All Stories
প্রথম স্বয়ম্ভূর খোঁজে
প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্বের পর....মূল প্রবন্ধ: The secret of how life on earth বেগান

১৯৬০ সালের পরে বিজ্ঞানীগণ প্রাণের উৎস অনুসন্ধানে তিনটি মতবাদে বিভক্ত হয়ে গেলেন। কারো ধারণা জীবন শুরু হয়েছিল প্রাথমিক পর্যায়ের জৈবিক কোষ গঠনের মাধ্যমে। অন্য একদল বিজ্ঞানী মনে করেন জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল রাসায়নিক বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কিন্তু আরেক দল বিজ্ঞানী বংশগতি এবং আপন কোষের প্রতিলিপি সৃষ্টির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শেষ দলের বিজ্ঞানীগণ, যে কোষটি নিজেই নিজের অনুরূপ সৃষ্টি করতে পারে তাদের স্বরূপ কেমন ছিল সেটা অন্বেষণের চেষ্টা করেন। এই বিজ্ঞানীগণ প্রথম থেকেই জোর দিয়ে প্রচার করেন জীব-কোষ আরএনএ দিয়ে তৈরি।

১৯৬০ দশকের বিজ্ঞানীগণের চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ ছিল যে আরএনএ হল সকল প্রাণের উৎস। বিশেষত আরএনএ এমনকিছু করতে পারে যেটা ডিএনএ করতে পারে না। আরএনএ হল একটা নমনীয় সুতো সদৃশ মলিকিউল। অন্যদিকে ডিএনএ হল দুইটা সুতো যারা নিজেরা পেঁচিয়ে স্তরে স্তরে বিভিন্ন আকারে সাজানো থাকে। আপনি এনজাইম ছাড়া বাঁচতে পারবেন না। আরএনএ এর ভিতরে কাগজের মত ভাজ করা একটা বস্তু দেখা গেল যেটা প্রোটিনের মত আচরণ করে। প্রোটিন দেখতে সাধারণত অনেকটা লম্বা সুতোর মত। প্রোটিন নিউক্লিওটাইড নয় বরং অ্যামাইনো এসিড দিয়ে তৈরি এবং তারা বিশদ জটিল অবয়ব সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আরএনএ হল প্রোটিন উৎপাদনের সবচেয়ে আশ্চর্য দক্ষতা। কিছু আরএনএ রাসায়নিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে অনুঘটকের কাজ করে। এই সমস্ত প্রোটিনকেই এনজাইম বলে।

আপনার মেরুদণ্ডের হাড়ের মজ্জায় বিপুল পরিমাণ এনজাইম বিদ্যমান। এনজাইম খাদ্যের জটিল মলিকিউলকে ভেঙে শর্করা বা চিনিজাতীয় সাধারণ সরল খাদ্য উপাদানে পরিণত করে যাতে প্রাণীর দেহকোষ সহজে গ্রহণ করতে পারে।

লেজলি ওরগেল এবং ফ্রান্সিস ক্রিক’র মনে হচ্ছিল যদি আরএনএ প্রোটিনের মত ভাজে ভাজে থাকে তাহলে আরএনএ এর মধ্যে জীবন্ত মলিকিউল থাকার সম্ভাবনা আছে এবং সেখানে তথ্যগুলো ডিএনএ আকারে সংরক্ষিত থাকে আর কিছু প্রোটিন রাসায়নিক বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। লেজলি ওরগেল এবং ফ্রান্সিস ক্রিক’র সন্দেহ ছিল নিছক ধারণা কিন্তু দশক ধরে সেই ধারণার কোন সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।

Thomas Cech in 2007
Thomas Cech in 2007 (Credit: Douglas A. Lockard, CC by 3.0)

টমাস রবার্ট চেক জন্মগ্রহণ করেন আমেরিকার আইওয়া শহরে এবং সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। শিশুকাল থেকেই চেক পাথর এবং খনিজ উপাদানের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ অনুভব করেন। তিনি যখন নিম্ন মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র তখনই সে স্থানীয় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের গবেষণাগারের দরজায় উঁকি দিয়ে শিক্ষকদের কাছে খনিজ উপাদানের গঠন প্রণালী দেখতে চেয়েছিলেন। টমাস রবার্ট চেক জৈব রসায়নবিদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন এবং তার আগ্রহের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল আরএনএ। এখন দেখা যাচ্ছে জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল আরএনএ দিয়ে এবং এতদিনের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর প্রায় দ্বারপ্রান্তে।

১৯৮০ সালের শুরুর দিকে টমাস রবার্ট চেক এবং তার কিছু সহকর্মী কোলারাডো বোলডার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে এককোষী প্রাণ ‘Tetrahymena thermophila’ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এককোষী প্রাণের অনুষঙ্গের সুতা সদৃশ বস্তুটি আরএনএ দিয়ে গঠিত। চেক আবিষ্কার করলেন আরএনএ’র একটা বিশেষ অংশ কখনো কখনো মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে যেন তাকে কাঁচি দিয়ে কেটে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। চেকের গবেষকদল যখন সব এনজাইমকে পৃথক করে ফেললেন তখন অন্যান্য মলিকিউল কাঁচির মত কাটাকুটির কাজ করছিল। এই কাজটি চালিয়ে নিচ্ছিল আরএনএ। তারা খুঁজে পেলেন প্রথম আরএনএ এনজাইম। আরএনএ’র ক্ষুদ্র অংশ যারা নিজেদেরকে বৃহৎ অংশ থেকে দ্বিখণ্ডিত করতে সক্ষম।

চেক তার গবেষণামূলক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করলেন ১৯৮২ সালে। পরের বছর অন্য একটি বিজ্ঞানীদল রাইবোজম নামের দ্বিতীয় আরেকটি আরএনএ এনজাইমের সন্ধান পেলেন। দুইটি আরএনএ পাওয়ার সফলতার দ্রুত ইঙ্গিত দিলো সেখানে আরও অনেক কিছুর অস্তিত্ব আছে। এই আবিষ্কারের ফলে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল জীবন সৃষ্টি হয়েছিল আরএনএ থেকে।

ম্যাসাচুচেটস প্রদেশের কেমব্রিজের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওয়াল্টার গিলবার্ট প্রথম মানুষের বংশগতি ধারণার গোড়াপত্তন করেন। পদার্থবিজ্ঞানী হলেও গিলবার্ট মলিকিউলার বায়োলজিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মানুষের জীনের ক্রমবিবর্তনের ধারা প্রমাণ করতে তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা। বিচ্ছিন্ন বস্তুকণা থেকে আরএনএ জগতে উত্তরণ হল প্রাণের বিকাশে রাজকীয় যাত্রার শুরু। ১৯৮৬ সালে ‘নেচার’ বিজ্ঞান সাময়িকীতে গিলবার্ট প্রস্তাব করেন প্রাণের উৎপত্তি হয়ে আরএনএ’র হাত ধরে।

গিলবার্ট যুক্তি দেখান বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে নিউক্লিওটাইড ঘনতরল থেকে বস্তুকণা থেকে নিজেই নিজের প্রাণ সৃষ্টির কাজকে ত্বরান্বিত করে আরএনএ মলিকিউল। আরএনএ সম্মিলিতভাবে দ্বিভাজিত হয় এবং নিজের স্বরূপ সৃষ্টি করে। আরএনএ মলিকিউল ক্রমান্বয়ে অনেক প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার জন্ম দিল। আরএনএ খুঁজে পেল প্রোটিন এবং প্রোটিন এনজাইম সৃষ্টির উপায় এবং প্রমাণিত হল তাদের গুরুত্ব এবং তারা যাত্রা শুরু করলো জীবনের পথে যে জীবন আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রাণের বিকাশ প্রথমদিকের নিউক্লিওটাইড আদিম ঘনতরল স্যুপ থেকে একাধিক জৈবরাসায়নিক অণুজীবের গঠনের উপর যুগপৎ নির্ভর করেনি বরং একটা বিশেষ অণুজীব প্রাণ সৃষ্টির সর্বকাজের কাজি। ২০০০ সালে আরএনএ তত্ত্বের সমর্থনে এক নাটকীয় প্রমাণ পাওয়া গেল।

রাইবোজম প্রোটিন সৃষ্টি করছে
রাইবোজম প্রোটিন সৃষ্টি করছে (কৃতজ্ঞতা: লেগুনা ডিজাইন/ বিজ্ঞান চিত্রশালা)

যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবরসায়নের অধ্যাপক টমাস আর্থার স্টিৎজ সুদীর্ঘ ৩০ বছর ধরে জীবন্ত কোষে অণুজীবের গঠন নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। ১৯৯০ সালে তিনি রাইবোজোমের গঠনপ্রণালী খুঁজে দেখার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলেন। প্রকৃত ঘটনা হলো প্রাণের প্রয়োজনীয় ক্রিয়াকর্ম আরএনএ নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এবং আরএনএ কেন্দ্রিক প্রাণের বিকাশ বেশি গ্রহণযোগ্য।

প্রতিটি জীবন্ত কোষে রাইবোজোম আছে। রাইবোজোম আরএনএ থেকে সংকেত গ্রহণ করতে পারে এবং আরএনএ’র অভ্যন্তরীণ সুতোর-মত জালিকা অ্যামাইনো এসিড একত্রিত করে প্রোটিন সৃষ্টি করতে পারে। প্রাণীদেহের বেশিরভাগ কোষ রাইবোজোম দ্বারা গঠিত। রাইবোজোম কোষের আরএনএ বহনকারী হিসেবে পরিচিত। ২০০০ সালে অধ্যাপক স্টিৎজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল রাইবোজোমের গঠনের বিশদ চিত্র খুঁজে পেলেন এবং আবিষ্কার করলেন রাইবোজোমের অন্তঃস্থলে অনুঘটকের কাজ করছে আরএনএ।

ভাবতেই কেমন জটিল লাগছে, তাই না? কারণ রাইবোজোম হলো জীবনের ভিত্তিমূল এবং একই সাথে প্রাচীন। যেসব বিজ্ঞানীগণ সমর্থন করতেন প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএন থেকে তাদের আনন্দের আর সীমা নাই। এই অসামান্য আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালে অধ্যাপক টমাস আর্থার স্টিৎজ রসায়নে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। কিন্তু সমস্যা ঘটে যায় অন্যত্র। এই আবিষ্কারের ফলে প্রাণ সৃষ্টির রহস্য আবার পিছনের দিকের সেই তিনটি ধারণার মধ্যে সন্দেহ ঘনীভূত হলো। আসলেই কী দিয়ে প্রাণ সৃষ্টি, কীভাবে সৃষ্টি? আরএনএ থেকে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল এই মতবাদের শুরুতেই দুইটা সমস্যা বিদ্যমান ছিল। আরএনএ কী প্রকৃতপক্ষে নিজে নিজেই প্রাণের সবধরনের ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম? পৃথিবীর প্রথম-যুগে কী প্রথমেই আরএনএ সৃষ্টি হয়েছিল?

বিজ্ঞানীগণ তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে গবেষণাগারে নিজেই নিজের সৃষ্টিকর্তা আরএনএ সৃষ্টির কাজ শুরু করলেন। ৩০ বছরের দীর্ঘ গবেষণার পরেও গিলবার্ট প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ দিয়ে এই মতবাদের সমর্থনে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারলেন না। গিলবার্ট পেলেন অণুজীব কিন্তু সেটা প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল। যদি প্রাণ সৃষ্টি হয় আরএনএ অণুজীব দিয়ে তাহলে আরএনএ অবশ্যই নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারবে। আরএনএ’কে হতে হবে স্বয়ম্ভূ।

কিন্তু আরএনএ নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে না। ডিএনএ’র দ্বারাও একাজ সম্ভব নয়। আরএনএ বা ডিএনএ যাকিছুই বলি না কেন নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে হলে তাদের দরকার বিপুল পরিমাণ এনজাইম এবং অন্যান্য অণুজীব। ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে কিছু জীববিজ্ঞানী প্রাণ বিকাশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কিছু অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের সমাধান করতে গবেষণা শুরু করেন। তাদের মতবাদের সমর্থনে তারা নেমে পড়লেন নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এমন আরএনএ’র সন্ধানে।

জ্যাক সোসটাক
জ্যাক সোসটাক (কৃতজ্ঞতাঃ ডেটলেভ ভ্যান র‍্যাভেনসায়ে/ বিজ্ঞান চিত্রশালা)

হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের জীনতত্ত্বের প্রফেসর জ্যাক ইউলিয়াম সোসটাক প্রাণের উৎস সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। শিশুকাল থেকেই তিনি রসায়নের প্রতি এত মুগ্ধ ছিলেন যে তার বাড়ির বেইজমেন্টে তার নিজস্ব একটা গবেষণাগার ছিল। তার নিজের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লেও তিনি একবার রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটান। ফলাফলে যা ঘটেছিল তা ছিল বিস্ময়কর। বিস্ফোরণের ফলে একটা গ্লাসের টিউব তীব্র-বেগে ছুটে গিয়ে ছাদের দেয়ালে গেঁথে গিয়েছিল।
১৯৮০ দশকের শুরুতে সোসটাক প্রমাণ করে দেখাতে সক্ষম হন কীভাবে জীন বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। তার এই গবেষণার ফলাফল তার জন্য নোবেল পুরষ্কার এনে দিয়েছিল। তিনি দেখান আরএনএ এনজাইম কতটা শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু তিনি অতি দ্রুতই টমাস রবার্ট চেক’র আরএনএ এনজাইমের গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। সোসটাক বলেন, “আমি মনে করেছিলাম এনজাইম নিয়ে গবেষণা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। মোটের উপর সম্ভবত আরএনএ নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে।”

১৯৮৮ সালে চেক এক বিশেষ ধরণের আরএনএ ইনজাইমের সন্ধান পেলেন যারা ক্ষুদ্র আরএনএ মলিকিউল বানাতে পারে এবং এই আরএনএ ১০ নিউক্লিওটাইডের সমান দীর্ঘ। সোসটাক গবেষণাগারে নতুন ধরণের আরএনএ ইনজাইম সৃষ্টি করে তার আবিষ্কারকে সমৃদ্ধ করতে গবেষণা শুরু করলেন। সোসটাকের গবেষকদল বিপুল পরিমাণ গবেষণার ফলাফল দৈব-চয়ন পদ্ধতিতে আবার পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন কোন ধরণের এনজাইম অনুঘটকের কাজ করে। সেই পরীক্ষাগুলো থেকে আবার পরীক্ষা করলেন। একই পদ্ধতিতে ১০ বার পরীক্ষার পর সোসটাক এমন এক আরএনএ এনজাইম সৃষ্টি করলেন যার বিক্রিয়ার অনুঘটক ক্ষমতা সাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশের তুলনায় ৭০লক্ষ গুণ বেশি গতিশীল। তারা দেখালেন আরএনএ এনজাইম প্রকৃত অর্থেই প্রভূত শক্তিশালী কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদের আরেকটি অনুরূপ সৃষ্টি করতে পারে না। এমনকি অনুরূপ সৃষ্টির ধারে কাছেও যায় না। সোসটাক যেন অসম্ভবের দেয়ালে আঘাত করলেন।

প্রথম স্বয়ম্ভূর খোঁজে
মনে হয় না আরএনএ জীবনের যাত্রাপথের সূচনা করেছিল। (কৃতজ্ঞতা: বিজ্ঞান চিত্রশালা/আলামি)

তারপরে সবচেয়ে বড় সাফল্য এলো ২০০১ সালে অধ্যাপক সোসটাক’র সাবেক শিক্ষার্থী কেমব্রিজের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির জীব বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড বারটেল’র হাত ধরে। বারটেল আর১৮ নামে আরএনএ এনজাইম সৃষ্টি করলেন যা বিদ্যমান আরএনএ জালের সাথে নতুন নিউক্লিওটাইড যোগ করতে পারে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে এই সাফল্য শুধু আরএনএ’র সাথে যথেচ্ছ নিউক্লিওটাইড সংযুক্তিই নয় বরং পূর্বের পরীক্ষার ফলাফলের যথাযথ প্রতিফলন।

এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের যা কিছু অর্জন তার কিছুই নিজেই নিজের অবিকল কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু অগ্রগতি প্রায় উদ্দেশ্যের কাছাকাছি চলে এসেছে। আর১৮ ১৮৯টি নিউক্লিওটাইড সুতোর জাল দিয়ে গঠিত এবং এটা নির্ভরযোগ্য-ভাবে আরও ১১টি নিউক্লিওটাইড আগের আরএনএ সুতোর জালের সাথে যুক্ত করতে পারে যা নিজের দৈর্ঘ্যের প্রায় ৬ শতাংশ। নতুন গবেষণা আশা জাগালো জালের কিছু সুতোর প্রান্ত ১৮৯টি নিউক্লিওটাইডের সমান দীর্ঘ। তবে এটা নিশ্চিত হওয়া গেল প্রাণের সৃষ্টি আরএনএ থেকে সূত্রপাত হয়নি।

২০১১ সালে কেমব্রিজের মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগে গবেষণাগারে সবচেয়ে সফল পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন ফিলিপ হোলিগার। তার গবেষকদল আর১৮ আরএনএ’র উন্নতি সাধন করেন তার নাম দিলেন টিসি১৯জেড। এই নতুন আরএনএ যেটা নিজেদের ফলাফলের নিউক্লিওটাইড ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিলিপি করতে পারে। তাদের ৪৮ শতাংশ নিজেদের দৈর্ঘ্য যা আর১৮ আরএনএ থেকেও বড় কিন্তু ১০০ শতাংশ সেখানে অত্যাবশ্যকীয় নয়। ক্যালিফোর্নিয়াতে লা জোলা’তে অবস্থিত ‘স্ক্রিপস রিসার্চ ইন্সটিটিউটে’ বিকল্প আর একটা গবেষণা তখন চলছিল জেরাল্ড ফ্রান্সিস জয়েস এবং ট্রেসি লিংকন’র নেতৃত্বে। ২০০৯ সালে তারা আর একধরণের এনজাইমের সন্ধান পেলেন যারা নিজেদের অগোচরেই নিজেদেরকে অবিকল প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। নতুন সৃষ্ট এনজাইম দুইটা ক্ষুদ্র আরএনএ’র সাথে যুক্ত হয়ে দ্বিতীয় আরেকটা এনজাইমের জন্ম দেয়। এই এনজাইম আর দুইটা আরএনএ’র সাথে যুক্ত হয়ে আবার নতুন এনজাইম সৃষ্টি করে। প্রয়োজনীয় উপাদান এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এনজাইম সৃষ্টির এই সরল চক্র অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতেই থাকে। কিন্তু এনজাইম শুধু তখনই সফলভাবে কাজ করতে পারে যখন তাদেরকে সঠিক আরএনএ সূত্র দেয়া হয়। ঠিক এই পরীক্ষাটাই জেরাল্ড ফ্রান্সিস জয়েস এবং ট্রেসি লিংকন গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করেন।

অনেক বিজ্ঞানী প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে এমন তত্ত্বে সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন কারণ আরএনএ নিজেই নিজের আর একটা অবিকল প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে না এবং এটাই এই তত্ত্বের প্রধান দুর্বলতা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আরএনএ থেকে জীবনের সূচনা হয়নি। সম্ভবত নবগঠিত পৃথিবীতে অন্যকোন ধরণের জৈব-কণার উপস্থিতি ছিল সেখান থেকেই প্রাণের সৃষ্টি। প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে যখন রসায়নবিজ্ঞানগণ পারস্পারিক সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন কোন বস্তু থেকে আরএনএ উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়। ডিএনএ’র তুলনায় অণুজীবকে মনে হল অনেক সাধারণ কিন্তু আরএনএ সৃষ্টি করা ভীষণ কঠিন এবং শ্রমসাধ্য কাজ। সমস্যা দেখা দিলো কোষের শর্করা উৎপাদন করতে গিয়ে এবং যার উপর ভিত্তি করে নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি হয় সেখানে বিস্তর ঝামেলা। কোষের এই দুইটা অপরিহার্য উপাদান আলাদা আলাদা উৎপাদন করা সম্ভব কিন্তু এই দুইটা উপাদানের মাঝে কোনভাবেই সংযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই সমস্যা ১৯৯০ দশকের শুরুতেই পরিষ্কার জানা গিয়েছিল সুতরাং অনেক বিজ্ঞানীই নাকসিটকিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে এই তত্ত্ব শুধুই নিরেট ধারণা মাত্র, বাস্তবের সাথে লেশমাত্র সম্পর্ক নাই। তত্ত্বটা মোটেও সঠিক নয়।

সম্ভবত নবগঠিত পৃথিবীতে অন্যকোন ধরণের জৈব-কণার উপস্থিতি ছিল যারা আরএনএ থেকে সরল এবং যারা পৃথিবীর আদিম জৈব-কণা ভর্তি ঘন তরল থেকে নিজেদেরকে সংগঠিত করতে পারে এবং নিজেদের অবিকল প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে শুরু করে এবং আরএনএ, ডিএনএ এবং অন্যান্য উপাদান সৃষ্টির দিকে ধাবিত করে।

[ সম্ভবত ডিএনএ পৃথিবীতে প্রাণের সূচনা করতে প্রথম সংগ্রাম শুরু করে। (কৃতজ্ঞতা: বিজ্ঞান চিত্রশালা/ আলামি) ]
[ সম্ভবত ডিএনএ পৃথিবীতে প্রাণের সূচনা করতে প্রথম সংগ্রাম শুরু করে। (কৃতজ্ঞতা: বিজ্ঞান চিত্রশালা/ আলামি) ]

ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পিটার নিলসেন ১৯৯১ সালে দাবী করলেন জীবনের সূচনা সেই আদিম পুকুরের ঘন তরল থেকে। যেখানে অণুজীব নিজের প্রতিলিপি নিজেই সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এটা ছিল বিস্তর বিবর্তিত ডিএনএ। পিটার নিলসেন পূর্বের বিজ্ঞানীদের গবেষণার উপর ভিত্তি করেই এগিয়ে গেলেন নতুন উদ্যমে এবং স্থির থাকলেন ডিএনএ’র মধ্যে প্রাপ্ত এ, টি, সি এবং জি এনজাইমে। নিলসেন অণুজীব গবেষণার মূল ভিত্তি গড়ে দিলেন এবং ডিএনএ’র ভিতরে শর্করার পরিবর্তে পলিএমাইডস অ্যামাইনো এসিডের সন্ধান পেলেন। তিনি নতুন প্রাপ্ত অণুজীবের নাম দিলেন পলিএমাইডস নিউক্লিক এসিড সংক্ষেপে পিএনএ। যদিও বিভ্রান্তিকরভাবে আমরা এখনো পিএনএ’কে জানি পেপটাইড নিউক্লিক এসিড নামে। আরএনএ’র পিএনএ গঠন এত দুঃসাধ্য নয়, সম্ভবত পৃথিবীর আদিম অবস্থায় পিএনএ গঠিত হয়েছিল।

পিএনএ প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, একে সৃষ্টি করতে হয় এবং আচরণ অনেকাংশে ডিএনএ’র মত। পিএনএ’র সুতার মতো একটা প্রান্ত ডিএনএ’র একটা প্রান্ত দখল করে নিতে পারে। অণুজীবের এই মিলে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তদুপরি পিএনএ, ডিএনএ’র মত দুইটা প্রান্ত পেঁচিয়ে মইয়ের আকার ধারণ করতে পারে। স্ট্যানলি মিলার এখানেই আমাদেরকে মুগ্ধ করে এবং প্রাণ সৃষ্টির রহস্য জগতে কৌতূহলী করে তোলে। তিনি প্রাণের বিকাশ হয়ে আরএনএ থেকে এই তত্ত্বের ঘোরতর অবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন প্রথম প্রাণের উপাদান সৃষ্টিতে পিএনএ বরং অনেক বেশী বিশ্বাসযোগ্য এবং যুক্তিপূর্ণ দাবীদার।

২০০০ সালে স্ট্যানলি মিলার আরও শক্তিশালী প্রমাণ উপস্থাপন করলেন। ইতিমধ্যে তিনি ৭০ বছরের অভিজ্ঞতায় পৌঁছে গেছেন। কিন্তু বিধি বাম, সেই সময়ে তিনি পরপর কয়েকটি ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন ফলে তাকে গবেষণা ছেড়ে নার্সিং হোমে চলে যেতে হয়। তার কাজ আর সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। মিলার তার সেই ক্লাসিকাল ‘স্ট্যানলি মিলার-হ্যারল্ড উরে পরীক্ষা’ পুনরায় করে দেখেন যে পরীক্ষার কথা আমরা ইতিমধ্যেই প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। এবারের পরীক্ষায় মিলার মিথেন, নাইট্রোজেন, অ্যামোনিয়া, পানির সাথে পিএনএ যুক্ত করে দিলেন।

A molecule of threose nucleic acid (TNA)
A molecule of threose nucleic acid (TNA) (Credit: Alfred Pasieka/Science Photo Library)

অন্যান্য রসায়নবিদগণ প্রাণ গবেষণায় এগিয়ে এলেন তাদের নিজস্ব বিকল্প নিউক্লিক এসিড এবং তাদের তত্ত্ব ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান নিয়ে। প্রতিটি বিকল্প নিউক্লিক এসিড ব্যবহারের পিছনে ভিন্ন ভিন্ন সমর্থক বিজ্ঞানীদলের বিশেষ করে যারা এই এসিডের উদ্ভাবন করেছেন তাদের পৃথক যুক্তি আছে। ২০০০ সালে আলবার্ট ইসেনমসার কৃত্রিম জেনেটিক পলিমার ‘থ্রেওস নিউক্লিক এসিড’ উদ্ভাবন করেন। থ্রেওস নিউক্লিক এসিড বা টিএনএ মূলত ডিএনএ কিন্তু এর রাইবোজোমে ভিন্ন ধরণের শর্করা আছে। টিএনএ রাইবোজোমের সুতোর প্রান্ত দুইটা দ্বিমুখী কুণ্ডলী বানাতে পারে এবং আরএনএ এবং টিএনএ’র মাঝে পূর্বাপর তথ্যের অবিকল প্রতিলিপি আদান প্রদান করতে পারে। এছাড়াও টিএনএ জটিলতর ভাজে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারে এবং প্রোটিন সংরক্ষণ করতে পারে। এথেকেই বোঝা যায় টিএনএ আরএনএ’র মতই এনজাইমের কাজ করতে পারে। একইভাবে ২০০৫ সালে এরিক মেগারস গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে গ্লাইকল নিউক্লিক এসিড উৎপাদন করলেন যেগুলো প্যাঁচানো কাঠামো তৈরি করতে পারে। এতক্ষণ যতগুলো নিউক্লিক এসিড নিয়ে আলোচনা হয়েছে তাদের কোনটিই প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, সৃষ্টি হয়েছে গবেষণাগারে। সুতরাং যদি প্রথম প্রাণ এইসব নিউক্লিক এসিডের মধ্য থেকে কোন একটিকে ব্যবহার করে থাকে তাহলে বলতেই হবে এতদিনের চলমান বিতর্ক চলে যাবে আরএনএ এবং ডিএনএ’র পক্ষে অর্থাৎ প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল আরএনএ এবং ডিএনএ দিয়ে। এই মতবাদ হয়ত সত্য, কিন্তু বিজ্ঞানীদের হাতে এই দাবীর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই।

আর এইসব কিছুর অর্থ দাঁড়ালো, ২০০০ শতকের মাঝামাঝি উপনীত হয়ে আরএনএ মতবাদের বিজ্ঞানীগণ প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। আরএনএ মতবাদের বিজ্ঞানীগণের চিন্তা, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ খুব যৌক্তিক এবং গোছানো পরিপাটি কিন্তু প্রাণের উৎস সম্পর্কে পুরোপুরি সত্যের কাছে পৌঁছাতে পারেননি।

A molecule of threose nucleic acid (TNA)
A molecule of threose nucleic acid (TNA) (Credit: Alfred Pasieka/Science Photo Library)

