয়ে নৌপথে পলায়ন করছিলেন তখন তাঁর পরিত্যাক্ত রাজধানি নদীয়াতে বহু তুর্কি সেনা উপস্থিত ছিল। এরপর বখতিয়ার আর তাঁর অবশিষ্ট সেনারা যখন নদীয়ার চকে একসাথে মিলিত হল তখনই বখতিয়ারের নদীয়া বিজয় সম্পন্ন হয়েছিল। বলাই বাহুল্য বখতিয়ারের সেদিনের এই ঘৃণ্য ও কাপুরুষোচিত অভিযানে কেবলমাত্র নদীয়া নগরীই অধিকৃত হয়েছিল। সমস্ত বঙ্গদেশ তো দুরস্ত, গৌড়ের আর কোন অংশই সেদিন বখতিয়ার কর্তৃক বিজিত হয়নি।

যখন তুর্কি আক্রমণের আশঙ্কায় ভীত ও সন্ত্রস্ত নদীয়ার অধিবাসীরা সারা বছর ধরে রাজ্যের অন্যত্র অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত স্থানে পলায়ন করতে ব্যস্ত ছিল তখনও কিন্তু এই অশীতিপর বৃদ্ধ সেন রাজা তাঁর মন্ত্রী, দৈবজ্ঞ আর সভাসদ পণ্ডিতগণের যাবতীয় উপদেশ ও পরামর্শ অগ্রাহ্য করে নিজ রাজধানি নদীয়াতেই উবস্থান করছিলেন। সুতরাং এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় প্রজাবর্গ ও সভাসদদের থেকে রাজার সাহস ও শৌর্য অধিক বেশি পরিমানেই ছিল। যখন বিশ্বাসঘাতকদের সহায়তায় ও রক্ষীগণের মূর্খতায় তুর্কি হত্যাকারী দস্যুরা বিনাবাধায় রাজার প্রাসাদে অনুপ্রবেশ করে অতর্কিতে আক্রমন ও গনহত্যা শুরু করল তখন অতর্কিত আক্রমনে বিধ্বস্ত ও নিরস্ত্র বৃদ্ধ রাজার কাছে পরে পুনরায় সেনা সজ্জিত করে তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের পরাজিত করে নিজ রাজ্য থেকে বিতাড়িত করবার জন্য তখন পলায়ন করা ছাড়া আর কোন ভিন্ন উপায়ও ছিল না। সুতরাং এই পলায়নকে কোনমতেই কাপুরুষতা বলা উচিত নয়। দিল্লির রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের মত অতিরিক্ত সাহস প্রদর্শন করে পরাজয় আসন্ন উপলব্ধি করেও পলায়ন না করে তুর্কিদের হাতে বন্দি হয়ে অন্ধ হয়ে অসহায় মৃত্যুবরন করার মধ্যে কোন বীরত্ব নেই কিন্তু তারচেয়ে প্রান বাঁচিয়ে পলায়ন করে পরে আবার যুদ্ধ করা বহুগুন শ্রেয় ও সঠিক যুদ্ধনীতি।

শুধুমাত্র মিনহাজ-ই-সিরাজের বিবরণের উপর নির্ভর করে যারা লক্ষণ সেনের চরিত্রের দোষারোপ করেন তারা ভুলে যান যে মিনহাজ কিন্তু স্বয়ং লক্ষণ সেনের বহু সুখ্যাতি করেছেন। এই তুর্কি লেখক লক্ষণ সেনকে হিন্দুস্থানের "রায়গণের পুরুষানুক্রমিক খলিফা স্থানীয়" বলে বর্ণনা করেছেন। এর অর্থ মিনহাজের মতে বঙ্গের রাজা লক্ষণ সেনই আর্যাবর্তের রাজাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। মিনহাজ, লক্ষণ সেনের সমসাময়িক পৃথ্বীরাজ আর জয়চাঁদ সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলেননি কিন্তু লক্ষণ সেনের জন্মকাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করে তাঁর দানশীলতার সুখ্যাতি আর শাসননীতির প্রশংসা করেছেন। এমনকি সাধারনত মুসলমান লেখকরা আরেকজন অমুসলমান সম্বন্ধে যে প্রকার উক্তি করেন না, তিনি লক্ষণ সেন সম্বন্ধে তাও করেছেন। মিনহাজ তাঁকে "সুলতান-এ-করিম-কুতুবউদ্দিন-হাতেমুজ্জমান" আখ্যা দিয়ে সেই কালের হাতেম কুতুবউদ্দিনের সাথে তুলনা করেছেন এবং আল্লার নিকট প্রার্থনা জানিয়েছেন যেন তিনি পরলোকে কাফের লক্ষণ সেনের শাস্তি (যা অমুসলমান হলেই প্রাপ্য) লাঘব করেন। সুতরাং মিনহাজের পূর্ববর্তী বক্তব্যগুলো যারা এর আগে সত্য বলে ধরে নিয়েছেন তারা যদি মিনহাজের এই বক্তব্যগুলোও সত্য বলে মেনে নেন তাহলে লক্ষণ সেনের চরিত্র ও খ্যাতি সম্বন্ধে উচ্চ ধারনাই পোষণ করতে হয়। বখতিয়ার কর্তৃক নদীয়া অধিকারের জন্য যে বৃদ্ধ রাজার চেয়ে তাঁর সভাকক্ষের বিশ্বাসঘাতক কিছু মন্ত্রীরা, বিদ্রোহী কৈবর্ত আর তাঁর সেনাবাহিনী অধিকতর দায়ি সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। যিনি আকৌমার যুদ্ধক্ষেত্রে শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়েছেন। গৌড়, কামরূপ, কলিঙ্গ, বারানসি ও প্রয়াগে যার বীরত্বের খ্যাতি বিস্তৃত হয়েছিল মিনহাজের লেখনী তাঁর স্বচ্ছ চরিত্রে কলঙ্ক ও কালিমা লেপন করার প্রয়াস মাত্র। মিনহাজের লেখা বখতিয়ারের নদীয়া অভিযানের কাহিনী সম্পূর্ণরূপে সত্যি বলে গ্রহন করা মূর্খতারই পরিচয় মাত্র। যে বিশ্বাসী ব্যক্তিগন মিনহাজকে সংবাদের জোগান দিয়েছিল তাদের জ্ঞান-বুদ্ধিও কতদূর ছিল তা মিনহাজ বর্ণিত লক্ষণ সেনের অদ্ভুত জন্ম বিবরণ ও তাঁর ৮০ বছরের রাজত্বকালের কথা থেকেই বোঝা যায়। বিশেষত এই কাহিনীর মধ্যে অনেক সুপরিচিত প্রবাদ, কথা ও অবিশ্বাস্য সব ঘটনার সমাবেশ আছে। "তুর্কি আক্রমন সম্বন্ধে হিন্দুর শাস্ত্রবাণী" চচনামা নামক গ্রন্থে সিন্ধুদেশের নামও উল্লিখিত হয়েছে। এই শাস্ত্রবাণীর মূল্য যাই হোক না কেন, এতে প্রমানিত হয় যে নদীয়া আক্রমনকালের অন্তত এক বছর পূর্ব থেকেই নদীয়াতে তুর্কি হামলার সম্ভবনা সম্বন্ধে বাংলার রাজকর্মচারীরা জ্ঞাত ছিলেন। অথচ বখতিয়ার বিহার অধিকার করল তারপর নালন্দা, বিক্রমশীলা, ঔদন্তপুরী সহ একাধিক বৌদ্ধ মঠ আর বিদ্যালয়গুলি ধ্বংস আর লুণ্ঠন করতে করতে বিহার থেকে ঝাড়খণ্ড হয়ে নদীয়া পৌঁছলেন, এর মধ্যে বখতিয়ারের এই অভিযানের কোন সংবাদ সেন রাজদরবারে পৌঁছল না ? যে সময়ে তুর্কি আগ্রাসনকারীদের হাতে সমগ্র ভারতবর্ষ আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা প্রবল সে সময় রাজধানির দ্বাররক্ষীরা ১৮ জন সশস্ত্র তুর্কি অশ্বারোহীকে বিনাবাধায় নগরে প্রবেশ করতে দিল এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ও বর্ম পরিহিত সেই ১৮ জন তুর্কি অশ্বারোহীকে অশ্বব্যবসায়ী বলে ভ্রম করল ? নগর রক্ষীরা যদি কোনরূপ সন্দেহ নাও করে প্রাসাদরক্ষীরা কিভাবে প্রাসাদের অভ্যন্তরে ধর্মীয় উৎসবের কারনে স্বয়ং মহারাজ আর তাঁর দেহরক্ষীরা নিরস্ত্র রয়েছেন জেনেও এই ১৮ জন অস্ত্রধারী ও অজ্ঞাত পরিচয় তুর্কিদের বিনাবাধায় প্রবেশ করতে দিল ? নদীয়া নগরের কেউই এই সন্দেহভাজন তুর্কিদের গতিরোধ করে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে অগ্রসর হল না কেন ? স্বয়ং মহারাজ যখন নদীয়াতে অবস্থান করছিলেন তখন এটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে অন্তত একদল বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রক্ষী রাজা এবং রাজপরিবারের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করবার জন্য সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বখতিয়ারের বাহিনীর একজনের গায়েও বিন্দুমাত্র আঁচড় পর্যন্ত লাগল না। প্রথমে তারা বিনাবাধায় স্বচ্ছন্দে খোদ রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে রাজকর্মচারীদেরই গণহত্যাকাণ্ড আর লুণ্ঠন কার্য সম্পন্ন করল ? রাজা আর তাঁর সেনারা যদি ধর্মীয় উৎসবের কারনে নিরস্ত্রও থাকেন তবুও এই কথাটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা মনে করে তাঁদের বাহিনীর অস্ত্রভাণ্ডার নিকটবর্তী স্থানেই অবস্থিত ছিল। সুতরাং এইসব প্রশ্নের যথাযথ বাখ্যা না পাওয়া পর্যন্ত মিনহাজ-ই-সিরাজের লেখা বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয়ের কাহিনী এক অতিরঞ্জিত ও কাল্পনিক কাহিনী বলেই ধরে নিতে হবে, অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য মজবুত প্রমান ছাড়া যা সত্যি বলে মেনে নেওয়ার অর্থ গতমাসে মার্কিন মুলুকে ভিনগ্রহী এলিয়েন হামলার সংবাদ ও সেইসব এলিয়েনদের টাইম ট্র্যাভেলের কাহিনীও সত্য বলে মেনে নেওয়া। যে সাক্ষীর উপর নির্ভর করে গজনীর তুর্কি লেখক মিনহাজ-ই-সিরাজ এই অদ্ভুত কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন তা খুবই অকিঞ্চিৎকর। তুর্কি অধিকৃত লখনউের চক বাজারে এক অতিবৃদ্ধ তুর্কি সেনা মিনহাজকে তাদের নদীয়া বিজয়ের কাহিনী শুনিয়েছিল, ঠিক যেইরূপে পটলডাঙার টেনিদা, প্যালা, হাবুল আর ক্যাবলাকে তাঁর বিভিন্ন অভিযানের অতিরঞ্জিত কাহিনী শোনাত। নদীয়া অভিযান সম্বন্ধে কোন লিখিত বিবরণ বা শিলালিপির সন্ধান তিনি পাননি। যে বৃদ্ধ তুর্কি সেনা মিনহাজকে এই কাহিনী শুনিয়েছিল তার নিজেরও বখতিয়ারের নদীয়া অভিযান সম্বন্ধে কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল কিনা সেটাও প্রশ্নযোগ্য। কারন সেই বৃদ্ধ সেনার নদীয়া অভিযানের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকলে মিনহাজ নিশ্চয়ই তাঁর লেখায় সেসব উল্ল্যেখ করতেন। সুতরাং এই বৃদ্ধ তুর্কি সেনার মুখ নিঃসৃত কাহিনী যা পরে মিনহাজের কলমে তাবাকত-ই-নাসিরি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছিল তাকে সত্যি বলে মেনে নিলে পটলডাঙার টেনিদার প্রত্যেকটা অভিযানকেও সত্যি বলে মেনে নিতে হবে। যে সময়ে মিনহাজ তাঁর এই পুস্তক লিখেছিলেন সেই সময় অর্ধশতাব্দী যাবৎ তুর্কিদের রাজত্ব আর্যাবর্তে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং একে একে উত্তর, মধ্য ও পূর্ব ভারতের চৌহান, গাহারওয়াল, সোলাঙ্কি, পারমার, সেন, প্রভৃতি প্রাচীন হিন্দু রাজ্যগুলো বহিরাগত তুর্কি দস্যুদলের পদানত হয়েছে। বিজয়গর্বে দৃপ্ত, প্রভুত্ব ও ধর্মীয় জিহাদের উন্মাদনায় মত্ত বিজিত পরাধীন শতাব্দী প্রাচীন আর্যজাতির প্রতি হতশ্রদ্ধ সাধারণ তুর্কি সেনা অথবা মিনহাজ-ই-সিরাজের ন্যায় রাজপুরুষ যে নিজেদের অতিতের বিজয়কাহিনী অতিশয়োক্তি ও আলৌকিক কাহিনী দ্বারা অতিরঞ্জিত করবে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যপার। পরবর্তীকালেও মিনহাজের এই অতিরঞ্জিত কাহিনী অবলম্বন করে বাংলাদেশে এবং পাকিস্তানে বখতিয়ার খিলজির নদীয়া অভিযানের উউপর প্রচুর লেখা বেরিয়েছে। পরিশেষে এটা ধরে নেওয়া যথেষ্ট যুক্তি সম্মত হবে যে সম্ভবত গুপ্তচর মারফৎ ভুল সংবাদ পেয়ে বখতিয়ার খিলজি যখন তার তুর্কি দস্যুদের নিয়ে বঙ্গের রাজধানি নদীয়ার প্রান্তে পৌঁছেছিলেন তখন রাজা লক্ষণ সেন আগে থেকেই অন্য কোন কারনে সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন। রাজার অনুপস্থিতে নদীয়া নগরও স্বাভাবিক কারনেই প্রায় অরক্ষিতই ছিল। রাজাকে না পেয়ে ক্রোধন্মত্ত বখতিয়ার আর তার বাহিনী নদীয়াতে নিরীহ কাফেরদের গনহত্যা করে ও নগর লুণ্ঠন করে প্রস্থান করেছিল। নদীয়া সেইকালে সেন সাম্রাজ্যের প্রধান রাজধানি বা বিশেষ সুরক্ষিত কোন স্থান ছিল কিনা এতকাল পরে আজ আর তা নিশ্চিতভাবে জানবার কোন উপায়ই নেই। বখতিয়ার খিলজির অন্তিমলগ্নঃ ======================= যদুনাথ সরকার ও আরও নানান বরেণ্য ঐতিহাসিকদের মতে বঙ্গ বিজয়ের পর বখতিয়ার খিলজি প্রায় দশ হাজার তুর্কি সেনা সমেত উত্তরবঙ্গের মধ্যে দিয়ে তিব্বত লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। সম্ভবত বখতিয়ারের বাহিনীতে যোগদান করা ইসলাম ধর্মে সদ্য ধর্মান্তরিত কোন স্থানীয় হিন্দু বা বৌদ্ধের প্ররোচনার ফাঁদে পা দিয়ে বখতিয়ার তার প্রধান সেনাপতি আলি মরদান খিলজির হাতে সদ্য গঠিত রাজ্য শাসনের দায়িত্ব অর্পণ করে দিনাজপুর শহরের দশ মাইল দক্ষিণে দেবকোট থেকে বখতিয়ার প্রায় দশ হাজার অশ্বারোহী বাহিনী সমেত তিব্বতের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। এর পরবর্তী ইতিহাস তুর্কিদের পক্ষে শুধুই বিপর্যয়ের। সে যুগে তিস্তা নদীর আরেক নাম ছিল বাগমতি। সে নদি তখন ছিল যেমন চওড়া তেমনই খরস্রোতা। ঘোড়ায় চেপে তো বটেই এমনকি তৎকালীন যুগের নৌকোতে চেপেও সে নদি অতিক্রম করা ছিল প্রায় এক অসাধ্য ব্যপার। প্রায় দিন দশেক যাত্রা করবার পর এগারোতম দিনে এক প্রাচীন পাথুরে সেতুর সন্ধান পেল বখতিয়ার আর তার সেনাদল। বখতিয়ারের বাহিনীর অধিকাংশ রসদ এই যাত্রাপথেই প্রায় নিঃশেষিত হয়ে এসেছিল। এরপর বখতিয়ারের বাহিনী সমতল ভূমি ত্যাগ করে নেপালের পার্বত্য পথের চড়াই উৎরাই বেয়ে তিব্বতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। এইভাবে হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে চলার বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা না থাকা বখতিয়ার খহিলজি আর তার বাহিনী আরও ১৭-১৮ দিন যাত্রা করবার পর অবশেষে এক জনাকীর্ণ উপত্যকায় এসে উপস্থিত হয়। একদল বিদেশি আর বিধর্মী লুণ্ঠকদের আগমনবার্তা পেয়ে স্থানীয় তিব্বতি যোদ্ধারা সেদিনই গভীর রাতে বিশ্রামরত বখতিয়ার খিলজি আর তার বাহিনীর উপর আচমকা হামলা করে। সেই আক্রমনে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ও পরাজিত হয়ে বখতিয়ার তার তিব্বত অভিযান অসমাপ্ত রেখে অবশিষ্ট বাহিনী সমেত পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর তিব্বত আর নেপাল থেকে বঙ্গের দিকে ফিরতি পথে দেখা দেয় আরও ভয়াবহ বিপদ সমূহ। এমনিতেই তো তিব্বতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বখতিয়ারকে হারাতে হয়েছিল তার অধিকাংশ বাহিনী, তার উপর এবারে দেখা দিল সমূহ খাদ্যাভাব। খাদ্যের অভাবে বখতিয়ারের সেনারা তাদের প্রিয় তুর্কি অশ্বগুলিকেই মেরে আগুনে ঝলসে সেই মাংস ভক্ষণ করতে শুরু করল। এর ফলে কিছুদিনের মধ্যেই ফুড পয়জনিং এর প্রভাবে মারা পড়ল বখতিয়ারের আরও বেশকিছু সেনা। অবশেষে বহু কষ্ট সহ্য করে বখতিয়ার আর তার অবশিষ্ট বাহিনী যখন বাগমতি নদীর পারে পূর্বের সেই প্রস্তর নির্মিত সেতুর নিকটে এসে পৌঁছল তখন তারা মুখোমুখি হুল আরেক বিপর্যয়ের। বখতিয়ার সবিস্ময়ে লক্ষ্য করল যে কামরূপ রাজের নির্দেশে সেই প্রস্তর নির্মিত প্রাচীন সেতুটি ইতিমধ্যেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বখতিয়ারের অভিশপ্ত তিব্বত অভিযানে অংশগ্রহণকারী দশ হাজার তুর্কি বাহিনীর মধ্যে কেবলমাত্র একশো জন জীবিত অবস্থায় দেবকোটে প্রত্যাবর্তন করতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্তু ইতিমধ্যেই পেটের সমস্যা আর ভয়ানক পাহাড়ি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে স্বয়ং বখতিয়ার সহ তারা ছিল প্রায় মৃত্যু শয্যায়। বখতিয়ারের প্রত্যাবর্তন সংবাদ পেয়ে তার প্রধান সেনাপতি আলি মরদান এলেন মৃত্যু শয্যায় শায়িত বখতিয়ার খিলজির সাথে দেখা করতে। এলেন এবং তার তীক্ষ্ণ ছুরিকাঘাতে মুমূর্ষু বখতিয়ারকে খতম করে নিজে বখতিয়ারের যাবতীয় রাজপাট অবলীলাক্রমে অধিকার করে নিলেন। সেন রাজাদের তুর্কি বিরোধী অভিযানঃ ============================ এই প্রতিবেদনের প্রথম আর দ্বিতীয় পর্বেই উল্ল্যেখ করা হয়েছে যে লক্ষণ সেনের দুই সভাকবি উমাপতিধর ও শরণ রচিত কয়েকটি শ্লোকে এক রাজার বিজয়কাহিনীর উল্ল্যেখ আছে। শ্লোকগুলিতে রাজার নাম না থাকলেও লেখা আছে যে তিনি প্রাগজ্যোতিষ (কামরূপ), গৌড়, কলিঙ্গ, কাশী, মগধ প্রভৃতি জয় করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে চেদি ও ম্লেচ্ছরাজাকে পরাজিত করেছিলেন। ম্লেচ্ছ অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষায় বিধর্মী যবন। এখানে মনে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক কে এই ম্লেচ্ছ রাজা ? সেইকালে ম্লেচ্ছ বলতে তুর্কি হামলাকারী হওয়াটাই স্বাভাবিক। এবং এই সমুদয় শ্লোক যে রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবিরা তাদের বরেণ্য রাজা লক্ষণ সেনকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছেন তা অনায়াসে অনুমান করা যেতে পারে। সুতরাং অনান্য হিন্দু রাজাগণ ছাড়াও লক্ষণ সেন যে পরবর্তীকালে কোন ম্লেচ্ছ শাসককেও পরাজিত করেছিলেন এইরূপ অনুমান অসঙ্গত নয় মোটেই। রাজা লক্ষণ সেন আর তাঁর পুত্রদ্বয় ম্লেচ্ছ যবনদের বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধে যে জয়ী হয়েছিলেন সমসাময়িক তাম্রশাসন, শিলালিপি আর কবিতায় এর উল্ল্যেখও আছে। নদীয়া জয়ের ঠিক কতদিন পরে এবং কিভাবে বখতিয়ার খিলজি লক্ষণাবতীজয় করে সেখানে তার রাজধানি স্থাপন করেছিল মিনহাজের গ্রন্থে তার কোন উল্ল্যেখই নেই। কিন্তু একাধিক তাম্রশাসন আর শিলালিপি থেকে আজ এটা প্রমানিত যে তুর্কিদের তথকথিত নদীয়া জয়ের বহু বছর পর পর্যন্ত লক্ষণ সেন আর তাঁর বংশধররা বঙ্গে রাজত্ব করেছিলেন। ১২৫৫ খ্রিষ্টাব্দে মুঘিসুদ্দিন উজবেক নদীয়া জয়ের চিহ্নস্বরূপ যে নয়া মুদ্রার প্রচলন করে তা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমানিত হয় যে ১২৫৫ সালের পূর্বে নদীয়ায় তুর্কি শাসন স্থায়ীরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুতরাং এই তথ্য থেকে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে নদীয়া কিছুকাল বখতিয়ারের অধিকারে থাকলেও পরে লক্ষণ সেন নিজে বা তাঁর কোন পুত্র পুনরায় আক্রমন করে তুর্কিদের কাছ থেকে ফের মুক্ত করেন নদীয়া নগর। কিন্তু যেহেতু সেই সময় সদুর গজনী থেকে দিল্লি হয়ে বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল শক্তিশালী তুর্কি সাম্রাজ্য তাই পরবর্তীকালে তুর্কিদের পরাজিত করলেও এর চেয়ে আর বেশিদুর অগ্রসর হওয়াটা যুক্তিসঙ্গত মনে করেননি সেন সাম্রাজ্যের শাসকগণ। যখন দিল্লি সহ উত্তর ভারতের অধিকাংশ শক্তিশালী হিন্দু সাম্রাজ্যগুলো তুর্কিদের নিকট পদানত তখন অনেকটা মেবারের বীর রাজপুতগণের মতই বঙ্গের বীর সেন রাজারা ব্যাঘ্র বিক্রমে কিছুকালের জন্য হলেও বঙ্গের স্বাধীনটা রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তবে এই কথা বলাই বাহুল্য যে মেবারের বীর যোদ্ধাদের মত সেন রাজারা তুর্কিদের বিরুদ্ধে নিজ স্বাধীনতা রক্ষায় চূড়ান্ত সফলতা লাভ করেননি।

মোঙ্গলদের ভারত আক্রমণ ও ভারতের ইতিহাস

                     
ষোড়শ মহাজনপদ• ৭০০-৩০০খ্রীষ্টপূর্ব
• মগধ সাম্রাজ্য• ৫৪৫খ্রীষ্টপূর্ব
• মৌর্য সাম্রাজ্য• ৩২১-১৮৪খ্রীষ্টপূর্ব
মধ্যকালীন রাজ্যসমূহ২৫০খ্রীষ্টপূর্ব
• চোল সাম্রাজ্য• ২৫০খ্রীষ্টপূর্ব
• সাতবাহন সাম্রাজ্য• ২৩০খ্রীষ্টপূর্ব
• কুষাণ সাম্রাজ্য• ৬০-২৪০ খ্রীষ্টাব্দ
• বাকাটক সাম্রাজ্য• ২৫০-৫০০ খ্রীষ্টাব্দ
সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অধীনে গুপ্ত সাম্রাজ্য (৩৭৫-৪১৫ খ্রিষ্টাব্দ)


পাল সাম্রাজ্য• ৭৫০-১১৭৪ খ্রীষ্টাব্দ
 রাষ্ট্রকুট• ৭৫৩-৯৮২
-রাষ্ট্রকূট রাজবংশ হল খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ থেকে দশম শতাব্দীতে ভারতে রাজত্বকারী একটি রাজবংশ।ভারতের ইতিহাসে রাষ্ট্রকূট রাজবংশের উৎপত্তি একটি বিতর্কিত বিষয়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে রাষ্ট্রকূটদের আদিপুরুষদের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে রাষ্ট্রকূটদের বিভিন্ন গোষ্ঠী ছোটো ছোটো রাজ্য শাসন করত। এই রাষ্ট্রকূট গোষ্ঠীগুলি সঙ্গে সবচেয়ে বিখ্যাত রাজবংশ মান্যখেতের (অধুনা কর্ণাটক রাজ্যের গুলবার্গ জেলার মালখেদ অঞ্চল) রাষ্ট্রকূটদের সম্পর্ক নিয়েও বিতর্ক আছে।(Altekar (1934), pp1–32.. Reu (1933), pp6–9, pp47–53)
 রাষ্ট্রকূটদের সবচেয়ে পুরনো যে লেখটি এখনও পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে, সেটি হল সপ্তম শতাব্দীর। এই তাম্রলিপি থেকে জানা যায়, আধুনিক মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের মালওয়া অঞ্চলের মানপুর তাঁরা শাসন করতেন। অন্যান্য কয়েকটি লেখ থেকে সমসাময়িক আরও কয়েকটি রাষ্ট্রকূট শাসকগোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এঁরা হলেন অচলপুর (অধুনা মহারাষ্ট্র রাজ্যের এলিচপুর) ও কনৌজের রাজা। রাষ্ট্রকূটদের উৎপত্তি, আদি নিবাস ও ভাষা নিয়ে একাধিক বিতর্কিত মত প্রচলিত আছে।

প্রথম দিকের রাষ্ট্রকূট রাজারা ছিলেন হিন্দু। পরবর্তীকালে তাঁরা জৈনধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন।

রাষ্ট্রকূট শাসনকালে জৈন গণিতবিদ ও পণ্ডিতেরা কন্নড় ও সংস্কৃত ভাষায় বহু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা প্রথম অমোঘবর্ষ কবিরাজমার্গ নামে একটি বিখ্যাত কন্নড় গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। দ্রাবিড় স্থাপত্য রাষ্ট্রকূট রাজত্বে বিশেষ উন্নতি লাভ করেছিল। এই স্থাপত্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল ইলোরা গুহার কৈলাসনাথ মন্দির (অধুনা মহারাষ্ট্র রাজ্যে), কাশীবিশ্বনাথ মন্দির ও জৈন নারায়ণ মন্দির (অধুনা কর্ণাটক রাজ্যে)। এই সবকটিই এখন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।

ইলোরা কৈলাসনাথ মন্দির, মহারাষ্ট্র

রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল প্রায় সমগ্র কর্ণাটকমহারাষ্ট্র এবং অন্ধ্রপ্রদেশের কিছু অংশ। অন্ধ্রের ঐ অঞ্চলে রাষ্ট্রকূটদের ২০০ বছরের শাসন ছিল।সামানগড় তাম্রলিপি (৭৫৩) থেকে জানা যায়, বেরারের (অধুনা মহারাষ্ট্রের এলিচপুর) অচলপুরের সামন্ত রাজা দন্তিদূর্গ ৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে বাদামির চালুক্য রাজা দ্বিতীয় কীর্তিবর্মণকে পরাজিত করে চালুক্য সাম্রাজ্যের উত্তরাঞ্চল জয় করে নেন। পরে তিনি তাঁর শ্বশুর পল্লব রাজা নন্দীবর্মণকে চালুক্যদের হাত থেকে কাঞ্চী উদ্ধার করতে সাহায্য করেন। তিনি মালওয়ার গুর্জরদের পরাস্ত করেন এবং কলিঙ্গকোশল ও শ্রীশৈলম জয় করেন।
দাক্ষিণাত্যের স্থাপত্য ঐতিহ্যে রাষ্ট্রকূট রাজবংশের অবদান অপরিসীম।রাষ্ট্রকূটরা বৌদ্ধ গুহাগুলির সংস্কার করে প্রস্তরখোদিত বেদিগুলি পুনরায় উৎসর্গ করেন। প্রথম অমোঘবর্ষ ছিলেন জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষক। তাঁর রাজত্বকালে ইলোরায় পাঁচটি জৈন গুহামন্দির নির্মিত হয়েছিল। ইলোরায় রাষ্ট্রকূটদের সবচেয়ে বড়ো ও উল্লেখযোগ্য কীর্তিটি হল একশিলায় খোদিত কৈলাসনাথ মন্দির

'অষ্টম শতাব্দীতে মুহাম্মদ বিন কাশিমের মাধ্যমে ইসলামের ভারত বিজয়ের পর ভারতে ইসলামি সাম্রাজ্য শুরু হয়। ইসলামি সভ্যতা ভারতীয় উপমহাদেশের বেলুচিস্তান(পূর্বে মুলতান) এবং সিন্ধু অঞ্চলে উপস্থিত হয়। ইসলামি সভ্যতা আসার পর দশম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত দিল্লী সুলতান ও মুঘল সাম্রাজ্য উত্তর ভারতে শাসন করে।


 সুলতানী আমল• ১২০৬-১৫৯৬
দিল্লী সালতানাত বলতে মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনকালকে বুঝানো হয়। ১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতে রাজত্বকারী একাধিক মুসলিম রাজ্য ও সাম্রাজ্যগুলি দিল্লী সালতানাত নামে অভিহিত।( "Delhi sultanate | Muslim kingdom, India"। Encyclopedia Britannica (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০২-১৮। Schimmel, Annemarie (১৯৮০)। Islam in the Indian Subcontinent (ইংরেজি ভাষায়)। BRILL।আইএসবিএন 978-90-04-06117-0)
 এই সময় বিভিন্ন তুর্কি ও আফগান রাজবংশ দিল্লি শাসন করে। এই রাজ্য ও সাম্রাজ্যগুলি হল: মামলুক সুলতান (১২০৬-৯০)খিলজি রাজবংশ (১২৯০-১৩২০), তুঘলক রাজবংশ (১৩২০-১৪১৩), সৈয়দ রাজবংশ (১৪১৩-৫১) এবং লোদি রাজবংশ (১৪৫১-১৫২৬)।

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম বিজয় শুরু হয় প্রধানত ১২শ থেকে ১৬শ শতাব্দীতে। তবে ৮ম শতাব্দীতে মুসলমানেরা রাজপুত সাম্রাজ্যে (বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে) কিছু কিছু হামলা চালিয়েছিল। দিল্লি সালতানাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলাম উপমহাদেশের বড় অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজি বাংলা জয় করেন যা ছিল তৎকালে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে উত্তর প্রান্ত।

১৪ শতকে খিলজি বংশের, আলাউদ্দিন খিলজি তার সাম্রাজ্যের সীমানা দক্ষিণে গুজরাত,রাজস্থান ও দাক্ষিণাত্য মালভূমি এবং তুগলক রাজবংশ তাদের সীমানা তামিলনাড়ু পর্যন্ত বাড়ায়। কিন্তু দিল্লি সালতানাত ভেংগে গেলে ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে অনেক গুলো নতুন সালতানাতে আবির্ভাব ঘটে, যার মধ্যে গুজরাত সালতানাত, মালওয়া সালতানাত, তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাণিজ্য পথের অধিকারী বাংলা সালতানাত

মারাঠা সাম্রাজ্য ও ব্রিটিশ রাজত্বের পূর্বে মুসলিম মুঘল সাম্রাজ্য ভারতের অধিকাংশ রাজ্যকে দখল বা দমন করতে সক্ষম হয়। তবে কিছু প্রান্তিক রাজ্য তারা দখল করতে পারেনি, যেমন - হিমালয়ের উপরাংশে হিমাচল প্রদেশ, উত্তরখণ্ড, সিকিম, নেপাল ও ভুটান; দক্ষিণ ভারতে ট্রাভাঙ্কর ও তামিলনাড়ু এবং পূর্বে আসামের আহোম সাম্রাজ্য।আরব উপদ্বীপে ইসলামের উৎপত্তি ও বিস্তৃতির অল্পকালের মধ্যেই তা আরব বণিক, সুফি ও ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সমুদ্র-উপকূলবর্তী অঞ্চল সিন্ধ, বাংলা, গুজরাট, কেরালা এবং সিলনে। মুসলিমরা এসব স্থানে বসতি করেন এবং স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করেন। ৬৪৩ খ্রীষ্টাব্দে খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়ে আরব বিশ্ব প্রথম নৌপথে ভারত উপমহাদেশে আক্রমণ করে, স্থলপথে আক্রমণ করে তার অনেক পরে।

ছবিটা বদলে গেল সুলতান সবুক্তগীনের ভারত আক্রমণের (৯৮৬–৯৮৭) সমসময়ে, এবং আরও বেশি করে তাঁর পুত্র সুলতান মাহ্‌মুদের উপর্যুপরি ভারত-লুণ্ঠনে।সবুক্তগিন বা সেবুক তিগিন জন্ম ৯৪২ খ্রিস্টাব্দ (সম্ভবত) - মৃত্যু আগস্ট, ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন গজনভি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তার পুরো নাম ছিল আবু মনসুর সবুক্তগিন । ৯৭৭ থেকে ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেন। তার পুত্র ও উত্তরাধিকারী ছিলেন মাহমুদ গজনভি,ইয়ামিনউদ্দৌলা আবুল কাসিম মাহমুদ ইবনে সবুক্তগিন সাধারণভাবে মাহমুদ গজনভি;  ২ নভেম্বর ৯৭১ – ৩০ এপ্রিল ১০৩০), সুলতান মাহমুদ ও মাহমুদে জাবুলি বলে পরিচিত, ছিলেন গজনভি সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাসক।

পিতাসবুক্তগিন
ধর্মসুন্নি ইসলাম
সুলতান মাহমুদ ৯৭১ সালের নভেম্বরে বর্তমান আফগানিস্তানের (সাবেক জাবালিস্তান) গজনী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সবুক্তগীন ছিলেন তুর্কি ক্রীতদাস এবং সেনাপতি যিনি ৯৭৭ সালে গজনভী রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।খোরাসান এবং ট্রান্সঅক্সিয়ানার সামানি রাজবংশের প্রতিনিধি হিসেবে শাসনকাজ পরিচালনা করেন।

 যিনি গজনির সুলতান মামুদ নামে ইতিহাসে বিখ্যাত। নিজ শাসনামলে তিনি ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন।(T. A. Heathcote, The Military in British India: The Development of British Forces in South Asia:1600-1947, (Manchester University Press, 1995), 6.৯৯৭ থেকে ১০৩০ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পূর্ব ইরানিয় ভূমি এবং ভারত উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম অংশ (বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তান) জয় করেন। সুলতান মাহমুদ সাবেক প্রাদেশিক রাজধানী গজনিকে এক বৃহৎ সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধশালী রাজধানীতে পরিণত করেন। তার সাম্রাজ্য বর্তমান আফগানিস্তান, পূর্ব ইরান ও পাকিস্তানের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে ছিল।

১৮৪৮ সনে সুলতান মাহমুদ গজনবীর সমাধি

 দশম শতকে উত্তর-পশ্চিম ভারতের ছোট ছোট রাজ্যগুলির দুর্বলতার সুযোগে ভারতের সঞ্চিত ঐশ্বর্যের প্রলোভনে গজনীর সুলতান সবুক্তগীন পাঞ্জাবের শাহী রাজ্য আক্রমণ করেন। সবুক্তগীন বিশেষ সাফল্যলাভ না-করলেও ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর পুত্র সুলতান মামুদ ১০০০ থেকে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অন্তত সতেরো-বার ভারত আক্রমণ করেছিলেন। ১০০১ খ্রীষ্টাব্দে ভারতীয় হিন্দু রাজা জয়পাল পরাজিত হলেন; ১০২৫–২৬ খ্রিস্টাব্দে মামুদ সোমনাথের মন্দির লুণ্ঠনের জন্য দুবার অভিযান করেন। তবু উত্তর-পশ্চিম বাদে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে তখনও ইস্‌লাম ছায়াপাত করেনি। আরও প্রায় দু’শ বছর পরে গজনীর সুলতান মহম্মদ বিন সাম—যাঁর সহজ পরিচয় ‘মহম্মদ ঘোরী’, এলেন উপর্যুপরি ভারত-লুন্ঠনের ধারণা নিয়ে; ১১৯২ খ্রীষ্টাব্দে তরাই-এর যুদ্ধ থেকে দিল্লী অঞ্চলে হিন্দু রাজত্বের অবসান হল বলে ধরে নেওয়া যায়।

মুইজউদ্দিন মুহাম্মাদ , জন্মনাম শিহাবউদ্দিন (১১৪৯ – মার্চ ১৫, ১২০৬), (মুহাম্মাদ ঘুরি বলেও পরিচিত) ছিলেন ঘুরি সাম্রাজ্যের সুলতান। তার ভাই গিয়াসউদ্দিন মুহাম্মাদের সাথে তিনি ১১৭৩ থেকে ১২০২ পর্যন্ত শাসন করেন। এরপর ১২০২ থেকে ১২০৬ পর্যন্ত তিনি সর্বো‌চ্চ শাসক হিসেবে শাসন করেন।

মহম্মদ ঘোরীর হাতে চৌহান বংশীয় পৃথ্বীরাজ—যাঁর রাজধানী ছিল দিল্লির লাটকোট অঞ্চলেভারত জয় করে মহম্মদ ঘোরী কোন উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে যাননি। তাঁর কোন পুত্রসন্তান ছিল না।১২১০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি যখন নিহত হলেন তখন কির্মানের শাসনকর্তা তাজউদ্‌দীন য়ীলদিজ্ উঠে বসলেন গজনীর মসনদে এবং কুৎবউদ্‌দীন আইবক পেলেন ভারত শাসনের অধিকার।অচিরেই দুজনের সংঘাত বাধল এবং সে গৃহযুদ্ধে বিজয়ী হলেন কুৎবউদ্‌দীন। উঠে বসলেন গজনীর মসনদে।কুৎববউদ্‌দীন আইবক দিল্লীতে এসে নতুন বংশের প্রতিষ্ঠা করলেন—যার প্রচলিত নাম ‘দাস বংশ’

মামলুক সালতানাত
মামলুক সালতানাত ১২০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্য এশিয়ার তুর্কি সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবেক মামলুকদের উত্তর ভারতে নিয়ে আসেন। দিল্লি সালতানাত শাসনকারী পাঁচটি রাজবংশের মধ্যে মামলুক রাজবংশ প্রথম। এর শাসনকাল ছিল ১২০৬ থেকে ১২৯০ সাল পর্যন্ত। ঘুরি রাজবংশের প্রতিনিধি শাসক হিসেবে কুতুবুদ্দিন আইবেক ১১৯২ থেকে ১২০৬ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। এসময় তিনি গাঙ্গেয় অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেন এবং নতুন অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।

তৈমুর বিন তারাগাই বারলাস (১৩৩৬ - ফেব্রুয়ারি, ১৪০৫) ১৪শ শতকের একজন তুর্কী-মোঙ্গল সেনাধ্যক্ষতিনি পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজ দখলে এনে তৈমুরি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৩৭০ থেকে ১৪০৫ সাল পর্যন্ত নেতৃত্বে আসীন ছিল।

মামলুকরা ছিল ইসলাম গ্রহণকারী দাস বংশোদ্ভূত সৈনিক। ৯ম শতাব্দী থেকে এই ধারা শুরু হয়ে মামলুকরা ধীরে ধীরে শক্তিশালী সামরিক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। বিশেষত মিশর এবং এর পাশাপাশি লেভান্ট, ইরাক ও ভারতে মামলুকরা রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিল।

১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ ঘুরি নিহত হন।তার কোনো সন্তান না থাকায় তার সাম্রাজ্য বিভিন্ন সালতানাতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তার প্রাক্তন মামলুক সেনাপতিরা এসব সালতানাতের নেতৃত্ব লাভ করেন। তাজউদ্দিন ইলদিজ, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি, নাসিরউদ্দিন কাবাচা ও কুতুবউদ্দিন আইবেক যথাক্রমে গজনি, বাংলা, মুলতান ও দিল্লির শাসক হন। এর মাধ্যমে মামলুকদের শাসন শুরু হয়।

তার উচ্চপদস্থ মুইজউদ্দিন মুহাম্মদ নিহত হওয়ার পর আইবেক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। আইবেকের শাসন স্বল্পস্থায়ী ছিল। ১২১০ সালে তিনি মারা যান। তার ছেলে আরাম শাহ ক্ষমতা লাভ করেন। ১২১১ সালে তিনি ইলতুতমিশের হাতে নিহত হন।

ইলতুতমিশ তার সালতানাতের সাথে আব্বাসীয় খিলাফতের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি চেঙ্গিস খান ও তার বংশধরদের আক্রমণ থেকে ভারতকে রক্ষা করতে সফল হয়েছিলেন। গিয়াসউদ্দিন বলবন চাগতাই খানাত ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহীদের থেকে সালতানাতকে সুরক্ষিত করতে সফল হন।জালালউদ্দিন ফিরোজ খিলজি কর্তৃক সর্বশেষ মামলুক শাসক ও বলবনের নাতি মুইজউদিন কায়কোবাদ ক্ষমতাচ্যুত হলে খিলজি রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়।

জালালউদ্দিন খিলজি (শাসনকাল ১২৯০-১২৯৬; মৃত্যু ১৯শে জুলাই ১২৯৬) ছিলেন খিলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম সুলতান, এই বংশ ১২৯০ থেকে ১৩২০ সাল পর্যন্ত দিল্লির সুলতানি শাসন করেছিল। ফিরুজ নামে পরিচিত, জালালউদ্দিন মামলুক রাজবংশের আধিকারিক হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তিনি সুলতান মুইজউদ্দীন কায়কাবাদের রাজসভায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ অধিকার করেছিলেন। কায়কাবাদ পক্ষাঘাতগ্রস্থ হওয়ার পরে একদল গণ্যমান্য ব্যক্তি তাঁর নবজাত পুত্র শামসুদ্দীন কয়ুমারসকে নতুন সুলতান হিসাবে নিয়োগ করে জালালউদ্দিনকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। পরিবর্তে, জালালউদ্দিন তাদের হত্যা করে নিজে বকলমে শাসক হয়ে বসেছিলেন। কয়েক মাস পরে, তিনি কয়ুমারস কে সরিয়ে নিজে নতুন সুলতান হয়ে বসেন।জালালউদ্দিন খিলজি উপজাতির একজন তুর্ক মানুষ ছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা তুর্কিস্তান থেকে বর্তমান আফগানিস্তানে চলে এসেছিলেন, যেখানে তাঁরা ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হেলমান্দ এবং লাঘমান প্রদেশে বাস করছিলেন। তাঁরা সেখানে স্থানীয় আফগানদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আফগানিস্তানের রীতিনীতি ও আচার ব্যবহার গ্রহণ করেছিলেন। এ কারণেই, যখন তাঁর পরিবার ভারতে পাড়ি জমায়, তখন দিল্লির তুর্কি অভিজাতরা তাঁদের আফগান বলে মনে করেছিলেন। সিংহাসনে আরোহণের আগে জালালউদ্দিন পরিচিত ছিলেন মালিক ফিরুজ নামে। তিনি এবং তাঁর ভাই শিহাবুদ্দিন (আলাউদ্দিন খিলজির পিতা) বেশ কয়েক বছর ধরে দিল্লির সুলতান বলবনের সেবা করেছিলেন। ১২৮৭ সালে বলবনের মৃত্যুর পরে, দিল্লির কোতোয়াল মালিক আল-উমারা ফখরুদ্দিন, বলবনের কিশোর নাতি মুইজউদ্দিন কায়কাবাদকে (বা কায়কুবাদ) সরিয়ে সিংহাসন দখল করেন। কায়কাবাদ একজন দুর্বল শাসক ছিলেন, এবং প্রশাসন মূলত তাঁর আধিকারিক মালিক নিজামুদ্দিন পরিচালনা করতেন।

সুলতান হিসাবে, তিনি একটি মঙ্গোল আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন, এবং অনেক মঙ্গোলকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পরে ভারতে বসতি স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিলেন। মঙ্গলরা পাঁচবার ভারত আক্রমন করেছিল, ১২২১ সালে গ্রেট খান (চেঙ্গিস) তিনি ভারত সিমান্ত থেকে ফিরে যান জালাল উদ্দিন আত্মরক্ষার জন্য পাঞ্জাবে পালিয়ে যাওয়ায়, মোঙ্গলদের নীতি অনুযায়ী তারা সাম্রাজ্য সোজা বিস্তার করতো ও ১২৯২ সালে আব্দুল্লাহ তাকে পরাজিত করে আলাউদ্দিন খলজি ..১২৯৯সালে দবাখাঁ আবার কিন্তু জাফর খাঁ যুদ্ধে নিহত হন ও মঙ্গলদের বিতারিত করেন। ১৩০৫ সালে আলিবেগ কে গাজী মালিক প্রতিহত করে ১৩০৭ সালে ইকবাল মন্দ তা আলাউদ্দিন প্রতিহত করেছিল .., তা কোন বাহাদুরী নয় সে সময় মোঘল রা ভারতের নানা স্থানে শাসন করতো তাদের সাথে যুদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক.. কিন্তু তখন মোঙ্গলরা ওতো শক্তিশালী ছিল না কারন ১২৫৯ সালে মঙ্গু খানের মৃত্যু হয়। ১২৯৪ সালের মধ্যে তাদের সাম্রাজ্য চারভাগে বিভক্ত হয়- ১. ইউয়ান সাম্রাজ্য ২। চাগতাই খানাত ৩. সোনালি সাম্রাজ্য, ৪। ইলখানদের এলাকা।

মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে তাতার বাহিনী নামে পরিচিত ছিল মোঙ্গল বাহিনী। ১২০৬ সালে চেঙ্গিস খানকে মঙ্গোলিয়ার স্তেপের একচ্ছত্র অধিপতি বা গ্রেট খান হিসাবে ঘোষণা করার পর মোঙ্গল বাহিনী একে একে জয় করে নিয়েছিল এশিয়া ও ইউরোপ বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের মালিক ছিল মোঙ্গলরা। চেঙ্গিসখানের সময় থেকে শুরু হওয়া মোঙ্গলদের জয়যাত্রা অব্যাহত ছিল পরবর্তী গ্রেট খানদের সময়ও। ভাবতে অবাক লাগে ১২০৬ সাল থেকে ১২৬০ সাল এই অর্ধশত বছরে তাঁরা  একটি যুদ্ধেও হারেন নি। বাগদাদ, সমরখন্দ, বেইজিং, বুখারা, আলেপ্পোর মত বড় বড় শহর তাতারি হামলায় মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল। কি পূর্ব কি পশ্চিম এমন একটিও রাজ্য ছিলনা যারা মোঙ্গলদের গতি পথে বিন্দুমাত্র বাঁধা সৃষ্টি করতে পেরেছিল। বিশ্বজয়ের যে আকাঙ্খা অপূর্ণ রেখে মারা গিয়েছিলেন চেঙ্গিস খান, তার পুত্র ও পৌত্ররা সেইটার যেন সত্য করতে যাচ্ছিলেন। তাঁদের বর্বরতায় ইউরোপ ও এশিয়ার কোটি কোটি নিরীহ মানুষ প্রাণ দিয়েছ অনেকটা বিনা প্রতিরোধে। তাই সারা দুনিয়ার মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল মোঙ্গলদের  থামানো বোধ হয় অসম্ভব। কিন্তু ১২৬০ সালে হঠাৎই থেমে গেল অপ্রতিরোধ্য মোঙ্গলদের জয়রথ। এক অসাধ্য সাধন হল ফিলিস্তিনের গাজার অদূরে আইন জালুত প্রান্তরে। মোঙ্গল প্রথম পরাজয়ে সেই অবিশ্বাস্য কাহিনী নিয়ে লেখা হয়েছে এই প্রতিবেদনটি।


মোঙ্গলদের উত্থানের যুগে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো বেশ কয়েকটি ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন রাজ্যে বিভক্ত ছিল যেটা ইসলামের উত্থানের শুরু থেকে তখন পর্যন্ত ৬০০ বছরের ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। ইসলামী খিলাফত তখন আব্বাসীয়দের হাতে। নাম মাত্র আব্বাসীয় খলিফাদের রাজধানী ছিল বাগদাদে। খলিফা হারুন উর রশিদ, খলিফা মুহতাসিম বিল্লাহ কিংবা খলিফা মামুন, মনসুর ও মুন্তাসিরদের পরাক্রম তখন কেবলই কিংবন্তি। বাস্তবের আব্বাসীয় শাসকরা আধ্যাত্নিক কিংবা সামরিক কোন ক্ষেত্রেই পূর্বসুরীদের ধারের কাছেও ছিলেন না। আব্বাসীয় খিলাফত তখন অন্তর কোন্দল এবং ভোগবিলাসে মত্ত। এরকম অবস্থায় মোঙ্গলদের গ্রেট খান ছিলেন মঙ্গে খান। তাঁরই ভাই হালাকু তখন মধ্যপ্রাচ্যে মোঙ্গল বাহিনীর দায়িত্বে। বৌদ্ধধর্মে দিক্ষিত হালাকু খান ধর্মীয় কারণে সুনজরে দেখতেন না বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতকে। তার উপর আব্বাসীয় খিলাফিতের সঞ্চিত রাশি রাশি ধন ভান্ডার হালাকু খানকে প্ররোচিত করেছিল বাগদাদ আক্রমণে। হালাকু খানের আক্রমণে মাটির সাথে মিশে যায় বাগদাদ। ইতিহাসের নজিরবিহীন বর্বরতায় বাগদাদে প্রাণ হারান প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ।

শুধু বাগদাদ ধ্বংস করেই হালাকু খানের বাহিনী থেমে থাকেনি। ইরাক থেকে সিরিয়া হয়ে তাঁরা এগিয়ে চলছিলেন মিশরের দিকে। পথে সিরিয়ার দামেস্ক ও আলেপ্পোর পতন হয় তাঁদের হাতে। সেই শহরের মানুষগুলোকেও বরণ করতে হয়েছিল বাগদাদবাসীর মত ভয়াবহ পরিণতি। মোঙ্গলদের ভয়ে সিরিয়া থেকে পালিয়ে তখন দলে দলে মানুষ আশ্রয় নিচ্ছিল মিশরে। এদিকে হালাকুর পরবর্তী পরিকল্পনা ছিল মিশর দখল করা। কেননা তখনকার সময়ে মিশর জয় করার অর্থ সমগ্র উত্তর আফ্রিকা জয় করে ফেলা। আর উত্তর আফ্রিকা থেকে জিব্রাল্টার হয়ে একবার স্পেনে ঢোকার মানে হল নিমিষেই ইউরোপকে পদানত করা। সেটি করতে পারলেই পূর্ণ হবে পিতামহ চেঙ্গিসের বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন। তাই মোঙ্গলদের বিশ্ব জয়ের স্বপ্নে একমাত্র বাঁধা তখন মিশরের তরুণ মামলুক  সুলতান সাইফউদ্দিন কুতুজ।

মিশর আক্রমণ

সিরিয়া থেকে মিশর আক্রমণের পূর্বে হালাকু খান মোঙ্গলদের স্বভাব সুলভ “হয় আত্মসমর্পণ নয় ভয়াবহ মৃত্যু” এই হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠালেন মিশরের সুলতানের কাছে। সেই চিঠির ভাষা এতটাই ভয়ঙ্কর যে চিঠিটি প্রিয় পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে দেওয়া হল যাতে বোঝা যায় মোঙ্গলদের হুমকি আসলে কতটা পিলে চমকানো।

আমাদের তরবারির ভয়ে পালিয়ে যাওয়া মিশরের মামলুক সুলতান কুতুজের প্রতি পূর্ব ও পশ্চিমের সকল রাজার রাজাধিরাজ বিশ্বধিপতি খানের ফরমান–

“অন্যদেশগুলোর ভাগ্যে কী ঘটেছিল তোমার সেটা চিন্তা করে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করা উচিত। তুমি শুনেছ কীভাবে আমরা বিশাল বিশাল সাম্রাজ্য জয় করেছি এবং বিশৃখলাময় দূষিত পৃথিবীকে পরিশুদ্ধ করেছি। আমরা বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড জয় করে সেখানকার সব মানুষকে হত্যা করেছি। তাই আমাদের আতংকের হাত থেকে তুমিও পালিয়ে বাঁচতে পারবে না।

তুমি কোথায় লুকাবে? কোন রাস্তায় দিয়ে পালিয়ে যাবে? আমাদের ঘোড়াগুলো যেমন তেজী, আমাদের শরগুলোও তেমন তীক্ষ্ণ। আমাদের তরবারিগুলো বজ্রের মত আর আমাদের হৃদয় পর্বতের মত শক্ত। মরুবালুকার মত আমাদের সৈন্যসংখ্যাও গুণে শেষ করা যাবে না। না কোন দুর্গ আমাদের আটকাতে পারবে, না কোন সৈন্যদল পারবে আমাদের রুখতে। তোমার আল্লাহর কাছে তোমাদের ফরিয়াদ আমাদের বিরুদ্ধে কোন কাজেই আসবে না। কোন শোকের মাতম আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারবেনা, না অশ্রু গলাতে পারবে আমাদের মন। শুধু যারা প্রাণ ভিক্ষা চাইবে তারাই আমাদের হাত থেকে বাঁচতে পারবে।

