All Stories


—॰ ইফকের ঘটনা ॰—

আবদুল আযীয ইবনে আবদুল্লাহ রহ………..উরওয়া ইবনে যুবাইর, সাঈদ ইবনে মুসায়্যিব, আলকামা ইবনে ওয়াক্কাস ও উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবা ইবনে মাসউদ রা. সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিণী আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, যখন অপবাদ রটনাকারীগণ তাঁর প্রতি অপবাদ রটিয়েছিল রাবী যুহরী রহ. বলেন, তারা প্রত্যেকেই হাদীসটির অংশবিশেষ আমার কাছে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি স্মরণ রাখা ও সঠিকভাবে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে তাদের কেউ কেউ একে অন্যের চেয়ে অধিকতর অগ্রগামী ও নির্ভরযোগ্য। আয়েশা রা. সম্পর্কে তারা আমার কাছে যা বর্ণনা করেছেন আমি তাদের প্রত্যেকের কথাই যথাযথভাবে স্মরণ রেখেছি। তাদের একজনের বর্ণিত হাদীসের অংশবিশেষ অপরের বর্ণিত হাদীসের অংশবিশেষের সত্যতা প্রমাণ করে। যদিও তাদের একজন অন্যজনের চেয়ে অধিক স্মৃতিশক্তির অধিকারী। রাবীগণ বলেন:

আয়েশা রা. বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সফরের ইচ্ছা করতেন তখন তিনি তাঁর স্ত্রীগণের (নামের জন্য) কোরা ব্যবহার করতেন। এতে যার নাম আসত তাকেই তিনি সাথে করে সফরে বের হতেন। আয়েশা রা. বলেন, এমনি এক যুদ্ধে (মুরায়সীর যুদ্ধ) তিনি আমাদের মাঝে কোরা ব্যবহার করেন, এতে আমার নাম বেরিয়ে আসে। তাই আমিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সফরে বের হলাম। এ ঘটনাটি পর্দার হুকুম নাযিল হওয়ার পর সংঘটিত হয়েছিল। তখন আমাকে হাওদাজ সহ সাওয়ারীতে উটানো ও নামানো হত। এমনি করে আমরা চলতে থাকলাম। অবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ যুদ্ধ থেকে অবসর হলেন, তখন তিনি (বাড়ির দিকে) ফিরলেন। ফেরার পথে আমরা মদীনার নিকটবর্তী হলে তিনি একদিন রাতের বেলা রওয়ানা হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। রওয়ানা হওয়ার ঘোষণার পর আমি উঠলাম এবং (প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য) পায়ে হেটে সেনাছাউনী অতিক্রম করে (একটু সামনে) গেলাম। এরপর প্রয়োজন সেরে আমি আমার সাওয়ারীর কাছে ফিরে এসে বুকে হাত দিয়ে দেখলাম যে, (ইয়ামানের অন্তর্গত) যিফার শহরের পুতি দ্বারা তৈরী করা আমার গলার হারটি ছিড়ে কোথায় পড়ে গিয়েছে। তাই আমি ফিরে গিয়ে আমার হারটি তালাশ করতে আরম্ভ করলাম। হার তালাশ করতে করতে আমার আসতে বিলম্ব হয়ে যায়।

আয়েশা রা. বলেন, যে সমস্ত লোক উটের পিঠে আমাকে উঠিয়ে দিতেন তারা এসে আমার হাওদাজ উঠিয়ে তা আমার উটের পিঠে তুলে দিলেন, যার উপর আরোহণ করতাম। তারা মনে করেছিলেন যে, আমি এর মধ্যে আছি, কারণ খাদ্যভাবে মহিলাগণ তখন খুবই হালকা পাতলা হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের দেহ মাংসল ছিলনা। তাঁরা খুবই স্বল্প পরিমাণ খানা খেতে পেত। তাই তারা যখন হাওদাজ উঠিয়ে উপরে রাখেন তখন তখন তা হালকা হওয়ার বিষয়টিকে কোন প্রকার অস্বাভাবিক মনে করেননি। অধিকন্তু আমি ছিলাম একজন অল্প বয়স্কা কিশোরী। এরপর তারা উট হাঁকিয়ে নিয়ে চলে যায়। সৈন্যদল রওয়ানা হওয়ার পর আমি আমার হারটি খুঁজে পাই এবং নিজস্ব স্থানে ফিরে এসে দেখি তাদের (সৈন্যদল) কোন আহবায়ক এবং কোন উত্তরদাতা তথায় নেই। ( নিরুপায় হয়ে) তখন আমি পূর্বে যেখানে ছিলাম সেখানে বসে রইলাম। ভাবছিলাম, তাঁরা আমাকে দেখতে না পেলে অবশ্যই আমার কাছে ফিরে আসবে। ঐ স্থানে বসে থাকা অবস্থায় ঘুম চেপে আসলে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। বানূ সুলামী গোত্রের যাকওয়ান শাখার সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল রা. (যাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফেলে যাওয়া আসবাবপত্র কুড়িয়ে নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন) সৈন্যদল চলে যাওয়ার পর সেখানে ছিলেন। তিনি প্রত্যুষে আমার অবস্থানস্থলের কাছে পৌঁছে একজন ঘুমন্ত মানুষ দেখে আমার দিকে তাকানোর পর আমাকে চিলে ফেললেন। তিনি আমাকে দেখেছিলে পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বে। তিনি আমাকে চিনতে পেরে ‘ইন্না লিল্লাহহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন’ পড়লে আমি তা শুনতে পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম এবং চাদর টেনে আমার চেহারা ঢেকে ফেললাম। আল্লাহর কসম, আমি কোন কথা বলিনি এবং তাঁর থেকে ইন্না লিল্লাহ……..পাঠ ছাড়া আর কোন কথাই শুনতে পাইনি। এরপর তিনি সাওয়ারী থেকে অবতরণ করলেন এবং সাওয়ারীকে বসিয়ে তার সামনের পা নিচু করে দিলে আমি গিয়ে তাতে আরোহণ করলাম। পরে তিনি আমাকেসহ সাওয়ারীকে টেনে আগে আগে চলতে লাগলেন, পরিশেষে ঠিক দ্বিপ্রহরে প্রচণ্ড গরমের সময় আমরা গিয়ে সেনাদলের সাথে মিলিত হলাম। সে সময় তাঁরা একটি জায়গায় অবতরণ করছিলেন।

আয়েশা রা. বলেন, এরপর যাদের ধ্বংস হওয়ার ছিল তারা (আমার প্রতি অপবাদ আরোপ করে) ধ্বংস হয়ে গেল। তাদের মধ্যে এ অপবাদ আরোপের ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল সে হচ্ছে আবদুল্লাহ ইবনে উবায় ইবনে সুলুল। রাবী উরওয়া রা. বলেন, আমি জানতে পেরেছি যে, তার সামনে অপবাদের কথাগুলো প্রচার করা হত এবং আলোচনা করা হত আর অমনি সে এগুলোকে বিশ্বাস করত, খুব ভালভাবে শ্রবণ করত এবং শোনা কথার ভিত্তিতেই বিষয়টিকে প্রমাণ করার চেষ্টা করত।

উরওয়া রা. আরো বর্ণনা করেছন যে, অপবাদ আরোপকারী ব্যক্তিদের মধ্যে হাসসান ইবনে সাবিত, মিসতাহ ইবনে উসাসা এবং হামনা বিনতে জাহাশ রা. ব্যতীত আরো কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। তারা গুটিকয়েক ব্যক্তির একটি দল ছিল, এতটুক ব্যতীত তাদের সম্পর্কে আমার আর কিছু জানা নেই। যেমন (আল কুরআনে) মহান আল্লাহ পাক বলেছেন, এ ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তাকে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বিন সুলুল বলে ডাকা হয়ে থাকে। বর্ণনাকারী উরওয়া রা. বলেন, আয়েশা রা.-এর এ ব্যাপারে হাসসান ইবনে সাবিত রা.-কে গালমন্দ করাকে পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, হাসসান ইবনে সাবিত রা. তো ঐ ব্যক্তি যিনি তার এক কবিতায় বলেছেন, আমার মান সম্মান এবং আমার বাপ দাদা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মান সম্মান রক্ষায় নিবেদিত।

আয়েশা রা. বলেন, এরপর আমরা মদীনায় আসলাম। মদীনায় আগমন করার পর এক মাস পর্যন্ত আমি অসুস্থ থাকলাম। এদিকে অপবাদ রটনাকরীদের কথা নিয়ে লোকদের মধ্যে আলোচনা ও চর্চা হতে লাগল। কিন্তু এসবের কিছুই আমি জানি না। তবে আমার সন্দেহ হচ্ছিল এবং তা আরো দৃঢ় হচ্ছিল আমার এ অসুখের সময়। কেননা এর পূর্বে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যেরূপ স্নেহ-ভালবাসা লাভ করতাম আমার এ অসুখের সময় তা আমি পাচ্ছিলাম না। তিনি আমার কাছে এসে সালাম করে কেবল ‘তুমি কেমন আছ’ জিজ্ঞাসা করে চলে যেতেন। তাঁর এ আচরণই আমার মনে চরম সন্দেহের উদ্রেক করে। তবে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাইরে বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ জঘন্য অপবাদ সম্বন্ধে আমি কিছুই জানতাম না। উম্মে মিসতাহ রা. একদা আমার সাথে পায়খানার দিকে বের হন। আর প্রকৃতির ডাকে আমাদের বের হওয়ার অবস্থা এই ছিল যে, এক রাতে বের হলে আমরা আবার পরের রাতে বের হতাম। এ ছিল আমাদের ঘরের পার্শ্বে পায়খানা তৈরী করার পূর্বের ঘটনা। আমাদের অবস্থা প্রাচীন আরবীয় লোকদের অবস্থার মত ছিল। তাদের মত আমরাও পায়খানা করার জন্য ঝোঁপঝাড়ে চলে যেতাম। এমনকি বাড়ির পার্শ্বে পায়খান তৈরী করলে আমরা খুব কষ্ট পেতাম। আয়েশা রা. বলেন, একদা আমি এবং উম্মে মিসতাহ “যিনি ছিলেন আবু রূহম ইবনে মুত্তালিব ইবনে আবদে মানাফের কন্যা, যার মা সাখার ইবনে আমির-এর কন্যা ও আবু বকর রা. সিদ্দীকের খালা এবং মিসতাহ ইবনে উসাসা ইবনে আব্বাদ ইবনে মুত্তালিব যার” একত্রে বের হলাম। আমরা আমাদের কাজ থেকে ফারিগ হওয়ার পর বাড়ি ফেরার পথে উম্মে মিসতাহ তার কাপড়ে জাড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে বললেন, মিসতাহ ধ্বংস হোক। আমি তাকে বললাম, আপনি খুব খারাপ কথা বলছেন। আপনি কি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকে গালি দিচ্ছেন? তিনি আমাকে বললেন, ওগো অবলা, সে তোমার সম্পর্কে কি বলে বেড়াচ্ছে তুমি তো তা শোননি। আয়েশা রা. বলেন, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে আমার সম্পর্কে কি বলছে? তখন তিনি অপবাদ রটনাকরীদের কথাবার্তা সম্পর্কে আমাকে জানালেন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, এরপর আমার পুরানো রোগ আরো বেড়ে গেল। আমি বাড়ি ফেরার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে আসলেন এবং সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কেমন আছ? আয়েশা রা. বলেন, আমি আমার পিতা-মাতার কাছে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক খবর জানতে চাচ্ছিলাম, তাই আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললাম, আপনি কি আমাকে আমার পিতা-মাতার কাছে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেবেন? আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমকে অনুমতি দিলেন। তখন (বাড়িতে গিয়ে) আমি আমার আম্মাকে বললাম, আম্মাজান, লোকজন কি আলোচনা করছে? তিনি বললেন, বেটী ও বিষয়টিকে হালকা করে ফেল। আল্লাহর কসম, সতীন আছে এমন স্বামী সোহাগিনী সুন্দরী রমণীকে তাঁর সতীনরা বদনাম করবে না, এমন খুব কমই হয়ে থাকে।