অন্যদিকে আরএনএ এনজাইম প্রকৃতিতেই বিদ্যমান ছিল এবং সুসংবাদ হলো সেই এনজাইমে জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক উপাদান রাইবোজোমের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু এমন কোন আরএনএ’র সন্ধান পাওয়া গেল না যে নিজেই নিজের অনুরূপ প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এবং কোন বিজ্ঞানীই প্রমাণ করতে পারলেন না যে আদিম ঘন তরল স্যুপ থেকে কীভাবে আরএনএ সৃষ্টি হয়েছিল। বিকল্প নিউক্লিক এসিড হয়ত পরবর্তী প্রশ্নের সমাধান দিতে সক্ষম কিন্তু হতাশার খবর এই যে, প্রাণের এইসব প্রাথমিক উপাদানগুলো প্রকৃতিতে আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল তার কোন নির্ভুল প্রমাণ বিজ্ঞানীগণের হাতে নেই। ঠিক সেই সময়ে ১৯৮০ দশক থেকে আরএনএ মদবাদের বিরোধী আর একটি মতবাদ ধীরেধীরে তাদের যুক্তির স্বপক্ষে প্রমাণ যোগার করতে ব্যস্ত ছিল। নতুন মতবাদে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীগণ যুক্তি দেখাতে লাগলেন জীবন আরএনএ বা ডিএনএ বা অন্যকোন বংশগতির বস্তু থেকেও নয় বরং জীবন সৃষ্টি হয়েছিল শক্তির যান্ত্রিক কৌশল ত্বরান্বিত করে। কারণ জীবনকে বেঁচে থাকতে হলে দরকার শক্তি।

Life needs energy to stay alive (Credit: Equinox Graphics Ltd)
Life needs energy to stay alive (Credit: Equinox Graphics Ltd)

পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি পর্ব-৩

প্রথম স্বয়ম্ভূর খোঁজে
প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্বের পর....মূল প্রবন্ধ: The secret of how life on earth বেগান

১৯৬০ সালের পরে বিজ্ঞানীগণ প্রাণের উৎস অনুসন্ধানে তিনটি মতবাদে বিভক্ত হয়ে গেলেন। কারো ধারণা জীবন শুরু হয়েছিল প্রাথমিক পর্যায়ের জৈবিক কোষ গঠনের মাধ্যমে। অন্য একদল বিজ্ঞানী মনে করেন জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল রাসায়নিক বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কিন্তু আরেক দল বিজ্ঞানী বংশগতি এবং আপন কোষের প্রতিলিপি সৃষ্টির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শেষ দলের বিজ্ঞানীগণ, যে কোষটি নিজেই নিজের অনুরূপ সৃষ্টি করতে পারে তাদের স্বরূপ কেমন ছিল সেটা অন্বেষণের চেষ্টা করেন। এই বিজ্ঞানীগণ প্রথম থেকেই জোর দিয়ে প্রচার করেন জীব-কোষ আরএনএ দিয়ে তৈরি।

১৯৬০ দশকের বিজ্ঞানীগণের চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ ছিল যে আরএনএ হল সকল প্রাণের উৎস। বিশেষত আরএনএ এমনকিছু করতে পারে যেটা ডিএনএ করতে পারে না। আরএনএ হল একটা নমনীয় সুতো সদৃশ মলিকিউল। অন্যদিকে ডিএনএ হল দুইটা সুতো যারা নিজেরা পেঁচিয়ে স্তরে স্তরে বিভিন্ন আকারে সাজানো থাকে। আপনি এনজাইম ছাড়া বাঁচতে পারবেন না। আরএনএ এর ভিতরে কাগজের মত ভাজ করা একটা বস্তু দেখা গেল যেটা প্রোটিনের মত আচরণ করে। প্রোটিন দেখতে সাধারণত অনেকটা লম্বা সুতোর মত। প্রোটিন নিউক্লিওটাইড নয় বরং অ্যামাইনো এসিড দিয়ে তৈরি এবং তারা বিশদ জটিল অবয়ব সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আরএনএ হল প্রোটিন উৎপাদনের সবচেয়ে আশ্চর্য দক্ষতা। কিছু আরএনএ রাসায়নিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে অনুঘটকের কাজ করে। এই সমস্ত প্রোটিনকেই এনজাইম বলে।

আপনার মেরুদণ্ডের হাড়ের মজ্জায় বিপুল পরিমাণ এনজাইম বিদ্যমান। এনজাইম খাদ্যের জটিল মলিকিউলকে ভেঙে শর্করা বা চিনিজাতীয় সাধারণ সরল খাদ্য উপাদানে পরিণত করে যাতে প্রাণীর দেহকোষ সহজে গ্রহণ করতে পারে।

লেজলি ওরগেল এবং ফ্রান্সিস ক্রিক’র মনে হচ্ছিল যদি আরএনএ প্রোটিনের মত ভাজে ভাজে থাকে তাহলে আরএনএ এর মধ্যে জীবন্ত মলিকিউল থাকার সম্ভাবনা আছে এবং সেখানে তথ্যগুলো ডিএনএ আকারে সংরক্ষিত থাকে আর কিছু প্রোটিন রাসায়নিক বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। লেজলি ওরগেল এবং ফ্রান্সিস ক্রিক’র সন্দেহ ছিল নিছক ধারণা কিন্তু দশক ধরে সেই ধারণার কোন সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।

Thomas Cech in 2007
Thomas Cech in 2007 (Credit: Douglas A. Lockard, CC by 3.0)

টমাস রবার্ট চেক জন্মগ্রহণ করেন আমেরিকার আইওয়া শহরে এবং সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। শিশুকাল থেকেই চেক পাথর এবং খনিজ উপাদানের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ অনুভব করেন। তিনি যখন নিম্ন মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র তখনই সে স্থানীয় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের গবেষণাগারের দরজায় উঁকি দিয়ে শিক্ষকদের কাছে খনিজ উপাদানের গঠন প্রণালী দেখতে চেয়েছিলেন। টমাস রবার্ট চেক জৈব রসায়নবিদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন এবং তার আগ্রহের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল আরএনএ। এখন দেখা যাচ্ছে জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল আরএনএ দিয়ে এবং এতদিনের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর প্রায় দ্বারপ্রান্তে।

১৯৮০ সালের শুরুর দিকে টমাস রবার্ট চেক এবং তার কিছু সহকর্মী কোলারাডো বোলডার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে এককোষী প্রাণ ‘Tetrahymena thermophila’ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এককোষী প্রাণের অনুষঙ্গের সুতা সদৃশ বস্তুটি আরএনএ দিয়ে গঠিত। চেক আবিষ্কার করলেন আরএনএ’র একটা বিশেষ অংশ কখনো কখনো মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে যেন তাকে কাঁচি দিয়ে কেটে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। চেকের গবেষকদল যখন সব এনজাইমকে পৃথক করে ফেললেন তখন অন্যান্য মলিকিউল কাঁচির মত কাটাকুটির কাজ করছিল। এই কাজটি চালিয়ে নিচ্ছিল আরএনএ। তারা খুঁজে পেলেন প্রথম আরএনএ এনজাইম। আরএনএ’র ক্ষুদ্র অংশ যারা নিজেদেরকে বৃহৎ অংশ থেকে দ্বিখণ্ডিত করতে সক্ষম।

চেক তার গবেষণামূলক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করলেন ১৯৮২ সালে। পরের বছর অন্য একটি বিজ্ঞানীদল রাইবোজম নামের দ্বিতীয় আরেকটি আরএনএ এনজাইমের সন্ধান পেলেন। দুইটি আরএনএ পাওয়ার সফলতার দ্রুত ইঙ্গিত দিলো সেখানে আরও অনেক কিছুর অস্তিত্ব আছে। এই আবিষ্কারের ফলে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল জীবন সৃষ্টি হয়েছিল আরএনএ থেকে।

ম্যাসাচুচেটস প্রদেশের কেমব্রিজের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওয়াল্টার গিলবার্ট প্রথম মানুষের বংশগতি ধারণার গোড়াপত্তন করেন। পদার্থবিজ্ঞানী হলেও গিলবার্ট মলিকিউলার বায়োলজিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মানুষের জীনের ক্রমবিবর্তনের ধারা প্রমাণ করতে তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা। বিচ্ছিন্ন বস্তুকণা থেকে আরএনএ জগতে উত্তরণ হল প্রাণের বিকাশে রাজকীয় যাত্রার শুরু। ১৯৮৬ সালে ‘নেচার’ বিজ্ঞান সাময়িকীতে গিলবার্ট প্রস্তাব করেন প্রাণের উৎপত্তি হয়ে আরএনএ’র হাত ধরে।

গিলবার্ট যুক্তি দেখান বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে নিউক্লিওটাইড ঘনতরল থেকে বস্তুকণা থেকে নিজেই নিজের প্রাণ সৃষ্টির কাজকে ত্বরান্বিত করে আরএনএ মলিকিউল। আরএনএ সম্মিলিতভাবে দ্বিভাজিত হয় এবং নিজের স্বরূপ সৃষ্টি করে। আরএনএ মলিকিউল ক্রমান্বয়ে অনেক প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার জন্ম দিল। আরএনএ খুঁজে পেল প্রোটিন এবং প্রোটিন এনজাইম সৃষ্টির উপায় এবং প্রমাণিত হল তাদের গুরুত্ব এবং তারা যাত্রা শুরু করলো জীবনের পথে যে জীবন আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রাণের বিকাশ প্রথমদিকের নিউক্লিওটাইড আদিম ঘনতরল স্যুপ থেকে একাধিক জৈবরাসায়নিক অণুজীবের গঠনের উপর যুগপৎ নির্ভর করেনি বরং একটা বিশেষ অণুজীব প্রাণ সৃষ্টির সর্বকাজের কাজি। ২০০০ সালে আরএনএ তত্ত্বের সমর্থনে এক নাটকীয় প্রমাণ পাওয়া গেল।

রাইবোজম প্রোটিন সৃষ্টি করছে
রাইবোজম প্রোটিন সৃষ্টি করছে (কৃতজ্ঞতা: লেগুনা ডিজাইন/ বিজ্ঞান চিত্রশালা)

যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবরসায়নের অধ্যাপক টমাস আর্থার স্টিৎজ সুদীর্ঘ ৩০ বছর ধরে জীবন্ত কোষে অণুজীবের গঠন নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। ১৯৯০ সালে তিনি রাইবোজোমের গঠনপ্রণালী খুঁজে দেখার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলেন। প্রকৃত ঘটনা হলো প্রাণের প্রয়োজনীয় ক্রিয়াকর্ম আরএনএ নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এবং আরএনএ কেন্দ্রিক প্রাণের বিকাশ বেশি গ্রহণযোগ্য।

প্রতিটি জীবন্ত কোষে রাইবোজোম আছে। রাইবোজোম আরএনএ থেকে সংকেত গ্রহণ করতে পারে এবং আরএনএ’র অভ্যন্তরীণ সুতোর-মত জালিকা অ্যামাইনো এসিড একত্রিত করে প্রোটিন সৃষ্টি করতে পারে। প্রাণীদেহের বেশিরভাগ কোষ রাইবোজোম দ্বারা গঠিত। রাইবোজোম কোষের আরএনএ বহনকারী হিসেবে পরিচিত। ২০০০ সালে অধ্যাপক স্টিৎজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল রাইবোজোমের গঠনের বিশদ চিত্র খুঁজে পেলেন এবং আবিষ্কার করলেন রাইবোজোমের অন্তঃস্থলে অনুঘটকের কাজ করছে আরএনএ।

ভাবতেই কেমন জটিল লাগছে, তাই না? কারণ রাইবোজোম হলো জীবনের ভিত্তিমূল এবং একই সাথে প্রাচীন। যেসব বিজ্ঞানীগণ সমর্থন করতেন প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএন থেকে তাদের আনন্দের আর সীমা নাই। এই অসামান্য আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালে অধ্যাপক টমাস আর্থার স্টিৎজ রসায়নে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। কিন্তু সমস্যা ঘটে যায় অন্যত্র। এই আবিষ্কারের ফলে প্রাণ সৃষ্টির রহস্য আবার পিছনের দিকের সেই তিনটি ধারণার মধ্যে সন্দেহ ঘনীভূত হলো। আসলেই কী দিয়ে প্রাণ সৃষ্টি, কীভাবে সৃষ্টি? আরএনএ থেকে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল এই মতবাদের শুরুতেই দুইটা সমস্যা বিদ্যমান ছিল। আরএনএ কী প্রকৃতপক্ষে নিজে নিজেই প্রাণের সবধরনের ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম? পৃথিবীর প্রথম-যুগে কী প্রথমেই আরএনএ সৃষ্টি হয়েছিল?

বিজ্ঞানীগণ তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে গবেষণাগারে নিজেই নিজের সৃষ্টিকর্তা আরএনএ সৃষ্টির কাজ শুরু করলেন। ৩০ বছরের দীর্ঘ গবেষণার পরেও গিলবার্ট প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ দিয়ে এই মতবাদের সমর্থনে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারলেন না। গিলবার্ট পেলেন অণুজীব কিন্তু সেটা প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল। যদি প্রাণ সৃষ্টি হয় আরএনএ অণুজীব দিয়ে তাহলে আরএনএ অবশ্যই নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারবে। আরএনএ’কে হতে হবে স্বয়ম্ভূ।

কিন্তু আরএনএ নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে না। ডিএনএ’র দ্বারাও একাজ সম্ভব নয়। আরএনএ বা ডিএনএ যাকিছুই বলি না কেন নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে হলে তাদের দরকার বিপুল পরিমাণ এনজাইম এবং অন্যান্য অণুজীব। ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে কিছু জীববিজ্ঞানী প্রাণ বিকাশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কিছু অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের সমাধান করতে গবেষণা শুরু করেন। তাদের মতবাদের সমর্থনে তারা নেমে পড়লেন নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এমন আরএনএ’র সন্ধানে।

জ্যাক সোসটাক
জ্যাক সোসটাক (কৃতজ্ঞতাঃ ডেটলেভ ভ্যান র‍্যাভেনসায়ে/ বিজ্ঞান চিত্রশালা)

হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের জীনতত্ত্বের প্রফেসর জ্যাক ইউলিয়াম সোসটাক প্রাণের উৎস সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। শিশুকাল থেকেই তিনি রসায়নের প্রতি এত মুগ্ধ ছিলেন যে তার বাড়ির বেইজমেন্টে তার নিজস্ব একটা গবেষণাগার ছিল। তার নিজের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লেও তিনি একবার রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটান। ফলাফলে যা ঘটেছিল তা ছিল বিস্ময়কর। বিস্ফোরণের ফলে একটা গ্লাসের টিউব তীব্র-বেগে ছুটে গিয়ে ছাদের দেয়ালে গেঁথে গিয়েছিল।
১৯৮০ দশকের শুরুতে সোসটাক প্রমাণ করে দেখাতে সক্ষম হন কীভাবে জীন বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। তার এই গবেষণার ফলাফল তার জন্য নোবেল পুরষ্কার এনে দিয়েছিল। তিনি দেখান আরএনএ এনজাইম কতটা শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু তিনি অতি দ্রুতই টমাস রবার্ট চেক’র আরএনএ এনজাইমের গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। সোসটাক বলেন, “আমি মনে করেছিলাম এনজাইম নিয়ে গবেষণা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। মোটের উপর সম্ভবত আরএনএ নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে।”

১৯৮৮ সালে চেক এক বিশেষ ধরণের আরএনএ ইনজাইমের সন্ধান পেলেন যারা ক্ষুদ্র আরএনএ মলিকিউল বানাতে পারে এবং এই আরএনএ ১০ নিউক্লিওটাইডের সমান দীর্ঘ। সোসটাক গবেষণাগারে নতুন ধরণের আরএনএ ইনজাইম সৃষ্টি করে তার আবিষ্কারকে সমৃদ্ধ করতে গবেষণা শুরু করলেন। সোসটাকের গবেষকদল বিপুল পরিমাণ গবেষণার ফলাফল দৈব-চয়ন পদ্ধতিতে আবার পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন কোন ধরণের এনজাইম অনুঘটকের কাজ করে। সেই পরীক্ষাগুলো থেকে আবার পরীক্ষা করলেন। একই পদ্ধতিতে ১০ বার পরীক্ষার পর সোসটাক এমন এক আরএনএ এনজাইম সৃষ্টি করলেন যার বিক্রিয়ার অনুঘটক ক্ষমতা সাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশের তুলনায় ৭০লক্ষ গুণ বেশি গতিশীল। তারা দেখালেন আরএনএ এনজাইম প্রকৃত অর্থেই প্রভূত শক্তিশালী কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদের আরেকটি অনুরূপ সৃষ্টি করতে পারে না। এমনকি অনুরূপ সৃষ্টির ধারে কাছেও যায় না। সোসটাক যেন অসম্ভবের দেয়ালে আঘাত করলেন।

প্রথম স্বয়ম্ভূর খোঁজে
মনে হয় না আরএনএ জীবনের যাত্রাপথের সূচনা করেছিল। (কৃতজ্ঞতা: বিজ্ঞান চিত্রশালা/আলামি)

তারপরে সবচেয়ে বড় সাফল্য এলো ২০০১ সালে অধ্যাপক সোসটাক’র সাবেক শিক্ষার্থী কেমব্রিজের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির জীব বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড বারটেল’র হাত ধরে। বারটেল আর১৮ নামে আরএনএ এনজাইম সৃষ্টি করলেন যা বিদ্যমান আরএনএ জালের সাথে নতুন নিউক্লিওটাইড যোগ করতে পারে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে এই সাফল্য শুধু আরএনএ’র সাথে যথেচ্ছ নিউক্লিওটাইড সংযুক্তিই নয় বরং পূর্বের পরীক্ষার ফলাফলের যথাযথ প্রতিফলন।

এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের যা কিছু অর্জন তার কিছুই নিজেই নিজের অবিকল কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু অগ্রগতি প্রায় উদ্দেশ্যের কাছাকাছি চলে এসেছে। আর১৮ ১৮৯টি নিউক্লিওটাইড সুতোর জাল দিয়ে গঠিত এবং এটা নির্ভরযোগ্য-ভাবে আরও ১১টি নিউক্লিওটাইড আগের আরএনএ সুতোর জালের সাথে যুক্ত করতে পারে যা নিজের দৈর্ঘ্যের প্রায় ৬ শতাংশ। নতুন গবেষণা আশা জাগালো জালের কিছু সুতোর প্রান্ত ১৮৯টি নিউক্লিওটাইডের সমান দীর্ঘ। তবে এটা নিশ্চিত হওয়া গেল প্রাণের সৃষ্টি আরএনএ থেকে সূত্রপাত হয়নি।

২০১১ সালে কেমব্রিজের মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগে গবেষণাগারে সবচেয়ে সফল পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন ফিলিপ হোলিগার। তার গবেষকদল আর১৮ আরএনএ’র উন্নতি সাধন করেন তার নাম দিলেন টিসি১৯জেড। এই নতুন আরএনএ যেটা নিজেদের ফলাফলের নিউক্লিওটাইড ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিলিপি করতে পারে। তাদের ৪৮ শতাংশ নিজেদের দৈর্ঘ্য যা আর১৮ আরএনএ থেকেও বড় কিন্তু ১০০ শতাংশ সেখানে অত্যাবশ্যকীয় নয়। ক্যালিফোর্নিয়াতে লা জোলা’তে অবস্থিত ‘স্ক্রিপস রিসার্চ ইন্সটিটিউটে’ বিকল্প আর একটা গবেষণা তখন চলছিল জেরাল্ড ফ্রান্সিস জয়েস এবং ট্রেসি লিংকন’র নেতৃত্বে। ২০০৯ সালে তারা আর একধরণের এনজাইমের সন্ধান পেলেন যারা নিজেদের অগোচরেই নিজেদেরকে অবিকল প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। নতুন সৃষ্ট এনজাইম দুইটা ক্ষুদ্র আরএনএ’র সাথে যুক্ত হয়ে দ্বিতীয় আরেকটা এনজাইমের জন্ম দেয়। এই এনজাইম আর দুইটা আরএনএ’র সাথে যুক্ত হয়ে আবার নতুন এনজাইম সৃষ্টি করে। প্রয়োজনীয় উপাদান এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এনজাইম সৃষ্টির এই সরল চক্র অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতেই থাকে। কিন্তু এনজাইম শুধু তখনই সফলভাবে কাজ করতে পারে যখন তাদেরকে সঠিক আরএনএ সূত্র দেয়া হয়। ঠিক এই পরীক্ষাটাই জেরাল্ড ফ্রান্সিস জয়েস এবং ট্রেসি লিংকন গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করেন।

অনেক বিজ্ঞানী প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে এমন তত্ত্বে সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন কারণ আরএনএ নিজেই নিজের আর একটা অবিকল প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে না এবং এটাই এই তত্ত্বের প্রধান দুর্বলতা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আরএনএ থেকে জীবনের সূচনা হয়নি। সম্ভবত নবগঠিত পৃথিবীতে অন্যকোন ধরণের জৈব-কণার উপস্থিতি ছিল সেখান থেকেই প্রাণের সৃষ্টি। প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে যখন রসায়নবিজ্ঞানগণ পারস্পারিক সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন কোন বস্তু থেকে আরএনএ উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়। ডিএনএ’র তুলনায় অণুজীবকে মনে হল অনেক সাধারণ কিন্তু আরএনএ সৃষ্টি করা ভীষণ কঠিন এবং শ্রমসাধ্য কাজ। সমস্যা দেখা দিলো কোষের শর্করা উৎপাদন করতে গিয়ে এবং যার উপর ভিত্তি করে নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি হয় সেখানে বিস্তর ঝামেলা। কোষের এই দুইটা অপরিহার্য উপাদান আলাদা আলাদা উৎপাদন করা সম্ভব কিন্তু এই দুইটা উপাদানের মাঝে কোনভাবেই সংযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই সমস্যা ১৯৯০ দশকের শুরুতেই পরিষ্কার জানা গিয়েছিল সুতরাং অনেক বিজ্ঞানীই নাকসিটকিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে এই তত্ত্ব শুধুই নিরেট ধারণা মাত্র, বাস্তবের সাথে লেশমাত্র সম্পর্ক নাই। তত্ত্বটা মোটেও সঠিক নয়।

সম্ভবত নবগঠিত পৃথিবীতে অন্যকোন ধরণের জৈব-কণার উপস্থিতি ছিল যারা আরএনএ থেকে সরল এবং যারা পৃথিবীর আদিম জৈব-কণা ভর্তি ঘন তরল থেকে নিজেদেরকে সংগঠিত করতে পারে এবং নিজেদের অবিকল প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে শুরু করে এবং আরএনএ, ডিএনএ এবং অন্যান্য উপাদান সৃষ্টির দিকে ধাবিত করে।

[ সম্ভবত ডিএনএ পৃথিবীতে প্রাণের সূচনা করতে প্রথম সংগ্রাম শুরু করে। (কৃতজ্ঞতা: বিজ্ঞান চিত্রশালা/ আলামি) ]
[ সম্ভবত ডিএনএ পৃথিবীতে প্রাণের সূচনা করতে প্রথম সংগ্রাম শুরু করে। (কৃতজ্ঞতা: বিজ্ঞান চিত্রশালা/ আলামি) ]

ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পিটার নিলসেন ১৯৯১ সালে দাবী করলেন জীবনের সূচনা সেই আদিম পুকুরের ঘন তরল থেকে। যেখানে অণুজীব নিজের প্রতিলিপি নিজেই সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এটা ছিল বিস্তর বিবর্তিত ডিএনএ। পিটার নিলসেন পূর্বের বিজ্ঞানীদের গবেষণার উপর ভিত্তি করেই এগিয়ে গেলেন নতুন উদ্যমে এবং স্থির থাকলেন ডিএনএ’র মধ্যে প্রাপ্ত এ, টি, সি এবং জি এনজাইমে। নিলসেন অণুজীব গবেষণার মূল ভিত্তি গড়ে দিলেন এবং ডিএনএ’র ভিতরে শর্করার পরিবর্তে পলিএমাইডস অ্যামাইনো এসিডের সন্ধান পেলেন। তিনি নতুন প্রাপ্ত অণুজীবের নাম দিলেন পলিএমাইডস নিউক্লিক এসিড সংক্ষেপে পিএনএ। যদিও বিভ্রান্তিকরভাবে আমরা এখনো পিএনএ’কে জানি পেপটাইড নিউক্লিক এসিড নামে। আরএনএ’র পিএনএ গঠন এত দুঃসাধ্য নয়, সম্ভবত পৃথিবীর আদিম অবস্থায় পিএনএ গঠিত হয়েছিল।

পিএনএ প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, একে সৃষ্টি করতে হয় এবং আচরণ অনেকাংশে ডিএনএ’র মত। পিএনএ’র সুতার মতো একটা প্রান্ত ডিএনএ’র একটা প্রান্ত দখল করে নিতে পারে। অণুজীবের এই মিলে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তদুপরি পিএনএ, ডিএনএ’র মত দুইটা প্রান্ত পেঁচিয়ে মইয়ের আকার ধারণ করতে পারে। স্ট্যানলি মিলার এখানেই আমাদেরকে মুগ্ধ করে এবং প্রাণ সৃষ্টির রহস্য জগতে কৌতূহলী করে তোলে। তিনি প্রাণের বিকাশ হয়ে আরএনএ থেকে এই তত্ত্বের ঘোরতর অবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন প্রথম প্রাণের উপাদান সৃষ্টিতে পিএনএ বরং অনেক বেশী বিশ্বাসযোগ্য এবং যুক্তিপূর্ণ দাবীদার।

২০০০ সালে স্ট্যানলি মিলার আরও শক্তিশালী প্রমাণ উপস্থাপন করলেন। ইতিমধ্যে তিনি ৭০ বছরের অভিজ্ঞতায় পৌঁছে গেছেন। কিন্তু বিধি বাম, সেই সময়ে তিনি পরপর কয়েকটি ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন ফলে তাকে গবেষণা ছেড়ে নার্সিং হোমে চলে যেতে হয়। তার কাজ আর সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। মিলার তার সেই ক্লাসিকাল ‘স্ট্যানলি মিলার-হ্যারল্ড উরে পরীক্ষা’ পুনরায় করে দেখেন যে পরীক্ষার কথা আমরা ইতিমধ্যেই প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। এবারের পরীক্ষায় মিলার মিথেন, নাইট্রোজেন, অ্যামোনিয়া, পানির সাথে পিএনএ যুক্ত করে দিলেন।

A molecule of threose nucleic acid (TNA)
A molecule of threose nucleic acid (TNA) (Credit: Alfred Pasieka/Science Photo Library)