যুদ্ধের দাবানল ছড়িয়ে পড়ার আগেই তোমার উত্তর পাঠিয়ে দিও। কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলে তার ফল হবে ভয়ঙ্করতম। আমরা তোমাদের মসজিদগুলো ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলব আর তোমাদের রবের দুর্বলতা সবার সমানে প্রকাশ করব তারপর তোমাদের শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাইকে হত্যা করব। মনে রেখ এই মুহুর্তে তোমরা আমদের একমাত্র শত্রু”।

সাইফউদ্দিন কুতুজ ভালভাবেই জানতেন ইতিপূর্বে যারা বিনা যুদ্ধে মোঙ্গলদের ভয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল তাঁদের কী করুণ পরিণতি হয়েছিল। তাই কাপুরুষের মত বিনা যুদ্ধে অপমানের সাথে মারা পড়ার চেয়ে তিনি চাইলেন এই বর্বর বাহিনীকে মোকাবেলা করতে। উপরে উল্লেখ করা চিঠির উত্তরটা সুলতান কুতুজ দিয়েছিলেন মোঙ্গল দূতের শিরশ্ছেদ করে। এর ফলাফলটা সকলের কাছেই নিশ্চয়ই অনুমেয়

অবধারিতভাবে বেঁধে গেল যুদ্ধ। সুলতান কুতুজ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মোঙ্গলদের মোকাবেলা করার। ঠিক সেই সময়ে মিশরে মস্ত বড় ইসলামিক স্কলার ছিলেন শেখ ইজ্জউদ্দিন আব্দুস সালাম । তিনি তার বক্তব্যে সুপষ্টভাবে সুলতান কুতুজের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানালেন এবং জনগণকে দলে দলে কুতুজের বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আহ্বান করলেন। এছাড়া সিরিয়া থেকে আরেক কিংবদন্তী কমান্ডার জহির উদ্দিন বাইবার্স কুতুজের সাথে যোগ দিলেন। এদিকে যাত্রা পথে হালাকু খবর পেলেন তাঁর ভাই গ্রেট খান মঙ্গে মারা গেছেন। তাই ৬ লক্ষ সৈন্যের প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ নিজের সাথে নিয়ে তিনি মংগোলিয়া ফিরে গেলেন গ্রেট খানের শেষকৃত্যে যোগ দিতে। বাকিদের তিনি রেখে গেলেন তাঁর বিশ্বস্ত ও দক্ষ সেনাপতি কিতবুকার অধীনে মিশর আক্রমণের জন্য।

যুদ্ধের অসাধারণ কৌশল

দুর্ধর্ষ মোঙ্গল বাহিনীর মূল শক্তি ছিল তাঁদের ক্ষিপ্রতা এবং দ্রুতগামী ঘোড়াগুলো। এছাড়া ঘোড়ার উপর থেকে তীর ছুড়ে মারার বিশেষ দক্ষতা ছিল তাঁদের যা ইউরোপ ও এশিয়ার সেনাবাহিনীগুলোর ছিলনা। মোঙ্গল ধনুকগুলো ছিল হালকা কিন্তু অসম্ভব শক্তিশালী।  হালকা কিন্তু পাল্লা বেশী হওয়ায় ঘোড়ার উপর চড়েও ব্যবহার যেত ধনুকগুলো।

মোঙ্গলরাদের আরেকটি স্ট্র্যাটেজি ছিল পর পর অনেকগুলো সারিতে বিন্যস্ত না হয়েই যতটা সম্ভব পাশাপাশি দাড়িয়ে হামলা চালানো যাতে সুযোগ বুঝে শত্রু বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা যায়। সুলতান কুতুজ বুঝতে পারলেন চওড়া প্রান্তরে মোঙ্গলদের মুখোমুখি হওয়া মানে সাক্ষাৎ ধ্বংস ঢেকে আনা। তিনি মোঙ্গলদের আগে যুদ্ধ ক্ষেত্র পছন্দ করার সুযোগই দিতে চাইলেন না বরং নিজেই সৈন্য নিয়ে এগিয়ে গেলেন তাঁদের মোকাবেলা করার জন্য এবং বেছে নিলেন ফিলিস্তিনের তাবারিয়ার আইনজালুত প্রান্তর।আইন জালুত প্রান্তরটি এর আগে থেকেই ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত। কারণ ওল্ড টেস্টামেন্টে ডেভিড ও গোলিয়াথের যে যুদ্ধের কথা বলা আছে সেটাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই প্রান্তরেই।

কুতুজ শুরুতেই তার সব সৈন্যদের দিয়ে আক্রমণ করালেন না বরং প্রথমে ছোট একটি দল পাঠিয়ে মোঙ্গল প্ররোচিত করলেন আগে হামলা করার। শুধু তাই নয় তিনি জানতেন তাঁর সিরীয় সৈন্যরা আগেও একবার মোঙ্গলদের কাছে হেরে পালিয়ে এসেছে তাই বিপদে পড়লে এরা আবারও পালাবে। যাতে পালাতে না পারে সেজন্য তিনি এদের রাখলেন সবার সামনে।

যুদ্ধের বর্ণনা

শুরুতে মোঙ্গলদের প্রবল আক্রমণের মুখে কুতুজের সৈন্যদের অবস্থা  ছিল টালমাটাল। তখন সুলতান নিজে শিরস্ত্রাণ খুলে উঁচু জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সৈন্যদের সাহস যোগালেন আর নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন সাধারণ সৈন্যদের মাঝে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য। যেহেতু প্রান্তরটি সরু তাই মোঙ্গলরা তাঁদের পুরনো সেই ট্যাক্টিক্স ব্যবহার করতে পারলনা। উপরন্তু সিরীয় সৈন্যদের ভেদকরে কুতুজের ব্যূহের ভেতরে প্রবেশ করার পর তারা মুখোমুখি হল কুতুজের এলিট বাহিনীর। এদিকে সামনের সারির সিরীয় সৈন্যদের জন্য তাঁরা পিছিয়েও আসতে পারছিলনা। সাথে সাথে দুই পাশ থেকে মোঙ্গলদের উপর নেমে আসল তীর বৃষ্টি। এক পর্যায়ে তাঁদের সেনাপতি কিতবুকা মারা যান। তারপরই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে মোঙ্গল সেনাবাহিনী। পালিয়ে যেতে থাকে দিগ্বিদিক বিক্ষিপ্ত মোঙ্গলরা। কুতুজের সৈন্যরা প্রায় ৬০০ কিলোমিটার তাড়িয়ে শেষ হানাদার সৈন্যটিকেও হত্যা করে। এভাবেই মামলুক সৈন্যদের কাছে পরাজয় ঘটে অহংকারী, বর্বর ও জালিম হালাকু বাহিনীর। নিমিষেই চূর্ণ হয়ে যায় তাঁদের আকাশছোঁয়া দম্ভ।

কেন আইন জালুতের যুদ্ধ এত গুরুত্বপূর্ণ

আইনজালুতের ঐতিহাসিক প্রান্তরে অবসান হয় মোঙ্গলদের অপরাজেয় মিথের। তাঁদের ভয়ে স্বদেশ থেকে পালিয়ে যেতে থাকা হাজার হাজার মানুষ একে একে আবার ফিরে আসতে শুরু করল। এই পরাজয়ের পরও মোঙ্গলরা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল কিন্তু আর কখনই আগের মত সেই মনোবল ফিরে পায়নি তারা। শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নয় পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটি হল আইন জালুতের যুদ্ধ কেননা এই যুদ্ধে সুলতান কুতুজ হেরে গেল উত্তর আফ্রিকা, স্পেন ও ইউরোপ পরিণত হত বাগদাদ, সমরখন্দ ও বেইজিং এর মত বধ্যভুমিতে। আদৌ মানব সভ্যতার ঐ ক্ষত সেরে উঠত কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। তবে বর্বর মোঙ্গল বাহিনীকে রুখে দেওয়ার অনন্য কীর্তির প্রতিদান হিসাবে যে বিশ্ববাসী চিরকাল সুলতান সাইফউদ্দিন কুতুজকে মনে রাখবে সেটা বলে দেওয়া যায় নিঃসন্দেহে।সে সময় মোঘল রা ভারতের নানা স্থানে শাসন করতো তাদের সাথে যুদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক.. কিন্তু তখন মোঙ্গলরা ওতো শক্তিশালী ছিল না কারন ১২৫৯ সালে মঙ্গু খানের মৃত্যু হয়। ১২৯৪ সালের মধ্যে তাদের সাম্রাজ্য চারভাগে বিভক্ত হয়- ১. ইউয়ান সাম্রাজ্য ২। চাগতাই খানাত ৩. সোনালি সাম্রাজ্য, ৪। ইলখানদের এলাকা।

দাক্ষিনাত্যের সুলতান ১৪৯০-১৫৯৬
হৈসল সাম্রাজ্য১০৪০-১৩৪৬
কাকতীয় সাম্রাজ্য১০৮৩-১৩২৩
আহমন সাম্রাজ্য১২২৮-১৮২৬
বিজয়নগর সাম্রাজ্য১৩৩৬-১৬৪৬
মুঘল সাম্রাজ্য১৫২৬-১৮৫৮
পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইবরাহিম লোদির বিরুদ্ধে বাবরের জয়ের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। মির্জা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর সাধারণত বাবরবাবুর নামেই বেশি পরিচিত (ফেব্রুয়ারি ১৪, ১৪৮৩ - ডিসেম্বর ২৬, ১৫৩০) 
রাজত্বকাল২৭শে এপ্রিল ১৫২৬– ৫ই জানুয়ারি ১৫৩১
বাবর একজন গোঁড়া সুন্নি মুসলিম ছিল। সে তার শিয়া মুসলিমদের অপছন্দ করাকে কখনও কখনও ব্যক্ত করেছিল " তাদের বিচ্যুতি " বলে ।যদিও ধর্ম বাবরের জীবনের এক প্রধান স্থান ছিল এবং তার সহযোগী রাজারা ইসলামকে হালকা ভাবে গ্রহণ করেছিল। বাবর তার সমকালীন এক কবির কবিতার একটি লাইন প্রায় উদ্ধৃত করতেন:" আমি মাতাল, আধিকারিক।আমাকে শাস্তি দিন যখন আমি সংযমি। " বাবরের সহযোগী রাজারা মদ পান করতেন এবং প্রাচুর্য্য পূর্ণ ভাবে জীবন যাপন করতেন, তারা বাজারের ছেলের সঙ্গে প্রেমে পড়েছিল এবং তারা হিংস্র এবং নির্মম ছিলেন।বাবরের এক কাকার মতে "অধর্ম এবং পাপকার্জে সে আসক্ত হয়েছিল। সে সমকামিতেও আসক্ত হয়ে পড়েছিল। তার এলাকাতে, যখনই শান্ত কোনো যুবক তার সামনে এসেছে, তাকে পাবার জন্য সে সবকিছু সে করেছিল। তার সময় এই ধরনের সমকামিতা প্রচলিত ছিল এবং সেটা একটি গুণহিসাবে বিবেচনা করা হোতো। । " সে তার মৃত্যূর দুই বছর আগে সুরাপান ত্যাগ করেছিলেন এবং তিনি তার রাজসভায় সকলকে একই কাজ করার দাবী করেছিলেন। কিন্তু সে নিজে আফিং এর নেশা ছাড়তে পারেননি।এবং তার কি বোধ হারানি। বাবর লিখেছিলেন: " সবাই সুরাপান পছন্দ করে ,পান করার জন্য শপথ নেয়,আমি শপথ নিয়েছিলাম এবং অনুতাপ করেছিলাম। "

আবু সা'ইদ ছিলেন তাইমুরের বড় নাতী,মিরান শাহ'র নাতী এবং উলুঘ বেগের ভাগ্নে। তিনি ছিলেন তার ছেলে উমার শেখ মির্জার পুত্র দক্ষিণ এশিয়ায় মুঘল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের দাদা।

                                                                তৈমুরের মৃত্যুকালে তৈমুরি সাম্রাজ্য (১৪০৫)

উমর শেখ মির্জা (১৪৫৬-১৪৯৪ খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত তিনি ফরগনার শাসক ছিলেন। তিনি তৈমুরী সাম্রাজ্যের সুলতান আবু সাঈদ মির্জার চতুর্থ পুত্র ছিলেন তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য ভাগ হয়ে যায় তার চার পুত্রের মধ্যে। তৈমুরী সাম্রাজ্যের কাজাখস্তান এর দ্বায়িত্ব পান ওমর সাঈখ মির্জা , উজবেকিস্তান, ইরান এবং আফগানিস্তান প্রদেশ ছিলো অন্যান্য ভাইদের কাছে। তার প্রথম স্ত্রী ও প্রধান রানী ছিল কুতলুগ নিগার খানম, তিনি ছিলেন চাগাতাই খানাতে রাজকুমারী এবং মঙ্গলীয় শাসক ইউনূস খান এর কন্যা। উমর আরো দুই স্ত্রী ও তিন পুত্র ছিলো ও পাঁচ কন্যা তার স্ত্রী কুতলগ নিগার খানম এর কাছে প্রথম সন্তান হয়েছিল তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মির্জা বাবর তার স্ত্রীদের থেকে কুতলগ নিগার খানম অন্য দুই স্ত্রীর মাধ্যমে দুই সন্তান ছিল, তারা হলো জাহাঙ্গীর মির্জা  নাসির মির্জা তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মির্জা বাবর ভারতভর্ষে ১৫২৫সনে মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন।

তিনি মধ্য এশিয়ার মুসলমান সম্রাট ছিলেন। তার জন্ম উজবেকিস্তান। তিনি ভারত উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট। তিনি তৈমুর লঙ্গ-এর সরাসরি বংশধর এবং মাতার দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। তিনি মির্জা ওমর সাঈখ বেগ এর পুত্র, এবংতৈমুরী শাসক উলুগ বেগ এর প্রপৌত্র ছিলেন। তিনি পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লীর লোদি রাজবংশের সুলতান ইবরাহিম লোদিকে পরাজিত করে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র মির্জা হুমায়ুন সিংহাসনে আরোহণ করেন। পানি পথের যুদ্ধে তিনিই প্রথম কামানের ব্যবহার করেন। তার প্রখর রণকৌশলের কাছে হার মানে ইবরাহিম লোদি।জহির উদ্দিন মোহাম্মদ জন্মেছিলেন ১৪৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ফারগানা প্রদেশের আনদিজান শহরে। ফারগানা বর্তমানে উজবেকিস্তান নামে পরিচিত। তিনি ফারগানা প্রদেশের শাসনকর্তা ওমর মির্জার বড় পুত্র ছিলেন। তার স্ত্রী কুতলুক নিগার আনাম ইউনূস খান এর কন্যা ছিলেন। মঙ্গলদের থেকে উদ্ধুত বারলাস উপজাতিতে বেড়ে উঠলেও বাবরের জাতিতে তুর্কি ও পারস্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ছিল।
এই অঞ্চলগুলো পরবর্তীতে ইসলামিক জাতিতে পরিণত হয় এবং তুরক এস্থান এবং খোরাসান নামে পরিচিত লাভ করে বাবরের মাতৃভাষা ছিল চাঘাতাই যা তার কাছে তুর্কি ভাষা নামে পরিচিত ছিল।
মুঘল সম্রাটরা ছিলেন মধ্য এশিয়ার টার্কো-মঙ্গোল বংশোদ্ভূত। তারা চাগতাই খান ও তৈমুরের মাধ্যমে চেঙ্গিস খানের বংশধর। ১৫৫৬ সালে আকবরের ক্ষমতারোহণের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্রূপদী যুগ শুরু হয়। আকবর ও তারছেলে জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ভারতে অর্থনৈতিক প্রগতি বহুদূর অগ্রসর হয়।


মারাঠা সাম্রাজ্য১৬৭৪-১৮১৮
শিখ রাষ্ট্র১৭১৬-১৮৪৯
শিখ সাম্রাজ্য১৭৯৯-১৮৪৯
ব্রিটিশ ভারত১৮৫৮–১৯৪৭
ভারত ভাগ১৯৪৭–বর্তমান

মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বো‌চ্চ সীমানা, (১৭০৭ সালে)

পোর্ট্রে‌টঅলংকারিক নামজন্ম নামজন্মশাসনকালমৃত্যুটীকা
Babur of India.jpgবাবর
بابر
জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ
ظہیر الدین محمد
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৪৮৩৩০ এপ্রিল ১৫২৬ – ২৬ ডিসেম্বর ১৫৩০২৬ ডিসেম্বর ১৫৩০ (৪৭ বছর)বাবা ও মায়ের দিক থেকে যথাক্রমে তৈমুর লং ও চেঙ্গিস খানের বংশধর। বাবর মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
Humayun of India.jpgহুমায়ুন
ہمایوں
নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন
نصیر الدین محمد ہمایوں
১৭ মার্চ ১৫০৮২৬ ডিসেম্বর ১৫৩০ – ১৭ মে ১৫৪০ এবং ২২ ফেব্রুয়ারি ১৫৫৫ - ২৭ জানুয়ারি ১৫৫৬২৭ জানুয়ারি ১৫৫৬ (৪৭ বছর)সুরি সম্রাট শের শাহ সুরির হাতে ক্ষমতাচ্যুত হন। ১৫৫৫ সালে পুনরায় ক্ষমতাদখলে সক্ষম হন। এর অল্পকাল পর দুর্ঘটনায় মারা যান।
Akbar Shah I of India.jpgআকবর-এ-আজম
اکبر اعظم
জালালউদ্দিন মুহাম্মদ
جلال الدین محمد اکبر
১৪ অক্টোবর ১৫৪২২৭ জানুয়ারি ১৫৫৬ – ২৭ অক্টোবর ১৬০৫২৭ অক্টোবর ১৬০৫ (৬৩ বছর)আকবর ও বৈরাম খান পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করেন। চিতোরগড় অবরোধে আকবর সফল হন। আকবর সাম্রাজ্যকে বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন এবং মুঘল শাসকদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিবেচিত হন। রাজপুত রাজকন্যা মরিয়ম উজ জামানিকে আকবর বিয়ে করেছিলেন। লাহোর দুর্গ আকবরের সময় নির্মিত অন্যতম বিখ্যাত স্থাপনা।তিনি দ্বীন-ই-ইলাহি ধর্মের প্রবর্তক।
Jahangir of India.jpgজাহাঙ্গীর
جہانگیر
নুরউদ্দিন মুহাম্মদ সেলিম
نور الدین محمد سلیم
২০ সেপ্টেম্বর ১৫৬৯১৫ অক্টোবর ১৬০৫ – ৮ নভেম্বর ১৬২৭৮ নভেম্বর ১৬২৭ (৫৮ বছর)মুঘল সম্রাটদের মধ্যে জাহাঙ্গীর সর্বপ্রথম পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি মদ্যপ ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়। তার স্ত্রী সম্রাজ্ঞী নূর জাহান এসময় মূল ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেন।
Shah Jahan I of India.jpgশাহজাহান-এ-আজম
شاہ جہان اعظم
শাহাবউদিন মুহাম্মদ খুররম
شہاب الدین محمد خرم
৫ জানুয়ারি ১৫৯২৮ নভেম্বর ১৬২৭ – ২ আগস্ট ১৬৫৮২২ জানুয়ারি ১৬৬৬ (৭৪ বছর)শাহজাহানের যুগে মুঘল শিল্প ও স্থাপত্য সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌছায়। তিনি তাজমহলদিল্লি জামে মসজিদলালকেল্লাজাহাঙ্গীরের মাজারশালিমার বাগান নির্মাণ করেছেন।
Alamgir I of India.jpgআলমগীর
عالمگیر
মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব
محی الدین محمداورنگزیب
৪ নভেম্বর ১৬১৮৩১ জুলাই ১৬৫৮ – ৩ মার্চ ১৭০৭৩ মার্চ ১৭০৭ (৮৮ বছর)আওরঙ্গজেব শরিয়া আইনের প্রচলন পুনরায় শুরু করেন। ফতোয়া-ই-আলমগীরি নামক আইন সংকলন তার সময় প্রণীত হয়। গোলকুন্ডা সালতানাতের হীরার খনি তিনি জয় করেছিলেন। জীবনের শেষ ২৭ বছরের অধিকাংশ সময় আওরঙ্গজেব বিদ্রোহী মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন। তার শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা সর্বো‌চ্চ পর্যায়ে পৌছায়। ব্যাপক বিস্তৃত সাম্রাজ্য মনসবদারদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হত। তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য বিভিন্ন দিক থেকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। নিজের হাতে কুরআন লিপিবদ্ধ করার জন্য আওরঙ্গজেব অধিক পরিচিত। দক্ষিণাত্যে মারাঠাদের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় তিনি মারা যান।
Muhammad Azam of India.jpgআজম শাহআবুল ফাইজ কুতুবউদ্দিন মুহাম্মদ আজম২৮ জুন ১৬৫৩১৪ মার্চ ১৭০৭ – ৮ জুন ১৭০৭৮ জুন ১৭০৭ (৫৩ বছর)
Bahadur Shah I of India.jpgবাহাদুর শাহকুতুবউদ্দিন মুহাম্মদ মুয়াজ্জম১৪ অক্টোবর ১৬৪৩১৯ জুন ১৭০৭ – ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৭১২২৭ ফেব্রুয়ারি ১৭১২ (৬৮ বছর)তিনি মারাঠাদের সাথে সমঝোতা করেন, রাজপুতদের শান্ত করেন এবং পাঞ্জাবের শিখদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থানে আসেন।
Jahandar Shah of India.jpgজাহানদার শাহমাআজউদ্দিন জাহানদার শাহ বাহাদুর৯ মে ১৬৬১২৭ ফেব্রুয়ারি ১৭১২ – ১১ ফেব্রুয়ারি ১৭১৩১২ ফেব্রুয়ারি ১৭১৩ (৫১ বছর)
Farrukhsiyar of India.jpgফররুখসিয়ারফর‌রুখসিয়ার২০ আগস্ট ১৬৮৫১১ জানুয়ারি ১৭১৩ – ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৭১৯২৯ এপ্রিল ১৭১৯ (৩৩ বছর)১৭১৭ সালে একটি ফরমানের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে শুল্ক ছাড়া বাংলায় বাণিজ্য করার অনুমতি দেন। সৈয়দ ভাইরা তার সময়ে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে।
Rafi ud-Darajat of India.jpgরাফি উল-দারজাতরাফি উল-দারজাত৩০ নভেম্বর ১৬৯৯২৮ ফেব্রুয়ারি – ৬ জুন ১৭১৯৯ জুন ১৭১৯ (১৯ বছর)
Shah Jahan II of India.jpgদ্বিতীয় শাহজাহানরাফি উদ-দৌলতজুন ১৬৯৬৬ জুন ১৭১৯ – ১৯ সেপ্টেম্বর ১৭১৯১৯ সেপ্টেম্বর ১৭১৯ (২৩ বছর)----
Muhammad Shah of India.jpgমুহাম্মদ শাহরোশান আখতার বাহাদুর১৭ আগস্ট ১৭০২২৭ সেপ্টেম্বর ১৭১৯ – ২৬ এপ্রিল ১৭৪৮২৬ এপ্রিল ১৭৪৮ (৪৫ বছর)সৈয়দ ভাইদের হাত থেকে নিস্কৃতি পান। মারাঠাদের সাথে দীর্ঘ লড়াইয়ে দক্ষিণাত্য ও মালওয়া হারান। শাসনামলে নাদির শাহের আক্রমণ হয়। সাম্রাজ্যের উপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম শেষ সম্রাট।
আহমেদ শাহ বাহাদুরআহমেদ শাহ বাহাদুর২৩ ডিসেম্বর ১৭২৫২৬ এপ্রিল ১৭৪৮ – ২ জুন ১৭১ জানুয়ারি ১৭৭৫ (৪৯ বছর)সিকান্দারাবাদের যুদ্ধে মারাঠাদের বিপক্ষে মুঘলদের পরাজয়
Alamgir II of India.jpgদ্বিতীয় আলমগীরআজিজউদ্দিন৬ জুন ১৬৯৯২ জুন ১৭৫৪ – ২৯ নভেম্বর ১৭৫৯২৯ নভেম্বর ১৭৫৯ (৬০ বছর)উজির গাজিউদ্দিন খান ফিরোজ জঙের আধিপত্য
Sin foto.svgতৃতীয় শাহজাহানমুহিউল মিল্লাত১৭১১১০ ডিসেম্বর ১৭৫৯ – ১০ অক্টোবর ১৭৬০১৭৭২
Ali Gauhar of India.jpgদ্বিতীয় শাহ আলমআলি গওহর২৫ জুন ১৭২৮২৪ ডিসেম্বর ১৭৫৯ – ১৯ নভেম্বর ১৮০৬ (৪৬ বছর, ৩৩০ তিন)১৯ নভেম্বর ১৮০৬ (৭৮ বছর)মারাঠারা তাকে মুঘল সম্রাট হিসেবে মেনে নেয়।[৩৩] পরে ১৭৬১ সালে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পর আহমেদ শাহ দুররানি কর্তৃক ভারতের সম্রাট স্বীকৃত হন।[৩৪] ১৭৬৪ সালে মুঘল সম্রাট, আওধের নবাব এবং বাংলা ও বিহারের নবাবের সম্মিলিত শক্তি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হয়। যুদ্ধে পরাজয়ের পর দ্বিতীয় শাহ আলম এলাহাবাদের উদ্দেশ্যে দিল্লি ত্যাগ করেন। এলাহাবাদের চুক্তির মাধ্যমে হানাহানি বন্ধ হয়। ১৭৭২ সালে মারাঠা নিরাপত্তায় তাকে মুঘল সিংহাসনে বসানো হয়।[৩৫] তার শাসনামলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় মুঘল নিজামত বিলুপ্ত করে।
Akbar Shah II of India.jpgদ্বিতীয় আকবর শাহমির্জা আকবর২২ এপ্রিল ১৭৬০১৯ নভেম্বর ১৮০৬ – ২৮ সেপ্টেম্বর ১৮৩৭২৮ সেপ্টেম্বর ১৮৩৭ (৭৭ বছর)ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের পর দ্বিতীয় আকবর শাহ ব্রিটিশ পেনশনভোগী হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ নিরাপত্তায় তিনি আনুষ্ঠানিক প্রধান ছিলেন।
Bahadur Shah II of India.jpgদ্বিতীয় বাহাদুর শাহআবু জাফর সিরাজউদ্দিন মুহাম্মদ বাহাদুর শাহ জাফর২৪ অক্টোবর ১৭৭৫২৮ সেপ্টেম্বর ১৮৩৭ – ১৪ সেপ্টেম্বর ১৮৫৭ (১৯ বছর ৩৫১ দিন)৭ নভেম্বর ১৮৬২শেষ মুঘল সম্রাট। সিপাহী বিদ্রোহের পর তাকে বন্দী করে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেয়া হয়। এর মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘটে। তিনি রেঙ্গুনে মারা যান।

আক্রমণে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র

বেশিরভাগ অশ্বারোহী সৈনিকগণ কাছাকাছি দূরত্বে যুদ্ধ করার জন্য মূলত খাটো অস্ত্রশস্ত্রের (kotah-yaraq) উপর নির্ভরশীল ছিল। এই খাটো অস্ত্রসমূহ মূলত ৫টি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল: ঢাল-তলোয়ার, গদা, যুদ্ধ-কুঠার, বল্লম এবং খঞ্জর। বেশি দূরত্বের আক্রমণের জন্য ব্যবহৃত হতো তীর-কামান, বন্দুক বা তিফাংক এবং পিস্তল। গোলন্দাজ (তোপখানা) বাহিনীতে ব্যবহৃত হতো ক্ষেপণাস্ত্র। স্বাভাবিকভাবেই কোনো ব্যক্তিই একা এসব অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে যেত না বরং একটি বিশাল সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অংশে এসকল অস্ত্রই কারো না কারো দ্বারা ব্যবহৃত হতো। যে পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র একজন মুঘল সেনা ব্যবহার করতো তার বর্ণনা পাওয়া যায় ফ্লিটজক্ল্যারেন্সের জবানিতে। ফ্লিটজক্ল্যারেন্স ছিলেন নিজামের সেনাবাহিনীর একজন ক্ষুদ্র প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা।

তিনি তার প্রতিরক্ষা সহচরকে বলেন:

“চমৎকার অশ্বসজ্জাবিশিষ্ট দুইটি অতীব দৃষ্টিনন্দন ঘোড়া আছে এই জমাদারের, যে কিনা নিজে সোনার লেস দেয়া সবুজ ইংলিশ ব্রড কাপড়ের (দ্বিগুণ চওড়া উন্নতমানের পশমি বস্ত্র) তৈরি পোশাকে শোভিত ছিল এবং তার পরনে আরও ছিল খুবই জাঁকালো কারুকার্যখচিত বেল্ট। মহিষের চামড়ায় তৈরি ও স্বর্ণমণ্ডিত গম্বুজের ন্যায় প্রতিরক্ষাংশযুক্ত একটি ঢাল ছিল তার পিঠে, তার হাতে অস্ত্রহিসেবে ছিল দুইটি তরবারি ও একটি খঞ্জর, ইংলিশ পিস্তল (রিভলভার) রাখার অস্ত্রবন্ধনী, এবং তার বন্দুকটি তার নফরের দ্বারা তার সামনে পরিবাহিত হচ্ছিল।”


তরবারি- 'জুলফিকার'

তরবারি রাখার কোমরবন্ধনীসমূহগুলো সাধারণত ছিল চওড়া এবং খুব সুন্দরভাবে কারুকাজ করা। মুঘল যুগের প্রকৃত সৌন্দর্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ এর তরবারিগুলো। অশ্বারোহীরা কাঁধে ঝোলানো বেল্টের মাধ্যমে তরবারি বহন করতো। তবে বাকীরা তাদের তরবারি তিনটি ফিতেওয়ালা একটি কোমরবন্ধনীতে করেই বহন করতো।

বিভিন্ন রকমের ফলা (ব্লেড)

শাহ্‍জাদা দারা শেকোর তরবারি ও তরবারির খাপ (৮ নং), লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এন্ড আলবার্টস মিউজিয়ামে রাখা।

শমশের- এটি অনেকটা নিমচার (আরব, পারসিক ও তুর্কীদের পুরনো আমলের খাটো, বাঁকা একধারী তলোয়ারবিশেষ ) ন্যায় একটি বাঁকানো অস্ত্র। এর আকৃতি ও এটির হাতলের ক্ষুদ্রাকারই নির্দেশ করে এটি পুরোপুরিই কাটাকাটির উপযুক্ত একটি অস্ত্র। এটি তৈরি হতো স্টিল দিয়ে।

ধূপ- ধূপ একপ্রকার সোজা তরবারি। দক্ষিণাঞ্চল এর এই তরবারিকে মুঘলবাহিনীতে স্থান দেয়া হয়। এই তরবারিটি প্রায় চার ফুট লম্বা এবং বেশ চওড়া ফলার অধিকারী ছিল এবং এর হাতল এর দুইদিকে ছিল আনুভূমিক অতিরিক্ত অংশ যার জন্য এটিকে অনেকটা ক্রসের মতো দেখাতো। সার্বভৌমত্ব ও উচ্চমর্যাদার প্রতীক এই অস্ত্রটিকে নানান রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত করা হতো, যেখানে একজন মানুষ তার মনিবের সামনে মখমলে মোড়া এই তলোয়ারটিকে উঁচুতে তুলে ধরে রাখতো। এছাড়াও দরবারে আসীন ক্ষমতাশালী ব্যক্তির বালিশেও শোভা পেত এই তরবারিটি। এই ধরনের তরবারি সফল সৈনিক, মহান ও অভিজাত ব্যক্তি এবং দরবারের প্রিয়পাত্রদের জন্য উচ্চমর্যাদার বিষয় ছিল। এটিও স্টিল দিয়ে তৈরি ছিল।

  • খান্দাঃ খান্দা একপ্রকার সোজা তরবারি। এটি প্রায় ধূপের ন্যায় দেখতে।
  • সিরোহিঃ এটিও একপ্রকার নিমচাসদৃশ তরবারি। ভারতীয় এই তলোয়ারের ধারাল ফলা দিয়ে কারো মাথায় উল্লম্বভাবে আঘাত করা হলে তা শরীরকে কোমর পর্যন্ত ফালি করে দিতো এবং শরীরে আঘাত করা হলে তা শরীরকে দ্বিখন্ডিত করে দিতে সক্ষম ছিল। এই তরবারির ফলা অনেকটা দামেস্কে ব্যবহৃত ফলার ন্যায় আকৃতির এবং কিছুটা বাঁকানো, সাধারণ তরবারির চেয়ে এটি ছিল হালকা এবং অপেক্ষাকৃত সরু। দামেস্কের ইস্পাত দিয়ে সিরোহী নামক স্থানে এই তরবারিটি তৈরি হতো।
  • পাটাঃ পাটা একপ্রকার সরু ফলাযুক্ত, সোজা তরবারি। এর হাতলের ভেতরে রাখা ক্রসবারের মাধ্যমে এটি ধরতে হতো এবং এর বাহিরের আবরণ ধাতব দস্তানার ন্যায় সুরক্ষা দিতো। এটিও ইস্পাতের তৈরি। মুহররম শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের এখন এ তলোয়ার ঘোরাতে দেখা যায়।
  • গুপ্তিঃ গুপ্তি একপ্রকার সোজা তরবারি যা হাঁটতে সহায়ক লাঠির আবরণের ন্যায় খাপে পুরে রাখা হতো। এটি ছিল তিন ফুট লম্বা এবং এই তরবারির হাতল ও মাথা সুফিদের ব্যবহৃত অস্ত্র ‘ফকিরস ক্রাচ’ এর সাথে মিলসম্পন্ন ছিল। পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের শক্তিমন্ত বিনম্রতার প্রতীক হিসেবে স্টিলনির্মিত এই অস্ত্রটি ব্যবহৃত হতো।
মুঘল ঢালসমূহ
রয়্যাল অন্টারিও মিউজিয়ামে রাখা ইস্পাত, সোনা, সিল্ক . চামড়ার তৈরি সপ্তদশ শতকে প্রস্তুতকৃত মুঘল ঢাল যা উত্তর ভারতে ব্যবহৃত হতো।- DSC04543

একজন তলোয়ারবাজের সরঞ্জামাদির অবিচ্ছেদ্য অংশ তরবারি ও এর সঙ্গী ঢাল। যুদ্ধের সময় বাম হাতে ধরা ঢাল এর এই ব্যবহার শেষ হলে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো। সাধারণত ঢালগুলো চামড়া কিংবা ইস্পাতের তৈরি এবং এর ব্যাস ছিল ১৭-২৪ ইঞ্চির (৪৩০-৬১০ মিলিমিটার) মধ্যে। ইস্পাতের তৈরি ঢালগুলো খুবই জমকালো কারুকার্যপূর্ণ ছিল এবং এই কাজগুলো ছিল সোনা দিয়ে করা। অপরপক্ষে চামড়ার তৈরি ঢালগুলোয় স্বর্ণ ও রৌপ্যমণ্ডিত উঁচু অংশ, অর্ধচন্দ্র অথবা তারকা আকৃতির উঁচু অংশ বসানো থাকতো।কিছু কছু ঢাল সাম্বার হরিণ, মহিষ, নিলগাই, হাতি অথবা গণ্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরি হতো যার মধ্যে গণ্ডারের চামড়ানির্মিত ঢালই বেশি মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত ছিল। ব্রাহ্মণ সেনারা নানান রঙ করা ৪০-৫০ পরত চওড়া সিল্কের তৈরি ঢাল ব্যবহার করতো।

ঢালের নানান প্রকারভেদঃ

  • চিরওয়াহ এবং তিলওয়াহ- এই ঢালগুলো সেসব তলোয়ারবাজ (শমশেরবাজ) অথবা যোদ্ধাবাহিনীর দ্বারা ব্যবহৃত হতো যারা মুঘল সম্রাট আকবরের (১৫৪২-১৬০৫) যুদ্ধযাত্রার সময় তার সঙ্গী হতো।
  • তরবারিযুদ্ধে ব্যবহৃত ঢাল

ছোট গোলাকৃতির এর ঢালগুলি কঞ্চি অথবা বাঁশের তৈরি। এর আকৃতি অনেকটা মসুরডাল এর হওয়ায় এটিকে ডাল হিসেবে ডাকা হতো এটিকে ডাল হিসেবে ডাকা হতো। এছাড়াও মারু বা সিংগৌটা নামক অদ্ভুতুড়ে ঢালগুলো তৈরি হতো কৃষ্ণসার হরিণের শিং ও ইস্পাত সহযোগে। হরিণের শিং মোড়া হতো ইস্পাতে এবং শিংদুটো মিলিত হতো এর ভোঁতা প্রান্তভাগে। সাইন্তি একপ্রকার ঢাল যা অসিযুদ্ধে প্রতিপক্ষের আঘাত ঠেকাতে ব্যবহৃত হতো।

আনুষ্ঠানিক গদা

চোব নামক আনুষ্ঠানিক গদা।
  • গুর্জঃ এটি একপ্রকার খাটো হাতলের গদা যার শেষে তিনটি বড় গোলাকৃতি বল রয়েছে এবং এই অস্ত্রটি সাধারণত বেশ গণ্যমান্য পদমর্যাদার মুঘলযোদ্ধার অস্ত্রাগারের অংশ ছিল।
  • শ্বাসবুরঃ এরই আরেকটি প্রকরণ হলো- শ্বাসবুর তথা ফুসফুসভেদী (ফুসফুস ছিন্নকারী)। এটির অনেকটা গুর্জেরই মতো গোলাকার মাথা ছিল। এছাড়াও এসদৃশ আরো কিছু গদা হচ্ছে- ধারা, গারগাজ এবং খান্ডলি ফাঁসি।
  • ধারাঃ কোলহাপুর থেকে আগত ধারা নামক গদাটির ছয়টি ফলাযুক্ত মাথা এবং অস্টভুজাকৃতির ইস্পাতের সরু-হাতল ছিল। এটি লম্বায় ছিল দু ফুট (০.৬১ মিটার)।
  • গারগাজঃ এটি ছিল ৮ অথবা ৭টি ফলাযুক্ত মাথাবিশিষ্ট এবং এর হাতলের চারিপাশ ঘেরা ছিল ঝুড়ির মতোন অংশে (basket hilt) যা জাতকে সুরক্ষা দিতো। এটি দৈর্ঘ্যে ২.৪-২.১০ ইঞ্চি (৬১-৫৩ মিলিমিটার) ছিল।
  • খুন্ডলি ফাঁসিঃ এটি এটি এক ইঞ্চি (২৫ মিলিমিটার) লম্বা ছিল এবং এর হাতলের মাথা ছিল ফাঁকা ধাতবকারুকাজসম্পন্ন।
  • কস্তনীঃ এটি এমন একপ্রকার অস্ত্র যা পুস্ত-খার (পিঠ খামচে আহতকারো অস্ত্র) এর ন্যায় গদা শ্রেণীভুক্ত। হাতের আকৃতিতে বানানো এই অস্ত্রটি ইস্পাতের তৈরি।
  • খার-ই-মাছই বা ‘মাছের মেরুদন্ডীয় কাঁটাঃ এই গদার সোজা মাথার দুপাশ থেকে ইস্পাতনির্মিত কণ্টকের ন্যায় ধারালো অংশ বেরিয়ে থাকতো।
  • গুজবাগঃ গুজবাগ নামক অস্ত্রটি ছিল হাতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রশিক্ষণ দেবার কাজে ব্যবহৃত এক প্রকার অস্ত্র (অঙ্কুশ)।
যুদ্ধ-কুঠার
১) লাঠির ভেতরে লুকিয়ে রাখা ছোরা (Dagger Crutch বা fakir's crutch) বা ভিক্ষুকের ক্রাচ তথা লাঠি, ২) তাবার (যুদ্ধকুঠার), ৩) অষ্টফলাযুক্ত ঢেউ খেলানো গদা, ৪) তাবার নামক যুদ্ধকুঠার, ৫) জাঘনাল (যুদ্ধকুঠার), ৬) লাঠির ন্যায় তরবারি (মুঘল আমলের)
  • সূঁচাল মাথা এবং দুইধারবিশিষ্ট ফলাওয়ালা কুঠারের নাম ছিল 'জাঘনল' তথা কাকের চঞ্চু।
  • দ্বিমাথাযুক্ত কুঠার যার হাতলের একপাশে চওড়া ফলাবিশিষ্ট এবং অন্যপাশে তীক্ষ্ণ ফলাবিশিষ্ট ব্লেড থাকলে তাকে তাবার জাঘনল বলা হতো।
  • লম্বা হাতলযুক্ত 'তারানগালাহ' নামক আরও একপ্রকারের কুঠারও ব্যবহৃত হতো। তাবারের হাতল ছিল সাধারণ ১৭-২৩ ইঞ্চি (৪৩০-৫৮০ মিলিমিটার) লম্বা এবং এর মাথা ছিল একদিকে ৫-৬ ইঞ্চি (১৩০-১৫০ মিলিমিটার) ও অন্যদিকে ৩-৫ ইঞ্চি (৭৬-১২৭ মিলিমিটার) দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট। কিছু কিছু কুঠারের মাথা ছিল অর্ধচন্দ্রাকৃতির এবং তার হাতলের একটি অংশ ছোরা লুকিয়ে রাখার জন্য ফাঁপা রাখা হতো।
  • ‘বাসোলাহ’ নামক কুঠারটি ছিল অনেকটা বাটালির ন্যায় দেখতে এবং প্রচুর কারুকার্যপূর্ণ রূপোর কুঠারগুলো সভাসদবৃন্দ দরবারে প্রদর্শনার্থে বহন করতেন।
বর্শা
মুঘল আমলের রাইফেল, বর্শা এবং হাতলযুক্ত বাঁকা ফলকওয়ালা ভারী তলোয়ার যা অশ্বারোহীদের দ্বারা ব্যবহৃত হতো।

এই ধরনের অস্ত্রের নানান ধরনের প্রকরণ ছিল। অশ্বারোহী সেনারা সাধারণত ঘোড়সওয়ারদের বিশেষ শর ব্যবহার করতো এবং পদাতিক সেনা ও সম্রাটের দরবার ঘিরে থাকা রক্ষীরা অন্য ধরনের বর্শা ব্যবহার করতো। এছাড়াও জ্যাভেলিন বা খাটো বর্শা, যা ছুঁড়ে মারা যেতো, তারও ব্যবহার থাকার প্রমাণ মিলেছে, বিশেষত মারাঠাদের মধ্যে।

  • নেজাহ্ঃ নেজাহ্ ছোট ইস্পাতনির্মিত মাথা ও লম্বা বাঁশের তৈরি হাতলযুক্ত একপ্রকার অশ্বারোহী সেনার বর্শা যা কিনা নেজাহ্-বাজান (বর্শা-নিক্ষেপক) এ করে বহন করা হতো। মারাঠা অস্ত্রশস্ত্রের ভাণ্ডারেই এই অস্ত্রটি বেশি দেখা যেতো এবং বলা হয় কোনো শত্রুপক্ষের অশ্বসেনাবাহিনীই এগুলোর মুখোমুখি হলে টিকে থাকতে সক্ষম ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রায় ২০,০০০-৩০,০০০ বর্শা শত্রুসেনার উদ্দেশ্যে তৈরি রাখা হতো এবং এগুলোকে এমন আঁটসাঁটভাবে প্রস্তুত রাখা হতো যেন শরবিদ্ধ মানুষের সারির মাঝে কোনো স্থান ফাঁকা (যেখানে বর্শা পৌঁছয়নি) না থাকে। যদি অশ্বারোহী সেনারা এই সকল বর্শা-নিক্ষেপকের ওপর দিয়ে একে অতিক্রম করার চেষ্টা করতো তাহলে এগুলোয় থাকা বর্শার ফলা ও আগুয়ান সেনাদের মাঝে সংঘর্ষ ঘটিত হয়ে সেনারা অশ্বচ্যুত হয়ে যেতো। অশ্বসেনা আক্রমণের সময় যদি নেজাহ্ এর সহিত শত্রুসেনার অস্ত্রের সংঘর্ষ হতো তাহলে তার পরিণামস্বরূপ এতো বেশি জোরে শদব হতো যে প্রতিপক্ষের ঘোড়াগুলো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উল্টো ঘুরে গিয়ে প্রচণ্ড বেগে দৌড়ে পালাতো। সাধারণত অশ্বারোহী একজন মানুষ তার মাথার ওপরে তুলে হাতের বাহুর সাথে সমান্তরালে বর্শা ধরতেন। বাঁশ ও ইস্পাত সহযোগে অস্ত্রটি তৈরি হতো।
  • বার্ছাহ্ঃ বার্ছাহ্‍ও একপ্রকার মুঘল অস্ত্র যা কিনা মারাঠাদের দ্বারাও ব্যবহৃত হতো। লৌহ বা ইস্পাতনির্মিত মাথা ও হাতলযুক্ত এই ভারী বর্শাটি পদাতিক সৈন্যদের দ্বারাই ব্যবহৃত হতো, কেননা, ঘোড়সওয়ারদের ব্যবহারের জন্য এটি বেশ ভারী ছিল।
  • সাঙঃ সাঙ ছিল পুরোপুরি লৌহনির্মিত বর্শা যা সাধারণত বার্ছাহ্ এর চেয়ে খাটো হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা ৭.১১ ফুট (২.১৭ মিটার) পর্যন্তও লম্বা হতো এবং এই লম্বা বর্শাগুলোর মাথার দৈর্ঘ্য ছিল ২.৬ ফুট (০.৭৯ মিটার)। অস্ত্রটির ছিল লম্বা, সরু তিন থেকে চারটি মাথা, ইস্পাতের হাতল এবং এর হাত দিয়ে ধরবার অংশটি ছিল মখমলমোড়া।
  • সাইন্থিঃ এর হাতল ছিল সাঙ এর চেয়ে খাটো আকৃতির।
  • সেলারাহ্ঃ সাইন্থির চেয়ে চেয়ে লম্বা কিন্তু সাঙ এর চেয়ে খাটো মাথা ও হাতলবিশিষ্ট এই বর্শা।
  • বল্লমঃ এই বর্শা তথা শরগুলো ক্রমশ বেঁকে তীক্ষ্ণ হওয়া মাথা ও কাষ্ঠনির্মিত হাতলযুক্ত এবং এগুলো লম্বায় ছিল ৫.১১ ফুট (১.৫৬ মিটার), যার মধ্যে ১৮ ইঞ্চি (৪৬০ মিলিমিটার) ছিলো এর ফলার দৈর্ঘ্য। পদাতিক সৈন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত বল্লম ছিল চওড়া মাথাযুক্ত এক খাটো আকারের বর্শা।
  • পান্ডি-বল্লমঃ শূকর শিকারে ব্যবহৃত এই বর্শাটি অনেকটা Aspidistra elatior গাছের পাতার ন্যায় দেখতে ফলা এবং বাঁশের হাতলে তৈরি ছিল। বর্শাটির সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছিল ৮.৩ ফুট (২.৫ মিটার) যার মধ্যে ফলার দৈর্ঘ্য ছিল ২.৩ ফুট (০.৭০ মিটার)।
  • পাঞ্জমুখঃ পাঁচটি মাথাবিশিষ্ট এই বর্শাটি গুজরাটের লোকেরা ব্যবহার করতো।
  • লাঙ্গেঃ এই একপ্রকার মুঘল শর যা চারটি চারকোনে থাকা মাথা ও একটি ফাঁপা হাতলযুক্ত ছিল।
  • গার্হিয়াঃ এটি ছিল সম্ভবত দীর্ঘ শূলাকৃতির বল্লম, জাভেলিন কিংবা বর্শাশ্রেণীর অস্ত্র।
  • আলমঃ এটি একপ্রকার বর্শা (সুচারুরূপে নিখুঁত বা চমৎকার)।
  • কন্টঃ এক প্রকারের বর্শা।
  • গান্দাসাঃ এটি বড়শির ন্যায় বাঁকানো বর্শা কিংবা প্রান্তভাগে ফলাযুক্ত কুঠার যার ইস্পাতের ফলা লম্বাকৃতির দণ্ডের অগ্রভাগে লাগাবো থাকতো। গ্রামের চৌকিদার বা গ্রাম্য রক্ষীর দ্বারা এটি ব্যবহৃত হতো।
খঞ্জর এবং ছুরি

এগুলো ছিলো নানান আকৃতি ও প্রকারের, যার প্রত্যেকটিই পৃথক পৃথক নামে অভিহিত ছিল।

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে ব্যবহৃত মুঘল সাম্রাজ্যের ছোরা, যার রয়েছে পানির ন্যায় অবয়বযুক্ত ইস্পাতের ফলা এবং নেফ্রাইটের হাতল। হাতলে সোনা, চুনি এবং পান্নাখচিত কারুকার্য রয়েছে। অবস্থান: ফ্রিয়ার গ্যালারি অফ আর্ট- DSC05186
  • কাটারা তথা কাটারিঃ এটি হালকা ওজনবিশিষ্ট আক্রমণে ব্যবহার্য ছোরা যা কিনা অনেকটা ফরাসী poignard (ছোট সরু আকৃতির ছোরাবিশেষ) এর সমতুল্য এবং ভারতে কিছুটা বিচিত্রও বটে। এর হাতলের দুইটি অংশ হাত এবং বাহুর কিঞ্চিৎ অংশকে সুরক্ষা দেবার জন্য বাহু বরাবর দুই পাশে প্রসারিত। এই অস্ত্রটির মোটা ফলা এবং দ্বিমুখী ধারালো কাটার অংশ রয়েছে যা হাতল অংশে প্রস্থে ৩ ইঞ্চি (৭৬ মিলিমিটার) এবং ফলাযুক্ত দৃঢ় অংশে ১ ইঞ্চি (২৫ মিলিমিটার)। এর ফলাটিকে বাঁকানো যেতো না এবং এটি এতটাই শক্ত ছিলো যে ধাতবনির্মিত শক্ত বর্ম ব্যতীত অন্য কোনো কিছুই এটিকে আটকাতে পারতো না। একটি কাটারার পুরো দৈর্ঘ্য ২২ ইঞ্চি (৫৬০ মিলিমিটার) পর্যন্ত হতে পারে যার অর্ধাংশ জুড়েই এর ফলার উপস্থিতি। ফলার ডানদিকে হাতলটির সাথে একটি ক্রসবার যুক্ত ছিল যার মাধ্যমে অস্ত্রটিকে এমনভাবে ধরা যেতো যাতে এটিকে শুধুমাত্র সম্মুখভাগে আঘাত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়।

এই অস্ত্রগুলির কিছু কিছু ছিল হালকা বাঁকানো আবার কিছু ছিলো কাঁটাচামচের ন্যায় ভাগ করা অংশযুক্ত কিংবা দুইটি ফলাযুক্ত। ফলাগুলি হতো নানান রকমের যার দৈর্ঘ্য ৯-১৭.৫ ইঞ্চির (২৩০-৪৪০ মিলিমিটার) এর মধ্যে হতো।

  • জমাধারঃ এগুলির কাটারার ন্যায় একই হাতল থাকলেও এদের ফলাগুলো ছিল চওড়া ও সোজা, যেখানে কাটারার ফলা সোজা বা বাঁকানো উভয় রকমই হতো। জমাধার কাটারির সোজা ফলা এবং তরবারি কিংবা সাধারণ চাকুর ন্যায় হাতল ছিল।
  • খঞ্জরঃ এটিও পয়েগনার্ডের ন্যায় ছোরাবিশেষ যার হাতল ছিল তরবারির ন্যায় এবং এর ফলাগুলো ছিলো দ্বি-বাঁকযুক্ত। অস্ত্রটি ছিল ১২ ইঞ্চি (৩০০ মিলিমিটার) লম্বা। অস্ত্রটির উদ্ভব হয় তুর্কিদের কাছে, তারা এটিকে উঁচু করে তুলে ধরে কিংবা তাদের ডানপাশে বহন করতো। তবে মাঝে মাঝে পারস্যদেশীয় লোকজন ও ভারতীয়রাও এটি পরিধান করতো এবং ভারতীয়রা বাঁ পাশে এটিকে বহন করতো। এগুলো ছিলো চার প্রকারের্: জামহাক, ঝাম্বওয়াহ্, বাঙ্ক এবং নরসিং মথ। এগুলোর প্রতিটিই প্রায় খঞ্জরের ন্যায় দেখতে ছিল যদিও কিছু খোটখাটো ব্যতিক্রম পাওয়া যেতো। প্রধানত তুর্কিরা ব্যবহার করতো, কখনো কখনো পারস্যদেশীয় ও ভারতীয়রাও।
  • বিছুয়া এবং খাপওয়াহ্ঃ বিছুয়া অর্থ বিচ্ছু, এই ধরনের ছুরিগুলোর বেশ ঢেউয়ের ন্যায় বাঁকা ফলা ছিল, অপরপক্ষে, খাপওয়াহ্ ছিলো একধরনের ছোরা। এটি দেখতে মারাঠাদের ব্যবহৃত জাম্বওয়াহান্দ এর ন্যায় প্রায় একইরকম ছিল।
  • পেশকাজঃ এটি একপ্রকার চোখা পারস্যের ছোরা যার ফলার ধারালো অংশটি বাঁকানো কিন্তু অন্যপার্শ্ব সোজা (straight back) এবং কোনোপ্রকার আচ্ছাদনবিহীন সোজা হাতলযুক্ত। তবে কখনো কখনো এর ফলা বাঁকানো কিংবা দুবার বাঁকানো থাকতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাতলে সুরক্ষা আচ্ছাদনও থাকতো।
  • কারুদঃ কারুদের আগমন আফগানদের হাত ধরে- এটি অনেকটা কসাইয়ের ছুরির ন্যায় দেখতে এবং এটি খাপে পুরে রাখা হতো। কারুদের সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছিল ২.৬ ফুট (০.৭৯ মিটার), যার মধ্যে এর ফলার দৈর্ঘ্যই ছিল ২ ফুট (০.৬১ মিটার)। ‘গুপ্তি-কারুদ’ নামক ছুরিটি লাঠিতে পুরে লুকিয়ে রাখা হতো এবং কামচি-কারুদ ছিলো চাবুকাকৃতির স্থিতিস্থাপক ছুরি। চাকু বাঁকিয়ে লুকিয়ে রাখা যায় এমন ছুরিবিশেষ (clasp knife) ছিল পাঞ্জাবিদের দ্বারা যুদ্ধে ব্যবহৃত একপ্রকার অস্ত্র।
  • সাইলাবাহ্-ই-ক্বালমাকিঃ কাশঘরের মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত ছুরিবিশেষ। এটি তরবারির ন্যায় লম্বা এবং শের-মাহি নামক (lion-fish) মাছের হাড় দিয়ে তৈরি হাতল বিশিষ্ট এই ধারালো অস্ত্রটি ‘আসোব’ তথা কাঁধ থেকে ঝোলানো বেল্টে ঝুলিয়ে বহন করা হতো। এই যুদ্ধ-ছুরিটি কাশঘরের লোকেরা ব্যবহার করতো।