আয়েশা রা. বলেন, আমি বিস্ময়ের সাথে বললাম, সুবহানাল্লাহ । লোকজন কি এমন গুজবই রটিয়েছে। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, রাতভর আমি কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে ভোর হয়ে গেল। এর মধ্যে আমার অশ্রুও বন্ধ হল না এবং আমি ঘুমাতেও পারলাম না। এরপর ভোরবেলাও আমি কাঁদছিলাম। তিনি আরো বলেন যে, এ সময ওহী নাযিল হতে বিলম্ব হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রীর (আমার) বিচ্ছেদের বিষয়টি সম্পর্কে পরামর্শ ও আলোচনা করার নিমিত্তে আলী ইবনে আবু তালিব এবং উসামা ইবনে যায়েদ রা.-কে ডেকে পাঠালেন। আয়েশা রা. বলেন, উসামা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীদের পবিত্রতা এবং তাদের প্রতি (নবীজীর) ভালবাসার কারণে বললেন, (হে আল্লাহর রাসূল) তাঁরা আপনার স্ত্রী, তাদের সম্পর্কে আমি ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না। আর আলী রা. বললেন, হে আল্লাহ রাসূল, আল্লাহ তো আপনার জন্য সংকীর্ণতা রাখেননি। তাকে (আয়েশা) ব্যতীত আরো বহু মহিলা রয়েছে। তবে আপনি এ ব্যাপারে দাসী (বারীরা রা.) কে জিজ্ঞাসা করুন। সে আপনার কাছে সত্য কথাই বলবে। আয়েশা রা. বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারীরা রা.-কে ডেকে বললেন, হে বারীরা তুমি তাঁর মধ্যে কোন সন্দেহমূলক আচরণ দেখেছ কি? বারীরা রা. তাকে বললেন, সেই আল্লাহর শপথ যিনি আপনাকে সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন আমি তার মধ্যে কখনো এমন কিছু দেখিনি যার দ্বারা তাকে দোষী বলা যায়। তবে তাঁর ব্যাপারে শুধু এতটুকু বলা যায় যে, তিনি হলেন অল্প বয়স্কা যুবতী, রুটি তৈরী করার জন্য আটা খামির করে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। আর বকরী এসে অমনি তা খেয়ে ফেলে।

আয়েশা রা .বলেন, (এ কথা শুনে) সেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে সাথে উঠে গিয়ে মিম্বরে বসে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই-এর ক্ষতি থেকে রক্ষার আহবান জানিয়ে বললেন, হে মুসলিম সম্প্রদায়, যে আমার স্ত্রীর ব্যাপারে অপবাদ ও বদনাম রটিয়ে আমাকে কষ্ট দিয়েছে তার এ অপবাদ থেকে আমাকে কে মুক্ত করবে? আল্লাহর কসম, আমি আমার স্ত্রী সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানিনা। আর তাঁরা (অপবাদ রটনাকারীরা) এমন এক ব্যক্তির (সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল) নাম উল্লেখ করছে যার সম্বন্ধেও আমি ভাল ছাড়া কিছু জানি না। সে তো আমর সাথেই আমার ঘরে যায়। আয়েশা রা. বলেন, (এ কথা শুনে) বনী আবদুল আশহাল গোত্রের সাদ (ইবনে মুআয) রা. উঠে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি আপনাকে এ অপবাদ থেকে মুক্তি দেব। সে যদি আউস গোত্রের লোক হয় তা হলে তার শিরচ্ছেদ করব। আর যদি সে আমাদের ভাই খাযরাজের লোক হয় তাহলে তার ব্যাপারে আপনি যা বলবেন তাই পালন করব। আয়েশা রা. বলেন, এ সময় হাসসান ইবনে সাবিত রা.-এর মায়ের চাচাতো ভাই খাযরাজ গোত্রের সর্দার সাঈদ ইবনে উবাদা রা. দাঁড়িয়ে এ কথার প্রতিবাদ করলেন। আয়েশা রা. বলেন, এ ঘটনার পূর্বে তিনি একজন সৎ ও নেককার লোক ছিলেন। কিন্তু (এ সময়) গোত্রীয় অহমিকায় উত্তেজিত হয়ে তিনি সাদ ইবনে মুআয রা.-কে বললেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। আল্লাহর কসম, তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না এবং তাকে হত্যা করার ক্ষমতাও তোমার নেই। যদিসে তোমার গোত্রের লোক হত তাহলে তুমি তার হত্যা হওয়া কখনো পছন্দ করতে না। তখন সাদ ইবনে মুআয রা.-এর চাচাতো ভাই উসাইদ ইবনে হুযাইর রা. সাদ ইবনে ওবায়দা রা.-কে বললেন, বরং তুমি মিথ্যা কথা বললে। আল্লাহর কসম, আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করব। তুমি হলে মুনাফিক। তাই মুনাফিকদের পক্ষ অবলম্বন করে কথাবার্তা বলছ।

আয়েশা রা. বলেন, এ সময় আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্র খুব উত্তেজিত হয়ে উঠে। এমনকি তারা যুদ্ধের সংকল্প পর্যন্ত করে বসে। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থামিয়ে শান্ত করলেন এবং নিজেও চুপ হয়ে গেলেন। আয়েশা রা. বলেন, আমি সেদিন সারাক্ষণ কেঁদে কাটালাম। অশ্রুঝরা আমার বন্ধ হয়নি এবং একটু ঘুমও আমার আসেনি। তিনি বলেন, আমি ক্রন্দনরত ছিলাম আর আমার পিতা-মাতা আমার পার্শ্বে বসা ছিলেন। এমনি করে একদিন দুই রাত কেঁদে কেঁদে কাটিয়ে দিই। এর মাঝে আমার কোন ঘুম আসেনি। বরং অবারিত ধারায় আমার চোখ থেকে অশ্রুপাত হতে থাকে। মনে হচ্ছিল যেন, কান্নার ফলে আমার কলিজা ফেটে যাবে। আমি ক্রন্দনরত ছিলাম আর আমার আব্বা-আম্মা আমার পাশে বসা ছিলেন। এমতাবস্থায় একজন আনসারী মহিলা আমার কাছে আসার অনুমতি চাইলে আমি তাকে আসার অনুমতি দিলাম। সে এসে বসল এবং আমার সাথে কাঁদতে আরম্ভ করল। তিনি বলেন, আমরা ক্রন্দনরত ছিলাম ঠিক এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে এসে সালাম করলেন এবং আমাদের পাশে বসে গেলেন। আয়েশা রা. বলেন, অপবাদ রটানোর পর আমার কাছে এসে এভাবে তিনি আর কখনো বসেননি। এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ একমাস কাল অপেক্ষা করার পরও আমার বিষয়ে তাঁর নিকট কোন ওহী আসেনি।

আয়েশা রা. বলেন, বসার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালিমা শাহাদাত পড়লেন। এরপর বললেন, যা হোক, আয়েশা তোমার সম্বন্ধে আমার কাছে অনেক কথাই পৌঁছেছে, যদি তুমি এর থেকে মুক্ত হও তাহলে শীঘ্রই আল্লাহ তোমাকে এ অপবাদ থেকে মুক্ত করে দেবেন। আর যদি তুমি কোন গুনাহ করে থাক তাহলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাওবা কর। কেননা বান্দা গুনাহ স্বীকার করে তাওবা করলে আল্লাহ তায়ালা তাওবা কবূল করেন। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা বলে শেষ করলে আমার অশ্রুপাত বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি এক ফোটা অশ্রুও আমি আর অনুভব করলাম না। তখন আমি আমার আব্বাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলছেন আমার পক্ষ হতে আপনি তার জবাব দিন। আমার আব্বা বললেন, আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কি জবাব দিব আমি তা জানিনা। তখন আমি আমার আম্মাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন, আপনি তার জবাব দিন। আম্মা বললেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কি জবাব দিব আমি তা জানি না। তখন আমি ছিলাম অল্প বয়স্কা কিশোরী। কুরআনও বেশি পড়তে পারতাম না। তথাপিও এ অবস্থা দেখে নিজেই বললাম, আমি জানি আপনারা এ অপবাদের ঘটনা শুনেছেন, আপনারা তা বিশ্বাস করেছেন এবং বিষয়টি আপনাদের মনে সুদৃঢ় হয়ে আছে। এখন যদি আমি বলি যে, এর থেকে আমি পবিত্র এবং আমি নিষ্কলুষ তাহলে আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন না। আর যদি আমি এ অপরাধের কথা স্বীকার করে নেই যা সম্পর্কে আল্লাহ জানেন যে, আমি এর থেকে পবিত্র তাহলে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন। আল্লাহর কসম, আমি ও আপনারা যে অবস্থায় শিকার হয়েছি এর জন্য (নবী) ইউসুফ আ.-এর পিতার কথা উদাহরণ ব্যতীত আমি কোন উদাহরণ খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি বলেছিলেন: “সুতরাং পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছ সে বিষয়ে আল্লাহই একমাত্র আমার আশ্রয়স্থল” এরপর আমি মুখ ফিরিয়ে আমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আল্লাহ তায়ালা জানেন যে, সে মুহূর্তেও আমি পবিত্র। অবশ্যই আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন। (একথার প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল) তবে আল্লাহর কসম,আমি কখনো ধারণা করিনি যে, আমার ব্যাপারে আল্লাহর ওহী নাযিল করবেন যা পঠিত হবে। আমার ব্যাপারে আল্লাহ কোন কথা বলবেন আমি নিজেকে এতখানি যোগ্য মনে করিনি বরং আমি নিজেকে এর চেয়ে অধিক অযোগ্য বলে মনে করতাম। তবে আমি আশা করাতাম যে, হয়তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এমন স্বপ্ন দেখানো হবে যার দ্বারা আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনো তাঁর বসার জায়গা ছাড়েননি এবং ঘরের লোকদের থেকেও কেউ ঘর থেকে বাইরে যাননি। এমতাবস্থায় তাঁর উপর ওহী নাযিল হতে শুরু হল। ওহী নাযিল হওয়ার সময় তাঁর যে বিশেষ কষ্ট হত তখনও সে অবস্থা তাঁর হল। এমনকি প্রচণ্ড শীতের দিনেও তাঁর দেহ থেকে মোতির দানার মত বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়ত ঐ বাণীর গুরুভাবের কারণে, যা তাঁর প্রতি নাযিল করা হয়েছে। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ অবস্থা দূরীভূত হলে তিনি হাসিমুখে প্রথমে যে কথাটি বললেন, তা হল, হে আয়েশা ! আল্লাহ তোমার পবিত্রতা জাহির করে দিয়েছেন। আয়েশা রা. বলেন, এ কথা শুনে আমার আম্মা আমাকে বললেন, তুমি উঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর। আমি বললাম, আল্লাহর কসম আমি এখন তাঁর দিকে উঠে যাব না। মহান আল্লাহ ব্যতীত আমি কারো প্রশংসা করব না। আয়েশা রা বললেন, আল্লাহ (আমার পবিত্রতা ঘোষণা করে) যে দশটি আয়াত নাযিল করেছেন, তা হল এই : “যারা এ অপবাদ রটনা করেছে (তারা তো তোমাদেরই একটি দল; এ ঘটনাকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না; বরং এও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য আছে তাদের কৃত পাপকর্মের ফল এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে তার জন্য আছ কঠিন শাস্তি। এ কথা শোনার পর মুমিন পুরুষ এবং নারীগণ কেন নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারণা করেনি এবং বলেনি, এটা তো সুষ্পষ্ট অপবাদ। তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি? যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সেহেতু তারা আল্লাহর বিধানে মিথ্যাবাদী। দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমরা যাতে লিপ্ত ছিলে তার জন্য কঠিন শাস্তি তোমাদেরকে স্পর্শ করত। যখন তোমরা মুখে মুখে এ মিথ্যা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিলনা এবং একে তোমরা তুচ্ছ ব্যাপার বলে ভাবছিলে, অথচ আল্লাহর কাছে তা ছিল খুবই গুরুতর ব্যাপার। আল্লাহ পবিত্র, মহান! এ তো এক গুরুতর অপনাদ। আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক তাহলে কখনো অনুরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি করবে না, আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বিবৃত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। যারা মুনিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতের মর্মন্তুদ শাস্তি। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউই অব্যাহতি পেতে না। আল্লাহ দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। (২৪ : ১১-২০) এরপর আমার পবিত্রতা ঘোষণা করে আল্লাহ এ আয়াতগুলো নাযিল করলেন।