অন্যান্য রসায়নবিদগণ প্রাণ গবেষণায় এগিয়ে এলেন তাদের নিজস্ব বিকল্প নিউক্লিক এসিড এবং তাদের তত্ত্ব ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান নিয়ে। প্রতিটি বিকল্প নিউক্লিক এসিড ব্যবহারের পিছনে ভিন্ন ভিন্ন সমর্থক বিজ্ঞানীদলের বিশেষ করে যারা এই এসিডের উদ্ভাবন করেছেন তাদের পৃথক যুক্তি আছে। ২০০০ সালে আলবার্ট ইসেনমসার কৃত্রিম জেনেটিক পলিমার ‘থ্রেওস নিউক্লিক এসিড’ উদ্ভাবন করেন। থ্রেওস নিউক্লিক এসিড বা টিএনএ মূলত ডিএনএ কিন্তু এর রাইবোজোমে ভিন্ন ধরণের শর্করা আছে। টিএনএ রাইবোজোমের সুতোর প্রান্ত দুইটা দ্বিমুখী কুণ্ডলী বানাতে পারে এবং আরএনএ এবং টিএনএ’র মাঝে পূর্বাপর তথ্যের অবিকল প্রতিলিপি আদান প্রদান করতে পারে। এছাড়াও টিএনএ জটিলতর ভাজে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারে এবং প্রোটিন সংরক্ষণ করতে পারে। এথেকেই বোঝা যায় টিএনএ আরএনএ’র মতই এনজাইমের কাজ করতে পারে। একইভাবে ২০০৫ সালে এরিক মেগারস গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে গ্লাইকল নিউক্লিক এসিড উৎপাদন করলেন যেগুলো প্যাঁচানো কাঠামো তৈরি করতে পারে। এতক্ষণ যতগুলো নিউক্লিক এসিড নিয়ে আলোচনা হয়েছে তাদের কোনটিই প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, সৃষ্টি হয়েছে গবেষণাগারে। সুতরাং যদি প্রথম প্রাণ এইসব নিউক্লিক এসিডের মধ্য থেকে কোন একটিকে ব্যবহার করে থাকে তাহলে বলতেই হবে এতদিনের চলমান বিতর্ক চলে যাবে আরএনএ এবং ডিএনএ’র পক্ষে অর্থাৎ প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল আরএনএ এবং ডিএনএ দিয়ে। এই মতবাদ হয়ত সত্য, কিন্তু বিজ্ঞানীদের হাতে এই দাবীর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই।

আর এইসব কিছুর অর্থ দাঁড়ালো, ২০০০ শতকের মাঝামাঝি উপনীত হয়ে আরএনএ মতবাদের বিজ্ঞানীগণ প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। আরএনএ মতবাদের বিজ্ঞানীগণের চিন্তা, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ খুব যৌক্তিক এবং গোছানো পরিপাটি কিন্তু প্রাণের উৎস সম্পর্কে পুরোপুরি সত্যের কাছে পৌঁছাতে পারেননি।

A molecule of threose nucleic acid (TNA)
A molecule of threose nucleic acid (TNA) (Credit: Alfred Pasieka/Science Photo Library)

অন্যদিকে আরএনএ এনজাইম প্রকৃতিতেই বিদ্যমান ছিল এবং সুসংবাদ হলো সেই এনজাইমে জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক উপাদান রাইবোজোমের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু এমন কোন আরএনএ’র সন্ধান পাওয়া গেল না যে নিজেই নিজের অনুরূপ প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এবং কোন বিজ্ঞানীই প্রমাণ করতে পারলেন না যে আদিম ঘন তরল স্যুপ থেকে কীভাবে আরএনএ সৃষ্টি হয়েছিল। বিকল্প নিউক্লিক এসিড হয়ত পরবর্তী প্রশ্নের সমাধান দিতে সক্ষম কিন্তু হতাশার খবর এই যে, প্রাণের এইসব প্রাথমিক উপাদানগুলো প্রকৃতিতে আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল তার কোন নির্ভুল প্রমাণ বিজ্ঞানীগণের হাতে নেই। ঠিক সেই সময়ে ১৯৮০ দশক থেকে আরএনএ মদবাদের বিরোধী আর একটি মতবাদ ধীরেধীরে তাদের যুক্তির স্বপক্ষে প্রমাণ যোগার করতে ব্যস্ত ছিল। নতুন মতবাদে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীগণ যুক্তি দেখাতে লাগলেন জীবন আরএনএ বা ডিএনএ বা অন্যকোন বংশগতির বস্তু থেকেও নয় বরং জীবন সৃষ্টি হয়েছিল শক্তির যান্ত্রিক কৌশল ত্বরান্বিত করে। কারণ জীবনকে বেঁচে থাকতে হলে দরকার শক্তি।

Life needs energy to stay alive (Credit: Equinox Graphics Ltd)
Life needs energy to stay alive (Credit: Equinox Graphics Ltd)

Posted at August 10, 2019 |  by Arya ঋষি

0 Comments:

ওত্জির

1991, অষ্ট্রিয়া আর ইটালির সীমান্ত এলাকা আল্পস পর্বতে একদল পর্যটক খুঁজে পান ওত্জি কে। না জীবন্ত নয় তাঁর মৃতদেহ। বহুকাল আগেই ওত্জি মারা গেছেন এই বরফের দেশে। তিনি মারা গেছেন সাধারন পূর্বাব্দ ৩৩০০ নাগাদ। অর্থাৎ আজ থেকে ৫৩০০ বৎসর আগে থেকে বরফ চাপা ওত্জি শুয়ে আছেন ওখানে।
বরফের নীচে চাপা থাকাতে প্রাচীন মৃত দেহগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভাল অবস্থায় ওত্জি কে পাওয়া গেছে। হ্যাঁ বিখ্যাত মিশরের পিরামিডের মমিগুলোর চেয়ে বহু বহু গুন ভাল অবস্থায়।
৫ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা ৫০ কেজি ওজনের ২৫-৩৫ বৎসর বয়স্ক ওত্জির নামাকরন হল যেখানে তাঁকে পাওয়া গেছে সেই এলাকার Ötztal Alps, নামের সাথে তাল মিলিয়ে।
কেমন করে মারা গেছেন তা জানা গেছে। তাঁর মাথার পেছন দিকে কেউ খুব জোরে মেরেছিল। আর তার সাথে তার পেছন থেকে একটি পাথরের তীরের ফলা তাঁর পাঁজর ভেদ করে। তাতেই তিনি মারা যান।
তিনি কি যোদ্ধা ছিলেন, না এটা সাধারন খুনোখুনি সেটা বলা কঠিন। তবে মরার আগে তিনি চারজনকে আহত করেছেন। তাঁর হাতের অস্ত্রে চারজন আলাদা আলাদা মানুষের রক্তের অস্তিত্ব জানা গেছে।
পাহাড়ের বাসিন্দা ছিলেন না, তবু কেন তিনি ঐ তিন হাজার ফুট উঁচুতে এসেছিলেন তা জানা সম্ভব না। ছিলেন সমতল এলাকার বাসিন্দা। তবে ৩৫ বৎসর বয়সি ওত্জি দীর্ঘকাল কায়িক পরিশ্রমের দরুণই হয়তো বয়সের তুলনায় যথেষ্ট বুড়োটে ছিলেন। তাঁর হাড়ের ক্ষয় দেখে সেটা সহজেই বলা যায়।
তিনি পাহাড়ের লোক ছিলেন না তা জানা গেল তাঁর পেটে খাবারের কনা থেকে। সেই খাবারের শষ্য উৎপন্ন হয় সমতলেই। মারা যাবার পাঁচ ঘন্টা আগে তিনি হরিনের মাংস আর রুটি খেয়েছেন। ও হ্যাঁ তাঁর পেটের সমস্যা ছিল। পেটে কৃমি ছিল। বেশ বড় কৃমি।
খাবার খেয়ে বেশ প্রস্তুত হয়েই পাহাড়ের পথে রওনা দেন। কারন তাঁর পরনে ছিল অন্তর্বাস হিসাবে ভেড়ার চামড়া। সে ভেড়া আবার অন্য এলাকার। কাজেই এটা তাঁর কেনা পোষাকই ছিল বোঝা যায়। চামড়ার উপরে ছিল ঘাষের তৈরী পোষাকের আস্তরন। পায়ে জুতো। দড়ি দিয়ে বোনা জুতোর সামনের দিকে চামড়া ছিল। আর পায়ের তলার দিকে প্যাডিং-এর জন্য ছিল ঘাস। হাতে ছিল কাঠের হাতল সহ তামার কুড়াল, পাথরের ফলা সহ তীর ধনুক।
ওত্জির দেহের ডি.এন.এ পরীক্ষা করে ইতালীর সার্ডিনিয়া অঞ্চলে তাঁর বহু বংশধরের সন্ধান পাওয়া গেছে।
সেই মৃতদেহ সযত্নে বিজ্ঞানীরা তুলে আনেন। শুরু হয় নানা গবেষনা। সাধারন ব্যাপার তো নয়। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগেকার একটি দেহ প্রায় অবিকৃত অবস্থায়। বিজ্ঞানীদের কাছে এটি একটি অমুল্য সম্পদ।
যেহেতু তার জিন ম্যাপিং করা হয়ে গেছে তাই তার চেহারা কম্প্যুটারে তৈরী করতে বিজ্ঞানীদের খুব একটা কষ্ট হয় নি।
ওতজি কে পাওয়ার পঁচিশ বৎসর উপলক্ষে বিজ্ঞানীরা একটি অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁরা জানতে চান ওতজির কন্ঠস্বর কেমন ছিল।
তাঁর কন্ঠস্বর শুনতে হলে তার স্বরনালী নতুন করে তৈরী করতেই হবে। কিন্তু সে জন্য দরকার ওতজির স্বরনালীর গঠন নিখুঁত ভাবে জানা। তা সেটা তো এক্স-রে করে বা সি.টি স্ক্যান করে করা যেতেই পারে। কিন্তু না ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না। কারন ওতজির একটা হাত তার গলার উপর ছিল। সেই হাতের জন্য কিছুতেই ঠিকঠাক ভাবে গলার ভেতরের স্বরনালীর সঠিক চেহারা ধরা যাচ্ছিল না।
অবশেষে অত্যাধুনিক ষন্ত্রপাতির সাহায্যে সেটা সম্ভব হয়েছে।
একবার তার স্বরনালীর গঠন জানা হয়ে গেলে বাকী কাজ তো বিজ্ঞানীদের কাছে খুবই সহজ।
তাঁরা কৃত্রিম স্বরনালী বানিয়ে ফেললেন। সফট ওয়্যার তৈরী হয়ে গেল। এখন আমরা ওত্জির গলার স্বর শুনতে পারি।
যেহেতু আমরা কেউ জানি না ওতজি কি ভাষায় কথা বলতেন, তাই বিজ্ঞানীরা ওতজির গলায় আমাদের শোনালেন শুধু AEIOU  পাঁচ হাজার তিনশ বৎসর আগে মৃত ওতজি এখন আমাদের শোনাচ্ছেন AEIOU
সেই কন্ঠস্বর শোনার জন্য ইউটিউবের লিঙ্ক দেওয়া হল।
তথ্যসুত্রঃ-
Encyclopedia Britannica
https://www.youtube.com/watch?v=_FUH4xpYUMs

Ötzi
Reconstruction of Ötzi based on forensic analysis of the mummy; in the South Tyrol Museum of Archaeology in Bolzano, Italy.

ওত্জির

ওত্জির

1991, অষ্ট্রিয়া আর ইটালির সীমান্ত এলাকা আল্পস পর্বতে একদল পর্যটক খুঁজে পান ওত্জি কে। না জীবন্ত নয় তাঁর মৃতদেহ। বহুকাল আগেই ওত্জি মারা গেছেন এই বরফের দেশে। তিনি মারা গেছেন সাধারন পূর্বাব্দ ৩৩০০ নাগাদ। অর্থাৎ আজ থেকে ৫৩০০ বৎসর আগে থেকে বরফ চাপা ওত্জি শুয়ে আছেন ওখানে।
বরফের নীচে চাপা থাকাতে প্রাচীন মৃত দেহগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভাল অবস্থায় ওত্জি কে পাওয়া গেছে। হ্যাঁ বিখ্যাত মিশরের পিরামিডের মমিগুলোর চেয়ে বহু বহু গুন ভাল অবস্থায়।
৫ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা ৫০ কেজি ওজনের ২৫-৩৫ বৎসর বয়স্ক ওত্জির নামাকরন হল যেখানে তাঁকে পাওয়া গেছে সেই এলাকার Ötztal Alps, নামের সাথে তাল মিলিয়ে।
কেমন করে মারা গেছেন তা জানা গেছে। তাঁর মাথার পেছন দিকে কেউ খুব জোরে মেরেছিল। আর তার সাথে তার পেছন থেকে একটি পাথরের তীরের ফলা তাঁর পাঁজর ভেদ করে। তাতেই তিনি মারা যান।
তিনি কি যোদ্ধা ছিলেন, না এটা সাধারন খুনোখুনি সেটা বলা কঠিন। তবে মরার আগে তিনি চারজনকে আহত করেছেন। তাঁর হাতের অস্ত্রে চারজন আলাদা আলাদা মানুষের রক্তের অস্তিত্ব জানা গেছে।
পাহাড়ের বাসিন্দা ছিলেন না, তবু কেন তিনি ঐ তিন হাজার ফুট উঁচুতে এসেছিলেন তা জানা সম্ভব না। ছিলেন সমতল এলাকার বাসিন্দা। তবে ৩৫ বৎসর বয়সি ওত্জি দীর্ঘকাল কায়িক পরিশ্রমের দরুণই হয়তো বয়সের তুলনায় যথেষ্ট বুড়োটে ছিলেন। তাঁর হাড়ের ক্ষয় দেখে সেটা সহজেই বলা যায়।
তিনি পাহাড়ের লোক ছিলেন না তা জানা গেল তাঁর পেটে খাবারের কনা থেকে। সেই খাবারের শষ্য উৎপন্ন হয় সমতলেই। মারা যাবার পাঁচ ঘন্টা আগে তিনি হরিনের মাংস আর রুটি খেয়েছেন। ও হ্যাঁ তাঁর পেটের সমস্যা ছিল। পেটে কৃমি ছিল। বেশ বড় কৃমি।
খাবার খেয়ে বেশ প্রস্তুত হয়েই পাহাড়ের পথে রওনা দেন। কারন তাঁর পরনে ছিল অন্তর্বাস হিসাবে ভেড়ার চামড়া। সে ভেড়া আবার অন্য এলাকার। কাজেই এটা তাঁর কেনা পোষাকই ছিল বোঝা যায়। চামড়ার উপরে ছিল ঘাষের তৈরী পোষাকের আস্তরন। পায়ে জুতো। দড়ি দিয়ে বোনা জুতোর সামনের দিকে চামড়া ছিল। আর পায়ের তলার দিকে প্যাডিং-এর জন্য ছিল ঘাস। হাতে ছিল কাঠের হাতল সহ তামার কুড়াল, পাথরের ফলা সহ তীর ধনুক।
ওত্জির দেহের ডি.এন.এ পরীক্ষা করে ইতালীর সার্ডিনিয়া অঞ্চলে তাঁর বহু বংশধরের সন্ধান পাওয়া গেছে।
সেই মৃতদেহ সযত্নে বিজ্ঞানীরা তুলে আনেন। শুরু হয় নানা গবেষনা। সাধারন ব্যাপার তো নয়। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগেকার একটি দেহ প্রায় অবিকৃত অবস্থায়। বিজ্ঞানীদের কাছে এটি একটি অমুল্য সম্পদ।
যেহেতু তার জিন ম্যাপিং করা হয়ে গেছে তাই তার চেহারা কম্প্যুটারে তৈরী করতে বিজ্ঞানীদের খুব একটা কষ্ট হয় নি।
ওতজি কে পাওয়ার পঁচিশ বৎসর উপলক্ষে বিজ্ঞানীরা একটি অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁরা জানতে চান ওতজির কন্ঠস্বর কেমন ছিল।
তাঁর কন্ঠস্বর শুনতে হলে তার স্বরনালী নতুন করে তৈরী করতেই হবে। কিন্তু সে জন্য দরকার ওতজির স্বরনালীর গঠন নিখুঁত ভাবে জানা। তা সেটা তো এক্স-রে করে বা সি.টি স্ক্যান করে করা যেতেই পারে। কিন্তু না ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না। কারন ওতজির একটা হাত তার গলার উপর ছিল। সেই হাতের জন্য কিছুতেই ঠিকঠাক ভাবে গলার ভেতরের স্বরনালীর সঠিক চেহারা ধরা যাচ্ছিল না।
অবশেষে অত্যাধুনিক ষন্ত্রপাতির সাহায্যে সেটা সম্ভব হয়েছে।
একবার তার স্বরনালীর গঠন জানা হয়ে গেলে বাকী কাজ তো বিজ্ঞানীদের কাছে খুবই সহজ।
তাঁরা কৃত্রিম স্বরনালী বানিয়ে ফেললেন। সফট ওয়্যার তৈরী হয়ে গেল। এখন আমরা ওত্জির গলার স্বর শুনতে পারি।
যেহেতু আমরা কেউ জানি না ওতজি কি ভাষায় কথা বলতেন, তাই বিজ্ঞানীরা ওতজির গলায় আমাদের শোনালেন শুধু AEIOU  পাঁচ হাজার তিনশ বৎসর আগে মৃত ওতজি এখন আমাদের শোনাচ্ছেন AEIOU
সেই কন্ঠস্বর শোনার জন্য ইউটিউবের লিঙ্ক দেওয়া হল।
তথ্যসুত্রঃ-
Encyclopedia Britannica
https://www.youtube.com/watch?v=_FUH4xpYUMs

Ötzi
Reconstruction of Ötzi based on forensic analysis of the mummy; in the South Tyrol Museum of Archaeology in Bolzano, Italy.

Posted at June 07, 2019 |  by Arya ঋষি

0 Comments:


প্রশ্নঃ নবী মুহাম্মদ (সা) শিশুকামি ছিলেন তাই তিনি আয়েশা (রা)কে শিশু অবস্থায় বিয়ে করে ? ৬ বছরের বিয়ে অমানবিক ?
লিখেছেনঃ এম ডি আলী

উত্তরঃ "নবী মুহাম্মদ (সা) শিশুকামি ছিলেন " - এই দাবির পক্ষে বিশুদ্ধ ইতিহাস থেকে সনদ সহ পারলে প্রমান করুন তৎকালীন ইতিহাস থেকে । শিশুকামি বা পিডোফিলিয়া হল মানসিক রোগ , তথা যারা শিশুদের প্রতি যৌন তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে বুঝায় । প্রশ্নকর্তাকে প্রমান করতে বলেছি যে "নবী মুহাম্মদ (সা) আয়েশা (রা) প্রতি যৌন আসক্তি ভুগছিল" তৎকালীন বিশুদ্ধ ইতিহাস থেকে প্রমান করুন ? এখন আমরা বিশুদ্ধ ইতিহাস থেকে জানতে পারি রাসুল (সা) আয়েশা(রা) কে বিয়ে করেছিলেন এবং তাঁদের সুখের সংসার ছিল সুতরাং এর থেকে প্রমান হয় যে রাসুলের প্রতি প্রশ্ন কর্তার অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং মিথ্যাচার ।

রাসুল (সা) নাকি অল্প বয়সে বিয়ে করে অমানবিক কাজ করেছেন - নাস্তিক ধর্মের একটি কমন ফতোয়া হল "সম্মতি থাকলে" সব ! করা যাবে এখানে কেউই ফ্যাক্ট না ! এখানে তাদের আপত্তি নাই অথচ যত চুলকানি পবিত্র বিয়ে নিয়ে । নিজের পরিবার সন্তানের কল্যাণ চেয়ে, কোন ভাল খাটি চরিত্রবান পুরুষের কাছে বিয়ে দিলে এখানে আপত্তি আসার কোন সম্পর্ক নাই যদি সেই সংসার, সুখের হয় ।

দুনিয়ার কোন দেশেই মেয়েদের বিয়ের বয়স পারফেক্ট নির্ধারণ করে দেয়া হয় নাই । একেক দেশে একেক রকম বিয়ের বয়স ।
* যেমনঃ parental kidnapping in america: an historical and cultural analysis- by maureen dabbagh, page 128 এ উল্লেখ আছেঃ

উনবিনশ শতাব্দীতে বেশিরভাগ অ্যামেরিকান রাজ্যে বিয়ের বয়সের সর্ব নিন্ম বয়স ছিল ১০ বছর এবং ডেলাওয়ারে বিয়ের বয়স ছিল মেয়েদের ৭ বছর ।

* নিউইয়র্কে ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত বিয়ের বয়স ছিল ১০ বছর । ১৮৮৫ সালের পর থেকে দেশের আইন "সম্মতি আইন" পরিবর্তন হয় ১৮৮৯ সালে । Newyork এ ১৬ বছর এবং ১৮৯৫ সালে হয় ১৮ বয়স । এই পরিবর্তনের আগে সম্মতির বয়স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ স্থানে ১০ বা ১২ বছর ছিল বিয়ের বয়স ।

রেফারেন্স দেখুনঃ prostitution and sex work - by melissa hope ditmore, page: 21 {introduction}
অ্যামেরিকার সংবিধান তৈরিতে যেসব বইয়ের সাহায্য নেয়া হয়েছে তার মদ্ধে Spirit of laws বইটি অন্যতম । এই বইয়ের ১৬ খণ্ডে ২৬৪ পৃষ্ঠায় ফ্রেঞ্চ দার্শনিক Montesquew উল্লেখ করেন উষ্ণ অঞ্চলের মেয়েরা ৮,৯,১০ বছর বয়সেই বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয়ে যায় আর ২০ বছর বয়সে তাদের বিয়ের জন্য বৃদ্ধ ভাবা হয় ।

আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানো তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসার যখন ৮ বছর হয় তখন বিয়ে করেন । শেখ ফজিলাতুন্নেসার জন্ম ১৯৩০ সালে আর তার বিয়ে ১৯৩৮ সালে । দেখুনঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, by মুজিবুর রহমান ।

আম্মাজান আয়েশা (রা) নিজেই (তৎকালীন আরবের) মেয়েদের জন্য বিয়ের বয়স নির্ধারণ তথা উল্লেখ করে দিয়েছিলেন । তিনি বলেন মেয়ে যখন ৯ বছরে উপনীত হয়ে যায় তখন সে মহিলা হয়ে যায় । (তিরমিজি, কিতাবুন নিকাহ) । তাই সে সময়কার আরব মেয়েদের জন্য যে ৯ বছরে বিয়ের জন্য উপযুক্ত ছিল তার প্রমান স্বয়ং আয়েশা (রা) নিজেই । অল্প বয়সে বিয়ে তখন খুবি নরমাল ব্যাপার ছিল ।

অল্প বয়সে বিয়ে কোন ভাবেই অমানবিক না ।
* হযরত আয়েশা (রা) এর সম্মতিঃ

+ ই,ফা। বুখারি ৮ নং খণ্ড, হাদিস নং: ৪৭০৭- আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুল (সা) বলেছেন দুবার করে আমাকে সপ্নযোগে তোমাকে দেখানো হয়েছে । এক লোক রেশমি কাপড়ে জড়িয়ে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছিল । আমাকে দেখে বলল এ হল তোমার স্ত্রী । তখন আমি পর্দা খুলে দেখি, সে তুমিই । তখন আয়েশা (রা) বলেন এ সপ্ন যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় তবে তিনি তা বাস্তবে পরিনত করবেন ।

+ হাকিম, সিলসিলা আহাদিস সহিফা লি আলবানি, হাদিস নং ১১৪২ এবং পিস পাবলিকেশন এর রাসুল (সা) এর স্ত্রীগন কেমন ছিলেন, পৃষ্ঠাঃ ৩৬ । হাদিস সহিহ । আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুল (সা) বলেছেন হে আয়েশা তুমি কি এতে খুশি নও যে তুমি দুনিয়া ও আখিরাতে আমার স্ত্রী হবে ? আয়েশা (রা) বলেন কেন নয় ? তখন রাসুল সা বললেন তুমি দুনিয়া ও আখিরাতে আমার স্ত্রী ।

উদাহরনঃ ধরেন কোন এক বিদ্বেষীরা এক দম্পতির সুখের সংসার নিয়ে আদালতে মামলা করল যে এই মেয়েকে তার স্বামী অল্প বয়সে বিয়ে করেছে এবং মেয়ের পরিবার রাজি ছিল এতে আমাদের সমস্যা ! তো বিচারপতি এই অল্প বয়স্কা মেয়েকে কোর্টে জিজ্ঞাসা করল , তোমার পরিবার তোমাকে ৬ বছরে বিয়ে দিয়েছিল তোমার কি আপত্তি আছে ? তুমি কি তোমার স্বামীর সাথে অসুখী ? মেয়ে জবাব দিলঃ জজসাহেব আমার স্বামী হলেন সত্যবাদি এবং সব থেকে খাটি চরিত্রবান মানুষ তাই আমার এই বিয়ে নিয়ে কোন আপত্তি নাই বিন্দুমাত্র এবং আমার স্বামীর সাথে আমি অনেক আনন্দেই আছি আলহামদুলিল্লাহ । আমার পরিবার আমাকে বিয়ে দিয়ে ভাল কাজ করেছেন । বিচারপতি রায় দিলেনঃ তুমি তোমার সংসার নিয়ে অনেক সুখেই আছ তাই এখানে অন্যদের আপত্তি গ্রহণযোগ্য এবং অযৌক্তিক । আশা করি বুঝতে পারছেন ।

আরও মজার বিষয় হচ্ছে নাস্তিক ধর্মের আলোকেও এই বিয়েও কোন আপত্তিকর কিছুই নয় । কেন জানেন ? কারন নাস্তিক ধর্মের নৈতিকতার মানদণ্ডেও আসলে এটি কোন অভিযোগের মধ্যেই পড়ে না কারন নাস্তিক ধর্মের দেবদ্যূত ড হুমায়ূন আজাদ তার "আমার অবিশ্বাস" বইয়ের ১৪৩ পৃষ্ঠায় বলেছেনঃ নৈতিকতার সীমা হওয়া উচিৎ সংকীর্ণ । আমার কোন কাজ যেন অন্যকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে,এটুকু । নাস্তিক ধর্মের এই ফতোয়ার আলোকে কি প্রমান হয়েছে যে নবী (সা) জোর করে আয়েশা (রা) কে বিয়ে করেছেন ? উত্তর হচ্ছে না । এই বিয়ের ফলে কি কেউ বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ? উত্তর হচ্ছে না । সুতরাং যেহেতু এই বিয়ের ফলে কেউই কোন ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি তাই নাস্তিক ধর্মের নৈতিকতার মানদণ্ডে এই বিয়ে আসলে কোন আপত্তিকর অথবা অভিযোগ হিসেবে গণ্য করার কিছুই নেই এবং নাস্তিক ধর্মের আলোকেও এই বিয়ে সম্পূর্ণ জায়েজ প্রমাণিত ।   

প্রশ্নঃ 

* আয়েশা (রা) কি এই বিয়েতে অখুশি ছিলেন ?

* তিনি কি তাঁর স্বামীকে ভালবাসতেন না ?

* অল্প বয়সে বিয়ে করার দরুন তাঁর কি বিন্দুমাত্র কোন ক্ষতি হয়েছে ?

* ফলাফল কি ভাল নাকি খারাপ হয়েছিল এই বিয়েতে ?

* কেউ যদি তাঁর সংসার এবং স্বামী নিয়ে খুশি এবং সুখি হয় এতে আপনার কি অধিকার আছে এখানে আপত্তি করার ?