ক্ষেপণাস্ত্রসমূহ

তীর-ধনুক, ম্যাচলক বন্দুক, পিস্তল এবং কামানসহ চার ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের অস্তিত্ব ছিল। অশ্বারোহী সৈন্যদের কাছে প্রধানত ধনুক থাকতো কেননা মুঘল অশ্বারোহী সেনারা তাদের ধনুর্বিদ্যার জন্য সর্বজনবিদিত ছিল। কথিত কিংবদন্তী আছে যে, তীর ও ধনুক সরাসরি জান্নাত থেকে ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল (আ.) এর মাধ্যমে আনিত হয় এবং তিনি সেটি হযরত আদম (আ.) কে দেন। ব্যক্তিগত অস্ত্রগুলো পদমর্যাদার বলে ছিলো এরূপে নিম্ন থেকে উচ্চস্তরে বিভক্ত ছিল: ছোরা, তরবারি, বর্শা এবং সর্বোচ্চ মর্যাদার অস্ত্র তীর-ধনুকবিশিষ্ট সেনা।

যদিও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার তখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, তীর-ধনুকের ব্যবহার এর চমৎকার নির্মাণ কাঠামো ও সহজে ব্যবহার্যতার দরুণ অস্টাদশ শতাব্দী জুড়ে বিরাজ করেছিল। ১৮৫৭ সালে ভারতীয় বিপ্লবের (সিপাহী বিদ্রোহ) সময় বিপ্লবীরা বেশমাত্রায় তীর-ধনুকের ব্যবহার করেছিল।

ম্যাচলক- এটি একপ্রকার ভারী এবং নিঃসন্দেহে কার্যকরী সমরাস্ত্র যা পদাতিক সৈন্যের জন্য বরাদ্দ ছিল যেখানে পিস্তলের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।

মুঘল গোলন্দাজ যুদ্ধাঙ্গনবাহিনী- যদিও এর খরচাপাতির অঙ্কটা অনেক বেশি ছিল তবুও শত্রুপক্ষের লড়াকু যুদ্ধহাতির বিরুদ্ধে এটি অত্যন্ত কার্যকরী ছিল এবং এটির ব্যবহার অনেকগুলি দোদুল্যমান বিজয়কে নিশ্চিত করেছিল। বাবুরের গোলন্দাজবাহিনী ষোড়শ শতাব্দীতে ইব্রাহীম লোদীর সেনাবাহিনীকে পরাভূত করার পর থেকে পরবর্তী মুঘল সম্রাটগণ যুদ্ধাঙ্গনে গোলন্দাজবাহিনীর ব্যবহারকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানসূচক রণাস্ত্র হিসেবে দেখতে শুরু করেন।

তীর-ধনুক
তীর-ধনুক ও হুক্কা-পাইপ হাতে ধরা অবস্থায় মুহম্মদ শাহ্‍ এর দণ্ডায়মান চিত্র।

নিজস্ব অস্ত্রচালনায় পারদর্শী হিসেবে সুবিদিত মুঘল অশ্বসেনারা তীর-ধনুকে সজ্জিতাবস্থায় বন্দুকধারী সৈন্যদের চেয়ে নিক্ষেপক অস্ত্রছোঁড়ায় প্রায় তিনগুণ দ্রুত ছিলেন।

আদর্শ মুঘল তীর-কামান (ধনুক) ছিল প্রায় ৪ ফুট (১.২ মিটার) লম্বা এবং দ্বিবাঁকযুক্ত আকৃতির, যার হাতে ধরার স্থল ছিল মখমলে মোড়া। প্রাণীর শিং, কাঠ, বাঁশ, হাতির দাঁত এবং কখনো কখনো ইস্পাত দিয়েও এটি তৈরি করা হতো।

কয়েক ছড়া মোটা তার দিয়ে টানা হতো মুঘল ধনুকের অবতল পার্শ্ব (টানাবস্থায় উত্তল) যেন তা স্থিতিস্থাপকতা ও বলের যোগান দেয়। তীরের পেটের অংশটি ছিলো সুন্দরভাবে ঘন কালো রঙে পালিশ করা মহিষ কিংবা জংলি ছাগলের শিং দিয়ে তৈরি। এর সাথে শক্ত কাঠের পাতলা পাতের ন্যায় অংশ আঠা দিয়ে লাগানো থাকতো। ধনুকের অগ্র ও পশ্চাত্‍ শীর্ষে চল অনুসারে সাপের মাথার আকৃতি দেয়া হতো, শিং এর তৈরি অংশটিতে কোনো কারুকার্য করা হতো না এবং কাঠের তৈরি পিঠের অংশ সোনায় মোড়ানো পাখি, ফুল-ফল, লতাপাতা ইত্যাদির চিত্রবিচিত্র বক্ররেখা-বিজাড়িত অলংকরণে শোভিত ছিল। পর্যটকদের বহনকৃত ভারতীয় ধনুক প্রদর্শনী কিংবা বিনোদনকার্যে ব্যবহৃত হতো। এই ধরনের ধনুকগুলো মহিষের শিং দিয়ে তৈরি হতো, দুইটি একই রকমভাবে বাঁকা শিং বাঁকিয়ে এটি তৈরি করা হতো যার প্রতিটির বাইরের দিকের প্রান্তভাগে কাঠের তৈরি সূক্ষ অগ্রভাগ ছিল জ্যা পরাবার কাজে ব্যবহারের জন্য। শিং দুটির অপর প্রান্তভাগের অংশদুটি একসাথে এনে শক্ত কাঠের টুকরোর সাথে কষে বেঁধে ফেলা হতো। এই কাঠের টুকরোটি ধনুকের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতো এবং এটিকে বাম হাত দিয়ে ধরা হতো। ধনুক তৈরির পর এগুলোকে মাপমতো প্রাণীজ তন্তুওতে মোড়ানো হতো এবং তার ওপর মিহি দড়ি মুড়ে পাতলা আবরণ দেয়া হতো অন্তিম কার্য হিসেবে রঙ ও বার্নিশের চূড়ান্ত প্রলেপ দেয়ার পূর্বে। ধনুর্গুণ বা জ্যাগুলো কখনো কখনো সাদা সিল্কের শক্তিশালী সুতো দিয়ে তৈরি হতো যা পরষ্পর পেঁচিয়ে ১.২৫ সেন্টিমিটার (০.৪৯ ইঞ্চি) ব্যাসার্ধের সিলিন্ডারের ন্যায় আকৃতি তৈরি করতো। একই বস্তু দ্বারা মধ্যিখানে তিন থেকে চার ইঞ্চি পেঁচানো হতো এবং এই মধ্যভাগেই রক্তাভ লাল কিংবা অন্যরঙের বড় বড় ফাঁসযুক্ত বস্তু জটিল গিঁটের মাধ্যমে যুক্ত থাকতো। এই জাঁকালো ফাঁসগুলো তখন সাদা সিল্কের বিপরীতে লক্ষণীয় রঙবৈচিত্র্য প্রকাশ করতো।

ধনুকের জ্যা যেখানে লাগানো হতো সেই অংশটি মূল্যবান রত্নপাথরখচিত বড় রিং আকৃতির হতো এবং এই মূল্যবান রত্নটি পদমর্যাদার পদাধিকারবল অনুসারে নানাবিধ হতো যেমন: স্ফটিক, জেডপাথর, হাতির দাঁত, শিং, মাছের কাঁটা/হাড়, সোনা কিংবা লৌহ।

বিশেষায়িত ধনুক
  • চার্খঃ এটি একপ্রকার আড়ধনুক যা চার্খ গোত্রীয় মানুষেরা ব্যবহার করতো।
  • তক্ষ কামানঃ এটি একপ্রকার ছোট ধনুক।
  • কামান-ই-গুরোহাহ্ঃ এটি আধুনিক গুলতির ন্যায় ছোট ছোট গুলি ছোঁড়ার ধনুক যা ছোট ছেলেরা পরিণতপ্রায় ফসলের থেকে পাখি তাড়াতে ব্যবহার করতো।
  • গোভানঃ এগুলোও গুলতির ন্যায় যেগুলো বানদাহ্ এর নেতৃত্বে শিখদের ১৭১০ সালে করা আক্রমণ থেকে জালালাবাদ শহরের প্রতিরক্ষাকল্পে গ্রামবাসী সমবেত হবার সময় সাথে এনেছিল।
  • কামথাহ্ঃ মধ্যভারতের ভীল জনগোষ্ঠীর দ্বারা ব্যবহৃত লম্বা ধনুকবিশেষ। এরা ধনুকটিকে তাদের পা দিয়ে ধরে ধনুর্গুণ (চিল্লাহ্) হাত দিয়ে টেনে ধরে এবং এতটাই শক্তি দিয়ে তীর ছুঁড়তে পারে যে তা হাতির চামড়া পর্যন্ত ভেদ করে যেতে পারে। ভীলদের প্রধান অস্ত্র ছিল কাম্পতি তথা বাঁশের ধনুক, যার জ্যা ছিল বাঁশের স্থিতিস্থাপক ছালের তৈরি পাতলা অংশ। ৬০টি কাঁটাযুক্ত তীর যা তূণীর ভেতর একগজ লম্বা, এবং যেগুলি মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত হতো সেগুলোয় হাতলের সাথে চোখা মাথাযুক্ত ছিল যেটি মাছের গায়ে আঘাত করতো। তীরের মাথা এবং হাতল লম্বা সূত্রের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকতো যেন পানির পৃষ্ঠদেশে হাতলটি ভেসে থাকে।
  • নওয়াকঃ এটি একপ্রকার চোঙবিশেষ যার মধ্য দিয়ে তীর ছোঁড়া হতো, নওয়াক পাখি মারার কাজে ব্যবহার করা হতো। এটি হয় একটি আড়ধনুকের ন্যায় কিংবা কিছুটা সাধারণ ধনুকের অংশবিশেষের ন্যায় দেখতে। এটি মালয়দের তৈরি ফুঁ দিয়ে বিষাক্ত তীর ছোড়ার ফুঁ-চোঙ নয়। এটির চোঙের বিভিন্ন নমুনা থেকে এর দৈর্ঘ্য পাওয়া গেছে ৬.৬-৭.৬ ফুট (২-২.৩ মিটার) এবং এতে তারা একফুট লম্বা তীর ব্যবহার করতো।
  • তুফাক-ই-দাহানঃ এটি একপ্রকার ফুঁ-চোঙ যা ফাঁপা চোঙাকৃতির অংশ দিয়ে দম তথা বাতাসের জোরে কাদামাটির ছোট বল ছুঁড়তে ব্যবহৃত হতো।

তীরগুলো ছিল দুই প্রকৃতির: সাধারণকার্যে ব্যবহার্যগুলি তৈরির নিমিত্তে নলখাগড়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং যেগুলো বাঘের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতো সেগুলি ছিলো কাঠের হাতলবিশিষ্ট। নলখাগড়াভিত্তিক তীরগুলির মাথা রজনের মাধ্যমে হাতলে লাগানো থাকতো এবং কাঠের হাতলযুক্ত তীরের ক্ষেত্রে হাতলে ছিদ্র করে লোহিত-তপ্ত তীরের মাথা সেখানে বলপূর্বক ঢুকিয়ে দেয়া হতো। ভারতীয় জাদুঘরের কিছু কিছু তীর. (ব্যাখ্যা প্রয়োজন কোনগুলির) ২.৪ ফুট (০.৭৩ মিটার) লম্বা, একটি উদাহরণস্বরূপ, ১৮৫৭ সালে লখনৌতে পাওয়া একটি তীর, ছয় ফুট (১.৮ মিটার) পর্যন্ত লম্বা ছিল এবং এর জন্য স্বাভাবিক গড়পড়তা ধনুকের চেয়ে বড় আকৃতির ধনুক প্রয়োজন ছিল। তীরে যে পালকগুলি ব্যবহার করা হতো তা প্রায়শই কালো সাদার মিশেলে হতো (আবলাক), যেখানে তীরের মাথা বা ফলা হতো সাধারণত ইস্পাতের যদিও ভীলরা হাড়নির্মিত তীরের মাথা ব্যবহার করতো।

ম্যাচলক বন্দুক
বৃহৎ আকৃতির ম্যাচলক বন্দুক নিয়ে মুঘল সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা

তুংফাং হিসেবে পরিচিত ম্যাচলক বন্দুকটির আদি অবস্থা থেকে তার প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেন মুঘল সম্রাট আকবর। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এটিকে তীর ধনুকের চেয়ে কম গুরুত্বের চোখে দেখা হতো। ম্যাচলক বন্দুক সাধারণত পদাতিক সেনার এখতিয়ারাধীনই রাখা হতো, যারা কিনা মুঘল সেনাপতিদের তথ্যানুসারে ঘোড়সওয়ার সেনাদের তুলনায় নিম্নস্তরভুক্ত সৈন্য হিসেবে বিবেচিত ছিল। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগের পূর্বে যতদিন না ফরাসী এবং ইংরেজ সেনারা পদাতিক সেনাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং শৃঙ্খলাচর্চা উন্নতির পদক্ষেপ নিলে সেটিকে পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করে ভারতেও এর চল শুরু হয়। সম্রাট আকবরের ম্যাচলক বন্দুকগুলোর দুটি ব্যারেলের দৈর্ঘ্য ছিল দু দুরকম: ৬৬ ইঞ্চি (১,৭০০ মিলিমিটার) এবং ৪১ ইঞ্চি (১,০০০ মিলিমিটার)। গোটানো ইস্পাতের পাত দুইপ্রান্ত ঝালাইয়ের মাধ্যমে একত্রিত করে এগুলোকে তৈরি করা হতো। সম্ভবত এরও আগে দাক্ষিণাত্য মালভূমিতে ফরাসি ও ইংরেজদের সংসর্গে আসার জন্য ফ্লিন্ট-লক অস্ত্র ব্যবহারের সূচনা হয়েছিল।

ম্যাচলকের ব্যারেলগুলোর ধাতব শরীর আরো বিশদ স্বর্ণ ও রৌপ্যের কারুকাজপূর্ণ ছিল, যে অংশটি শরীরে ভর দিয়ে রেখে তা চালাতে হতো (অস্ত্রের হাতল কিংবা ভিত্তি) সেখানে ধাতব নকশা খচিত ছিল কিংবা বার্ণিশ, রঙ কিংবা বিভিন্ন জিনিসের টুকরো দিয়ে তা সাজানো হতো। কখনো কখনো অস্ত্রটির ভিত্তিতে সোনার স্ফীত অংশ খচিত বা শোভিত থাকতো কিংবা পেছনভাগে হাতির দাঁত অথবা আবলুস কাঠের ঢাকনির ন্যায় আবরণ লাগানো থাকতো। ব্যারেল সাধারণত হাতলের সাথে ধাতব চওড়া বন্ধনী কিংবা ইস্পাত, পিতল, রূপা অথবা স্বর্ণের তারের মাধ্যমে যুক্ত থাকতো। চওড়া বন্ধনীগুলো অনেকসময় হতো ছিদ্রযুক্ত কিংবা কখনোবা তাতে খোদাইয়ের কাজ করা থাকতো। ভিত্তি কিংবা হাতলগুলো হতো দুই ধরনের: প্রথমত, সরু, কিঞ্চিত বাঁকা এবং সকল অংশেই সমান প্রস্থযুক্ত এবং দ্বিতীয়ত, নিখুঁতভাবে অনেকটা বাঁকানো এবং হাতে ধরার স্থানে সরু, তবে পশ্চাত্‍ভাগে কিছুটা চওড়া। ব্যবহার ব্যতিরেকে ম্যাচলকগুলোকে রক্তলাল কিংবা সবুজরঙা খোলসে ভরে বহন করা হতো।

পুরো সরঞ্জামাদির সেটটিতে থাকতো একটি পাউডার ধারক, গুলি রাখার থলে, যুদ্ধশিঙা (সিঙ্গরা), পোড়াবার দড়ি, চকমকি পাথর এবং ইস্পাত যেখানে সবমিলিয়ে সম্পূর্ণ জিনিসটি প্রায়শই একটি মখমলের বেল্টে রাখা হতো যাতে করা থাকতো সোনার সূচিকর্ম। যেসব আধারে করে পাউডার এবং মাস্কেট বলসমূহ (একপ্রকারের গুলি) বহন করা হতো সেগুলো ছিল বেশ ভারী এবং তাই বহনের পক্ষে বেশ কস্টকর, এবং যেহেতু মুঘলসেনারা কখনোই কার্তুজ ব্যবহার করেনি তাদের অস্ত্র লোড করতে অপেক্ষাকৃত দেরী হতো। কোনো কোনো সৈন্য একাই প্রায় বিশ গজেরও বেশি আগুন ধরাবার ফিতে বা দড়ি বহন করতো যা কিনা দেখতে অনেকটা প্যাঁচানো সুতোর বলের মতো ছিল।

বিশেষায়িত বন্দুকসমূহ
  • ক্যাইলেটকঃ এক অদ্ভুত ও অত্যন্ত লম্বা এবং ভারী ম্যাচলক বন্দুক। এই বন্দুকটিকে প্রায়ই হাতের বাহুর নিচে পরিবহন করা হতো।
  • জাযাইল বা জাযাইরঃ এগুলো ছিল দুর্গদেয়ালে ব্যবহৃত বন্দুক কিংবা কাঠামোর সাহায্যে বিভিন্নদিকে ঘুরিয়ে ব্যবহার করা যায় এমন তোপ যেগুলো কিনা যুদ্ধসেনাদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলন্দাজবাহিনীর দ্বারা ব্যবহৃত কামানের মাঝামাঝি অস্ত্রবিশেষ এবং এতে এ দুই ধরনের অস্ত্রেরই বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ বিদ্যমান ছিল। জাযাইলের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৭-৮ ফুট (২.১-২.৪ মিটার)। বিভিন্ন ক্যালিবারের (বন্দুকের ব্যারেলের ছিদ্রের ব্যাস) ম্যাচলকগুলো ভারতের স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা দেয়ালে ব্যবহার্য যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো, এগুলো সহজেই ঘুরানো বা নাড়ানো যায় এমন কব্জার ওপর বসানো থাকতো এবং এগুলো থেকে প্রায় এক পাউন্ডেরও (০.৪৫ কেজি) কম ওজনের গোলা ছোঁড়া হতো। যুদ্ধ ময়দানে কখনো কখনো এগুলোকে উটের পিঠে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। দুই বা ততোধিক আউন্স ওজনধারী হতো ভারতীয় জাযাইলের গোলাগুলি।

জিনযাল বা ভারী ম্যাচলক আগ্নেয়াস্ত্রগুলি সাধারণত দুর্গ প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহৃত হতো। এগুলো এক থেকে তিন আউন্স ওজনের গোলা বহনে সক্ষম ছিল। এগুলোর ব্যারেল বা নলগুলো ছিল বৃহদাকার, মধ্যবর্তী কালক্ষেপন ব্যতীত একেবারে ব্যবহার করার পক্ষে বেশ ভারী। অনেকগুলিরই লোহার তৈরি প্রায় এক ফুট লম্বা দাঁড়ার ন্যায় অংশ ছিল, যা সরু মুখনলের অদূরে ক্ষুদ্র পিভটের ওপর যুক্ত ছিল। দেয়াল, ঝোপ কিংবা মাটি যেখানেই রাখা হোক না কেনো এটি ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কাজ করতো। মাটিনির্মিত দুর্গ বিশেষত বুন্দেলখন্ডে, অবরুদ্ধ সেনারা অসাধারণ করদক্ষতার সাথে কাজ করেছিল, এমনকি বেশ অনেক দূরত্বও তারা প্রায় নির্ভুলভাবে মাথায় কিংবা হৃদপিণ্ডের নিকটে নিশানাবিদ্ধ করেছিল যা প্রায় লক্ষ্যচ্যুত হয়নি বললেই চলে। ভারতীয়দের ব্যবহৃত সকল আগ্নেয়াস্ত্রের ছোট বেলনাকৃতির প্রকোষ্ঠ ছিল এবং সেগুলোর ছিদ্র হতো ছোট, বল আকৃতির গুলিগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভরবেগপ্রাপ্ত হতো।

ঘোর-দাহান এক ধরনের জাযাইলের প্রকরণ। এই নাম এর নলের উল্টানো কিংবা চওড়াকৃত মুখকেই নির্দেশ করে।

পিস্তল

পিস্তলগুলিকে ‘তামানচাহ্’ নামে ডাকা হতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে পিস্তল ভারতে ব্যবহৃত হতো, কিছুক্ষেত্রে যে কোনো মূল্যে এর ব্যবহারই প্রচলিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৭২০ সালের অক্টোবর মাসে হুসেইন আলি খানের আত্মীয়- এক তরুণ সৈয়দ, তাঁরই হত্যার উদ্দেশ্যে প্রেরিত এক গুপ্তঘাতককে পিস্তলের এক গুলিতে হত্যা করেন। পিস্তল উচ্চপদস্থ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, খুব কম সংখ্যক সৈন্যেরই ইউরোপীয় পিস্তল এবং তাবানচাহ্ ব্যবহারের সুযোগ ছিল।

  • শেরবাচাহ্ঃ এই ছোট বন্দুক তথা ব্লান্ডারবাস বন্দুকের আগমন ঘটে পিস্তলের পর। সম্ভবত নাদির শাহ্ এর সৈন্যবাহিনী (১৭৩৮) কিংবা আহমাদ শাহ্ আবদালী এর সেনাবাহিনীর (১৭৪৮-১৭৬১) হাত ধরে ভারতবর্ষে এর আগমন ঘটে। অষ্টাদশ শতকের শেষের এক-চতুর্থাংশে লখনৌ এর কার্যে এক দল পারসিক ঘোড়া নিয়োজিত ছিল যেগুলোকে একত্রে ডাকা হতো- ‘শেরবাচাহ্’ নামে। সম্ভবত তারা এই যুদ্ধাস্ত্র থেকেই এই নাম দিয়েছিল, যা দিয়ে তাদের অস্ত্রসজ্জিত করা হতো। কিংবা এই নামের পেছনে তাদের সম্ভাব্য হিংস্রতা এবং শত্রুপক্ষের রক্তের জন্য তাদের রক্তপিপাসু মনোভাবও দায়ী হতে পারে।

গোলন্দাজবাহিনী

রত্নাম্ভর দুর্গ আক্রমণের সময় বলদ কর্তৃক পাহাড়ের ওপরে টেনে তোলা হচ্ছে অবরোধ বন্দুক। Fort[১]

মুঘল সৈন্যবাহিনী বেশ বড় পরিসরের গান পাউডার বা বারুদভিত্তিক অস্ত্র ব্যবহার করতো যেগুলো ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের চেয়ে বড় ছিল। এর মধ্যে রকেট ক্ষেপণাস্ত্র থেকে শুরু করে চলমান বন্দুক এমনকি চৌদ্দ ফুটেরও (৪.৩ মিটার) বেশি লম্বা সুবিশাল কামানও ছিল যা কিনা একদা "বিশ্বের সর্বাধিক বিশালকায় অস্ত্র"[২] হিসেবে বিবেচিত ছিল। এই ধরনের অস্ত্রসস্ত্রসমূহ ভারী এবং হালকা গোলন্দাজবাহিনী আকারে বিভক্ত ছিল।[৩]

যুদ্ধময়দানে ব্যবহৃত চলমান গোলন্দাজবাহিনীকে কিছু কিছু ইতিহাসবিদ মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় সামরিক শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং এসকল সেনাদলকে তাদের অধিকাংশ প্রতিপক্ষের তুলনায় অনন্যভাবে আলাদা হিসেবে গণ্য করেছেন। এছাড়াও এটি ছিল সম্রাটের পদমর্যাদার প্রতীক, তাই সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ যাত্রাগুলোতে গোলন্দাজবাহিনীর একাংশ সর্বদা মুঘল সম্রাটের সঙ্গে সঙ্গে চলতো।[৪] প্রতিপক্ষের হাতিসমূহ যেগুলো কিনা ভারতীয় উপমহাদেশের যুদ্ধগুলোতে অত্যধিক পরিমাণে দেখা যেতো, সেগুলোর মোকাবেলায় মুঘলরা মূলত যুদ্ধক্ষেত্রে গোলন্দাজ সেনাদের ব্যবহার করতো। তবে যদিও কামানের নিশানাভেদ আরো নিখুঁত করার উদ্দেশ্যে সম্রাট আকবর নিজেই ব্যক্তিগতভাবে তার কামানবাহী রথসমূহের নকশা করেন, তবুও মুঘল গোলন্দাজবাহিনীর ছোঁড়া গোলাসমূহ সবচেয়ে কার্যকরী ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের হাতিগুলোকে ভয় দেখাতেই। প্রতিপক্ষ সৈন্যদলে এভাবে সৃষ্টি হওয়া বিশৃঙ্খলাই মুঘল সেনাবাহিনীকে তাদের শত্রুর ওপর বিজয় হাসিলে ভূমিকা রাখতো। প্রাণীজ-উত্‍স থেকে তৈরি কব্জাসমৃদ্ধ ঘুরানো-বাঁকানোয় সক্ষম তোপগুলো মুঘল যুদ্ধবিগ্রহের একটি বৈশিষ্ট্যে পরিণত হতেছিল যার ভিত্তি ছিল ৬.৭ ফুটেরও (২ মিটার) বেশি লম্বা দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট, যা থেকে ছোঁড়া গোলার ব্যাস ৩.৮-৪.৭ ইঞ্চি (৯৯-১১৯ মিলিমিটার)।

                  

 রাজস্থানের মহাযুদ্ধ 

======================
সম্রাট নাগভট্টের পত্র
================
৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমার্ধ। আরব ভূমির উমেদ খলিফার দ্বারা নিয়োজিত তাঁর ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান হামিরা আল হাকামের পত্র এসে উপস্থিত হলো গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট প্রথম নাগভট্টের রাজপ্রাসাদে। পত্রে লিখিত রয়েছে আরব খলিফার সেই বহু পুরাতন আদেশনামা, “হয় পবিত্র আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মহামান্য খলিফার প্রভুত্ব স্বীকার করে ভারতবর্ষে নিজ সাম্রাজ্য যেমন শাসন করছিলেন তেমনই শাসন করো, নতুবা খলিফা বাহিনীর তরবারির নিকট নিজ মাতৃভূমি, ধর্ম আর সংস্কৃতির ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করো”


খলিফার প্রধান সেনাপতির পত্র পাঠ করে যারপরনাই ক্ষিপ্ত হলেন সম্রাট প্রথম নাগভট্ট। সদুর আরবের ধুসর মরুভূমির অধিবাসী এক বিদেশি যবন হামিরার এতো স্পর্ধা যে স্বয়ং ইস্কভাকু সাম্রাজ্যের অধিপতি রঘুপতি রামচন্দ্রের স্মৃতিধন্য বহু শতাব্দী প্রাচীন ভারতবর্ষের ভূমিতে পদার্পণ করে সেই ভূমিরই সনাতন ধর্মাবলম্বী আদি অধিবাসীদের ভীতি প্রদর্শন করে নির্দেশ দান করছেন তাঁদের যবন ধর্ম গ্রহণ করে আরবের যবন খলিফার পদতলে আত্মসমর্পণ করবার। আল হাকামের পত্রটি পাঠ করবার পরে ক্ষিপ্ত সম্রাট নাগভট্ট নিজে পত্র প্রেরণ করলেন উত্তর ও মধ্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের শক্তিশালি সামন্ত এবং অনান্য স্বতন্ত্র রাজাদের। সেই ঐতিহাসিক পত্রে তিনি লিখলেন, ““শ্রবণ করুন আর্যগণ, আর্যবর্তের উত্তর আর পশ্চিম সীমান্তে বহুদূরের মরুভূমিবাসী বর্বর স্মেচ্ছ আরব জাতি বারবার আমাদের পবিত্র ভূমিতে উপদ্রব করছে। সিন্ধ, দেবল, সৌরাষ্ট্র, ভীনমল ও কান্যকুব্জের একাংশ সহ বহু ভারতীয় রাজার রাজত্ব বলপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে সেখানে সনাতন ধর্মের অবলুপ্তি ঘটিয়ে তারা তাঁদের স্মেচ্ছ ধর্মের প্রসার করছে, স্মেচ্ছরা আমাদের নারীহরণ করছে, আমাদের শতাব্দী প্রাচীন সভ্যতা আর সংস্কৃতির পরিচায়ক মন্দিরগুলি দূষিত করছে। আসুন আমার নেতৃত্বে আপনারা সকলে একত্রিত হয়ে এই বর্বর বিজাতীয় আরবদের, আরব সাগরের পরপারে খেঁদিয়ে দিয়ে আসি। আসুন আমরা সকলে একত্রিত হয়ে আর্তত্রান রূপ ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করে ভারতবর্ষের পবিত্রতা আর স্বতন্ত্রতা রক্ষা করি। বিজাতীয় আরবদের দেখিয়ে দেই ভারতীয় অসির শক্তি।”

সম্রাট নাগভট্টের এহেন আবেগপূর্ণ পত্র লাভ করে মানসিকভাবে উদবুদ্ধ হয়ে নিজেদের বিশাল সেনা সমেত অবন্তী নগরে সম্রাটের রাজসভায় এসে উপস্থিত হলেন শাকম্ভরীর সামন্তরাজ প্রথম বিগ্রহরাজ চৌহান (পৃথ্বীরাজ চৌহানের পূর্বপুরুষ), অবন্তির সামন্তরাজ জয়সিংহ বর্মা এবং চিতোরের মৌর্য বংশের রাজাদের সামন্ত সর্দার বাপ্পাদিত্য রাওয়াল (মেবারের গুহিলট রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা)।


বাপ্পা রাওয়ালের উত্থান
================
৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দের গ্রীষ্মকাল। বর্তমান মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নি নগরী। সেই গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কাল থেকেই ইতিহাসের পাতায় প্রসিদ্ধি লাভ করেছে সমৃদ্ধশালী এই প্রাচীন নগরী। উজ্জয়িনি নগরের উত্তরপ্রান্তে সুবিশাল উচ্চতার প্রস্তর দ্বারা নির্মিত শক্তিশালি প্রাকার দ্বারা বেষ্টিত সম্রাট নাগভট্টের সুরম্য শ্বেতপ্রস্তরের রাজপ্রাসাদ। সেই অতিকায় অট্টালিকার মোহনগৃহের অভ্যন্তরে একাধিক মশালের আলোয় আলোকিত সম্রাটের গুপ্ত মন্ত্রণা কক্ষে নিজ নিজ আসনে আসীন সব সামন্ত রাজারা বিধর্মী আরব খলিফার শক্তিশালি আগ্রাসনকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজেদের আসন্ন যুদ্ধাভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। একটি বিখ্যাত বাংলা প্রবাদ বাক্যে রয়েছে, অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। ক্রমে সামন্ত রাজাদের সেই আলোচনা, বাক-বিতণ্ডায় পরিণত হলো। বিজাতীয় বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানের পরিকল্পনা করবার পরিবর্তে ভারতের হিন্দু রাজন্যগণ নিজেরাই নিজেদের মধ্য তীব্র কলহ, বৈরিতা আর দোষারোপে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ঠিক এহেন সময়ে শিঙা ফুঁকে দুই স্বসস্ত্র দ্বাররক্ষী সম্রাট নাগভট্টের আগমনের কথা ঘোষণা করলেন।

ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্ত্রণাকক্ষে প্রবেশ করলেন সম্রাট। সম্রাটের দেহের রঙ শ্যামবর্ণ, মস্তক থেকে কাঁধ পর্যন্ত বিস্তৃত কুঞ্চিত ঘন কেশদাম, ওষ্ঠাধরের উপরে পুরুষ্টু বক্র গোঁফের রেখা, দুই কর্ণযুগলে দুলছে হীরক খচিত সুবর্ণ কুণ্ডল, কণ্ঠে মহার্ঘ্য রত্নহার। সম্রাটের সুদীর্ঘ দেহ সৌষ্ঠবের পুরু কবচের উপরে আচ্ছাদিত লৌহ জালিকা ভেদ করে তাঁর বলিষ্ঠ যৌবনের উদ্দাম শক্তি সমূহ যুক্ত মাংস পেশিগুলো যেন ঠেলে বাইরে উন্মুক্ত হতে চাইছে। সম্রাটের বাম হস্তের অঙ্গুলিগুলো সুদৃঢ় রূপে আঁকড়ে ধরে রয়েছে তাঁর কোমরবন্ধনীতে আবদ্ধ বিশালকায় তীক্ষ্ণধার অসির স্বর্ণখোচিত হাতল।


কক্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সম্রাট নিজের দক্ষিণ হস্ত উপরে উত্থোলিত করে বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বরে কক্ষে বাদানুবাদে ব্যস্ত সকল সামন্তরাজাদের শান্ত হবার আহ্বান জানালেন। কি যেন এক সম্মোহীনি জাদুমন্ত্র ছিল সম্রাটের আদেশে। মুহূর্তের মধ্যেই নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো মন্ত্রণাকক্ষ। এবারে সম্রাট নিজের সিংহাসনে আসীন হয়ে গুরু গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আর্যগণ আপনারা যদি এইভাবে প্রকাশ্যে নিজেদের মধ্যেই বৈরিতা, মনোমালিন্য আর উষ্মা প্রকাশ করেন তাহলে গুপ্তচর মারফৎ একবার আপনাদের এই অনৈক্যের সংবাদ স্মেচ্ছ যবন শিবিরে পৌঁছলে এর কি পরিনাম হবে সেটা উপলব্ধি করতে পারছেন ? আপনাদের অবস্থাও রাজা রাসিল, রাজা দাহির শাহ, হুলি শাহ আর উত্তর ভারতের অনান্য রাজনদের অনুরূপ হবে। আরব ভূমির বিধর্মী স্মেচ্ছদের ক্রীতদাসে পরিণত হবে রাজা রামচন্দ্রের স্মৃতিধন্য ভারতবর্ষ। আপনারা কি আরবের স্মেচ্ছ খলিফা বাহিনীর হাতে নিজ মাতৃভূমিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় দেখতে চান ?”


সম্রাটের প্রশ্ন শুনে নিজের আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন বিশ বছর বর্ষীয় এক তরুণ তরতাজা যুবক। তিনি নতমস্তকে সম্রাটকে অভিবাদন জানিয়ে বিনম্র কণ্ঠে বললেন, “আপনি সম্পূর্ণ সঠিক কথা বলেছেন মহামান্য সম্রাট। আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করছি। আপনি যদি এই অধমকে অভয় দান করেন তাহলে স্মেচ্ছদের বিরুদ্ধে আসন্ন মহাযুদ্ধের জন্য এমন এক পরিকল্পনার কথা জানাতে পারি যার সঠিক রুপায়নে হলে বিধর্মী স্মেচ্ছরা শোচনীয় রূপে পরাজিত হয়ে জীবিত অবস্থায় হয়ে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে পলায়ন মার্গের সন্ধান পাবে না।”

যুবকের দিকে ফিরে তাকালেন সম্রাট নাগভট্ট। যুবকের সুঠাম দেহ, তেজদৃপ্ত চাহনি আর পুরুষ্টু গুম্ফের অন্তরালে তাঁর ইস্পাতকঠিন মুখমণ্ডল দেখলে সহজেই উপলব্ধি হয় ইনি কোন সাধারন যুবা নন। নিশ্চিতরূপে ইনি একজন সুদক্ষ বীর যোদ্ধা। সম্রাট সেই যুবার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “কে আপনি ? নিজের পরিচয় দান করুন।” সম্রাটের প্রশ্নের জবাবে যুবা বিনম্র কণ্ঠে বললেন, “মহামান্য সম্রাট, এই অধমের নাম বাপ্পাদিত্য রাওয়াল। রঘুপতি রামচন্দ্রের সূর্যবংশীয় জাত গুহিলট বংশের ক্ষত্রিয় সন্তান আমি। যুদ্ধ আমার ধমনীর রক্তে প্রবাহিত হয়। বর্তমানে চিত্রকূট দুর্গের (চিতোর কেল্লা) অধিপতি মৌর্য (সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের মৌর্য বংশ নয়, রাজস্থানের মোরি বংশ) বংশের মহারাজ মনুরাজের প্রধান সেনাপতি হিসাবে কর্তব্যরত আমি। মহারাজের নির্দেশে আমি এখানে উপস্থিত হয়েছি স্মেচ্ছদের বিরুদ্ধে আসন্ন মহাযুদ্ধে আপনাকে সাহায্য দান করে ভারত ভূমিতে ধর্মের রক্ষার জন্য।”


সেনাপতি বাপ্পা রাওয়ালের বক্তব্য শ্রবণ করে সম্রাট নাগভট্ট প্রসন্ন চিত্তে বলে উঠলেন, “উত্তম, অতি উত্তম হে বীর যুবা। আপনি পেশ করুন আপনার যুদ্ধের পরিকল্পনা।” স্বয়ং সম্রাটের অভয়বাণী শুনে এবারে বাপ্পা রাওয়াল সর্ব সমক্ষে পেশ করলেন আসন্ন যুদ্ধে নিজের যুদ্ধের পরিকল্পনার কথা। সেই পরিকল্পনা ছিল একেবারে অপ্রচলিত। বাপ্পা রাওয়ালের এহেন যুদ্ধ পরিকল্পনা ইতিপূর্বে গ্রহণ করেননি সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বিখ্যাত মৌর্য রাজবংশ থেকে শুরু করে সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের গুপ্ত সাম্রাজ্য, সম্রাট গৌতমীপুত্র শতকার্নির সাতবাহন সাম্রাজ্য থেকে ভারতবর্ষের অনান্য পরিচিত এবং অপরিচিত রাজা এবং সম্রাটরা। বাপ্পা রাওয়ালের পরিকল্পনা শুনে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে পড়লেন স্বয়ং সম্রাট নাগভট্ট।


বাপ্পা রাওয়ালের যুদ্ধ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠলেন সভায় উপস্থিত অনান্য সামন্ত রাজারা। শাকম্ভরীর সামন্তরাজ প্রথম বিগ্রহরাজ চৌহান নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তীব্র অসন্তোষভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, “চিত্রকূটের সেনাপতির এহেন রণনীতি মেনে নেওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব মহামান্য সম্রাট। এই রণনীতি একেবারে ক্ষাত্রধর্মের বিপরীত। রামায়ণ আর মহাভারত আমাদের শত্রুর সম্মুখে দণ্ডায়মান হয়ে বীরের ন্যায় বুক চিতিয়ে লড়তে আর মরতে শিখিয়েছে। এইভাবে কাপুরুষের মতো অন্তরালে থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত করতে শেখায়নি। ক্ষমা করবেন সম্রাট চিত্রকূটের একজন সামান্য সেনাপতির এহেন কাপুরুষচিত রণনীতি গ্রহণ করতে আমরা অপারগ।”
বিগ্রহরাজ চৌহানের বক্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করে সমস্বরে প্রতিবাদে জানালেন সভায় উপস্থিত অনান্য সামন্তরাজারাও। সম্রাট নাগভট্ট পড়লেন ধর্ম সঙ্কটে। একদিকে চিত্রকূটের তরুণ সেনাপতি বাপ্পা রাওয়ালের এই অভূতপূর্ব রণনীতি তাঁর অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে, কিন্তু অপরদিকে বাপ্পা রাওয়ালের এই রণনীতির বিরুদ্ধে রয়েছে তাঁর সামন্ত রাজাদের তীব্র অসন্তোষ। সামন্ত রাজাদের অসন্তোষ আর ক্ষোভ প্রশমিত করে সকলকে একসূত্রে আবদ্ধ করতে এক নয়া কূটনৈতিক চাল গ্রহণ করলেন তিনি।



মৃগয়া ভূমিতে নয়া যুদ্ধনীতির ঘোষণা
==========================
এই ঘটনার দিন কয়েক পরে দেখা গেল উজ্জয়িনির প্রাসাদে অবস্থানরত সকল সামন্ত রাজা আর সেনাপতিদের নিয়ে সম্রাট যাত্রা করলেন মৃগয়া অভিযানে। তৎকালীন সময়ে এহেন রাজকীয় মৃগয়া যাত্রা খুবই স্বাভাবিক ব্যপার ছিল। জঙ্গলে শিকার অভিযানের সময় এক অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হলেন তাঁরা। একরাতে বাঘ শিকারের উদ্দেশ্যে গহন অরণ্যের অভ্যন্তরে একটি বিশাল বৃক্ষের উপর মাচা বেঁধে মশালের আলোয় তির ধনুক হস্তে শিকারের উদ্দেশ্যে নীরবে অপেক্ষারত ছিলেন সম্রাট নাগভট্ট, রাজা বিগ্রহরাজ এবং জয়সিংহ বর্মা। কিছুক্ষণ পরেই সামনের ঝোপগুলো প্রবলভাবে দুলতে শুরু করলো। হিংস্র নরখাদক শার্দূলের উপস্থিতি টের পেয়ে সজাগ হলেন শিকারিগণ। এমন সময় তাঁদের বিস্ময়াচকিত করে ঝোপের অন্তরাল থেকে দ্রুতগতিতে আত্মপ্রকাশ করলো এক শজারু। শজারুটি বাঁদিকের ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে ডান দিকের ঝোপের দিকে ছুটতে শুরু করলো। কিন্তু শজারুটি তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনোর পূর্বেই বজ্রের ন্যায় ভয়ানক গর্জন করে ঝোপের মধ্যে থেকে এক বিশাল লম্ফ প্রদর্শন করে আত্মপ্রকাশ করলো একটি বিশালকায় ব্যাঘ্র। বাঘটি শজারুর পথরোধ করে দাঁড়িয়ে তাকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি নিতে লাগলো। ঠিক এমন সময় উল্টোদিকের ঝোপের মধ্যে থেকে একটি শম্বর হরিণের মৃদু ধ্বনির আওয়াজ শুনতে পেয়ে শজারুর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সেইদিকে নিজ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বাঘ মহাশয়। বাঘটির এইটুকু অন্যমনস্কতার সুযোগের সম্পূর্ণ সদবহার করে বিপদগ্রস্ত শজারুটি ধনুকের ছিলা থেকে নিক্ষিপ্ত তিরের ন্যায় দ্রুতগতিতে তার প্রবল শত্রুর দিকে ধেয়ে গিয়ে নিজের সর্বশক্তি একত্রিত করে তীক্ষ্ণধার কণ্টকাকীর্ণ শরীরের সাহায্যে প্রবলবেগে আঘাত করলো বাঘের শরীরে। রক্তাক্ত হয়ে উঠলো বাঘের শরীর। এরপর শজারুটি উপরর্যপুরি আরও বার দুয়েক আঘাত করতেই রক্তাক্ত ও আহত বাঘটি কিছুটা ভীত ও বিস্মিত হয়ে আপাতত রণে ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন করলো।


এই দুর্লভ ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে বিস্মিত হলেন শিকারিগণ। ঠিক তখনই নিজের সিদ্ধান্ত স্থির করে নিলেন সম্রাট। পরেরদিন নিজেদের অরন্যে শিবিরের সভায় বসে সম্রাট নাগভট্ট তাঁর সামন্ত রাজাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “আশাকরি আপনারা কাল রাতে বাঘ আর শজারুর অসম যুদ্ধযাত্রা প্রত্যক্ষ করেছেন। এই অসম দ্বন্দ্বযুদ্ধ থেকে কি শিক্ষা গ্রহণ করলেন আপনারা ?” সম্রাটের প্রশ্নের কোন যুৎসই জবাব দান করতে পারলেন না তাঁর সামন্তরাজারা। শেষে সম্রাট নিজেই বলে উঠলেন, “গতকালের বাঘ বনাম শজারুর দ্বন্দ্বযুদ্ধ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে ক্ষাত্র ধর্ম পালন করে সবসময় প্রবল শত্রুর বিপক্ষে সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে আসীন হলে জয়লাভ সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু শজারুর ন্যায় কূট এবং কৌশলী অপ্রচলিত রণনীতি গ্রহণ করে শত্রুকে তার অসতর্ক মুহূর্তে আক্রমণ করলে, নিজে অতিরিক্ত ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন না হয়েও প্রবল শত্রুকে অনায়াসে পরাজিত ও বিতাড়িত করা সম্ভব। এমনকি সেদিন আপনারা যে রামায়ণ, মহাভারতের যুদ্ধনীতির অজুহাত প্রদর্শন করছিলেন সেই রামায়ণ আর মহাভারতেই নির্দেশিত রয়েছে যদুপতি দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণের সেই অমোঘ বাণী, অধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে ধর্মের সংস্থাপনা করবার জন্য সাম-ধাম-দণ্ডভেদ যে কোনো রণনীতিই গ্রহণ করা সম্পূর্ণ বৈধ। শ্রীকৃষ্ণের এই অমোঘ বানীরই প্রতিরূপ আমরা খুঁজে পাই বিখ্যাত মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রতিষ্ঠাপক আচার্য চাণক্যের অর্থশাস্ত্রেও। আমি গুহিলট সেনাপতি বাপ্পা রাওয়ালের নয়া রণনীতির সাথে সম্পূর্ণ একমত। এই মুহূর্তেই আরবের স্মেচ্ছদের বিরুদ্ধে আসন্ন মহাযুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত ভারতীয় বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসাবে আমি বাপ্পা রাওয়ালের নাম ঘোষণা করছি। এবারে আপনারা বলুন আপনাদের কি মতামত ?”
সম্রাটের বক্তব্যের পর চোখ খুলে গেল সকলের। এরপর সর্ব সম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হলো বাপ্পা রাওয়ালের নয়া রণনীতি আর সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসাবেও নিযুক্ত হলেন তিনি।


খলিফা শিবিরে মতভেদ
=================
৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসের মাঝামাঝি সময়। সমগ্র রাজস্থান জুড়ে গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহে অস্থির স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দ থেকে ভূস্বামী আর রাজন্যবর্গও। ঠিক এহেন সময়ে সিন্ধ প্রদেশের পূর্ববর্তী রাজধানি বামনাবাদ বা ব্রাহ্মণ্যবাদের নগরে রাজা দাহির শাহের অধিকৃত রাজপ্রাসাদে অবস্থানরত উমেদ খলিফার তিন প্রধান আরবি হামিরা তামিম-ইবান-জইদ-আল-উঠবি, জুনেদ-ইবান-আবদুল্লা-রেহমান-আল-মুয়ারি আর আল-হাকাম ইবান-আওয়ানা শিবিরে এসে পৌঁছল গুর্জর-প্রতিহার সম্রাট নাগভট্টের জবাবি পত্র। সেই পত্রে লিখিত রয়েছে, “আরবের ভিনদেশি বিধর্মী স্মেচ্ছ যবনদের প্রতি গুর্জর সম্রাট নাগভট্টের কঠোর আদেশ। নিজেদের প্রাণ এবং সম্মান রক্ষা করতে ইচ্ছুক হলে এই পত্র আপনাদের শিবিরে পৌঁছনোর সাথে সাথেই অবিলম্বে নিজেদের শিবির ভঙ্গ করে ভারতবর্ষের পবিত্র ভূমি পরিত্যাগ করে আরব সাগরের পরপারে নিজেদের ধূলি ধূসরিত মরুপ্রান্তরে প্রত্যাবর্তন করুন, অন্যথায় আদেশ অমান্য করলে বেদনাদায়ক মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করুন। আদেশ পালনের জন্য আরবের স্মেচ্ছদের দুই মাস সময়দান করা হলো।”

সম্রাট নাগভট্টের এই পত্র পাঠ করবার পর মতান্তর দেখা দিল আরব শিবিরে। নিজেদের পরিচিত ভূমি থেকে সহস্র মাইল দূরে ভারতবর্ষের অজানা প্রান্তরে এই প্রবল গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যে অপরিচিত প্রবল শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার বিরুদ্ধে অনীহা প্রকাশ করলেন আরব সেনাপতি তামিম-ইবান-জইদ-আল-উঠবি। কিন্তু ভারতবর্ষের বুক থেকে বহু শতাব্দী প্রাচীন সনাতন ধর্ম আর সভ্যতাকে উপড়ে ফেলে ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠা করে উমেদ খলিফার শাসন কায়েম করবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আল-হাকাম ইবান-আওয়ানা বেঁকে বসলেন। তাঁকে সমর্থন করে বসলেন আরেক আরব সেনাপতি জুনেদ-ইবান-আবদুল্লা-রেহমান-আল-মুয়ারি। শেষপর্যন্ত হামিরা আল হাকামের নেতৃত্বে আরব বাহিনী সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্তই গ্রহণ করে আরেকটি পাল্টা পত্র প্রেরণ করলেন উজ্জয়িনিতে সম্রাটের দরবারে।


“হিন্দের কাফের সম্রাটের প্রতি মহামান্য খলিফার সমাচার। আপনি খলিফার আদেশ অমান্য করে নিজেকে মহামান্য আল্লাহর নিকটে সমর্পণ না করে সমগ্র হিন্দের অবস্থা ঘোর সঙ্কটাপন্ন করে তুললেন। এবারে আল্লাহর রোষানলে সম্পূর্ণ রূপে ভস্মীভূত হবে আপনার সাম্রাজ্য। সেই পবিত্র দিনের আর অধিক বিলম্ব নেই যেদিন খলিফার বাহিনী আপনার রাজধানি উজ্জয়নি নগরে প্রবেশ করে আপনার শিরচ্ছেদ করে আপনারই রাজমহলের শীর্ষদেশে খলিফা সাম্রাজ্যের অর্ধ চন্দ্র অঙ্কিত শ্যামবর্ণ ধ্বজ উড্ডীন করবে আর আপনাদের প্রধান উপাসনাস্থল মহাকালেশ্বর মন্দিরকে একটি প্রসিদ্ধ মসজিদে রূপান্তরিত করবে।”
আরব সেনাপতিদের প্রেরিত চরম ওৌধত্বপূর্ণ পত্রটি পাঠ করে সম্রাট নাগভট্ট বুঝতে পারলেন বিনাযুদ্ধে এক সুচাগ্র মেদিনীও ছাড়বে না আরবদেশের স্মেচ্ছ যবনরা। অতএব তিনি এবারে পূর্ণদমে শুরু করলেন আসন্ন মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি।


অল্প কিছুদিনের ব্যবধানেই দেখা গেল সম্রাট নাগভট্টের গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্যের ধ্বজের প্রতিক তলে গুহিলট সেনাপতি বাপ্পা রাওয়ালের নেতৃত্বে সমবেত হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার সেনার এক সুবিশাল চতুরঙ্গ সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনী। সংযুক্ত বাহিনীর প্রথম স্থরে ছিল ধনুকধারী তিরন্দাজ বাহিনী, দ্বিতীয় স্থরে ছিল অসি আর বিশালকায় ভল্লধারী অগ্রিমপন্থী পদাতিক সেনা, তৃতীয় স্থরে ছিল দ্রুতগামীর অশ্বারোহী বাহিনী এবং অন্তিম স্থরে ছিল দৈত্যাকার রণহস্তীর পৃষ্ঠে আসীন গজবাহিনী। যুদ্ধযাত্রার পূর্ববর্তী রাতে উজ্জয়িনি নগরে মশালের আলোয় প্রজ্বলিত সম্রাটের রাজপ্রাসাদের গুপ্ত মন্ত্রণাকক্ষে এসে উপস্থিত হলেন এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। কক্ষে প্রবেশ করে তিনি যুক্তকর হস্তে সম্রাটকে শ্রদ্ধাপূর্বক প্রণাম নিবেদন করলেন। সম্রাট নাগভট্ট সেই ব্যক্তির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রসন্ন চিত্তে বলে উঠলেন, “বলো গুপ্তচর মিহিরভট্ট আরবের স্মেচ্ছ বাহিনীর গতিবিধি সম্বন্ধে কি সংবাদ এনেছো।”


গুপ্তচর মিহিরভট্ট বিনম্র কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আজ্ঞে সম্রাট আরবের খলিফা বাহিনীর তিন প্রধান হামিরা জুনেদ-ইবান-আবদুল্লা, আল-হাকাম ইবান-আওয়ানা আর রেহমান-আল-মুয়ারির মধ্যে তীব্র মত পার্থক্য দেখা গিয়েছে। হামিরা তামিম-ইবান-জইদ-আল-উঠবি এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি তাঁর বিশ হাজার খলিফা সেনা সমেত বামনাবাদ নগরেই অবস্থান করবেন। অপরদিকে বাকি দুই হামিরা আল-হাকাম ইবান-আওয়ানা আর জুনেদ-ইবান-আবদুল্লা-রেহমান-আল-মুয়ারি তাঁদের অবশিষ্ট সেনা সমেত মুলতান হয়ে গুর্জরাত্র রাষ্ট্রের (বর্তমান রাজস্থান আর গুজরাট) দিকে অগ্রসর হবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।”

গুপ্তচরের সংবাদ শুনে সম্রাট নাগভট্ট পুনরায় প্রশ্ন করলেন, “এই মুহূর্তে খলিফার স্মেচ্ছ বাহিনীর সেনা সংখ্যা কত ?”
সম্রাটের প্রশ্নের উত্তরে মিহিরভট্ট বলে উঠলেন, “হুজুর স্মেচ্ছ বাহিনীতে রণহস্তী সম্বলিত কোন গজবাহিনীর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু হামিরা তামিম-ইবান-জইদ তাঁর সেনা সমেত এই যুদ্ধে অংশহগ্রহন না করলেও বাকি দুই হামিরার পদাতিক, তিরন্দাজ আর অশ্বারোহী বাহিনী মিলিয়ে খলিফা বাহিনীর সংখ্যা কমকরেও ৫৫-৬০ হাজারের মতো হবে।”