আত্মীয়তা এবং দারিদ্রের কারণে আবু বকর সিদ্দীক রা. মিসতাহ ইবনে উসাসাকে আর্থিক ও বৈষয়িক সাহায্য করতেন। কিন্তু আয়েশা রা. সম্পর্কে তিনি যে অপবাদ রটিয়েছিলেন এ কারণে আবু বকর সিদ্দীক রা কসম করে বললেন, আমি আর কখনো মিসতাহকে আর্থিক কোন সাহায্য করব না। তখন আল্লাহ তায়ালা নাযিল করলে, তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ গ্রহণ করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজন ও অভাবগ্রস্তকে এবং আল্লাহর রাস্তায় যারা গৃহত্যাগ করেছে তাদেরকে কিছুই দিবে না। তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে এবং তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। শোন! তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (২৪: ২২) (এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর) আবু বকর সিদ্দীক রা. বলে উঠলেন হ্যাঁ, আল্লাহর কসম অবশ্যই আমি পছন্দ করি যে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিন। এরপর তিনি মিসতাহ রা.-এর জন্য যে অর্থ খরচ করতেন তা পুন: দিতে শুরু করলেন এবং বললেন, আল্লাহর কসম, আমি তাকে এ অর্থ দেওয়া আর কখনো বন্ধ করব না। আয়েশা রা .বললেন, আমার এ বিষয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়নাব বিনতে জাহাশ রা.-কেও জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তিনি যায়নাব রা. -কে বলেছিলেন, তুমি আয়েশা রা. সম্পর্কে কি জান অথবা বলেছিলেন তুমি কী দেখেছ? তখন তিনি বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি আমার চোখ ও কানকে সংরক্ষণ করেছি। আল্লাহর কসম ! আমি তাঁর সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না। আয়েশ রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর স্ত্রীগণের মধ্যে তিনি আমার সমকক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। আল্লাহ তাকে আল্লাহ-ভীতির ফলে রক্ষা করেছেন। আয়েশা রা. বলেন, অথচ তাঁর বোন হামনা রা. তাঁর পক্ষ অবলম্বন করে অপবাদ রটনাকারীদের মত অপবাদ রটনা করে বেড়াচ্ছিলেন। ফলে তিনি ধ্বংসপ্রাপ্তদের সাথে ধ্বংস হয়ে গেলেন। বর্ণনাকারী ইবনে শিহাব রহ. বলেন, ঐ সমস্ত লোকের ঘটনা সম্পর্কে আমার কাছে যা পৌঁছেছে তা হল এই : উরওয়ার রা. বলেন, আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ কসম, যে ব্যক্তি সম্পর্কে অপবাদ দেওয়া হয়েছিল, তিনি এসব কথা শুনে বলতেন, আল্লাহ মহান। ঐ সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, আমি কোন স্ত্রীলোকের কাপড় খু্লেও কোনদিন দেখিনি। আয়েশা রা. বলেন, পরে তিনি আল্লাহর পথে শাহাদত লাভ করেছিলেন।

(সহীহ বুখারী, আল মাগাযী অধ্যায়, হাদীস নং ৩৮৪৬)

উৎস: আরবী বাংলা হাদীস বিশ্বকোষ

ইফকের ঘটনা


—॰ ইফকের ঘটনা ॰—

আবদুল আযীয ইবনে আবদুল্লাহ রহ………..উরওয়া ইবনে যুবাইর, সাঈদ ইবনে মুসায়্যিব, আলকামা ইবনে ওয়াক্কাস ও উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবা ইবনে মাসউদ রা. সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিণী আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, যখন অপবাদ রটনাকারীগণ তাঁর প্রতি অপবাদ রটিয়েছিল রাবী যুহরী রহ. বলেন, তারা প্রত্যেকেই হাদীসটির অংশবিশেষ আমার কাছে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি স্মরণ রাখা ও সঠিকভাবে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে তাদের কেউ কেউ একে অন্যের চেয়ে অধিকতর অগ্রগামী ও নির্ভরযোগ্য। আয়েশা রা. সম্পর্কে তারা আমার কাছে যা বর্ণনা করেছেন আমি তাদের প্রত্যেকের কথাই যথাযথভাবে স্মরণ রেখেছি। তাদের একজনের বর্ণিত হাদীসের অংশবিশেষ অপরের বর্ণিত হাদীসের অংশবিশেষের সত্যতা প্রমাণ করে। যদিও তাদের একজন অন্যজনের চেয়ে অধিক স্মৃতিশক্তির অধিকারী। রাবীগণ বলেন:

আয়েশা রা. বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সফরের ইচ্ছা করতেন তখন তিনি তাঁর স্ত্রীগণের (নামের জন্য) কোরা ব্যবহার করতেন। এতে যার নাম আসত তাকেই তিনি সাথে করে সফরে বের হতেন। আয়েশা রা. বলেন, এমনি এক যুদ্ধে (মুরায়সীর যুদ্ধ) তিনি আমাদের মাঝে কোরা ব্যবহার করেন, এতে আমার নাম বেরিয়ে আসে। তাই আমিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সফরে বের হলাম। এ ঘটনাটি পর্দার হুকুম নাযিল হওয়ার পর সংঘটিত হয়েছিল। তখন আমাকে হাওদাজ সহ সাওয়ারীতে উটানো ও নামানো হত। এমনি করে আমরা চলতে থাকলাম। অবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ যুদ্ধ থেকে অবসর হলেন, তখন তিনি (বাড়ির দিকে) ফিরলেন। ফেরার পথে আমরা মদীনার নিকটবর্তী হলে তিনি একদিন রাতের বেলা রওয়ানা হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। রওয়ানা হওয়ার ঘোষণার পর আমি উঠলাম এবং (প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য) পায়ে হেটে সেনাছাউনী অতিক্রম করে (একটু সামনে) গেলাম। এরপর প্রয়োজন সেরে আমি আমার সাওয়ারীর কাছে ফিরে এসে বুকে হাত দিয়ে দেখলাম যে, (ইয়ামানের অন্তর্গত) যিফার শহরের পুতি দ্বারা তৈরী করা আমার গলার হারটি ছিড়ে কোথায় পড়ে গিয়েছে। তাই আমি ফিরে গিয়ে আমার হারটি তালাশ করতে আরম্ভ করলাম। হার তালাশ করতে করতে আমার আসতে বিলম্ব হয়ে যায়।

আয়েশা রা. বলেন, যে সমস্ত লোক উটের পিঠে আমাকে উঠিয়ে দিতেন তারা এসে আমার হাওদাজ উঠিয়ে তা আমার উটের পিঠে তুলে দিলেন, যার উপর আরোহণ করতাম। তারা মনে করেছিলেন যে, আমি এর মধ্যে আছি, কারণ খাদ্যভাবে মহিলাগণ তখন খুবই হালকা পাতলা হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের দেহ মাংসল ছিলনা। তাঁরা খুবই স্বল্প পরিমাণ খানা খেতে পেত। তাই তারা যখন হাওদাজ উঠিয়ে উপরে রাখেন তখন তখন তা হালকা হওয়ার বিষয়টিকে কোন প্রকার অস্বাভাবিক মনে করেননি। অধিকন্তু আমি ছিলাম একজন অল্প বয়স্কা কিশোরী। এরপর তারা উট হাঁকিয়ে নিয়ে চলে যায়। সৈন্যদল রওয়ানা হওয়ার পর আমি আমার হারটি খুঁজে পাই এবং নিজস্ব স্থানে ফিরে এসে দেখি তাদের (সৈন্যদল) কোন আহবায়ক এবং কোন উত্তরদাতা তথায় নেই। ( নিরুপায় হয়ে) তখন আমি পূর্বে যেখানে ছিলাম সেখানে বসে রইলাম। ভাবছিলাম, তাঁরা আমাকে দেখতে না পেলে অবশ্যই আমার কাছে ফিরে আসবে। ঐ স্থানে বসে থাকা অবস্থায় ঘুম চেপে আসলে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। বানূ সুলামী গোত্রের যাকওয়ান শাখার সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল রা. (যাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফেলে যাওয়া আসবাবপত্র কুড়িয়ে নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন) সৈন্যদল চলে যাওয়ার পর সেখানে ছিলেন। তিনি প্রত্যুষে আমার অবস্থানস্থলের কাছে পৌঁছে একজন ঘুমন্ত মানুষ দেখে আমার দিকে তাকানোর পর আমাকে চিলে ফেললেন। তিনি আমাকে দেখেছিলে পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বে। তিনি আমাকে চিনতে পেরে ‘ইন্না লিল্লাহহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন’ পড়লে আমি তা শুনতে পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম এবং চাদর টেনে আমার চেহারা ঢেকে ফেললাম। আল্লাহর কসম, আমি কোন কথা বলিনি এবং তাঁর থেকে ইন্না লিল্লাহ……..পাঠ ছাড়া আর কোন কথাই শুনতে পাইনি। এরপর তিনি সাওয়ারী থেকে অবতরণ করলেন এবং সাওয়ারীকে বসিয়ে তার সামনের পা নিচু করে দিলে আমি গিয়ে তাতে আরোহণ করলাম। পরে তিনি আমাকেসহ সাওয়ারীকে টেনে আগে আগে চলতে লাগলেন, পরিশেষে ঠিক দ্বিপ্রহরে প্রচণ্ড গরমের সময় আমরা গিয়ে সেনাদলের সাথে মিলিত হলাম। সে সময় তাঁরা একটি জায়গায় অবতরণ করছিলেন।

আয়েশা রা. বলেন, এরপর যাদের ধ্বংস হওয়ার ছিল তারা (আমার প্রতি অপবাদ আরোপ করে) ধ্বংস হয়ে গেল। তাদের মধ্যে এ অপবাদ আরোপের ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল সে হচ্ছে আবদুল্লাহ ইবনে উবায় ইবনে সুলুল। রাবী উরওয়া রা. বলেন, আমি জানতে পেরেছি যে, তার সামনে অপবাদের কথাগুলো প্রচার করা হত এবং আলোচনা করা হত আর অমনি সে এগুলোকে বিশ্বাস করত, খুব ভালভাবে শ্রবণ করত এবং শোনা কথার ভিত্তিতেই বিষয়টিকে প্রমাণ করার চেষ্টা করত।