নবী মুহাম্মদ (সা) শিশুকামি ছিলেন ইসলামিক বিশ্লেষণঃ


প্রশ্নঃ নবী মুহাম্মদ (সা) শিশুকামি ছিলেন তাই তিনি আয়েশা (রা)কে শিশু অবস্থায় বিয়ে করে ? ৬ বছরের বিয়ে অমানবিক ?
লিখেছেনঃ এম ডি আলী

উত্তরঃ "নবী মুহাম্মদ (সা) শিশুকামি ছিলেন " - এই দাবির পক্ষে বিশুদ্ধ ইতিহাস থেকে সনদ সহ পারলে প্রমান করুন তৎকালীন ইতিহাস থেকে । শিশুকামি বা পিডোফিলিয়া হল মানসিক রোগ , তথা যারা শিশুদের প্রতি যৌন তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে বুঝায় । প্রশ্নকর্তাকে প্রমান করতে বলেছি যে "নবী মুহাম্মদ (সা) আয়েশা (রা) প্রতি যৌন আসক্তি ভুগছিল" তৎকালীন বিশুদ্ধ ইতিহাস থেকে প্রমান করুন ? এখন আমরা বিশুদ্ধ ইতিহাস থেকে জানতে পারি রাসুল (সা) আয়েশা(রা) কে বিয়ে করেছিলেন এবং তাঁদের সুখের সংসার ছিল সুতরাং এর থেকে প্রমান হয় যে রাসুলের প্রতি প্রশ্ন কর্তার অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং মিথ্যাচার ।

রাসুল (সা) নাকি অল্প বয়সে বিয়ে করে অমানবিক কাজ করেছেন - নাস্তিক ধর্মের একটি কমন ফতোয়া হল "সম্মতি থাকলে" সব ! করা যাবে এখানে কেউই ফ্যাক্ট না ! এখানে তাদের আপত্তি নাই অথচ যত চুলকানি পবিত্র বিয়ে নিয়ে । নিজের পরিবার সন্তানের কল্যাণ চেয়ে, কোন ভাল খাটি চরিত্রবান পুরুষের কাছে বিয়ে দিলে এখানে আপত্তি আসার কোন সম্পর্ক নাই যদি সেই সংসার, সুখের হয় ।

দুনিয়ার কোন দেশেই মেয়েদের বিয়ের বয়স পারফেক্ট নির্ধারণ করে দেয়া হয় নাই । একেক দেশে একেক রকম বিয়ের বয়স ।
* যেমনঃ parental kidnapping in america: an historical and cultural analysis- by maureen dabbagh, page 128 এ উল্লেখ আছেঃ

উনবিনশ শতাব্দীতে বেশিরভাগ অ্যামেরিকান রাজ্যে বিয়ের বয়সের সর্ব নিন্ম বয়স ছিল ১০ বছর এবং ডেলাওয়ারে বিয়ের বয়স ছিল মেয়েদের ৭ বছর ।

* নিউইয়র্কে ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত বিয়ের বয়স ছিল ১০ বছর । ১৮৮৫ সালের পর থেকে দেশের আইন "সম্মতি আইন" পরিবর্তন হয় ১৮৮৯ সালে । Newyork এ ১৬ বছর এবং ১৮৯৫ সালে হয় ১৮ বয়স । এই পরিবর্তনের আগে সম্মতির বয়স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ স্থানে ১০ বা ১২ বছর ছিল বিয়ের বয়স ।

রেফারেন্স দেখুনঃ prostitution and sex work - by melissa hope ditmore, page: 21 {introduction}
অ্যামেরিকার সংবিধান তৈরিতে যেসব বইয়ের সাহায্য নেয়া হয়েছে তার মদ্ধে Spirit of laws বইটি অন্যতম । এই বইয়ের ১৬ খণ্ডে ২৬৪ পৃষ্ঠায় ফ্রেঞ্চ দার্শনিক Montesquew উল্লেখ করেন উষ্ণ অঞ্চলের মেয়েরা ৮,৯,১০ বছর বয়সেই বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয়ে যায় আর ২০ বছর বয়সে তাদের বিয়ের জন্য বৃদ্ধ ভাবা হয় ।

আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানো তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসার যখন ৮ বছর হয় তখন বিয়ে করেন । শেখ ফজিলাতুন্নেসার জন্ম ১৯৩০ সালে আর তার বিয়ে ১৯৩৮ সালে । দেখুনঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, by মুজিবুর রহমান ।

আম্মাজান আয়েশা (রা) নিজেই (তৎকালীন আরবের) মেয়েদের জন্য বিয়ের বয়স নির্ধারণ তথা উল্লেখ করে দিয়েছিলেন । তিনি বলেন মেয়ে যখন ৯ বছরে উপনীত হয়ে যায় তখন সে মহিলা হয়ে যায় । (তিরমিজি, কিতাবুন নিকাহ) । তাই সে সময়কার আরব মেয়েদের জন্য যে ৯ বছরে বিয়ের জন্য উপযুক্ত ছিল তার প্রমান স্বয়ং আয়েশা (রা) নিজেই । অল্প বয়সে বিয়ে তখন খুবি নরমাল ব্যাপার ছিল ।

অল্প বয়সে বিয়ে কোন ভাবেই অমানবিক না ।
* হযরত আয়েশা (রা) এর সম্মতিঃ

+ ই,ফা। বুখারি ৮ নং খণ্ড, হাদিস নং: ৪৭০৭- আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুল (সা) বলেছেন দুবার করে আমাকে সপ্নযোগে তোমাকে দেখানো হয়েছে । এক লোক রেশমি কাপড়ে জড়িয়ে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছিল । আমাকে দেখে বলল এ হল তোমার স্ত্রী । তখন আমি পর্দা খুলে দেখি, সে তুমিই । তখন আয়েশা (রা) বলেন এ সপ্ন যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় তবে তিনি তা বাস্তবে পরিনত করবেন ।

+ হাকিম, সিলসিলা আহাদিস সহিফা লি আলবানি, হাদিস নং ১১৪২ এবং পিস পাবলিকেশন এর রাসুল (সা) এর স্ত্রীগন কেমন ছিলেন, পৃষ্ঠাঃ ৩৬ । হাদিস সহিহ । আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুল (সা) বলেছেন হে আয়েশা তুমি কি এতে খুশি নও যে তুমি দুনিয়া ও আখিরাতে আমার স্ত্রী হবে ? আয়েশা (রা) বলেন কেন নয় ? তখন রাসুল সা বললেন তুমি দুনিয়া ও আখিরাতে আমার স্ত্রী ।

উদাহরনঃ ধরেন কোন এক বিদ্বেষীরা এক দম্পতির সুখের সংসার নিয়ে আদালতে মামলা করল যে এই মেয়েকে তার স্বামী অল্প বয়সে বিয়ে করেছে এবং মেয়ের পরিবার রাজি ছিল এতে আমাদের সমস্যা ! তো বিচারপতি এই অল্প বয়স্কা মেয়েকে কোর্টে জিজ্ঞাসা করল , তোমার পরিবার তোমাকে ৬ বছরে বিয়ে দিয়েছিল তোমার কি আপত্তি আছে ? তুমি কি তোমার স্বামীর সাথে অসুখী ? মেয়ে জবাব দিলঃ জজসাহেব আমার স্বামী হলেন সত্যবাদি এবং সব থেকে খাটি চরিত্রবান মানুষ তাই আমার এই বিয়ে নিয়ে কোন আপত্তি নাই বিন্দুমাত্র এবং আমার স্বামীর সাথে আমি অনেক আনন্দেই আছি আলহামদুলিল্লাহ । আমার পরিবার আমাকে বিয়ে দিয়ে ভাল কাজ করেছেন । বিচারপতি রায় দিলেনঃ তুমি তোমার সংসার নিয়ে অনেক সুখেই আছ তাই এখানে অন্যদের আপত্তি গ্রহণযোগ্য এবং অযৌক্তিক । আশা করি বুঝতে পারছেন ।

আরও মজার বিষয় হচ্ছে নাস্তিক ধর্মের আলোকেও এই বিয়েও কোন আপত্তিকর কিছুই নয় । কেন জানেন ? কারন নাস্তিক ধর্মের নৈতিকতার মানদণ্ডেও আসলে এটি কোন অভিযোগের মধ্যেই পড়ে না কারন নাস্তিক ধর্মের দেবদ্যূত ড হুমায়ূন আজাদ তার "আমার অবিশ্বাস" বইয়ের ১৪৩ পৃষ্ঠায় বলেছেনঃ নৈতিকতার সীমা হওয়া উচিৎ সংকীর্ণ । আমার কোন কাজ যেন অন্যকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে,এটুকু । নাস্তিক ধর্মের এই ফতোয়ার আলোকে কি প্রমান হয়েছে যে নবী (সা) জোর করে আয়েশা (রা) কে বিয়ে করেছেন ? উত্তর হচ্ছে না । এই বিয়ের ফলে কি কেউ বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ? উত্তর হচ্ছে না । সুতরাং যেহেতু এই বিয়ের ফলে কেউই কোন ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি তাই নাস্তিক ধর্মের নৈতিকতার মানদণ্ডে এই বিয়ে আসলে কোন আপত্তিকর অথবা অভিযোগ হিসেবে গণ্য করার কিছুই নেই এবং নাস্তিক ধর্মের আলোকেও এই বিয়ে সম্পূর্ণ জায়েজ প্রমাণিত ।   

প্রশ্নঃ 

* আয়েশা (রা) কি এই বিয়েতে অখুশি ছিলেন ?

* তিনি কি তাঁর স্বামীকে ভালবাসতেন না ?

* অল্প বয়সে বিয়ে করার দরুন তাঁর কি বিন্দুমাত্র কোন ক্ষতি হয়েছে ?

* ফলাফল কি ভাল নাকি খারাপ হয়েছিল এই বিয়েতে ?

* কেউ যদি তাঁর সংসার এবং স্বামী নিয়ে খুশি এবং সুখি হয় এতে আপনার কি অধিকার আছে এখানে আপত্তি করার ?

Posted at June 04, 2019 |  by Arya ঋষি

0 Comments:


—॰ ইফকের ঘটনা ॰—

আবদুল আযীয ইবনে আবদুল্লাহ রহ………..উরওয়া ইবনে যুবাইর, সাঈদ ইবনে মুসায়্যিব, আলকামা ইবনে ওয়াক্কাস ও উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবা ইবনে মাসউদ রা. সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিণী আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, যখন অপবাদ রটনাকারীগণ তাঁর প্রতি অপবাদ রটিয়েছিল রাবী যুহরী রহ. বলেন, তারা প্রত্যেকেই হাদীসটির অংশবিশেষ আমার কাছে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি স্মরণ রাখা ও সঠিকভাবে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে তাদের কেউ কেউ একে অন্যের চেয়ে অধিকতর অগ্রগামী ও নির্ভরযোগ্য। আয়েশা রা. সম্পর্কে তারা আমার কাছে যা বর্ণনা করেছেন আমি তাদের প্রত্যেকের কথাই যথাযথভাবে স্মরণ রেখেছি। তাদের একজনের বর্ণিত হাদীসের অংশবিশেষ অপরের বর্ণিত হাদীসের অংশবিশেষের সত্যতা প্রমাণ করে। যদিও তাদের একজন অন্যজনের চেয়ে অধিক স্মৃতিশক্তির অধিকারী। রাবীগণ বলেন:

আয়েশা রা. বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সফরের ইচ্ছা করতেন তখন তিনি তাঁর স্ত্রীগণের (নামের জন্য) কোরা ব্যবহার করতেন। এতে যার নাম আসত তাকেই তিনি সাথে করে সফরে বের হতেন। আয়েশা রা. বলেন, এমনি এক যুদ্ধে (মুরায়সীর যুদ্ধ) তিনি আমাদের মাঝে কোরা ব্যবহার করেন, এতে আমার নাম বেরিয়ে আসে। তাই আমিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সফরে বের হলাম। এ ঘটনাটি পর্দার হুকুম নাযিল হওয়ার পর সংঘটিত হয়েছিল। তখন আমাকে হাওদাজ সহ সাওয়ারীতে উটানো ও নামানো হত। এমনি করে আমরা চলতে থাকলাম। অবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ যুদ্ধ থেকে অবসর হলেন, তখন তিনি (বাড়ির দিকে) ফিরলেন। ফেরার পথে আমরা মদীনার নিকটবর্তী হলে তিনি একদিন রাতের বেলা রওয়ানা হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। রওয়ানা হওয়ার ঘোষণার পর আমি উঠলাম এবং (প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য) পায়ে হেটে সেনাছাউনী অতিক্রম করে (একটু সামনে) গেলাম। এরপর প্রয়োজন সেরে আমি আমার সাওয়ারীর কাছে ফিরে এসে বুকে হাত দিয়ে দেখলাম যে, (ইয়ামানের অন্তর্গত) যিফার শহরের পুতি দ্বারা তৈরী করা আমার গলার হারটি ছিড়ে কোথায় পড়ে গিয়েছে। তাই আমি ফিরে গিয়ে আমার হারটি তালাশ করতে আরম্ভ করলাম। হার তালাশ করতে করতে আমার আসতে বিলম্ব হয়ে যায়।

আয়েশা রা. বলেন, যে সমস্ত লোক উটের পিঠে আমাকে উঠিয়ে দিতেন তারা এসে আমার হাওদাজ উঠিয়ে তা আমার উটের পিঠে তুলে দিলেন, যার উপর আরোহণ করতাম। তারা মনে করেছিলেন যে, আমি এর মধ্যে আছি, কারণ খাদ্যভাবে মহিলাগণ তখন খুবই হালকা পাতলা হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের দেহ মাংসল ছিলনা। তাঁরা খুবই স্বল্প পরিমাণ খানা খেতে পেত। তাই তারা যখন হাওদাজ উঠিয়ে উপরে রাখেন তখন তখন তা হালকা হওয়ার বিষয়টিকে কোন প্রকার অস্বাভাবিক মনে করেননি। অধিকন্তু আমি ছিলাম একজন অল্প বয়স্কা কিশোরী। এরপর তারা উট হাঁকিয়ে নিয়ে চলে যায়। সৈন্যদল রওয়ানা হওয়ার পর আমি আমার হারটি খুঁজে পাই এবং নিজস্ব স্থানে ফিরে এসে দেখি তাদের (সৈন্যদল) কোন আহবায়ক এবং কোন উত্তরদাতা তথায় নেই। ( নিরুপায় হয়ে) তখন আমি পূর্বে যেখানে ছিলাম সেখানে বসে রইলাম। ভাবছিলাম, তাঁরা আমাকে দেখতে না পেলে অবশ্যই আমার কাছে ফিরে আসবে। ঐ স্থানে বসে থাকা অবস্থায় ঘুম চেপে আসলে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। বানূ সুলামী গোত্রের যাকওয়ান শাখার সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল রা. (যাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফেলে যাওয়া আসবাবপত্র কুড়িয়ে নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন) সৈন্যদল চলে যাওয়ার পর সেখানে ছিলেন। তিনি প্রত্যুষে আমার অবস্থানস্থলের কাছে পৌঁছে একজন ঘুমন্ত মানুষ দেখে আমার দিকে তাকানোর পর আমাকে চিলে ফেললেন। তিনি আমাকে দেখেছিলে পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বে। তিনি আমাকে চিনতে পেরে ‘ইন্না লিল্লাহহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন’ পড়লে আমি তা শুনতে পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম এবং চাদর টেনে আমার চেহারা ঢেকে ফেললাম। আল্লাহর কসম, আমি কোন কথা বলিনি এবং তাঁর থেকে ইন্না লিল্লাহ……..পাঠ ছাড়া আর কোন কথাই শুনতে পাইনি। এরপর তিনি সাওয়ারী থেকে অবতরণ করলেন এবং সাওয়ারীকে বসিয়ে তার সামনের পা নিচু করে দিলে আমি গিয়ে তাতে আরোহণ করলাম। পরে তিনি আমাকেসহ সাওয়ারীকে টেনে আগে আগে চলতে লাগলেন, পরিশেষে ঠিক দ্বিপ্রহরে প্রচণ্ড গরমের সময় আমরা গিয়ে সেনাদলের সাথে মিলিত হলাম। সে সময় তাঁরা একটি জায়গায় অবতরণ করছিলেন।

আয়েশা রা. বলেন, এরপর যাদের ধ্বংস হওয়ার ছিল তারা (আমার প্রতি অপবাদ আরোপ করে) ধ্বংস হয়ে গেল। তাদের মধ্যে এ অপবাদ আরোপের ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল সে হচ্ছে আবদুল্লাহ ইবনে উবায় ইবনে সুলুল। রাবী উরওয়া রা. বলেন, আমি জানতে পেরেছি যে, তার সামনে অপবাদের কথাগুলো প্রচার করা হত এবং আলোচনা করা হত আর অমনি সে এগুলোকে বিশ্বাস করত, খুব ভালভাবে শ্রবণ করত এবং শোনা কথার ভিত্তিতেই বিষয়টিকে প্রমাণ করার চেষ্টা করত।

উরওয়া রা. আরো বর্ণনা করেছন যে, অপবাদ আরোপকারী ব্যক্তিদের মধ্যে হাসসান ইবনে সাবিত, মিসতাহ ইবনে উসাসা এবং হামনা বিনতে জাহাশ রা. ব্যতীত আরো কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। তারা গুটিকয়েক ব্যক্তির একটি দল ছিল, এতটুক ব্যতীত তাদের সম্পর্কে আমার আর কিছু জানা নেই। যেমন (আল কুরআনে) মহান আল্লাহ পাক বলেছেন, এ ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তাকে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বিন সুলুল বলে ডাকা হয়ে থাকে। বর্ণনাকারী উরওয়া রা. বলেন, আয়েশা রা.-এর এ ব্যাপারে হাসসান ইবনে সাবিত রা.-কে গালমন্দ করাকে পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, হাসসান ইবনে সাবিত রা. তো ঐ ব্যক্তি যিনি তার এক কবিতায় বলেছেন, আমার মান সম্মান এবং আমার বাপ দাদা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মান সম্মান রক্ষায় নিবেদিত।

আয়েশা রা. বলেন, এরপর আমরা মদীনায় আসলাম। মদীনায় আগমন করার পর এক মাস পর্যন্ত আমি অসুস্থ থাকলাম। এদিকে অপবাদ রটনাকরীদের কথা নিয়ে লোকদের মধ্যে আলোচনা ও চর্চা হতে লাগল। কিন্তু এসবের কিছুই আমি জানি না। তবে আমার সন্দেহ হচ্ছিল এবং তা আরো দৃঢ় হচ্ছিল আমার এ অসুখের সময়। কেননা এর পূর্বে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যেরূপ স্নেহ-ভালবাসা লাভ করতাম আমার এ অসুখের সময় তা আমি পাচ্ছিলাম না। তিনি আমার কাছে এসে সালাম করে কেবল ‘তুমি কেমন আছ’ জিজ্ঞাসা করে চলে যেতেন। তাঁর এ আচরণই আমার মনে চরম সন্দেহের উদ্রেক করে। তবে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাইরে বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ জঘন্য অপবাদ সম্বন্ধে আমি কিছুই জানতাম না। উম্মে মিসতাহ রা. একদা আমার সাথে পায়খানার দিকে বের হন। আর প্রকৃতির ডাকে আমাদের বের হওয়ার অবস্থা এই ছিল যে, এক রাতে বের হলে আমরা আবার পরের রাতে বের হতাম। এ ছিল আমাদের ঘরের পার্শ্বে পায়খানা তৈরী করার পূর্বের ঘটনা। আমাদের অবস্থা প্রাচীন আরবীয় লোকদের অবস্থার মত ছিল। তাদের মত আমরাও পায়খানা করার জন্য ঝোঁপঝাড়ে চলে যেতাম। এমনকি বাড়ির পার্শ্বে পায়খান তৈরী করলে আমরা খুব কষ্ট পেতাম। আয়েশা রা. বলেন, একদা আমি এবং উম্মে মিসতাহ “যিনি ছিলেন আবু রূহম ইবনে মুত্তালিব ইবনে আবদে মানাফের কন্যা, যার মা সাখার ইবনে আমির-এর কন্যা ও আবু বকর রা. সিদ্দীকের খালা এবং মিসতাহ ইবনে উসাসা ইবনে আব্বাদ ইবনে মুত্তালিব যার” একত্রে বের হলাম। আমরা আমাদের কাজ থেকে ফারিগ হওয়ার পর বাড়ি ফেরার পথে উম্মে মিসতাহ তার কাপড়ে জাড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে বললেন, মিসতাহ ধ্বংস হোক। আমি তাকে বললাম, আপনি খুব খারাপ কথা বলছেন। আপনি কি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকে গালি দিচ্ছেন? তিনি আমাকে বললেন, ওগো অবলা, সে তোমার সম্পর্কে কি বলে বেড়াচ্ছে তুমি তো তা শোননি। আয়েশা রা. বলেন, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে আমার সম্পর্কে কি বলছে? তখন তিনি অপবাদ রটনাকরীদের কথাবার্তা সম্পর্কে আমাকে জানালেন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, এরপর আমার পুরানো রোগ আরো বেড়ে গেল। আমি বাড়ি ফেরার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে আসলেন এবং সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কেমন আছ? আয়েশা রা. বলেন, আমি আমার পিতা-মাতার কাছে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক খবর জানতে চাচ্ছিলাম, তাই আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললাম, আপনি কি আমাকে আমার পিতা-মাতার কাছে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেবেন? আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমকে অনুমতি দিলেন। তখন (বাড়িতে গিয়ে) আমি আমার আম্মাকে বললাম, আম্মাজান, লোকজন কি আলোচনা করছে? তিনি বললেন, বেটী ও বিষয়টিকে হালকা করে ফেল। আল্লাহর কসম, সতীন আছে এমন স্বামী সোহাগিনী সুন্দরী রমণীকে তাঁর সতীনরা বদনাম করবে না, এমন খুব কমই হয়ে থাকে।

আয়েশা রা. বলেন, আমি বিস্ময়ের সাথে বললাম, সুবহানাল্লাহ । লোকজন কি এমন গুজবই রটিয়েছে। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, রাতভর আমি কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে ভোর হয়ে গেল। এর মধ্যে আমার অশ্রুও বন্ধ হল না এবং আমি ঘুমাতেও পারলাম না। এরপর ভোরবেলাও আমি কাঁদছিলাম। তিনি আরো বলেন যে, এ সময ওহী নাযিল হতে বিলম্ব হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রীর (আমার) বিচ্ছেদের বিষয়টি সম্পর্কে পরামর্শ ও আলোচনা করার নিমিত্তে আলী ইবনে আবু তালিব এবং উসামা ইবনে যায়েদ রা.-কে ডেকে পাঠালেন। আয়েশা রা. বলেন, উসামা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীদের পবিত্রতা এবং তাদের প্রতি (নবীজীর) ভালবাসার কারণে বললেন, (হে আল্লাহর রাসূল) তাঁরা আপনার স্ত্রী, তাদের সম্পর্কে আমি ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না। আর আলী রা. বললেন, হে আল্লাহ রাসূল, আল্লাহ তো আপনার জন্য সংকীর্ণতা রাখেননি। তাকে (আয়েশা) ব্যতীত আরো বহু মহিলা রয়েছে। তবে আপনি এ ব্যাপারে দাসী (বারীরা রা.) কে জিজ্ঞাসা করুন। সে আপনার কাছে সত্য কথাই বলবে। আয়েশা রা. বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারীরা রা.-কে ডেকে বললেন, হে বারীরা তুমি তাঁর মধ্যে কোন সন্দেহমূলক আচরণ দেখেছ কি? বারীরা রা. তাকে বললেন, সেই আল্লাহর শপথ যিনি আপনাকে সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন আমি তার মধ্যে কখনো এমন কিছু দেখিনি যার দ্বারা তাকে দোষী বলা যায়। তবে তাঁর ব্যাপারে শুধু এতটুকু বলা যায় যে, তিনি হলেন অল্প বয়স্কা যুবতী, রুটি তৈরী করার জন্য আটা খামির করে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। আর বকরী এসে অমনি তা খেয়ে ফেলে।

আয়েশা রা .বলেন, (এ কথা শুনে) সেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে সাথে উঠে গিয়ে মিম্বরে বসে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই-এর ক্ষতি থেকে রক্ষার আহবান জানিয়ে বললেন, হে মুসলিম সম্প্রদায়, যে আমার স্ত্রীর ব্যাপারে অপবাদ ও বদনাম রটিয়ে আমাকে কষ্ট দিয়েছে তার এ অপবাদ থেকে আমাকে কে মুক্ত করবে? আল্লাহর কসম, আমি আমার স্ত্রী সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানিনা। আর তাঁরা (অপবাদ রটনাকারীরা) এমন এক ব্যক্তির (সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল) নাম উল্লেখ করছে যার সম্বন্ধেও আমি ভাল ছাড়া কিছু জানি না। সে তো আমর সাথেই আমার ঘরে যায়। আয়েশা রা. বলেন, (এ কথা শুনে) বনী আবদুল আশহাল গোত্রের সাদ (ইবনে মুআয) রা. উঠে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি আপনাকে এ অপবাদ থেকে মুক্তি দেব। সে যদি আউস গোত্রের লোক হয় তা হলে তার শিরচ্ছেদ করব। আর যদি সে আমাদের ভাই খাযরাজের লোক হয় তাহলে তার ব্যাপারে আপনি যা বলবেন তাই পালন করব। আয়েশা রা. বলেন, এ সময় হাসসান ইবনে সাবিত রা.-এর মায়ের চাচাতো ভাই খাযরাজ গোত্রের সর্দার সাঈদ ইবনে উবাদা রা. দাঁড়িয়ে এ কথার প্রতিবাদ করলেন। আয়েশা রা. বলেন, এ ঘটনার পূর্বে তিনি একজন সৎ ও নেককার লোক ছিলেন। কিন্তু (এ সময়) গোত্রীয় অহমিকায় উত্তেজিত হয়ে তিনি সাদ ইবনে মুআয রা.-কে বললেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। আল্লাহর কসম, তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না এবং তাকে হত্যা করার ক্ষমতাও তোমার নেই। যদিসে তোমার গোত্রের লোক হত তাহলে তুমি তার হত্যা হওয়া কখনো পছন্দ করতে না। তখন সাদ ইবনে মুআয রা.-এর চাচাতো ভাই উসাইদ ইবনে হুযাইর রা. সাদ ইবনে ওবায়দা রা.-কে বললেন, বরং তুমি মিথ্যা কথা বললে। আল্লাহর কসম, আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করব। তুমি হলে মুনাফিক। তাই মুনাফিকদের পক্ষ অবলম্বন করে কথাবার্তা বলছ।

আয়েশা রা. বলেন, এ সময় আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্র খুব উত্তেজিত হয়ে উঠে। এমনকি তারা যুদ্ধের সংকল্প পর্যন্ত করে বসে। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থামিয়ে শান্ত করলেন এবং নিজেও চুপ হয়ে গেলেন। আয়েশা রা. বলেন, আমি সেদিন সারাক্ষণ কেঁদে কাটালাম। অশ্রুঝরা আমার বন্ধ হয়নি এবং একটু ঘুমও আমার আসেনি। তিনি বলেন, আমি ক্রন্দনরত ছিলাম আর আমার পিতা-মাতা আমার পার্শ্বে বসা ছিলেন। এমনি করে একদিন দুই রাত কেঁদে কেঁদে কাটিয়ে দিই। এর মাঝে আমার কোন ঘুম আসেনি। বরং অবারিত ধারায় আমার চোখ থেকে অশ্রুপাত হতে থাকে। মনে হচ্ছিল যেন, কান্নার ফলে আমার কলিজা ফেটে যাবে। আমি ক্রন্দনরত ছিলাম আর আমার আব্বা-আম্মা আমার পাশে বসা ছিলেন। এমতাবস্থায় একজন আনসারী মহিলা আমার কাছে আসার অনুমতি চাইলে আমি তাকে আসার অনুমতি দিলাম। সে এসে বসল এবং আমার সাথে কাঁদতে আরম্ভ করল। তিনি বলেন, আমরা ক্রন্দনরত ছিলাম ঠিক এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে এসে সালাম করলেন এবং আমাদের পাশে বসে গেলেন। আয়েশা রা. বলেন, অপবাদ রটানোর পর আমার কাছে এসে এভাবে তিনি আর কখনো বসেননি। এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ একমাস কাল অপেক্ষা করার পরও আমার বিষয়ে তাঁর নিকট কোন ওহী আসেনি।