গুপ্তচরের মুখ নিঃসৃত সংবাদ শুনে সম্রাট যারপরনাই খুশি হয়ে বলে উঠলেন, “উত্তম, অতি উত্তম সংবাদ। রাজপ্রহরী অবিলম্বে গুপ্তচর মিহিরভট্টকে তাঁর মহামূল্যবান সংবাদের জন্য এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার প্রদান করে রাজ অতিথিশালায় ওনার বিশ্রামের ব্যবস্থা করো।”
সম্রাটের খুশি হবার কারণ হলো তাঁর প্রধান সেনাপতি বাপ্পা রাওয়ালের রণ পরিকল্পনা অনুযায়ীই সবকিছু চলছে। ইতিমধ্যেই রণনীতির প্রথম ধাপ অনুসরণ করে সম্রাট নাগভট্টের নির্দেশে গুর্জররাত্রের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের সমস্ত জনপদ লোকশূন্য করে সেখানকার অধিবাসী প্রজাগণকে উজ্জয়নি আর নিকটবর্তী সংলগ্ন এলাকায় সসম্মানে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে। গুর্জররাত্রের জনশূন্য উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের সমস্ত জলাশয়ে মিশ্রিত করা হয়েছে প্রাণঘাতী ভয়ানক বিষ। সম্রাটের সেনারা জনপদের সব খাদ্যভাণ্ডার শূন্য করে সমস্ত শস্য আর খাদ্যদ্রব্য অনত্র স্থান্তরিত করেছে। অগ্নি সংযোগ করে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দেওয়া হয়েছে শস্য-ক্ষেত।
#SR

বেজে উঠলো যুদ্ধের দামামা
====================
পরেরদিন প্রত্যূষে দেখা গেল উজ্জয়নি নগরীর প্রাসাদ কেল্লার অনতিদূরে অস্ত্রশস্ত্র সমেত যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে আরবের খলিফা বাহিনীর বিরুদ্ধে আসন্ন মহাযুদ্ধের যাত্রায় জন্য প্রস্তুত ভারতবর্ষের সুবিশাল সংযুক্ত বাহিনী। কিছুক্ষণের মধ্যেই সংযুক্ত সেনাবাহিনীর সম্মুখে ঢোলক বাজাতে বাজাতে এসে হাজির হলো রাজকীয় বাদ্যকারের দল, তাঁদের পেছনে নিজের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী দ্বারা পরিবৃত হয়ে লৌহপাত আর বর্ম দ্বারা আচ্ছাদিত রাজকীয় রণহস্তীর পৃষ্ঠের হাওদায় আসীন হয়ে উপস্থিত হলেন সম্রাট নাগভট্ট। সম্রাটকে দেখতে পেয়ে প্রধান সেনাপতি বাপ্পা রাওয়াল তাঁর কোষবদ্ধ তরবারি উন্মুক্ত করে শূন্যে উত্থোলিত করে ব্যাঘ্র গর্জনে “হর হর মহাদেব” রণহুংকার দিয়ে উঠলেন। সূর্যালোকে ঝলমল করে উঠলো বাপ্পা রাওয়ালের তরবারির তীক্ষ্ণধার ফলা। প্রধান সেনাপতিকে অনুসরণ করে অবশিষ্ট সৈন্যগণও বজ্র কণ্ঠে “হর হর মহাদেব” শ্লোগান দিয়ে উঠলেন।


নিজের রণহস্তীর পৃষ্ঠদেশ থেকে ভূমিতে অবতরণ করে সম্রাট নাগভট্ট এবারে সংযুক্ত বাহিনীর দিকে নিজের তেজদৃপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বজ্রকঠিন কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আমার প্রিয় সেনাপতি, সামন্ত রাজণগণ আর সেনারা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সম্ভবত ভারতবর্ষের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এক যুদ্ধযাত্রা শুরু করতে চলেছি। শ্রবণ করুন প্রিয় আর্যগণ, ইতিপূর্বেও আপনারা হয়তো নিজ নিজ রাজ্যের বাহিনীর হয়ে একাধিকবার বিভিন্ন যুদ্ধযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু সেসব যুদ্ধযাত্রা ছিল নেহাতই আপনাদের নিজ নিজ রাজ্যের স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে, নিজ নিজ রাজ্যের সীমানার পরিধি বৃদ্ধি আর ক্ষমতা প্রদর্শনের তাগিদে। কিন্তু আজ আপনারা সদুর আরবদেশের এক বহিরাগত শক্তিশালি স্মেচ্ছ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চলেছেন অখণ্ড ভারতবর্ষের বহু শতাব্দী প্রাচীন সনাতন বৈদিক সভ্যতা, ধর্ম আর সংস্কৃতির রক্ষার জন্য, নিজের মাতৃভূমির স্বতন্ত্রতা রক্ষার জন্য, অখণ্ড ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক স্বর্ণোজ্বল যুগ উপহার দেবার জন্য। আর্তত্রানের এই মহাযুদ্ধে আপনাদের নিজ নিজ জাতিসত্ত্বা বিস্মৃত হয়ে ভারতবর্ষের পবিত্র ভূমি থেকে বিধর্মীদের বিনাশ করে ধর্মের স্থাপনা করে লক্ষ লক্ষ অসহায় দেশবাসীকে উদ্ধার করতে হবে আরবের স্মেচ্ছদের অন্যায় আর উৎপীড়নের হাত থেকে, বৈদিক সভ্যতাকে রক্ষা করতে হবে বিনাশের হাত থেকে। আসুন এইক্ষণে আমরা সকলে মিলে প্রতিজ্ঞা করি যে এই আসন্ন মহাযুদ্ধে আরবের খলিফা বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে খেঁদিয়ে দিয়ে আসবো বিস্তীর্ণ আরব সাগরের পরপারে ওদের ধূলি ধূসরিত মরুপ্রান্তরে।” এই পর্যন্ত বলে সম্রাট নাগভট্ট নিজের অসি কোষমুক্ত করে শূন্যে উত্থোলিত করে গর্জন করে উঠলেন, “হর হর মহাদেব।”
সম্রাটকে অনুসরণ করে সংযুক্ত বাহিনীর সেনারাও ভৈরব কণ্ঠে "হর হর মহাদেব" রবে রণহুংকার দিয়ে উঠলো।


খলিফা বাহিনীর যুদ্ধযাত্রা এবং ভারতীয় বাহিনীর ফাঁদ
======================================
এদিকে ভরা গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যে খলিফা বাহিনী মুলতান হয়ে প্রবেশ করলো গুর্জররাত্র প্রদেশে। ক্রমে তাঁরা এসে উপস্থিত হলো মাউন্ট আবুর নিকটে এক বর্ধিষ্ণু জনপদে। দীর্ঘ পথশ্রম আর তীব্র দাবদাহে ইতিমধ্যেই বেশ পরিশ্রান্ত হয়ে উঠেছে খলিফা বাহিনী। খলিফা বাহিনীর রসদে দেখা দিয়েছে জল আর খাদ্যের অভাব। হামিরা আল-হাকাম মনে মনে ভেবেছিলেন এইসব স্থানীয় জনপদের মধ্যে প্রবেশ করে নিজের সেনা দ্বারা বলপূর্বক লুণ্ঠন করবেন স্থানীয় কাফের অধিবাসীদের শস্যভাণ্ডার আর যাবতীয় ধন সম্পদ। কিন্তু এতো একেবারে বিধিবাম। পুরোপুরি জনশূন্য জনপদ একেবারে খাঁখাঁ করছে। লোকালয়ের আবাসনগুলিও একেবারে শূন্য, রসুইখানা এবং ভাঁড়ার ঘরে মজুদ নেই কোন খাদ্য শস্য, আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে ক্ষেত-খামার। এমনকি জনপদে অস্তিত্ব নেই কোন গবাদি পশুরও। ব্যপারটা প্রত্যক্ষ করে বেশ হতাশ হয়েই সেই নিঃস্ব আর রিক্ত জনপদ ত্যাগ করতে বাধ্য হলো খলিফা বাহিনী। এগিয়ে চললো উদয়পুরের দিকে। পথে পড়লো আরেকটি জনপদ। কিন্তু খলিফা বাহিনী সেই জনপদের ভেতরেও প্রবেশ করে দেখতে পেলো পূর্বের ন্যায় অনুরূপ দৃশ্যাবলী। এবারে নিরুপায় হয়ে পড়লো ক্ষুধার্ত আর প্রবল তৃষ্ণার্ত খলিফা সেনারা। সেনাবাহিনীর জনাকয়েক রক্ষী সেই পরিত্যাক্ত জনপদের একপ্রান্তে অবস্থিত একটি বিশাল সরোবর দেখতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। মনপ্রান ভরে আকণ্ঠ পান করলো সরোবরের পানীয় জল। কিন্তু জলপানের অল্প বিলম্বে তাদের শরীরে দেখা দিল তীব্র বিষের ক্রিয়া। সরোবরের জলে মিশ্রিত বিষের প্রভাবে মৃত্যুর মুখে পতিত হলো সেই রক্ষীরা। পানীয় জলের সন্ধান পাবার পর উৎফুল্ল খলিফা বাহিনীর উল্লাস কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিণত হলো বিষাদে। খলিফা বাহিনীর এক বরিষ্ঠ পদাধিকারি সেনা সন্ত্রস্তভাবে দুই হামিরা আল-হাকাম আর রেহমান-আল-মুয়ারির নিকটে এসে আবেদন জানালেন সিন্ধে ফিরে যাবার। কিন্তু সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে পবিত্র ইসলামিক সাম্রাজ্য স্থাপনের খোয়াব দেখা আল-হাকাম তীব্র ভর্ৎসনা করে তাঁকে নিরস্ত্র করে ভারতবর্ষের আরও দক্ষিণপ্রান্তে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন।


কায়দারার গিরিঘাটে প্রথম সংঘর্ষ
========================
ক্ষুধা আর তৃষ্ণা নিয়েই আল-হাকাম আর রেহমান-আল-মুয়ারির নির্দেশে তাঁরা যাত্রা শুরু করলেন গুর্জররাত্রের আরও দক্ষিণ প্রান্তে। সর্বাগ্রে চলেছে ঢোলক আর শিঙাধারী বাদ্যকার দ্বারা পরিবেষ্টিত চাঁদ-তাঁরা অঙ্কিত শ্যামবর্ণ ঝাণ্ডা আর শ্বেতকায় হরফে কলমা অঙ্কিত কৃষ্ণবর্ণ ধ্বজধারী অগণিত পদাতিক বাহিনী, তারপরের সারিতে অশ্বের পৃষ্ঠে আসীন দুই হামিরা সহ ঈদের চাঁদের ন্যায় বক্র তরবারি আর বিশাল ভল্লধারী ঘোড়সওয়ার বাহিনী আর অন্তিম সারিতে রয়েছে তিরন্দাজ বাহিনী। “আল্লাহ-আকবর” ধ্বনিতে চতুর্দিক আলোড়িত করতে করতে একসময় খলিফা বাহিনী তাঁদের সুবিশাল লস্কর সমেত মন্দ্র গতিতে এসে উপস্থিত হলো মাউন্ট আবুর পাদদেশে কায়দারা নামক এক সঙ্কীর্ণ গিরিঘাটে। অতি সন্তর্পণে খলিফা বাহিনী যখন কায়দারা গিরিঘাট অতিক্রম করছে ঠিক এহেন সময়েই গিরিঘাটের দুই বিপরীত প্রান্ত থেকে উঠলো প্রবল ভৈরবধ্বনি, “হর হর মহাদেব, জয় একলিঙ্গনাথ”। তারপরেই গিরিঘাটের দুই প্রান্ত থেকে ধেয়ে এলো কাতারে কাতারে তির। সেইসব তীক্ষ্ণধার শরশয্যার আঘাতে মুহূর্তের মধ্যেই রক্তাপ্লুত অবস্থায় ধরাশায়ী হলো ইসলাম আর খলিফা সাম্রাজের ঝাণ্ডাবাহী বেশ কিছু আরবি সেনা আর বাদ্যকর, ভূলুণ্ঠিত হলো অর্ধ চন্দ্র আর কলমা অঙ্কিত ঝাণ্ডা। এছাড়াও তিরের আঘাতে গুরুতর আহত ও নিহত হলো খলিফা বাহিনীর আরও বহু পদাতিক সেনা। এরপর প্রাথমিক আঘাতটা সামলে নিয়ে খলিফা সেনারা নিজেদের বর্মাবৃত শরীরকে শক্তিশালি লৌহ ঢালের অন্তরালে আত্মগোপন করলো। এদিকে বাপ্পা রাওয়ালের রণ পরিকল্পনা অনুযায়ী খলিফা বাহিনীকে মধ্যপথে স্বাগত জানানোর জন্য, কায়দারা গিরিঘাটের দুই প্রান্তে আরাবল্লি পাহাড়ের অন্তরালে নিজের সেনা সমেত আত্মগোপন করে অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত ছিল সামন্তরাজ জয়সিংহ বর্মা। খলিফা বাহিনীকে এই পথে অগ্রসর হতে দেখে তিনি তাঁর তিরন্দাজদের নির্দেশ দিলেন তির বর্ষণের। জয়সিংহের তিরন্দাজ বাহিনীর শরাঘাতে বিস্ময়ে হতচকিত আরব বাহিনী যখন কিংকর্তব্য বিমুঢ় হয়ে পড়েছে তখন আপাদমস্তক পুরু লৌহবর্ম দ্বারা আবৃত, লৌহ শিরস্ত্রাণ পরিহিত রাজা জয়সিংহ একটি দ্রুতগতির অশ্বেপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে নিজের তরবারি শূন্যে উত্থোলিত করে “জয় একলিঙ্গনাথ” রবে সরব হয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তিরবেগে ধেয়ে গেলেন নিচে খলিফা বাহিনীর দিকে। রাজা জয়সিংহকে অনুসরণ করে তাঁর অবশিষ্ট অশ্বারোহী বাহিনীও প্রবলবেগে ধেয়ে গেলেন খলিফা বাহিনীর দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গিরিঘাটে শুরু হলো রাজপুত বাহিনী এবং খলিফা বাহিনীর এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। জয়সিংহ আর তাঁর দুর্দমনীয় বাহিনীর অসির আঘাতে মৃত্যুমুখে পতিত হলো বেশকিছু খলিফা সেনা। এদিকে ক্ষুদ্র রাজপুত বাহিনীর প্রাথমিক আঘাতটা সামলে নিয়ে এবারে পাল্টা প্রত্যাঘাত শুরু করলো খলিফা বাহিনীও। কিন্তু ততক্ষণে রণ পরিকল্পনা সফল হয়েছে জয়সিংহের। তিনি তাঁর বাহিনীর উদ্দেশ্যে সঙ্কেত দিলেন রণে ভঙ্গ দিয়ে পিছু হটার। জয়সিংহের নির্দেশ পেয়েই তাঁর বাহিনী দ্রুতগতিতে অশ্ব চালনা করে পিছিয়ে গেলেন আরও দক্ষিণপ্রান্তে।


এদিকে রাজা জয়সিংহের এই কৌশলী পশ্চাৎপশরনকে হিন্দুস্থানের কাফের বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজেদের বিজয় বলে ভ্রম করে প্রবল উত্তেজিত হয়ে হামিরা আল-হাকাম জোরালো কণ্ঠে আদেশদান করলেন, “পিছু ধাওয়া করো শয়তান কাফের বাহিনীর। একজন কাফেরও যেন জীবিত পালাতে না পারে।” আল-হাকামের আদেশ শুনে জয়সিংহ আর তাঁর পলাতক বাহিনীর পিছু ধাওয়া করলো খলিফা বাহিনী। কিছুক্ষণের মধ্যেই খলিফা বাহিনী এসে উপস্থিত হলো বর্তমান উদয়পুর শহরের নিকটে দুই দিকে আরাবল্লি পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত একটি বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তরে। এদিকে সূর্য তখন পশ্চিমপ্রান্তের দিকচক্রবালে ঢলে পড়ছে। সন্ধ্যে নামতে আর অধিক বিলম্ব নেই। সম্পূর্ণ অপরিচিত শত্রুভূমিতে আর অগ্রসর হওয়া উচিত হবে না উপলব্ধি করতে পেরে সেই উন্মুক্ত প্রান্তর থেকে কিছুটা দূরে নিজেদের শিবির স্থাপন করলো খলিফা বাহিনী।


খলিফা বাহিনীর দুঃস্বপ্নের রাত
======================
এদিকে সেই প্রান্তরের ওপরদিকে নিজেদের শিবির স্থাপন করে খলিফা বাহিনীকে স্বাগত জানানোর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল সম্রাট নাগভট্টের বাহিনী। সন্ধ্যের মুখে রাজা জয়সিংহ যুদ্ধের পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁর প্রাথমিক কর্তব্য সম্পন্ন করে ফিরে এলেন সম্রাট নাগভট্টের সেনা শিবিরে। তাঁর মুখে সম্রাট আর সেনাপতি বাপ্পা রাওয়াল শুনলেন সব বিবরণ। এরপর শুরু হলো সংযুক্ত বাহিনীর দ্বিতীয় পরিকল্পনার রুপায়ন। সন্ধ্যে নামবার সাথে সাথেই সম্রাটের তাঁর সংযুক্ত বাহিনীর রাজকীয় বাদ্যকারদের নির্দেশ দিলেন প্রবল ধ্বনি সহকারে শুরু করলো ঢাক-ঢোল বাজানোর আর শিঙা ফোঁকার। এদিকে বাপ্পা রাওয়ালের নির্দেশে তাঁর চিত্রকূটি সেনারা খলিফা বাহিনীর শিবিরের নিকটে অরন্য থেকে প্রচুর পরিমাণে সংগ্রহ করে আনা শুকনো ঘাসপাতা আর কাঠ জ্বালিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তীব্র কৃষ্ণবর্ণ কটু ধূম্ররাশিতে ছেয়ে গেল খলিফা বাহিনীর শিবিরের চতুর্দিক। এমনিতেই গ্রীষ্মের নিদারুণ দাবদাহে পানীয় জলের অভাবে চাতকপাখির ন্যায় যারপরনাই তৃষ্ণার্ত ছিল খলিফা বাহিনী, এরপর রাজপুত বাহিনীর দ্বারা সৃষ্ট অগ্নিকুণ্ডের ধূম্ররাশির প্রভাবে তাঁদের অবস্থা হয়ে উঠলো আরও মর্মন্তুদ। কণ্ঠনালি শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেল, নিশ্বাস-প্রশ্বাস নিতে অসম্ভব পিড়া বোধ হচ্ছিল আর সেইসাথে শুরু হলো শুকনো কাশির জালা। কোনরকমে বস্ত্রখণ্ড দিয়ে নিজেদের মুখমণ্ডল আবৃত করে শিবির ত্যাগ করে বাইরে বেরিয়ে এলো দুই হামিরা সহ খলিফা বাহিনীর সেনারা। এমন সময় সম্রাট নাগভট্টের নির্দেশে তাঁর সেনাবাহিনীর রাজকীয় বাদ্যকররা শুরু করলো ভৈরব ধ্বনিতে ঢাক-ঢোল বাজানো আর শিঙা ফোঁকা। সারারাত ধরে চললো কর্ণ বিদারক সেই বাদ্যকরদের তাণ্ডব লীলা। খলিফা বাহিনীর অবস্থা হলো অনেকটা খাঁচায় বন্দি অসহায় পশুর ন্যায়।
#SR

সারারাত ধরে সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর তাণ্ডবে নিদ্রাহীন খলিফা বাহিনীর শিবিরে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠলো। তাঁরা আল্লাহর নিকট সনির্বদ্ধ রূপে প্রার্থনা করতে লাগলেন সূর্য উদয়ের। পরেরদিন ভোরের আলো প্রস্ফুটিত হবার সাথে সাথেই হামিরা আল-হাকাম আর রাহমান-আল-মুয়ারি মরিয়া হয়ে তাঁদের বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন হিন্দের কাফের বাহিনীকে আক্রমণ করবার। এদিকে ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত আর নিদ্রাহীন খলিফা বাহিনীর অবস্থা তখন রীতিমতো শোচনীয়। তবুও হামিরাদের নির্দেশে সম্মুখপানে অগ্রসর হলো খলিফা বাহিনী। কিছুদূর গিয়ে তিনদিক আরাবল্লি পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত সেই উন্মুক্ত প্রান্তরে উপস্থিত হয়ে খলিফা বাহিনী দেখতে পেলো তাঁদের স্বাগত জানানোর জন্য সেখানে অপেক্ষা করছে এক বিশাল ভারতীয় বাহিনী। সংযুক্ত বাহিনীর প্রথমভাগের পদাতিক সেনাদের সাথে রয়েছে বেশ কয়েকটা বিশালাকৃতি দড়ির কপিকল। তাঁদের নেতৃত্বদান করছেন শাকম্ভরীর সামন্তরাজ প্রথম বিগ্রহরাজ চৌহান আর কায়দারা গিরিপথের অতর্কিত আক্রমণকারী অবন্তির সামন্তরাজ জয়সিংহ। রাজা জয়সিংহকে দেখেই যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়ে হামিরা আল-হাকাম তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে হামলা করার।

রাজস্থানের মহাযুদ্ধ শুরু
==================
ভারতীয় বাহিনীর বাদ্যকররাও তুড়ি, ভেড়ি আর দুন্দুভি বাজিয়ে মহাযুদ্ধের আরম্ভের ঘোষণা করলেন। জোরালো শব্দে “আল্লাহ-আকবর” ধ্বনিতে চতুর্দিক আন্দোলিত করে ভারতীয় বাহিনীর দিকে ধেয়ে এলো খলিফা বাহিনীর পদাতিক সেনারা। খলিফা বাহিনীর পদাতিক সেনাদের ধেয়ে আসতে দেখেই নিজের সেনাদের উদ্দেশ্যে ইশারা করলেন রাজা জয়সিংহ। তাঁরা দড়ির কপিকলগুলো ধরে টান মারতেই সামনের প্রান্তরের উপর থেকে সরে গেল ঘাসপাতা। মুহূর্তের মধ্যেই উন্মুক্ত হয়ে পড়লো বেশ কয়েকটা প্রমাণ সাইজের সুগভীর গড্ডালিকা। সম্মুখপানে প্রবলবেগে ধেয়ে আসা খলিফা বাহিনীর অগণিত পদাতিক সেনা অন্তিম মুহূর্তে নিজেদের গতিবেগ রোধ করতে না পেরে সেই গড্ডালিকাগুলোর মধ্যে হুড়মুড় করে আছড়ে পড়লো। পরমুহূর্তেই গড্ডালিকাগুলোর নিচে অবস্থিত তীক্ষ্ণধার ভল্লের ফলায় বিদ্ধ হয়ে তীব্র যাতনায় ছটফট করতে করতে মৃত্যু হলো তাঁদের। পদাতিক বাহিনীর অবশিষ্ট সেনারা সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর আরও নিকটে আসতেই রাজা বিগ্রহরাজ চৌহানের নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তিরন্দাজরা নির্বিচারে শুরু করলো মুহুর্মুহু তিরের বর্ষণ। অন্তরীক্ষ ছেয়ে গেল অগণিত শরশয্যায়। শরাঘাতে বিদ্ধ হয়ে রক্তাপ্লুত অবস্থায় ভূপাতিত হয়ে মৃত্যু হলো আরও অগণিত খলিফা সেনার। এরপর অবশিষ্ট পদাতিক বাহিনী সন্ত্রস্ত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হলো।


যুদ্ধের পরিনতি ক্রমশ নিজেদের বিপরীতে যাচ্ছে দেখতে পেয়ে এবারে দুই হামিরা নিজেদের বাহিনীকে দুইভাগে বিভক্ত করে দুই প্রান্ত থেকে ভারতীয় বাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। আল-হাকাম আর রেহেমান-আল-মুয়ারি তাঁদের দ্রুতগতির অশ্বারোহী বাহিনী সমেত প্রবল বেগে ধেয়ে এলেন ভারতীয় বাহিনীর দিকে। এদিকে খলিফা বাহিনীর অশ্বারোহী বাহিনীকে বাধাদান করতে রাজা বিগ্রহরাজ চৌহান আর রাজা জয়সিংহও নিজ নিজ অশ্বারোহী বাহিনী সমেত ভল্ল আর ঢাল-তরবারি হস্তে মার মার রবে ধেয়ে গেলেন শত্রু বাহিনীর দিকে। শুরু হলো এক ভয়ানক যুদ্ধ। একদিকে ফাঁদে বন্দি মরিয়া খলিফা বাহিনী অপরদিকে আরবের ভিনদেশি স্মেচ্ছ যবন দস্যুদের ভারতবর্ষের পবিত্র ভূমি থেকে বিতাড়িত করে নিজ ধর্ম, সভ্যতা আর সংস্কৃতির রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর ভারতীয় বাহিনী। ক্রমে সকাল থেকে দুপুর হলো, দুপুর থেকে বিকেল। বিকেলের শুরুতে দুই বীর রাজপুত সামন্তরাজ বিগ্রহরাজ চৌহান আর জয়সিংহের তরবারি আর ভল্লের আঘাতে কচুকাটা হতে থাকা খলিফা বাহিনী কিছুটা হতোদ্যম হয়ে আপাতত পশ্চাৎপশরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে পিছিয়ে আসবার প্রয়াস করতেই আচমকা কিছুদূর থেকে ভেসে এলো বাদ্যকরদের তুড়ি, ভেড়ি আর দুন্দুভির ধ্বনি, হটাতই যেন ভূমিকম্পের ন্যায় মুহুর্মুহু কম্পিত হতে থাকল ধরিত্রী, মেঘ গর্জনের গুড়গুড় আওয়াজের ন্যায় ভেসে আসতে লাগলো একাধিক হস্তীর বৃহণ ধ্বনি। সম্পূর্ণ অপরিচিত শত্রু ভূমিতে অবস্থিত খলিফা বাহিনী ব্যপারটা কি ঘটতে চলেছে তা কিছুটা অনুধাবন করতে পেরে শঙ্কিত হয়ে পড়লো। এরপরই হামিরা আল-হাকাম আর রেহমান-আল-মুয়ারি সভয়ে দেখতে পেলেন নিজেদের সুবিশাল পদতলের চাপে ধরিত্রীকে কম্পিত করে তাঁদের দিকে ধেয়ে আসছে সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর অতিকায় রণহস্তী বাহিনী। সেই বাহিনীর সর্বাগ্রে মধ্যমণির ন্যায় অবস্থান করছে একটি দুর্ভেদ্য বর্ম পরিহিত রণহস্তী আর সেই রণহস্তীর পৃষ্ঠে স্বর্ণ হাওদার উপর দুর্ভেদ্য লৌহজালিকা আর শিরস্ত্রাণ পরিহিত হয়ে আসীন মহাপরাক্রমশালী বীরনারায়ণ স্বয়ং সম্রাট প্রথম নাগভট্ট। সম্রাটের দক্ষিণ হস্তে শোভা পাচ্ছে বিশালকায় ভল্ল আর বাম হস্তে গর্বের সাথে উড্ডীন প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি আর সনাতন ধর্মের প্রতিক এক বিশাল গৈরিক ধ্বজ। বহু দূর থেকে সূর্যালোকে ঝলমল করছে গুর্জর-প্রতিহার অধিপতির হীরক খোচিত রাজ উষ্ণীষ। সেই মুহূর্তে রণহস্তীর পৃষ্ঠে আসীন ভল্লধারী সম্রাটকে অবিকল রুদ্ররূপি নটরাজের ন্যায় প্রতীত হচ্ছিল। ইতিপূর্বেও সিন্ধের রাজা দাহির শাহের বাহিনীর রণহস্তীর সম্মুখীন হয়েছে আরবের খলিফা বাহিনী। কিন্তু বামনাবাদের সেই যুদ্ধেও রাজা দাহির শাহের ক্ষুদ্রকায় সিন্ধী বাহিনীর রণহস্তীর সম্মুখে রীতিমতো পর্যুদস্ত হতে হয়েছিল হামিরা মহম্মদ বিন কাশিমের নেতৃত্বাধিন খলিফা বাহিনীকে। নেহাত প্রবল সংখ্যা গরিষ্ঠ আর মহম্মদ কাশিমের কুশল নেতৃত্ব আর ছলনার সাহায্যে সে যাত্রা পার পেয়েছিল খলিফা বাহিনী। কিন্তু আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এমনিতেই সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর চতুর আর কৌশলী রণনীতির সম্মুখীন হয়ে ছন্নছাড়া অবস্থা খলিফা বাহিনীর তার উপর গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার ন্যায় অতিকায় রণহস্তী বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ।


ভারতীয় বাহিনীর নির্ণায়ক বিজয়গাথা
===========================
কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্রাট নাগভট্টের নেতৃত্বাধীন রণহস্তী বাহিনী প্রবলবেগে হামলা করলো খলিফা বাহিনীকে। রণহস্তীদের পদতলে পিষ্ট হয়ে মারা পড়লো বহু খলিফা সেনা। এছাড়াও হস্তী পৃষ্ঠে আসীন যোদ্ধাদের নিক্ষিপ্ত তির আর ভল্লের আঘাতে জন্নত আর জাহান্নমগামী হলো আরও বহু সেনা। যুদ্ধে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী উপলব্ধি করতে পেরে হামিরা রেহেমান-আল-মুয়ারি মরিয়া হয়ে সম্রাট নাগভট্টকে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে রাজপুতদের সাম্মানিক যুদ্ধনীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁকে সরাসরি দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালেন। রেহেমান-আল-মুয়ারির আহ্বান গ্রহণ করে তৎক্ষণাৎ ভল্লধারী সম্রাট হস্তীপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করলেন। আল-মুয়ারিও তাঁর অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করে ভল্ল হস্তে সম্রাটের দিকে এগিয়ে এলেন। শুরু হলো এক ভয়ানক দ্বন্দ্বযুদ্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্রাট নাগভট্টের ভল্লের আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে ধরাশায়ী হলেন রেহমান-আল-মুয়ারি। নিরস্ত্র আর গুরুতর আহত আল-মুয়ারি নিরুপায় হয়ে প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন সম্রাটের নিকটে। ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি আর ধর্মের বিনাশ করতে আসা ভূপাতিত যবন শত্রুর প্রতি কোনরকম অনুকম্পা বা ক্ষমা প্রদর্শনের রাজপুতীয় ভুল করলেন না সম্রাট নাগভট্ট। তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে “হর হর মহাদেব” ধ্বনিতে চতুর্দিক আন্দোলিত করে নিজের হস্তধারী ভল্লের তীক্ষ্ণধার ফলাটি আমূল বিদ্ধ করলেন হামিরা রেহেমান-আল-মুয়ারির বুকে।


এদিকে নিজেদের চোখের সামনে হামিরা রেহেমান-আল-মুয়ারির জাহান্নম যাত্রা দর্শন করে কম্পিত আর সন্ত্রস্ত অবশিষ্ট খলিফা বাহিনী তাঁদের আরেক হামিরা আল-হাকামের নির্দেশে তিরবেগে নিজেদের শিবিরের দিকে পলায়ন করলো। কিন্তু কিছুদূর ধাবিত হয়েই তাঁরা সভয়ে দেখতে পেলো যে তাঁদের শিবিরে যাবার পথ রুদ্ধ করে খলিফা বাহিনীকে স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে দুই সামন্তরাজ বিগ্রহরাজ চৌহান আর জয়সিংহের বাহিনী। এবারে সন্ত্রস্ত আল-হাকামের নজর পড়লো পূর্বের আরাবল্লির পর্বত শ্রেণীর দিকে। এদিকে তখন সন্ধ্যাকাল প্রায় আসন্ন। আল-হাকাম তাঁর অবশিষ্ট বাহিনীকে নিয়ে পলায়ন করলেন সেইদিকে। তিনি মনে মনে ভেবেছিলেন সন্ধ্যার আধারের আশ্রয় নিয়ে আরাবল্লি পর্বতের অন্তরালে আপাতত আশ্রয় গ্রহণ করবেন। এদিকে নিজেদের রাজপুতী যুদ্ধনীতি অনুসারে রাতের আধারে তাঁদের উপর আর হামলা চালাবে না নাগভট্টের সংযুক্ত বাহিনী। রাজপুতদের যুদ্ধ বিরামের সহায়তা নিয়ে রাত থাকতে থাকতেই কোনমতে গাঢাকা দিয়ে বধ্যভূমি ত্যাগ করে সিন্ধের উদ্দেশ্যে পলায়ন করবে খলিফা বাহিনী। কিন্তু বিধি বাম। পূর্ব প্রান্তের পর্বতশ্রেণীর নিকটে উপস্থিত হতেই হাজার হাজার জ্বলন্ত মশাল হস্তে অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে ভৈরব কণ্ঠে “জয় একলিঙ্গনাথ” ধ্বনিতে চতুর্দিক অনুরণিত করে তিরবেগে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে খলিফা বাহিনীর দিকে সুনামির ঢেউের ন্যায় ধেয়ে এলো সেনাপতি বাপ্পাদিত্য রাওয়ালের নেতৃত্বাধীন চিত্রকূট (চিতোরী) বাহিনী। নিজেদের প্রচলিত রণনীতি অগ্রাহ্য করে রাতের আধারের মধ্যেই অসি আর ভল্ল হস্তে মধ্যেই খলিফা বাহিনীকে জল্লাদের ন্যায় কচুকাটা করতে লাগলেন গুহিলট সেনাপতি বীরনারায়ণ বাপ্পাদিত্য রাওয়াল আর তাঁর চিতোরী সেনা। পলায়ন করা অসম্ভব অনুধাবন করতে পেরে হামিরা আল-হাকাম তাঁর বক্র তরবারি হস্তে ঘোড়া ছুটিয়ে মুখোমুখি হলেন বাপ্পা রাওয়ালের। তরবারির দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানালেন। অসি চালনার দক্ষতায় বাপ্পা রাওয়ালের নিকটে আল-হাকাম ছিলেন নিতান্তই এক শিক্ষা নবিশ। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাপ্পা রাওয়ালের তরবারির আঘাতে আল-হাকামের হাত থেকে তাঁর অসি খসে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো। এরপর বাপ্পা রাওয়ালের তরবারির আরেক সুনিপুণ আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ভূপাতিত হলেন আল-হাকাম। ভূপাতিত হয়ে তিনিও যথারীতি করলেন নিজের প্রাণ ভিক্ষা। কিন্তু এবারেও কোনরকম অনুকম্পা বা মার্জনা প্রদর্শন করলেন না বাপ্পা রাওয়াল। নিজের অসির এক সুনিপুণ আঘাতে আরবের ধূলি ধূসরিত মরুপ্রান্তর থেকে আগত বর্বর স্মেচ্ছ যবন হামিরার শিরচ্ছেদ করলেন তিনি। এরপর সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর সাঁড়াশি হামলায় শোচনীয়ভাবে পরাজিত আর নিহত হলো অবশিষ্ট খলিফা বাহিনী। রাজস্থানের বধ্যভূমিতে ক্রমশ স্তব্ধ হয়ে পড়লো আল্লাহ-আকবর ধ্বনি। চতুর্দিক থেকে ভৈরব কণ্ঠে অনুরণিত হতে থাকলো বিজয়ী সংযুক্ত বাহিনীর উল্লসিত “হর হর মহাদেব” ধ্বনি।

খলিফা বাহিনীকে পদপিষ্ট করে সম্রাট নাগভট্টের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনী বিজয় গর্বে গৈরিক ধ্বজ উড্ডীন করে যাত্রা শুরু করলো ভারতবর্ষে খলিফা বাহিনীর প্রধান কার্যালয় সিন্ধের উদ্দেশ্যে।


খলিফা বাহিনীর দাক্ষিণাত্য অভিযান
==========================
এদিকে গুপ্তচর মারফৎ আল-হাকাম আর রেহেমান-আল-মুয়ারির বাহিনীর মর্মান্তিক পরিণতি আর সংযুক্ত ভারতীয় সেনার অগ্রসরের সমাচার পেয়ে সন্ত্রস্ত তৃতীয় হামিরা তামিম-ইবান-জইদ-আল-উঠবি তাঁর অবশিষ্ট বাহিনী নিয়ে সিন্ধ পরিত্যাগ করে আরব সাগরের পথে রণতরীতে আসীন হয়ে পাড়ি জমালেন ভারতবর্ষের দক্ষিণাপথে। তাঁর ইচ্ছা ছিল দাক্ষিণাত্যের জলপথে আপাতত কিছুকাল আত্মগোপন করে থাকা। আল-হাকাম আর রেহেমান-আল-মুয়ারির বাহিনীর শোচনীয় পরিণতির কথা জানিয়ে তিনি পত্র প্রেরণ করেছিলেন খলিফাকে। সেই পত্রে হিন্দের শক্তিশালি কাফের বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য আরও সেনা প্রেরণের সনির্বদ্ধ অনুরোধও জানিয়েছিলেন। কিন্তু খলিফা কোন এক অজ্ঞাত কারণ বশত তামিম-ইবান-জইদ-আল-উঠবির যাবতীয় দাবি দাওয়া নস্যাৎ করে তাঁকে নির্দেশ প্রেরণ করলেন জলপথে দাক্ষিণাত্যের কাফের রাজাদের আক্রমণ করে সেখানে খলিফা সাম্রাজ্য আর ইসলামের ধ্বজ স্থাপন করবার। আদেশ অমান্য করলে হামিরা তামিম-ইবান-জইদকে চরম দণ্ডে দণ্ডিত করবার ভীতিও প্রদর্শন করলেন।


খলিফার নির্দেশ পেয়ে নিরুপায় তামিম-ইবান-জইদ তাঁর নৌবাহিনী নিয়ে বর্তমান গুজরাটের গালফ অফ খাম্বাট দিয়ে দাক্ষিণাত্যের মাহি নদিপথে প্রবেশ করে সন্তর্পণে নভসরী বন্দর নগরের দিকে এগিয়ে চললেন। সেই সময় মাহি নদির তটবর্তী নভসরী বন্দর নগর কর্ণাটকের অমিত শক্তিধর বাদামি চালুক্য সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। সম্রাট নাগভট্টের গুপ্তচরদের নিকট থেকে জলপথে আরবের খলিফা বাহিনীর সাম্ভাব্য হামলার সংবাদ পেয়ে ভিনদেশি স্মেচ্ছ যবন বাহিনীকে উপযুক্ত শিক্ষাদানের জন্য চালুক্য সম্রাট দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের নির্দেশে তাঁর নৌবাহিনীর প্রধান সেনাপতি (অ্যাডমিরাল) তথা তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা অবনীজনাশ্রয় পুলকেশি আর তাঁর প্রধান সামন্ত রাজা রাষ্ট্রকূট রাজবংশের যুবরাজ দান্তিদুর্গ তাঁদের শক্তিশালি সুবিশাল সংযুক্ত নৌবাহিনী সমেত নভসরীর বন্দর শহরের পোতের নিকট অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত ছিলেন।


মাহি নদীর খাঁড়িতে ঐতিহাসিক নৌযুদ্ধ
============================
অবশেষে এক ভোরে হামিরা তামিম-ইবান-জইদ তাঁর নৌবাহিনী সমেত মাহি নদির সঙ্কীর্ণ খাঁড়িপথে প্রবেশ করে নভসরী নগরীর দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। কিন্তু কিছুদূরে গিয়েই তামিম-ইবান-জইদ আচমকা দেখতে পেলেন তাঁদের পথরোধ করে খাঁড়ির সম্মুখপ্রান্তের মুখে দণ্ডায়মান চালুক্য নৌবাহিনীর রণতরী। এবারে তামিম-ইবান-জইদ পশ্চাৎপশরন করতে চাইলেন। কিন্তু সেখানেও বিপদ অপেক্ষা করছিল খলিফা বাহিনীর জন্য। খাঁড়ির অপরপ্রান্তেও সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের ন্যায় দণ্ডায়মান রাষ্ট্রকূট নৌসেনার আরেকটি বিশাল রণতরী। পলায়নের পথ রুদ্ধ দেখে অবশেষে মরিয়া হামিরা তামিম-ইবান-জইদ আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই চালুক্য রণতরী গুলি থেকে কাষ্ঠ নির্মিত বিশাল গুলতি দ্বারা নিক্ষিপ্ত লৌহ নির্মিত ভারি ন্যাপথা বল, অগ্নিবাণ আর অগ্নিগোলকের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়লো খলিফা বাহিনীর রণতরীগুলি। এরপর দুর্ভেদ্য লৌহপাত দ্বারা আবৃত চালুক্য রণতরীর শক্তিশালের হালের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে একে একে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে সলিল সমাধিপ্রাপ্ত হলো খলিফা বাহিনীর সমস্ত রণতরী। নিজের রণতরীর সাথেই খাঁড়ির জলে ডুবে জাহান্নমে গমন করলেন হামিরা হামিরা তামিম-ইবান-জইদ-আল-উঠবি। চালুক্য আর রাষ্ট্রকূটদের রণতরী গুলি থেকে ভৈরব গর্জনে “জয় বরাহদেব” শব্দে মুহুর্মুহু ভেসে আসতে লাগলো বিজয় ধ্বনি। মাহি নদির খাঁড়িপথের এই নৌযুদ্ধে আরবের স্মেচ্ছ ভিনদেশি বর্বর খলিফা বাহিনীর বিরুদ্ধে এই নির্ণায়ক নৌযুদ্ধে অভূতপূর্ব সাফল্যলাভের পর চালুক্য সম্রাট দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য যারপরনাই খুশি হয়ে নৌযুদ্ধের নায়ক তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা অবনীজনাশ্রয় পুলকেশিকে “দক্ষিণাপথ সধরা” খেতাবে ভূষিত করলেন। এই খেতাবের অর্থ হলো দাক্ষিণাত্যের মহাশক্তিশালি অটুট স্তম্ভ। আর তাঁর দ্বিতীয় সহকারি রাষ্ট্রকূট যুবরাজ দান্তিদুর্গকে “অনিবর্তক নিভারাত্রাত্রির” খেতাবে ভূষিত করেলেন। এই খেতাবের অর্থ হলো অপরাজেয় দুর্দমনীয় বীর।


যুদ্ধ পরবর্তী ভারতবর্ষের পরিণাম
========================
প্রথমে স্থলপথে রাজস্থানের মহাযুদ্ধে এবং পরে জলপথে মাহিনদীর যুদ্ধে খলিফা বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় এবং আল-হাকাম সহ তিন শক্তিশালি হামিরার (আমির) মৃত্যুর পর ভারতবর্ষের মাটিতে আরবদের যাবতীয় প্রতিরোধ ধূলিসাৎ হলো। সম্রাট নাগভট্টের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত রাজপুত বাহিনীর তাড়া খেয়ে আরবের খলিফা বাহিনী তখনকার মতো পলায়ন করলো সিন্ধু নদীর অপরপ্রান্তে। সিন্ধু নদীর দক্ষিণ প্রান্তের সীমানা পর্যন্ত যাবতীয় ভারতীয় ভূখণ্ড ভারতীয় বাহিনীর অন্তর্গত হলো। পরবর্তীকালে আরবের দুর্বল খলিফা নৌবাহিনী হামিরা আমীর-বিন-মহম্মদ-বিন--আল-কাশিমের-আল-তাকাফির নেতৃত্বে মূলত ব্যস্ত ছিল সিন্ধের সাগরপথে সফররত ভারতীয় রাজাদের রণতরীগুলোকে চোরাগোপ্তাভাবে আচমকা আক্রমণ করে অন্তত সিন্ধে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে। আরেক শক্তিশালি গুর্জর-প্রতিহার সম্রাট মিহিরভোজের পাল্টা আক্রমণে ভারতবর্ষের মাটিতে চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায় আরবের খলিফা বাহিনীর আক্রমণ। কিন্তু সাফারিদ ইসলামিক তুর্কি বাহিনী ভারতবর্ষের নতুন বিপদ হিসাবে দেখা দেয় উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের আফগানিস্থানের হিন্দুকুশ পর্বত প্রান্তে।


এদিকে কালের নিয়মে সেদিনের একতায় চিড় ধরে ভারতবর্ষের হিন্দু রাজাদের মধ্যে। দক্ষিণে চালুক্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজেদের স্বাধীন সাম্রাজ্য স্থাপন করলো রাষ্ট্রকূট রাজবংশ। উত্তরে সাম্রাজ্য বিস্তারের লোভে রাষ্ট্রকূট বাহিনী সংঘাতে জড়ালো সম্রাট নাগভট্টের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজের বিরুদ্ধে। অপরদিকে চিতোরের মৌর্য রাজা মনুরাজাকে হত্যা করে বলপূর্বক চিতোরের রাজসিংহাসন অধিকার করলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজপুত সেনাপতি বাপ্পাদিত্য রাওয়াল। চিতোরের কেল্লায় স্থাপন করলেন গুহিলট রাজবংশ, পরবর্তীকালে আলাউদ্দিন খিলজির চিতোর হামলায় মহারাওয়াল রতন সিংহের প্রয়াণের সাথে সাথে যেই রাজবংশের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে শিশোদিয়া রাজবংশের স্থাপনা করেছিলেন মহারানা হামির সিংহ। এদিকে রাষ্ট্রকূটদের মতোই কিছুকাল পরে গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজেদের স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করলেন শাকম্ভরীর সামন্তরাজ প্রথম বিগ্রহরাজ চৌহানের বংশধররাও। পরবর্তীকালে ১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে তরাইনের প্রান্তরে বাপ্পা রাওয়ালের আধুনিক যুদ্ধনীতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ শাকম্ভরীর চৌহান রাজবংশের অযোগ্য উত্তরসূরি পৃথ্বীরাজ চৌহানকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে তাঁর রাজধানি দিল্লি নগর অধিকার করে বহুকাল পরে ভারতবর্ষের পবিত্র ভূমিতে স্থায়ীভাবে পদার্পণ করে ইসলামের বিজয় নির্ঘোষ ঘোষণা করে রাজস্থানের ঐতিহাসিক মহাযুদ্ধে নিহত হামির আল-হাকামের অসমাপ্ত স্বপ্ন পূর্ণ করে, ভারতবর্ষের ভূমিতে সনাতন ধর্ম, সভ্যতা আর সংস্কৃতির পতন ঘটিয়ে, সম্রাট নাগভট্ট, সেনাপতি বাপ্পা রাওয়াল আর সম্রাট বিক্রমাদিত্য চালুক্যের সেদিনের ঐতিহাসিক বিজয়ের যাবতীয় গৌরবগাথা পরাজয়ের গ্লানিতে ম্লান করে ইতিহাসের পাতায় প্রায় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে দিয়েছিলেন ঘুরের তুর্কি সুলতান মহম্মদ ঘোরী।
#SR #Battle_of_Rajasthan


তথ্যসূত্রঃ
১) Crawford, Peter (2013). The War of the Three Gods: Romans, Persians and the Rise of Islam. Barnsley, Great Britain: Pen & Sword Books. p. 216
২) Sandhu, Gurcharn Singh (2000). A Military History of Ancient India. Vision Books. p. 402
৩) Sailendra Nath Sen (1 January 1999). Ancient Indian History and Civilization. New Age International. pp. 343–344
৪) Kumar, Amit (2012). "Maritime History of India: An Overview". Maritime Affairs:Journal of the National Maritime Foundation of India. 8 (1): 93–115. In 776 AD, Arabs tried to invade Sind again but were defeated by the Saindhava naval fleet. A Saindhava inscription provides information about these naval actions.
৫) Majumdar, R. C. (1977). Ancient India (Eighth ed.). Delhi: Motilal Banarsidass.
তরাইনের প্রথম যুদ্ধ
===============
মহম্মদ ঘোরীর পুনরুত্থান
===================
আগের পর্বে আপনারা পড়েছেন কিভাবে ১১৭৮ খ্রিষ্টাব্দে মাউন্ট আবুর নিকটে কায়দারার গিরিঘাটে যুদ্ধে চালুক্য রানি নাইকি দেবীর কুশল রণনীতির সম্মুখে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েও পুনরায় জিহাদের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ভারতবর্ষের ভূমিতে এক বিশাল ইসলামিক সাম্রাজ্য স্থাপনের লক্ষ্যে ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন আফগানিস্থানের ঘুর সুলতানতের অধিপতি মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। এরপর ১১৮৬ খ্রিষ্টাব্দে লাহোরের যুদ্ধে ঘোরীর জিহাদি বাহিনীর নিকটে ধস্ত হয়েছিল তার প্রতিদ্বন্দ্বী সেলজুক তুর্কি সুলতান খুস্রু মালিক আর খোকারদের মিলিত বাহিনী। এরপর ঘোরী শিয়ালকোট আর রাওলপিণ্ডি কব্জা করলেন। মামুদ গজনীর অন্তিম বংশধর খুস্রু মালিক পরাজিত ও বন্দি হবার পর একদিকে সম্পূর্ণ আফগানিস্থানে কণ্টকশূন্য হলো ঘোরী সাম্রাজ্য, অপরদিকে তুর্কি ঘোরী সাম্রাজ্য আর হিন্দুস্থানের সনাতনি চৌহান সাম্রাজ্যর সীমান্তরেখা একে অপরকে স্পর্শ করলো।

আজমির আর দিল্লিকে দুই কেন্দ্রস্থল করে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত শাকম্ভরির চৌহান রাজবংশ তখন উত্তর ও মধ্য ভারতের অন্যতম এক শক্তিশালী হিন্দু সাম্রাজ্য। তখন দিল্লির রাজসিংহাসনে আসীন চৌহান রাজবংশের ৩১ তম সদস্য মহারাজ পৃথ্বীরাজ চৌহান তৃতীয়। ভারতবর্ষের ইতিহাসের পাতায় মতে স্বাধীন ভারতবর্ষ এবং দিল্লির অন্তিম সনাতনি ভারতীয় শাসক হিসাবে চির অমর হয়ে রয়েছেন রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুর্কিদের দ্বারা হরণ হয় ভারতবর্ষের এক বিশাল অঞ্চলের স্বাধীনতা এবং দিল্লির বুকে উড্ডীন হয় অর্ধচন্দ্র আর তাঁরা অঙ্কিত বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুর্কিদের সবুজ ঝাণ্ডা। বর্ণময় এই যুবা রাজাকে নিয়ে যবন তুর্কি ও সনাতনি ভারতীয় ঐতিহাসিক আর কবিদের দ্বারা রচিত ও প্রচারিত হয়েছে নানান লোকগাথা, হরেক কিংবদন্তী আর অত্যাশ্চর্য সব ঘটনার কাহিনী। সেগুলোর মধ্যে কোনটা ঐতিহাসিক রূপে সত্যি আর কোনটা শুধুই কিংবদন্তী আর নিছকই গল্পকথা তা আজও তর্ক সাপেক্ষ। ব্রিটিশ শাসনকালে এবং কংগ্রেস শাসনাধীন স্বাধীনতাত্তোর ভারতে পৃথ্বীরাজের সভাকবি চাঁদ বারদাই দ্বারা রচিত “পৃথ্বীরাজ রাসো” নামক কাব্যগ্রন্থটিকে সর্বচ্চো মান্যতা দান করা হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে রাজস্থান আর গুজরাটের বহু প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিকগণ সন, তারিখ ও নিখুঁত তথ্য সহ প্রমান করেছেন যে “পৃথ্বীরাজ রাসোতে” বর্ণিত ৮৫% ঘটনাই কাল্পনিক ও অতিরঞ্জিত। বাস্তবের ইতিহাসের সহিত এই কাব্যগ্রন্থে বর্ণিত ঘটনাবলির কোন মিল নেই। অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে পৃথ্বীরাজের সভায় উপস্থিত কাশ্মীরি কবি তথা ঐতিহাসিক জয়নাক দ্বারা রচিত কাব্যগ্রন্থ “পৃথ্বীরাজ বিজয়” ঐতিহাসিক রূপে অনেক অধিক নির্ভুল। তরাইনের প্রথম যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণের পূর্বে আসুন জেনে নেওয়া যাক দিল্লির অন্তিম হিন্দু রাজা সম্বন্ধে “পৃথ্বীরাজ বিজয়” গ্রন্থে বর্ণিত কিছু তথ্য।

চৌহান রাজবংশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পর্ব
=============================
কবি জয়নাক তাঁর কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন চৌহান বংশের তৃতীয় শক্তিশালী রাজা আর্নোরাজ চৌহান ঘোরী সাম্রাজ্যের (মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরীর পূর্বজরাও একাধিকবার ভারত আক্রমণ করেছিলেন) এক বিশাল তুর্কি বাহিনীকে আজমিরের নিকটে শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও বিতাড়িত করবার পর সহস্র স্মেচ্ছ তুর্কি দস্যুদের রক্তে শিক্ত যুদ্ধভূমিকে শুদ্ধ করবার জন্য ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতগণের পরামর্শে সেই স্থানে এক বিশাল সরোবর খনন করলেন। নিকটবর্তী চন্দ্রা নদী থেকে পরিখা খনন করে সরোবর জলে পরিপূর্ণ করা হলো। সরোবরের টলটলে নির্মল জল দেখে পুলকিত হলেন চৌহান অধিপতি। যোগ্য করে আর পূজাদান করে সরোবরকে বিশুদ্ধ করলেন আজমিরের পুরোহিত আর ব্রাহ্মণগণ। রাজা আর্ণোরাজ খুশি হয়ে সরোবরের নাম রাখলেন “আনাসাগর হ্রদ” (বর্তমানে আজমিরের অন্যতম প্রধান পর্যটন স্থল হলো এই আনাসাগর হ্রদ)। হ্রদের সম্মুখে শ্বেত মর্মর সুরম্য পারিবারিক রাজপ্রাসাদের মুখোমুখি এলাকায় এক বিশাল শিব মন্দির নির্মাণ করলেন রাজা আর্ণোরাজ। মন্দিরের নাম দিলেন সোমেশ্বর মন্দির। তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে এই নির্ণায়ক বিজয়ের মাস দুয়েক পরে গুজরাটের চালুক্য রাজবংশের শাসক মহারাজ জয়সীমা সিদ্ধরাজের জ্যৈষ্ঠ কন্যা রাজকুমারী কাঞ্চনাদেবীর সাথে দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন রাজা আর্ণোরাজ। বৎসরকাল অতিবাহিত হতে না হতেই গর্ভবতী হলেন রানি কাঞ্চনাদেবী। তিনি জন্মদান করলেন এক পুত্র সন্তানের। মহারাজ আর্ণোরাজ নিজের নির্মিত সোমেশ্বর দেবের মন্দিরের নামাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর সেই পুত্রের নাম রাখলেন সোমেশ্বর চৌহান। পরবর্তীকালে ১১৫০ খ্রিষ্টাব্দে এক মৃগয়াভূমিতে ষড়যন্ত্র করে যবন বিতারনকারী মহারাজ আর্ণোরাজকে বিষাক্ত তির দ্বারা বিদ্ধ করে হত্যা করলেন তাঁরই জ্যৈষ্ঠ পুত্র জগৎদেব চৌহান।