উরওয়া রা. আরো বর্ণনা করেছন যে, অপবাদ আরোপকারী ব্যক্তিদের মধ্যে হাসসান ইবনে সাবিত, মিসতাহ ইবনে উসাসা এবং হামনা বিনতে জাহাশ রা. ব্যতীত আরো কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। তারা গুটিকয়েক ব্যক্তির একটি দল ছিল, এতটুক ব্যতীত তাদের সম্পর্কে আমার আর কিছু জানা নেই। যেমন (আল কুরআনে) মহান আল্লাহ পাক বলেছেন, এ ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তাকে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বিন সুলুল বলে ডাকা হয়ে থাকে। বর্ণনাকারী উরওয়া রা. বলেন, আয়েশা রা.-এর এ ব্যাপারে হাসসান ইবনে সাবিত রা.-কে গালমন্দ করাকে পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, হাসসান ইবনে সাবিত রা. তো ঐ ব্যক্তি যিনি তার এক কবিতায় বলেছেন, আমার মান সম্মান এবং আমার বাপ দাদা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মান সম্মান রক্ষায় নিবেদিত।

আয়েশা রা. বলেন, এরপর আমরা মদীনায় আসলাম। মদীনায় আগমন করার পর এক মাস পর্যন্ত আমি অসুস্থ থাকলাম। এদিকে অপবাদ রটনাকরীদের কথা নিয়ে লোকদের মধ্যে আলোচনা ও চর্চা হতে লাগল। কিন্তু এসবের কিছুই আমি জানি না। তবে আমার সন্দেহ হচ্ছিল এবং তা আরো দৃঢ় হচ্ছিল আমার এ অসুখের সময়। কেননা এর পূর্বে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যেরূপ স্নেহ-ভালবাসা লাভ করতাম আমার এ অসুখের সময় তা আমি পাচ্ছিলাম না। তিনি আমার কাছে এসে সালাম করে কেবল ‘তুমি কেমন আছ’ জিজ্ঞাসা করে চলে যেতেন। তাঁর এ আচরণই আমার মনে চরম সন্দেহের উদ্রেক করে। তবে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাইরে বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ জঘন্য অপবাদ সম্বন্ধে আমি কিছুই জানতাম না। উম্মে মিসতাহ রা. একদা আমার সাথে পায়খানার দিকে বের হন। আর প্রকৃতির ডাকে আমাদের বের হওয়ার অবস্থা এই ছিল যে, এক রাতে বের হলে আমরা আবার পরের রাতে বের হতাম। এ ছিল আমাদের ঘরের পার্শ্বে পায়খানা তৈরী করার পূর্বের ঘটনা। আমাদের অবস্থা প্রাচীন আরবীয় লোকদের অবস্থার মত ছিল। তাদের মত আমরাও পায়খানা করার জন্য ঝোঁপঝাড়ে চলে যেতাম। এমনকি বাড়ির পার্শ্বে পায়খান তৈরী করলে আমরা খুব কষ্ট পেতাম। আয়েশা রা. বলেন, একদা আমি এবং উম্মে মিসতাহ “যিনি ছিলেন আবু রূহম ইবনে মুত্তালিব ইবনে আবদে মানাফের কন্যা, যার মা সাখার ইবনে আমির-এর কন্যা ও আবু বকর রা. সিদ্দীকের খালা এবং মিসতাহ ইবনে উসাসা ইবনে আব্বাদ ইবনে মুত্তালিব যার” একত্রে বের হলাম। আমরা আমাদের কাজ থেকে ফারিগ হওয়ার পর বাড়ি ফেরার পথে উম্মে মিসতাহ তার কাপড়ে জাড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে বললেন, মিসতাহ ধ্বংস হোক। আমি তাকে বললাম, আপনি খুব খারাপ কথা বলছেন। আপনি কি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকে গালি দিচ্ছেন? তিনি আমাকে বললেন, ওগো অবলা, সে তোমার সম্পর্কে কি বলে বেড়াচ্ছে তুমি তো তা শোননি। আয়েশা রা. বলেন, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে আমার সম্পর্কে কি বলছে? তখন তিনি অপবাদ রটনাকরীদের কথাবার্তা সম্পর্কে আমাকে জানালেন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, এরপর আমার পুরানো রোগ আরো বেড়ে গেল। আমি বাড়ি ফেরার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে আসলেন এবং সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কেমন আছ? আয়েশা রা. বলেন, আমি আমার পিতা-মাতার কাছে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক খবর জানতে চাচ্ছিলাম, তাই আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললাম, আপনি কি আমাকে আমার পিতা-মাতার কাছে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেবেন? আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমকে অনুমতি দিলেন। তখন (বাড়িতে গিয়ে) আমি আমার আম্মাকে বললাম, আম্মাজান, লোকজন কি আলোচনা করছে? তিনি বললেন, বেটী ও বিষয়টিকে হালকা করে ফেল। আল্লাহর কসম, সতীন আছে এমন স্বামী সোহাগিনী সুন্দরী রমণীকে তাঁর সতীনরা বদনাম করবে না, এমন খুব কমই হয়ে থাকে।

আয়েশা রা. বলেন, আমি বিস্ময়ের সাথে বললাম, সুবহানাল্লাহ । লোকজন কি এমন গুজবই রটিয়েছে। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, রাতভর আমি কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে ভোর হয়ে গেল। এর মধ্যে আমার অশ্রুও বন্ধ হল না এবং আমি ঘুমাতেও পারলাম না। এরপর ভোরবেলাও আমি কাঁদছিলাম। তিনি আরো বলেন যে, এ সময ওহী নাযিল হতে বিলম্ব হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রীর (আমার) বিচ্ছেদের বিষয়টি সম্পর্কে পরামর্শ ও আলোচনা করার নিমিত্তে আলী ইবনে আবু তালিব এবং উসামা ইবনে যায়েদ রা.-কে ডেকে পাঠালেন। আয়েশা রা. বলেন, উসামা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীদের পবিত্রতা এবং তাদের প্রতি (নবীজীর) ভালবাসার কারণে বললেন, (হে আল্লাহর রাসূল) তাঁরা আপনার স্ত্রী, তাদের সম্পর্কে আমি ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না। আর আলী রা. বললেন, হে আল্লাহ রাসূল, আল্লাহ তো আপনার জন্য সংকীর্ণতা রাখেননি। তাকে (আয়েশা) ব্যতীত আরো বহু মহিলা রয়েছে। তবে আপনি এ ব্যাপারে দাসী (বারীরা রা.) কে জিজ্ঞাসা করুন। সে আপনার কাছে সত্য কথাই বলবে। আয়েশা রা. বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারীরা রা.-কে ডেকে বললেন, হে বারীরা তুমি তাঁর মধ্যে কোন সন্দেহমূলক আচরণ দেখেছ কি? বারীরা রা. তাকে বললেন, সেই আল্লাহর শপথ যিনি আপনাকে সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন আমি তার মধ্যে কখনো এমন কিছু দেখিনি যার দ্বারা তাকে দোষী বলা যায়। তবে তাঁর ব্যাপারে শুধু এতটুকু বলা যায় যে, তিনি হলেন অল্প বয়স্কা যুবতী, রুটি তৈরী করার জন্য আটা খামির করে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। আর বকরী এসে অমনি তা খেয়ে ফেলে।

আয়েশা রা .বলেন, (এ কথা শুনে) সেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে সাথে উঠে গিয়ে মিম্বরে বসে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই-এর ক্ষতি থেকে রক্ষার আহবান জানিয়ে বললেন, হে মুসলিম সম্প্রদায়, যে আমার স্ত্রীর ব্যাপারে অপবাদ ও বদনাম রটিয়ে আমাকে কষ্ট দিয়েছে তার এ অপবাদ থেকে আমাকে কে মুক্ত করবে? আল্লাহর কসম, আমি আমার স্ত্রী সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানিনা। আর তাঁরা (অপবাদ রটনাকারীরা) এমন এক ব্যক্তির (সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল) নাম উল্লেখ করছে যার সম্বন্ধেও আমি ভাল ছাড়া কিছু জানি না। সে তো আমর সাথেই আমার ঘরে যায়। আয়েশা রা. বলেন, (এ কথা শুনে) বনী আবদুল আশহাল গোত্রের সাদ (ইবনে মুআয) রা. উঠে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি আপনাকে এ অপবাদ থেকে মুক্তি দেব। সে যদি আউস গোত্রের লোক হয় তা হলে তার শিরচ্ছেদ করব। আর যদি সে আমাদের ভাই খাযরাজের লোক হয় তাহলে তার ব্যাপারে আপনি যা বলবেন তাই পালন করব। আয়েশা রা. বলেন, এ সময় হাসসান ইবনে সাবিত রা.-এর মায়ের চাচাতো ভাই খাযরাজ গোত্রের সর্দার সাঈদ ইবনে উবাদা রা. দাঁড়িয়ে এ কথার প্রতিবাদ করলেন। আয়েশা রা. বলেন, এ ঘটনার পূর্বে তিনি একজন সৎ ও নেককার লোক ছিলেন। কিন্তু (এ সময়) গোত্রীয় অহমিকায় উত্তেজিত হয়ে তিনি সাদ ইবনে মুআয রা.-কে বললেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। আল্লাহর কসম, তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না এবং তাকে হত্যা করার ক্ষমতাও তোমার নেই। যদিসে তোমার গোত্রের লোক হত তাহলে তুমি তার হত্যা হওয়া কখনো পছন্দ করতে না। তখন সাদ ইবনে মুআয রা.-এর চাচাতো ভাই উসাইদ ইবনে হুযাইর রা. সাদ ইবনে ওবায়দা রা.-কে বললেন, বরং তুমি মিথ্যা কথা বললে। আল্লাহর কসম, আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করব। তুমি হলে মুনাফিক। তাই মুনাফিকদের পক্ষ অবলম্বন করে কথাবার্তা বলছ।

আয়েশা রা. বলেন, এ সময় আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্র খুব উত্তেজিত হয়ে উঠে। এমনকি তারা যুদ্ধের সংকল্প পর্যন্ত করে বসে। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থামিয়ে শান্ত করলেন এবং নিজেও চুপ হয়ে গেলেন। আয়েশা রা. বলেন, আমি সেদিন সারাক্ষণ কেঁদে কাটালাম। অশ্রুঝরা আমার বন্ধ হয়নি এবং একটু ঘুমও আমার আসেনি। তিনি বলেন, আমি ক্রন্দনরত ছিলাম আর আমার পিতা-মাতা আমার পার্শ্বে বসা ছিলেন। এমনি করে একদিন দুই রাত কেঁদে কেঁদে কাটিয়ে দিই। এর মাঝে আমার কোন ঘুম আসেনি। বরং অবারিত ধারায় আমার চোখ থেকে অশ্রুপাত হতে থাকে। মনে হচ্ছিল যেন, কান্নার ফলে আমার কলিজা ফেটে যাবে। আমি ক্রন্দনরত ছিলাম আর আমার আব্বা-আম্মা আমার পাশে বসা ছিলেন। এমতাবস্থায় একজন আনসারী মহিলা আমার কাছে আসার অনুমতি চাইলে আমি তাকে আসার অনুমতি দিলাম। সে এসে বসল এবং আমার সাথে কাঁদতে আরম্ভ করল। তিনি বলেন, আমরা ক্রন্দনরত ছিলাম ঠিক এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে এসে সালাম করলেন এবং আমাদের পাশে বসে গেলেন। আয়েশা রা. বলেন, অপবাদ রটানোর পর আমার কাছে এসে এভাবে তিনি আর কখনো বসেননি। এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ একমাস কাল অপেক্ষা করার পরও আমার বিষয়ে তাঁর নিকট কোন ওহী আসেনি।