আয়েশা রা. বলেন, বসার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালিমা শাহাদাত পড়লেন। এরপর বললেন, যা হোক, আয়েশা তোমার সম্বন্ধে আমার কাছে অনেক কথাই পৌঁছেছে, যদি তুমি এর থেকে মুক্ত হও তাহলে শীঘ্রই আল্লাহ তোমাকে এ অপবাদ থেকে মুক্ত করে দেবেন। আর যদি তুমি কোন গুনাহ করে থাক তাহলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাওবা কর। কেননা বান্দা গুনাহ স্বীকার করে তাওবা করলে আল্লাহ তায়ালা তাওবা কবূল করেন। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা বলে শেষ করলে আমার অশ্রুপাত বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি এক ফোটা অশ্রুও আমি আর অনুভব করলাম না। তখন আমি আমার আব্বাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলছেন আমার পক্ষ হতে আপনি তার জবাব দিন। আমার আব্বা বললেন, আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কি জবাব দিব আমি তা জানিনা। তখন আমি আমার আম্মাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন, আপনি তার জবাব দিন। আম্মা বললেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কি জবাব দিব আমি তা জানি না। তখন আমি ছিলাম অল্প বয়স্কা কিশোরী। কুরআনও বেশি পড়তে পারতাম না। তথাপিও এ অবস্থা দেখে নিজেই বললাম, আমি জানি আপনারা এ অপবাদের ঘটনা শুনেছেন, আপনারা তা বিশ্বাস করেছেন এবং বিষয়টি আপনাদের মনে সুদৃঢ় হয়ে আছে। এখন যদি আমি বলি যে, এর থেকে আমি পবিত্র এবং আমি নিষ্কলুষ তাহলে আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন না। আর যদি আমি এ অপরাধের কথা স্বীকার করে নেই যা সম্পর্কে আল্লাহ জানেন যে, আমি এর থেকে পবিত্র তাহলে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন। আল্লাহর কসম, আমি ও আপনারা যে অবস্থায় শিকার হয়েছি এর জন্য (নবী) ইউসুফ আ.-এর পিতার কথা উদাহরণ ব্যতীত আমি কোন উদাহরণ খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি বলেছিলেন: “সুতরাং পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছ সে বিষয়ে আল্লাহই একমাত্র আমার আশ্রয়স্থল” এরপর আমি মুখ ফিরিয়ে আমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আল্লাহ তায়ালা জানেন যে, সে মুহূর্তেও আমি পবিত্র। অবশ্যই আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন। (একথার প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল) তবে আল্লাহর কসম,আমি কখনো ধারণা করিনি যে, আমার ব্যাপারে আল্লাহর ওহী নাযিল করবেন যা পঠিত হবে। আমার ব্যাপারে আল্লাহ কোন কথা বলবেন আমি নিজেকে এতখানি যোগ্য মনে করিনি বরং আমি নিজেকে এর চেয়ে অধিক অযোগ্য বলে মনে করতাম। তবে আমি আশা করাতাম যে, হয়তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এমন স্বপ্ন দেখানো হবে যার দ্বারা আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনো তাঁর বসার জায়গা ছাড়েননি এবং ঘরের লোকদের থেকেও কেউ ঘর থেকে বাইরে যাননি। এমতাবস্থায় তাঁর উপর ওহী নাযিল হতে শুরু হল। ওহী নাযিল হওয়ার সময় তাঁর যে বিশেষ কষ্ট হত তখনও সে অবস্থা তাঁর হল। এমনকি প্রচণ্ড শীতের দিনেও তাঁর দেহ থেকে মোতির দানার মত বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়ত ঐ বাণীর গুরুভাবের কারণে, যা তাঁর প্রতি নাযিল করা হয়েছে। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ অবস্থা দূরীভূত হলে তিনি হাসিমুখে প্রথমে যে কথাটি বললেন, তা হল, হে আয়েশা ! আল্লাহ তোমার পবিত্রতা জাহির করে দিয়েছেন। আয়েশা রা. বলেন, এ কথা শুনে আমার আম্মা আমাকে বললেন, তুমি উঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর। আমি বললাম, আল্লাহর কসম আমি এখন তাঁর দিকে উঠে যাব না। মহান আল্লাহ ব্যতীত আমি কারো প্রশংসা করব না। আয়েশা রা বললেন, আল্লাহ (আমার পবিত্রতা ঘোষণা করে) যে দশটি আয়াত নাযিল করেছেন, তা হল এই : “যারা এ অপবাদ রটনা করেছে (তারা তো তোমাদেরই একটি দল; এ ঘটনাকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না; বরং এও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য আছে তাদের কৃত পাপকর্মের ফল এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে তার জন্য আছ কঠিন শাস্তি। এ কথা শোনার পর মুমিন পুরুষ এবং নারীগণ কেন নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারণা করেনি এবং বলেনি, এটা তো সুষ্পষ্ট অপবাদ। তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি? যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সেহেতু তারা আল্লাহর বিধানে মিথ্যাবাদী। দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমরা যাতে লিপ্ত ছিলে তার জন্য কঠিন শাস্তি তোমাদেরকে স্পর্শ করত। যখন তোমরা মুখে মুখে এ মিথ্যা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিলনা এবং একে তোমরা তুচ্ছ ব্যাপার বলে ভাবছিলে, অথচ আল্লাহর কাছে তা ছিল খুবই গুরুতর ব্যাপার। আল্লাহ পবিত্র, মহান! এ তো এক গুরুতর অপনাদ। আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক তাহলে কখনো অনুরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি করবে না, আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বিবৃত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। যারা মুনিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতের মর্মন্তুদ শাস্তি। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউই অব্যাহতি পেতে না। আল্লাহ দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। (২৪ : ১১-২০) এরপর আমার পবিত্রতা ঘোষণা করে আল্লাহ এ আয়াতগুলো নাযিল করলেন।

আত্মীয়তা এবং দারিদ্রের কারণে আবু বকর সিদ্দীক রা. মিসতাহ ইবনে উসাসাকে আর্থিক ও বৈষয়িক সাহায্য করতেন। কিন্তু আয়েশা রা. সম্পর্কে তিনি যে অপবাদ রটিয়েছিলেন এ কারণে আবু বকর সিদ্দীক রা কসম করে বললেন, আমি আর কখনো মিসতাহকে আর্থিক কোন সাহায্য করব না। তখন আল্লাহ তায়ালা নাযিল করলে, তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ গ্রহণ করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজন ও অভাবগ্রস্তকে এবং আল্লাহর রাস্তায় যারা গৃহত্যাগ করেছে তাদেরকে কিছুই দিবে না। তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে এবং তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। শোন! তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (২৪: ২২) (এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর) আবু বকর সিদ্দীক রা. বলে উঠলেন হ্যাঁ, আল্লাহর কসম অবশ্যই আমি পছন্দ করি যে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিন। এরপর তিনি মিসতাহ রা.-এর জন্য যে অর্থ খরচ করতেন তা পুন: দিতে শুরু করলেন এবং বললেন, আল্লাহর কসম, আমি তাকে এ অর্থ দেওয়া আর কখনো বন্ধ করব না। আয়েশা রা .বললেন, আমার এ বিষয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়নাব বিনতে জাহাশ রা.-কেও জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তিনি যায়নাব রা. -কে বলেছিলেন, তুমি আয়েশা রা. সম্পর্কে কি জান অথবা বলেছিলেন তুমি কী দেখেছ? তখন তিনি বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি আমার চোখ ও কানকে সংরক্ষণ করেছি। আল্লাহর কসম ! আমি তাঁর সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না। আয়েশ রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর স্ত্রীগণের মধ্যে তিনি আমার সমকক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। আল্লাহ তাকে আল্লাহ-ভীতির ফলে রক্ষা করেছেন। আয়েশা রা. বলেন, অথচ তাঁর বোন হামনা রা. তাঁর পক্ষ অবলম্বন করে অপবাদ রটনাকারীদের মত অপবাদ রটনা করে বেড়াচ্ছিলেন। ফলে তিনি ধ্বংসপ্রাপ্তদের সাথে ধ্বংস হয়ে গেলেন। বর্ণনাকারী ইবনে শিহাব রহ. বলেন, ঐ সমস্ত লোকের ঘটনা সম্পর্কে আমার কাছে যা পৌঁছেছে তা হল এই : উরওয়ার রা. বলেন, আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ কসম, যে ব্যক্তি সম্পর্কে অপবাদ দেওয়া হয়েছিল, তিনি এসব কথা শুনে বলতেন, আল্লাহ মহান। ঐ সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, আমি কোন স্ত্রীলোকের কাপড় খু্লেও কোনদিন দেখিনি। আয়েশা রা. বলেন, পরে তিনি আল্লাহর পথে শাহাদত লাভ করেছিলেন।

(সহীহ বুখারী, আল মাগাযী অধ্যায়, হাদীস নং ৩৮৪৬)

উৎস: আরবী বাংলা হাদীস বিশ্বকোষ

ইফকের ঘটনা


—॰ ইফকের ঘটনা ॰—

আবদুল আযীয ইবনে আবদুল্লাহ রহ………..উরওয়া ইবনে যুবাইর, সাঈদ ইবনে মুসায়্যিব, আলকামা ইবনে ওয়াক্কাস ও উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবা ইবনে মাসউদ রা. সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিণী আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, যখন অপবাদ রটনাকারীগণ তাঁর প্রতি অপবাদ রটিয়েছিল রাবী যুহরী রহ. বলেন, তারা প্রত্যেকেই হাদীসটির অংশবিশেষ আমার কাছে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি স্মরণ রাখা ও সঠিকভাবে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে তাদের কেউ কেউ একে অন্যের চেয়ে অধিকতর অগ্রগামী ও নির্ভরযোগ্য। আয়েশা রা. সম্পর্কে তারা আমার কাছে যা বর্ণনা করেছেন আমি তাদের প্রত্যেকের কথাই যথাযথভাবে স্মরণ রেখেছি। তাদের একজনের বর্ণিত হাদীসের অংশবিশেষ অপরের বর্ণিত হাদীসের অংশবিশেষের সত্যতা প্রমাণ করে। যদিও তাদের একজন অন্যজনের চেয়ে অধিক স্মৃতিশক্তির অধিকারী। রাবীগণ বলেন:

আয়েশা রা. বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সফরের ইচ্ছা করতেন তখন তিনি তাঁর স্ত্রীগণের (নামের জন্য) কোরা ব্যবহার করতেন। এতে যার নাম আসত তাকেই তিনি সাথে করে সফরে বের হতেন। আয়েশা রা. বলেন, এমনি এক যুদ্ধে (মুরায়সীর যুদ্ধ) তিনি আমাদের মাঝে কোরা ব্যবহার করেন, এতে আমার নাম বেরিয়ে আসে। তাই আমিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সফরে বের হলাম। এ ঘটনাটি পর্দার হুকুম নাযিল হওয়ার পর সংঘটিত হয়েছিল। তখন আমাকে হাওদাজ সহ সাওয়ারীতে উটানো ও নামানো হত। এমনি করে আমরা চলতে থাকলাম। অবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ যুদ্ধ থেকে অবসর হলেন, তখন তিনি (বাড়ির দিকে) ফিরলেন। ফেরার পথে আমরা মদীনার নিকটবর্তী হলে তিনি একদিন রাতের বেলা রওয়ানা হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। রওয়ানা হওয়ার ঘোষণার পর আমি উঠলাম এবং (প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য) পায়ে হেটে সেনাছাউনী অতিক্রম করে (একটু সামনে) গেলাম। এরপর প্রয়োজন সেরে আমি আমার সাওয়ারীর কাছে ফিরে এসে বুকে হাত দিয়ে দেখলাম যে, (ইয়ামানের অন্তর্গত) যিফার শহরের পুতি দ্বারা তৈরী করা আমার গলার হারটি ছিড়ে কোথায় পড়ে গিয়েছে। তাই আমি ফিরে গিয়ে আমার হারটি তালাশ করতে আরম্ভ করলাম। হার তালাশ করতে করতে আমার আসতে বিলম্ব হয়ে যায়।

আয়েশা রা. বলেন, যে সমস্ত লোক উটের পিঠে আমাকে উঠিয়ে দিতেন তারা এসে আমার হাওদাজ উঠিয়ে তা আমার উটের পিঠে তুলে দিলেন, যার উপর আরোহণ করতাম। তারা মনে করেছিলেন যে, আমি এর মধ্যে আছি, কারণ খাদ্যভাবে মহিলাগণ তখন খুবই হালকা পাতলা হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের দেহ মাংসল ছিলনা। তাঁরা খুবই স্বল্প পরিমাণ খানা খেতে পেত। তাই তারা যখন হাওদাজ উঠিয়ে উপরে রাখেন তখন তখন তা হালকা হওয়ার বিষয়টিকে কোন প্রকার অস্বাভাবিক মনে করেননি। অধিকন্তু আমি ছিলাম একজন অল্প বয়স্কা কিশোরী। এরপর তারা উট হাঁকিয়ে নিয়ে চলে যায়। সৈন্যদল রওয়ানা হওয়ার পর আমি আমার হারটি খুঁজে পাই এবং নিজস্ব স্থানে ফিরে এসে দেখি তাদের (সৈন্যদল) কোন আহবায়ক এবং কোন উত্তরদাতা তথায় নেই। ( নিরুপায় হয়ে) তখন আমি পূর্বে যেখানে ছিলাম সেখানে বসে রইলাম। ভাবছিলাম, তাঁরা আমাকে দেখতে না পেলে অবশ্যই আমার কাছে ফিরে আসবে। ঐ স্থানে বসে থাকা অবস্থায় ঘুম চেপে আসলে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। বানূ সুলামী গোত্রের যাকওয়ান শাখার সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল রা. (যাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফেলে যাওয়া আসবাবপত্র কুড়িয়ে নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন) সৈন্যদল চলে যাওয়ার পর সেখানে ছিলেন। তিনি প্রত্যুষে আমার অবস্থানস্থলের কাছে পৌঁছে একজন ঘুমন্ত মানুষ দেখে আমার দিকে তাকানোর পর আমাকে চিলে ফেললেন। তিনি আমাকে দেখেছিলে পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বে। তিনি আমাকে চিনতে পেরে ‘ইন্না লিল্লাহহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন’ পড়লে আমি তা শুনতে পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম এবং চাদর টেনে আমার চেহারা ঢেকে ফেললাম। আল্লাহর কসম, আমি কোন কথা বলিনি এবং তাঁর থেকে ইন্না লিল্লাহ……..পাঠ ছাড়া আর কোন কথাই শুনতে পাইনি। এরপর তিনি সাওয়ারী থেকে অবতরণ করলেন এবং সাওয়ারীকে বসিয়ে তার সামনের পা নিচু করে দিলে আমি গিয়ে তাতে আরোহণ করলাম। পরে তিনি আমাকেসহ সাওয়ারীকে টেনে আগে আগে চলতে লাগলেন, পরিশেষে ঠিক দ্বিপ্রহরে প্রচণ্ড গরমের সময় আমরা গিয়ে সেনাদলের সাথে মিলিত হলাম। সে সময় তাঁরা একটি জায়গায় অবতরণ করছিলেন।

আয়েশা রা. বলেন, এরপর যাদের ধ্বংস হওয়ার ছিল তারা (আমার প্রতি অপবাদ আরোপ করে) ধ্বংস হয়ে গেল। তাদের মধ্যে এ অপবাদ আরোপের ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল সে হচ্ছে আবদুল্লাহ ইবনে উবায় ইবনে সুলুল। রাবী উরওয়া রা. বলেন, আমি জানতে পেরেছি যে, তার সামনে অপবাদের কথাগুলো প্রচার করা হত এবং আলোচনা করা হত আর অমনি সে এগুলোকে বিশ্বাস করত, খুব ভালভাবে শ্রবণ করত এবং শোনা কথার ভিত্তিতেই বিষয়টিকে প্রমাণ করার চেষ্টা করত।

উরওয়া রা. আরো বর্ণনা করেছন যে, অপবাদ আরোপকারী ব্যক্তিদের মধ্যে হাসসান ইবনে সাবিত, মিসতাহ ইবনে উসাসা এবং হামনা বিনতে জাহাশ রা. ব্যতীত আরো কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। তারা গুটিকয়েক ব্যক্তির একটি দল ছিল, এতটুক ব্যতীত তাদের সম্পর্কে আমার আর কিছু জানা নেই। যেমন (আল কুরআনে) মহান আল্লাহ পাক বলেছেন, এ ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তাকে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বিন সুলুল বলে ডাকা হয়ে থাকে। বর্ণনাকারী উরওয়া রা. বলেন, আয়েশা রা.-এর এ ব্যাপারে হাসসান ইবনে সাবিত রা.-কে গালমন্দ করাকে পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, হাসসান ইবনে সাবিত রা. তো ঐ ব্যক্তি যিনি তার এক কবিতায় বলেছেন, আমার মান সম্মান এবং আমার বাপ দাদা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মান সম্মান রক্ষায় নিবেদিত।

আয়েশা রা. বলেন, এরপর আমরা মদীনায় আসলাম। মদীনায় আগমন করার পর এক মাস পর্যন্ত আমি অসুস্থ থাকলাম। এদিকে অপবাদ রটনাকরীদের কথা নিয়ে লোকদের মধ্যে আলোচনা ও চর্চা হতে লাগল। কিন্তু এসবের কিছুই আমি জানি না। তবে আমার সন্দেহ হচ্ছিল এবং তা আরো দৃঢ় হচ্ছিল আমার এ অসুখের সময়। কেননা এর পূর্বে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যেরূপ স্নেহ-ভালবাসা লাভ করতাম আমার এ অসুখের সময় তা আমি পাচ্ছিলাম না। তিনি আমার কাছে এসে সালাম করে কেবল ‘তুমি কেমন আছ’ জিজ্ঞাসা করে চলে যেতেন। তাঁর এ আচরণই আমার মনে চরম সন্দেহের উদ্রেক করে। তবে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাইরে বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ জঘন্য অপবাদ সম্বন্ধে আমি কিছুই জানতাম না। উম্মে মিসতাহ রা. একদা আমার সাথে পায়খানার দিকে বের হন। আর প্রকৃতির ডাকে আমাদের বের হওয়ার অবস্থা এই ছিল যে, এক রাতে বের হলে আমরা আবার পরের রাতে বের হতাম। এ ছিল আমাদের ঘরের পার্শ্বে পায়খানা তৈরী করার পূর্বের ঘটনা। আমাদের অবস্থা প্রাচীন আরবীয় লোকদের অবস্থার মত ছিল। তাদের মত আমরাও পায়খানা করার জন্য ঝোঁপঝাড়ে চলে যেতাম। এমনকি বাড়ির পার্শ্বে পায়খান তৈরী করলে আমরা খুব কষ্ট পেতাম। আয়েশা রা. বলেন, একদা আমি এবং উম্মে মিসতাহ “যিনি ছিলেন আবু রূহম ইবনে মুত্তালিব ইবনে আবদে মানাফের কন্যা, যার মা সাখার ইবনে আমির-এর কন্যা ও আবু বকর রা. সিদ্দীকের খালা এবং মিসতাহ ইবনে উসাসা ইবনে আব্বাদ ইবনে মুত্তালিব যার” একত্রে বের হলাম। আমরা আমাদের কাজ থেকে ফারিগ হওয়ার পর বাড়ি ফেরার পথে উম্মে মিসতাহ তার কাপড়ে জাড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে বললেন, মিসতাহ ধ্বংস হোক। আমি তাকে বললাম, আপনি খুব খারাপ কথা বলছেন। আপনি কি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকে গালি দিচ্ছেন? তিনি আমাকে বললেন, ওগো অবলা, সে তোমার সম্পর্কে কি বলে বেড়াচ্ছে তুমি তো তা শোননি। আয়েশা রা. বলেন, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে আমার সম্পর্কে কি বলছে? তখন তিনি অপবাদ রটনাকরীদের কথাবার্তা সম্পর্কে আমাকে জানালেন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, এরপর আমার পুরানো রোগ আরো বেড়ে গেল। আমি বাড়ি ফেরার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে আসলেন এবং সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কেমন আছ? আয়েশা রা. বলেন, আমি আমার পিতা-মাতার কাছে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক খবর জানতে চাচ্ছিলাম, তাই আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললাম, আপনি কি আমাকে আমার পিতা-মাতার কাছে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেবেন? আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমকে অনুমতি দিলেন। তখন (বাড়িতে গিয়ে) আমি আমার আম্মাকে বললাম, আম্মাজান, লোকজন কি আলোচনা করছে? তিনি বললেন, বেটী ও বিষয়টিকে হালকা করে ফেল। আল্লাহর কসম, সতীন আছে এমন স্বামী সোহাগিনী সুন্দরী রমণীকে তাঁর সতীনরা বদনাম করবে না, এমন খুব কমই হয়ে থাকে।

আয়েশা রা. বলেন, আমি বিস্ময়ের সাথে বললাম, সুবহানাল্লাহ । লোকজন কি এমন গুজবই রটিয়েছে। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, রাতভর আমি কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে ভোর হয়ে গেল। এর মধ্যে আমার অশ্রুও বন্ধ হল না এবং আমি ঘুমাতেও পারলাম না। এরপর ভোরবেলাও আমি কাঁদছিলাম। তিনি আরো বলেন যে, এ সময ওহী নাযিল হতে বিলম্ব হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রীর (আমার) বিচ্ছেদের বিষয়টি সম্পর্কে পরামর্শ ও আলোচনা করার নিমিত্তে আলী ইবনে আবু তালিব এবং উসামা ইবনে যায়েদ রা.-কে ডেকে পাঠালেন। আয়েশা রা. বলেন, উসামা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীদের পবিত্রতা এবং তাদের প্রতি (নবীজীর) ভালবাসার কারণে বললেন, (হে আল্লাহর রাসূল) তাঁরা আপনার স্ত্রী, তাদের সম্পর্কে আমি ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না। আর আলী রা. বললেন, হে আল্লাহ রাসূল, আল্লাহ তো আপনার জন্য সংকীর্ণতা রাখেননি। তাকে (আয়েশা) ব্যতীত আরো বহু মহিলা রয়েছে। তবে আপনি এ ব্যাপারে দাসী (বারীরা রা.) কে জিজ্ঞাসা করুন। সে আপনার কাছে সত্য কথাই বলবে। আয়েশা রা. বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারীরা রা.-কে ডেকে বললেন, হে বারীরা তুমি তাঁর মধ্যে কোন সন্দেহমূলক আচরণ দেখেছ কি? বারীরা রা. তাকে বললেন, সেই আল্লাহর শপথ যিনি আপনাকে সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন আমি তার মধ্যে কখনো এমন কিছু দেখিনি যার দ্বারা তাকে দোষী বলা যায়। তবে তাঁর ব্যাপারে শুধু এতটুকু বলা যায় যে, তিনি হলেন অল্প বয়স্কা যুবতী, রুটি তৈরী করার জন্য আটা খামির করে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। আর বকরী এসে অমনি তা খেয়ে ফেলে।

আয়েশা রা .বলেন, (এ কথা শুনে) সেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে সাথে উঠে গিয়ে মিম্বরে বসে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই-এর ক্ষতি থেকে রক্ষার আহবান জানিয়ে বললেন, হে মুসলিম সম্প্রদায়, যে আমার স্ত্রীর ব্যাপারে অপবাদ ও বদনাম রটিয়ে আমাকে কষ্ট দিয়েছে তার এ অপবাদ থেকে আমাকে কে মুক্ত করবে? আল্লাহর কসম, আমি আমার স্ত্রী সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানিনা। আর তাঁরা (অপবাদ রটনাকারীরা) এমন এক ব্যক্তির (সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল) নাম উল্লেখ করছে যার সম্বন্ধেও আমি ভাল ছাড়া কিছু জানি না। সে তো আমর সাথেই আমার ঘরে যায়। আয়েশা রা. বলেন, (এ কথা শুনে) বনী আবদুল আশহাল গোত্রের সাদ (ইবনে মুআয) রা. উঠে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি আপনাকে এ অপবাদ থেকে মুক্তি দেব। সে যদি আউস গোত্রের লোক হয় তা হলে তার শিরচ্ছেদ করব। আর যদি সে আমাদের ভাই খাযরাজের লোক হয় তাহলে তার ব্যাপারে আপনি যা বলবেন তাই পালন করব। আয়েশা রা. বলেন, এ সময় হাসসান ইবনে সাবিত রা.-এর মায়ের চাচাতো ভাই খাযরাজ গোত্রের সর্দার সাঈদ ইবনে উবাদা রা. দাঁড়িয়ে এ কথার প্রতিবাদ করলেন। আয়েশা রা. বলেন, এ ঘটনার পূর্বে তিনি একজন সৎ ও নেককার লোক ছিলেন। কিন্তু (এ সময়) গোত্রীয় অহমিকায় উত্তেজিত হয়ে তিনি সাদ ইবনে মুআয রা.-কে বললেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। আল্লাহর কসম, তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না এবং তাকে হত্যা করার ক্ষমতাও তোমার নেই। যদিসে তোমার গোত্রের লোক হত তাহলে তুমি তার হত্যা হওয়া কখনো পছন্দ করতে না। তখন সাদ ইবনে মুআয রা.-এর চাচাতো ভাই উসাইদ ইবনে হুযাইর রা. সাদ ইবনে ওবায়দা রা.-কে বললেন, বরং তুমি মিথ্যা কথা বললে। আল্লাহর কসম, আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করব। তুমি হলে মুনাফিক। তাই মুনাফিকদের পক্ষ অবলম্বন করে কথাবার্তা বলছ।

আয়েশা রা. বলেন, এ সময় আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্র খুব উত্তেজিত হয়ে উঠে। এমনকি তারা যুদ্ধের সংকল্প পর্যন্ত করে বসে। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থামিয়ে শান্ত করলেন এবং নিজেও চুপ হয়ে গেলেন। আয়েশা রা. বলেন, আমি সেদিন সারাক্ষণ কেঁদে কাটালাম। অশ্রুঝরা আমার বন্ধ হয়নি এবং একটু ঘুমও আমার আসেনি। তিনি বলেন, আমি ক্রন্দনরত ছিলাম আর আমার পিতা-মাতা আমার পার্শ্বে বসা ছিলেন। এমনি করে একদিন দুই রাত কেঁদে কেঁদে কাটিয়ে দিই। এর মাঝে আমার কোন ঘুম আসেনি। বরং অবারিত ধারায় আমার চোখ থেকে অশ্রুপাত হতে থাকে। মনে হচ্ছিল যেন, কান্নার ফলে আমার কলিজা ফেটে যাবে। আমি ক্রন্দনরত ছিলাম আর আমার আব্বা-আম্মা আমার পাশে বসা ছিলেন। এমতাবস্থায় একজন আনসারী মহিলা আমার কাছে আসার অনুমতি চাইলে আমি তাকে আসার অনুমতি দিলাম। সে এসে বসল এবং আমার সাথে কাঁদতে আরম্ভ করল। তিনি বলেন, আমরা ক্রন্দনরত ছিলাম ঠিক এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে এসে সালাম করলেন এবং আমাদের পাশে বসে গেলেন। আয়েশা রা. বলেন, অপবাদ রটানোর পর আমার কাছে এসে এভাবে তিনি আর কখনো বসেননি। এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ একমাস কাল অপেক্ষা করার পরও আমার বিষয়ে তাঁর নিকট কোন ওহী আসেনি।