এরপর আজমিরের রাজসিংহাসনের দখল নিলেন তিনি। এরই মধ্যে আজমিরের রাজজ্যোতিষী গণনা করে ঘোষণা করলেন যে অতি শীঘ্র শাসন ক্ষমতা হারাতে চলেছেন তিনি আর তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা সোমেশ্বর লাভ করতে চলেছেন এক বীরপুত্র সন্তান। তাঁর দ্বিতীয় ভ্রাতা এবং সোমেশ্বর চৌহানের পুত্রের বলিষ্ঠ তরবারির জোরে চৌহান রাজ্য এক বিশাল সাম্রাজ্যের রূপ নিতে চলেছে। রাজজ্যোতিষীর এই ঘোষণা শুনেই ভীত ও সন্ত্রস্ত্র জগৎদেব হত্যার আদেশ দিলেন তাঁর দুই ভ্রাতা বিগ্রহরাজ এবং সোমেশ্বরকে। দুজনেই গোপনে আজমির ত্যাগ করে গুজরাটে পলায়ন করলেন। তাঁদের আশ্রয়দান করলেন চালুক্য নৃপতি জয়সীমা সিদ্ধরাজ। এরপর চালুক্য বাহিনীর সাহায্যে জগৎদেবকে আক্রমণ ও হত্যা করে আজমিরের রাজসিংহাসনের আসীন হলেন চতুর্থ বিগ্রহরাজ। জগৎদেবের অত্যাচার আর শোষণে দীর্ণ চৌহান রাজ্যে পুনরায় শান্তি ও শৃঙ্খলার সুদিন ফিরিয়ে আনলেন চতুর্থ বিগ্রহরাজ। ললিত বিগ্রহরাজ নাটক আর প্রবন্ধ চিন্তামনির বর্ণনা অনুসারে ঘোরী সুলতানদের যবন তুর্কি বাহিনীকে দিল্লির যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে, দিল্লির রাজা অনঙ্গপাল তোমারের কন্যা দেশালাদেবীকে বিবাহ করে পুত্র সন্তানহীন বৃদ্ধ রাজা অনঙ্গপাল তোমারের নিকট থেকে দিল্লি রাজ্য যৌতুক হিসাবে পেয়েছিলেন তিনি। ইতিহাসের পাতায় ইনিই চৌহান বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক।

চৌহান-চালুক্য বংশের মিত্রতা আর বৈরিতার ইতিহাস
=====================================
এদিকে গুজরাটের রাজধানি আনহিলওয়াড়ার প্রাসাদে রাজা জয়সীমা তাঁর রাজজ্যোতিষীর নিকটে পেলেন আরেকটি অদ্ভুত সংবাদ। রাজজ্যোতিষীর মুখে তিনি জানতে পারলেন আজমিরের রাজকুমার সোমেশ্বর চৌহানের পুত্র হিসাবে পৃথিবীর বুকে পুনরায় পুনর্জন্ম লাভ করতে চলেছেন স্বয়ং অযোধ্যা নরেশ রাজা রামচন্দ্র। এই সংবাদ শুনে যারপরনাই পুলকিত হয়ে ত্রিপুরির রাজা তেজালার কন্যা রাজকুমারী কর্পূরদেবীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন সোমেশ্বর চৌহান। রাজা জয়সীমার মৃত্যুর পরে গুজরাটের রাজসিংহাসনে আসীন হলেন তাঁর পুত্র রাজা কুমারপাল। যদিও তিনি সোমেশ্বরকে পছন্দ করতেন, কিন্তু তাঁর শাসনকাল থেকেই সাম্রাজ্য বিস্তার নিয়ে দিল্লি-আজমিরের রাজা চতুর্থ বিগ্রহরাজের সাথে বৈরিতা শুরু হয়। অপরদিকে ১১৬৬ সালে সন্তান সম্ভবা হলেন রাজকুমারী কর্পূরদেবী। এই ঘটনার মাসখানেক ব্যবধানে এক পুত্র সন্তানের জন্মদান করলেন তিনি। স্বয়ং অযোধ্যা নরেশ রঘুপতি রামচন্দ্র সোমেশ্বরের পুত্রের রূপধারন করে পুনরায় ভূমিষ্ঠ হয়েছেন মনে করে আনহিলওয়াড়ার রাজপ্রাসাদে আনন্দ ও উৎসবের তরঙ্গস্রোত প্রবাহিত হলো। ভবিষ্যৎকালে, সমগ্র পৃথিবীর বুকে (আসলে ভারতবর্ষ) নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করে সনাতন ধর্ম আর সভ্যতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে পুনরায় রামরাজ্যের সেই স্বর্ণময় গৌরবশালী দিনগুলি ফিরিয়ে আনবেন এই প্রার্থনা করে সোমেশ্বর তাঁর শিশু পুত্রের নাম রাখলেন পৃথ্বীরাজ।

গুজরাটের রাজধানি আনহিলওয়াড়ায় যখন এই নাটক সংগঠিত হচ্ছে, তখন আজমিরেও ঘটে চলেছে নানান ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত। ১১৬৪ সালে এক যুদ্ধে আহত হয়ে প্রয়াত হলেন সম্রাট চতুর্থ বিগ্রহরাজ। তিনি পুত্র সন্তান হীন হওয়াও তাঁর প্রয়ানের পর দিল্লি-আজমিরের রাজসিংহাসনে আসীন হলেন কুচক্রী জগৎদেবের পুত্র দ্বিতীয় পৃথ্বীরাজ। মাত্র সাড়ে চার বৎসরকাল রাজত্ব করতে পেরেছিলেন তিনি। গুজরাটের সাথে আজমিরের বৈরিতা তখন তুঙ্গে। ১১৬৯ সালে গুজরাটের রাজা কুমারপালের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে নিহত হলেন রাজা দ্বিতীয় পৃথ্বীরাজ। এর ফলে উত্তরাধিকারীহীন হয়ে পড়লো দিল্লি-আজমিরের সিংহাসন। তখন আজমিরের অমাত্যগণ গুজরাট নিবাসি রাজকুমার সোমেশ্বরকে সনির্বদ্ধ আহ্বান জানালেন আজমিরে প্রত্যাবর্তন করে রাজ্য সামলানোর। যুবাকালে গুজরাটের চালুক্য রাজবংশের হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও ১১৬৯ সালে পুনরায় আজমিরে প্রত্যাবর্তন করলেন তিনি। দিল্লি-আজমিরের রাজা হবার পর রাজ্যের সাম্রাজ্য বিস্তারের যুদ্ধে কিছুকালের মধ্যেই একদা পরম মিত্র রাজ্য গুজরাট হয়ে উঠলো রাজা সোমেশ্বর চৌহানের চরম শত্রু রাজ্য। ১১৭৫ সালে গুজরাটের বিরুদ্ধে আজমিরের বাহিনীর এক যুদ্ধে নিহত হলেন তৎকালীন গুজরাট নরেশ রাজা অজয়পাল (কুমারপালের পুত্র)। সেই সময় রাজা অজয়পালের দুই পুত্র সন্তান দ্বিতীয় মুলারাজ আর দ্বিতীয় ভীমদেব মাত্র ৬-৭ বৎসরের বালক। এদিকে ১১৭৮ সালের প্রারম্ভে সেই গুজরাটের বিরুদ্ধেই এক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সম্মান খুইয়ে ভগ্ন হৃদয়ে মৃত্যুবরন করলেন আজমির নরেশ রাজা সোমেশ্বর। ঘটনাবহুল ১১৭৮ সালের মধ্যভাগে গোমাল গিরিবর্ত্ম অতিক্রম করে গুজরাট আক্রমণ করলেন স্মেচ্ছ তুর্কি সুলতান মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। কিন্তু কায়দারার যুদ্ধে প্রয়াত রাজা অজয়পালের বিধবা স্ত্রী রানি নাইকিদেবীর চতুর রণনীতির বিরুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে কোনমতে গজনীতে পশ্চাৎপশরন করলেন তিনি।

কায়দারার ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাসকয়েক পরেই কোন এক অজ্ঞাত দুর্ঘটনায় নিহত হলেন বালক গুজরাট নরেশ দ্বিতীয় মুলারাজ। মুলারাজের মৃত্যুর পর গুজরাটের রাজসিংহাসনে আসীন হলেন ভীমদেব। এদিকে পুত্রশোকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন গুজরাটের বিধবা রাজমাতা রানি নাইকিদেবী। সম্ভবত আরও মাসখানেক পরে ১১৭৯ সালের প্রথমার্ধে ভগ্ন হৃদয়ে অন্তিম নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতবর্ষের বীরাঙ্গনা রমণী রানি নাইকিদেবী। পিতার পর মাতাকেও হারিয়ে রাজা ভীমদেবের সমস্ত ক্রোধ পুঞ্জিভূত হয় আজমিরের উপর। একে তো আজমিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন তাঁর পিতা রাজা অজয়পাল। তার উপর কায়দারার গিরিঘাটে তুর্কি দস্যুদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে তাঁর মাতা রানি নাইকিদেবীকে কোনরকম সামরিক সহায়তা প্রদান করেনি আজমির নরেশ তৃতীয় পৃথ্বীরাজ। নাইকিদেবীর মৃত্যুর পরেই রাজা ভীমদেব যুদ্ধ ঘোষণা করলেন পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিরুদ্ধে।

পৃথ্বীরাজ-জয়চাঁদের বৈরিতা পর্ব
=======================
অপরদিকে  নিজেকে রাজপুতানার সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতি হিসাবে দেখবার বাসনায় অশ্বমেধ যোগ্য পালন করে মহা সারম্ভরে দিগ্বিজয় ঘোষণা করলেন কান্যকুব্জের রাজা জয়চাঁদ গাহারওয়াল। জেজাকভুক্তি (বর্তমান বুন্দেলখণ্ড), পারমার, পাট্টান রাজ্য ভ্রমণ করে অবশেষে জয়চাঁদের অশ্বমেধের রথ এসে উপস্থিত হল দিল্লিতে রাজা পৃথ্বীরাজের রাজদরবারে। কান্যকুব্জের অশ্বমেধ রথের আগমনী সংবাদ শুনে নিজের ধমনীর ক্ষত্রিয় রক্ত তপ্ত হয়ে উঠল দিল্লিশ্বর চৌহান বীরের। তিনি নিজের রাজসিংহাসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে কনৌজের রাজদূত ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন, “কি এতো স্পর্ধা কান্যকুব্জের নৃপতির ? চৌহান রাজবংশকে নিজের পদানত করতে চান তিনি ? রাজপুত ক্ষাত্র ধর্ম অনুসারে দূত অবধ্য। তাই আপনাকে হত্যা না করে অক্ষত শরীরে কান্যকুব্জে প্রত্যাবর্তন করবার সুযোগ দিচ্ছি। আপনি অবিলম্বে নিজ রাজ্যে ফিরে গিয়ে আপনার রাজাকে জানান পৃথ্বীরাজকে পদানত করতে হলে তাঁকে সসৈন্যে যুদ্ধ ভূমিতে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। অদূর ভবিষ্যতে কান্যকুব্জের রাজা নন, আর্যাবর্তের রাজচক্রবর্তী সম্রাট হতে চলেছেন দিল্লির অধিপতি পৃথ্বীরাজ চৌহান।” পরবর্তীকালে দূতের মুখে পৃথ্বীরাজের বার্তা শ্রবণ করে যারপরনাই ক্রুদ্ধ হলেন কান্যকুব্জের রাজা জয়চাঁদও। তিনি ক্রধোন্মত্ত হয়ে মুহূর্তের মধ্যে নিজ কটিদেশের বাম প্রান্তে রক্ষিত কোষ থেকে অসি বের করে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “কি সেদিনের শিশুপুত্র পৃথ্বীরাজ, যার দুধের দন্ত আজও বিরাজমান, সে আজ শুধুমাত্র ভাগ্যের সহায়তায় আজমির আর দিল্লির অধিপতি হয়ে নিজেকে এতটাই মহান বীর মনে করছে যে কান্যকুব্জের রাজার অশ্বমেধের রথকে রুখে দিয়ে চূড়ান্ত অপমানিত করে নিজেকে আর্যাবর্তের ভবিষ্যতের রাজচক্রবর্তী সম্রাট ঘোষণা করে ফেরৎ পাঠিয়ে আমাকে যুদ্ধের আহবান জানিয়েছে। উত্তম সমরভূমিতেই আমি পৃথ্বীরাজকে ওর ঔদ্ধত্যের যোগ্য আর সমুচিত জবাব দেবো। অতি শীঘ্রই কনৌজের সামরিক শক্তির পরিচয় পাবে শিশুপুত্র পৃথ্বীরাজ।”ফলে শুরু হলো এক দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর অনৈক্যের অধ্যায়। ১১৯২ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে এই ভারতীয় রাজাদের এই আভ্যন্তরীণ কলহ, বৈরিতা আর অনৈক্যই বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুর্কি বাহিনীর দাসত্ব আর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছিল সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অখণ্ড ভারতবর্ষকে।

তরাইনের প্রথম যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
=======================
এদিকে ১১৯০ সালের অন্তিমলগ্নে ভারতবর্ষের মাটিতে ইসলামিক সাম্রাজ্য বিস্তারের অদম্য লক্ষ্য বুকে নিয়ে খাইবার পাস অতিক্রম করে পাঞ্জাবের ভাতিণ্ডা অঞ্চল দিয়ে রাহুর ন্যায় পুনরায় মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করলেন মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। এবারের অভিযানেও কায়দারার যুদ্ধের সময়ের দুই বিশ্বস্ত সেনাপতি নাসিরউদ্দিন কুবাচা আর তাজউদ্দিন ইয়ালদুজ, মহম্মদ ঘোরীর সাথে সামিল হয়েছিল। সেই সাথে ঘোরী বাহিনীর এবারের ভারত অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল এক তরুন তুর্কি যোদ্ধা, যার নাম পরে জানা যাবে। সেই সময় ভাতিণ্ডা ছিল আজমিরের অন্তর্গত। পৃথ্বীরাজ চৌহানের বাল্যসখা তথা অন্যতম প্রিয় সেনাপতি চাঁদ পুন্দিরের উপর ন্যস্ত ছিল ভাতিণ্ডা অঞ্চলের শাসনের দায়িত্ব। রাজ্য সুরক্ষিত রাখবার প্রয়োজনে চাঁদ পুন্দির ভাতিণ্ডা আর পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলে নির্মাণ করেছিলেন এক কেল্লা। এক নিশুতি রাতে নৈশভোজ সম্পন্ন করে চাঁদ পুন্দিরের নেতৃত্বাধীন আজমির বাহিনী যখন বিশ্রামরত ছিল ঠিক সেই সময় এক বিশ্বাসঘাতকের সহায়তায় গুপ্ত সুড়ঙ্গপথে কেল্লায় প্রবেশ করলো ঘোরী বাহিনী। কেল্লার ভেতরে প্রবেশ করেই নিদ্রিত আজমির বাহিনীকে নির্মম ও নির্দয়ভাবে সংহার করে কেল্লার দখল নিলো তুর্কি সেনা। তারপর কেল্লার বুরুজে উড্ডীন আজমিরের ধ্বজ প্রত্যাহার করে লটকানো হলো অর্ধচন্দ্র আর কলমা অঙ্কিত ঘুরের ঝাণ্ডা। কেল্লা অধিকারের দিনকয়েক পরে দিল্লি-আজমিরের শাসক পৃথ্বীরাজ চৌহানকে ঘৃণ্য কাফের আখ্যা দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে দিল্লি অধিকার করবার লক্ষ্যে নিজ লস্কর সমেত সেদিকে অগ্রসর হলেন মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী।

নিজ রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের অক্ষপটলে যখন ঘনিয়ে আসছে বর্বর বিজাতীয় তুর্কি আগ্রাসনের করাল কালো ছায়া, ঠিক সেই সময় ব্যক্তিগত প্রতিশোধ গ্রহনের লক্ষ্যে পৃথ্বীরাজকে আক্রমণ করলেন গুজরাটের রাজা ভীমদেব সোলাঙ্কি। কায়দারার নিকটেই এক উন্মুক্ত প্রান্তরে মুখোমুখি হলো চৌহান আর চালুক্য বাহিনী। শুরু হলো এক শক্তিক্ষয়ী অহেতুক যুদ্ধ। ভীমদেবকে তাঁর আগ্রাসনের সমুচিত জবাবদানের লক্ষ্যে নিজের সেনাপতি উদয়রাজের সাথে নিজের হস্তীবাহিনী সমেত কায়দারা অভিমুখে যাত্রা করলেন ক্রুদ্ধ পৃথ্বীরাজ। সেনাপতি উদয়রাজ গৌড়ীয় রাজপুত ছিলেন। বহু পূর্বে বাংলার পাল রাজবংশের শাসনকালের অন্তিম লগ্নে বঙ্গের গৌড় রাজ্যের জনা কয়েক ক্ষত্রিয় পরিবার রাজপুতানার অন্তর্গত মেবার আর আজমিরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীকালে আজমিরের শাকম্ভরি চৌহানদের অন্যতম প্রধান সামন্ত রাজার পদে নিযুক্ত হন গৌড় রাজপুত যোদ্ধা ঈশ্বরদাস। রাজা ঈশ্বরদাসের জ্যৈষ্ঠ পুত্র ছিলেন উদয়রাজ।

প্রথমদিনের যাত্রাশেষে শেষে তখন সন্ধ্যাকালে প্রায় আসন্ন। সূর্য ঢলে পড়েছে দিকচক্রবালের পশ্চিমপ্রান্তে। গোধূলি লগ্নের নরম স্বর্ণজ্বল আলোকছটায় বিচ্ছুরিত প্রান্তরভূমি যেন সেই অতীতকালের সোনার চিড়িয়া ভারতবর্ষের ছবিই অঙ্কিত করছিল তাঁর অদৃশ্য চিত্রপটে। দিনান্তের অন্তিমলগ্নের আলোয় দেখা যাচ্ছিল সসৈন্যে রাজধানি দিল্লি ত্যাগ করে গুজরাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায় যাচ্ছেন দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ। তাঁর বিশাল বাহিনীর একেবারে সম্মুখভাগে আজমিরের রাজকীয় পতাকাবাহী পদাতিক বাহিনী, এর পরবর্তী সারিতে সেনাপতি উদয়রাজের নেতৃত্বাধীন বাদ্যকারের দল আর কবচ আচ্ছাদিত অশ্বারোহী বাহিনী, অন্তিম সূর্যালোকের স্বর্ণালি আলোকরশ্মিতে ঝলমল করছে তাঁদের হস্তে ধরা ভল্ল আর তরবারি। এরপর চলেছে দৈত্যাকার বিশালদেহী হস্তী বাহিনী। হস্তী বাহিনীর মধ্যভাগে ব্যক্তিগত দেহরক্ষী পরিবৃত লৌহপাত আর বর্ম আচ্ছাদিত দিল্লিশ্বরের রাজহস্তি। সেই হস্তি পৃষ্ঠে স্বর্ণ হাওদায় বসে আছেন লৌহবর্ম, লৌহজালিকা আর লৌহ শিরস্ত্রাণ পরিহিত যোদ্ধার বেশে সজ্জিত পরাক্রমশালী ২৫ বছর বর্ষীয় দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ চৌহান। যুবা রাজার বাম হস্তে শোভা পাচ্ছে রাজপুত আভূষণ কোষবদ্ধ তরবারি। বহু দূর থেকে সূর্যালোকে ঝলমল করছে দিল্লিশ্বরের হীরক খোচিত রাজ উষ্ণীষ। ক্রমে দীর্ঘ পথযাত্রার শেষে সূর্য অস্তাচলে গেল, সন্ধ্যার ঘন পুরু আধারে আচ্ছাদিত হয়ে পড়ল সমগ্র চরাচর। সেদিনের মত পথযাত্রায় ক্ষান্ত দিয়ে একটি জনপদের নিকটে শিবির স্থাপন করল চৌহান বাহিনী। তখন মধ্যরাত। নিজের সুসজ্জিত তাঁবুতে নিদ্রামগ্ন দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ। নিস্তব্ধ নিশুতি রাতে মশাল আর অস্ত্র হাতে অতন্দ্র প্রহরায় রত চৌহান বাহিনীর রক্ষীগণ আচমকা শ্রবণ করলেন এক অশ্বের খুঁড়ের ধ্বনি। রাতের নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে এক অজানা সুরের তালে তাল মিলিয়ে ক্রমে চৌহান শিবিরের দিকেই যেন এগিয়ে আসছিল সেই অশ্বখুঁড়ের ছন্দময় খট-খটা-খট ধ্বনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আজমিরের রক্ষীরা মশালের আলোয় দেখতে পেলেন এক রহস্যময় অজ্ঞাত পরিচয় অশ্বারোহীকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অশ্বারোহী দ্রুতগতিতে এসে প্রবেশ করলো আজমিরের সেনা শিবিরের মধ্যে। সাথে সাথেই সাবধান হয়ে উঠলো আজমির বাহিনী। শুরু হলো প্রবল কোলাহল। নিজের তরবারি হস্তে রক্ষী সমেত অশ্বারোহীর দিকে ধেয়ে এলেন সেনাপতি উদয়রাজ। অশ্বারোহীর দিকে তরবারি উঁচিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, “দাঁড়াও যাত্রী, বিনা অনুমতিতে আরেক এক পা অগ্রসর হলে নিজের পৈতৃক প্রাণটা হারাবে তুমি। অবিলম্বে নিজের পরিচয় দাও।”
অশ্বারোহী দাঁড়িয়ে পড়ে ক্লান্ত অবসন্ন কণ্ঠে বলে উঠলেন, “সেনাপতি উদয়রাজ আমিও আজমির বাহিনীর এক সংবাদবাহক দূত। সদুর ভাতিণ্ডা থেকে এসেছি, সেনাপতি চাঁদ পুন্দিরের নির্দেশে মাননীয় মহারাজকে এক অতীব দুঃসংবাদ প্রেরন করতে।”

ততক্ষণে বাইরে কোলাহলের শব্দে নিদ্রাভগ্ন হয়েছে মহারাজ পৃথ্বীরাজের। এরপর উদয়রাজ সেই দূতকে নিয়ে এলেন তাঁর তাঁবুতে। দূতের মুখে পৃথ্বীরাজ শুনলেন স্মেচ্ছ তুর্কি বাহিনীর দ্বারা তাঁর রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ভয়াবহ আগ্রাসনের সংবাদ। একদিকে চালুক্য নরেশ ভীমদেব, অপরদিকে বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুর্কি দস্যু মহম্মদ ঘোরী। বিপন্ন ও ক্ষুব্ধ পৃথ্বীরাজ তাঁর রণনীতি ও কর্তব্য স্থির করতে না পেরে সেই রাতেই দিল্লির রাজজ্যোতিষী আচার্য আদিত্যনারায়ণের শরণাপন্ন হবার জন্য গুজরাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা স্থগিত রেখে সেই মুহূর্তেই দিল্লি ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। পরেরদিন দিল্লির লালকোটে (বর্তমানে কুতুব কমপ্লেক্স) নিজের রাজমহলে পৌঁছলেন পৃথ্বীরাজ। পৃথ্বীরাজের মুখে দ্বাদশ বর্ষকাল পরে পুনরায় ভারতভূমিতে যবন আগ্রাসনের সংবাদ শুনে দিল্লির ভীত অমাত্য প্রধান কইমস পূর্বের ন্যায় এবারেরও রাজাকে পরামর্শ দিলেন ঘোরী বাহিনীর সাথে সন্ধি আলোচনা প্রস্তাবের। এরপর রাজজ্যোতিষী আদিত্যনারায়ণের সাথে সাক্ষাৎ করলেন চিন্তান্বিত মহারাজ। পৃথ্বীরাজের মুখে সব শুনে রাজজ্যোতিষী আদিত্যনারায়ণ শান্ত ও সৌম্য কণ্ঠে বললেন, “মহারাজ, বর্তমানে দিল্লি দ্বিমুখী শত্রু দ্বারা আক্রান্ত। তবে প্রতিবেশি চালুক্য নরেশের থেকেও এই মুহূর্তে দিল্লি তথা সমগ্র ভারতবর্ষের জন্য অধিক সঙ্কটজনক হলো উত্তর-পশ্চিমের পর্বত আর রুক্ষ মরুপ্রান্তর দ্বারা অবরুদ্ধ লুণ্ঠকদের ভূমি (আফগানিস্থান) থেকে আগত বর্বর স্মেচ্ছ যবন দস্যুগণ। বর্তমানে যেই গুজরাট নরেশ আপনার শত্রু আজ থেকে ১২ বছর পূর্বে তাঁদের রাজ্যেও হানা দিয়েছিল এই তুরস্কজাত এই স্মেচ্ছ মরুদস্যরা। এই বিধর্মীরা গোমাংস ভক্ষণকারী বর্বর উৎপীড়ক। ইতিপূর্বে বহুবার এদের হাতে আক্রান্ত ও লুণ্ঠিত হয়েছে আমাদের সনাতন ধর্ম আর সভ্যতা, লাঞ্ছিত ও ধ্বস্ত হয়েছে আমাদের একাধিক দেবালয়, এদের তরবারির আঘাতে পীড়াদায়ক নিষ্ঠুর মৃত্যুর শিকার হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা, বন্দি ও ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছেন বহু সনাতন ভারতবাসী আর এদের যৌন লালসার শিকার হয়েছেন অগণিত ভারতীয় ললনা। আজ থেকে দ্বাদশ বর্ষ পূর্বেও তুরস্কজাত যবন দস্যু সর্দার মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী আমাদের মাতৃভূমিকে বিনষ্ট করবার অভিপ্রায়ে গুজরাট সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান গুজরাট নরেশের রাজমাতার তরবারির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছিলেন সেবারে। এতো বছর পরে আবার ফিরে এসেছে যবন অসুররা। আপনি ধর্ম রক্ষা করুন মহারাজ। এই মুহূর্তে যবনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করুন। অবিলম্বে ওদের পরাজিত না করতে পারলে বিগত সহস্র বৎসরকাল ধরে আমাদের মহান পূর্বজদের দ্বারা নির্মিত সোনার ভারতবর্ষ বিনষ্ট হবে। লুপ্ত হবে বৈদিক সভ্যতা আর সংস্কৃতি।”

দিল্লির প্রস্তুতি পর্ব
=============
রাজজ্যোতিষীর পরামর্শ শুনে পৃথ্বীরাজ নিজের কোষবদ্ধ অসি উন্মুক্ত করে দেবাদিদেব সোমেশ্বরের (মহাদেব, পৃথ্বীরাজের পিতা নন) নামে শপথ করলেন গোমাংস ভক্ষনকারী গর্জিনীর ঘোরী বাহিনীকে পূর্বের কায়দারার রণাঙ্গনের ন্যায় পুনরায় পর্যুদস্ত করে ধুলোয় মিশিয়ে ভারতবর্ষের ভূমি থেকে বিতাড়িত করবার। এরপর পূর্বের ৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দের রাজস্থানের ধর্মযুদ্ধ আর ১০৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ভারুচের ধর্মযুদ্ধের পদাঙ্ক অনুসরন করে সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনী গঠন করবার অভিপ্রায়ে সামরিক সহায়তা চেয়ে পত্র প্রেরন করলেন চতুর্দিকে। কিন্তু ১১৭৮ খ্রিষ্টাব্দের রানি নাইকিদেবীর ন্যায় পৃথ্বীরাজকেও হতাশ হতে হলো। বঙ্গ অধিপতি লক্ষণসেন, কনৌজ অধিপতি জয়চাঁদ, চান্দেল অধিপতি, পারমার অধিপতি সহ হিন্দুস্থানের নিকটবর্তী সমস্ত শক্তিশালী রাজারাই স্বভাবসিদ্ধ ঔদ্ধত্যে দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ চৌহানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন। পৃথ্বীরাজের পত্র নিয়ে দিল্লির দূত উপস্থিত হলেন আনহিলওয়াড়ার রাজপ্রাসাদেও।

গুজরাট নরেশ ভীমদেব সোলাঙ্কি পত্র পাঠ করেই তাচ্ছিল্যপূর্ণ স্বরে দিল্লির রাজদূতকে বললেন, “আজ থেকে দ্বাদশ বর্ষ পূর্বে ঠিক এরকমই সঙ্কটজনক ছিল গুজরাটের পরিস্থিতি। সেই সময় আমার মাতাশ্রী প্রয়াত মহারানি নাইকিদেবীও সামরিক সহায়তা প্রার্থনা করে দূত মারফৎ পত্র প্রেরন করেছিলেন আপনাদের রাজদরবারে। কিন্তু উদ্ধত দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ তাচ্ছিল্যভরে সেই প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, আর আজ অদৃষ্টের কি করুন পরিহাস। দিল্লি আজ নিজেই স্মেচ্ছ তুর্কি দস্যুদের হাতে আক্রান্ত হয়ে সেনা সহায়তার ভিক্ষা চেয়ে পত্র প্রেরন করেছে। দিল্লি ফিরে গিয়ে আপনাদের মহারাজ পৃথ্বীরাজকে জানিয়ে দিন গুজরাট কোনরকম সামরিক সহায়তা প্রদান করবে না দিল্লিকে। তবে বিজাতীয় স্মেচ্ছ যবন দস্যুদের পরাজিত করে ধর্মের রক্ষার প্রয়োজনে এই মুহূর্তে গুজরাটের তরফ থেকে দিল্লির বিরুদ্ধে যাবতীয় যুদ্ধযাত্রা স্থগিত রাখবার কথা ঘোষণা করলাম আমি।”
গুজরাটের তরফ থেকে আগ্রাসনের আশঙ্কা নির্মূল হবার পরে নিজের দৈত্যসম হস্তী বাহিনী নিয়ে ঘোরী বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করলেন পৃথ্বীরাজ।

ভারতীয় ক্রুসেড পর্বঃ তরাইনের প্রথম যুদ্ধ (দ্বিতীয় ভাগ)
=========================================
দিল্লির মন্ত্রনাকক্ষে কাপুরুষ কইমসের মুখোমুখি পৃথ্বীরাজ
========================================
ধর্ম রক্ষার স্বার্থে গুজরাটের রাজা দ্বিতীয় ভীমদেব আপাতত আজমিরের বিরুদ্ধে আক্রমন স্থগিত রাখবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। আক্রমনের শঙ্কা স্থিমিত হবার সংবাদ শ্রবণের সাথে সাথেই দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ নির্ণয় নিলেন স্মেচ্ছ ঘোরী বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ভারতমাতাকে শঙ্কা মুক্ত করবার। সেইমতো তিনি লালকোটের মন্ত্রণা সভায় সকল সভাসদ আর অমাত্যদের এক আপাতকালীন জরুরি সভায় ডেকে পাঠালেন। সভায় দিল্লির দুই সেনাপতি উদয়রাজ আর চামুণ্ডা রায় আর সামন্ত রাজ অর্জুন রায় গোমাংস ভক্ষনকারী দুর্বৃত্ত স্মেচ্ছ ঘোরী বাহিনীকে যথোচিত শিক্ষা প্রদানের জন্য তুর্কিদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে যুদ্ধ ঘোষণা করবার পক্ষে মতদান দিলেন। কিন্তু কাপুরুষ অমাত্য প্রধান কইমস এবারেও পৃথ্বীরাজের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “ক্ষমা করবেন মহারাজ, আপনি এবং আপনার সেনাপতি ও সামন্ত রাজারা বয়সে তরুন। আপনাদের ধমনী দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে উষ্ণ রক্তস্রোতের তাজা ধারা। শত্রুর বিরুদ্ধে খুব অল্পেতেই উত্তেজিত হয়ে যুদ্ধের পথ বেছে নেন আপনারা। কিন্তু যুদ্ধনীতি ও রাজনীতিতে আপনারা এখনও অনভিজ্ঞ। আমাদের মনে রাখতে হবে এই মুহূর্তে আমাদের শত্রু রাজা ভীমদেব বা রাজা জয়চাঁদের ন্যায় আর্যবর্ত্মের কোন অতি পরিচিত প্রতিবেশী রাজ্য নয়, আমাদের শত্রু সদুর গর্জিনীর রক্ষ মরুপ্রান্তর আর বন্ধুর গিরিকান্তর প্রদেশ থেকে আগত গোমাংসভোগী স্মেচ্ছ যবন বাহিনী। যবনদের ধর্ম, সংস্কৃতি আর যুদ্ধনীতি আমাদের সম্পূর্ণ অপরিচিত। এর আগেও একাধিকবার ওরা আমাদের মাতৃভূমিতে হামলা চালিয়ে আমাদের রাজাদের পরাজিত করে অবাধে লুণ্ঠনপর্ব সম্পন্ন করেছে। খুব সম্ভবত এবারেও ওদের লক্ষ্য শুধুমাত্র ভারতবর্ষের ধনসম্পদ লুণ্ঠন। আমার মত যদি গ্রহণ করেন মহারাজ, তাহলে অজানা বর্বর বিজাতীয় যবন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায় না গিয়ে তাদের প্রচুর পরিমানে রত্নরাজি উপঢৌকন প্রেরন করে মহম্মদ ঘোরীর সহিত সন্ধি চুক্তি সাক্ষরিত করুন। এতে অজানা শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধযাত্রা এড়ানো সম্ভব হবে, আবার তুর্কি আগ্রাসনের হাত থেকে দিল্লি-আজমিরকে রক্ষা করাও সম্ভব হবে। মহারাজ শাস্ত্রেই লিপিবদ্ধ রয়েছে, শত্রুর শত্রু আমার মিত্র। অতএব যবনদের সহিত সন্ধি চুক্তির সময় আপনি তাঁদের সামরিক সহায়তা নিয়ে আপনার দুই প্রবল শত্রু রাজা জয়চাঁদ আর রাজা ভীমদেবকেও পরাজিত করবার সুযোগ পাবেন।”

অমাত্য কইমসের মুখে এহেন কাপুরুষোচিত পরামর্শ শুনে যারপরনাই ক্ষিপ্ত হলেন মহারাজ পৃথ্বীরাজ চৌহান। তিনি বিদ্যুৎ গতিতে নিজের রাজসিংহাসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের অসি কোষমুক্ত করে কইমসের সামনে এগিয়ে এসে তাঁর কণ্ঠনালিতে নিজের তরবারির ফলা স্পর্শ করে ক্ষুব্ধ স্বরে বলে উঠলেন, “অবিলম্বে আপনার বাক্য সম্বরন করুন অমাত্য প্রধান কইমস। আপনি নিজে একজন রাজপুত ক্ষত্রিয় হয়েও আরেক রাজপুতকে পরামর্শ দান করছেন বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুর্কি দস্যুদের বিরুদ্ধে শান্তি ক্রয় করবার ? আজ থেকে দ্বাদশ বর্ষ পূর্বেও কায়দারার যুদ্ধের সময় আমার নিজের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র আপনার কাপুরুষোচিত পরামর্শ শুনে গুজরাটের রাজমাতা রানি নাইকিদেবীকে কোনরূপ সহায়তা প্রদান করতে পারিনি। কিন্তু তখন আমি বালক ছিলাম, দুর্বল ছিলাম। একক সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা আমার ছিল না। আপনার সেদিনের সেই কাপুরুষোচিত পরামর্শের কারনেই আজ রাজা ভীমদেব দিল্লির শত্রু। কিন্তু আজ আমি যুবা ও এক শক্তিশালী নরপতি। আপনি বোধহয় বিস্মৃত হয়েছেন যে, রাজপুত ক্ষত্রিয়দের নিকট যুদ্ধ হলো তাঁদের অন্যতম প্রিয় ক্রীড়া আর নিজের প্রান দিয়ে মাতৃভূমি আর প্রজাগণের সম্মান, প্রান আর সম্ভ্রম রক্ষা করা হলো ক্ষত্রিয়ের পরম কর্তব্য। ক্ষত্রিয়রা প্রয়োজনে নিজের মস্তক বিসর্জন দেয়, কিন্তু কখনও শত্রুর সম্মুখে মাথানত করে না, আমি এই মুহূর্তে বিজাতীয় স্মেচ্ছ ঘোরী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছি। হয় রণাঙ্গনে তুর্কি দুর্বৃত্ত বাহিনীকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে, আর্যবর্ত্মকে সম্মানিত করে বিজয়ীর বেশে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করবো, নতুবা যুদ্ধভূমিতেই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে প্রান বিসর্জন দেবো। জয় সোমেশ্বর।”

পৃথ্বীরাজের যুদ্ধযাত্রা
===============
পৃথ্বীরাজের সিদ্ধান্ত শুনে মন্ত্রণাকক্ষে উপস্থিত অবশিষ্ট সেনাপতি ও সামন্তরাজরা একত্রে তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে “হর হর মহাদেব” ধ্বনিতে মন্ত্রণাকক্ষ আন্দোলিত করে তুললেন। পরেরদিন ঊষার প্রথম কিরণ প্রস্ফুটিত হবার সাথে সাথেই দেখা গেল পৃথ্বীরাজ সুদ্ধ বসনে লালকোট প্রাসাদ সংলগ্ন কুঞ্জবনের পশ্চাৎভাগে অবস্থিত সরোবরে স্নান পর্ব সম্পন্ন করে প্রাসাদের ঈশানকোনে অবস্থিত সুবিশাল সোমেশ্বর দেবের মন্দিরে প্রবেশ করে ভক্তিভরে তরবারি পূজো সম্পন্ন করে, বিধর্মীদের বিরুদ্ধে আসন্ন যুদ্ধে বিজয়লাভের প্রার্থনা করলেন। এরপর প্রাসাদে ফিরে এসে যুদ্ধের আভূষণে সজ্জিত হয়ে নিজের মাতা রানি কর্পূরদেবীর সম্মুখে এসে উপস্থিত হয়ে মায়ের পদস্পর্শ করে প্রনাম করলেন। তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে আসন্ন মহারণে নিজের জ্যৈষ্ঠ পুত্রের সাফল্য কামনা করে লালকোট প্রাসাদ চত্বরে অবস্থিত ২৭ টি বিগ্রহ মন্দিরে পূজা সম্পন্ন করে তার জন্য পদ্মপুষ্প নিয়ে এসেছিলেন। রানি কর্পূর দেবী প্রথমে পৃথ্বীরাজের ললাটে পূজোর পদ্মপুষ্প স্পর্শ করিয়ে তারপর চিরাচরিত রাজপুত প্রথা অনুসারে বিজয়তিলক অঙ্কিত করে আবেগপূর্ণ বাষ্পরুদ্ধ স্বরে বললেন, “বিজয়ী ভব, আশীর্বাদ করছি আজ থেকে দ্বাদশ বর্ষ পূর্বে গুজরাটের রাজমাতা নাইকি দেবীর ন্যায় তুমিও বিজাতীয় স্মেচ্ছ বাহিনীকে ভারতবর্ষের পবিত্র ভূমি থেকে বিতাড়িত করে সফল হয়ে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করবে।” এরপর নিজের মাতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পৃথ্বীরাজের কনিষ্ঠ ভগিনী রাজকুমারী পৃথাও তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় দাদাভাইয়ের ললাটে বিজয় তিলক অঙ্কিত করলেন। তারপর রাজপ্রাসাদের বাইরে এসে হস্তী বাহিনীর সম্মুখেভাগে আপাদমস্তক লৌহপাত আর লৌহ বর্ম দ্বারা আচ্ছাদিত একটি বিশেষ হস্তীর সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন রাজা পৃথ্বীরাজ। হস্তীর পৃষ্ঠদেশে সুকঠিন কাষ্ঠ নির্মিত একটি চতুষ্কোণ হাওদা। হাওদার চারপাশ কেল্লার বুরুজের মতো করে নির্মিত। ওই হাওদার বহির্বিভাগের চারিপাশে একাধিক সুকঠিন লৌহ ঢাল লাগিয়ে আরও মজবুত করা হয়েছে। হস্তী বাহিনীর অনান্য রণহস্তীগুলোও একইরকমভাবে সজ্জিত। তৎকালীন মধ্যযুগীয় ভারতীয় যুদ্ধের প্রথা অনুযায়ী হাওদার অভ্যন্তরে আপাত নিরাপদ স্থানেই আসন গ্রহণ করবেন দিল্লিশ্বর। হাওদার ভেতরেই থরে থরে সজ্জিত রয়েছে তুন ভর্তি তির আর একাধিক ভল্ল। এছাড়া মহারাজের কটিদেশের বাম প্রান্তে স্বর্ণকোষে ঝলমল করেছে তাঁর তরবারি আর পৃষ্ঠদেশে অবস্থান করছে তাঁর ধনুক। হাওদার সম্মুখে রয়েছেন মাহুত। নিজের প্রিয় মনিবকে দেখতে পেয়েই হাতিটি মহাখুশি হয়ে শূন্যে শুঁড় উত্থলিত করে সজোরে বৃংহণ ধ্বনি দিয়ে উঠলো। রাজাও যারপরনাই পুলকিত হয়ে তাঁর প্রিয় রণহস্তীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “উত্তম, অতি উত্তম গজরাজ।” এরপর গজরাজের পৃষ্ঠে আসীন হয়ে রাজা পৃথ্বীরাজ তাঁর অসি কোষমুক্ত করে নিজের সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে ভৈরবধ্বনিতে সিংহ গর্জন করে উঠলেন, “জয় সোমেশ্বর! হর হর মহাদেব।” প্রত্যুত্তরে দিল্লির সেনাবাহিনীও পাল্টা গর্জন করে জবাব দিলো, “হর হর মহাদেব”। এরপর শুরু হলো ভাতিণ্ডার উদ্দেশ্যে যুদ্ধযাত্রা।

যুদ্ধের প্রস্তুতি মইজুদ্দিন ঘোরীর
=======================
অপরদিকে সদুর পাঞ্জাবে ছল চাতুরির সাহায্যে ভাতিণ্ডা কেল্লা অধিকার করবার পর সেই কেল্লার ভেতরে অবস্থিত দিল্লি-আজমিরের সমস্ত বন্দি রক্ষীদের নির্মমভাবে হত্যা করলেন মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। তুর্কি অধিপতির হৃদয়ের অভ্যন্তরে তখনও যেন তীক্ষ্ণ শলাকার ন্যায় বিদ্ধ হচ্ছিল দ্বাদশ বর্ষ পূর্বে কায়দারার যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের স্মৃতি। এরপর কেল্লার ভেতরে অবস্থিত সুপ্রাচীন বারোটি মন্দির রাজি সম্পূর্ণ রূপে ধ্বস্ত করে সেগুলোর মালমশলা দিয়ে একটি অতিকায় মসজিদ নির্মাণ করা হলো ঘোরী আর তাঁর বাহিনীর নমাজ পাঠের জন্য। এরপর তুর্কি বাহিনীর রক্ষীরা কেল্লার ভেতরেই শিবির স্থাপন করে গোমাংস ভক্ষন আর সুরাপান করে দিন কতক সেখানেই আনন্দ উৎসব করলো। তারপর এক সন্ধ্যায় দৈনন্দিন নামাজপাঠের পর নিজের বাহিনীর রক্ষীদের এক জরুরি সভায় ডেকে পাঠালেন মইজুদ্দিন ঘোরী। সর্দারের নির্দেশ পেয়ে ভাতিণ্ডা কেল্লার ভেতরে অবস্থিত এক বিশাল প্রাঙ্গনে এসে জমায়েত হলো তুর্কি সেনারা। প্রাঙ্গনের অপর প্রান্তে কেল্লার উঁচু প্রাকারের উপর দণ্ডায়মান স্বয়ং মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। দীর্ঘ দ্বাদশ বছরের ব্যবধানে কায়দারার রণাঙ্গনের যুবা তুর্কি অধিপতি আজ রণকৌশলে পারদর্শী এক মধ্য বয়স্ক প্রবীণ ব্যক্তি। একাধিক মশালের আলোয় ঘোরীর দুই চক্ষুর ক্রূর দৃষ্টি থেকে যেন বিষধর সর্পের ন্যায় যেন দ্বেষপূর্ণ বিষাক্ত গরল নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। রক্ষীরা দেখতে পেলো, ঘোরীর বাম হস্তে বস্ত্রখণ্ডে নির্মিত একটি মানচিত্র আর দক্ষিন হস্তের মুষ্টিতে ধরা একটি তীক্ষ্ণধার ছুরিকা। নিজের সেনাদের উদ্দেশ্যে ঘোরী সর্পের ন্যায় হিমশীতল স্বরে বলে উঠলেন যে বিশ্রাম আর ফুর্তি অনেক হলো, এবারে সময় হয়েছে হিন্দুস্থানের মুল ভূখণ্ডে আক্রমন করে পৌত্তলিক কাফেরদের নির্ণায়কভাবে পরাজিত করে হিন্দুস্থানের বুকে এক বিশাল ইসলামিক সাম্রাজ্য স্থাপনের। সেই উদ্দেশ্যে তার প্রাথমিক লক্ষ্য হবে দিল্লি আর আজমির অধিকার। তারপর ঘোরী নিজের মুষ্টিতে ধরা মানচিত্রটি সর্ব সম্মুখে তুলে ধরে ছুরিকার ফলা দিয়ে একটি বিশেষ স্থান নির্দেশিত করে সেনাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন যে ওই জায়গাটি বর্তমান আজমির নরেশ পৃথ্বীরাজ চৌহানের রাজধানি রাজধানি দিল্লি নগর। এরপর মানচিত্রটি সামনের একটি উঁচু প্রস্তরখণ্ডের উপর রেখে ছুরিকার ফলা দ্বারা দিল্লি নগরের চিত্রকে বিদ্ধ করে হিমশীতল স্বরে বলে উঠলেন, “ইনশাল্লা, অদূর ভবিষ্যতে এই দিল্লি নগরই হতে চলেছে হিন্দুস্থানে বুকে আমার দ্বারা নবগঠিত ইসলামিক সাম্রাজ্যের রাজধানি। তোমরা সকলে তৈরি হও দিল্লি অধিকারের জন্য। এবারে আর দ্বাদশ বর্ষ পূর্বের কায়দারার যুদ্ধের ন্যায় ভুল করলে চলবে না আমাদের। ছলে, বলে আর কৌশলে কাফের রাজা রায় পিথোরার (পৃথ্বীরাজ) হাত থেকে দিল্লি ছিনিয়ে নেবো আমরা। আল্লাহ-আকবর”
ঘোরীর ভাষণ শেষ হবার সাথে সাথেই তুর্কি বাহিনী সমস্বরে গর্জন করে উঠলো, “আল্লাহ-আকবর”। এরপর ঘোরী সিদ্ধান্ত নিলেন আগামীকাল ভোরে দিল্লির উদ্দেশ্যে শুরু করবেন যুদ্ধযাত্রা।

তুর্কি শিবিরে এক অদ্ভুত ফকিরের আগমন
===============================
তখন প্রায় শেষরাত। নিজের তাঁবুতে নিদ্রামগ্ন মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। এমন সময় আচমকা তাঁবুর বাইরে এক তীব্র কোলাহলে নিদ্রা ভগ্ন হলো তার। যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয়ে ঘোরী ডেকে পাঠালেন তার দেহরক্ষীদের। বক্র অসি হস্তে পাগড়ি পরিহিত দুই ছাগল দাড়িওয়ালা রক্ষী সন্ত্রস্ত ভাবে এসে উপস্থিত হলেন সিপাহী সালারের তাঁবুর ভেতরে। তাদের নিকটে কোলাহলের কারন জানতে চাইলেন ক্রুদ্ধ ঘোরী। দুই রক্ষী কোনমতে ভীত কম্পিত স্বরে বলে উঠলেন ফকির গোছের এক অদ্ভুত আধা উন্মাদ ব্যক্তি আচমকা এসে উপস্থিত হয়েছে তাদের শিবিরে। তিনি অবিলম্বে সিপাহী সালারের সাক্ষাৎ প্রার্থী। তিনি দাবি করেছেন যে সর্দারের প্রতি একটি বিশেষ ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ এনেছেন তিনি। মইজুদ্দিন মহম্মদ
ঘোরী সামরিক বিদ্যা আর ছল-চাতুরিতে পারদর্শী হলেও যথেষ্ট কুসংস্কারগ্রস্ত মনভাবাপন্ন ব্যক্তি ছিলেন। এছাড়া পূর্বের কায়দারার যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি তখনও যেন তাকে এক দুঃস্বপ্নের ন্যায় তাড়া করে বেরাচ্ছিল। অজ্ঞাত পরিচয় কোন এক ফকির নিজে এই শেষরাতে তার সাথে দেখা করতে এসেছেন শুনে বিন্দুমাত্র কালবিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ তাঁকে ভেতরে নিয়ে আসবার অনুমতি দিলেন।

কিছুক্ষণ পরেই রক্ষীদের নজরবন্দি হয়ে ঘোরীর তাঁবুতে প্রবেশ করলেন এক মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি। বয়স তার আন্দাজ পঞ্চাস ছুঁইছুঁই। তিনি গুম্ফহীন হলেও তার গাল ভর্তি শুভ্র পরিপক্ক দাড়ি। তার মস্তক জুড়ে বিশাল সফেদ পাগড়ি আর পরনের পদযুগলের পাতা পর্যন্ত বিস্তৃত সফেদ আলখাল্লা। তাঁবুর ভেতরে প্রবেশ করেই তিনি কুর্নিশ করে বলে উঠলেন, “সুলতান-এ-ঘুর, জাহাঁপনা এতো রাতে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য মাফি চাইছি। এই অধমের নাম চিস্তি-মইন-আলদিন-হাসান-সিজ্জি। যদিও মইনউদ্দিন চিস্তি নামে অধিক পরিচিত। আমি এক সামান্য ফকির। আমি এসেছি সদুর হিরাট থেকে আপনাকে একটি বিশেষ বার্তা দানের জন্য।”
ঘোরী ফকির মইনউদ্দিন চিস্তিকে আসন গ্রহণ করতে বলে ভক্তিপূর্ণ স্বরে ফকিরের হিন্দুস্থান আগমনের হেতু জানতে চাইলেন। উত্তরে ফকির কিছুক্ষণ নীরব থেকে অবশেষে মন্দ্র স্বরে বলে উঠলেন, “কসুর নেবেন না সুলতান। আমি কিছুদিন আগে এক স্বপ্নে দেখলাম আপনার এই হিন্দুস্থান অভিযান অভিশপ্ত। গতবারের ন্যায় এবারেও নাকামিয়াব হতে চলেছেন আপনি। এবারেও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছেন। তাই এই বান্দার সবিনয় নিবেদন অবিলম্বে গজনী ফিরে যান আপনি। এরপর আমি নিজে গণনা করে আপনাকে হিন্দুস্থানে হামলার শুভ সময় আর তারিখ জানাবো।”

ফকিরের এহেন কথা শুনে বিস্ময়ে স্তভিত হয়ে পড়লেন ঘোরী। তিনি ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, “বেততমিজ তুমি নিজে একজন তুর্কি হয়েও আমার সিখস্ত কামনা করছো ? এছাড়া তুমি আমাকে সুলতান বলে সম্বোধন করছ কেন ? তুমি কি জানো না এই মুহূর্তে ঘুরের সুলতান আমার অগ্রজ ঘিয়াতউদ্দিন মহম্মদ ঘোরী ?”
মইজুদ্দিনের প্রশ্নের জবাবে ফকির মৃদু হেসে রহস্যময় কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আজ্ঞে জনাব, আমি স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখতে পারি। আমি স্বপ্নে দেখেছি বহুৎ জলদি আপনি ঘুর আর হিন্দুস্থানের সুলতান হবেন, তবে আমি স্বপ্নেও এও দেখেছি যে আপনার এইবারের হিন্দুস্থান অভিযান পূর্বের ন্যায় ব্যর্থ হবে। তাই আপনাকে কাতর মিনতি করছি মাননীয় সুলতান-এ-হজরত, আপনি গজনী ফিরে যান।”
এবারে ঘোরী যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয়ে তার রক্ষীদের নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে ইতর ফকির মইনউদ্দিন চিস্তিকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে তার শিবির থেকে তাড়িয়ে দেবার।

তুর্কি বাহিনীর যুদ্ধযাত্রা আর সৈন্য বিন্যাস
==============================
পরেরদিন ভোরে সেজে উঠলো তুর্কি বাহিনী। ঘোরী বাহিনীর সেনা সংখ্যা কত ছিল সে বিষয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। মিনহাজ- সিরাজের তাবাকত আই নাসিরি আর হাসান নিজামির তাজ-উল-মাসিরের মতে তুর্কি বাহিনীর সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৫০ হাজারের মতো। আবার জামি-উল-হিকায়ার মতে ঘোরী বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৪০ হাজারের আশেপাশে। অপরদিকে পৃথ্বীরাজ প্রবন্ধ, প্রবন্ধকোষা আর প্রবন্ধ চিন্তামনির মতো সমসাময়িক সংস্কৃত গ্রন্থ অনুসারে তুর্কি বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৮০ থেকে প্রায় ৯০ হাজারের মতো আর চাঁদ বারদাইয়ের কাব্যগ্রন্থ পৃথ্বীরাজ রাসো ও জয়নাকের কাব্যগ্রন্থ পৃথ্বীরাজ বিজয়ের মতে তুর্কি বাহিনীর সংখ্যা ছিল এক লাখের আশেপাশে। তুর্কি সেনাধ্যক্ষ জিয়াউদ্দিন আর তার ১২০০ অশ্বারোহী বাহিনীকে ভাতিণ্ডা কেল্লার দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে যুদ্ধযাত্রা শুরু করলো ঘোরী বাহিনী। তাদের সম্মুখ সারিতে অবস্থানরত বাদ্যকারদের দল তুড়ি, ভেড়ি আর দুন্দুভি বাজাতে বাজাতে, কলমা আর অর্ধ চন্দ্র অঙ্কিত সবুজ ঝাণ্ডা উড্ডীন করে যুদ্ধ যাত্রা শুরু করলো। বাদ্যকারদের পেছনের ভাগে বক্র অসি, তীক্ষ্ণধার কুঠার আর হাল্কা অজনের লৌহদণ্ড হস্তে দুলকি চালে চলেছে তুর্কি শিবিরের হাল্কা অশ্বারোহী বাহিনী। ফার্সি ভাষায় তাদের পোশাকি নাম আকিঞ্জি। তাদের পেছনের সারিতে পায়ে পা মিলিয়ে চলেছে বিশাল পদাতিক বাহিনী আজাপ। আজাপদের হাতে শোভিত হচ্ছে সুবিশাল তীক্ষ্ণধার ভল্ল, ভারি তরবারি, তির-ধনুক, অতিকায় কুঠার আর লৌহ নির্মিত ভারি ঢাল। তাদের পশ্চাৎভাগে মেদিনিতে অশ্বখুড়ে ধুলো উড়িয়ে চলেছে ভারি অশ্বারোহী বাহিনী। ফার্সি ভাষায় তাদের পোশাকি নাম সিপাহী। সিপাহীরা সজ্জিত মাঝারি মাপের ভল্ল, তরবারি আর ক্রসবো ধরনের তির-ধনুক দ্বারা। সবার পেছনের সারিতে রয়েছে হিন্দুস্থানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বলপূর্বক বন্দি করে আনা ধর্মান্তরিত অসহায় ভারতীয় কৃষক আর সাধারন প্রজাদের দল। এরা সজ্জিত ছিল তির-ধনুক, লৌহ দণ্ড আর অসি সহ বিভিন্ন অস্ত্র দ্বারা। মইজুদ্দিন ঘোরীর হুকুম অমান্য করলে পৈতৃক প্রানটা বেঘোরে খোয়াতে হবে এদের।