আয়েশা রা. বলেন, বসার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালিমা শাহাদাত পড়লেন। এরপর বললেন, যা হোক, আয়েশা তোমার সম্বন্ধে আমার কাছে অনেক কথাই পৌঁছেছে, যদি তুমি এর থেকে মুক্ত হও তাহলে শীঘ্রই আল্লাহ তোমাকে এ অপবাদ থেকে মুক্ত করে দেবেন। আর যদি তুমি কোন গুনাহ করে থাক তাহলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাওবা কর। কেননা বান্দা গুনাহ স্বীকার করে তাওবা করলে আল্লাহ তায়ালা তাওবা কবূল করেন। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা বলে শেষ করলে আমার অশ্রুপাত বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি এক ফোটা অশ্রুও আমি আর অনুভব করলাম না। তখন আমি আমার আব্বাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলছেন আমার পক্ষ হতে আপনি তার জবাব দিন। আমার আব্বা বললেন, আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কি জবাব দিব আমি তা জানিনা। তখন আমি আমার আম্মাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন, আপনি তার জবাব দিন। আম্মা বললেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কি জবাব দিব আমি তা জানি না। তখন আমি ছিলাম অল্প বয়স্কা কিশোরী। কুরআনও বেশি পড়তে পারতাম না। তথাপিও এ অবস্থা দেখে নিজেই বললাম, আমি জানি আপনারা এ অপবাদের ঘটনা শুনেছেন, আপনারা তা বিশ্বাস করেছেন এবং বিষয়টি আপনাদের মনে সুদৃঢ় হয়ে আছে। এখন যদি আমি বলি যে, এর থেকে আমি পবিত্র এবং আমি নিষ্কলুষ তাহলে আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন না। আর যদি আমি এ অপরাধের কথা স্বীকার করে নেই যা সম্পর্কে আল্লাহ জানেন যে, আমি এর থেকে পবিত্র তাহলে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন। আল্লাহর কসম, আমি ও আপনারা যে অবস্থায় শিকার হয়েছি এর জন্য (নবী) ইউসুফ আ.-এর পিতার কথা উদাহরণ ব্যতীত আমি কোন উদাহরণ খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি বলেছিলেন: “সুতরাং পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছ সে বিষয়ে আল্লাহই একমাত্র আমার আশ্রয়স্থল” এরপর আমি মুখ ফিরিয়ে আমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আল্লাহ তায়ালা জানেন যে, সে মুহূর্তেও আমি পবিত্র। অবশ্যই আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন। (একথার প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল) তবে আল্লাহর কসম,আমি কখনো ধারণা করিনি যে, আমার ব্যাপারে আল্লাহর ওহী নাযিল করবেন যা পঠিত হবে। আমার ব্যাপারে আল্লাহ কোন কথা বলবেন আমি নিজেকে এতখানি যোগ্য মনে করিনি বরং আমি নিজেকে এর চেয়ে অধিক অযোগ্য বলে মনে করতাম। তবে আমি আশা করাতাম যে, হয়তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এমন স্বপ্ন দেখানো হবে যার দ্বারা আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনো তাঁর বসার জায়গা ছাড়েননি এবং ঘরের লোকদের থেকেও কেউ ঘর থেকে বাইরে যাননি। এমতাবস্থায় তাঁর উপর ওহী নাযিল হতে শুরু হল। ওহী নাযিল হওয়ার সময় তাঁর যে বিশেষ কষ্ট হত তখনও সে অবস্থা তাঁর হল। এমনকি প্রচণ্ড শীতের দিনেও তাঁর দেহ থেকে মোতির দানার মত বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়ত ঐ বাণীর গুরুভাবের কারণে, যা তাঁর প্রতি নাযিল করা হয়েছে। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ অবস্থা দূরীভূত হলে তিনি হাসিমুখে প্রথমে যে কথাটি বললেন, তা হল, হে আয়েশা ! আল্লাহ তোমার পবিত্রতা জাহির করে দিয়েছেন। আয়েশা রা. বলেন, এ কথা শুনে আমার আম্মা আমাকে বললেন, তুমি উঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর। আমি বললাম, আল্লাহর কসম আমি এখন তাঁর দিকে উঠে যাব না। মহান আল্লাহ ব্যতীত আমি কারো প্রশংসা করব না। আয়েশা রা বললেন, আল্লাহ (আমার পবিত্রতা ঘোষণা করে) যে দশটি আয়াত নাযিল করেছেন, তা হল এই : “যারা এ অপবাদ রটনা করেছে (তারা তো তোমাদেরই একটি দল; এ ঘটনাকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না; বরং এও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য আছে তাদের কৃত পাপকর্মের ফল এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে তার জন্য আছ কঠিন শাস্তি। এ কথা শোনার পর মুমিন পুরুষ এবং নারীগণ কেন নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারণা করেনি এবং বলেনি, এটা তো সুষ্পষ্ট অপবাদ। তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি? যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সেহেতু তারা আল্লাহর বিধানে মিথ্যাবাদী। দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমরা যাতে লিপ্ত ছিলে তার জন্য কঠিন শাস্তি তোমাদেরকে স্পর্শ করত। যখন তোমরা মুখে মুখে এ মিথ্যা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিলনা এবং একে তোমরা তুচ্ছ ব্যাপার বলে ভাবছিলে, অথচ আল্লাহর কাছে তা ছিল খুবই গুরুতর ব্যাপার। আল্লাহ পবিত্র, মহান! এ তো এক গুরুতর অপনাদ। আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক তাহলে কখনো অনুরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি করবে না, আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বিবৃত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। যারা মুনিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতের মর্মন্তুদ শাস্তি। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউই অব্যাহতি পেতে না। আল্লাহ দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। (২৪ : ১১-২০) এরপর আমার পবিত্রতা ঘোষণা করে আল্লাহ এ আয়াতগুলো নাযিল করলেন।

আত্মীয়তা এবং দারিদ্রের কারণে আবু বকর সিদ্দীক রা. মিসতাহ ইবনে উসাসাকে আর্থিক ও বৈষয়িক সাহায্য করতেন। কিন্তু আয়েশা রা. সম্পর্কে তিনি যে অপবাদ রটিয়েছিলেন এ কারণে আবু বকর সিদ্দীক রা কসম করে বললেন, আমি আর কখনো মিসতাহকে আর্থিক কোন সাহায্য করব না। তখন আল্লাহ তায়ালা নাযিল করলে, তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ গ্রহণ করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজন ও অভাবগ্রস্তকে এবং আল্লাহর রাস্তায় যারা গৃহত্যাগ করেছে তাদেরকে কিছুই দিবে না। তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে এবং তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। শোন! তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (২৪: ২২) (এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর) আবু বকর সিদ্দীক রা. বলে উঠলেন হ্যাঁ, আল্লাহর কসম অবশ্যই আমি পছন্দ করি যে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিন। এরপর তিনি মিসতাহ রা.-এর জন্য যে অর্থ খরচ করতেন তা পুন: দিতে শুরু করলেন এবং বললেন, আল্লাহর কসম, আমি তাকে এ অর্থ দেওয়া আর কখনো বন্ধ করব না। আয়েশা রা .বললেন, আমার এ বিষয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়নাব বিনতে জাহাশ রা.-কেও জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তিনি যায়নাব রা. -কে বলেছিলেন, তুমি আয়েশা রা. সম্পর্কে কি জান অথবা বলেছিলেন তুমি কী দেখেছ? তখন তিনি বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি আমার চোখ ও কানকে সংরক্ষণ করেছি। আল্লাহর কসম ! আমি তাঁর সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না। আয়েশ রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর স্ত্রীগণের মধ্যে তিনি আমার সমকক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। আল্লাহ তাকে আল্লাহ-ভীতির ফলে রক্ষা করেছেন। আয়েশা রা. বলেন, অথচ তাঁর বোন হামনা রা. তাঁর পক্ষ অবলম্বন করে অপবাদ রটনাকারীদের মত অপবাদ রটনা করে বেড়াচ্ছিলেন। ফলে তিনি ধ্বংসপ্রাপ্তদের সাথে ধ্বংস হয়ে গেলেন। বর্ণনাকারী ইবনে শিহাব রহ. বলেন, ঐ সমস্ত লোকের ঘটনা সম্পর্কে আমার কাছে যা পৌঁছেছে তা হল এই : উরওয়ার রা. বলেন, আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ কসম, যে ব্যক্তি সম্পর্কে অপবাদ দেওয়া হয়েছিল, তিনি এসব কথা শুনে বলতেন, আল্লাহ মহান। ঐ সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, আমি কোন স্ত্রীলোকের কাপড় খু্লেও কোনদিন দেখিনি। আয়েশা রা. বলেন, পরে তিনি আল্লাহর পথে শাহাদত লাভ করেছিলেন।

(সহীহ বুখারী, আল মাগাযী অধ্যায়, হাদীস নং ৩৮৪৬)