আয়েশা রা. বলেন, বসার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালিমা শাহাদাত পড়লেন। এরপর বললেন, যা হোক, আয়েশা তোমার সম্বন্ধে আমার কাছে অনেক কথাই পৌঁছেছে, যদি তুমি এর থেকে মুক্ত হও তাহলে শীঘ্রই আল্লাহ তোমাকে এ অপবাদ থেকে মুক্ত করে দেবেন। আর যদি তুমি কোন গুনাহ করে থাক তাহলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাওবা কর। কেননা বান্দা গুনাহ স্বীকার করে তাওবা করলে আল্লাহ তায়ালা তাওবা কবূল করেন। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা বলে শেষ করলে আমার অশ্রুপাত বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি এক ফোটা অশ্রুও আমি আর অনুভব করলাম না। তখন আমি আমার আব্বাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলছেন আমার পক্ষ হতে আপনি তার জবাব দিন। আমার আব্বা বললেন, আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কি জবাব দিব আমি তা জানিনা। তখন আমি আমার আম্মাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন, আপনি তার জবাব দিন। আম্মা বললেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কি জবাব দিব আমি তা জানি না। তখন আমি ছিলাম অল্প বয়স্কা কিশোরী। কুরআনও বেশি পড়তে পারতাম না। তথাপিও এ অবস্থা দেখে নিজেই বললাম, আমি জানি আপনারা এ অপবাদের ঘটনা শুনেছেন, আপনারা তা বিশ্বাস করেছেন এবং বিষয়টি আপনাদের মনে সুদৃঢ় হয়ে আছে। এখন যদি আমি বলি যে, এর থেকে আমি পবিত্র এবং আমি নিষ্কলুষ তাহলে আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন না। আর যদি আমি এ অপরাধের কথা স্বীকার করে নেই যা সম্পর্কে আল্লাহ জানেন যে, আমি এর থেকে পবিত্র তাহলে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন। আল্লাহর কসম, আমি ও আপনারা যে অবস্থায় শিকার হয়েছি এর জন্য (নবী) ইউসুফ আ.-এর পিতার কথা উদাহরণ ব্যতীত আমি কোন উদাহরণ খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি বলেছিলেন: “সুতরাং পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছ সে বিষয়ে আল্লাহই একমাত্র আমার আশ্রয়স্থল” এরপর আমি মুখ ফিরিয়ে আমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আল্লাহ তায়ালা জানেন যে, সে মুহূর্তেও আমি পবিত্র। অবশ্যই আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন। (একথার প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল) তবে আল্লাহর কসম,আমি কখনো ধারণা করিনি যে, আমার ব্যাপারে আল্লাহর ওহী নাযিল করবেন যা পঠিত হবে। আমার ব্যাপারে আল্লাহ কোন কথা বলবেন আমি নিজেকে এতখানি যোগ্য মনে করিনি বরং আমি নিজেকে এর চেয়ে অধিক অযোগ্য বলে মনে করতাম। তবে আমি আশা করাতাম যে, হয়তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এমন স্বপ্ন দেখানো হবে যার দ্বারা আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনো তাঁর বসার জায়গা ছাড়েননি এবং ঘরের লোকদের থেকেও কেউ ঘর থেকে বাইরে যাননি। এমতাবস্থায় তাঁর উপর ওহী নাযিল হতে শুরু হল। ওহী নাযিল হওয়ার সময় তাঁর যে বিশেষ কষ্ট হত তখনও সে অবস্থা তাঁর হল। এমনকি প্রচণ্ড শীতের দিনেও তাঁর দেহ থেকে মোতির দানার মত বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়ত ঐ বাণীর গুরুভাবের কারণে, যা তাঁর প্রতি নাযিল করা হয়েছে। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ অবস্থা দূরীভূত হলে তিনি হাসিমুখে প্রথমে যে কথাটি বললেন, তা হল, হে আয়েশা ! আল্লাহ তোমার পবিত্রতা জাহির করে দিয়েছেন। আয়েশা রা. বলেন, এ কথা শুনে আমার আম্মা আমাকে বললেন, তুমি উঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর। আমি বললাম, আল্লাহর কসম আমি এখন তাঁর দিকে উঠে যাব না। মহান আল্লাহ ব্যতীত আমি কারো প্রশংসা করব না। আয়েশা রা বললেন, আল্লাহ (আমার পবিত্রতা ঘোষণা করে) যে দশটি আয়াত নাযিল করেছেন, তা হল এই : “যারা এ অপবাদ রটনা করেছে (তারা তো তোমাদেরই একটি দল; এ ঘটনাকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না; বরং এও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য আছে তাদের কৃত পাপকর্মের ফল এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে তার জন্য আছ কঠিন শাস্তি। এ কথা শোনার পর মুমিন পুরুষ এবং নারীগণ কেন নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারণা করেনি এবং বলেনি, এটা তো সুষ্পষ্ট অপবাদ। তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি? যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সেহেতু তারা আল্লাহর বিধানে মিথ্যাবাদী। দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমরা যাতে লিপ্ত ছিলে তার জন্য কঠিন শাস্তি তোমাদেরকে স্পর্শ করত। যখন তোমরা মুখে মুখে এ মিথ্যা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিলনা এবং একে তোমরা তুচ্ছ ব্যাপার বলে ভাবছিলে, অথচ আল্লাহর কাছে তা ছিল খুবই গুরুতর ব্যাপার। আল্লাহ পবিত্র, মহান! এ তো এক গুরুতর অপনাদ। আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক তাহলে কখনো অনুরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি করবে না, আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বিবৃত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। যারা মুনিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতের মর্মন্তুদ শাস্তি। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউই অব্যাহতি পেতে না। আল্লাহ দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। (২৪ : ১১-২০) এরপর আমার পবিত্রতা ঘোষণা করে আল্লাহ এ আয়াতগুলো নাযিল করলেন।

আত্মীয়তা এবং দারিদ্রের কারণে আবু বকর সিদ্দীক রা. মিসতাহ ইবনে উসাসাকে আর্থিক ও বৈষয়িক সাহায্য করতেন। কিন্তু আয়েশা রা. সম্পর্কে তিনি যে অপবাদ রটিয়েছিলেন এ কারণে আবু বকর সিদ্দীক রা কসম করে বললেন, আমি আর কখনো মিসতাহকে আর্থিক কোন সাহায্য করব না। তখন আল্লাহ তায়ালা নাযিল করলে, তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ গ্রহণ করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজন ও অভাবগ্রস্তকে এবং আল্লাহর রাস্তায় যারা গৃহত্যাগ করেছে তাদেরকে কিছুই দিবে না। তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে এবং তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। শোন! তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (২৪: ২২) (এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর) আবু বকর সিদ্দীক রা. বলে উঠলেন হ্যাঁ, আল্লাহর কসম অবশ্যই আমি পছন্দ করি যে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিন। এরপর তিনি মিসতাহ রা.-এর জন্য যে অর্থ খরচ করতেন তা পুন: দিতে শুরু করলেন এবং বললেন, আল্লাহর কসম, আমি তাকে এ অর্থ দেওয়া আর কখনো বন্ধ করব না। আয়েশা রা .বললেন, আমার এ বিষয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়নাব বিনতে জাহাশ রা.-কেও জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তিনি যায়নাব রা. -কে বলেছিলেন, তুমি আয়েশা রা. সম্পর্কে কি জান অথবা বলেছিলেন তুমি কী দেখেছ? তখন তিনি বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি আমার চোখ ও কানকে সংরক্ষণ করেছি। আল্লাহর কসম ! আমি তাঁর সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না। আয়েশ রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর স্ত্রীগণের মধ্যে তিনি আমার সমকক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। আল্লাহ তাকে আল্লাহ-ভীতির ফলে রক্ষা করেছেন। আয়েশা রা. বলেন, অথচ তাঁর বোন হামনা রা. তাঁর পক্ষ অবলম্বন করে অপবাদ রটনাকারীদের মত অপবাদ রটনা করে বেড়াচ্ছিলেন। ফলে তিনি ধ্বংসপ্রাপ্তদের সাথে ধ্বংস হয়ে গেলেন। বর্ণনাকারী ইবনে শিহাব রহ. বলেন, ঐ সমস্ত লোকের ঘটনা সম্পর্কে আমার কাছে যা পৌঁছেছে তা হল এই : উরওয়ার রা. বলেন, আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ কসম, যে ব্যক্তি সম্পর্কে অপবাদ দেওয়া হয়েছিল, তিনি এসব কথা শুনে বলতেন, আল্লাহ মহান। ঐ সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, আমি কোন স্ত্রীলোকের কাপড় খু্লেও কোনদিন দেখিনি। আয়েশা রা. বলেন, পরে তিনি আল্লাহর পথে শাহাদত লাভ করেছিলেন।

(সহীহ বুখারী, আল মাগাযী অধ্যায়, হাদীস নং ৩৮৪৬)

উৎস: আরবী বাংলা হাদীস বিশ্বকোষ

Posted at June 03, 2019 |  by Arya ঋষি

0 Comments:

দ্বিতীয় পর্ব



আলোচিত মেহেদির পূর্বাপর এবং বাকি বৃত্তান্ত
এর আগে প্রস্তুতি হিসেবে সে এই পূর্বালোচিত মেহেদী বা প্রেরিত পুরুষ হিসেবে মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল কাহ্তানী বলে মৃদুভাষী একটি তরুণ ধর্ম প্রচারক কে চিহ্নিত করে।এই ক্ষেত্রে হাদিসে সেই প্রেরিত পুরুষের নাম বা তাঁর বাবার নাম এবং এই লোকটির ক্ষেত্রেও একই হওয়া একটি বড় হাতিয়ার হয়।একই সাথে বর্ণিত মেহেদির উন্নত কপাল ,রোগা গড়ন ,উন্নত নাসিকা ইত্যাদি মিল একটি মোক্ষম সুযোগ এনে দিলো। প্রথমে কাহতানি নিজেকে দেখতে রাজি না হলেও পরবর্তীতে জুহাইমান এর মোহে আবিষ্ট হয়ে সত্যিই নিজেকে ওই ভাবে ভাবতে শুরু করে।এই সখ্যতা আরো পোক্ত হয় যখন তার বড় বোন কে জুহাইমান তার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে বিয়ে করে।
অভিযানের আগে কাবা একটি গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে ইমাম মেহেদী কে শত শত মক্কাবাসী স্বপ্নে দেখেছে শীর্ষ মসজিদের মিনারে ইসলামের পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।একই সাথে দলের অভ্যন্তরে এই ইমামের বিষয়ে কোনো সন্দেহের প্রশ্ন রাখার অবকাশ সে রাখে নি।একদিকে যখন জুহাইমান আর তাঁর দল প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই প্রস্তুতি নিচ্ছিল ওই সময়ে সৌদি বাদশা পুত্র এবং এক অর্থে ক্ষমতার কর্নধার ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজ ছিল তিউনিসিয়ায় আরব লীগের একটি বৈঠকের সফরে আর প্রিন্স আব্দুল্লাহ ,জাতীয় সুরক্ষার প্রধান ছিল মরোক্কো সফরে।দেশের দেখভাল করার জন্য ছিল বৃদ্ধ এবং অসুস্থ রাজা খালেদ আর রক্ষামন্ত্রী প্রিন্স সুলতান।
সৌদি রাজশক্তির তৎপরতা :
সেই সকালেই খবর পেয়ে শেখ নাসের রাজা খালেদকে এই খবর দেন।রাজা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রিন্স সুলতান বিন আব্দুল আজিজ এবং অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের সর্বোচ্চ কর্তা প্রিন্স নাইফ বিন আব্দুল আজিজ কে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে আদেশ করে।পরবর্তিতে মক্কার প্রশাসক প্রিন্স ফাওয়াজ বিন আব্দুল আজিজ,গুপ্তচর বিভাগের প্রিন্স তুর্কি অকুস্থলের কাছে চলে আসে।তুর্কি স্বীকার করে যে জুহাইমান আর তার গোষ্ঠী তুলনামূলক ভাবে একটু ছোট দল হওয়ার কারণে এদের উপরে নজর রাখা হলেও সামগ্রিক কোন বিপদের আশংকা বা এই ধরনের কোনো কান্ড করতে পারে তা তারা ভাবতেও পারে নি।
সৌদি পুলিশ প্রথমে এই দখলের গুরুত্ব বুঝতেই পারে নি।সকালে একজন পুলিস অফিসার বিষয়টি দেখতে একটি জিপ নিয়ে এগিয়ে গেলে দখলদার বাহিনীর গুলিতে আহত হয়।একই ভাবে অন্য দিক থেকে আসা অন্য পুলিস অফিসারদের গাড়ি গুলোতেও ভিতর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসে।এই পর্যায়ে ভিতরে থাকা সাধারন মানুষদের ঢাল বানিয়ে এই দলটি ক্রমশ আক্রমন চালিয়ে যায় সৌদি পুলিশের উপরে।এই পর্যায়ে আহত বা নিহত এই সব মানুষদের দেহ উদ্ধার করার চেষ্টা করলেও তাদের উপরে একই ভাবে গুলি বর্ষণ করতে থাকে ভিতর থেকে।মৃত্যু হয় এক পুলিস অফিসারের এবং ভিতরের এক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা এক কিশোরের।ইমামের মতো আরো কিছু সৌদি নাগরিক পিলারের আড়াল ধরে ধীরে ধীরে একটি জানালার কাঁচের ফাঁক দিয়ে একদল রোগা পাতলা লোক বাইরে পালাতে স্বক্ষম হয়।মসজিদ চত্ত্বরে থাকা সৌদি নারী পুরুষদের জোর করে এই ঘোষিত ইমামের পক্ষে শপথ পাঠ করানো চলতে থাকে।
প্রিন্স তুর্কি মসজিদের পাশের হোটেল সৌবরাতে এই পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে একটি বৈঠক করতে এলে,হোটেলের দরজাতে হাত দেওয়া মাত্র একটি বুলেট তার দিকে ছুটে আসে,কপাল গুনে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে দরজার কাজ চুরমার করে দেয়।তড়িঘড়ি তাঁকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়।এই বুলেট এসেছিল মসজিদের আব্দুল আজিজ দরজার জোড়া মিনারের থেকে।হোটেলটি মসজিদের থেকে মাত্র ১৫০ মিটার দুরে থাকায় ওই দখলদার বাহিনীর স্নাইপারের আওতায় ছিল আর সৌদি কর্তিপক্ষ তা আগে একদম আন্দাজ করতে পারে নি।
সৌদি উপলব্ধি এবং পরবর্তী কাজকর্ম:
এইবার সৌদি শাসক গোষ্ঠী বুঝতে পারে এদের প্রস্তুতি বা শক্তি অনেক বেশি।এরপরে এই কাবা এবং শীর্ষ মসজিদের চারপাশে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরী করে।বিশেষ রক্ষী বাহিনী ,বিশেষ ছত্রী বাহিনী আর বিশেষ স্বশস্ত্র দল কে মোতায়েন করা হয়।সমস্যা হলো,পাল্টা আক্রমন করার ক্ষেত্রে,যেহেতু সব চেয়ে পবিত্র এই স্থানে কোনো অস্ত্র ইত্যাদি নিয়ে যাওয়া বা পাল্টা আক্রমন এতো সহজ ছিল না,এর সাথে গোটা মুসলিম দেশগুলোর মানুষের এবং নিজের দেশের মানুষের অনুভুতির প্রশ্ন জড়িত ছিল।এই কারণে দরকার ছিল উলেমাদের থেকে ধর্মীয় নির্দেশ।এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ভারপ্রাপ্ত উলেমাদের দল দুই দিন সময় নিয়েছিল।এই দুই দিন সৌদি প্রশাসন প্রস্তুতি নিতে থাকে আর একই সঙ্গে পুরো জায়গাটির উপরে নজর রাখা শুরু করে।
হেলিকপ্টারের চক্কর এবং জঙ্গি বিমানের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়।নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া হেলিকপ্টারকে লক্ষ্য করে গুলি ছুটে আসে,ভাগ্যক্রমে একজন চালক রক্ষা পায় তার বদলে সঙ্গের বেতার ব্যবস্থার গায়ে গুলি লাগার কারণে।এই সময়ে নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়ার কারণে দেখা যায় ভিতরে স্বশস্ত্র পুরুষই না,বেশ কিছু নারী ও অস্ত্র নিয়ে ভিতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।পরবর্তিতে সৌদি প্রশাসন জানতে পেরেছিল এই জুহাইমানের সাথে তার স্ত্রী আর বাকিদের অনেকের পরিবার বা সন্তান ও এসেছিল এই অভিযানে।সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টি অনেক জটিল হয়ে ওঠে মোকাবিলার জন্য।
পরেরদিন সরকারী ভাবে অতি ভোরে রিয়াদ রেডিও থেকে ঘোষণা করা হয় এই কাবা এবং সংলগ্ন মসজিদ দখলের আর দখলকারী গোষ্ঠির কোনো এক ব্যক্তিকে সেই মেহেদী ঘোষণার কথা।ইতিমধ্যেই অবশ্য মার্কিন সংবাদ মাধ্যমের সূত্র ধরে এই খবর গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গিয়েছিল।এই দ্বিতীয় দিনে সেই সময়ের নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি ভয়াবহ অসত্য খবর দিয়ে ফেলে যাতে শিরোনাম ছিল, “মক্কা মসজিদ দখল করা বন্দুকধারীর দল সম্ভবত ইরানের জঙ্গি গোষ্ঠী।
বিশ্বজুড়ে নতুন অশান্তির সূচনা:
এই খবর এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরী করলো,কারণ এর কিছু দিন আগেই ইরানের শাহ কে অপসারণ করে মোল্লা গোষ্ঠির বা আরো নির্দিস্ট করে বললে শিয়া পন্থী খোমেইনি ক্ষমতা দখল করে আমেরিকার দুতাবাসে ৫২ জন মার্কিন নাগরিক এবং বাকিদের আটকে রেখেছিল।এরপরে এর প্রত্যুত্তর দিতে খোমেইনি পাল্টা দায়ী করে আমেরিকাকে আর চারিদিকে পল্লবিত হতে থাকে গুজবের নানান বিষয়।
এরপরেই একদল লোক পাকিস্থানে মার্কিন দুতাবাসে আক্রমন করে সেটি মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়।দুজন মার্কিন এবং দুজন পাকিস্থানি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী এই ঘটনায় মারা ও যায়।পরবর্তিতে একই কারণে খোমেইনীর অভিযোগের ভিত্তিতে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলিতে একই ভাবে মার্কিন দুতাবাস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়,এই ঘটনা এতটাই সুদুরপ্রসারী হয়েছিল যে পরবর্তী ২৫ বছর ওই দেশে আর মার্কিন কোনো দুতাবাস স্থাপনা হয় নি।
এই সবের মাঝে, ঘটনার দু দিন পরে অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের প্রধান প্রিন্স নাইফ সব জল্পনা শেষ করে পরিস্কার জানায় আমেরিকা বা ইরান অথবা অন্য কোনো দেশ এতে জড়িত না।এই ঘটনা সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ একটি গোষ্ঠির কাজ যারা ‘পথভ্রষ্ট‘ হয়েছিল।
এই সময়ের মধ্যে একাধিকবার এই মসজিদ বা পুরো স্থাপনার ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেও সফল হয় নি সৌদি বাহিনী।এই সময়ে পুরো অভিযানের নেতৃত্ব দিতে নিয়ে আসা হয় সৌদি রাজার স্বশস্ত্র ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফালেহ আল দাহরি কে।ঠিক হয় ,মারওয়া দরজা উড়িয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকবে এই বাহিনী।এই সময়ে এক কঠিন অবস্থার সামনে পড়েছিল সৌদি শাসকরা।ইমাম মেহেদির তত্বে বিশ্বাসী একাংশ ধরে নিয়েছিল এই বিরোধিতা আসছে শয়তানের পক্ষ থেকে এই সাজোয়া গাড়ির বহর নিয়ে।অর্থাৎ একটা জন সমর্থন গড়ে ওঠার অবস্থা তৈরী হয়েছিল এই ইমাম মেহেদীকে কেন্দ্র করে যাতে শাসক গোষ্ঠী শয়তানের দোসর হিসেবে ভুমিকা নিতে যাচ্ছিল।এই পর্যায়ে একটি বুদ্ধিমানের মতো কাজ সৌদি প্রশাসন করে,পুরো অভিযানের নানান পর্যায়ে এরা সংবাদ মাধ্যমকে নিজেদের কাজের বিষয়ে জানানো বা সঙ্গে রাখার কাজ শুরু করে ফলে বিষয়টি অনেক স্বচ্ছ হয়ে ওঠে।
প্রথমদিনে সাজোয়া গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেলেও তীব্র গুলির কারণে শারীরিক ভাবে মসজিদের আশেপাশে নেমে অবস্থান নেওয়ার কোনো সুযোগ পায় নি সৌদি বাহিনী।এরপরের দিন কৌশলগত ভাবে আসেপাশের উচু অবস্থাপনা গুলোতে পাল্টা দূর পাল্লার বন্দুকবাজ মোতায়েন করে সৌদি বাহিনী।এইবার উচ্চ অবস্থান থেকে পাল্টা গুলি চালিয়ে অনেকটাই নিস্ক্রিয় করে ফেলতে পারে ওই দখলদার বাহিনীর স্নাইপার গুলো কে।একই সাথে আকাশ থেকে নিরীক্ষণের মাধ্যমে সৌদি বাহিনী জানতে পারে উত্তর ভাগের মারওয়া দরজা অপেক্ষাকৃত কম প্রতিরোধের জায়গা হতে পারে।
এই পর্যায়ে ২২ তারিখ,ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ, সৌদি গোলন্দাজরা কম মাপের বিস্ফোরক গোলা ছুড়তে থাকে,এটি স্রেফ ওই অবস্থানরত প্রতিরোধকারীদের নজর অন্যদিকে নিয়ে আরো একটি বাহিনীকে সাফা-মারওয়া পথের পূর্ব দিকে অবস্থান নিতে করা হয়েছিল।এই কাজে অর্ধেক পথ এগিয়ে গেলেও তীব্র গুলির কারণে বেশ কিছু সেনার মৃত্যু হলে বাহিনী আবার পিছু হটে যায়।একই ভাবে আগে বলা সেই মারওয়া দরজার দিকে বিস্ফোরক সহযোগে দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকতে পারলেও সফল হলো না।
ফতোয়ার জোরে নতুন শক্তি প্রাপ্তি:
অবশেষে,নভেম্বর ২৩তারিখে ইসলামের ইতিহাসে সূচনা থেকে এই প্রথম,জুম্মার নামাজ পড়া হলো না এই শীর্ষ মসজিদে।দিনের শেষে উলেমারা ফতোয়া দিলো “এই জঙ্গিদের অস্ত্র ত্যাগ করে আত্মসমর্পর্ন করার আবেদন করা হোক,তা না মানলে কোরানের আল বাকারাহর বিধান অনুযায়ী যদি আল মসজিদ আল হারাম এ আক্রমন না করার এবং যদি একান্তই আক্রান্ত হও তবে তাদের হত্যা করার আদেশের ভিত্তিতে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া হোক”
এইবার এই ফতোয়ার আনুকূল্যে একটা শক্ত অবস্থান পেলো সৌদিশক্তি।এতদিন বাইরে থেকে প্রত্যাঘাত করলেও এবার ধর্মীয় সমর্থনে ভিতরে মারার অধিকার একটা নির্দিস্ট দিক নির্দেশ দিলো।প্রথমে ওই ফতোয়ার নির্দেশ ধরে আত্মসমর্পর্ন করার কথা ঘোষনা করা হয়,কোনো সদুত্তর না পাওয়ার পরে মিনারগুলোতে রকেট নিক্ষেপ করা হয় উপরে থাকা দুরপাল্লার(স্নাইপার)রাইফেলধারী লোকদের নিস্ক্রিয় করতে।একই সাথে সেই আগের বলা সাফা-মারওয়া পথের বাইরের দিকের আগেই ভেঙ্গে দেওয়া দরজা দিয়ে গোলা দাগা শুরু করে।
অবশেষে,শনিবার, নভেম্বর ২৪ তারিখ এই সাফা মারওয়া পথের দখল নিতে পারে সৌদি বাহিনী।জুহাইমান আর তার দল উপরের অংশ থেকে পিছু হটে আশ্রয় নেয় মসজিদের মাটির নিচের ঘরগুলোতে।এই জায়গায় সর্বসাকুল্যে ২২৫টী ঘর পরস্পরের সাথে সংযোগ যুক্ত ছিল।পর্যাপ্ত অস্ত্র,গুলি আর প্রয়োজনীয় খাদ্য নিয়ে আরো এক সপ্তাহ লড়াই করার অবস্থায় ছিল বলে ধারণা করা হয়।বোমা,গুলি এমনকি নানান কার্পেট বা গাড়ির টায়ার পুড়িয়ে সব রকম ভাবে সৌদি বাহিনী কে বাধা দিয়ে যায় জুহাইমানের বাহিনী।এই সময়ে কাদানে গ্যাস দিয়ে এদের বের করে নিয়ে আসার কাজ ও ব্যর্থ হয়।ভূগর্ভে থাকার কারণে এই গ্যাস আবার মাটির উপরের দিকেই উঠতে থাকে আর এই লোকগুলো মুখে জলে ভিজানো কাপড় লাগিয়ে রাখার কারণে কোনো প্রতিকুল অবস্থায় পড়ে নি বরং উল্টে এই গ্যাস মাটির উপরে থাকা সৌদি বাহিনীর জন্য বিরূপ অবস্থা তৈরী করে।এই পর্যায়ে সমস্যা আরো প্রকট হয় কারণ মসজিদে নামাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গোটা মুসলিম বিশ্বে প্রভূত সম্মানহানি হতে থাকে।গোটা পৃথিবীর মুসলিম দেশগুলোতে এই আজান সম্প্রসার বা এর প্রতীকী একটি মূল্য ছিল যা ধাক্কা খায়। সৌদি শাসকদের অত্যন্ত অস্বস্তির কারণ হতে থাকে এই সময়টি। সৌদি শাসকের সেনা একের পর এক উপায়ে চেষ্টা করে যেতে থাকে এদের উৎখাত করতে তবে সফলতা পাচ্ছিল না এই অসংখ্য কক্ষ আর ভূগর্ভের কক্ষে এদের অবস্থানের কারণে।আরো একটি কারণ ছিল , সৌদি শাসক পাখির চোখের মতো লক্ষ্য করেছিল এদের পালের গোদা কে জীবন্ত ধরার জন্য।অতঃপর,এই অস্বস্তিকর অবস্থা এবং বিশ্বজুড়ে চাপ অবসান করতে সৌদি রাজা সাহায্যের জন্য ফরাসি রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করে।
পরবর্তী পর্বে এই দখলের অন্তিম পরিনতি এবং বিষ বৃক্ষের সূচনার প্রাসঙ্গিক কথা থাকবে।ততক্ষণ আবার একটি চা পানের বিরতি।
এই পর্বের তথ্যসূত্র:
১. ইতিহাসের পাতা থেকে https://medium.com/@haramainarchives/makkah-grand-mosque-seizure-1979-ae55625315a5
২. যে অসত্য খবর পরিবেশন করার পরে পৃথিবীতে এক নতুন অশান্তি শুরু হয়েছিল https://www.nytimes.com/1979/11/21/archives/mecca-mosque-seized-by-gunmen-believed-to-be-militants-from-iran.html
৩. স্রেফ ছবির হিসেবে দেখলেও পর্ব ধরে দেখতে পারেন এই প্রতিবেদন গুলো https://www.youtube.com/watch?v=Z7kzj-zPoOM
৪. একই ভাবে পরের পর্ব https://www.youtube.com/watch?v=JufzBz6gbnA
৫. তিন নম্বর পর্ব https://www.youtube.com/watch?v=oomQ6IyWyg4

কাবা এবং মসজিদ আল হারাম দখলের কালান্তক ইতিহাস–দ্বিতীয় পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব



আলোচিত মেহেদির পূর্বাপর এবং বাকি বৃত্তান্ত
এর আগে প্রস্তুতি হিসেবে সে এই পূর্বালোচিত মেহেদী বা প্রেরিত পুরুষ হিসেবে মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল কাহ্তানী বলে মৃদুভাষী একটি তরুণ ধর্ম প্রচারক কে চিহ্নিত করে।এই ক্ষেত্রে হাদিসে সেই প্রেরিত পুরুষের নাম বা তাঁর বাবার নাম এবং এই লোকটির ক্ষেত্রেও একই হওয়া একটি বড় হাতিয়ার হয়।একই সাথে বর্ণিত মেহেদির উন্নত কপাল ,রোগা গড়ন ,উন্নত নাসিকা ইত্যাদি মিল একটি মোক্ষম সুযোগ এনে দিলো। প্রথমে কাহতানি নিজেকে দেখতে রাজি না হলেও পরবর্তীতে জুহাইমান এর মোহে আবিষ্ট হয়ে সত্যিই নিজেকে ওই ভাবে ভাবতে শুরু করে।এই সখ্যতা আরো পোক্ত হয় যখন তার বড় বোন কে জুহাইমান তার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে বিয়ে করে।
অভিযানের আগে কাবা একটি গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে ইমাম মেহেদী কে শত শত মক্কাবাসী স্বপ্নে দেখেছে শীর্ষ মসজিদের মিনারে ইসলামের পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।একই সাথে দলের অভ্যন্তরে এই ইমামের বিষয়ে কোনো সন্দেহের প্রশ্ন রাখার অবকাশ সে রাখে নি।একদিকে যখন জুহাইমান আর তাঁর দল প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই প্রস্তুতি নিচ্ছিল ওই সময়ে সৌদি বাদশা পুত্র এবং এক অর্থে ক্ষমতার কর্নধার ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজ ছিল তিউনিসিয়ায় আরব লীগের একটি বৈঠকের সফরে আর প্রিন্স আব্দুল্লাহ ,জাতীয় সুরক্ষার প্রধান ছিল মরোক্কো সফরে।দেশের দেখভাল করার জন্য ছিল বৃদ্ধ এবং অসুস্থ রাজা খালেদ আর রক্ষামন্ত্রী প্রিন্স সুলতান।
সৌদি রাজশক্তির তৎপরতা :
সেই সকালেই খবর পেয়ে শেখ নাসের রাজা খালেদকে এই খবর দেন।রাজা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রিন্স সুলতান বিন আব্দুল আজিজ এবং অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের সর্বোচ্চ কর্তা প্রিন্স নাইফ বিন আব্দুল আজিজ কে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে আদেশ করে।পরবর্তিতে মক্কার প্রশাসক প্রিন্স ফাওয়াজ বিন আব্দুল আজিজ,গুপ্তচর বিভাগের প্রিন্স তুর্কি অকুস্থলের কাছে চলে আসে।তুর্কি স্বীকার করে যে জুহাইমান আর তার গোষ্ঠী তুলনামূলক ভাবে একটু ছোট দল হওয়ার কারণে এদের উপরে নজর রাখা হলেও সামগ্রিক কোন বিপদের আশংকা বা এই ধরনের কোনো কান্ড করতে পারে তা তারা ভাবতেও পারে নি।
সৌদি পুলিশ প্রথমে এই দখলের গুরুত্ব বুঝতেই পারে নি।সকালে একজন পুলিস অফিসার বিষয়টি দেখতে একটি জিপ নিয়ে এগিয়ে গেলে দখলদার বাহিনীর গুলিতে আহত হয়।একই ভাবে অন্য দিক থেকে আসা অন্য পুলিস অফিসারদের গাড়ি গুলোতেও ভিতর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসে।এই পর্যায়ে ভিতরে থাকা সাধারন মানুষদের ঢাল বানিয়ে এই দলটি ক্রমশ আক্রমন চালিয়ে যায় সৌদি পুলিশের উপরে।এই পর্যায়ে আহত বা নিহত এই সব মানুষদের দেহ উদ্ধার করার চেষ্টা করলেও তাদের উপরে একই ভাবে গুলি বর্ষণ করতে থাকে ভিতর থেকে।মৃত্যু হয় এক পুলিস অফিসারের এবং ভিতরের এক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা এক কিশোরের।ইমামের মতো আরো কিছু সৌদি নাগরিক পিলারের আড়াল ধরে ধীরে ধীরে একটি জানালার কাঁচের ফাঁক দিয়ে একদল রোগা পাতলা লোক বাইরে পালাতে স্বক্ষম হয়।মসজিদ চত্ত্বরে থাকা সৌদি নারী পুরুষদের জোর করে এই ঘোষিত ইমামের পক্ষে শপথ পাঠ করানো চলতে থাকে।
প্রিন্স তুর্কি মসজিদের পাশের হোটেল সৌবরাতে এই পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে একটি বৈঠক করতে এলে,হোটেলের দরজাতে হাত দেওয়া মাত্র একটি বুলেট তার দিকে ছুটে আসে,কপাল গুনে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে দরজার কাজ চুরমার করে দেয়।তড়িঘড়ি তাঁকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়।এই বুলেট এসেছিল মসজিদের আব্দুল আজিজ দরজার জোড়া মিনারের থেকে।হোটেলটি মসজিদের থেকে মাত্র ১৫০ মিটার দুরে থাকায় ওই দখলদার বাহিনীর স্নাইপারের আওতায় ছিল আর সৌদি কর্তিপক্ষ তা আগে একদম আন্দাজ করতে পারে নি।
সৌদি উপলব্ধি এবং পরবর্তী কাজকর্ম:
এইবার সৌদি শাসক গোষ্ঠী বুঝতে পারে এদের প্রস্তুতি বা শক্তি অনেক বেশি।এরপরে এই কাবা এবং শীর্ষ মসজিদের চারপাশে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরী করে।বিশেষ রক্ষী বাহিনী ,বিশেষ ছত্রী বাহিনী আর বিশেষ স্বশস্ত্র দল কে মোতায়েন করা হয়।সমস্যা হলো,পাল্টা আক্রমন করার ক্ষেত্রে,যেহেতু সব চেয়ে পবিত্র এই স্থানে কোনো অস্ত্র ইত্যাদি নিয়ে যাওয়া বা পাল্টা আক্রমন এতো সহজ ছিল না,এর সাথে গোটা মুসলিম দেশগুলোর মানুষের এবং নিজের দেশের মানুষের অনুভুতির প্রশ্ন জড়িত ছিল।এই কারণে দরকার ছিল উলেমাদের থেকে ধর্মীয় নির্দেশ।এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ভারপ্রাপ্ত উলেমাদের দল দুই দিন সময় নিয়েছিল।এই দুই দিন সৌদি প্রশাসন প্রস্তুতি নিতে থাকে আর একই সঙ্গে পুরো জায়গাটির উপরে নজর রাখা শুরু করে।
হেলিকপ্টারের চক্কর এবং জঙ্গি বিমানের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়।নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া হেলিকপ্টারকে লক্ষ্য করে গুলি ছুটে আসে,ভাগ্যক্রমে একজন চালক রক্ষা পায় তার বদলে সঙ্গের বেতার ব্যবস্থার গায়ে গুলি লাগার কারণে।এই সময়ে নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়ার কারণে দেখা যায় ভিতরে স্বশস্ত্র পুরুষই না,বেশ কিছু নারী ও অস্ত্র নিয়ে ভিতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।পরবর্তিতে সৌদি প্রশাসন জানতে পেরেছিল এই জুহাইমানের সাথে তার স্ত্রী আর বাকিদের অনেকের পরিবার বা সন্তান ও এসেছিল এই অভিযানে।সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টি অনেক জটিল হয়ে ওঠে মোকাবিলার জন্য।
পরেরদিন সরকারী ভাবে অতি ভোরে রিয়াদ রেডিও থেকে ঘোষণা করা হয় এই কাবা এবং সংলগ্ন মসজিদ দখলের আর দখলকারী গোষ্ঠির কোনো এক ব্যক্তিকে সেই মেহেদী ঘোষণার কথা।ইতিমধ্যেই অবশ্য মার্কিন সংবাদ মাধ্যমের সূত্র ধরে এই খবর গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গিয়েছিল।এই দ্বিতীয় দিনে সেই সময়ের নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি ভয়াবহ অসত্য খবর দিয়ে ফেলে যাতে শিরোনাম ছিল, “মক্কা মসজিদ দখল করা বন্দুকধারীর দল সম্ভবত ইরানের জঙ্গি গোষ্ঠী।
বিশ্বজুড়ে নতুন অশান্তির সূচনা:
এই খবর এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরী করলো,কারণ এর কিছু দিন আগেই ইরানের শাহ কে অপসারণ করে মোল্লা গোষ্ঠির বা আরো নির্দিস্ট করে বললে শিয়া পন্থী খোমেইনি ক্ষমতা দখল করে আমেরিকার দুতাবাসে ৫২ জন মার্কিন নাগরিক এবং বাকিদের আটকে রেখেছিল।এরপরে এর প্রত্যুত্তর দিতে খোমেইনি পাল্টা দায়ী করে আমেরিকাকে আর চারিদিকে পল্লবিত হতে থাকে গুজবের নানান বিষয়।
এরপরেই একদল লোক পাকিস্থানে মার্কিন দুতাবাসে আক্রমন করে সেটি মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়।দুজন মার্কিন এবং দুজন পাকিস্থানি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী এই ঘটনায় মারা ও যায়।পরবর্তিতে একই কারণে খোমেইনীর অভিযোগের ভিত্তিতে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলিতে একই ভাবে মার্কিন দুতাবাস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়,এই ঘটনা এতটাই সুদুরপ্রসারী হয়েছিল যে পরবর্তী ২৫ বছর ওই দেশে আর মার্কিন কোনো দুতাবাস স্থাপনা হয় নি।
এই সবের মাঝে, ঘটনার দু দিন পরে অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের প্রধান প্রিন্স নাইফ সব জল্পনা শেষ করে পরিস্কার জানায় আমেরিকা বা ইরান অথবা অন্য কোনো দেশ এতে জড়িত না।এই ঘটনা সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ একটি গোষ্ঠির কাজ যারা ‘পথভ্রষ্ট‘ হয়েছিল।
এই সময়ের মধ্যে একাধিকবার এই মসজিদ বা পুরো স্থাপনার ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেও সফল হয় নি সৌদি বাহিনী।এই সময়ে পুরো অভিযানের নেতৃত্ব দিতে নিয়ে আসা হয় সৌদি রাজার স্বশস্ত্র ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফালেহ আল দাহরি কে।ঠিক হয় ,মারওয়া দরজা উড়িয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকবে এই বাহিনী।এই সময়ে এক কঠিন অবস্থার সামনে পড়েছিল সৌদি শাসকরা।ইমাম মেহেদির তত্বে বিশ্বাসী একাংশ ধরে নিয়েছিল এই বিরোধিতা আসছে শয়তানের পক্ষ থেকে এই সাজোয়া গাড়ির বহর নিয়ে।অর্থাৎ একটা জন সমর্থন গড়ে ওঠার অবস্থা তৈরী হয়েছিল এই ইমাম মেহেদীকে কেন্দ্র করে যাতে শাসক গোষ্ঠী শয়তানের দোসর হিসেবে ভুমিকা নিতে যাচ্ছিল।এই পর্যায়ে একটি বুদ্ধিমানের মতো কাজ সৌদি প্রশাসন করে,পুরো অভিযানের নানান পর্যায়ে এরা সংবাদ মাধ্যমকে নিজেদের কাজের বিষয়ে জানানো বা সঙ্গে রাখার কাজ শুরু করে ফলে বিষয়টি অনেক স্বচ্ছ হয়ে ওঠে।
প্রথমদিনে সাজোয়া গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেলেও তীব্র গুলির কারণে শারীরিক ভাবে মসজিদের আশেপাশে নেমে অবস্থান নেওয়ার কোনো সুযোগ পায় নি সৌদি বাহিনী।এরপরের দিন কৌশলগত ভাবে আসেপাশের উচু অবস্থাপনা গুলোতে পাল্টা দূর পাল্লার বন্দুকবাজ মোতায়েন করে সৌদি বাহিনী।এইবার উচ্চ অবস্থান থেকে পাল্টা গুলি চালিয়ে অনেকটাই নিস্ক্রিয় করে ফেলতে পারে ওই দখলদার বাহিনীর স্নাইপার গুলো কে।একই সাথে আকাশ থেকে নিরীক্ষণের মাধ্যমে সৌদি বাহিনী জানতে পারে উত্তর ভাগের মারওয়া দরজা অপেক্ষাকৃত কম প্রতিরোধের জায়গা হতে পারে।
এই পর্যায়ে ২২ তারিখ,ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ, সৌদি গোলন্দাজরা কম মাপের বিস্ফোরক গোলা ছুড়তে থাকে,এটি স্রেফ ওই অবস্থানরত প্রতিরোধকারীদের নজর অন্যদিকে নিয়ে আরো একটি বাহিনীকে সাফা-মারওয়া পথের পূর্ব দিকে অবস্থান নিতে করা হয়েছিল।এই কাজে অর্ধেক পথ এগিয়ে গেলেও তীব্র গুলির কারণে বেশ কিছু সেনার মৃত্যু হলে বাহিনী আবার পিছু হটে যায়।একই ভাবে আগে বলা সেই মারওয়া দরজার দিকে বিস্ফোরক সহযোগে দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকতে পারলেও সফল হলো না।
ফতোয়ার জোরে নতুন শক্তি প্রাপ্তি:
অবশেষে,নভেম্বর ২৩তারিখে ইসলামের ইতিহাসে সূচনা থেকে এই প্রথম,জুম্মার নামাজ পড়া হলো না এই শীর্ষ মসজিদে।দিনের শেষে উলেমারা ফতোয়া দিলো “এই জঙ্গিদের অস্ত্র ত্যাগ করে আত্মসমর্পর্ন করার আবেদন করা হোক,তা না মানলে কোরানের আল বাকারাহর বিধান অনুযায়ী যদি আল মসজিদ আল হারাম এ আক্রমন না করার এবং যদি একান্তই আক্রান্ত হও তবে তাদের হত্যা করার আদেশের ভিত্তিতে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া হোক”
এইবার এই ফতোয়ার আনুকূল্যে একটা শক্ত অবস্থান পেলো সৌদিশক্তি।এতদিন বাইরে থেকে প্রত্যাঘাত করলেও এবার ধর্মীয় সমর্থনে ভিতরে মারার অধিকার একটা নির্দিস্ট দিক নির্দেশ দিলো।প্রথমে ওই ফতোয়ার নির্দেশ ধরে আত্মসমর্পর্ন করার কথা ঘোষনা করা হয়,কোনো সদুত্তর না পাওয়ার পরে মিনারগুলোতে রকেট নিক্ষেপ করা হয় উপরে থাকা দুরপাল্লার(স্নাইপার)রাইফেলধারী লোকদের নিস্ক্রিয় করতে।একই সাথে সেই আগের বলা সাফা-মারওয়া পথের বাইরের দিকের আগেই ভেঙ্গে দেওয়া দরজা দিয়ে গোলা দাগা শুরু করে।
অবশেষে,শনিবার, নভেম্বর ২৪ তারিখ এই সাফা মারওয়া পথের দখল নিতে পারে সৌদি বাহিনী।জুহাইমান আর তার দল উপরের অংশ থেকে পিছু হটে আশ্রয় নেয় মসজিদের মাটির নিচের ঘরগুলোতে।এই জায়গায় সর্বসাকুল্যে ২২৫টী ঘর পরস্পরের সাথে সংযোগ যুক্ত ছিল।পর্যাপ্ত অস্ত্র,গুলি আর প্রয়োজনীয় খাদ্য নিয়ে আরো এক সপ্তাহ লড়াই করার অবস্থায় ছিল বলে ধারণা করা হয়।বোমা,গুলি এমনকি নানান কার্পেট বা গাড়ির টায়ার পুড়িয়ে সব রকম ভাবে সৌদি বাহিনী কে বাধা দিয়ে যায় জুহাইমানের বাহিনী।এই সময়ে কাদানে গ্যাস দিয়ে এদের বের করে নিয়ে আসার কাজ ও ব্যর্থ হয়।ভূগর্ভে থাকার কারণে এই গ্যাস আবার মাটির উপরের দিকেই উঠতে থাকে আর এই লোকগুলো মুখে জলে ভিজানো কাপড় লাগিয়ে রাখার কারণে কোনো প্রতিকুল অবস্থায় পড়ে নি বরং উল্টে এই গ্যাস মাটির উপরে থাকা সৌদি বাহিনীর জন্য বিরূপ অবস্থা তৈরী করে।এই পর্যায়ে সমস্যা আরো প্রকট হয় কারণ মসজিদে নামাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গোটা মুসলিম বিশ্বে প্রভূত সম্মানহানি হতে থাকে।গোটা পৃথিবীর মুসলিম দেশগুলোতে এই আজান সম্প্রসার বা এর প্রতীকী একটি মূল্য ছিল যা ধাক্কা খায়। সৌদি শাসকদের অত্যন্ত অস্বস্তির কারণ হতে থাকে এই সময়টি। সৌদি শাসকের সেনা একের পর এক উপায়ে চেষ্টা করে যেতে থাকে এদের উৎখাত করতে তবে সফলতা পাচ্ছিল না এই অসংখ্য কক্ষ আর ভূগর্ভের কক্ষে এদের অবস্থানের কারণে।আরো একটি কারণ ছিল , সৌদি শাসক পাখির চোখের মতো লক্ষ্য করেছিল এদের পালের গোদা কে জীবন্ত ধরার জন্য।অতঃপর,এই অস্বস্তিকর অবস্থা এবং বিশ্বজুড়ে চাপ অবসান করতে সৌদি রাজা সাহায্যের জন্য ফরাসি রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করে।
পরবর্তী পর্বে এই দখলের অন্তিম পরিনতি এবং বিষ বৃক্ষের সূচনার প্রাসঙ্গিক কথা থাকবে।ততক্ষণ আবার একটি চা পানের বিরতি।
এই পর্বের তথ্যসূত্র:
১. ইতিহাসের পাতা থেকে https://medium.com/@haramainarchives/makkah-grand-mosque-seizure-1979-ae55625315a5
২. যে অসত্য খবর পরিবেশন করার পরে পৃথিবীতে এক নতুন অশান্তি শুরু হয়েছিল https://www.nytimes.com/1979/11/21/archives/mecca-mosque-seized-by-gunmen-believed-to-be-militants-from-iran.html
৩. স্রেফ ছবির হিসেবে দেখলেও পর্ব ধরে দেখতে পারেন এই প্রতিবেদন গুলো https://www.youtube.com/watch?v=Z7kzj-zPoOM
৪. একই ভাবে পরের পর্ব https://www.youtube.com/watch?v=JufzBz6gbnA
৫. তিন নম্বর পর্ব https://www.youtube.com/watch?v=oomQ6IyWyg4

Posted at April 18, 2019 |  by Arya ঋষি

0 Comments:

No photo description available.
এক বিষ বৃক্ষের সূচনা -১ম পর্ব 
মুখবন্ধ: আমরা অনেক কাছের বিষয় দেখি না বা ভুলে যাই।এই লেখাটি একটি ঐতিহাসিক তবে কালান্তক ঘটনার উপরে লেখা যা একটি দেশ বা গোটা পৃথিবীতে এক রক্ষণশীল ঘেরাটোপের সূচনা করেছিল। আসুন,জানি , ঠিক কি ছিল সেই ঘটনা। ইতিহাসের নিরিখে বেশি আগের নয় , স্রেফ চার দশকের আগে একটি ধর্মান্ধ মানুষ আর তার তৈরী একটি স্বশস্ত্র গোষ্ঠী আচমকা দখল নিয়েছিল কাবা এবং এর মধ্যে থাকা মসজিদ আর নানান স্থাপনাগুলো।এই ঘটনা ইসলামিক দুনিয়া তো বটেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা দুনিয়াকে।একই সাথে তুলনামূলক আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা সৌদি আরবকে পরিবর্তিত করেছিল একটি ধর্মের ঘেরাটোপে মধ্যযুগের একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়। সেই কলঙ্কিত দিনগুলোর শুরু হয় ২০শে নভেম্বর , ১৯৭৯ সালে।এই সময়ের এক মাস আগে ছিল হ্বজ এবং ঈদের উৎসবের সময়।দুনিয়ার নানান প্রান্ত থেকে আগত পুণ্যার্থী এবং আশেপাশের নানান দেশের অনেক শীর্ষস্থানীয় মানুষের সমাগম হয়েছিল ওই মাসে মানে অক্টবরে।পরের মাসেও প্রায় হাজার পঞ্চাশেক মানুষ ছিল এই কাবা প্রাঙ্গনে সকালের প্রথম প্রার্থনা মানে ফজরের নামাজের সময়ে।এই সময়েই দুশো অস্ত্রধারী লোকের সাথে এই পবিত্রতম স্থানের দখল নিয়েছিল চল্লিশ বছরের জুহাইমান আল উতায়বি।কাবা সংলগ্ন শীর্ষ মসজিদের ইমাম তার ফজরের নামাজ শেষ করার পরেই এই ঘটনা ঘটে। কি করে লোকটি এই ঘটনা ঘটিয়েছিল ? এই কাজের সুযোগ পেয়েছিল কারণ পঞ্চাশের দশক থেকেই এই স্থানের প্রসারণ এবং আরো মানুষের স্থান করে দিতে নানান প্রাসঙ্গিক নির্মাণের কাজ হচ্ছিল সেই প্রথম বাদশা সৌদ এর সময় থেকেই।ওই মাস সেই বছরের ইসলামী নতুন বছরের শুরুর কারণে আরো একটু বেশি নির্মাণের কাজ চলছিল।ঠিক এই সুযোগ নিয়েছিল এই দলটি। এই নতুন ইসলামী বছর মানে ১৪০০ উজ্জাপনের ধর্মীয় রীতির জন্য সৌদি এবং বিদেশী অনেক নাগরিক যখন ওই জায়গায় এসেছিল,ঠিক সেই সময়েই কয়েকটি ট্রাকে নির্মাণ শ্রমিকদের নিত্য আনাগোনার পথেই নজর এড়িয়ে মসজিদের ফাতাহ দরজা দিয়ে ঢুকে যায় এই দলটি।আল সুবাইল যিনি ওই সময়ের ইমামতি করতেন ,তার ভাষায় ,ফজরের নামাজ আদায়ের পরেই দেখতে পেলেন তার দিকে বিশ /তিরিশজন সশস্ত্র মানুষ এগিয়ে আসছে।আশংকা প্রবল হয়ে উঠলো যখন তিনি প্রাঙ্গনে বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পেলেন।এই পুরো জায়গাটি দখলের শুরুতেই দরজার দুজন লাঠি হাতে থাকা রক্ষী গুলিতে নিহত হলো এই সময়ে।এই আতংক আর হুড়োহুড়ির মধ্যেই বেশ কিছু মানুষ এই জায়গা থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো।এরপরেই এই দখলকারী বাহিনী বেরিয়ে যাওয়ার দরজা গুলো বন্ধ করে দিলো।এই পর্যায়ে তিনজন সশস্ত্র লোক ইমামের দিকে এগিয়ে এলো ,এদের একজন মানে জুহাইমান মাইক দখল করে নির্দেশ দিতে থাকলো তার সঙ্গের নানান অস্ত্রধারীদের। সব মিনারের উপরে বন্দুকধারী আর প্রত্যেক দরজায় একই ভাবে তাঁদের অবস্থান নিতে নির্দেশ দিলো সে। সোজা কথায় কেউ অগ্রসর হলেই গুলি করতে ফরমান জারি করে সে।এই দলটি তাদের অস্ত্র এবং অন্য গোলা বারুদ নিয়ে আসার জন্য ব্যবহার করেছিল কফিনের মধ্যে।এই জায়গাতে প্রায়শই মৃত মানুষের দেহ নিয়ে আসা হয় অন্তিম যাত্রার আগে মৃতের কল্যাণের জন্য। জুহাইমান এর পরে মাইক দেয় তার অপর সঙ্গী আরো এক ধর্মপ্রচারক খালেদ আল ইয়ামিকে।সে পূর্ব লিখিত ভাষণ থেকে মসজিদের মাইকে ঘোষণা করে তাদের সাথে আছে প্রত্যাশিত সেই ইমাম মেহেদী যার পরিচিত নাম মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল কাহ্তানী।এই বিষয়ে বলতে গিয়ে এও বলা হয় যে , সে কুরেশ বংশের এবং তার বাবা এবং মা আশরাফ।একই সাথে এর বংশপরিচয়ে নবী মোহাম্মদের সঙ্গী এবং আত্মীয় আর অন্যতম খলিফা আলীর এবং ফাতেমার ঔরসজাত সন্তানের ধারক ও বলা হয়।এই গুণাবলী গুলি প্রত্যাশিত ইমাম মেহেদির থাকার কথা যা এই মানুষটির আছে এই ছিল মূল দাবি।এই পর্যায়ে বলতে ইচ্ছে হয় , সব জায়গায় সেই একই উচ্চ বংশ এবং শ্রেণী বিভাজনের জন্য আলাদা ব্যবস্থার কথা দেখা যায়,কোনো ব্যতিক্রম নেই !এই সঙ্গে বলা হয় তাঁরা এক পরিচ্ছন্ন দুনিয়া বিশেষতঃ কুশাসন মুক্ত সৌদি প্রশাসনের জন্য এসেছে।একই সাথে তৎকালীন সৌদি রাজতন্ত্র এবং উলেমা এবং অন্য ইসলামী ধর্মীয় গুরু যাঁরা সৌদি সমাজে স্বীকৃত ছিল তাদের উৎখাত এবং তাদের নির্দেশাবলী কে নস্যাৎ করার কথাও বলে।উপস্থিত সব মানুষকে তাঁদের ঘোষিত মেহেদির আনুগত্য জানাতে আহ্বান ও জানানো হয় একই সাথে।তাদের এই কার্যাবলী সবই মানুষকে কোরান এবং হাদিসের পথে নিয়ে যাওয়ার তাই কোনো অন্যায় করতে তাঁরা আসেনি,এই ছিল ভাষণের মূল বক্তব্য। এই মেহেদির আবির্ভাব একটি অত্যাশ্চর্য ঘোষণা ছিল ওই মসজিদ চত্বরে উপস্থিত সব পুণ্যার্থীর জন্য। যারা জানেন না তাঁদের জন্য বলে রাখি , এই ইমাম মেহেদির আগমন কেয়ামতের আগে ঘটবে এবং এক সার্বিক যুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীতে আবার অন্যায় ,অবিচার ইত্যাদি মিটিয়ে শোষণ নির্যাতন দূর করে এক সুবর্ন যুগের সূচনার কথা ইসলামী হাদিসে বলা আছে। এই আবির্ভাব হওয়ার কথা নবী মোহাম্মদ বলেছে বলেই বলা হয় আর তাই এই ঘোষণা এক অভূতপূর্ব চাঞ্চল্য তৈরী করে ওই জায়গায় থাকা সবার কাছেই। এই ঘটনার মূল চক্রী জুহাইমান এরপরে নাটকীয় ভাবে সবার সামনে তুলে ধরা সেই মেহেদীকে সর্বপ্রথম শ্রদ্ধা জানায় আর তারপরেই তার দলের "আল্লাহ আকবর " উল্লাস ধ্বনি শোনা যায়।এক সার্বিক অচলাবস্থার সূচনা হয়।এই পুণ্যার্থীদের একটি বড় অংশ ছিল বিদেশী এবং তাঁরা আরবি সে ভাবে জানতো না। এই কারণে ঠিক কি হচ্ছে তা বুঝে উঠতে পারে নি। এর সাথে এই সর্বাধিক পবিত্র জায়গায় নিষিদ্ধ ছিল কোনো অস্ত্র বহন করা তাই এতো অস্ত্রধারী আর এই সব কান্ড দেখে তাঁরা হতচকিত হয়ে যায়।সত্যি বলতে কাবাতে ওই সময়ে অস্ত্রের প্রবেশ এতোটাই নিষিদ্ধ ছিল যে মূল দরজার রক্ষীদের হাতেও স্রেফ লাঠি থাকতো। এই প্রবল বিশৃঙ্খলার মধ্যে ইমাম কোনক্রমে তার মসজিদের অফিসে ঢুকে যেতে তার উর্দ্ধতন কর্তিপক্ষ শেখ নাসের বিন হামাদ আল রাশিদ যিনি ওই সময়ের প্রাসঙ্গিক বিষয়ের কর্তা ছিলেন তাকে ফোনে বিষয়টি জানান,একই সাথে আসেপাশে হওয়া ঘটনার গুরুত্ব বুঝাতে ফোনটি ধরে রাখে যাতে বন্দুকের আওয়াজ শোনানো যায়।এরপরে তিনি খেয়াল করেন এই দখলদারের দল বিদেশী পূন্যার্থীদের চলে যেতে দিচ্ছে তবে আরব বিশেষত সৌদি নাগরিকদের না।ঘন্টা চারেক অপেক্ষা করে নিজের নির্দিস্ট ইমামতির পোশাক ছেড়ে সাধারণ পোশাকে ভূগর্ভস্থ দরজা দিয়ে ইন্দোনেশীয় তীর্থযাত্রীদের সাথে বাইরে চলে আসতে স্বক্ষম হন। স্রেফ এক ঘন্টার মধ্যেই এই দলটি পুরো কাবা এবং সংলগ্ন পুরো জায়গাটি দখল করে নিয়ে সোজাসুজি সৌদি রাজার মানে রাজশক্তির জন্য অতীব বিপদজনক সংকেত তৈরী করে দিলো।এই দখলদারি করা লোকগুলো একটি সংগঠন তৈরী করেছিল এর আগে যার নাম আল-জামা আল-সালাফিয়া আল মুহতাসিবা বা JSM যেটির মূল দাবি ছিল ইসলামী পথে তৎকালীন সৌদি আরব কে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। সোজা কথায় একটি পুরো দস্তুর ধর্মীয় পথে রাষ্ট্রের চালনা এবং তৎকালীন শাসকের অপসারণ। মূল ঘটনার পূর্বাপর বৃত্তান্ত তিরিশের দশকের পর থেকে তেলের টাকার কারণে একটা অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক আর সামাজিক পটপরিবর্তন শুরু হয়েছিল গোটা আরব অঞ্চলে। নানান ভোগের সামগ্রী অতি সুলভ আর ক্রমশঃ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো নারী পুরুষের সামাজিক মেলামেশা ইত্যাদি নানান নতুন বস্তুর প্রচলন এক শ্রেণীর মৌলবাদী আর প্রাচীন পন্থী মানুষের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল।এই সময়ে এই জেএসএম নামের দল বা এদের সমর্থক গোষ্ঠী সেই পুরোনো ধাঁচে কোরান পাঠ ,হাদিসের বা প্রাসঙ্গিক পথেই চলার কাজ করে চলেছিল। এদের কাছে সৌদি রাজার কোনো অনুশাসনের বদলে স্রেফ কোরানের বাক্য ধরে চলার পথ গ্রহণীয় হয়েছিল।এক কথায়,সৌদি রাজতন্ত্রের কোনো অনুশাসন তাদের কাছে গ্রাহ্য ছিল না।দলের তরুণ নেতৃত্ব দেওয়া জুহাইমান সৌদি আরবের সাজির বলে একটি অঞ্চলের বেদুঈন পরিবারের সন্তান ছিল।তাঁর প্রথম জীবনের সৌদি রাজার সেনাদলের কাজের অভিজ্ঞতা এই অভিযানের জন্য কাজে লেগেছিল।এক পর্যায়ে সেনার চাকরি থেকে বেরিয়ে এসে এই কাজে যোগ দেয় এই লোকটি। দিনের পর দিন নিজের এলাকাতে মরুভূমির রাতের আসরে নিজের আগের জীবনের পথ ভুল ইত্যাদি বলে সঠিক পথ দেখানোর এই ধর্মীয় কথা বলে গিয়েছিল অসংখ্য নিজের গোষ্ঠীর লোকেদের কাছে।এই ভাবে সে ব্যক্তিগত অনুসারীর দল ও তৈরী করে ফেলেছিল। তার এই ধর্মীয় বয়ান বা নানান প্রাসঙ্গিক আসরের প্রত্যক্ষদর্শী ওসামা আল কোয়াশি ,যে নিজেও একটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিল ,বলেছিল যে জুহাইমান এই সময়ে বেআইনি নেশার বস্তু চোরাচালানের কাজ ও করছিল।ক্রমশঃ এক বড় সংখ্যক অল্পবয়েসী ছেলেদের আকর্ষিত করে তাঁর অনুসারী করে ফেলে।একটিই জায়গায় তার খামতি ছিল যা হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এমনকি অন্য আর পাঁচটি ধর্মীয় গুরুর মতো প্রাসঙ্গিক পড়াশোনাতে। এই প্রসঙ্গে তার এক সময়ের অনুসারী নাসের আল হজেইমির বয়ানে জানা যায় যে লোকটি মুলত প্রত্যন্ত বেদুইন অঞ্চলেই নিজের প্রচার করতো যেহেতু তার নিজের ভাষা মানে আরবির ধাঁচ ছিল তাঁদের মতো।শহরের বিশেষতঃ বুনিয়াদি আরবি ভাষাতে তাঁর দখল কম থাকায় কোনো শহরের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় স্থানে নিজের বক্তব্য রাখতে যায় নি।এই কাজ করতে গেলে তাঁর ওই শ্রোতাদের কাছে সম্ভ্রম বা শ্রদ্ধা আদায় করা সম্ভব হতো না ওটা সে নিজেও বুঝেছিল। এই ইমাম মেহেদী মোহ নিয়ে ওই সময়ের সৌদি রাষ্ট্রীয় নজরদারি বিভাগ বা ইন্টালিজেন্সির প্রধান তুর্কি আল ফায়সাল পরবর্তীতে একটি স্বাক্ষাৎকারে জানিয়েছিল যে এই গোষ্ঠীতে অসংখ্য ছাত্র ছিল যাঁরা এই মেহেদির আবির্ভাব কে আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করতো।প্রাথমিক পর্যায়ে কাবা এবং গোটা সৌদি আরবের ক্ষমতা দখল এবং পরবর্তীতে গোটা ইসলামী দুনিয়ায় নেতৃত্ব করা একটি প্রবল বাসনা ছিল এই দলটির।পাঠক,আল কায়দা বা আইসিস এর সাথে অনেকটাই মিল পাচ্ছেন কি ? যাইহোক ,একটা মজার বিষয় দেখুন , এই একই ভাবে প্রায় সব প্রচলিত ধর্মেই একজন পরিত্রাতা অন্তে আসার কথা বলা হয়েছে যে এই ধরিত্রীর সব পাপ বা ক্লেশ ইত্যাদি দূর করে একটি কাঙ্খিত যুগের সূচনা করবে। এই ক্ষেত্রেও কোনো ব্যতিক্রম নেই ,এক বহু যুগের এই আকাঙ্খা কে পুঁজি করে অনেক লোক এই কাজ করেছে।মুসলিম সমাজেও নানান দেশে এই কাজ আগেও হয়েছে।ঊনবিংশ শতকে মোহাম্মদ আহমেদ নামের এক সুদানিস শেখ ১৮৮১তে এই ধরণের একটি উত্থানের কাজ করতে গিয়েছিল তৎকালীন মিশরীয় পরাধীনতায় থাকা শাসকের বিরুদ্ধে। মজার কথা হলো এই মেহেদির কোনো প্রসঙ্গ কোরানে কিন্তু নেই।কেয়ামতের মানে শেষ দিনের আগে এই ধরণের ঘটনার আভাস থাকলেও হাদিস বর্ণিত কোনো ঘটনার বিষয় নেই বলেই মতামত দিয়েছে ইসলামের নানান পন্ডিত মহল।সে যে যাই বলুক,জুহাইমান এই মেহেদী বলে কাঙ্খিত মানুষের ভিত্তিতে এক বড় সংখ্যক অনুসারীর দল বানিয়ে ফেলেছিল।এই অনুসারীদের নিয়ে একটি নিকটস্থ মসজিদে এক জায়গায় হয় এই অভিযানের তিনদিন আগে।এই প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক নানান স্বাক্ষাতকারে দেখতে পাই এই অনুসারীদের প্রাক্তন কয়েকজন সদস্য এই গোষ্ঠিকে সালাফি আন্দোলনের একটি ধারা বলেছে,যাদের প্রবীন মাথাদের সরিয়ে এই নতুন প্রজন্মের দল পুরো নেতৃত্ব হাতে নিয়েছিল জুহাইমানের নেতৃত্বে। পরবর্তী পর্বে থাকবে এক চলমান পনেরো দিনের ক্রমাগত লড়াই এবং বিশ্ব রাজনীতিতে বিবিধ দোলাচল আর অন্য প্রাসঙ্গিক বিষয়-ততক্ষণ একটু চা পানের বিরতি  তথ্যসূত্র : ১. আলোচিত বইটির লেখকের একটি স্বাক্ষাতকার দেখুন 