মইজুদ্দিন ঘোরীর থানেশ্বর নগর লুণ্ঠন
===========================
পূর্বের সেলজুক সুলতান মামুদ গজনীর দেখানো পথ অনুসরণ করে দিন দুয়েক যাত্রা শেষে সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম পবিত্র স্থান সুপ্রাচীন থানেশ্বর নগরে এসে উপস্থিত হলো ঘোরী বাহিনী। মামুদের ন্যায় সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন আর প্রভাস পট্টন নগর ধ্বংসের বাসনা ইতিপূর্বেই ধূলিসাৎ হয়েছে মহারানি নাইকি দেবীর পরাক্রমের ফলে। কিন্তু এবারে সম্পূর্ণ অরক্ষিত থানেশ্বর নগর লুণ্ঠন আর ধ্বস্ত করে মামুদের কীর্তিতে ভাগ বসানোর এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করলেন না ঘোরী। তার নির্দেশে “আল্লাহ আকবর” রবে এক ক্ষুধার্ত নেকড়ের ন্যায় সমৃদ্ধশালী থানেশ্বর নগরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো মামেলুক তুর্কি বাহিনী। তুর্কি তরবারি আর ভল্লের আঘাতে মুহূর্তের মধ্যেই থানেশ্বর নগর পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো অসহায় নগরবাসীর ক্ষতবিক্ষত মরদেহের স্থুপে। ধ্বস্ত হলো সুপ্রাচীন নগরের অগণিত মন্দিররাজি। এরপর মইজুদ্দিন ঘোরী নিজে তার ব্যক্তিগত রক্ষীবাহিনী সমেত উপস্থিত হলেন থানেশ্বরের বিখ্যাত যোগসোমার মন্দিরে। মন্দিরে প্রবেশ করে ঘোরীর নির্দেশে মুহূর্তের মধ্যে তুর্কি বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করলো সমস্ত অসহায় ভক্তবৃন্দ আর পুরোহিতগণকে। তারপর মন্দিরের যাবতীয় রত্নরাজি লুণ্ঠন করে, যোগসোমার বিগ্রহের বহুমূল্য রুবি ছিনিয়ে নিয়ে সম্পূর্ণ বিগ্রহটি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে সমগ্র মন্দির পরিসর কাফের পৌত্তলিকদের রক্তে শিক্ত করে রক্ষী সমেত বাইরে বেরিয়ে এলেন ঘোরী। প্রাচীন পবিত্র সরস্বতী নদীর সাথে যুক্ত থানেশ্বর নগরের সন্নিহিত সরোবরের জল রক্তিমবর্ণ ধারন করলো তুর্কি দস্যুদের অস্ত্রের আঘাতে নিহত নগরবাসীর রক্তে।

তরাইনের প্রান্তরে চিন্তিত চাঁদ পুন্দিরের বাহিনী
=================================
এহেন মর্মান্তিক গনহত্যা যখন সংগঠিত হচ্ছিল, ঠিক তখন থানেশ্বর থেকে কিছুদূরে তরারি বা তরাইন নামক এক বিশাল ময়দানের সম্মুখে নিজেদের সেনা শিবির স্থাপন করেছিল ভাতিণ্ডার সামন্তরাজ চাঁদ পুন্দির। পুন্দিরের সাথে উপস্থিত ছিলেন দুই সেনাপতি স্কন্ধ আর ভুবনায়ক মাল্লা। সেই সময় আজমির, গুজরাট, কনৌজ, দেবগিরি, বাংলা, কাকাতিয়া সহ সমগ্র ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মাবলম্বী রাজারা মৌর্য আর গুপ্ত সাম্রাজ্যের ন্যায় চতুরঙ্গ বাহিনী প্রতিপালন করতেন। সমসাময়িক ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মতে সেই সময় পুন্দিরের বাহিনীর সেনা সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৩০ হাজারের মতো। তাঁদের বাহিনী বিভক্ত ছিল অশ্বারোহী, তিরন্দাজ আর পদাতিক বাহিনীতে। কোন হস্তী বাহিনীর অস্তিত্ব ছিল না পুন্দিরের বাহিনীতে। এই বাহিনী দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ চৌহানের মূল বাহিনীর মাত্র এক তৃতীয়াংশ। হস্তী বাহিনী সহ অবশিষ্ট ৬০ হাজার বাহিনীই ছিল মহারাজ পৃথ্বীরাজ আর তাঁর খুড়তুতো ভ্রাতা গোবিন্দরাজ চৌহানের নিকটে। এহেন পরিস্থিতিতে চাঁদ পুন্দির যখন গুপ্তচরের মুখে স্মেচ্ছ ঘোরী বাহিনী দ্বারা নিকটবর্তী থানেশ্বর নগর ধ্বংসের সংবাদ পেলেন তখন রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে পড়লেও সাহস হারালেন না। তিনি একটি পত্র লিখে মহারাজ পৃথ্বীরাজকে যত দ্রুত সম্ভব তরাইনের যুদ্ধভূমিতে আসবার অনুরোধ জানিয়ে পুনরায় সংবাদ প্রেরন করলেন।

তারপর নিজের দুই সেনানায়কের সাথে এক জরুরি আলোচনা সভায় বসলেন। সেখানে সামন্তরাজ তথা সেনাপতি পুন্দির তাঁর সেনানায়কদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নির্ভীক স্বরে বলে উঠলেন, “প্রিয় মিত্রগণ, স্মেচ্ছ যবন দস্যুরা আমাদের মাতৃভূমিতে অনুপ্রবেশ করে ছলনার সাহায্যে ভাতিণ্ডার কেল্লা অধিগ্রহন করেছে, অত্যন্ত বর্বরতা আর নিষ্ঠুরতার সহিত পবিত্র থানেশ্বর নগর ধ্বংস করেছে। এবারে ওদের লক্ষ্য দিল্লি আর আজমির নগর। মহারাজ পৃথ্বীরাজ আমাকে নিযুক্ত করেছেন রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত শত্রু হানার হাত থেকে সুরক্ষিত রাখবার জন্য। মহারাজের আদেশ পালন করতে আমি বদ্ধপরিকর। কিন্তু এই মুহূর্তে যবন বাহিনী আমার বাহিনীর থেকে সংখ্যায় প্রায় তিনগুনেরও অধিক। নিজের অন্তিম নিঃশ্বাস পর্যন্ত বিজাতীয় স্মেচ্ছ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে আমি অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও, আপনাদের জীবন বিপন্ন করবার কোন অধিকার নেই আমার। অতএব আমি আপনাদের নিকট বিকল্প পেশ করছি। আপনারা চাইলে আমার সাথে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে স্মেচ্ছ দস্যু বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারেন, অথবা চাইলে আপনারা এই মুহূর্তে যুদ্ধভূমি ত্যাগ করে দিল্লির নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যেতে পারেন। বলুন আপনারা কি চান ?”
সেনাপতি পুন্দিরের প্রশ্নের উত্তরে সেনাপতি স্কন্ধ নিজের আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে নিজের কোষবদ্ধ অসি উন্মুক্ত করে শূন্যে উত্থলিত করে সিংহনাদ করে উঠলেন, “রাজা পুন্দির, আপনার ন্যায় মাতৃভূমির সম্মান রক্ষার্থে আমিও বহু পূর্বেই নিজের জীবন সমর্পিত করেছি। অতএব তরাইনের যুদ্ধভূমিতে দাঁড়িয়ে আপনার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত আমি।” স্কন্ধের বক্তব্য শেষ হতে না হতেই সেনাপতি ভুবনায়ক মাল্লাও উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, “রাজা পুন্দির, আমি এক ক্ষত্রিয় রাজপুত। আর কোন রাজপুত শত্রুর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে যুদ্ধভূমি ত্যাগ করে কাপুরুষের ন্যায় পলায়ন করেন না। তরাইনের প্রান্তরে বিজাতীয় তুর্কিদের অপবিত্র রক্তে নিজের তরবারি শিক্ত করে মাতৃভূমির জন্য উৎসর্গ করবো নিজের প্রান। তারপর সেনাপতি মাল্লা নিজের কোষবদ্ধ অসি শূন্যে উত্থলিত করে গর্জন করে উঠলেন, “হর হর মহাদেব”। সাথে সাথেই তরাইনের প্রাঙ্গনে দাঁড়ানো অবশিষ্ট সেনারাও গলা মিলিয়ে সমস্বরে গর্জন করে উঠলো, “হর হর মহাদেব”। সামন্তরাজ পুন্দির নিজের দুই নির্ভীক সেনানায়কের সম্মুখে এগিয়ে এসে তাঁদের সহিত আবেগপূর্ণ ভাবে আলিঙ্গনবদ্ধ হলেন।

পরেরদিন প্রত্যুষে সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই তরাইনের রণাঙ্গনে মুখোমুখি হলো মইজুদ্দিন ঘোরীর ভিনদেশি তুর্কি বাহিনী আর চাঁদ পুন্দিরের নেতৃত্বাধীন চৌহান বাহিনী। তরাইনের রণাঙ্গনের উন্মুক্ত ময়দানের দুই প্রান্তে ছিল ঘন অরন্য। মইজুদ্দিন ঘোরী তাঁর সাগরের জলরাশির ন্যায় সুবিশাল বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করলেন। বাম প্রান্তে নিজের বাহিনী সমেত অবস্থান নিলেন সেনাধ্যক্ষ নাসিরুদ্দিন কুবাচা আর দক্ষিন প্রান্তে নিজ বাহিনী সমেত অবস্থান নিলেন দ্বিতীয় তুর্কি সেনাধ্যক্ষ তাজউদ্দিন ইয়ালদুজ। দুজনেই নিজেদের বাহিনীর পদাতিক ধনুর্ধর রক্ষীদের একেবারে সম্মুখপ্রান্তে রাখলেন, তারপর অবস্থান নিল কৃতদাস বাহিনী, তার পরের সারিতে রইলো হাল্কা অশ্বারোহী বাহিনী। সবশেষে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত তুর্কি পদাতিক বাহিনী।
অপরদিকে মইজুদ্দিন ঘোরী নিজে তাঁর এক নতুন সেনাপতি সহ রণাঙ্গনের মধ্যপ্রান্তে অবস্থান নিলেন। প্রথমের সারিতে রাখলেন কৃতদাস বাহিনী, তারপরের সারিতে ভারি অশ্বারোহী বাহিনী এবং সবশেষে পদাতিক সেনা।

চাঁদ পুন্দিরের যুদ্ধের প্রস্তুতি
====================
সুবিশাল ঘোরী বাহিনীর সেনাসংখ্যা দর্শন করে কম্পিত হলো চৌহান সেনাপতি ভুবনায়ক মাল্লার হৃদয়। তিনি অশ্ব চালনা করে পুন্দিরের সম্মুখে এসে মৃদু স্বরে জিগ্যেস করলেন, “সামন্তরাজ পুন্দির, আপনার প্রেরিত পত্র কি পৌঁছেছে মহারাজ পৃথ্বীরাজের নিকটে ? যদি মহারাজ তাঁর বাহিনী সমেত সঠিক সময়ে রণাঙ্গনে পৌঁছতে না পারেন, তাহলে এক লহমায় শেষ হয়ে যাবে সবকিছু। গোমাংস ভক্ষণকারী বিদেশি স্মেচ্ছ দস্যুদের নিকটে সর্বস্ব হারাবে ভারতবর্ষ। নিজভূমেই সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়বে বহু শতাব্দী প্রাচীন বৈদিক ধর্ম আর সভ্যতার অস্তিত্ব।”
ভুবনায়ক মাল্লার প্রশ্নের জবাবে সামন্তরাজ পুন্দির তাঁর সেনাপতির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নির্ভীক ও দৃপ্ত স্বরে বলে উঠলেন, “সাহস হারাবেন না সেনাপতি মাল্লা। ইতিপূর্বে আমাদের মতোই কম সংখ্যক বাহিনী নিয়েও কায়দারার রণাঙ্গনে সুবিশাল ঘোরী বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেছিলেন মহারানি নাইকিদেবী। এছাড়াও আমার দৃঢ় বিশ্বাস মহারাজ পৃথ্বীরাজ সঠিক সময়েই তাঁর বিশাল বাহিনী সমেত রণাঙ্গনে উপস্থিত হবেন আর এই ধর্ম যুদ্ধে বর্বর স্মেচ্ছদের নির্ণায়কভাবে পরাজিত করে নিজ স্বাধীনতা, বৈদিক ধর্ম আর সভ্যতা রক্ষা করতে সফল হবো আমরা।

এরপর সামন্তরাজ পুন্দিরও তুর্কিদের ন্যায় নিজের বাহিনী তিন ভাগে বিভক্ত করলেন। দক্ষিন দিকের দায়িত্বে রইলেন সেনাপতি স্কন্ধ, বামপ্রান্তে সেনাপতি মাল্লা আর মধ্যভাগে চাঁদ পুন্দির। চৌহান বাহিনীর মুখ্য অস্ত্র ছিল ভারি তরবারি, বিশালকায় দণ্ড যুক্ত ভল্ল, চিরাচরিত কাষ্ঠ নির্মিত লম্বা ধনুক আর ওজনদার লৌহ ঢাল। যুদ্ধের বেশে সজ্জিত হয়ে নিজের অশ্বপৃষ্ঠে আসীন হয়ে অশ্বচালনা করে সেনাবাহিনীর সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন চাঁদ পুন্দির। তারপর নিজের অসি উন্মুক্ত করে সম্মুখ প্রান্তে এগিয়ে ধরে উদ্দাত্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন,
“ধন ধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা,
ওসে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সেদেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সেযে আমার জন্মভূমি,
সে যে আমার জন্মভূমি, সেযে আমার জন্মভূমি।”
গান সমাপ্ত করে নিজের সেনাদের উদ্দেশ্যে নির্ভীক স্বরে বলে উঠলেন, “আমার প্রিয় সেনারা, বিজাতীয় স্মেচ্ছ দস্যু বাহিনীর সাথে আমাদের পার্থক্য কি সেটা আপনারা জানেন ? ওদের সর্দার মইজুদ্দিন ঘোরী সদুর ঘোর থেকে আর্যাবর্ত্মে যুদ্ধ করতে এসেছে শুধুমাত্র ধনসম্পদ লুণ্ঠন আর সাম্রাজ্য বিস্তারের লোভে। ঘোরী বাহিনীর অধিকাংশ সেনাই ভাড়াটে। শুধুমাত্র ধন সম্পদ, সুরা আর রূপবতী রমণীর লোভ দেখিয়ে তাদের যুদ্ধভূমিতে নিয়ে এসেছে স্মেচ্ছ সর্দার ঘোরী। কিন্তু আমরা ধন সম্পদ লুণ্ঠন বা সাম্রাজ্য বিস্তারের লালসায় যুদ্ধ করছি না। আমরা আজ নিজেদের সর্বস্ব পন করে যুদ্ধ করছি শুধুমাত্র নিজ মাতৃভূমির সম্মান রক্ষা করতে, নিজ মাতৃভূমিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা করতে, হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সমৃদ্ধশালী বৈদিক ধর্ম আর সভ্যতাকে রক্ষা করতে, আজমির আর দিল্লির সহস্র নিরপরাধ ও নিরস্ত্র প্রজাদের প্রান রক্ষা করতে। হর হর মহাদেব।”
সাথে সাথে চৌহান বাহিনীও গর্জন করে উঠলো।

ভারতীয় ক্রুসেড পর্বঃ তরাইনের প্রথম যুদ্ধ (তৃতীয় পর্ব)
=======================================
বেজে উঠলো তরাইনের প্রথম যুদ্ধের শঙ্খধ্বনি
=================================
তরারির প্রান্তরে কাজল নদীর তীরে
তরবারি হস্তে উন্নত শিরে
দেখিতে দেখিতে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার মন্ত্রে
জাগিয়া উঠেছে রাজপুত ক্ষত্রিয়
নির্মম নির্ভীক।
হাজার কণ্ঠে আর্যাবর্ত্মের জয়
ধ্বনিতে আলোড়িত চতুর্দিক।
দেশপ্রেমের মন্ত্রে জাগিয়া উঠে ভারতবাসী বীর
নূতন উষার সূর্যের পানে
চাহিল নির্নিমিখ।
"হর হর মহাদেব”
মহারব উঠে বন্ধন টুটে
করে ভয়ভঞ্জন।
বক্ষের পাশে ঘন উল্লাসে
অসি বাজে ঝন্‌ঝন্‌।
দিল্লি আজি গরজি উঠিল,
"হর হর মহাদেব!'

তরারির প্রান্তরে চাঁদ পুন্দির তাঁর নেতৃত্বাধীন দিল্লি বাহিনীকে ত্রিশূল ব্যূহে সজ্জিত করলেন। মধ্যপ্রান্তে একদম সম্মুখভাগে নিজে তাঁর অশ্বারোহী আর ধনুর্ধর পদাতিক বাহিনী নিয়ে দণ্ডায়মান রইলেন, বাম প্রান্তে নিজের বাহিনী সমেত উপস্থিত রইলেন সেনাপতি ভুবনায়ক মাল্লা আর ডান প্রান্তে রইলেন দ্বিতীয় সেনাপতি স্কন্ধ। ব্যূহ রচনার পর চাঁদ পুন্দির তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন কোনমতেই তাঁরা যেন প্রথমেই ঘোরী বাহিনীকে আক্রমন না করেন।

অপরদিকে তুর্কি অধিপতি ঘোরী তাঁর বাহিনীকে অর্ধচন্দ্র ব্যূহে সজ্জিত করলেন। অর্ধচন্দ্রের মধ্যপ্রান্তে ঘোরী নিজে তাঁর নতুন ক্রীতদাস সেনাপতিকে নিয়ে রইলেন, বাম প্রান্তে রাখলেন সেনাধ্যক্ষ নাসিরুদ্দিন কুবাচাকে আর ডান প্রান্তে দ্বিতীয় তুর্কি সেনাধ্যক্ষ তাজউদ্দিন ইয়ালদুজ। পূর্ব দিগন্তের ধূসর প্রান্তরে সূর্যের আলো প্রস্ফুটিত হবার সাথে সাথেই ঘোরী বাহিনীর তুর্কি বাদ্যকাররা বাদ্য বাজিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। ঘোরীর পরিকল্পনা অনুসারে প্রথমে ১০০০ তুর্কি তিরন্দাজ, দিল্লির সেনাবাহিনীর দিকে অগ্রসর হয়ে প্ররোচনা মূলক তির বর্ষণ শুরু করলো। তৎক্ষণাৎ চাঁদ পুন্দিরের বাহিনী নিজেদের বিশালকায় লৌহ ঢাল সম্মুখপ্রান্তে বাড়িয়ে ধরলো। তুর্কি তিরন্দাজদের আক্রমন দিল্লি বাহিনীর ঢালে প্রত্যাঘাত হয়ে নিষ্ফলা হলো। এরপর উত্তেজিত নাসিরউদ্দিন তাঁর বাহিনীর সম্মুখভাগে থাকা হাল্কা ঘোড়সওয়ার বাহিনীকে নির্দেশদান করে বললেন, “যাও কাফেরদের খতম করে এসো।”


সেনাপতি স্কন্ধের বীরত্ব
================
সেনাপতির নির্দেশ পেতেই “আল্লাহ-আকবর” রবে তরবারি আর ভল্ল উঁচিয়ে অশ্বখুঁড়ে ধুলো উড়িয়ে চাঁদ পুন্দিরের বাহিনীর দিকে দ্রুতবেগে ধাবমান হলো তুর্কি বাহিনী। অস্ত্র হাতে নগ্ন পদে তাদের অনুসরণ করলো ধর্মান্তরিত ক্রীতদাস বাহিনী। এদিকে তুর্কি সেনাদের ধেয়ে আসতে দেখে সেনাপতি স্কন্ধ তাঁর ধনুর্ধরদের নির্দেশ দিলেন তির বর্ষণের। চৌহান বাহিনীর তির দ্রুতগতির তুর্কি অশ্বারোহীদের গতি রুদ্ধ সক্ষম না হলেও তাঁদের নিক্ষিপ্ত তিরের তীক্ষ্ণ ফলার আঘাতে নিহত হলো বেশকিছু ক্রীতদাস পদাতিক বাহিনীর সেনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কন্ধের বাহিনীর একেবারে সম্মুখে এসে পড়লো নাসিরের তুর্কি অশ্বারোহীগণ। এবারে সেনাপতি স্কন্ধ নিজের অশ্বপৃষ্ঠে আসীন হয়ে নিজের ডান হাতে ধরা ভল্ল শূন্যে উত্থলিত করে বলে নিজের বাহিনীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “মিত্রগণ স্মেচ্ছ যবন দস্যুরা আমাদের সম্মুখে উপস্থিত। এবারে সময় এসেছে ওদের রাজপুত শক্তি, পরাক্রম, শৌর্য আর দেশপ্রেমের সাথে অবগত করানোর। মাতৃভূমিকে শপথ করে বলছি আজ একজনও স্মেচ্ছ দস্যু আমাদের তীক্ষ্ণধার অস্ত্রের আঘাত থেকে রক্ষা পাবে না। আজ তুর্কি দস্যুদের রক্তে মোরা শিক্ত করে পবিত্র করবো তরারির প্রান্তর। তোমরা পাল্টা আক্রমন করো। হর হর মহাদেব”

সেনাপতি স্কন্ধের নির্দেশ পেতেই “হর হর মহাদেব” ধ্বনিতে চতুর্দিক আলোড়িত করে পাল্টা ভয়ানক আক্রমন শানালো তাঁর নেতৃত্বাধীন দিল্লির অশ্বারোহী আর পদাতিক বাহিনী। তরবারির ঝনঝনানি, ভল্লের আস্ফালন, অশ্বের হেস্রাধ্বনি আর দুই পক্ষের সেনাদের কোলাহলে শুরু হলো ধুন্ধুমার যুদ্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই দিল্লির সেনাদের পাল্টা ভয়ানক আক্রমনে নিহত হলো নাসিরের অধিকাংশ ক্রীতদাস পদাতিক বাহিনী। স্কন্ধের বাহিনীর অস্ত্রের নির্মম আঘাতে মৃত্যুর মিছিল দেখা গেল তুর্কি অশ্বারোহী বাহিনীতেও। চৌহান বাহিনীর রুদ্ররোষ দর্শন করে কম্পিত তুর্কি অশ্বারোহী বাহিনী এবারে পিছু হটলো। তারা দ্রুতগতিতে ফিরে যেতে লাগলো সেনাপতি নাসিরের দিকে। এদিকে পলায়নরত তুর্কিদের পিছু ধাওয়া করলো স্কন্ধের বাহিনী।

সেনাপতি ভুবনায়ক মাল্লার বীরগতি
=========================
অপরদিকে দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দ্বিতীয় তুর্কি সেনাপতি তাজউদ্দিন এবারে নিজের নেতৃত্বাধীন অশ্বারোহী আর পদাতিক সেনাদের আক্রমনের নির্দেশ দিলো। নির্দেশ পেয়েই মার মার রবে দ্রুতগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে ভুবনায়ক মাল্লার বাহিনীর দিকে ধেয়ে এলো তাজের বাহিনী। সেনাপতি মাল্লাও “জয় সোমেশ্বর” ধ্বনিতে গর্জন করে উঠে তাঁর বাহিনীকে পাল্টা আক্রমনের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু এযাত্রা স্কন্ধের ন্যায় সৌভাগ্য হলো না মাল্লার। কারন মাল্লার বাহিনীকে আক্রমনকারী তুর্কি বাহিনীর যোদ্ধারা ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পদাতিক আর ভারি অশ্বারোহী বাহিনী। এছাড়াও আক্রমনকারী তুর্কি বাহিনী সংখ্যার দিক থেকেও অনেক অধিক ছিল মাল্লার চৌহান বাহিনীর তুলনায়। পরাজয় সুনিশ্চিত জেনেও রাজপুত প্রথা অনুযায়ী বীরের ন্যায় নিজের অন্তিম নিঃশ্বাস বিন্দু পর্যন্ত তুল্যমূল্য যুদ্ধ করলেন সেনাপতি মাল্লা আর তাঁর বাহিনী। কিন্তু তুর্কি বাহিনীর অস্ত্রের আঘাতে একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে লাগলো তাঁর বাহিনীর সেনারা। একসময় সেনাপতি মাল্লাকে চতুর্দিক থেকে অবরুদ্ধ করলো তাজউদ্দিন আর তার ঘোড়সওয়ার বাহিনী। একদিকে ভল্ল হস্তে নিজের অশ্বপৃষ্ঠে আসীন একাকি সেনাপতি ভুবনায়ক মাল্লা, অপরদিকে তাজউদ্দিন সহ কমকরেও জনা চল্লিশেক তুর্কি অশ্বারোহী। শুরু হলো এক অসম যুদ্ধ। আত্মসমর্পণ করলেন না মাল্লা। মাল্লার ভল্লের আঘাতে আহত হয়ে নিজের অশ্বপৃষ্ঠ থেকে মাটিতে ভূপাতিত হলো তাজউদ্দিন নিজে, ঘায়েল হলো আরও জনা আটেক তুর্কি ঘোড়সওয়ার। শেষে একাধিক তুর্কি বাহিনীর নির্মম তরবারির আঘাতে রক্তাক্ত হলেন মাল্লা। গুরুতর আহত হয়ে নিজের অশ্বের পিঠ থেকে পড়ে গেলেন তরারির ভূমিতে। মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়া গুরুতর আহত মাল্লা সেই অবস্থাতেও কোনমতে নিজের দক্ষিন হস্তের মুষ্টি দিয়ে তুলে নিলেন একখণ্ড মাটি। তারপর পরম যত্ন সহকারে সেই মাটি নিজের ললাটে লাগিয়ে কোনমতে অস্ফুট ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলেন, “জয় মাতৃভূমি”। এমন সময় তাঁর পেছনে উপস্থিত হওয়া এক তুর্কি সেনার ভল্লের ফলা আহত মাল্লার ঘাড় আর কণ্ঠনালি ভেদ করলো নির্মমভাবে।

চাঁদ পুন্দিরের শৌর্য
==============
ওদিকে নাসিরের পলায়নরত বাহিনীকে ধাওয়া করে তুর্কি শিবিরে উপস্থিত হতেই নিজেদের ভুল আর চতুর রণনায়ক মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরীর ছলনাময় তুর্কি চাল উপলব্ধি করতে পারলো স্কন্ধ আর তাঁর বাহিনী। এবারে তাঁদের মোকাবিলা করবার জন্য উপস্থিত হলো নাসিরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভারি অশ্বারোহী বাহিনী। তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এবারে প্রবল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলেন সেনাপতি স্কন্ধ। অপরদিকে নিজের এক সেনাপতি মাল্লাকে শহীদ হতে দেখে এবং দ্বিতীয় সেনাপতি স্কন্ধকেও তুর্কি চক্রব্যূহে আক্রান্ত হতে দেখে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না সামন্তরাজ চাঁদ পুন্দির। তিনি এবারে “হর হর মহাদেব” ধ্বনিতে তাঁর বাহিনীকে আক্রমনের নির্দেশ দিয়ে ঘোড়া ছোটালেন নাসিরের বাহিনীর দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুন্দিরের বাহিনী তুর্কি শিবিরে উপস্থিত হয়ে প্রানপন আক্রমন শুরু করলেন। রাজপুত বাহিনীর অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যু হলো অধিকাংশ তুর্কি সেনার। চাঁদ পুন্দির নিজে ব্যক্তিগতভাবে মুখোমুখি হলেন নাসিরের সাথে। নাসির তাচ্ছিল্যপূর্ণ স্বরে পুন্দিরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “এখনও ওয়াক্ত আছে কাফের। তুমি যদি তোমার পৌত্তলিক ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম কবুল করে খলিফা-এ-দিল্লি রায় পিথোরার (পৃথ্বীরাজ চৌহান) বিরুদ্ধে আমাদের এয়নাত করো তাহলে আমাদের সিপাহী শালার তোমার জান বক্স করে দেবে”

জবাবে পুন্দির নাসিরের দিকে ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাচ্ছিল্যপূর্ণ স্বরে বলে উঠলেন, “তোমাদের মতো বিজাতীয় স্মেচ্ছদের নিকট ধর্ম শব্দের অর্থ কি সেটা আমার জানা নেই। কিন্তু আমাদের মতো রাজপুতদের নিকট বৈদিক ধর্ম কোন মামুলি ধর্ম নয়, আমাদের নিকটে ধর্ম হলো একটি আস্থা, যা অর্থ আর প্রাচুজ্যের লোভ দেখিয়ে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, আমাদের নিকট ধর্ম হলো সহস্র শতাব্দী প্রাচীন এক মহান সভ্যতা যা পেশি শক্তির আস্ফালন করে পরিবর্তন করা অসম্ভব। চাঁদ পুন্দির হাজার বার মৃত্যুবরণ আর হাজার বার জন্মগ্রহণ করতে প্রস্তুত, কিন্তু কখনও ধর্ম ত্যাগ করবে না। আর এক রাজপুতের নিকট বিশ্বাসযোগ্যতা আর মিত্রতা হলো এমন একটি প্রতিজ্ঞা, যা শত অত্যাচার করে বা শত প্রলোভন দেখিয়েও বদলানো সম্ভব নয়। দিল্লির মহারাজ তথা আমার পরম মিত্র পৃথ্বীরাজের প্রতি আমৃত্যুকাল পর্যন্ত বিশ্বস্ত থাকতে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এবারে নিজে মরবার জন্য প্রস্তুত হও বর্বর স্মেচ্ছ যবন।”

এরপর দুই সেনাপতি ভল্ল উঁচিয়ে তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে একে অপরের দিকে ধেয়ে এলেন। শুরু হলো দ্বন্দ্বযুদ্ধ। ঝনাৎ, ঠনাৎ শব্দে বার কয়েক একে অপরের ভল্ল ঠোকাঠুকি হলো। একসময় মরিয়া হয়ে নাসির দ্রুতবেগে অশ্ব ছুটিয়ে ধেয়ে এলো পুন্দিরের দিকে, তারপর পুন্দিরের শরীর লক্ষ্য করে সজোরে ভল্ল দিয়ে আঘাত হানলো। পুন্দিরের দক্ষিণ বাহু শত্রুর ভল্লের আঘাতে আহত হলেও, দ্রুত নিজের শরীর পেছনদিকে বেঁকিয়ে প্রাণঘাতী আঘাত থেকে কোনমতে নিজেকে রক্ষা করে পাল্টা নিজের ভল্ল দিয়ে সজোরে আঘাত হানলেন নাসিরের শরীর লক্ষ্য করে। পুন্দিরের ভল্লের ফলা নাসিরের বর্মের পুরু আস্তরন ভেদ করে তুর্কি সেনাপতির বক্ষের বামদিকে জোরালো আঘাত হানলো। টাল সামলাতে না পেরে আহত হয়ে অশ্বের পিঠ থেকে নিচে পড়ে গেলেন নাসির। এরপর পুন্দির এক লম্ফে নিজের অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরন করে এগিয়ে এলেন ভূপাতিত নাসিরের দিকে।

ঠিক এহেন সময় নিজের অন্যতম প্রিয় সেনাপতিকে রক্ষার জন্য অর্ধচন্দ্র ব্যূহের মধ্যভাগে অবস্থানরত মইজুদ্দিন ঘোরী তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন পুন্দিরকে হামলা করবার। তুর্কি তিরন্দাজগণ নিজেদের ক্রসবো উঁচিয়ে আল্লাহ আকবর রবে ধ্বনি দিয়ে পেছন থেকে কাপুরুষের ন্যায় তির বর্ষণ শুরু করলো চাঁদ পুন্দিরকে লক্ষ্য করে। একঝাঁক ঘাতক তির এসে বিদ্ধ করলো পুন্দিরকে। তিনি গুরুতর আহত হয়ে রক্তাক্ত দেহে ভূপাতিত হলেন তরারির (তরাইন) প্রান্তরে। প্রধান সেনাপতি তথা সামন্তরাজকে বিপদমুক্ত করবার জন্য স্কন্ধের নির্দেশে পাল্টা তির বর্ষণ শুরু করলো তাঁর নেতৃত্বাধীন বাহিনী। দিল্লি বাহিনীর তিরের আঘাত থেকে রক্ষা পেতে সাময়িকভাবে পিছু হটলো ঘোরী বাহিনী। এরপর নিজের রক্ষীদের নিয়ে রক্তাপ্লুত পুন্দিরের নিকটে ছুটে এলেন স্কন্ধ। মরনাপন্ন পুন্দির নিজের রক্তমাখা অশীতিপর হস্ত দিয়ে স্কন্ধের হাত চেপে ধরে আবেগপূর্ণ ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলেন, “আমরা এই যুদ্ধে পরাজিত হয়েছি সেনাপতি স্কন্ধ। ইতিপূর্বেই বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছেন সেনাপতি ভুবনায়ক মাল্লা, গুরুতর আহত আমি। মইজুদ্দিন ঘোরীর নেতৃত্বাধীন বিশাল স্মেচ্ছ যবন বাহিনী দ্রুত এগিয়ে আসছে এই দিকে। এই মুহূর্তে দিল্লির অন্তিম ভরসা কেবলমাত্র আপনি। আপনি অবিলম্বে নিজের অবশিষ্ট সেনাদের নিয়ে দ্রুত রণভূমি ত্যাগ করে দিল্লি ফিরে গিয়ে মহারাজ আর তাঁর অনান্য সামন্তদের বিস্তারিত বিবরণ দিন।”
স্কন্ধ বাস্পরুদ্ধ স্বরে বলে উঠলেন, “হে সামন্তরাজ, আপনাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে অনত্র পলায়ন করা রাজপুত ক্ষত্রিয় ধর্ম বিরোধী। হয় আমি আপনাকে রক্ষা করে একসাথে ফিরে যাবো, নতুবা তরারির প্রান্তরে স্মেচ্ছ দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতেই প্রান বিসর্জন দেবো।”

জবাবে পুন্দির বলে উঠলেন, “আপনি ভুলে যাচ্ছেন সেনাপতি স্কন্ধ,
মুক্তির মন্দির সোপানতলে
কত প্রাণ হলো বলিদান,
লেখা আছে অশ্রুজলে।।
কত বীর যোদ্ধার রক্তে রাঙা
বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙ্গা
তাঁরা কি ফিরিবে আজ সুপ্রভাতে
যত তরুণ যোদ্ধা গেছেন অস্তাচলে।।
যাঁরা স্বর্গগত তাঁরা এখনও জানেন
স্বর্গের চেয়ে প্রিয় এই জন্মভূমি
আসুন মোরা স্বদেশ ব্রতের মহা দীক্ষা লভি
সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ আমরা।
আজি রক্ত কমলে গাঁথা মাল্যখানি
বিজয় লক্ষ্মী দেবে তাঁদেরই গলে।।
শত্রুর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে জয়ী না হলে, বীরের ন্যায় লড়তে লড়তে মৃত্যু বরণ করাই এক রাজপুত ক্ষত্রিয়ের পরম ধর্ম আর আকাঙ্ক্ষা। আজ সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হতে চলেছে আমার। কিন্তু এই মুহূর্তে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করার দায়িত্ব সম্পূর্ণ রূপে নির্ভর করছে আপনার স্কন্ধের উপর সেনাপতি স্কন্ধ। আপনি অবিলম্বে অবশিষ্ট সেনাদের নিয়ে দিল্লি ফিরে গিয়ে মহারাজকে রণভুমির সবিস্তার বর্ণনা দিন আর হ্যাঁ মহারাজকে জানাবেন যে তাঁর বাল্য সখা তথা ভাতিণ্ডার সামন্তরাজ চাঁদ পুন্দির তরাইনের রণাঙ্গনে এক বীরের ন্যায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এটাই আমার নির্দেশ।
এরপর অশ্রুশিক্ত চোখে নিদারুন অনিচ্ছার সাথে সেনাপতি স্কন্ধ দিল্লির অবশিষ্ট জীবিত সেনাদের নিয়ে রণভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। অবশেষে পৌত্তলিক কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নির্ণায়ক ফতে (বিজয়লাভ) হাসিল করা গিয়েছে ভ্রম করে রক্তের নেশায় তুর্কি বাহিনী হারে রে রে রবে পিছু ধাওয়া করলো পলায়নরত সেনাপতি স্কন্ধ আর তাঁর অবশিষ্ট বাহিনীর।


পৃথ্বীরাজের যুদ্ধযাত্রা
===============
"বিজাতীয় তুর্কি দস্যু আসিছে রে ওই,
করো করো সবে সাজ'
পিথোরা গড়ে কহিলা হাঁকিয়া
দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ।
বেলা দু'পহরে যে যাহার ঘরে
সেঁকিছে জোয়ারি রুটি,
দুর্গতোরণে নাকাড়া বাজিছে
বাহিরে আসিল ছুটি।
প্রাকারে চড়িয়া দেখিল চাহিয়া
দুর্গের দক্ষিণে কিছুটা দূরে
আকাশ জুড়িয়া উড়িয়াছে ধুলা
দিল্লির হস্তীবাহিনীর বৃংহণ ধ্বনি আর অশ্বারোহীদের অশ্বখুরে।
"তুর্কিরা যত পতঙ্গপাল
কৃপাণ-অনলে আজ
ঝাঁপ দিয়া পড়ি ফিরে নাকো যেন'
গর্জিলা পৃথ্বীরাজ।”

একদিকে তরাইনের প্রান্তরে যখন নিদারুণ সংখ্যালঘু সেনা বাহিনী নিয়ে তুর্কি দস্যুদের বিরুদ্ধে বাঘ্র বিক্রমে যুদ্ধ করেও পরাজয়ের সম্মুখে দিল্লি বাহিনী, ঠিক সেই সময় যুদ্ধভূমি থেকে কিছুটা দূরে গভীর অরন্যপথে নিজ হস্তী বাহিনী সমেত দ্রুতগতিতে তরারির প্রান্তরে এগিয়ে চলেছেন দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ চৌহান। যবন দস্যুদের নগ্ন আগ্রাসন থেকে মাতৃভূমির সম্ভ্রম রক্ষার জন্য চিন্তিত পৃথ্বীরাজ, বিশাল বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুরস্ক দস্যু বাহিনীর আক্রমনের নাগপাশে আবদ্ধ নিজ বাল্যবন্ধু চাঁদ পুন্দির সহ অনান্য দুই সেনাপতির প্রান রক্ষায় চিন্তিত পৃথ্বীরাজ, যুদ্ধযাত্রায় নিজের বীর বৈমাত্রেয় ভ্রাতা গোবিন্দরাজ চৌহানের অনুপস্থিতির জন্যও তিনি চিন্তিত আজ। গোবিন্দরাজের অনুপস্থিতির কারনে তাঁর বাহিনী সংখ্যা এখন ৩০ হাজারের মতো। আরও ৩০ হাজার চৌহান সেনা রয়েছে গোবিন্দরাজের নেতৃত্বে। তবুও মাতৃভূমির স্বতন্ত্রতা, সম্মান আর সম্ভ্রম রক্ষায় অনড় পৃথ্বীরাজ অবিচলভাবে এগিয়ে চলেছেন তরারির রণাঙ্গনের দিকে।

ক্রমে দিন শেষ হয়ে এলো, সূর্যদেব অস্তাচলে গেলেন। ঘোর অমাবস্যার তমশাছন্ন রাতের গাড় আধার গ্রাস করলো বিশ্ব চরাচর। ক্লান্ত দিল্লির সেনাবাহিনী, পরিশ্রান্ত মহারাজ পৃথ্বীরাজ নিজেও। কিন্তু সঠিক সময়ে রণাঙ্গনে উপস্থিত হয়ে বাল্যবন্ধু পুন্দিরের জীবন রক্ষার জন্য মরিয়া পৃথ্বীরাজ রাতেও তাঁর যুদ্ধযাত্রা অব্যাহত রেখেছেন। একসময় তিনি উদ্বিগ্ন স্বরে তাঁর মাহুতের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “গজরাজের গতি এতো শ্লথ হয়ে পড়েছে কেন ? দ্রুত আরও দ্রুত তাঁকে পরিচালনা করুন। আগামীকাল প্রত্যুষে সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই আমাদের তরারির প্রান্তরে যেভাবেই হোক পৌঁছতেই হবে।”

দুই ভ্রাতার মিলনপর্ব
===============
এমন সময় জঙ্গলের গভীরে বাম প্রান্ত থেকে শোনা গেল বহু অশ্বের হেস্রাধ্বনি, ভূকম্পনধারী রণহস্তীর পদশব্দ আর বৃংহণ ধ্বনি আর অগণিত সেনার কোলাহল। শঙ্কিত হলেন পৃথ্বীরাজ। মনে মনে ভাবতে লাগলেন, কে ওরা ? ওরা কি গুজরাটের শত্রু রাজ ভীমদেব সোলাঙ্কির সেনাবাহিনী, নাকি কনৌজের শত্রুরাজ জয়চাঁদের বাহিনী ? দিল্লির এহেন বিপদজনক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কাপুরুষের ন্যায় অতর্কিতে আক্রমন করতে এসেছে। ধিক সেইসব ভারতবাসীদের।

এমন সময় কিছুটা দূর থেকে এক অতি পরিচিত কণ্ঠে শোনা গেল এক অতি পরিচিত কবিতা,
“দুশমন সে লোহা লেনে কো,
ডাঁটে হুয়ে হ্যায় রণ (যুদ্ধ) ম্যায় বীর,
হিলা না পায়ে পথ সে উনকো,
হো চাহে ভালে (ভল্ল) ইয়া তির,

টুট পড়ে হ্যায় শত্রু পে,
ও গিরতে হ্যায় মুহ কি বল,
ভাগ রাহে হ্যায় দুশমন,
চারো আউর মাচি হ্যায় এক হালচাল,
কই করতব কাম না আয়া
দুশমন কি হোশ উড়া
আউর নিকল গেয়ি সারি অভিমান
জয় জয় জয় পৃথ্বীরাজ চৌহান
জয় জয় জয় পৃথ্বীরাজ চৌহান”

এরপর হাজারো মশালের আলোয় আলোকিত অরন্যপথের মধ্যে থেকে রণহস্তীর পৃষ্ঠে আসীন হয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন পৃথ্বীরাজের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা তথা দিল্লির প্রধান বীর সেনাপতি গোবিন্দরাজ চৌহান। গোবিন্দরাজকে দেখে আনন্দের আথিসজ্জে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো পৃথ্বীরাজের দুই চোখ। তিনি অবিলম্বে তাঁর মাহুতকে নির্দেশ দিলেন গজরাজকে দাঁড় করানোর। তারপর দুই ভ্রাতা নিজ নিজ হস্তী পৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করে একে অপরকে আলিঙ্গনবদ্ধ করলেন। এরপর গোবিন্দরাজ, দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজের দুইহাত আঁকড়ে ধরে স্মিত হাস্যমুখে আবেগপূর্ণ স্বরে বলে উঠলেন, “চলুন ভ্রাতা মহারাজ, আমরা দুই ভাই এবারে একত্রে তরাইনের রণাঙ্গনে বিজাতীয় স্মেচ্ছ দস্যুদের উপর তুফানের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ধ্বংস করি যবন বাহিনীকে। হর হর মহাদেব।” জবাবে পৃথ্বীরাজও বলে উঠলেন, “জয় সোমেশ্বর”।

ভারতীয় ক্রুসেড পর্বঃ তরাইনের প্রথম যুদ্ধ (চতুর্থ এবং শেষ পর্ব)
=============================================
পৃথ্বীরাজের প্রবল প্রতি আক্রমণ
=======================
কায়দারার যুদ্ধের ১৩ বছর পর, ১১৯১ খ্রিষ্টাব্দে থানেশ্বরের নিকটে তরারি বা তরাইনের প্রান্তরে ঘোরের বিশাল তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুখোমুখি হলো ভাতিণ্ডার চৌহান সামন্তরাজ চাঁদ পুন্দিরের নেতৃত্বাধীন ক্ষুদ্র রাজপুত বাহিনী। সারাদিন ভয়াবহ যুদ্ধের পর নিহত হলো বহু তুর্কি সেনা। অপরদিকে যুদ্ধে বীরগতিপ্রাপ্ত হলেন চৌহান সেনাপতি ভুবনায়ক মাল্লা আর গুরুতর আহত হয়ে ধরাশায়ী হলেন সামন্তরাজ চাঁদ পুন্দির। রনাঙ্গনের অন্তিম শয্যায় শায়িত হয়ে তিনি তাঁর বাহিনির অন্তিম সেনাপতি স্কন্ধকে নির্দেশ দিলেন অবশিষ্ট বাহিনী সমেত রনাঙ্গন ত্যাগ করে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তনের। অপরদিকে সেই সময় নিজের রণহস্তী বাহিনী সমেত দ্রুতগতিতে তরাইনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন দিল্লির অন্তিম রাজপুত শাসক মহারাজ পৃথ্বীরাজ চৌহান। পথিমধ্যে নিজের বাহিনী সমেত পৃথ্বীরাজের বাহিনীতে যোগদান করলেন চৌহান বাহিনীর প্রধান সেনাপতি তথা পৃথ্বীরাজের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা গোবিন্দরাজ চৌহান।

পৃথ্বীরাজ আর গোবিন্দরাজের বাহিনী একত্রিত হয়ে এক বিশাল সেনা সমুদ্রের রূপ ধারন করলো। হামীরা মহাকাব্য আর প্রবন্ধ চিন্তামনি কাব্যগ্রন্থ অনুসারে দুই ভ্রাতার মিলিত বাহিনীতে দৈত্যাকার রণহস্তীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ এর নিকটে। এছাড়া অশ্বারোহী বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২০ হাজারের মতো আর অবশিষ্ট ৩২ হাজার পদাতিক আর ধনুর্ধর বাহিনী। দুই নিপুন রণনায়কের নেতৃত্বে তুফানের বেগে তরাইনের প্রান্তরের দিকে এগিয়ে চললো চৌহান বাহিনী।


অপরদিকে গুরুতর আহত ও সংজ্ঞাহীন সামন্তরাজ চাঁদ পুন্দিরকে রণভূমির তৃণশয্যার উপরেই পরম যত্ন সহকারে শায়িত অবস্থায় রেখে মৃত্যুপথ যাত্রী চাঁদ পুন্দিরের পাশে তাঁর অঙ্গসজ্জা হিসাবে সর্বদা নিজের কোষে বহনকারী প্রিয় অসিটা রেখে নিতান্ত অনিচ্ছা ভরা স্বরেই নিজের বাহিনীর অবশিষ্ট সেনাদের পশ্চাৎপশরনের নির্দেশ দিলেন স্কন্ধ। এরপর স্কন্ধের পরিকল্পনা অনুসারে তাঁর বাহিনীর ধনুর্ধররা ক্রমাগত তির বর্ষণ শুরু করলো তাঁদের দিকে অস্ত্র হাতে ধেয়ে আসা স্মেচ্ছ ঘোরী বাহিনীর উদ্দেশ্যে। তিরের আঘাতে সাময়িকভাবে পিছু হটলো তুর্কি বাহিনী। সেই সুযোগে এক লাফে নিজের অশ্বের উপর আসীন হয়ে দ্রুতগতিতে দিল্লির দিকে ধাবিত হলেন স্কন্ধ। সেনাপতিকে অনুসরণ করলো তাঁর বাহিনী। অপরদিকে স্কন্ধকে পালাতে দেখে তুর্কি অধিপতি মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী তাঁর বাহিনীর উদ্দেশ্যে উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন, “হে আমার জিহাদ-এ-লস্কর বাহিনী, আমার অকুতোভয় ফিদায়ে বাহিনী দেখো আজ তোমাদের আতঙ্কে সন্ত্রস্ত্র হয়ে কায়রের ন্যায় জঙ্গ-এ-ময়দান ত্যাগ করে পলায়ন করছে রায়-পিথোরার (পৃথ্বীরাজ) পরাজিত কাপুরুষ কাফের বাহিনী। হিন্দুস্থানের বুকে আল্লাহর পবিত্র স্বর্গরাজ্য দার-উল-ইসলামের স্থাপন আর মাত্র কিছুক্ষণের অপেক্ষা। তোমরা দাঁড়িয়ে না থেকে যাও ওদের পিছু ধাওয়া করো আর প্রত্যেক কাফেরকে হত্যা করে তোফা হিসাবে ওদের কাটা মস্তক নিয়ে এসো। মনে রেখো তোমাদের এই পবিত্র কর্মের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ তোমাদের প্রত্যেককে বেহশতে পাঠাবেন।”

ঘোরীর নির্দেশ পেয়ে আল্লাহ-আকবর রবে স্কন্ধের বাহিনীর পিছু ধাওয়া করলো তুর্কি বাহিনী। এদিকে কিছুক্ষণ যাত্রার পর তরারির মূল প্রাঙ্গণ পেরিয়ে অরন্য দ্বারা আবৃত যমুনা নদীর তটবর্তী এক বিশাল প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হলো স্কন্ধের বাহিনী। দক্ষ সেনাপতি স্কন্ধ উপলব্ধি করতে পারলেন আর পলায়নের চেষ্টা করা বৃথা। ভারতীয় অশ্বের চেয়ে আফগানিস্থান আর মধ্যপ্রাচ্যের অশ্ব অধিক বেশি দ্রুতগতি সম্পন্ন। তুর্কি অশ্বে সওয়ারি বিজাতীয় ইসলামিক সেনারা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘিরে ফেলবে তাঁদের। অতএব যমুনা নদীর তটে এই অরন্যে ঘেরা প্রান্তরের সাহায্য নিয়ে জীবনের অন্তিম সময় পর্যন্ত স্মেচ্ছ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সাকা পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন স্কন্ধ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেনাপতি স্কন্ধের চিন্তাকে বাস্তবে পরিণত করে তুর্কি বাহিনী চতুর্দিক থেকে বেষ্টিত করলো তাঁদের। তারপর আল্লাহ-আকবর রবে কোণঠাসা রাজপুত বাহিনীর দিকে ধেয়ে এসে আক্রমন শানালো তাঁদের। “জয় সোমেশ্বর” ধ্বনিতে চতুর্দিক আন্দোলিত করে পাল্টা প্রতি আক্রমণ করলো স্কন্ধের বাহিনী। কিন্তু বিশাল তুর্কি বাহিনীর সামনে কিছুক্ষণের মধ্যেই বধ্যভূমিতে পরিণত হলো যমুনার তট। অবশেষে নিজের অন্তিম যুদ্ধ লড়বার জন্য সেনাপতি স্কন্ধ নিজের অশ্ব থেকে অবতীর্ণ হয়ে বাম হস্তে একটি পুরু ঢাল আর দক্ষিণ হস্তে নিজের তরবারি নিয়ে “হর হর মহাদেব” রবে তুর্কি বাহিনীর দিকে ধেয়ে গেলেন। এরপর বীরবর স্কন্ধের তরবারির আঘাতে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত দেহে যুদ্ধভূমিতে লুটিয়ে পড়তে লাগলো একের পর এক তুর্কি সেনা। কিন্তু একাকি স্কন্ধ আর কতক্ষণ যুদ্ধ করবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুর্কি সেনাপতি তাজউদ্দিন আর তাঁর ঘাতক বাহিনী চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেললো স্কন্ধকে।

নিজের মৃত্যু আসন্ন বলে যখন ধরে নিয়েছেন স্কন্ধ। ঠিক সেই সময় রনাঙ্গনের ধরিত্রী যেন ভয়াবহ ভূকম্পনের ন্যায় কাঁপতে শুরু করলো, অনতিদূর থেকে ভেসে এলো একাধিক হস্তীর মদমত্ত বৃংহণ ধ্বনি, সেইসাথে গৌরিকুণ্ডের খরস্রোতা গঙ্গা নদীর ক্রুদ্ধ গর্জনধ্বনির ন্যায় ভেসে এলো অগনিত সেনার ভৈরব কণ্ঠের “হর হর মহাদেব”, “জয় সোমেশ্বর” কলধ্বনি। এক নতুন আশায় পুলকিত হয়ে পেছন ফিরে তাকালেন সেনাপতি স্কন্ধ। তিনি দেখতে পেলেন অবশেষে রনাঙ্গনে উপস্থিত হয়েছেন দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ চৌহান আর তাঁর ভ্রাতা গোবিন্দরাজ চৌহানের সুবিশাল সেনাবাহিনী। আনন্দে আত্মহারা স্কন্ধ বলে উঠলেন, “জয় মহারাজ পৃথ্বীরাজের জয়”। তাজউদ্দিন আর তাঁর নেতৃত্বাধীন তুর্কি বাহিনীও পেছন ফিরে পৃথ্বীরাজের বিশাল বাহিনী দর্শন করে তীব্র আতঙ্কে শিহরিত হয়ে উঠলো। তাজউদ্দিন ভীত-কম্পিত কণ্ঠস্বরে তাঁর বাহিনীকে পলায়নের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। দিল্লির বাহিনী এবারে ঘোরী বাহিনীকে চতুর্দিক থেকে বেষ্টন করলো। এরপর নিজের প্রিয় রণহস্তী গজরাজের পৃষ্ঠে আসীন পৃথ্বীরাজ নিজের অসি শূন্যে উত্থলিত করে বজ্রগম্ভীর স্বরে গর্জন করে বলে উঠলেন, “আক্রমণ”।

মহারাজের নির্দেশ পেয়ে দিল্লির বাহিনী দুইভাগে বিভক্ত হয়ে এক ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ের ন্যায় দুদিক থেকে সবেগে ধেয়ে এলো তুর্কি বাহিনীর দিকে। দিল্লির রণন্মাদ হস্তীবাহিনী তীব্র বৃংহণ ধ্বনি সহকারে ধেয়ে এলো তুর্কি বাহিনীর দিকে। তারপর তাদের বিশাল শুঁড়ে তুর্কি সেনাদের বেষ্টিত করে প্রথমে তাদের শূন্যে তুলে তারপর সবেগে মাটিতে আছাড় দিয়ে ফেলে আর তাদের বিশালকায় পা দিয়ে স্মেচ্ছ যবন দস্যুদের পদদলিত করে নির্মমভাবে হত্যা করতে লাগলো। অপরদিকে হস্তীপৃষ্ঠে আসীন দিল্লির দক্ষ তিরন্দাজরা নিপুনভাবে বিষাক্ত তির আর ভল্ল নিক্ষেপ করে নিধন করতে লাগলো ঘোরী বাহিনীকে। ভারতীয় বাহিনীর এহেন ভয়াবহ আক্রমনের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না তুরস্ক বাহিনী। অকেজো হয়ে গেল তাদের ঘোড়সওয়ার বাহিনী আর ক্রসবো ধারী হাল্কা ধনুর্ধর বাহিনী। কিছুক্ষণের মধ্যেই দিল্লির দৈত্যাকার রণহস্তী বাহিনীর আক্রমনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো বিজাতীয় স্মেচ্ছ বাহিনী। সেই সময় পৃথ্বীরাজ তাঁর বাহিনীর অবশিষ্ট ২০ হাজার অশ্বারোহী আর ৩২ হাজার পদাতিক সেনাকে নির্দেশ দিলেন আক্রমনের। এবারে রনাঙ্গনের দৃশ্যপট সম্পূর্ণরূপে বদলে গেল। রাজপুত বাহিনীর অস্ত্রের আঘাতে তুর্কি দস্যুদের বধ্যভূমিতে পরিণত হলো রনাঙ্গন। সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত ও বিধস্ত দুই তুর্কি সেনাপতি তাজউদ্দিন আর নাসিরউদ্দিন পরাজয় স্বীকার করে তীব্র আতঙ্কে রনে ভঙ্গ দিয়ে কাপুরুষের ন্যায় সাধারন অশ্বারোহী সেনার ছদ্মবেশ ধারন করে রণভূমি ত্যাগ করে পলায়ন করলো। পৃথ্বীরাজ আর তাঁর তুর্কি নাশক বিজয়ী বাহিনী গৈরিক ধ্বজ আন্দোলিত করে “হর হর মহাদেব” রবে তাদের পিছু ধাওয়া করলো।

গোবিন্দরাজের পরাক্রমের সম্মুখে নতনাজু মইজুদ্দিন ঘোরী
==========================================
অপরদিকে গোবিন্দরাজ তাঁর বাহিনী সমেত অগ্রসর হলেন তরাইনের মূল রনাঙ্গনের দিকে। এদিকে পৃথ্বীরাজের কাফের বাহিনীর বিরুদ্ধে তরাইনের যুদ্ধে জয়লাভ সম্পন্ন হয়েছে ভ্রম করে, তুর্কি অধিপতি মইজুদ্দিন ঘোরী তাঁর বাহিনীর অধিকাংশ সেনাকে পলায়নরত স্কন্ধের বাহিনীকে নিধন করবার জন্য প্রেরন করেছিলেন। তরারির প্রান্তরে ঘোরীর সাথে উপস্থিত ছিল তাঁর নতুন ক্রীতদাস সেনাপতি সহ মাত্র পাঁচশত তুর্কি অশ্বারোহী বাহিনী আর তাঁর দুইশত পদাতিক অঙ্গরক্ষক। নিজেদের ভল্লের ফলায় সেনাপতি স্কন্ধ আর তাঁর কাফের সেনাদের কাটা মুণ্ডু বিদ্ধ করে কখন বিজয়দর্পে তাঁর বীরপুঙ্গব তুর্কি সেনারা আল্লাহ-আকবর ধ্বনিতে কাফেরস্থান আন্দোলিত করে প্রত্যাবর্তন করবে এই চিন্তায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। এমন সময় তাঁর প্রিয় তুর্কি বাহিনীর পরিবর্তে তরাইনের প্রান্তরে বিশাল রাজপুত বাহিনী সমেত উপস্থিত হলেন দিল্লির সেনাপতি গোবিন্দরাজ। তরারির প্রান্তরে এসেই তিনি প্রবলবেগে আক্রমণ করলেন তীব্র বিস্ময়ে অভিভূত হতবাক মহম্মদ ঘোরীকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোবিন্দরাজের প্রবল আক্রমনের সম্মুখে খড়কুটোর মতো উড়ে গেল মুষ্টিমেয় ঘোরী বাহিনীর প্রতিরোধ। নিজের বাহিনীর নিধন রুখবার জন্য মইজুদ্দিন ঘোরী এবারে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে বসলেন গোবিন্দরাজকে। চতুর ঘোরী নিজের তরবারি ফেলে দিয়ে নিজের অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করে সম্পূর্ণ অস্ত্রহীন অবস্থায় গোবিন্দরাজের রণহস্তীর সম্মুখে এসে উদ্দেশ্যে তির্যক স্বরে বলে উঠলেন, “আমি শুনেছি তোমরা রাজপুতরা সম্মানযুদ্ধে বিশ্বাস করো আর নিরস্ত্র শত্রুকে আঘাত করো না। আমি ঘোরের প্রধান সিপাহী সালার মইজুদ্দিন মহম্মদ বিন সাম ঘোরী আজ সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় তোমার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তোমাকে এক বীরের ন্যায় তরবারির দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছি। যদি আমি বিজয়ী হই তাহলে তুমি পরাজয় স্বীকার করে আমাকে নিজের ওয়াতন ঘোরে ফিরে যেতে দেবে, আর যদি পরাজিত হই তাহলে আমাকে হত্যা করলেও অন্তত আমার সিপাহীদের মুক্তি দেবে। বল রাজি আছ এই শর্তে ?”