উৎস: আরবী বাংলা হাদীস বিশ্বকোষ

Posted at June 03, 2019 |  by Arya ঋষি
দ্বিতীয় পর্ব



আলোচিত মেহেদির পূর্বাপর এবং বাকি বৃত্তান্ত
এর আগে প্রস্তুতি হিসেবে সে এই পূর্বালোচিত মেহেদী বা প্রেরিত পুরুষ হিসেবে মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল কাহ্তানী বলে মৃদুভাষী একটি তরুণ ধর্ম প্রচারক কে চিহ্নিত করে।এই ক্ষেত্রে হাদিসে সেই প্রেরিত পুরুষের নাম বা তাঁর বাবার নাম এবং এই লোকটির ক্ষেত্রেও একই হওয়া একটি বড় হাতিয়ার হয়।একই সাথে বর্ণিত মেহেদির উন্নত কপাল ,রোগা গড়ন ,উন্নত নাসিকা ইত্যাদি মিল একটি মোক্ষম সুযোগ এনে দিলো। প্রথমে কাহতানি নিজেকে দেখতে রাজি না হলেও পরবর্তীতে জুহাইমান এর মোহে আবিষ্ট হয়ে সত্যিই নিজেকে ওই ভাবে ভাবতে শুরু করে।এই সখ্যতা আরো পোক্ত হয় যখন তার বড় বোন কে জুহাইমান তার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে বিয়ে করে।
অভিযানের আগে কাবা একটি গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে ইমাম মেহেদী কে শত শত মক্কাবাসী স্বপ্নে দেখেছে শীর্ষ মসজিদের মিনারে ইসলামের পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।একই সাথে দলের অভ্যন্তরে এই ইমামের বিষয়ে কোনো সন্দেহের প্রশ্ন রাখার অবকাশ সে রাখে নি।একদিকে যখন জুহাইমান আর তাঁর দল প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই প্রস্তুতি নিচ্ছিল ওই সময়ে সৌদি বাদশা পুত্র এবং এক অর্থে ক্ষমতার কর্নধার ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজ ছিল তিউনিসিয়ায় আরব লীগের একটি বৈঠকের সফরে আর প্রিন্স আব্দুল্লাহ ,জাতীয় সুরক্ষার প্রধান ছিল মরোক্কো সফরে।দেশের দেখভাল করার জন্য ছিল বৃদ্ধ এবং অসুস্থ রাজা খালেদ আর রক্ষামন্ত্রী প্রিন্স সুলতান।
সৌদি রাজশক্তির তৎপরতা :
সেই সকালেই খবর পেয়ে শেখ নাসের রাজা খালেদকে এই খবর দেন।রাজা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রিন্স সুলতান বিন আব্দুল আজিজ এবং অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের সর্বোচ্চ কর্তা প্রিন্স নাইফ বিন আব্দুল আজিজ কে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে আদেশ করে।পরবর্তিতে মক্কার প্রশাসক প্রিন্স ফাওয়াজ বিন আব্দুল আজিজ,গুপ্তচর বিভাগের প্রিন্স তুর্কি অকুস্থলের কাছে চলে আসে।তুর্কি স্বীকার করে যে জুহাইমান আর তার গোষ্ঠী তুলনামূলক ভাবে একটু ছোট দল হওয়ার কারণে এদের উপরে নজর রাখা হলেও সামগ্রিক কোন বিপদের আশংকা বা এই ধরনের কোনো কান্ড করতে পারে তা তারা ভাবতেও পারে নি।
সৌদি পুলিশ প্রথমে এই দখলের গুরুত্ব বুঝতেই পারে নি।সকালে একজন পুলিস অফিসার বিষয়টি দেখতে একটি জিপ নিয়ে এগিয়ে গেলে দখলদার বাহিনীর গুলিতে আহত হয়।একই ভাবে অন্য দিক থেকে আসা অন্য পুলিস অফিসারদের গাড়ি গুলোতেও ভিতর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসে।এই পর্যায়ে ভিতরে থাকা সাধারন মানুষদের ঢাল বানিয়ে এই দলটি ক্রমশ আক্রমন চালিয়ে যায় সৌদি পুলিশের উপরে।এই পর্যায়ে আহত বা নিহত এই সব মানুষদের দেহ উদ্ধার করার চেষ্টা করলেও তাদের উপরে একই ভাবে গুলি বর্ষণ করতে থাকে ভিতর থেকে।মৃত্যু হয় এক পুলিস অফিসারের এবং ভিতরের এক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা এক কিশোরের।ইমামের মতো আরো কিছু সৌদি নাগরিক পিলারের আড়াল ধরে ধীরে ধীরে একটি জানালার কাঁচের ফাঁক দিয়ে একদল রোগা পাতলা লোক বাইরে পালাতে স্বক্ষম হয়।মসজিদ চত্ত্বরে থাকা সৌদি নারী পুরুষদের জোর করে এই ঘোষিত ইমামের পক্ষে শপথ পাঠ করানো চলতে থাকে।
প্রিন্স তুর্কি মসজিদের পাশের হোটেল সৌবরাতে এই পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে একটি বৈঠক করতে এলে,হোটেলের দরজাতে হাত দেওয়া মাত্র একটি বুলেট তার দিকে ছুটে আসে,কপাল গুনে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে দরজার কাজ চুরমার করে দেয়।তড়িঘড়ি তাঁকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়।এই বুলেট এসেছিল মসজিদের আব্দুল আজিজ দরজার জোড়া মিনারের থেকে।হোটেলটি মসজিদের থেকে মাত্র ১৫০ মিটার দুরে থাকায় ওই দখলদার বাহিনীর স্নাইপারের আওতায় ছিল আর সৌদি কর্তিপক্ষ তা আগে একদম আন্দাজ করতে পারে নি।
সৌদি উপলব্ধি এবং পরবর্তী কাজকর্ম:
এইবার সৌদি শাসক গোষ্ঠী বুঝতে পারে এদের প্রস্তুতি বা শক্তি অনেক বেশি।এরপরে এই কাবা এবং শীর্ষ মসজিদের চারপাশে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরী করে।বিশেষ রক্ষী বাহিনী ,বিশেষ ছত্রী বাহিনী আর বিশেষ স্বশস্ত্র দল কে মোতায়েন করা হয়।সমস্যা হলো,পাল্টা আক্রমন করার ক্ষেত্রে,যেহেতু সব চেয়ে পবিত্র এই স্থানে কোনো অস্ত্র ইত্যাদি নিয়ে যাওয়া বা পাল্টা আক্রমন এতো সহজ ছিল না,এর সাথে গোটা মুসলিম দেশগুলোর মানুষের এবং নিজের দেশের মানুষের অনুভুতির প্রশ্ন জড়িত ছিল।এই কারণে দরকার ছিল উলেমাদের থেকে ধর্মীয় নির্দেশ।এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ভারপ্রাপ্ত উলেমাদের দল দুই দিন সময় নিয়েছিল।এই দুই দিন সৌদি প্রশাসন প্রস্তুতি নিতে থাকে আর একই সঙ্গে পুরো জায়গাটির উপরে নজর রাখা শুরু করে।
হেলিকপ্টারের চক্কর এবং জঙ্গি বিমানের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়।নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া হেলিকপ্টারকে লক্ষ্য করে গুলি ছুটে আসে,ভাগ্যক্রমে একজন চালক রক্ষা পায় তার বদলে সঙ্গের বেতার ব্যবস্থার গায়ে গুলি লাগার কারণে।এই সময়ে নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়ার কারণে দেখা যায় ভিতরে স্বশস্ত্র পুরুষই না,বেশ কিছু নারী ও অস্ত্র নিয়ে ভিতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।পরবর্তিতে সৌদি প্রশাসন জানতে পেরেছিল এই জুহাইমানের সাথে তার স্ত্রী আর বাকিদের অনেকের পরিবার বা সন্তান ও এসেছিল এই অভিযানে।সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টি অনেক জটিল হয়ে ওঠে মোকাবিলার জন্য।
পরেরদিন সরকারী ভাবে অতি ভোরে রিয়াদ রেডিও থেকে ঘোষণা করা হয় এই কাবা এবং সংলগ্ন মসজিদ দখলের আর দখলকারী গোষ্ঠির কোনো এক ব্যক্তিকে সেই মেহেদী ঘোষণার কথা।ইতিমধ্যেই অবশ্য মার্কিন সংবাদ মাধ্যমের সূত্র ধরে এই খবর গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গিয়েছিল।এই দ্বিতীয় দিনে সেই সময়ের নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি ভয়াবহ অসত্য খবর দিয়ে ফেলে যাতে শিরোনাম ছিল, “মক্কা মসজিদ দখল করা বন্দুকধারীর দল সম্ভবত ইরানের জঙ্গি গোষ্ঠী।
বিশ্বজুড়ে নতুন অশান্তির সূচনা:
এই খবর এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরী করলো,কারণ এর কিছু দিন আগেই ইরানের শাহ কে অপসারণ করে মোল্লা গোষ্ঠির বা আরো নির্দিস্ট করে বললে শিয়া পন্থী খোমেইনি ক্ষমতা দখল করে আমেরিকার দুতাবাসে ৫২ জন মার্কিন নাগরিক এবং বাকিদের আটকে রেখেছিল।এরপরে এর প্রত্যুত্তর দিতে খোমেইনি পাল্টা দায়ী করে আমেরিকাকে আর চারিদিকে পল্লবিত হতে থাকে গুজবের নানান বিষয়।