https://www.youtube.com/watch?v=1hNjJY1OXmM ২. যারা বিষয়টি প্রতিবেদনের আকারে দেখতে চাইছেন তাদের জন্য https://www.youtube.com/watch?v=HItn3u02RwU ৩. নির্মোহ তবে আংশিক একটি প্রতিবেদন https://www.bbc.com/news/stories-50852379 ৪.  আরো একটি ভালো প্রতিবেদন  https://www.arabnews.com/node/1371221/saudi-arabia ৫. মূল বইটির লেখকের একটি স্বাক্ষাতকার এবং ঘটনার বিবরণ জানতে পারেন এই সুত্রে https://www.npr.org/templates/story/story.php?storyId=112051155

কাবা এবং মসজিদ আল হারাম দখলের কালান্তক ইতিহাসঃ-১ম পর্ব

No photo description available.
এক বিষ বৃক্ষের সূচনা -১ম পর্ব 
মুখবন্ধ: আমরা অনেক কাছের বিষয় দেখি না বা ভুলে যাই।এই লেখাটি একটি ঐতিহাসিক তবে কালান্তক ঘটনার উপরে লেখা যা একটি দেশ বা গোটা পৃথিবীতে এক রক্ষণশীল ঘেরাটোপের সূচনা করেছিল। আসুন,জানি , ঠিক কি ছিল সেই ঘটনা। ইতিহাসের নিরিখে বেশি আগের নয় , স্রেফ চার দশকের আগে একটি ধর্মান্ধ মানুষ আর তার তৈরী একটি স্বশস্ত্র গোষ্ঠী আচমকা দখল নিয়েছিল কাবা এবং এর মধ্যে থাকা মসজিদ আর নানান স্থাপনাগুলো।এই ঘটনা ইসলামিক দুনিয়া তো বটেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা দুনিয়াকে।একই সাথে তুলনামূলক আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা সৌদি আরবকে পরিবর্তিত করেছিল একটি ধর্মের ঘেরাটোপে মধ্যযুগের একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়। সেই কলঙ্কিত দিনগুলোর শুরু হয় ২০শে নভেম্বর , ১৯৭৯ সালে।এই সময়ের এক মাস আগে ছিল হ্বজ এবং ঈদের উৎসবের সময়।দুনিয়ার নানান প্রান্ত থেকে আগত পুণ্যার্থী এবং আশেপাশের নানান দেশের অনেক শীর্ষস্থানীয় মানুষের সমাগম হয়েছিল ওই মাসে মানে অক্টবরে।পরের মাসেও প্রায় হাজার পঞ্চাশেক মানুষ ছিল এই কাবা প্রাঙ্গনে সকালের প্রথম প্রার্থনা মানে ফজরের নামাজের সময়ে।এই সময়েই দুশো অস্ত্রধারী লোকের সাথে এই পবিত্রতম স্থানের দখল নিয়েছিল চল্লিশ বছরের জুহাইমান আল উতায়বি।কাবা সংলগ্ন শীর্ষ মসজিদের ইমাম তার ফজরের নামাজ শেষ করার পরেই এই ঘটনা ঘটে। কি করে লোকটি এই ঘটনা ঘটিয়েছিল ? এই কাজের সুযোগ পেয়েছিল কারণ পঞ্চাশের দশক থেকেই এই স্থানের প্রসারণ এবং আরো মানুষের স্থান করে দিতে নানান প্রাসঙ্গিক নির্মাণের কাজ হচ্ছিল সেই প্রথম বাদশা সৌদ এর সময় থেকেই।ওই মাস সেই বছরের ইসলামী নতুন বছরের শুরুর কারণে আরো একটু বেশি নির্মাণের কাজ চলছিল।ঠিক এই সুযোগ নিয়েছিল এই দলটি। এই নতুন ইসলামী বছর মানে ১৪০০ উজ্জাপনের ধর্মীয় রীতির জন্য সৌদি এবং বিদেশী অনেক নাগরিক যখন ওই জায়গায় এসেছিল,ঠিক সেই সময়েই কয়েকটি ট্রাকে নির্মাণ শ্রমিকদের নিত্য আনাগোনার পথেই নজর এড়িয়ে মসজিদের ফাতাহ দরজা দিয়ে ঢুকে যায় এই দলটি।আল সুবাইল যিনি ওই সময়ের ইমামতি করতেন ,তার ভাষায় ,ফজরের নামাজ আদায়ের পরেই দেখতে পেলেন তার দিকে বিশ /তিরিশজন সশস্ত্র মানুষ এগিয়ে আসছে।আশংকা প্রবল হয়ে উঠলো যখন তিনি প্রাঙ্গনে বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পেলেন।এই পুরো জায়গাটি দখলের শুরুতেই দরজার দুজন লাঠি হাতে থাকা রক্ষী গুলিতে নিহত হলো এই সময়ে।এই আতংক আর হুড়োহুড়ির মধ্যেই বেশ কিছু মানুষ এই জায়গা থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো।এরপরেই এই দখলকারী বাহিনী বেরিয়ে যাওয়ার দরজা গুলো বন্ধ করে দিলো।এই পর্যায়ে তিনজন সশস্ত্র লোক ইমামের দিকে এগিয়ে এলো ,এদের একজন মানে জুহাইমান মাইক দখল করে নির্দেশ দিতে থাকলো তার সঙ্গের নানান অস্ত্রধারীদের। সব মিনারের উপরে বন্দুকধারী আর প্রত্যেক দরজায় একই ভাবে তাঁদের অবস্থান নিতে নির্দেশ দিলো সে। সোজা কথায় কেউ অগ্রসর হলেই গুলি করতে ফরমান জারি করে সে।এই দলটি তাদের অস্ত্র এবং অন্য গোলা বারুদ নিয়ে আসার জন্য ব্যবহার করেছিল কফিনের মধ্যে।এই জায়গাতে প্রায়শই মৃত মানুষের দেহ নিয়ে আসা হয় অন্তিম যাত্রার আগে মৃতের কল্যাণের জন্য। জুহাইমান এর পরে মাইক দেয় তার অপর সঙ্গী আরো এক ধর্মপ্রচারক খালেদ আল ইয়ামিকে।সে পূর্ব লিখিত ভাষণ থেকে মসজিদের মাইকে ঘোষণা করে তাদের সাথে আছে প্রত্যাশিত সেই ইমাম মেহেদী যার পরিচিত নাম মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল কাহ্তানী।এই বিষয়ে বলতে গিয়ে এও বলা হয় যে , সে কুরেশ বংশের এবং তার বাবা এবং মা আশরাফ।একই সাথে এর বংশপরিচয়ে নবী মোহাম্মদের সঙ্গী এবং আত্মীয় আর অন্যতম খলিফা আলীর এবং ফাতেমার ঔরসজাত সন্তানের ধারক ও বলা হয়।এই গুণাবলী গুলি প্রত্যাশিত ইমাম মেহেদির থাকার কথা যা এই মানুষটির আছে এই ছিল মূল দাবি।এই পর্যায়ে বলতে ইচ্ছে হয় , সব জায়গায় সেই একই উচ্চ বংশ এবং শ্রেণী বিভাজনের জন্য আলাদা ব্যবস্থার কথা দেখা যায়,কোনো ব্যতিক্রম নেই !এই সঙ্গে বলা হয় তাঁরা এক পরিচ্ছন্ন দুনিয়া বিশেষতঃ কুশাসন মুক্ত সৌদি প্রশাসনের জন্য এসেছে।একই সাথে তৎকালীন সৌদি রাজতন্ত্র এবং উলেমা এবং অন্য ইসলামী ধর্মীয় গুরু যাঁরা সৌদি সমাজে স্বীকৃত ছিল তাদের উৎখাত এবং তাদের নির্দেশাবলী কে নস্যাৎ করার কথাও বলে।উপস্থিত সব মানুষকে তাঁদের ঘোষিত মেহেদির আনুগত্য জানাতে আহ্বান ও জানানো হয় একই সাথে।তাদের এই কার্যাবলী সবই মানুষকে কোরান এবং হাদিসের পথে নিয়ে যাওয়ার তাই কোনো অন্যায় করতে তাঁরা আসেনি,এই ছিল ভাষণের মূল বক্তব্য। এই মেহেদির আবির্ভাব একটি অত্যাশ্চর্য ঘোষণা ছিল ওই মসজিদ চত্বরে উপস্থিত সব পুণ্যার্থীর জন্য। যারা জানেন না তাঁদের জন্য বলে রাখি , এই ইমাম মেহেদির আগমন কেয়ামতের আগে ঘটবে এবং এক সার্বিক যুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীতে আবার অন্যায় ,অবিচার ইত্যাদি মিটিয়ে শোষণ নির্যাতন দূর করে এক সুবর্ন যুগের সূচনার কথা ইসলামী হাদিসে বলা আছে। এই আবির্ভাব হওয়ার কথা নবী মোহাম্মদ বলেছে বলেই বলা হয় আর তাই এই ঘোষণা এক অভূতপূর্ব চাঞ্চল্য তৈরী করে ওই জায়গায় থাকা সবার কাছেই। এই ঘটনার মূল চক্রী জুহাইমান এরপরে নাটকীয় ভাবে সবার সামনে তুলে ধরা সেই মেহেদীকে সর্বপ্রথম শ্রদ্ধা জানায় আর তারপরেই তার দলের "আল্লাহ আকবর " উল্লাস ধ্বনি শোনা যায়।এক সার্বিক অচলাবস্থার সূচনা হয়।এই পুণ্যার্থীদের একটি বড় অংশ ছিল বিদেশী এবং তাঁরা আরবি সে ভাবে জানতো না। এই কারণে ঠিক কি হচ্ছে তা বুঝে উঠতে পারে নি। এর সাথে এই সর্বাধিক পবিত্র জায়গায় নিষিদ্ধ ছিল কোনো অস্ত্র বহন করা তাই এতো অস্ত্রধারী আর এই সব কান্ড দেখে তাঁরা হতচকিত হয়ে যায়।সত্যি বলতে কাবাতে ওই সময়ে অস্ত্রের প্রবেশ এতোটাই নিষিদ্ধ ছিল যে মূল দরজার রক্ষীদের হাতেও স্রেফ লাঠি থাকতো। এই প্রবল বিশৃঙ্খলার মধ্যে ইমাম কোনক্রমে তার মসজিদের অফিসে ঢুকে যেতে তার উর্দ্ধতন কর্তিপক্ষ শেখ নাসের বিন হামাদ আল রাশিদ যিনি ওই সময়ের প্রাসঙ্গিক বিষয়ের কর্তা ছিলেন তাকে ফোনে বিষয়টি জানান,একই সাথে আসেপাশে হওয়া ঘটনার গুরুত্ব বুঝাতে ফোনটি ধরে রাখে যাতে বন্দুকের আওয়াজ শোনানো যায়।এরপরে তিনি খেয়াল করেন এই দখলদারের দল বিদেশী পূন্যার্থীদের চলে যেতে দিচ্ছে তবে আরব বিশেষত সৌদি নাগরিকদের না।ঘন্টা চারেক অপেক্ষা করে নিজের নির্দিস্ট ইমামতির পোশাক ছেড়ে সাধারণ পোশাকে ভূগর্ভস্থ দরজা দিয়ে ইন্দোনেশীয় তীর্থযাত্রীদের সাথে বাইরে চলে আসতে স্বক্ষম হন। স্রেফ এক ঘন্টার মধ্যেই এই দলটি পুরো কাবা এবং সংলগ্ন পুরো জায়গাটি দখল করে নিয়ে সোজাসুজি সৌদি রাজার মানে রাজশক্তির জন্য অতীব বিপদজনক সংকেত তৈরী করে দিলো।এই দখলদারি করা লোকগুলো একটি সংগঠন তৈরী করেছিল এর আগে যার নাম আল-জামা আল-সালাফিয়া আল মুহতাসিবা বা JSM যেটির মূল দাবি ছিল ইসলামী পথে তৎকালীন সৌদি আরব কে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। সোজা কথায় একটি পুরো দস্তুর ধর্মীয় পথে রাষ্ট্রের চালনা এবং তৎকালীন শাসকের অপসারণ। মূল ঘটনার পূর্বাপর বৃত্তান্ত তিরিশের দশকের পর থেকে তেলের টাকার কারণে একটা অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক আর সামাজিক পটপরিবর্তন শুরু হয়েছিল গোটা আরব অঞ্চলে। নানান ভোগের সামগ্রী অতি সুলভ আর ক্রমশঃ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো নারী পুরুষের সামাজিক মেলামেশা ইত্যাদি নানান নতুন বস্তুর প্রচলন এক শ্রেণীর মৌলবাদী আর প্রাচীন পন্থী মানুষের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল।এই সময়ে এই জেএসএম নামের দল বা এদের সমর্থক গোষ্ঠী সেই পুরোনো ধাঁচে কোরান পাঠ ,হাদিসের বা প্রাসঙ্গিক পথেই চলার কাজ করে চলেছিল। এদের কাছে সৌদি রাজার কোনো অনুশাসনের বদলে স্রেফ কোরানের বাক্য ধরে চলার পথ গ্রহণীয় হয়েছিল।এক কথায়,সৌদি রাজতন্ত্রের কোনো অনুশাসন তাদের কাছে গ্রাহ্য ছিল না।দলের তরুণ নেতৃত্ব দেওয়া জুহাইমান সৌদি আরবের সাজির বলে একটি অঞ্চলের বেদুঈন পরিবারের সন্তান ছিল।তাঁর প্রথম জীবনের সৌদি রাজার সেনাদলের কাজের অভিজ্ঞতা এই অভিযানের জন্য কাজে লেগেছিল।এক পর্যায়ে সেনার চাকরি থেকে বেরিয়ে এসে এই কাজে যোগ দেয় এই লোকটি। দিনের পর দিন নিজের এলাকাতে মরুভূমির রাতের আসরে নিজের আগের জীবনের পথ ভুল ইত্যাদি বলে সঠিক পথ দেখানোর এই ধর্মীয় কথা বলে গিয়েছিল অসংখ্য নিজের গোষ্ঠীর লোকেদের কাছে।এই ভাবে সে ব্যক্তিগত অনুসারীর দল ও তৈরী করে ফেলেছিল। তার এই ধর্মীয় বয়ান বা নানান প্রাসঙ্গিক আসরের প্রত্যক্ষদর্শী ওসামা আল কোয়াশি ,যে নিজেও একটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিল ,বলেছিল যে জুহাইমান এই সময়ে বেআইনি নেশার বস্তু চোরাচালানের কাজ ও করছিল।ক্রমশঃ এক বড় সংখ্যক অল্পবয়েসী ছেলেদের আকর্ষিত করে তাঁর অনুসারী করে ফেলে।একটিই জায়গায় তার খামতি ছিল যা হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এমনকি অন্য আর পাঁচটি ধর্মীয় গুরুর মতো প্রাসঙ্গিক পড়াশোনাতে। এই প্রসঙ্গে তার এক সময়ের অনুসারী নাসের আল হজেইমির বয়ানে জানা যায় যে লোকটি মুলত প্রত্যন্ত বেদুইন অঞ্চলেই নিজের প্রচার করতো যেহেতু তার নিজের ভাষা মানে আরবির ধাঁচ ছিল তাঁদের মতো।শহরের বিশেষতঃ বুনিয়াদি আরবি ভাষাতে তাঁর দখল কম থাকায় কোনো শহরের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় স্থানে নিজের বক্তব্য রাখতে যায় নি।এই কাজ করতে গেলে তাঁর ওই শ্রোতাদের কাছে সম্ভ্রম বা শ্রদ্ধা আদায় করা সম্ভব হতো না ওটা সে নিজেও বুঝেছিল। এই ইমাম মেহেদী মোহ নিয়ে ওই সময়ের সৌদি রাষ্ট্রীয় নজরদারি বিভাগ বা ইন্টালিজেন্সির প্রধান তুর্কি আল ফায়সাল পরবর্তীতে একটি স্বাক্ষাৎকারে জানিয়েছিল যে এই গোষ্ঠীতে অসংখ্য ছাত্র ছিল যাঁরা এই মেহেদির আবির্ভাব কে আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করতো।প্রাথমিক পর্যায়ে কাবা এবং গোটা সৌদি আরবের ক্ষমতা দখল এবং পরবর্তীতে গোটা ইসলামী দুনিয়ায় নেতৃত্ব করা একটি প্রবল বাসনা ছিল এই দলটির।পাঠক,আল কায়দা বা আইসিস এর সাথে অনেকটাই মিল পাচ্ছেন কি ? যাইহোক ,একটা মজার বিষয় দেখুন , এই একই ভাবে প্রায় সব প্রচলিত ধর্মেই একজন পরিত্রাতা অন্তে আসার কথা বলা হয়েছে যে এই ধরিত্রীর সব পাপ বা ক্লেশ ইত্যাদি দূর করে একটি কাঙ্খিত যুগের সূচনা করবে। এই ক্ষেত্রেও কোনো ব্যতিক্রম নেই ,এক বহু যুগের এই আকাঙ্খা কে পুঁজি করে অনেক লোক এই কাজ করেছে।মুসলিম সমাজেও নানান দেশে এই কাজ আগেও হয়েছে।ঊনবিংশ শতকে মোহাম্মদ আহমেদ নামের এক সুদানিস শেখ ১৮৮১তে এই ধরণের একটি উত্থানের কাজ করতে গিয়েছিল তৎকালীন মিশরীয় পরাধীনতায় থাকা শাসকের বিরুদ্ধে। মজার কথা হলো এই মেহেদির কোনো প্রসঙ্গ কোরানে কিন্তু নেই।কেয়ামতের মানে শেষ দিনের আগে এই ধরণের ঘটনার আভাস থাকলেও হাদিস বর্ণিত কোনো ঘটনার বিষয় নেই বলেই মতামত দিয়েছে ইসলামের নানান পন্ডিত মহল।সে যে যাই বলুক,জুহাইমান এই মেহেদী বলে কাঙ্খিত মানুষের ভিত্তিতে এক বড় সংখ্যক অনুসারীর দল বানিয়ে ফেলেছিল।এই অনুসারীদের নিয়ে একটি নিকটস্থ মসজিদে এক জায়গায় হয় এই অভিযানের তিনদিন আগে।এই প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক নানান স্বাক্ষাতকারে দেখতে পাই এই অনুসারীদের প্রাক্তন কয়েকজন সদস্য এই গোষ্ঠিকে সালাফি আন্দোলনের একটি ধারা বলেছে,যাদের প্রবীন মাথাদের সরিয়ে এই নতুন প্রজন্মের দল পুরো নেতৃত্ব হাতে নিয়েছিল জুহাইমানের নেতৃত্বে। পরবর্তী পর্বে থাকবে এক চলমান পনেরো দিনের ক্রমাগত লড়াই এবং বিশ্ব রাজনীতিতে বিবিধ দোলাচল আর অন্য প্রাসঙ্গিক বিষয়-ততক্ষণ একটু চা পানের বিরতি  তথ্যসূত্র : ১. আলোচিত বইটির লেখকের একটি স্বাক্ষাতকার দেখুন 

https://www.youtube.com/watch?v=1hNjJY1OXmM ২. যারা বিষয়টি প্রতিবেদনের আকারে দেখতে চাইছেন তাদের জন্য https://www.youtube.com/watch?v=HItn3u02RwU ৩. নির্মোহ তবে আংশিক একটি প্রতিবেদন https://www.bbc.com/news/stories-50852379 ৪.  আরো একটি ভালো প্রতিবেদন  https://www.arabnews.com/node/1371221/saudi-arabia ৫. মূল বইটির লেখকের একটি স্বাক্ষাতকার এবং ঘটনার বিবরণ জানতে পারেন এই সুত্রে https://www.npr.org/templates/story/story.php?storyId=112051155

Posted at March 12, 2019 |  by Arya ঋষি

0 Comments:

Tags

Text Widget

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipisicing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation test link ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat.

Blog Archive

© 2013 Arya Rishi. WP Theme-junkie converted by Bloggertheme9Published..Blogger Templates
Blogger templates. Proudly Powered by Blogger.
back to top