ঘোরীর দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান গোবিন্দরাজের ক্ষাত্রধর্মে আঘাত করলো। তিনিও তৎক্ষণাৎ নিজের অসি শূন্যে উত্থলিত করে বলে উঠলেন, “এর আগেও কায়দারার যুদ্ধে, রাজপুত ক্ষত্রিয় যোদ্ধাদের বীরত্ব, দেশ আর ধর্ম প্রেম আর আত্মত্যাগের পরিচয় তুমি পেয়েছিলে স্মেচ্ছ দস্যু সর্দার মইজুদ্দিন ঘোরী। এবারেও তুমি আরেকবার পরিচয় পাবে রাজপুতানার পরাক্রম আর শৌর্যের। আমি তোমার শর্তে রাজি ঘোরী।”
এরপর নিজের হস্তী পৃষ্ঠ থেকে অবতরন করে তরবারি হস্তে একটি অশ্বপৃষ্ঠে আসীন হলেন গোবিন্দরাজ। অপরদিকে ঘোরীও নিজের তরবারি নিয়ে পুনরায় নিজ অশ্বপৃষ্ঠে আসীন হলেন। তারপর তরবারি উঁচিয়ে ঘোরী আর গোবিন্দরাজ একে অপরের দিকে ধেয়ে এলেন। শুরু হলো এক ভয়ানক দ্বন্দ্বযুদ্ধ। দুই যুযুধান যোদ্ধার অসির ঝনঝনানি আওয়াজ আর দুজনের অশ্বের হেস্রাধ্বনিতে কম্পিত হতে লাগলো চতুর্দিক। একসময় নিজের থুতনিতে ঘোরীর তরবারির হাতলের আঘাত লেগে গুরুতর আহত হলেন গোবিন্দরাজ। তাঁর সম্মুখের পাটির গোটাদুয়েক দন্ত ভেঙে পড়লো। ওষ্ঠের কষ বেয়ে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগলো। আহত হয়ে তীব্র যন্ত্রণা আর নিদারুন ক্রোধে দ্রুতগতিতে ঘোরীর দিকে ধেয়ে এসে নিজের অসি দিয়ে ঘোরীর শিরস্ত্রাণ লক্ষ্য করে এক জোরালো আঘাত হানলেন গোবিন্দরাজ। গোবিন্দরাজের আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য নিজের অসি সুদ্ধ দক্ষিণ হস্ত মাথার উপরে তুললেন ঘোরী। গোবিন্দরাজের অসির তীক্ষ্ণধার ফলার আঘাত এসে নির্মমভাবে আছড়ে পড়লো ঘোরীর ডানহাতের বাহুতে। তৎক্ষণাৎ ঘোরীর হাত থেকে মাটিতে খসে পড়লো তাঁর তরবারি। আহত ও রক্তাক্ত ঘোরী অস্ফুট স্বরে আর্তনাদ করে রনে ভঙ্গ দিয়ে কোনমতে নিজের অশ্বের মুখ বিপরিত দিকে করে যন্ত্রণাক্লিষ্ট বিকৃত মুখে পলায়ন করলেন। হর হর মহাদেব রবে তাঁর পিছু ধাওয়া করলেন গোবিন্দরাজ। কিন্তু দ্রুতগামির তুর্কি অশ্বের সাথে গতি যুদ্ধে পরাজিত হলেন বীরবর গোবিন্দরাজ।

তরাইনের রনাঙ্গন ছেড়ে রাজপুত বাহিনীর নজর এড়িয়ে আরও কিছুদূর অগ্রসর হয়ে একসময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে তীব্র যন্ত্রণায় সংজ্ঞাহীন হয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলেন ঘোরী। ভারতবর্ষের দুর্ভাগ্য আর ঘোরীর সৌভাগ্য সেদিন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়লো। রাজপুত শিবির থেকে ভেসে এলো দিনান্তের যুদ্ধ বিরামের ঘোষণাকারী বিউগলের ধ্বনি।

পৃথ্বীরাজের বন্ধু বিচ্ছেদ আর ভাতিণ্ডা কেল্লা মুক্ত
==================================
অপরদিকে দ্রুতগামীর অশ্বের সহায়তায় মহারাজ পৃথ্বীরাজ আর তাঁর বাহিনীর নজর এড়িয়ে নিরাপদ দূরত্বে সফলভাবে পলায়ন করতে সফল হলো দুই তুর্কি সেনাপতি তাজউদ্দিন ইয়ালদুজ আর নাসিরউদ্দিন কুবাচা। আর্যাবর্ত্মের পবিত্র ভূমি থেকে বিজাতীয় স্মেচ্ছ যবন দস্যুদের সফলভাবে পরাজিত ও বিতাড়িত করে স্বগর্বে গৈরিক ধ্বজ উড্ডীন করে “জয় সোমেশ্বর” ধ্বনিতে চতুর্দিক আলোড়িত করে তরাইনের মূল রণাঙ্গনে ফিরে এলেন পৃথ্বীরাজ। সেখানে এসেই ভ্রাতা গোবিন্দরাজের নিকটে তিনি পেলেন মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরীর কাপুরুষচিত পলায়নের শুভ সংবাদ। দুই ভ্রাতা নিজেদের শিবিরে যখন যুদ্ধজয়ের আনন্দ উৎসব পালন করতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় এক রক্ষী এসে পৃথ্বীরাজকে জানালেন মৃত্যুপথযাত্রী ভাতিণ্ডার সামন্তরাজ তথা পৃথ্বীরাজের বাল্যসখা চাঁদ পুন্দির গুরুতর আহত অবস্থায় অদূরে অপেক্ষা করছেন মহারাজের অন্তিম সাক্ষাৎলাভের জন্য।

মুহূর্তের মধ্যে বিজয় উৎসব পরিণত হলো এক শোক যাত্রায়। প্রিয় বন্ধুর সংবাদ শুনে শোকাতুর পৃথ্বীরাজ তৎক্ষণাৎ তাঁর দেহরক্ষী সমেত ছুটে গেলেন তরাইনের প্রান্তরে যেখানে আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় অন্তিম শয্যায় শায়িত ছিলেন চাঁদ পুন্দির। পুন্দিরের কাছে গিয়ে শোকস্তব্ধ পৃথ্বীরাজ পরম যত্ন সহকারে তাঁর মাথাটা নিজের জানুদেশে তুলে নিয়ে গভীর মমতা সহকারে পুন্দিরের রক্তমাখা দক্ষিণ হস্তের পাতা নিজের ডান হাতের অঙ্গুলি দিয়ে আঁকড়ে ধরলেন। এরপর চাঁদ পুন্দিরের মুখের দিকে তাকিয়ে বাষ্পরুদ্ধ স্বরে বলে উঠলেন, “তোমার কিচ্ছু হবে না পুন্দির। আমরা যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি। রাজপুত শৌর্য আর পরাক্রমের সম্মুখে পুনরায় নত হয়েছে উদ্ধত স্মেচ্ছ তুর্কি দুর্বৃত্ত বাহিনী। এবারে তোমাকে দিল্লি ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। রাজবৈদ্যের চিকিৎসার সহায়তায় কিছুদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ রূপে সুস্থ হয়ে উঠবে তুমি। তারপর আবার আমরা একত্রে যুদ্ধাভিযানে গিয়ে নাশ করবো তুর্কি, কনৌজ আর গুজরাট সহ দিল্লির সমস্ত শত্রুদের।”

পৃথ্বীরাজের কথা শুনে তাঁর দিকে তাকিয়ে কোনমতে ক্ষীণ স্বরে পুন্দির বলে উঠলেন, “তা আর সম্ভব নয় মহারাজ। আমার অন্তিম সময় আসন্ন। আমি গর্বিত বিদেশি স্মেচ্ছ দস্যুদের বিরুদ্ধে এই নির্ণায়ক ধর্মযুদ্ধে মাতৃভূমির স্বতন্ত্রতা আর ধর্ম রক্ষার জন্য নিজের প্রান উৎসর্গ করতে পেরে। নিজের মনকে শক্ত করুন মহারাজ। আর আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করুন যে দিল্লি ফিরে গিয়ে আমার স্ত্রী আর পুত্রকে জানাবেন তাঁদের পতি আর পিতা চাঁদ পুন্দির এক প্রকৃত রাজপুত বীরের ন্যায় তরাইনের যুদ্ধভূমিতে স্মেচ্ছ বিজাতীয় দস্যু বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে বীরগতিপ্রাপ্ত হয়েছে।”
পৃথ্বীরাজ কোনমতে ক্ষীণ স্বরে বললেন, “কথা দিলাম মিত্র”। এরপরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে চিরঘুমের দেশে যাত্রা করলেন চাঁদ পুন্দির। প্রিয় বন্ধুকে হারানোর শোকে আর দুঃখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন পৃথ্বীরাজ। সেরাতে তরাইনের প্রান্তরে স্থাপিত শিবিরেই সেনাবাহিনী সহ রাত্রি যাপন করলেন মহারাজ পৃথ্বীরাজ। পরেরদিন নিকটবর্তী লোকালয় থেকে বেশ কয়েকজন পুরোহিত সমেত ভাতিণ্ডা কেল্লার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন মহারাজ পৃথ্বীরাজ। ভাতিণ্ডা কেল্লায় উপস্থিত হয়ে তিনি দেখতে পেলেন কাপুরুষ তুর্কি সিপাহী সালার জিয়াউদ্দিন কাজি কেল্লা পরিত্যাক্ত করে ইতিপূর্বেই তার বাহিনী সমেত গজনীর দিকে পলায়ন করেছেন। বিনা বাধায় ভাতিণ্ডা কেল্লা তুর্কি অধিকার মুক্ত করে পুরোহিতদের দিয়ে শুদ্ধিকরণ করালেন পৃথ্বীরাজ। তারপর কেল্লার বিভিন্ন প্রান্তে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে থাকা দিল্লির হতভাগ্য চৌহান রক্ষীদের ক্ষতবিক্ষত মরদেহগুলি পূর্ণ শ্রদ্ধা সহকারে দাহ করে ভাতিণ্ডা কেল্লার বুরুজে পুনরায় গৈরিক ধ্বজ উড্ডীন করে রাজধানি দিল্লির উদ্দেশ্যে প্রত্যাবর্তন যাত্রা শুরু করলেন পৃথ্বীরাজ।

ক্রীতদাস সেনাপতির সাহায্যে প্রাণ রক্ষা ঘোরীর
=================================
অপরদিকে তরাইনের রনাঙ্গন ছেড়ে মইজুদ্দিন ঘোরীর পলায়নের পর এক সময় রাত নেমে এলো। তরারির রনাঙ্গনের অদূরে এক অরন্যপ্রান্তরে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে রয়েছেন গুরুতর আহত তুর্কি অধিপতি মইজুদ্দিন ঘোরী। প্রভুর পাশে দণ্ডায়মান তাঁর বিশ্বস্ত অশ্বটি মাঝেমধ্যেই হেস্রাধ্বনি তুলে যেন বলতে চাইছে “ওহে কোন পথিক কি যাচ্ছ আশপাশ দিয়ে। কেউ সামনে উপস্থিত থাকলে একটু এদিকে এসে দয়া করে আমার প্রভুর জীবন রক্ষা করো।” এমন সময় জ্ঞান ফিরে পেলেন ঘোরী। তাঁর ডান হাত তীব্র যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে রয়েছে। তীব্র জ্বরের ঘোরে বিজাতীয় তুর্কি অধিপতির শরীরটা যেন ভেঙে পড়তে চাইছে। নড়াচড়া আর চিৎকার করবার  ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। যন্ত্রণা ক্লিষ্ট একটা মৃদু গোঙানির আওয়াজ যেন ছিটকে বেরিয়ে আসছিল হিন্দুস্থানের মাটিতে জিহাদের স্বপ্ন দেখা তুর্কি অধিপতির মুখ থেকে। এমন সময় হটাতই তাঁর ঘোড়াটা চিঁহিহি করে ডেকে উঠলো। সন্ত্রস্ত্র ঘোরী অদূরেই শুনতে পেলেন একাধিক অশ্বখুড়ের আওয়াজ আর দেখতে পেলেন একাধিক মশালের আলো। অশ্বারোহীরা যেন তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছিল। তীব্র আতঙ্কে কম্পিত হলো তুর্কি অধিপতির হৃদয়। মনে মনে ভাবলেন কে ওরা ? কাফেররাজা রায় পিথোরার ঘাতক বাহিনী নাকি ? কিন্তু ঘোরীর ভাবনাকে মিথ্যে প্রমানিত করে কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশিষ্ট দেহরক্ষী সমেত তাঁর সামনে এসে উপস্থিত হলো ঘোরীর নব্য নিযুক্ত সেই ক্রীতদাস সেনাপতি। ক্রীতদাস সেনাপতির দর্শনলাভ করে ঘোরী কোনমতে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন, “ইনশাল্লা, সুভানাল্লা কুতুবউদ্দিন, আল্লাহর অসীম কৃপায় অবশেষে তুমি সন্ধান পেয়েছে আমার। এবারে আমার প্রান রক্ষা করো। কসম খাচ্ছি যদি আমি কখনও হিন্দুস্থানের বুকে ইসলামের সাম্রাজ্য স্থাপন করতে পারি তাহলে তুমিই হবে হিন্দুস্থানের প্রথম তুর্কি সুলতান।”

এরপর তুর্কি সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবক, আহত ঘোরীকে পরম যত্ন সহকারে নিজের অশ্বশকটে তুলে নিয়ে ঘোরের রাজধানি গজনীর দিকে যাত্রা শুরু করলেন। দীর্ঘ যাত্রাপথে আবার সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন মইজুদ্দিন ঘোরী। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ঘোরী তাঁর সুপ্ত চেতনায় দেখতে পেলেন সেই অদ্ভুত ফকির মইনউদ্দিন চিস্তি যেন তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বলেছেন, “আপনাকে আগেই এই অশুভ যুদ্ধযাত্রা স্থগিত রাখবার অনুরোধ করেছিলাম জাহাঁপনা। কিন্তু আপনি আমার নিষেধাজ্ঞা না শুনে উল্টে আমাকেই আপনার শিবির থেকে বিতাড়িত করলেন।”

পৃথ্বীরাজের দিল্লি প্রত্যাবর্তন আর রাজা জয়চাঁদের শত্রুতা
=========================================
অপরদিকে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুর্কি দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে নির্ণায়ক জয়লাভ করে বিজয়ীর বেশে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করলেন মহারাজ পৃথ্বীরাজ চৌহান। বিজাতীয় স্মেচ্ছ দস্যু বাহিনীকে পরাভূত করে মাতৃভূমি আর বৈদিক ধর্মের রক্ষা করে দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজের রাজধানিতে প্রত্যাবর্তনের সংবাদ শুনে তাঁদের প্রিয় মহারাজকে শুভেচ্ছা বার্তা জানাবার জন্য দিল্লির চকবাজার থেকে লালকোটের কেল্লা-প্রাসাদ পর্যন্ত সমবেত হলেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দিল্লির প্রজাগণ। দিল্লির প্রশস্ত রাজপথ, কুঞ্জবন আর শ্বেত প্রস্তর নির্মিত সুবিশাল সুরম্য মন্দির আর দ্বিতল প্রাসাদগুলি সজ্জিত করা হলো একাধিক রংবেরঙের পুষ্প স্তবকের মোড়কে। দেহরক্ষী পরিবৃত হয়ে গজরাজের পৃষ্ঠে আসীন মহারাজ পৃথ্বীরাজ পুষ্প স্তবক দ্বারা সজ্জিত দিল্লি নগরীর প্রধান তোরণ দ্বার অতিক্রম করে নগরীর মধ্যে প্রবেশ করতেই প্রজারা তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিতে শুরু করলেন। দিল্লির অগনিত মন্দিরে বেজে উঠলো শঙ্খ আর কাসর-ঘণ্টার ধ্বনি। রাজপ্রাসাদের রাজকীয় বাদ্যকাররা তুড়ি, ভেড়ি, দুন্দুভি আর বিউগল বাজিয়ে তুর্কি নাশক দিল্লিশ্বরকে স্বাগত জানালেন। লালকোট কেল্লা প্রাসাদের সিংহ দুয়ার অতিক্রম করে কেল্লার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই চৌহান রাজবংশের নারীরা পুষ্পবৃষ্টি সহকারে রাজপ্রাসাদে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ চৌহানকে। পৃথ্বীরাজের মাতা রানি কর্পূরদেবী আর ভগিনী রাজকুমারী পৃথা বাঈ লালকোটের বিগ্রহরাজের মন্দিরে পূজাদান সম্পন্ন করে ফিরে এসে জয় তিলক অঙ্কিত করলেন যবন বিজয়ী দিল্লিশ্বরের ললাটে। অপরদিকে তুর্কিদের বিরুদ্ধে পৃথ্বীরাজের এই অভূতপূর্ব সাফল্যে প্রবল ঈর্ষান্বিত হয়ে চান্দেলরাজের সাথে হাত মিলিয়ে তাঁর সামন্ত রাজ্য নাগোর আক্রমণ করে বসলেন কনৌজের রাজা জয়চাঁদ গাহারওয়াল। রাজা জয়চাঁদ জানতেন না নাগররাজ চেত সিংহ, দিল্লি নরেশ পৃথ্বীরাজের সাথে তাঁর একমাত্র কন্যা রাজকুমারী ইন্দ্রাবতী দেবীর বিবাহ স্থির করেছেন। জয়চাঁদের এহেন দুঃসাহসিক স্পর্ধার পরিচয় পেয়ে যারপরনাই ক্রুদ্ধ হলেন পৃথ্বীরাজ। অপরদিকে দিল্লির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য পুনরায় অস্ত্রে শান দেওয়া শুরু করলেন গুজরাট নরেশ ভীমদেব সোলাঙ্কি। এদিকে গজনী প্রত্যাবর্তন করে শাহী হাকিমের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠে পুনরায় নবোদ্যমে হিন্দুস্থানের মাটিতে জিহাদের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন পরপর দুবার পরাজিত মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরী। তাকে সাহায্যের জন্য পুনরায় এগিয়ে এলেন ফকির মইনউদ্দিন চিস্তি। এবারে আর ফকিরকে ফেরালেন না মইজুদ্দিন ঘোরী।


বিঃদ্রঃ রাজস্থান আর গুজরাটের বহু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন তথ্য সহকারে প্রমান করেছেন যে কনৌজের রাজা তথা পৃথ্বীরাজের চিরশত্রু রাজা জয়চাঁদের কোন কন্যা সন্তান ছিল না। চাঁদ বারদাইয়ের দ্বারা রচিত “পৃথ্বীরাজ রাসো” কাব্যগ্রন্থে বর্ণিত দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ আর কনৌজের রাজকুমারী সংযোগীতার প্রণয় পর্ব সম্পূর্ণ মিথ্যা আর বিকৃত ইতিহাস। পৃথ্বীরাজের রাজমাতা রানি কর্পূরদেবী তাঁর পুত্রের সাথে নাগরের সামন্তরাজের কন্যা রাজকুমারী ইন্দ্রাবতী দেবীর বিবাহ স্থির করেছিলেন। কিন্তু তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের ফলে সেই বৈবাহিক সম্পর্ক আর স্থাপিত হয়নি।
১১৯২ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে দিল্লির রাজপুত শাসক সম্রাট পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরাজয় ও মৃত্যুর পর থেকেই ভিনদেশি বর্বর তুর্কি আক্রমণের প্রবল সম্ভাবনা কালবৈশাখীর ঝড়ের মতই ঘনিয়ে আসছিল সমৃদ্ধশালী বাংলার পশ্চিম প্রান্তে। যতদিন পৃথ্বীরাজ জীবিত আর মুক্ত ছিলেন ততদিন তাঁর দুই বলিষ্ঠ বাহু আর সুতীক্ষ্ণ তরবারি বিদেশি তুর্কি আগ্রাসনকারীদের ভারতের পবিত্র ভূমিতে পদার্পণ করতে দেয়নি আর একমাত্র পৃথ্বীরাজ ব্যতিত তৎকালীন উত্তর ও পূর্ব ভারতের অবশিষ্ট নৃপতিরাও আসন্ন তুর্কি আক্রমণ আর তাদের ধর্মীয় জিহাদের চিন্তা নিজেদের বহু দূরবর্তী চিন্তাতেও স্থান দেননি। তাঁদের ভাবখানা এমন ছিল যেন তুর্কি আক্রমণ কেবলমাত্র দিল্লি তথা পৃথ্বীরাজেরই সমস্যা, যদি তুর্কিদের বিরুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেন তবে বাকিরা মিলে পৃথ্বীরাজকে উচিত শিক্ষা দেবেন আর যুদ্ধে যদি পৃথ্বীরাজের পরাজয় হয় তবে তুর্কিদের সাথে তাঁরা সমঝোতা করে নেবেন। সম্ভবত তুর্কিদের বর্বরতা আর ইসলামের আসল পরিচয় সম্বন্ধে তাঁদের সম্যক জ্ঞান ছিল না বলেই তাঁদের এই অদূরদর্শিতা আর অনৈক্যই আর কিছুকালের মধ্যেই এক ভয়ানক সর্বনাশ ডেকে আনল ভারতের বুকে। তৎকালীন যুগের হিন্দু নৃপতিদের অপরিনামিতার মূল্য শুধু তৎকালীন যুগেই নয়, তাঁদের পরবর্তী বহু প্রজন্মমকেও চোকাতে হয়েছিল নিজেদের রক্ত দিয়ে। তবু প্রশ্নটা থেকেই যায় তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর বিদেশি তুর্কিরা অপ্রতিরোধ্যভাবে যখন একের পর এক হিন্দু রাজ্যগুলি অধিকার করে সেখানে ব্যপক গণহত্যা, লুণ্ঠন, মন্দির আর মঠ ধ্বংস আর ধরমান্তকরন করছিল এবং বক্তিয়ারের হাতে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের পর তুর্কি সর্পদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস যখন বঙ্গের দুয়ারে এসে উপস্থিত হয়েছিল তখনও সেন সাম্রাজ্য সেই ভয়ানক বিপদের প্রতি এত উদাসীন ছিল কেন ? এই প্রশ্ন আজও এক ঐতিহাসিক বিস্ময়। এর উত্তরের সন্ধান কেবলমাত্র একটি উপন্যাস বা পোস্টে সম্ভব নয়। তবুও আমার এই পোস্টে যতটা সম্ভব সেই বিস্ময়ের সমাধানের প্রয়াস করা হবে। এই ব্যপারে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করবার আগে আসুন জেনে নি বাংলার সেন সাম্রাজ্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

সেন রাজবংশের উৎপত্তিঃ
===================
আসল কাহিনী শুরু করবার আগে আসুন জেনে নেই সেন রাজবংশের উৎপত্তির ইতিহাস। সেনরাজবংশের পূর্বপুরুষরা দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটকের অধিবাসী ছিলেন। তাঁদের শিলালিপি অনুযায়ী তাঁরা চন্দ্রবংশীয় এবং ব্রহ্মক্ষত্রিয় ছিলেন। বাংলার প্রাচীন কুলুজীগ্রন্থে তাঁদের বৈদ্যজাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানকালের ঐতিহাসিকদের মতে তাঁরা ক্ষত্রিয়জাত। সেন রাজারা কিভাবে আর কোন সময়ে সদুর কর্ণাটক থেকে বাংলায় এসে রাজবংশ স্থাপন করেছিলেন সে বিষয়ে সেন রাজবংশের শিলালিপিতে দুটি উক্তি আছে। শ্রী বিজয়সেনের দেওপাড়া লিপিতে উল্লিখিত আছে যে সামন্তসেন রামেশ্বরমে রামসেতু পর্যন্ত বহু যুদ্ধাভিযান করে এবং দুর্বৃত্ত কর্ণাটলক্ষ্মী লুণ্ঠনকারী শত্রুকূলকে ধ্বংস করে গঙ্গাতটের সন্নিকটে এক পূর্ণাশ্রমে তাঁর শেষ জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। সুতরাং এই লিপি থেকে অনুমান করা যেতেই পারে যে সামন্তসেনই সর্বপ্রথম কর্ণাটক থেকে বাংলায় এসে গঙ্গাতীরে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু বল্লাল সেনের নৈহাটি তাম্রশাসন লিপি অনুযায়ী চন্দ্রবংশজাত বহু রাজপুত্র রাঢ়দেশের অলঙ্কারস্বরূপ ছিলেন এবং তাঁদের বংশেই সামন্তসেন ভূমিষ্ঠ হন। সুতরাং এই লিপি অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে সামন্তসেনের পূর্বপুরুষগন রাঢ়দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। এই দুই লিপির মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন করলে এটা অনুমান করা যায় যে কর্ণাটকের এক সেনবংশ বহুদিন ধরেই রাঢ় বাংলায় বাস করতেন এবং সেই বংশের সামন্তসেন যৌবনে দাক্ষিণাত্যে বহু যুদ্ধে নিজের শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়ে এই বংশের উন্নতির সূত্রপাত করেন এবং সম্ভবত এর ফলেই তাঁর পুত্র শ্রী হেমন্ত সেন রাঢ় বাংলায় এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন।

লক্ষণ সেনের বিজয় যাত্রার পরিচয়ঃ
---------------------------------------------
১১১৮ খ্রিষ্টাব্দে লক্ষণ সেন জন্মগ্রহণ করেন আর ১১৭৮ খ্রিষ্টাব্দে পিতৃ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর রাজ্যকালের আটটি তাম্রশাসন, তাঁর সভাকবিগণ রচিত কয়েকটি স্তুতিবাচক শ্লোক, তাঁর পুত্রদ্বয়ের তাম্রশাসন ও তুর্কি ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দিন রচিত তাবাকত-ই-নাসিরী নামক গ্রন্থ থেকে লক্ষণ সেনের রাজ্যের অনেক বিবরণ পাওয়া যায়। বাল্যকালে তিইনি পিতা বল্লাল সেন আর পিতামহ বিজয় সেনের সাথে সমরভূমিতে উপস্থিত হয়ে রণকুশলতার প্রভূত পরিচয় দিয়েছিলেন। রাজা লক্ষণ সেনের দুটি তাম্রশাসনে উক্ত হয়েছে যে তিনি কৌমারে উদ্ধত গৌড়েশ্বরের শ্রীহরণ আর কলিঙ্গ দেশে অভিযান করেছিলেন। তিনি দিল্লিস্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা না করলেও কাশীরাজকে পরাজিত করেছিলেন এবং ভীরু প্রাগ-জ্যোতিষের (অসমের কামরূপ) রাজা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন।

বিজয়সেন আর বল্লাল সেন উভয়েই তৎকালীন গৌড়েশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। সুতরাং খুব সম্ভবত রাজকুমার লক্ষণ সেন তাঁর পিতামহ বা পিতার রাজত্বকালে গৌড়ে যে সামরিক অভিযান করেছিলেন প্রসস্তিকায় তারও উল্লেখ রয়েছে। আবার প্রশস্তিকার অন্যত্র লেখা রয়েছে যে লক্ষণ সেন নিজভুজবলে সমর-সমুদ্র মন্থন করে গৌড়লক্ষ্মী লাভ করেছিলেন। অর্থাৎ খহুব সম্ভবত ব্বিজয় সেন গৌড়রাজকে দূরীভূত করলেও তাঁর শাসনকালে খুব সম্ভবত গৌড় বিজয়্য সম্পূর্ণ হয়নি। কারন এরপরেও গোবিন্দপাল গৌড়েশ্বর উপাধি ধারণ করেছিলেন এবং বল্লাল সেনকে পুনরায় গৌড় অভিযান করতে হয়েছিল। লক্ষণ সেনই সম্ভবত সম্পূর্ণরূপে গৌড়দেশ জয় করেছিলেন। কারন গৌড়ের রাজধানির নাম লক্ষণাবতী সম্ভবত লক্ষণ সেনের নাম অনুসারেই নামাঙ্কিত হয়েছিল এবং সর্বপ্রথম তাঁর তাম্রশাসনেই সেন নৃপতিদের নামের পূর্বে গৌড়েশ্বর উপাধি ব্যবহার করা হয়েছে।

লক্ষণ সেনের কামরূপ ও কলিঙ্গ জয়ও সম্ভবত তাঁর পিতামহের রাজ্যকালেই সংঘটিত হয়েছিল। কারন তাম্র শাসন অনুযায়ী বিজয় সেনের শাসনকালেই এই দুই দেশ বিজিত হয়েছিল। আবার এমনটাও হতে পারে যে বিজয় সেনের শাসনকালে গৌড়ের ন্যায় এই দুই রাজ্য জয়ও সম্পূর্ণরূপে সফল হয়নি। এরপরেও কুমার লক্ষণ সেনকে এই দুই রাজ্য বিজয় সম্পূর্ণ করতে পুনরায় যুদ্ধ করতে হয়েছিল। কারন লক্ষণ সেনের পুত্রদ্বয়ের তাম্র শাসনে দেখা গেছে যে তিনি সাগরপাড়ে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে, কাশীতে ও প্রয়াগে যজ্ঞযূপের সহ "সমরজয়স্তম্ভ" স্থাপিত করেছিলেন। এই সময়ে গঙ্গাবংশীয় রাজগণ কলিঙ্গ ও উৎকল উভয় দেশেই রাজত্ব করতেন। সম্ভবত লক্ষণ সেন কোন গঙ্গা বংশীয় রাজাকে পরাজিত করেই পুরিতে জয়স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন।

এদিকে কাশী ও প্রয়াগের জয়স্তম্ভ স্থাপন পশ্চিমপ্রান্তে গাহড়ওয়াল রাজার বিরুদ্ধে তাঁর বিজয়াভিজান সূচিত করেছে এবং এই অভিযানে দিল্লিস্বরের সাথে মিত্রতার উল্লেখ করেছে। ভারতের বিভিন্ন ঐতিহাসিক শিলালিপিতে পাল বংশের পতনের পূর্বেই যে গাহড়ওয়াল রাজবংশ যে মগধে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন তার উল্লেখ রয়েছে। বিজয়সেন তাঁর নৌবাহিনী প্রেরণ করেও কনৌজের গাহড়ওয়াল রাজবংশের বিরুদ্ধে বিশেষ সাফল্যলাভ করতে পারেননি। বল্লালসেন কিছুটা সফলতা লাভ করেছিলেন বটে তবে পরে তিনি গোবিন্দপালের রাজ্য হরণ করায় কনৌজের গাহড়ওয়াল রাজবংশ মগধে তাঁদের আধিপত্য বিস্তার করার আরও সুযোগ পেয়েছিলেন। দুই শক্তিশালি গাহড়ওয়াল নৃপতি বিজয়চন্দ্র আর জয়চন্দ্রের (জয়চাঁদ) লিপি থেকে প্রমানিত হয় যে ১১৬৯ থেকে ১১৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মগধের পশ্চিম ও মধ্যভাগ গাহড়ওয়াল রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। বঙ্গদেশের পশ্চিমপ্রান্তে এইভাবে কনৌজের গাহড়ওয়াল রাজবংশের সেনারা দ্রুত তাঁদের রাজ্য বিস্তার করতে থাকায় লক্ষণ সেনের সাথে জয়চাঁদের সামরিক সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল এবং হয়তো এই যুদ্ধে শক্তিশালি জয়চাঁদের বিরুদ্ধে জয়লাভের আশায় শত্রুর শত্রু আমার মিত্র বহু পুরাতন এই নীতি গ্রহণ করে লক্ষণ সেন গাহড়ওয়াল রাজবংশের ঘোরতর শত্রু দিল্লিস্বর পৃথ্বীরাজ চৌহানের সহিত মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন।

বিস্তৃত বিবরণ না থাকলেও কনৌজের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে লক্ষণ সেন যে প্রভূত সফলতা লাভ করেছিলেন সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। মগধের গয়া জেলায় লক্ষণ সেন যে রাজ্য বিস্তার করেছিলেন বৌদ্ধ গয়ায় প্রাপ্ত দুখানা লিপিতে তার স্পষ্ট প্রমান পাওয়া যায়। গাহড়ওয়াল রাজ জয়চাঁদের লিপি থেকে প্রমানিত হয় যে ১১৮২-১১৯২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিনি গয়ায় রাজত্ব করতেন। সুতরাং জয়চাঁদকে পরাজিত না করে লক্ষণ সেনের পক্ষে কখনই গয়ায় রাজ্য বিস্তার সম্ভব নয়। লক্ষণ সেনের বিরুদ্ধে জয়চাঁদের পরাজয়ের এইরূপ স্পষ্ট প্রমান বিদ্যমান থাকায় লক্ষণ সেন যে কাশী ও গয়ায় জয়স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন তাম্রশাসনের এই বিশিষ্ট উক্তি নিছক কল্পনা মনে করে হাস্যকৌতুকে উড়িয়ে দেবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

এইভাবে আমরা দেখতে পাই যে উত্তরে গৌড়, পূর্বে কামরূপ ও দক্ষিনে কলিঙ্গ রাজকে পরাজিত করে লক্ষণ সেন তাঁর পৈত্রিক রাজ্যকে অক্ষুণ্ণ ও সুদৃঢ় করতে সমর্থ হয়েছিলেন। পশ্চিমে তিনি কনৌজের বিরুদ্ধে তাঁর পিতামহ ও পিতার অপেক্ষা বহুগুণ অধিকতর সফলতা অর্জন করেছিলেন এবং মগধ (বর্তমান বিহার) পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। লক্ষণ সেনের তিরোধান আর সেন সাম্রাজ্যের ধ্বংসের বহু বছর পরেও মগধে তাঁর রাজ্যশেষ থেকে সংবৎসর গণনা করা হত। মগধ অর্থাৎ বিহারে যে লক্ষণ সেনের ক্ষমতা দৃঢ়ভভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়্যেছিল এটাই তার প্রকৃষ্ট প্রমান।

লক্ষণ সেনের দুই সভাকবি উমাপতিধর ও শরণ রচিত কয়েকটি শ্লোকে এক রাজার বিজয়গাথা বর্ণিত আছে। শ্লোকগুলোতে সেই রাজার নাম নেই ঠিকই কিন্তু সেই নৃপতি যে প্রাগজ্যোতিষ (কামরূপ), গৌড়, কলিঙ্গ, কাশী, মগধ প্রভৃতি জয় করেছিলেন এবং চেদি ও ম্লেচ্ছরাজকে পরাজিত করেছিলেন তার উল্লেখ রয়েছে। এই শ্লোক সমুদয় যে রাজা লক্ষণ সেনকে উদ্দেশ্যে করেই তাঁর দুই সভাকবি রচিত করেছিলেন এইরূপ সিদ্ধান্তে অনায়াসেই উপনীত হওয়া যেতে পারে। সুতরাং কামরূপ, কলিঙ্গ আর জয়চাঁদকে পরাজিত করা ছাড়াও লক্ষণ সেন যে চেদি (কলচুরি) ও কোন ম্লেচ্ছ শাসককে পরাজিত করেছিলেন এইরূপ অনুমান বিন্দুমাত্র অসঙ্গত নয়। রতনপুরের কলচুরিরাজের সামন্ত বল্লভরাজ গৌড় নৃপতিকে পরাজিত করেছিলেন, মধ্যপ্রদেশের একটি শিলালিপিতে এরকম উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং প্রতিশোধ নিতে কুলচুরিদের বিরুদ্ধে লক্ষণ সেনের সামরিক সংঘর্ষ সম্ভবত ঐতিহাসিক ঘটনা। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষই জয়ের দাবি করেছেন সুতরাং যুদ্ধের ফলাফল অনিশ্চিত বলেই গ্রহণ করতে হবে।

উল্লিখিত আলোচনা সমূহ থেকে আমরা দেখতে পাই যে লক্ষণ সেন তাঁর বাল্যকাল থেকে শুরু করে প্রায় সারা জীবনই যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত ছিলেন। ধর্মপাল আর দেবপালের পর বঙ্গে আর কোন নৃপতিই লক্ষণ সেনের ন্যায় বাংলার মূল সীমানার বাইরে যুদ্ধে এইরূপ অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করতে পারেননি। সুতরাং মাত্র ১৮ জন তুর্কি দস্যুদের আতঙ্কে ভীত হয়ে তিনি পলায়ন করেছিলেন এই তথ্য বেশ কিছুটা অতিরঞ্জিত বলেই সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক।

লক্ষণ সেন যখন পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন তখনই তাঁর বয়স প্রায় ষাট বছর। তখনকার সময় একালের মত ছিল না। বর্তমানকালের রাজনীতিবিদরা ৯০ বছর বয়সে অশীতিপর শরীর আর ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়েও প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সির অধিকারী হতে চান। কিন্তু সেকালের জনগন একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর পুণ্যলাভে বাণপ্রস্থে যেতেন। স্বয়ং দিগ্বিজয়ী সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যও নিজের জীবনের অন্তিম ১০ বছর কর্ণাটকের শ্রবণবেলগোলায় সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করেছিলেন। প্রায় ২০ বছর রাজত্ব করে অশীতিপর বৃদ্ধ ক্ষত্রিয় নৃপতি লক্ষণ সেন তাঁর পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে গঙ্গাতীরে নিজের জীবনের অন্তিমকাল অতিবাহিত করবার অভিপ্রায়ে নবদ্বীপে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনকালের এই অন্তিম সময়ে রাজ্যে আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের সূচনা হয়। ১১৯৬ খ্রিষ্টাব্দের একটি তাম্রশাসন থেকে জানা যায় ডোমনপাল নামধারি এক ব্যক্তি সুন্দরবনের খাঁড়ি পরগণায় বিদ্রোহী হয়ে এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিল।

লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে আর্যাবর্তের ভাগ্যাকাশে সূর্যাস্ত হয়েছিল। নয়শত বর্ষব্যাপী মহারাত্রি আসন্ন। পশ্চিম দিকপ্রান্তে রাক্ষসী বেলার রুধিরোৎসব আরম্ভ হয়েছে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী তুর্কি লুণ্ঠকদের দল অগনিত রক্তবীজের ন্যায় তাদের নেতা সুলতান মহম্মদ ঘোরীর নেতৃত্বে প্রথমে দিল্লিস্বর পৃথ্বীরাজ চৌহান ও তার অবহিতকাল পরেই কনৌজ অধিপতি জয়চাঁদকে পরাজিত করে ক্রমে ক্রমে আর্যাবর্তের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিধর্মী তুর্কিদের লুণ্ঠক সাম্রাজ্যের বিস্তার করেন। ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চান্দেরওয়ারের যুদ্ধে কনৌজ অধিপতি জয়চাঁদকে পরাজিত ও নিহত করে এবং ১১৯৫ খ্রিষ্টাব্দে মাউন্ট আবুর পাদদেশে কায়দারার দ্বিতীয় যুদ্ধে গুজরাতের চালুক্যরাজ ভীমদেব সোলাঙ্কিকে পরাজিত করবার পর (১১৭৮ খ্রিষ্টাব্দে কায়দারার প্রথম যুদ্ধে রানি নাইকি দেবির অসাধারন শৌর্য আর পরাক্রমের সামনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল মহম্মদ ঘোরীর তুর্কি বাহিনী) আর্যাবর্তের প্রসিদ্ধ রাজপুত রাজ্য্যগুলি একে একে তুর্কিদের পদানত হল। ক্রমে তুর্কিরা যুক্তপ্রদেশ অধিকার করে মগধ আর বাংলার সীমান্তে এক ঝঞ্ঝাবর্তের ন্যায় উপনীত হল।

এই ঘোর দুর্দিনে বঙ্গদেশের শাসক রাজা লক্ষণ সেন স্বীয় রাজ্য রক্ষার উদ্দেশ্যে কি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এত শতাব্দী পর তা আর জানবার কোন উপায় নেই। পরবর্তীকালে বাঙালি অথবা ভারতীয় কোন লেখক দ্বারা রচিত বাংলার এই দুর্যোগময় অন্ধকার যুগের সেরকম কোন বিবরণই পাওয়া যায়নি। সপ্ত শতাব্দীর আধারাছন্ন সময়ের কারাগারে আজ স্তব্ধ ও বন্দি সেই ইতিহাস। বক্তিয়ার খিলজির নবদ্বীপ লুণ্ঠনের অর্ধশতাব্দী পরে তুর্কি বিজেতা সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদের সভাসদ ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ তার স্বজাতীয় তুর্কি লুণ্ঠকদের মুখে সেনরাজ্য জয়ের যে কাহিনী শুনেছিলেন তাই তিনি তার পার্সি গ্রন্থ তবাকাত-ই-নাসিরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে এই তবাকত-ই-নাসিরি গ্রন্থকে অবলম্বন করেই প্রচারিত হয়েছিল বঙ্গের রাজা লক্ষণ সেনের কাপুরুষচিত পলায়ন আর মামুলি তুর্কি লুঠেরা বক্তিয়ার খিলজির সপ্তদশ অশ্বারোহী নিয়ে বাংলা বিজয়ের কাল্পনিক ও অতিরঞ্জিত কাহিনী। আর এই কাল্পনিক কাহিনীর ঐতিহাসিক সত্যতা আর বাস্তবসম্মত গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনা না করেই আজও সমগ্র ভারত ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের বহু ব্যক্তি লক্ষণ সেনকে কাপুরুষ বলে হতশ্রদ্ধা ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে আসছে।

তুর্কি আগ্রাসনকারী কর্তৃক গৌড় জয়ঃ
============================
তুর্কিদের গৌড় জয়ের ইতিহাস সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে হলে প্রথমেই আমাদের জেনে নিতে হবে বক্তিয়ার খিলজির আসল পরিচয়। বক্তিয়ার ছিল এক হুনদের মতই এক যাযাবর ভ্রাম্যমাণ তুর্কি লুণ্ঠনকারী দলের সদস্য। আফগানিস্থানের হিন্দুকুশ থেকে সিন্ধ ব্যাপী বিস্তীর্ণ প্রাচীন সিল্করুটের পাহাড়ি দুর্গম পথের গিরিকান্তরে দলবল সমেত আত্মগোপন করে থাকতো তাদের লুণ্ঠক বাহিনী। পাহাড়ি পথে ভ্রাম্যমাণ নিরস্ত্র সওাদাগরদের টুকরী দেখলেই আচমকা অস্ত্রসস্ত্র সমেত হামলা করে বিনা প্রতিরোধে সেই ব্যবসায়ীদের সর্বস্ব লুঠ করে তাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করে সমস্ত লুঠের মাল সেই সওদাগরদেরই অশ্বপৃষ্ঠে চাপিয়ে নিজেদের অস্থায়ী বাসস্থানে প্রত্যাবর্তন করে এক পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠত সেই তুর্কি লুণ্ঠকরা। সারা রাত ধরে মশালের আলোয় চলত তুর্কি যৌনদাসীদের নৃত্যকলা আর ছুটটো মদিরার ফোয়ারা। অপরদিকে অন্ধাকারাছন্ন সিল্করুটের পথের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে থাকতো তুর্কি তরবারির আঘাতে ছিন্ন হতভাগ্য সওদাগরদের রক্তাক্ত শবদেহ আর কর্তিত মুণ্ডু।

এদিকে বক্তিয়ারের এসব মামুলি লুণ্ঠন আর হত্যা একেবারেই ছিল না পসন্দ। বক্তিয়ার শৈশবকাল থেকেই ছিল প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষী। বক্তিয়ারের মনে হত এইসব মামুলি সওদাগরদের আক্রমন আর লুণ্ঠন আর নিধন করে আর কত ধনসম্পদের মালিক হওয়া যায় আর মামুদ গজনী বা মহম্মদ ঘোরী এমনকি নিদেনপক্ষে কুতুবউদ্দিন আইবকের মতও মহান কাফের হত্যাকারী হিসাবে নিজের নাম ইতিহাসের পাতায় কিছুতেই অমর করে রাখাও সম্ভব নয়। এই মামুলি লুণ্ঠন আর হত্যা তার কাজ নয়। তার জন্য অপেক্ষা করছে আরও বড় মঞ্চ। এবারে সময় এসেছে সোনার চিড়িয়া হিসাবে খ্যাত প্রসিদ্ধ কাফেরদের মুল্ক হিন্দুস্থানের ভূমিতে পদার্পণ করবার। নিজের ছোটবেলার স্থান পরিত্যাগ করবার বক্তিয়ারের এই বাসনার পিছনে আরেকটি কারনও অবশ্য ছিল। সেটি হল তার কদর্য স্থূলকায় চেহারা। তার এই বদদর্শন চেহারার কারনেই তুর্কিস্থানে প্রতিনিয়ত বক্তিয়ারকে তার পরিচিত ব্যক্তিদের রঙ্গ-তামাশার সম্মুখীন হতে হত। হয়তো বা নিজের এই কদর্য ও বিকৃত চেহারার দোষ স্খালন করবার অভিপ্রায়ের প্রচুর ক্ষমতা ও অতুল ঐশ্বর্যের আস্বাদ পেতে চেয়েছিল সে।

আনুমানিক ১১৮৫ থেকে ১১৮৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ঘুরের রাজধানি গজনী নগরে গিয়ে সুলতান গিয়াসউদ্দিন ঘোরীর রাজদরবারে প্রবেশ করে তুর্কি বাহিনীর যোদ্ধা হিসাবে কর্ম প্রার্থনা করেছিল বক্তিয়ার খিলজি। কিন্তু মন্দ ভাগ্য বক্তিয়ারের। তার স্থূলকায় চেহারার কারনেই সম্ভবত তাকে একজন যোদ্ধা হিসাবে গ্রহণ করেননি তুর্কি সুলতান। কিন্তু তাও নিজের উচ্চাশা ত্যাগ করল না বক্তিয়ার। এরপর অতিবাহিত হল আরও কয়েকটি বছর। তখন ১১৯৩ সাল। ভারতবর্ষ তথা তুর্কি বর্ণিত হিন্দুস্থানের উত্তরভাগের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তখন বিধর্মী পৌত্তলিক স্থানীয় আর্য কাফেরদের পরাজিত ও নিধন করে প্রবলভাবে কায়েম হয়েছে তুর্কিদের শরিয়তি শাসন। দিল্লির লালকোট তথা চৌহান রাজপরিবারের প্রাচীন কেল্লায় তখন কুতুবউদ্দিন আইবকের রাজপাট। সুলতান মহম্মদ ঘোরীর বিশ্বস্ত দাস হিসাবে ঘোরীর হয়ে তখন দিল্লি শাসন করছেন কুতুবউদ্দিনই। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বক্তিয়ার সোজা এসে হাজির হল কুতুবের দরবারে। মর্কটাকৃতি বক্তিয়ারের ভাগ্য এখানেও তার প্রতি সহায় হল না। স্রেফ সান্ত্রীদের মুখে বক্তিয়ারের বর্ণনা শুনে তার সাথে সাক্ষাৎ না করেই বক্তিয়ারকে ফিরিয়ে দিল কুতুবউদ্দিন। এদিকে দীর্ঘ যাত্রার ফলে বক্তিয়ার তখন নিদারুন অর্থকষ্টে ভুগছে। আরও যাত্রার জন্য ঘোড়া ক্রয় করবার অর্থও নেই তার কাছে। কিন্তু তবুও হাল ছাড়ল না সে। তাকেও মামুদ গজনী আর মহম্মদ ঘোরীর মতই মহান গাজী হতেই হবে যে। এরপর এক রাতের আঁধারে দিল্লির এক অশ্ব ব্যবসায়ীর আস্তাবল থেকে একটি হৃষ্টপুষ্ট ঘোড়া চুরি আর অস্ত্র চুরি করে দিল্লি ত্যাগ করে বদায়ু শহরের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালো সে। বক্তিয়ার খবর পেয়েছিল বদায়ু নগরের তুর্কি সুবেদার শিহাবউদ্দিন খিলজি তারই স্বজাতি। শিহাবের উপাধিও খিলজি। তাহলে এক তুর্কি খিলজি কি আরেক তুর্কি খিলজির দুর্দিনে তার পাশে দাঁড়াবে না, নিশ্চয়ই দাঁড়াবে। মনে এই আশা নিয়ে অবশেষে বক্তিয়ার এসে উপস্থিত হলেন বদায়ু শহরে।