এরপরেই একদল লোক পাকিস্থানে মার্কিন দুতাবাসে আক্রমন করে সেটি মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়।দুজন মার্কিন এবং দুজন পাকিস্থানি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী এই ঘটনায় মারা ও যায়।পরবর্তিতে একই কারণে খোমেইনীর অভিযোগের ভিত্তিতে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলিতে একই ভাবে মার্কিন দুতাবাস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়,এই ঘটনা এতটাই সুদুরপ্রসারী হয়েছিল যে পরবর্তী ২৫ বছর ওই দেশে আর মার্কিন কোনো দুতাবাস স্থাপনা হয় নি।
এই সবের মাঝে, ঘটনার দু দিন পরে অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের প্রধান প্রিন্স নাইফ সব জল্পনা শেষ করে পরিস্কার জানায় আমেরিকা বা ইরান অথবা অন্য কোনো দেশ এতে জড়িত না।এই ঘটনা সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ একটি গোষ্ঠির কাজ যারা ‘পথভ্রষ্ট‘ হয়েছিল।
এই সময়ের মধ্যে একাধিকবার এই মসজিদ বা পুরো স্থাপনার ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেও সফল হয় নি সৌদি বাহিনী।এই সময়ে পুরো অভিযানের নেতৃত্ব দিতে নিয়ে আসা হয় সৌদি রাজার স্বশস্ত্র ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফালেহ আল দাহরি কে।ঠিক হয় ,মারওয়া দরজা উড়িয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকবে এই বাহিনী।এই সময়ে এক কঠিন অবস্থার সামনে পড়েছিল সৌদি শাসকরা।ইমাম মেহেদির তত্বে বিশ্বাসী একাংশ ধরে নিয়েছিল এই বিরোধিতা আসছে শয়তানের পক্ষ থেকে এই সাজোয়া গাড়ির বহর নিয়ে।অর্থাৎ একটা জন সমর্থন গড়ে ওঠার অবস্থা তৈরী হয়েছিল এই ইমাম মেহেদীকে কেন্দ্র করে যাতে শাসক গোষ্ঠী শয়তানের দোসর হিসেবে ভুমিকা নিতে যাচ্ছিল।এই পর্যায়ে একটি বুদ্ধিমানের মতো কাজ সৌদি প্রশাসন করে,পুরো অভিযানের নানান পর্যায়ে এরা সংবাদ মাধ্যমকে নিজেদের কাজের বিষয়ে জানানো বা সঙ্গে রাখার কাজ শুরু করে ফলে বিষয়টি অনেক স্বচ্ছ হয়ে ওঠে।
প্রথমদিনে সাজোয়া গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেলেও তীব্র গুলির কারণে শারীরিক ভাবে মসজিদের আশেপাশে নেমে অবস্থান নেওয়ার কোনো সুযোগ পায় নি সৌদি বাহিনী।এরপরের দিন কৌশলগত ভাবে আসেপাশের উচু অবস্থাপনা গুলোতে পাল্টা দূর পাল্লার বন্দুকবাজ মোতায়েন করে সৌদি বাহিনী।এইবার উচ্চ অবস্থান থেকে পাল্টা গুলি চালিয়ে অনেকটাই নিস্ক্রিয় করে ফেলতে পারে ওই দখলদার বাহিনীর স্নাইপার গুলো কে।একই সাথে আকাশ থেকে নিরীক্ষণের মাধ্যমে সৌদি বাহিনী জানতে পারে উত্তর ভাগের মারওয়া দরজা অপেক্ষাকৃত কম প্রতিরোধের জায়গা হতে পারে।
এই পর্যায়ে ২২ তারিখ,ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ, সৌদি গোলন্দাজরা কম মাপের বিস্ফোরক গোলা ছুড়তে থাকে,এটি স্রেফ ওই অবস্থানরত প্রতিরোধকারীদের নজর অন্যদিকে নিয়ে আরো একটি বাহিনীকে সাফা-মারওয়া পথের পূর্ব দিকে অবস্থান নিতে করা হয়েছিল।এই কাজে অর্ধেক পথ এগিয়ে গেলেও তীব্র গুলির কারণে বেশ কিছু সেনার মৃত্যু হলে বাহিনী আবার পিছু হটে যায়।একই ভাবে আগে বলা সেই মারওয়া দরজার দিকে বিস্ফোরক সহযোগে দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকতে পারলেও সফল হলো না।
ফতোয়ার জোরে নতুন শক্তি প্রাপ্তি:
অবশেষে,নভেম্বর ২৩তারিখে ইসলামের ইতিহাসে সূচনা থেকে এই প্রথম,জুম্মার নামাজ পড়া হলো না এই শীর্ষ মসজিদে।দিনের শেষে উলেমারা ফতোয়া দিলো “এই জঙ্গিদের অস্ত্র ত্যাগ করে আত্মসমর্পর্ন করার আবেদন করা হোক,তা না মানলে কোরানের আল বাকারাহর বিধান অনুযায়ী যদি আল মসজিদ আল হারাম এ আক্রমন না করার এবং যদি একান্তই আক্রান্ত হও তবে তাদের হত্যা করার আদেশের ভিত্তিতে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া হোক”
এইবার এই ফতোয়ার আনুকূল্যে একটা শক্ত অবস্থান পেলো সৌদিশক্তি।এতদিন বাইরে থেকে প্রত্যাঘাত করলেও এবার ধর্মীয় সমর্থনে ভিতরে মারার অধিকার একটা নির্দিস্ট দিক নির্দেশ দিলো।প্রথমে ওই ফতোয়ার নির্দেশ ধরে আত্মসমর্পর্ন করার কথা ঘোষনা করা হয়,কোনো সদুত্তর না পাওয়ার পরে মিনারগুলোতে রকেট নিক্ষেপ করা হয় উপরে থাকা দুরপাল্লার(স্নাইপার)রাইফেলধারী লোকদের নিস্ক্রিয় করতে।একই সাথে সেই আগের বলা সাফা-মারওয়া পথের বাইরের দিকের আগেই ভেঙ্গে দেওয়া দরজা দিয়ে গোলা দাগা শুরু করে।
অবশেষে,শনিবার, নভেম্বর ২৪ তারিখ এই সাফা মারওয়া পথের দখল নিতে পারে সৌদি বাহিনী।জুহাইমান আর তার দল উপরের অংশ থেকে পিছু হটে আশ্রয় নেয় মসজিদের মাটির নিচের ঘরগুলোতে।এই জায়গায় সর্বসাকুল্যে ২২৫টী ঘর পরস্পরের সাথে সংযোগ যুক্ত ছিল।পর্যাপ্ত অস্ত্র,গুলি আর প্রয়োজনীয় খাদ্য নিয়ে আরো এক সপ্তাহ লড়াই করার অবস্থায় ছিল বলে ধারণা করা হয়।বোমা,গুলি এমনকি নানান কার্পেট বা গাড়ির টায়ার পুড়িয়ে সব রকম ভাবে সৌদি বাহিনী কে বাধা দিয়ে যায় জুহাইমানের বাহিনী।এই সময়ে কাদানে গ্যাস দিয়ে এদের বের করে নিয়ে আসার কাজ ও ব্যর্থ হয়।ভূগর্ভে থাকার কারণে এই গ্যাস আবার মাটির উপরের দিকেই উঠতে থাকে আর এই লোকগুলো মুখে জলে ভিজানো কাপড় লাগিয়ে রাখার কারণে কোনো প্রতিকুল অবস্থায় পড়ে নি বরং উল্টে এই গ্যাস মাটির উপরে থাকা সৌদি বাহিনীর জন্য বিরূপ অবস্থা তৈরী করে।এই পর্যায়ে সমস্যা আরো প্রকট হয় কারণ মসজিদে নামাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গোটা মুসলিম বিশ্বে প্রভূত সম্মানহানি হতে থাকে।গোটা পৃথিবীর মুসলিম দেশগুলোতে এই আজান সম্প্রসার বা এর প্রতীকী একটি মূল্য ছিল যা ধাক্কা খায়। সৌদি শাসকদের অত্যন্ত অস্বস্তির কারণ হতে থাকে এই সময়টি। সৌদি শাসকের সেনা একের পর এক উপায়ে চেষ্টা করে যেতে থাকে এদের উৎখাত করতে তবে সফলতা পাচ্ছিল না এই অসংখ্য কক্ষ আর ভূগর্ভের কক্ষে এদের অবস্থানের কারণে।আরো একটি কারণ ছিল , সৌদি শাসক পাখির চোখের মতো লক্ষ্য করেছিল এদের পালের গোদা কে জীবন্ত ধরার জন্য।অতঃপর,এই অস্বস্তিকর অবস্থা এবং বিশ্বজুড়ে চাপ অবসান করতে সৌদি রাজা সাহায্যের জন্য ফরাসি রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করে।
পরবর্তী পর্বে এই দখলের অন্তিম পরিনতি এবং বিষ বৃক্ষের সূচনার প্রাসঙ্গিক কথা থাকবে।ততক্ষণ আবার একটি চা পানের বিরতি।
এই পর্বের তথ্যসূত্র:
১. ইতিহাসের পাতা থেকে https://medium.com/@haramainarchives/makkah-grand-mosque-seizure-1979-ae55625315a5
২. যে অসত্য খবর পরিবেশন করার পরে পৃথিবীতে এক নতুন অশান্তি শুরু হয়েছিল https://www.nytimes.com/1979/11/21/archives/mecca-mosque-seized-by-gunmen-believed-to-be-militants-from-iran.html
৩. স্রেফ ছবির হিসেবে দেখলেও পর্ব ধরে দেখতে পারেন এই প্রতিবেদন গুলো https://www.youtube.com/watch?v=Z7kzj-zPoOM
৪. একই ভাবে পরের পর্ব https://www.youtube.com/watch?v=JufzBz6gbnA
৫. তিন নম্বর পর্ব https://www.youtube.com/watch?v=oomQ6IyWyg4