এরপর শিহাবউদ্দিনের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করল বক্তিয়ার। পাঠান মুলুক থেকে তারই এক স্বজাতি তুর্কি এসেছে তার সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে এই অনুরোধ শুনে বক্তিয়ারের সাথে দেখা করতে রাজি হল শিহাবউদ্দিন। শিহাবের সভাকক্ষে প্রবেশ করে বক্তিয়ার কোনরূপ ভনিতা না করেই সটান বলে উঠল, "হুজুর, মালিক আমার আমি আপনারই স্বজাতি। ভাগ্যান্বেষণে আমি এসেছি সদুর তুর্কিস্থান থেকে এতদূরে। দয়া করে একটা জায়গীর উপহার দিন আমায়। আপনিও খিলজি জাত আর আমিও খিলজি জাত। এই দুর্দিনে আপনি আমাকে সাহায্য না করলে আর অন্য কোন তুর্কি আমাকে সাহায্য করবে ? আমি প্রতিজ্ঞা করছি খোদাবন্দ, আমি আপনাকে নিরাশ করব না।" বক্তিয়ারের এহেন আবেদন শুনে যারপরনাই বিস্মিত হল শিহাবউদ্দিন। তার মনেও আশঙ্কা জন্মাল এহেন স্থূলকায় কদর্য ব্যক্তির পক্ষে যুদ্ধজয় কি আদৌ সম্ভব। এর চেহারা দেখলেই তো অনান্য সহযোদ্ধারা হাসতে শুরু করবে। তবুও স্বজাতি বলে কথা। একেবারে নিরাশ করে ফেরানোটা মটেই উচিত কাজ হবে না। এরপর মাসিক ৬০ টি রৌপ্যমুদ্রার বেতনে তার বাহিনীর এক সর্দারের পদে বক্তিয়ারকে নিযুক্ত করল শিহাবউদ্দিন খিলজি।

বখতিয়ার খিলজির সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ =========================== মাসিক ৬০ টি রৌপ্যমুদ্রার বেতনে শিহাবউদ্দিন খিলজির বাহিনীর সর্দারের চাকরিতে যোগদান করল বখতিয়ার খিলজি। সেখানেই বেশ কয়েকমাস অতিবাহিত হল। শিহাবউদ্দিন খিলজির বাহিনীর সাথে ভিড়ে এই কয়েকমাস উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রাচীন লোকালয়ে বসবাসকারী কাফের আর্যদের বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযানে অংশগ্রহণ করল সে। বহু অসহায় আর নিরস্ত্র আর্য পুরুষদের নির্মমভাবে হত্যা করল আর আর্যা নারীদের বন্দি করে তুর্কিদের যৌনদাসী করবার অভিপ্রায়ে তাঁদের দিল্লি আর গজনীর দরবারে প্রেরণ করল। কিন্তু এখানেই যদি থেমে যেত বখতিয়ার তাহলে হয়তো বিহার আর বাংলার ইতিহাসটা একটু ভিন্ন ধরনের হত। কিন্তু প্রবাল উচ্চাকাঙ্ক্ষা যেন বারংবার বখতিয়ারের মনের অভ্যন্তরে বলে চলেছিল, এখানেই থেমে যেও না বখতিয়ার, এখানে তো তুমি কেবলমাত্র রূপো পেয়েছ, আরও পূর্ব দিগন্তে প্রসারিত হও। সেখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে ঘৃণ্য আর্যদের মহার্ঘ সোনা আর হিরে মানিক্য সহ আরও আরও বহুমুল্য ধনরত্ন, আর ভুলে যেও না বখতিয়ার এখনও তোমার সুলতান মামুদ গজনী আর মহম্মদ ঘোরীর মত পবিত্র গাজী উপাধি লাভ হয়নি। কিছু অর্থ জমানোর পর বখতিয়ার একদিন শিহাবউদ্দিন খিলজির দরবারে গিয়ে তাকে একটা মস্ত সেলাম ঠুকে বলল, "আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ হুজুর। মালিক আমি আপনার নমক খেয়েছে। আমার দুঃসময়ে আপনি আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। সারা জীবন আপনার এই দাস কখনও ভুলতে পারবে না আপনাকে। তবে এবারে আমি হিন্দুস্থানের আরও পূর্ব দিগন্তে গিয়ে আমার ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখতে চাই। আমাকে অনুমতি দিন হুজুর।" শিহাবউদ্দিন অনুমতি দিলেন। এরপর বখতিয়ার তার জমানো অর্থ ব্যায় করে একটা তেজি তুর্কি অশ্ব কিনে সেটায় আরোহণ করে এসে উপস্থিত হল আওধ রাজ্যে। সেখানকার জায়গীরদার তখন মালিক নাসিরুদ্দিন। নাসিরুদ্দিনের দরবারে হাজির হয়ে তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতেই তিনি তুরন্ত বখতিয়ারকে দুটো জায়গীর উপহার দিলেন। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। একসাথে দু-দুটো জায়গীর। পরে বখতিয়ার বুঝতে পারল যে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের স্মৃতিধন্য মগধ (বিহার) রাজ্যের যে জায়গীর দুটো তাকে উউপহার দেওয়া হয়েছে সেখানে বর্তমানে ঘৃণ্য আর্যরাই বসবাস আর শাসন করে। তুর্কি শাসনের কোন অস্তিত্বই নেই সেখানে। এ যেন রাজ্যহীন রাজার মত অবস্থা। জায়গীরদার হিসাবে বখতিয়ারের কোন মূল্যই নেই যতক্ষণ পর্যন্ত না বখতিয়ার তার তুর্কি বাহিনী সমেত নিজে সেখানে উপস্থিত হয়ে কাফের আর্যদের বধ করে নিজের তরবারির ফলা কাফেরদের রক্তে শাণিত করে ওই স্থানগুলো বলপূর্বক অধিকার করে সেখানকার শাসক হয়ে বসছেন। এরপর বখতিয়ার আর তার লুণ্ঠক বাহিনী মগধের (বিহার) চুনার জেলার ভুইলি আর ভাগবত নামক দুই স্থানে আচমকা হামলা চালিয়ে নিরস্ত্র ও অসহায় আর্য আর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নির্বিচারে গনহত্যা করে ওই স্থান বলপূর্বক অধিকার করে সেখানকার শাসক হয়ে বসল। বলাই বাহুল্য পৃথ্বীরাজ আর জয়চাঁদের পরাজয় ও মৃত্যুর পর উত্তর আর মধ্য ভারতে তুর্কিদের নির্বিচার গনহত্যা আর লুণ্ঠন রোধ করবার মত হাক্কা-বুক্কা বা কৃষ্ণদেব রায় বা ছত্রপতি শিবাজী বা পেশওয়া বাজিরাও বল্লালের মত কোন বিকল্প আর্য শক্তির তখনও উত্থান হয়নি। আর বঙ্গের সমসাময়িক বৃদ্ধ শাসক লক্ষণ সেন তখন বাংলা রক্ষা করতে ব্যস্ত। চর মারফৎ রাজা লক্ষণ সেনেরও কর্ণগোচর হয়েছিল মগধ পর্যন্ত তুর্কি আক্রমণকারীদের উন্মাদ যাত্রা। তৎকালীন মগধ রাজ্যে পূর্ববর্তী মৌর্য, গুপ্ত আর বাংলার পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে নালন্দা, ঔদন্তপুরী, বিক্রমশিলার মত অসংখ্য প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ আর বিদ্যালয়ে সজ্জিত ছিল। বখতিয়ার লক্ষ্য করল কাফেরদের সেইসব ধর্মীয় স্থানগুলিতে তুর্কিদের বাধাধান করবার মত সেরকম কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থাই নেই। অতএব শুরু হল বখতিয়ারের বিভিন্ন প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার আর বিদ্যালয়গুলি লুণ্ঠন আর সেই সকল বিদ্যালয়ের নিরস্ত্র কাফের সন্ন্যাসীদের নির্বিচারে হত্যালীলা। সে যুগে গনিমাতের মালের ব্যপক লুণ্ঠন আর নির্বিচারে নিরস্ত্র কাফের বধই ইসলামের সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রথম ধাপ হিসাবে গণ্য হত। এলাকা অধিকার করে দার-উল-ইসলাম স্থাপন করা দ্বিতীয় ধাপ। সেজন্যই শুধুমাত্র লুণ্ঠন আর গনহত্যা করেই সে যুগের তুর্কি আর একালের মুসলিম ঐতিহাসিকদের নিকটে বখতিয়ার আজ এক মহাবীরে পরিণত হয়েছে। এমনিতে মামুদ গজনী বা মহম্মদ ঘোরী বা আলাউদ্দিন খিলজির মত বিশাল ইসলামিক সাম্রাজ্য স্থাপন করবার মত সেনাবাহিনী, ছল-চাতুরী আর মানসিক জোর কোনটাই ছিল না বখতিয়ার খিলজির মত একটি মামুলি ডাকাতদলের সর্দারের। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ যুগে বাংলার বিশে ডাকাতদের মতই মামুলি লুণ্ঠক ছিল বখতিয়ার। ক্রমে বখতিয়ারের কানে এল বিহারের শতাব্দী প্রাচীন নালন্দা আর বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। সেখানে নাকি প্রচুর ধনসম্পদ গচ্ছিত করে রেখেছে বৌদ্ধ কাফেররা। নালন্দার তিনটি বিখ্যাত কক্ষের নামই তো রত্নদধি, রত্নসাগর আর রত্নরঞ্জক। না জানি কত সহস্র স্বর্ণমুদ্রা আর হীরকখণ্ড লুকনো রয়েছে সেখানে। এরপর গনিমতের মাল লুণ্ঠন ও আত্মসাৎ করে কাফের বধ করে গাজী উপাধি লাভের অভিপ্রায়ে একরাতে নালন্দা আক্রমন করল বখতিয়ার আর তার তুর্কি দস্যু বাহিনী। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে কক্ষগুলি ধনরত্ন ভর্তি থাকবে আশা করেছিল বখতিয়ার সেগুলি পরিপূর্ণ ছিল বজ্জাত কাফের বৌদ্ধ আর আর্যদের নানা প্রাচীন পুস্তকে। যাইহোক এরপর নালন্দা, বিক্রমশিলা, ঔদন্তপুরী সহ একাধিক বৌদ্ধ মঠ নির্বিচারে ধ্বংস করলেন বখতিয়ার। সেদিন বখতিয়ারের এই লুণ্ঠন আর কাফের হত্যাকে স্বীকৃতি দিতেই যেন আজ ঔদন্তপুরীর নাম বদলে বখতিয়ারপুর রেখেছে বিহার সরকার। বৌদ্ধ বিহারগুলি ধ্বংস করবার পিছনে আরেকটি অভিপ্রায় ছিল বখতিয়ারের। সেকালে পাল রাজাদের সৃষ্টি প্রচুর বৌদ্ধ বিহাররাজি ছিল মগধে। সেগুলো ধ্বংস আর লুণ্ঠন করে স্থানীয় অধিবাসীদের মনে সহজেই তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি করা আর একাধিক নিরস্ত্র কাফের বধ করে গাজী উপাধি লাভ করা। এরপর তুর্কি হামলাকারীদের মুখে মুখে মগধের নাম পরিবর্তন হহয়ে সেই রাজ্যের নয়া নামকরণ হয়ে গেল বিহার। এরপর বখতিয়ারের নজর পড়ল ধনধান্যে পুষ্পভরা বাংলার দিকে। অপপ্রচারের আলোয় লক্ষণ সেন ======================== এবারে পুনরায় ফিরে আসা যাক বাংলার তৎকালীন আর্য শাসক রাজা লক্ষণ সেনের প্রসঙ্গে। প্রবন্ধ কোষা, প্রবন্ধ চিন্তামনি আর আরও একাধিক সমসাময়িক হিন্দু আর জৈন ঐতিহাসিক গ্রন্থ অনুসারে তৎকালীন বাংলার শাসক তুর্কিদের অগ্রগতির সংবাদ বিলক্ষণ জানতেন এবং সেই অনুযায়ী স্বরাজ্যকে রক্ষা করতে যথা সম্ভব ব্যবস্থাও গ্রহন করেছিলেন। একথা নিজের গ্রন্থ তবাকত-ই-নাসিরিতে স্বীকার করেছিলেন তুর্কি ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজও। কিন্তু তারপর কি হল ? কিভাবে বাংলা অধিকার করেছিল বখতিয়ার খিলজি ? নাকি আদৌ বাংলা অধিকার করতে পারেনি বখতিয়ার, কেবলমাত্র ছদ্মবেশে আচমকা হামলা করে শুধুমাত্র নদিয়া লুণ্ঠন আর পশ্চিমবঙ্গের আড়াইখানা জেলা সাময়িকভাবে অধিকার করেছিল বখতিয়ার ? আজ এতকাল পরে এসবের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে জোর দিয়ে দাবি জানানোর মত কোন শক্ত প্রমানও নেই। আছে কেবলমাত্র কতিপয় তুর্কি আর হিন্দু ও জৈন ঐতিহাসিক কাব্য গ্রন্থ। তবাকাত-ই-নাসিরি গ্রন্থে তুর্কি লুঠেরা দ্বারা মগধ ও গৌড় জয়ের কিছুটা বিস্তারিত বিবরন পাওয়া যায় বটে, তবে গ্রন্থকার মিনহাজ-ই-সিরাজ ওরফে আবু ওসমান মিনহাজউদ্দিন বিন সিরাজউদ্দিন নিজে আফগানিস্থানের ঘোর রাজ্যের অধিবাসী ছিলেন। জন্মসূত্রেই তুর্কি মিনহাজ 1193 খ্রিষ্টাব্দে ঘোরের রাজধানি ফিরুজকু নগরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এরপর ১২২৭ সালে অনেকটা বখতিয়ার খিলজির মতই ভাগ্যান্বেষণে তিনি হিন্দুস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। প্রথমে মাসখানেক উচ রাজ্যে বসবাস করবার পর অবশেষে তিনি তুর্কি অধিকৃত দিল্লি নগরে পদার্পণ করেন। দিল্লির তৎকালীন সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ তার লেখা কবিতা ও কাহিনী পরে মুগ্ধ হয়ে মিনহাজ কে তার সভাকবি পদে নিযুক্ত করেন এবং সুলতান তার নিজের জীবন কাহিনী লিপিবদ্ধ করবার জন্য মিনহাজকে অনুরোধ করেন। সুলতানের অনুরোধ মেনে মিনহাজ তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ তবাকত-ই-নাসিরি লেখার কাজ শুরু করেন। অতএব একজন তুর্কি লেখকের পরাজিত কাফের আর্য জাতির প্রতি যে জন্মগত ঘৃণাবোধ থাকবে সেটা আশাকরি একজন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রেরও বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। এছাড়াও মিনহাজ দিল্লির সুলতানের অধীনে তার রাজসভায় উচ্চ আমলার পদে নিযুক্ত ছিলেন এবং রাজকার্য সম্পন্ন করবার জন্য মিনহাজকে নানা স্থানে ভ্রমণ করতে হত। এইরকমভাবে হিন্দুস্থানে নানান স্থানে ভ্রমণ করে স্থানীয় তুর্কি অধিবাসীদের নিকট থেকে তথ্য ও সংবাদ সংগ্রহ করে ১২৪২ সালের কিছু পরে এই ইতিহাস রচনা করেন। মগধ জয়ের প্রায় ৪০ বছর পরে লখনৌ নগরি ভ্রমণকালে মিনহাজের সাথে দুজন বৃদ্ধ তুর্কি সেনার সাথে দেখা হয়। ওরা দাবি করে যে ওরা ওই যুদ্ধে বখতিয়ার খিলজির তুর্কি বাহিনীতে ছিল এবং এই দুই বৃদ্ধ তুর্কি সেনার মুখ নিঃসৃত কাহিনী শুনেই মিনহাজ-ই-সিরাজ পরবর্তীকালে তাঁর গ্রন্থে বখতিয়ারের মাত্র ১৮ জন তুর্কি যোদ্ধা নিয়ে গৌড় বিজয়ের রূপকথার কাল্পনিক কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন। তুর্কিদের মগধ আর গৌড় বিজয়ের কোন সরকারি বিবরণ বা দলিলপত্রও মিনহাজের হস্তগত হয়নি। হয়তো বা বিজয়গর্বে দৃপ্ত, প্রভুত্বের উন্মাদনায় মত্ত হয়ে এক বিজিত ও ঘৃণ্য কাফের আর্য জাতির প্রতি সহজাত হতশ্রদ্ধা হয়ে শুধুমাত্র দুজন বৃদ্ধ তুর্কি সেনার মুখ নিঃসৃত বিবরণ শুনেই তিনি আজকালকার ঐতিহাসিক পটভূমিকা আর কল্পনার মিশ্রণে কালজয়ী উপন্যাস লেখা শ্রী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতই বখতিয়ারের নদিয়া বিজয় নিয়ে এক কাল্পনিক কাহিনী রচিত করেছিলেন।

বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের বিস্তারিত বর্ণনা কেবলমাত্র মিনহাজ-ই-সিরাজের লেখা তাবাকত-ই-নাসিরি পুস্তকে পাওয়া যায়। কিন্তু পরে জানা যায় বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয়ের প্রমান হিসাবে মিনহাজের নিকটে না ছিল কোন সরকারি বিবরণ আর দলিলপত্র না ছিল সেই যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারী কোন তুর্কি যোদ্ধার সাক্ষ্য। পরবর্তীকালে মিনহাজ তার পুস্তকে নিজেই লিখেছিলেন যে তিনি কেবলমাত্র কয়েকজন বিশ্বাসী ব্যক্তির (অবশ্যই তুর্কি) মুখ নিঃসৃত বর্ণনা শ্রবণ করেই বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয়ের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

এইভাবে কেবলমাত্র লোকমুখে শুনে ও তার সাথে নিজের কল্পনার রঙ চড়িয়ে মিনহাজ বখতিয়ারের মগধ ও গৌড় জয়ের যে বর্ণনা লিখেছিলেন তা বিখ্যাত বাঙালি ঐতিহাসিক শ্রী নিহাররঞ্জন রায় পরবর্তীকালে কিছুটা বঙ্গানুবাদ করেছিলেন। মিনহাজের লেখার বঙ্গানুবাদ নিচে দেওয়া হলঃ

"ইখতারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি নামক খিলজি বংশীয় একজন তুরস্ক সেনানায়ক উপযুক্ত কর্মানুসন্ধানে মহম্মদ ঘোরী ও কুতুবুদ্দিনের নিকট গিয়ে বিফল মনোরথ হয়ে অবশেষে অযোধ্যার বা আওধের মালিক নাসিরুদ্দিনের (বা হুসামুদ্দিন) অনুগ্রহে চুনারগড়ের নিকট দুটি পরগনার জায়গীর প্রাপ্ত হন। এখান থেকে বখতিয়ার দুবছর যাবৎ মগধের নানাস্থানে লুণ্ঠন করে এবং লুণ্ঠিত অর্থের দ্বারা সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে অবশেষে দুইশত অশ্বারোহী সৈন্যসহ হটাৎ আক্রমন করে একপ্রকার বিনা বাধায় "কিলা বিহার" অধিকার করেন। এর মুণ্ডিত মস্তক অধিবাসীদিগকে নিহত ও বিস্তর দ্রব্য লুণ্ঠন করবার পর আক্রমণকারীগন জানতে পারলেন যে এটি বস্তুত "কিলা" অর্থাৎ দুর্গ নহে। এটি একটি বিদ্যালয় মাত্র, এবং হিন্দুর ভাষায় একে "বিহার" বলে।
"কিলা বিহারের" লুণ্ঠিত ধনরত্ন সহ বখতিয়ার স্বয়ং দিল্লিতে গিয়ে কুতুবুদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বহু সম্মান প্রাপ্ত হন। দিল্লি থেকে ফিরে এসে তিনি বিহার প্রদেশ জয় করেন।

এই সময় রায় লখমনিয়া (রাজা লক্ষণ সেন) তাঁর রাজধানি নুদিয়াতে অবস্থান করছিলেন। তাঁর পিতার মৃত্যুর সময় তিনি মাতৃগর্ভে ছিলেন। তাঁর জন্মকালে দৈবজ্ঞগণ গননা করে বলেছিল যে যদি এই শিশুর এখনই জন্ম হয় তবে সে কখনই রাজা হবে না, কিন্তু আর দুঘণ্টা পরে জন্মালে সে ৮০ বছর রাজত্ব করবে। এই কথা শোনার পর রাজমাতার আদেশে তাঁর (রাজমাতার) দুই পা বেঁধে মাথা নিচের দিকে করে তাঁকে ঝুলিয়ে রাখা হল। অবশেষে শুভ মুহূর্ত উপস্থিত হলে তাঁকে মাটিতে নামানো হয়, কিন্তু পুত্র প্রসবের পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। এরপর রায় লখমনিয়া ৮০ বছরই রাজত্ব করেছিলেন এবং হিন্দুস্থানের একজন প্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন।

বখতিয়ার কর্ত্বিক বিহার জয়ের পরে তাঁর খ্যাতি নুদিয়ায় পৌঁছল। দৈবজ্ঞ, পণ্ডিত ও ব্রাহ্মণগণ রাজাকে বললেন, "শাস্ত্রে লেখা আছে তুরস্করা এই দেশ জয় করবে, এবং তাঁর অন্তিমকাল উপস্থিত। সুতরাং পলায়ন করাই সঙ্গত"। রাজার প্রশ্নের উত্তরে সেই বিশ্বাসঘাতক ব্রাহ্মণরা জানালেন যে তুরস্ক বিজয়ীর চেহারা কিরূপ তাহাও শাস্ত্রে লেখা আছে। ইতিমধ্যেই রায় লখমনিয়ার বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ কৈবর্ত গুপ্তচর প্রেরণ করে রাজদরবারের বিশ্বাসঘাতক ব্রাহ্মণরা বখতিয়ার খিলজির আকৃতির বিবরণ জেনে এসেছিল। রাজার প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা গুপ্তচর মারফৎ পাওয়া বখতিয়ারের আকৃতির বর্ণনা দিলেন। এরপর রাজা নিজে সন্দেহভাজনের জন্য বখতিয়ারের আকৃতির বর্ণনা জানতে গুপ্তচর প্রেরণ করলেন। রাজা রায় লখমনিয়ার গুপ্তচর যে বর্ণনা আনল স্বভাবতই তাঁর সাথে রাজদরবারের ব্রাহ্মণদের বর্ণনা মিলে গেল। তখন বহু ব্রাহ্মণ ও বনিকগণ রাজাকে ত্যাগ করেই স্বার্থপরের ন্যায় নুদিয়া থেকে পলায়ন করল। কিন্তু রাজা লখমনিয়া তাঁর রাজধানি ত্যাগ করতে স্বীকৃত হলেন না।

এর এক বছর পরে বখতিয়ার একদল সৈন্য সহ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিহার থেকে নুদিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। তিনি এতটাই দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে যখন অতর্কিতভাবে তিনি সহসা নুদিয়ায় পৌঁছলেন, তখন মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী তাঁর সাথে আসতে পেরেছিল। নগরদ্বারে উপস্থিত হয়ে তিনি কাউকে কিছু না বলে এমন ধীরেসুস্থে সঙ্গীগণ সহ নগরে প্রবেশ করলেন যে নুদিয়ার কাফের প্রজারা মনে করল যে সম্ভবত এরা একদল তুর্কি সওদাগর। অশ্ব বিক্রয় করতে এসেছে। এদিকে সেদিন নুদিয়ার রাজপ্রাসাদে কাফেরদের কোন ধর্মীয় উৎসব চলছিল। সেই উৎসবের ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী রাজা লখমনিয়া সহ অধিকাংশ রক্ষীরা নিরস্ত্র ছিলেন (হয়তো এটাও বিশ্বাসঘাতক ব্রাহ্মণদেরই কোন ষড়যন্ত্র হবে)। বখতিয়ার সশস্ত্র তুর্কি রক্ষী সমেত যখন রাজপ্রাসাদের দ্বারে উপনিত হলেন তখন সারাদিন উপবাস করে বৃদ্ধ রাজা রায় লখমনিয়া মধ্যাহ্ন ভোজন করতে বসেছিলেন। সহসা প্রাসাদ দ্বারে এবং নগরের অভ্যন্তর থেকে তুমুল কলরব শোনা গেল। লখমনিয়া এই কলরবের প্রকৃত জানতে পারবার পূর্বেই বখতিয়ার সদলে রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে প্রবেশ করে রাজঅনুচরদের নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করলেন। মুহূর্তের মধ্যেই রাজপুরীর চতুর্দিক কাফের আর্যদের রক্ত রুধিরে রঞ্জিত হয়ে উঠল আর ছিন্নভিন্ন মরদেহের স্তূপে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। পুরুষ, নারী, বৃদ্ধ ও শিশু, বখতিয়ার ও তাঁর সাথিদের তরবারির তীক্ষ্ণ ফলার মারন আঘাত থেকে নিষ্কৃতি পেলো না রাজপুরীর কেউই। এদিকে বৃদ্ধ রাজা রায় লখমনিয়া সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। এই অবস্থায় তিনি তাঁর কয়েকজন বিশেষ অঙ্গরক্ষকদের পরামর্শ মেনে নগ্নপদে প্রাসাদের পশ্চাৎ দ্বার দিয়ে বাইরে বেরিয়ে নৌকোযোগে রাজপ্রাসাদের পশ্চাতের নদীপথে পলায়ন করতে বাধ্য হলেন। এবারে বখতিয়ারের সমুদয় সেনা নুদিয়ায় প্রবেশ করে কাফের আর্যদের ওই ধর্মীয় নগরী আর তার চতুশ পার্শ্ববর্তী স্থান সমূহ অধিকার করল এবং সেখানেই তুর্কিদের নয়া বসতি স্থাপন করল। ওদিকে রায় লখমনিয়া সঙ্কনাৎ ও পূর্ববঙ্গের অভিমুখে প্রস্থান করলেন। তথায় অল্পদিন পরেই তাঁর রাজ্যকাল শেষ হল এবং তাঁর বংশধরগণ এখনও বঙ্গদেশে রাজত্ব করছেন।

রায় লখমনিয়ার রাজধানি অধিকার করবার পর বখতিয়ার তাঁর তরবারির সাহায্যে নুদিয়াকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে কাফেরদের রক্তে স্নাত হয়ে ধ্বংসপ্রায় নুদিয়া ত্যাগ করে বর্তমানে যে স্থান লক্ষণাবতী নামে পরিচিত সেইখানে নিজের রাজধানি স্থাপন করলেন।"

এখানেই শেষ হয়েছে মিনহাজ-ই-সিরাজের বর্ণনা। বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক বাংলা জয় সম্বন্ধে যত কাহিনী ও মতবাদ প্রচলিত আছে সবই মিনহাজের উল্লিখিত বিবরণের উপর প্রতিষ্ঠিত। কারন এই বিষয়ে অন্য কোন সমসাময়িক হিন্দু বা জৈন ঐতিহাসিকের বিবরণ পাওয়া যায়নি। মিনহাজের বিবরণ সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক সত্য বলে কখনই গ্রহণযোগ্য নহে এবং তর্কের খাতিরে তা গ্রহন করলেও প্রচলিত বিশ্বাস অনেক পরিমাণে ভ্রান্ত বলেই প্রতিপন্ন হবে। প্রথমত "সপ্তদশ অশ্বারোহীর যবনের ডরে" কাপুরুষ লক্ষণ সেন তাঁর "সোনার বাংলা" রাজ্য বিসর্জন দিয়েছিলেন, কবিবর নবীনচন্দ্রের এই উক্তি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বখতিয়ার যখন নদীয়ার নগরদ্বারে উপস্থিত হয়েছিল তখন তিনি তুর্কি অশ্বারোহীর ছদ্মবেশে ছিলেন এবং ছদ্মবেশের প্রয়োজনেই সেই সময় তাঁর সাথে মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী সেনা ছিল। কিন্তু চতুর বখতিয়ার তাঁর অবশিষ্ট সেনাদের নদীয়া নগরের বাইরেই লুকিয়ে রেখেছিল। তাদের কাছে নির্দেশ ছিল সঙ্কেত পাওয়া মাত্রই সদলবলে অরক্ষিত নদীয়া নগরে সশস্ত্রে ঝাঁপিয়ে পরে কাফের হত্যালিলায় যোগদান করবার। সম্ভবত লক্ষণ সেনের রাজদরবারের কোন বিশ্বাসঘাতক ব্রাহ্মণ বা কৈবর্ত শূদ্র গুপ্তচরের নিকট থেকে থেকে বখতিয়ার আগে থেকেই সংবাদ পেয়েছিলেন যে সেদিন এক বিশেষ ধর্মীয় উৎসবের কারনে রাজা সহ রাজপুরীর অধিকাংশ রক্ষীরা নিরস্ত্র থাকবে। এর ফলে বখতিয়ার তাঁর ১৮ জন তুর্কি সেনা সমেত নির্ভয়ে রাজপ্রাসাদে যায়, নিজেদের তুর্কি অশ্বারোহীর পরিচয় দিয়ে রাজার সাথে সাক্ষাৎ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করে, এবং প্রাসাদের রক্ষীরাও কোনরূপ সন্দেহ প্রকাশ না করেই তাঁদের প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ কবার অনুমতি দেয়। প্রাসাদে প্রবেশ করেই বখতিয়ার ও তাঁর সেনারা স্বমূর্তি ধারন করে এবং নিজেদের অসি দিয়ে রাজপুরীর অভ্যন্তরে নির্বিচারে হত্যালিলা শুরু করে। এদিকে বখতিয়ার যখন রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রাসাদের রক্ষী আর দাসদাসীদের গনহত্যা করছিল ঠিক সেই সময়ই সঙ্কেত পেয়ে বখতিয়ারের অবশিষ্ট সেনাদল সদম্ভে "আল্লাহু আকবর" ধ্বনিতে চতুর্দিক কম্পিত করে অরক্ষিত নদীয়া নগরে প্রবেশ করে নিরস্ত্র ও অসহায় হিন্দু প্রজাদের নির্বিচারে নির্মমভাবে গনহত্যা শুরু করে। প্রাসাদের অন্দরমহলে মধ্যাহ্নভোজনে বসে বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেন মিনহাজ বর্ণিত যে বিশাল হইহট্টগোল শ্রবণ করেছিলেন সম্ভবত সেটা বখতিয়ারের অবশিষ্ট বিশাল তুর্কি সেনাদলের হাতে গনহত্যার শিকার তাঁরই রাজ্যের রাজধানির নিরীহ প্রজাদের আর্তনাদ ছিল। অতএব এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় রাজা লক্ষণ সেন যখন রাজপুরীর পশ্চাৎদ্বার দিয়ে নৌপথে পলায়ন করছিলেন তখন তাঁর পরিত্যাক্ত রাজধানি নদীয়াতে বহু তুর্কি সেনা উপস্থিত ছিল। এরপর বখতিয়ার আর তাঁর অবশিষ্ট সেনারা যখন নদীয়ার চকে একসাথে মিলিত হল তখনই বখতিয়ারের নদীয়া বিজয় সম্পন্ন হয়েছিল। বলাই বাহুল্য বখতিয়ারের সেদিনের এই ঘৃণ্য ও কাপুরুষোচিত অভিযানে কেবলমাত্র নদীয়া নগরীই অধিকৃত হয়েছিল। সমস্ত বঙ্গদেশ তো দুরস্ত, গৌড়ের আর কোন অংশই সেদিন বখতিয়ার কর্তৃক বিজিত হয়নি।

যখন তুর্কি আক্রমণের আশঙ্কায় ভীত ও সন্ত্রস্ত নদীয়ার অধিবাসীরা সারা বছর ধরে রাজ্যের অন্যত্র অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত স্থানে পলায়ন করতে ব্যস্ত ছিল তখনও কিন্তু এই অশীতিপর বৃদ্ধ সেন রাজা তাঁর মন্ত্রী, দৈবজ্ঞ আর সভাসদ পণ্ডিতগণের যাবতীয় উপদেশ ও পরামর্শ অগ্রাহ্য করে নিজ রাজধানি নদীয়াতেই উবস্থান করছিলেন। সুতরাং এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় প্রজাবর্গ ও সভাসদদের থেকে রাজার সাহস ও শৌর্য অধিক বেশি পরিমানেই ছিল। যখন বিশ্বাসঘাতকদের সহায়তায় ও রক্ষীগণের মূর্খতায় তুর্কি হত্যাকারী দস্যুরা বিনাবাধায় রাজার প্রাসাদে অনুপ্রবেশ করে অতর্কিতে আক্রমন ও গনহত্যা শুরু করল তখন অতর্কিত আক্রমনে বিধ্বস্ত ও নিরস্ত্র বৃদ্ধ রাজার কাছে পরে পুনরায় সেনা সজ্জিত করে তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের পরাজিত করে নিজ রাজ্য থেকে বিতাড়িত করবার জন্য তখন পলায়ন করা ছাড়া আর কোন ভিন্ন উপায়ও ছিল না। সুতরাং এই পলায়নকে কোনমতেই কাপুরুষতা বলা উচিত নয়। দিল্লির রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের মত অতিরিক্ত সাহস প্রদর্শন করে পরাজয় আসন্ন উপলব্ধি করেও পলায়ন না করে তুর্কিদের হাতে বন্দি হয়ে অন্ধ হয়ে অসহায় মৃত্যুবরন করার মধ্যে কোন বীরত্ব নেই কিন্তু তারচেয়ে প্রান বাঁচিয়ে পলায়ন করে পরে আবার যুদ্ধ করা বহুগুন শ্রেয় ও সঠিক যুদ্ধনীতি।

শুধুমাত্র মিনহাজ-ই-সিরাজের বিবরণের উপর নির্ভর করে যারা লক্ষণ সেনের চরিত্রের দোষারোপ করেন তারা ভুলে যান যে মিনহাজ কিন্তু স্বয়ং লক্ষণ সেনের বহু সুখ্যাতি করেছেন। এই তুর্কি লেখক লক্ষণ সেনকে হিন্দুস্থানের "রায়গণের পুরুষানুক্রমিক খলিফা স্থানীয়" বলে বর্ণনা করেছেন। এর অর্থ মিনহাজের মতে বঙ্গের রাজা লক্ষণ সেনই আর্যাবর্তের রাজাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। মিনহাজ, লক্ষণ সেনের সমসাময়িক পৃথ্বীরাজ আর জয়চাঁদ সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলেননি কিন্তু লক্ষণ সেনের জন্মকাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করে তাঁর দানশীলতার সুখ্যাতি আর শাসননীতির প্রশংসা করেছেন। এমনকি সাধারনত মুসলমান লেখকরা আরেকজন অমুসলমান সম্বন্ধে যে প্রকার উক্তি করেন না, তিনি লক্ষণ সেন সম্বন্ধে তাও করেছেন। মিনহাজ তাঁকে "সুলতান-এ-করিম-কুতুবউদ্দিন-হাতেমুজ্জমান" আখ্যা দিয়ে সেই কালের হাতেম কুতুবউদ্দিনের সাথে তুলনা করেছেন এবং আল্লার নিকট প্রার্থনা জানিয়েছেন যেন তিনি পরলোকে কাফের লক্ষণ সেনের শাস্তি (যা অমুসলমান হলেই প্রাপ্য) লাঘব করেন। সুতরাং মিনহাজের পূর্ববর্তী বক্তব্যগুলো যারা এর আগে সত্য বলে ধরে নিয়েছেন তারা যদি মিনহাজের এই বক্তব্যগুলোও সত্য বলে মেনে নেন তাহলে লক্ষণ সেনের চরিত্র ও খ্যাতি সম্বন্ধে উচ্চ ধারনাই পোষণ করতে হয়। বখতিয়ার কর্তৃক নদীয়া অধিকারের জন্য যে বৃদ্ধ রাজার চেয়ে তাঁর সভাকক্ষের বিশ্বাসঘাতক কিছু মন্ত্রীরা, বিদ্রোহী কৈবর্ত আর তাঁর সেনাবাহিনী অধিকতর দায়ি সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। যিনি আকৌমার যুদ্ধক্ষেত্রে শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়েছেন। গৌড়, কামরূপ, কলিঙ্গ, বারানসি ও প্রয়াগে যার বীরত্বের খ্যাতি বিস্তৃত হয়েছিল মিনহাজের লেখনী তাঁর স্বচ্ছ চরিত্রে কলঙ্ক ও কালিমা লেপন করার প্রয়াস মাত্র। মিনহাজের লেখা বখতিয়ারের নদীয়া অভিযানের কাহিনী সম্পূর্ণরূপে সত্যি বলে গ্রহন করা মূর্খতারই পরিচয় মাত্র। যে বিশ্বাসী ব্যক্তিগন মিনহাজকে সংবাদের জোগান দিয়েছিল তাদের জ্ঞান-বুদ্ধিও কতদূর ছিল তা মিনহাজ বর্ণিত লক্ষণ সেনের অদ্ভুত জন্ম বিবরণ ও তাঁর ৮০ বছরের রাজত্বকালের কথা থেকেই বোঝা যায়। বিশেষত এই কাহিনীর মধ্যে অনেক সুপরিচিত প্রবাদ, কথা ও অবিশ্বাস্য সব ঘটনার সমাবেশ আছে। "তুর্কি আক্রমন সম্বন্ধে হিন্দুর শাস্ত্রবাণী" চচনামা নামক গ্রন্থে সিন্ধুদেশের নামও উল্লিখিত হয়েছে। এই শাস্ত্রবাণীর মূল্য যাই হোক না কেন, এতে প্রমানিত হয় যে নদীয়া আক্রমনকালের অন্তত এক বছর পূর্ব থেকেই নদীয়াতে তুর্কি হামলার সম্ভবনা সম্বন্ধে বাংলার রাজকর্মচারীরা জ্ঞাত ছিলেন। অথচ বখতিয়ার বিহার অধিকার করল তারপর নালন্দা, বিক্রমশীলা, ঔদন্তপুরী সহ একাধিক বৌদ্ধ মঠ আর বিদ্যালয়গুলি ধ্বংস আর লুণ্ঠন করতে করতে বিহার থেকে ঝাড়খণ্ড হয়ে নদীয়া পৌঁছলেন, এর মধ্যে বখতিয়ারের এই অভিযানের কোন সংবাদ সেন রাজদরবারে পৌঁছল না ? যে সময়ে তুর্কি আগ্রাসনকারীদের হাতে সমগ্র ভারতবর্ষ আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা প্রবল সে সময় রাজধানির দ্বাররক্ষীরা ১৮ জন সশস্ত্র তুর্কি অশ্বারোহীকে বিনাবাধায় নগরে প্রবেশ করতে দিল এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ও বর্ম পরিহিত সেই ১৮ জন তুর্কি অশ্বারোহীকে অশ্বব্যবসায়ী বলে ভ্রম করল ? নগর রক্ষীরা যদি কোনরূপ সন্দেহ নাও করে প্রাসাদরক্ষীরা কিভাবে প্রাসাদের অভ্যন্তরে ধর্মীয় উৎসবের কারনে স্বয়ং মহারাজ আর তাঁর দেহরক্ষীরা নিরস্ত্র রয়েছেন জেনেও এই ১৮ জন অস্ত্রধারী ও অজ্ঞাত পরিচয় তুর্কিদের বিনাবাধায় প্রবেশ করতে দিল ? নদীয়া নগরের কেউই এই সন্দেহভাজন তুর্কিদের গতিরোধ করে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে অগ্রসর হল না কেন ? স্বয়ং মহারাজ যখন নদীয়াতে অবস্থান করছিলেন তখন এটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে অন্তত একদল বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রক্ষী রাজা এবং রাজপরিবারের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করবার জন্য সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বখতিয়ারের বাহিনীর একজনের গায়েও বিন্দুমাত্র আঁচড় পর্যন্ত লাগল না। প্রথমে তারা বিনাবাধায় স্বচ্ছন্দে খোদ রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে রাজকর্মচারীদেরই গণহত্যাকাণ্ড আর লুণ্ঠন কার্য সম্পন্ন করল ? রাজা আর তাঁর সেনারা যদি ধর্মীয় উৎসবের কারনে নিরস্ত্রও থাকেন তবুও এই কথাটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা মনে করে তাঁদের বাহিনীর অস্ত্রভাণ্ডার নিকটবর্তী স্থানেই অবস্থিত ছিল। সুতরাং এইসব প্রশ্নের যথাযথ বাখ্যা না পাওয়া পর্যন্ত মিনহাজ-ই-সিরাজের লেখা বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয়ের কাহিনী এক অতিরঞ্জিত ও কাল্পনিক কাহিনী বলেই ধরে নিতে হবে, অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য মজবুত প্রমান ছাড়া যা সত্যি বলে মেনে নেওয়ার অর্থ গতমাসে মার্কিন মুলুকে ভিনগ্রহী এলিয়েন হামলার সংবাদ ও সেইসব এলিয়েনদের টাইম ট্র্যাভেলের কাহিনীও সত্য বলে মেনে নেওয়া। যে সাক্ষীর উপর নির্ভর করে গজনীর তুর্কি লেখক মিনহাজ-ই-সিরাজ এই অদ্ভুত কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন তা খুবই অকিঞ্চিৎকর। তুর্কি অধিকৃত লখনউের চক বাজারে এক অতিবৃদ্ধ তুর্কি সেনা মিনহাজকে তাদের নদীয়া বিজয়ের কাহিনী শুনিয়েছিল, ঠিক যেইরূপে পটলডাঙার টেনিদা, প্যালা, হাবুল আর ক্যাবলাকে তাঁর বিভিন্ন অভিযানের অতিরঞ্জিত কাহিনী শোনাত। নদীয়া অভিযান সম্বন্ধে কোন লিখিত বিবরণ বা শিলালিপির সন্ধান তিনি পাননি। যে বৃদ্ধ তুর্কি সেনা মিনহাজকে এই কাহিনী শুনিয়েছিল তার নিজেরও বখতিয়ারের নদীয়া অভিযান সম্বন্ধে কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল কিনা সেটাও প্রশ্নযোগ্য। কারন সেই বৃদ্ধ সেনার নদীয়া অভিযানের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকলে মিনহাজ নিশ্চয়ই তাঁর লেখায় সেসব উল্ল্যেখ করতেন। সুতরাং এই বৃদ্ধ তুর্কি সেনার মুখ নিঃসৃত কাহিনী যা পরে মিনহাজের কলমে তাবাকত-ই-নাসিরি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছিল তাকে সত্যি বলে মেনে নিলে পটলডাঙার টেনিদার প্রত্যেকটা অভিযানকেও সত্যি বলে মেনে নিতে হবে। যে সময়ে মিনহাজ তাঁর এই পুস্তক লিখেছিলেন সেই সময় অর্ধশতাব্দী যাবৎ তুর্কিদের রাজত্ব আর্যাবর্তে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং একে একে উত্তর, মধ্য ও পূর্ব ভারতের চৌহান, গাহারওয়াল, সোলাঙ্কি, পারমার, সেন, প্রভৃতি প্রাচীন হিন্দু রাজ্যগুলো বহিরাগত তুর্কি দস্যুদলের পদানত হয়েছে। বিজয়গর্বে দৃপ্ত, প্রভুত্ব ও ধর্মীয় জিহাদের উন্মাদনায় মত্ত বিজিত পরাধীন শতাব্দী প্রাচীন আর্যজাতির প্রতি হতশ্রদ্ধ সাধারণ তুর্কি সেনা অথবা মিনহাজ-ই-সিরাজের ন্যায় রাজপুরুষ যে নিজেদের অতিতের বিজয়কাহিনী অতিশয়োক্তি ও আলৌকিক কাহিনী দ্বারা অতিরঞ্জিত করবে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যপার। পরবর্তীকালেও মিনহাজের এই অতিরঞ্জিত কাহিনী অবলম্বন করে বাংলাদেশে এবং পাকিস্তানে বখতিয়ার খিলজির নদীয়া অভিযানের উউপর প্রচুর লেখা বেরিয়েছে। পরিশেষে এটা ধরে নেওয়া যথেষ্ট যুক্তি সম্মত হবে যে সম্ভবত গুপ্তচর মারফৎ ভুল সংবাদ পেয়ে বখতিয়ার খিলজি যখন তার তুর্কি দস্যুদের নিয়ে বঙ্গের রাজধানি নদীয়ার প্রান্তে পৌঁছেছিলেন তখন রাজা লক্ষণ সেন আগে থেকেই অন্য কোন কারনে সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন। রাজার অনুপস্থিতে নদীয়া নগরও স্বাভাবিক কারনেই প্রায় অরক্ষিতই ছিল। রাজাকে না পেয়ে ক্রোধন্মত্ত বখতিয়ার আর তার বাহিনী নদীয়াতে নিরীহ কাফেরদের গনহত্যা করে ও নগর লুণ্ঠন করে প্রস্থান করেছিল। নদীয়া সেইকালে সেন সাম্রাজ্যের প্রধান রাজধানি বা বিশেষ সুরক্ষিত কোন স্থান ছিল কিনা এতকাল পরে আজ আর তা নিশ্চিতভাবে জানবার কোন উপায়ই নেই। বখতিয়ার খিলজির অন্তিমলগ্নঃ ======================= যদুনাথ সরকার ও আরও নানান বরেণ্য ঐতিহাসিকদের মতে বঙ্গ বিজয়ের পর বখতিয়ার খিলজি প্রায় দশ হাজার তুর্কি সেনা সমেত উত্তরবঙ্গের মধ্যে দিয়ে তিব্বত লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। সম্ভবত বখতিয়ারের বাহিনীতে যোগদান করা ইসলাম ধর্মে সদ্য ধর্মান্তরিত কোন স্থানীয় হিন্দু বা বৌদ্ধের প্ররোচনার ফাঁদে পা দিয়ে বখতিয়ার তার প্রধান সেনাপতি আলি মরদান খিলজির হাতে সদ্য গঠিত রাজ্য শাসনের দায়িত্ব অর্পণ করে দিনাজপুর শহরের দশ মাইল দক্ষিণে দেবকোট থেকে বখতিয়ার প্রায় দশ হাজার অশ্বারোহী বাহিনী সমেত তিব্বতের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। এর পরবর্তী ইতিহাস তুর্কিদের পক্ষে শুধুই বিপর্যয়ের। সে যুগে তিস্তা নদীর আরেক নাম ছিল বাগমতি। সে নদি তখন ছিল যেমন চওড়া তেমনই খরস্রোতা। ঘোড়ায় চেপে তো বটেই এমনকি তৎকালীন যুগের নৌকোতে চেপেও সে নদি অতিক্রম করা ছিল প্রায় এক অসাধ্য ব্যপার। প্রায় দিন দশেক যাত্রা করবার পর এগারোতম দিনে এক প্রাচীন পাথুরে সেতুর সন্ধান পেল বখতিয়ার আর তার সেনাদল। বখতিয়ারের বাহিনীর অধিকাংশ রসদ এই যাত্রাপথেই প্রায় নিঃশেষিত হয়ে এসেছিল। এরপর বখতিয়ারের বাহিনী সমতল ভূমি ত্যাগ করে নেপালের পার্বত্য পথের চড়াই উৎরাই বেয়ে তিব্বতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। এইভাবে হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে চলার বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা না থাকা বখতিয়ার খহিলজি আর তার বাহিনী আরও ১৭-১৮ দিন যাত্রা করবার পর অবশেষে এক জনাকীর্ণ উপত্যকায় এসে উপস্থিত হয়। একদল বিদেশি আর বিধর্মী লুণ্ঠকদের আগমনবার্তা পেয়ে স্থানীয় তিব্বতি যোদ্ধারা সেদিনই গভীর রাতে বিশ্রামরত বখতিয়ার খিলজি আর তার বাহিনীর উপর আচমকা হামলা করে। সেই আক্রমনে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ও পরাজিত হয়ে বখতিয়ার তার তিব্বত অভিযান অসমাপ্ত রেখে অবশিষ্ট বাহিনী সমেত পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর তিব্বত আর নেপাল থেকে বঙ্গের দিকে ফিরতি পথে দেখা দেয় আরও ভয়াবহ বিপদ সমূহ। এমনিতেই তো তিব্বতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বখতিয়ারকে হারাতে হয়েছিল তার অধিকাংশ বাহিনী, তার উপর এবারে দেখা দিল সমূহ খাদ্যাভাব। খাদ্যের অভাবে বখতিয়ারের সেনারা তাদের প্রিয় তুর্কি অশ্বগুলিকেই মেরে আগুনে ঝলসে সেই মাংস ভক্ষণ করতে শুরু করল। এর ফলে কিছুদিনের মধ্যেই ফুড পয়জনিং এর প্রভাবে মারা পড়ল বখতিয়ারের আরও বেশকিছু সেনা। অবশেষে বহু কষ্ট সহ্য করে বখতিয়ার আর তার অবশিষ্ট বাহিনী যখন বাগমতি নদীর পারে পূর্বের সেই প্রস্তর নির্মিত সেতুর নিকটে এসে পৌঁছল তখন তারা মুখোমুখি হুল আরেক বিপর্যয়ের। বখতিয়ার সবিস্ময়ে লক্ষ্য করল যে কামরূপ রাজের নির্দেশে সেই প্রস্তর নির্মিত প্রাচীন সেতুটি ইতিমধ্যেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বখতিয়ারের অভিশপ্ত তিব্বত অভিযানে অংশগ্রহণকারী দশ হাজার তুর্কি বাহিনীর মধ্যে কেবলমাত্র একশো জন জীবিত অবস্থায় দেবকোটে প্রত্যাবর্তন করতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্তু ইতিমধ্যেই পেটের সমস্যা আর ভয়ানক পাহাড়ি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে স্বয়ং বখতিয়ার সহ তারা ছিল প্রায় মৃত্যু শয্যায়। বখতিয়ারের প্রত্যাবর্তন সংবাদ পেয়ে তার প্রধান সেনাপতি আলি মরদান এলেন মৃত্যু শয্যায় শায়িত বখতিয়ার খিলজির সাথে দেখা করতে। এলেন এবং তার তীক্ষ্ণ ছুরিকাঘাতে মুমূর্ষু বখতিয়ারকে খতম করে নিজে বখতিয়ারের যাবতীয় রাজপাট অবলীলাক্রমে অধিকার করে নিলেন। সেন রাজাদের তুর্কি বিরোধী অভিযানঃ ============================ এই প্রতিবেদনের প্রথম আর দ্বিতীয় পর্বেই উল্ল্যেখ করা হয়েছে যে লক্ষণ সেনের দুই সভাকবি উমাপতিধর ও শরণ রচিত কয়েকটি শ্লোকে এক রাজার বিজয়কাহিনীর উল্ল্যেখ আছে। শ্লোকগুলিতে রাজার নাম না থাকলেও লেখা আছে যে তিনি প্রাগজ্যোতিষ (কামরূপ), গৌড়, কলিঙ্গ, কাশী, মগধ প্রভৃতি জয় করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে চেদি ও ম্লেচ্ছরাজাকে পরাজিত করেছিলেন। ম্লেচ্ছ অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষায় বিধর্মী যবন। এখানে মনে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক কে এই ম্লেচ্ছ রাজা ? সেইকালে ম্লেচ্ছ বলতে তুর্কি হামলাকারী হওয়াটাই স্বাভাবিক। এবং এই সমুদয় শ্লোক যে রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবিরা তাদের বরেণ্য রাজা লক্ষণ সেনকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছেন তা অনায়াসে অনুমান করা যেতে পারে। সুতরাং অনান্য হিন্দু রাজাগণ ছাড়াও লক্ষণ সেন যে পরবর্তীকালে কোন ম্লেচ্ছ শাসককেও পরাজিত করেছিলেন এইরূপ অনুমান অসঙ্গত নয় মোটেই। রাজা লক্ষণ সেন আর তাঁর পুত্রদ্বয় ম্লেচ্ছ যবনদের বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধে যে জয়ী হয়েছিলেন সমসাময়িক তাম্রশাসন, শিলালিপি আর কবিতায় এর উল্ল্যেখও আছে। নদীয়া জয়ের ঠিক কতদিন পরে এবং কিভাবে বখতিয়ার খিলজি লক্ষণাবতীজয় করে সেখানে তার রাজধানি স্থাপন করেছিল মিনহাজের গ্রন্থে তার কোন উল্ল্যেখই নেই। কিন্তু একাধিক তাম্রশাসন আর শিলালিপি থেকে আজ এটা প্রমানিত যে তুর্কিদের তথকথিত নদীয়া জয়ের বহু বছর পর পর্যন্ত লক্ষণ সেন আর তাঁর বংশধররা বঙ্গে রাজত্ব করেছিলেন। ১২৫৫ খ্রিষ্টাব্দে মুঘিসুদ্দিন উজবেক নদীয়া জয়ের চিহ্নস্বরূপ যে নয়া মুদ্রার প্রচলন করে তা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমানিত হয় যে ১২৫৫ সালের পূর্বে নদীয়ায় তুর্কি শাসন স্থায়ীরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুতরাং এই তথ্য থেকে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে নদীয়া কিছুকাল বখতিয়ারের অধিকারে থাকলেও পরে লক্ষণ সেন নিজে বা তাঁর কোন পুত্র পুনরায় আক্রমন করে তুর্কিদের কাছ থেকে ফের মুক্ত করেন নদীয়া নগর। কিন্তু যেহেতু সেই সময় সদুর গজনী থেকে দিল্লি হয়ে বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল শক্তিশালী তুর্কি সাম্রাজ্য তাই পরবর্তীকালে তুর্কিদের পরাজিত করলেও এর চেয়ে আর বেশিদুর অগ্রসর হওয়াটা যুক্তিসঙ্গত মনে করেননি সেন সাম্রাজ্যের শাসকগণ। যখন দিল্লি সহ উত্তর ভারতের অধিকাংশ শক্তিশালী হিন্দু সাম্রাজ্যগুলো তুর্কিদের নিকট পদানত তখন অনেকটা মেবারের বীর রাজপুতগণের মতই বঙ্গের বীর সেন রাজারা ব্যাঘ্র বিক্রমে কিছুকালের জন্য হলেও বঙ্গের স্বাধীনটা রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তবে এই কথা বলাই বাহুল্য যে মেবারের বীর যোদ্ধাদের মত সেন রাজারা তুর্কিদের বিরুদ্ধে নিজ স্বাধীনতা রক্ষায় চূড়ান্ত সফলতা লাভ করেননি।

Posted at December 23, 2020 |  by Arya ঋষি

Tags

Text Widget

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipisicing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation test link ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat.

Blog Archive

© 2013 Arya Rishi. WP Theme-junkie converted by Bloggertheme9Published..Blogger Templates
Blogger templates. Proudly Powered by Blogger.
back to top