কাবা এবং মসজিদ আল হারাম দখলের কালান্তক ইতিহাস–দ্বিতীয় পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব



আলোচিত মেহেদির পূর্বাপর এবং বাকি বৃত্তান্ত
এর আগে প্রস্তুতি হিসেবে সে এই পূর্বালোচিত মেহেদী বা প্রেরিত পুরুষ হিসেবে মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল কাহ্তানী বলে মৃদুভাষী একটি তরুণ ধর্ম প্রচারক কে চিহ্নিত করে।এই ক্ষেত্রে হাদিসে সেই প্রেরিত পুরুষের নাম বা তাঁর বাবার নাম এবং এই লোকটির ক্ষেত্রেও একই হওয়া একটি বড় হাতিয়ার হয়।একই সাথে বর্ণিত মেহেদির উন্নত কপাল ,রোগা গড়ন ,উন্নত নাসিকা ইত্যাদি মিল একটি মোক্ষম সুযোগ এনে দিলো। প্রথমে কাহতানি নিজেকে দেখতে রাজি না হলেও পরবর্তীতে জুহাইমান এর মোহে আবিষ্ট হয়ে সত্যিই নিজেকে ওই ভাবে ভাবতে শুরু করে।এই সখ্যতা আরো পোক্ত হয় যখন তার বড় বোন কে জুহাইমান তার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে বিয়ে করে।
অভিযানের আগে কাবা একটি গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে ইমাম মেহেদী কে শত শত মক্কাবাসী স্বপ্নে দেখেছে শীর্ষ মসজিদের মিনারে ইসলামের পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।একই সাথে দলের অভ্যন্তরে এই ইমামের বিষয়ে কোনো সন্দেহের প্রশ্ন রাখার অবকাশ সে রাখে নি।একদিকে যখন জুহাইমান আর তাঁর দল প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই প্রস্তুতি নিচ্ছিল ওই সময়ে সৌদি বাদশা পুত্র এবং এক অর্থে ক্ষমতার কর্নধার ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজ ছিল তিউনিসিয়ায় আরব লীগের একটি বৈঠকের সফরে আর প্রিন্স আব্দুল্লাহ ,জাতীয় সুরক্ষার প্রধান ছিল মরোক্কো সফরে।দেশের দেখভাল করার জন্য ছিল বৃদ্ধ এবং অসুস্থ রাজা খালেদ আর রক্ষামন্ত্রী প্রিন্স সুলতান।
সৌদি রাজশক্তির তৎপরতা :
সেই সকালেই খবর পেয়ে শেখ নাসের রাজা খালেদকে এই খবর দেন।রাজা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রিন্স সুলতান বিন আব্দুল আজিজ এবং অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের সর্বোচ্চ কর্তা প্রিন্স নাইফ বিন আব্দুল আজিজ কে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে আদেশ করে।পরবর্তিতে মক্কার প্রশাসক প্রিন্স ফাওয়াজ বিন আব্দুল আজিজ,গুপ্তচর বিভাগের প্রিন্স তুর্কি অকুস্থলের কাছে চলে আসে।তুর্কি স্বীকার করে যে জুহাইমান আর তার গোষ্ঠী তুলনামূলক ভাবে একটু ছোট দল হওয়ার কারণে এদের উপরে নজর রাখা হলেও সামগ্রিক কোন বিপদের আশংকা বা এই ধরনের কোনো কান্ড করতে পারে তা তারা ভাবতেও পারে নি।
সৌদি পুলিশ প্রথমে এই দখলের গুরুত্ব বুঝতেই পারে নি।সকালে একজন পুলিস অফিসার বিষয়টি দেখতে একটি জিপ নিয়ে এগিয়ে গেলে দখলদার বাহিনীর গুলিতে আহত হয়।একই ভাবে অন্য দিক থেকে আসা অন্য পুলিস অফিসারদের গাড়ি গুলোতেও ভিতর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসে।এই পর্যায়ে ভিতরে থাকা সাধারন মানুষদের ঢাল বানিয়ে এই দলটি ক্রমশ আক্রমন চালিয়ে যায় সৌদি পুলিশের উপরে।এই পর্যায়ে আহত বা নিহত এই সব মানুষদের দেহ উদ্ধার করার চেষ্টা করলেও তাদের উপরে একই ভাবে গুলি বর্ষণ করতে থাকে ভিতর থেকে।মৃত্যু হয় এক পুলিস অফিসারের এবং ভিতরের এক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা এক কিশোরের।ইমামের মতো আরো কিছু সৌদি নাগরিক পিলারের আড়াল ধরে ধীরে ধীরে একটি জানালার কাঁচের ফাঁক দিয়ে একদল রোগা পাতলা লোক বাইরে পালাতে স্বক্ষম হয়।মসজিদ চত্ত্বরে থাকা সৌদি নারী পুরুষদের জোর করে এই ঘোষিত ইমামের পক্ষে শপথ পাঠ করানো চলতে থাকে।
প্রিন্স তুর্কি মসজিদের পাশের হোটেল সৌবরাতে এই পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে একটি বৈঠক করতে এলে,হোটেলের দরজাতে হাত দেওয়া মাত্র একটি বুলেট তার দিকে ছুটে আসে,কপাল গুনে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে দরজার কাজ চুরমার করে দেয়।তড়িঘড়ি তাঁকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়।এই বুলেট এসেছিল মসজিদের আব্দুল আজিজ দরজার জোড়া মিনারের থেকে।হোটেলটি মসজিদের থেকে মাত্র ১৫০ মিটার দুরে থাকায় ওই দখলদার বাহিনীর স্নাইপারের আওতায় ছিল আর সৌদি কর্তিপক্ষ তা আগে একদম আন্দাজ করতে পারে নি।
সৌদি উপলব্ধি এবং পরবর্তী কাজকর্ম:
এইবার সৌদি শাসক গোষ্ঠী বুঝতে পারে এদের প্রস্তুতি বা শক্তি অনেক বেশি।এরপরে এই কাবা এবং শীর্ষ মসজিদের চারপাশে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরী করে।বিশেষ রক্ষী বাহিনী ,বিশেষ ছত্রী বাহিনী আর বিশেষ স্বশস্ত্র দল কে মোতায়েন করা হয়।সমস্যা হলো,পাল্টা আক্রমন করার ক্ষেত্রে,যেহেতু সব চেয়ে পবিত্র এই স্থানে কোনো অস্ত্র ইত্যাদি নিয়ে যাওয়া বা পাল্টা আক্রমন এতো সহজ ছিল না,এর সাথে গোটা মুসলিম দেশগুলোর মানুষের এবং নিজের দেশের মানুষের অনুভুতির প্রশ্ন জড়িত ছিল।এই কারণে দরকার ছিল উলেমাদের থেকে ধর্মীয় নির্দেশ।এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ভারপ্রাপ্ত উলেমাদের দল দুই দিন সময় নিয়েছিল।এই দুই দিন সৌদি প্রশাসন প্রস্তুতি নিতে থাকে আর একই সঙ্গে পুরো জায়গাটির উপরে নজর রাখা শুরু করে।
হেলিকপ্টারের চক্কর এবং জঙ্গি বিমানের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়।নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া হেলিকপ্টারকে লক্ষ্য করে গুলি ছুটে আসে,ভাগ্যক্রমে একজন চালক রক্ষা পায় তার বদলে সঙ্গের বেতার ব্যবস্থার গায়ে গুলি লাগার কারণে।এই সময়ে নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়ার কারণে দেখা যায় ভিতরে স্বশস্ত্র পুরুষই না,বেশ কিছু নারী ও অস্ত্র নিয়ে ভিতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।পরবর্তিতে সৌদি প্রশাসন জানতে পেরেছিল এই জুহাইমানের সাথে তার স্ত্রী আর বাকিদের অনেকের পরিবার বা সন্তান ও এসেছিল এই অভিযানে।সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টি অনেক জটিল হয়ে ওঠে মোকাবিলার জন্য।
পরেরদিন সরকারী ভাবে অতি ভোরে রিয়াদ রেডিও থেকে ঘোষণা করা হয় এই কাবা এবং সংলগ্ন মসজিদ দখলের আর দখলকারী গোষ্ঠির কোনো এক ব্যক্তিকে সেই মেহেদী ঘোষণার কথা।ইতিমধ্যেই অবশ্য মার্কিন সংবাদ মাধ্যমের সূত্র ধরে এই খবর গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গিয়েছিল।এই দ্বিতীয় দিনে সেই সময়ের নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি ভয়াবহ অসত্য খবর দিয়ে ফেলে যাতে শিরোনাম ছিল, “মক্কা মসজিদ দখল করা বন্দুকধারীর দল সম্ভবত ইরানের জঙ্গি গোষ্ঠী।
বিশ্বজুড়ে নতুন অশান্তির সূচনা:
এই খবর এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরী করলো,কারণ এর কিছু দিন আগেই ইরানের শাহ কে অপসারণ করে মোল্লা গোষ্ঠির বা আরো নির্দিস্ট করে বললে শিয়া পন্থী খোমেইনি ক্ষমতা দখল করে আমেরিকার দুতাবাসে ৫২ জন মার্কিন নাগরিক এবং বাকিদের আটকে রেখেছিল।এরপরে এর প্রত্যুত্তর দিতে খোমেইনি পাল্টা দায়ী করে আমেরিকাকে আর চারিদিকে পল্লবিত হতে থাকে গুজবের নানান বিষয়।
এরপরেই একদল লোক পাকিস্থানে মার্কিন দুতাবাসে আক্রমন করে সেটি মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়।দুজন মার্কিন এবং দুজন পাকিস্থানি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী এই ঘটনায় মারা ও যায়।পরবর্তিতে একই কারণে খোমেইনীর অভিযোগের ভিত্তিতে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলিতে একই ভাবে মার্কিন দুতাবাস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়,এই ঘটনা এতটাই সুদুরপ্রসারী হয়েছিল যে পরবর্তী ২৫ বছর ওই দেশে আর মার্কিন কোনো দুতাবাস স্থাপনা হয় নি।
এই সবের মাঝে, ঘটনার দু দিন পরে অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের প্রধান প্রিন্স নাইফ সব জল্পনা শেষ করে পরিস্কার জানায় আমেরিকা বা ইরান অথবা অন্য কোনো দেশ এতে জড়িত না।এই ঘটনা সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ একটি গোষ্ঠির কাজ যারা ‘পথভ্রষ্ট‘ হয়েছিল।
এই সময়ের মধ্যে একাধিকবার এই মসজিদ বা পুরো স্থাপনার ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেও সফল হয় নি সৌদি বাহিনী।এই সময়ে পুরো অভিযানের নেতৃত্ব দিতে নিয়ে আসা হয় সৌদি রাজার স্বশস্ত্র ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফালেহ আল দাহরি কে।ঠিক হয় ,মারওয়া দরজা উড়িয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকবে এই বাহিনী।এই সময়ে এক কঠিন অবস্থার সামনে পড়েছিল সৌদি শাসকরা।ইমাম মেহেদির তত্বে বিশ্বাসী একাংশ ধরে নিয়েছিল এই বিরোধিতা আসছে শয়তানের পক্ষ থেকে এই সাজোয়া গাড়ির বহর নিয়ে।অর্থাৎ একটা জন সমর্থন গড়ে ওঠার অবস্থা তৈরী হয়েছিল এই ইমাম মেহেদীকে কেন্দ্র করে যাতে শাসক গোষ্ঠী শয়তানের দোসর হিসেবে ভুমিকা নিতে যাচ্ছিল।এই পর্যায়ে একটি বুদ্ধিমানের মতো কাজ সৌদি প্রশাসন করে,পুরো অভিযানের নানান পর্যায়ে এরা সংবাদ মাধ্যমকে নিজেদের কাজের বিষয়ে জানানো বা সঙ্গে রাখার কাজ শুরু করে ফলে বিষয়টি অনেক স্বচ্ছ হয়ে ওঠে।
প্রথমদিনে সাজোয়া গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেলেও তীব্র গুলির কারণে শারীরিক ভাবে মসজিদের আশেপাশে নেমে অবস্থান নেওয়ার কোনো সুযোগ পায় নি সৌদি বাহিনী।এরপরের দিন কৌশলগত ভাবে আসেপাশের উচু অবস্থাপনা গুলোতে পাল্টা দূর পাল্লার বন্দুকবাজ মোতায়েন করে সৌদি বাহিনী।এইবার উচ্চ অবস্থান থেকে পাল্টা গুলি চালিয়ে অনেকটাই নিস্ক্রিয় করে ফেলতে পারে ওই দখলদার বাহিনীর স্নাইপার গুলো কে।একই সাথে আকাশ থেকে নিরীক্ষণের মাধ্যমে সৌদি বাহিনী জানতে পারে উত্তর ভাগের মারওয়া দরজা অপেক্ষাকৃত কম প্রতিরোধের জায়গা হতে পারে।
এই পর্যায়ে ২২ তারিখ,ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ, সৌদি গোলন্দাজরা কম মাপের বিস্ফোরক গোলা ছুড়তে থাকে,এটি স্রেফ ওই অবস্থানরত প্রতিরোধকারীদের নজর অন্যদিকে নিয়ে আরো একটি বাহিনীকে সাফা-মারওয়া পথের পূর্ব দিকে অবস্থান নিতে করা হয়েছিল।এই কাজে অর্ধেক পথ এগিয়ে গেলেও তীব্র গুলির কারণে বেশ কিছু সেনার মৃত্যু হলে বাহিনী আবার পিছু হটে যায়।একই ভাবে আগে বলা সেই মারওয়া দরজার দিকে বিস্ফোরক সহযোগে দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকতে পারলেও সফল হলো না।
ফতোয়ার জোরে নতুন শক্তি প্রাপ্তি:
অবশেষে,নভেম্বর ২৩তারিখে ইসলামের ইতিহাসে সূচনা থেকে এই প্রথম,জুম্মার নামাজ পড়া হলো না এই শীর্ষ মসজিদে।দিনের শেষে উলেমারা ফতোয়া দিলো “এই জঙ্গিদের অস্ত্র ত্যাগ করে আত্মসমর্পর্ন করার আবেদন করা হোক,তা না মানলে কোরানের আল বাকারাহর বিধান অনুযায়ী যদি আল মসজিদ আল হারাম এ আক্রমন না করার এবং যদি একান্তই আক্রান্ত হও তবে তাদের হত্যা করার আদেশের ভিত্তিতে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া হোক”
এইবার এই ফতোয়ার আনুকূল্যে একটা শক্ত অবস্থান পেলো সৌদিশক্তি।এতদিন বাইরে থেকে প্রত্যাঘাত করলেও এবার ধর্মীয় সমর্থনে ভিতরে মারার অধিকার একটা নির্দিস্ট দিক নির্দেশ দিলো।প্রথমে ওই ফতোয়ার নির্দেশ ধরে আত্মসমর্পর্ন করার কথা ঘোষনা করা হয়,কোনো সদুত্তর না পাওয়ার পরে মিনারগুলোতে রকেট নিক্ষেপ করা হয় উপরে থাকা দুরপাল্লার(স্নাইপার)রাইফেলধারী লোকদের নিস্ক্রিয় করতে।একই সাথে সেই আগের বলা সাফা-মারওয়া পথের বাইরের দিকের আগেই ভেঙ্গে দেওয়া দরজা দিয়ে গোলা দাগা শুরু করে।
অবশেষে,শনিবার, নভেম্বর ২৪ তারিখ এই সাফা মারওয়া পথের দখল নিতে পারে সৌদি বাহিনী।জুহাইমান আর তার দল উপরের অংশ থেকে পিছু হটে আশ্রয় নেয় মসজিদের মাটির নিচের ঘরগুলোতে।এই জায়গায় সর্বসাকুল্যে ২২৫টী ঘর পরস্পরের সাথে সংযোগ যুক্ত ছিল।পর্যাপ্ত অস্ত্র,গুলি আর প্রয়োজনীয় খাদ্য নিয়ে আরো এক সপ্তাহ লড়াই করার অবস্থায় ছিল বলে ধারণা করা হয়।বোমা,গুলি এমনকি নানান কার্পেট বা গাড়ির টায়ার পুড়িয়ে সব রকম ভাবে সৌদি বাহিনী কে বাধা দিয়ে যায় জুহাইমানের বাহিনী।এই সময়ে কাদানে গ্যাস দিয়ে এদের বের করে নিয়ে আসার কাজ ও ব্যর্থ হয়।ভূগর্ভে থাকার কারণে এই গ্যাস আবার মাটির উপরের দিকেই উঠতে থাকে আর এই লোকগুলো মুখে জলে ভিজানো কাপড় লাগিয়ে রাখার কারণে কোনো প্রতিকুল অবস্থায় পড়ে নি বরং উল্টে এই গ্যাস মাটির উপরে থাকা সৌদি বাহিনীর জন্য বিরূপ অবস্থা তৈরী করে।এই পর্যায়ে সমস্যা আরো প্রকট হয় কারণ মসজিদে নামাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গোটা মুসলিম বিশ্বে প্রভূত সম্মানহানি হতে থাকে।গোটা পৃথিবীর মুসলিম দেশগুলোতে এই আজান সম্প্রসার বা এর প্রতীকী একটি মূল্য ছিল যা ধাক্কা খায়। সৌদি শাসকদের অত্যন্ত অস্বস্তির কারণ হতে থাকে এই সময়টি। সৌদি শাসকের সেনা একের পর এক উপায়ে চেষ্টা করে যেতে থাকে এদের উৎখাত করতে তবে সফলতা পাচ্ছিল না এই অসংখ্য কক্ষ আর ভূগর্ভের কক্ষে এদের অবস্থানের কারণে।আরো একটি কারণ ছিল , সৌদি শাসক পাখির চোখের মতো লক্ষ্য করেছিল এদের পালের গোদা কে জীবন্ত ধরার জন্য।অতঃপর,এই অস্বস্তিকর অবস্থা এবং বিশ্বজুড়ে চাপ অবসান করতে সৌদি রাজা সাহায্যের জন্য ফরাসি রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করে।
পরবর্তী পর্বে এই দখলের অন্তিম পরিনতি এবং বিষ বৃক্ষের সূচনার প্রাসঙ্গিক কথা থাকবে।ততক্ষণ আবার একটি চা পানের বিরতি।
এই পর্বের তথ্যসূত্র:
১. ইতিহাসের পাতা থেকে https://medium.com/@haramainarchives/makkah-grand-mosque-seizure-1979-ae55625315a5
২. যে অসত্য খবর পরিবেশন করার পরে পৃথিবীতে এক নতুন অশান্তি শুরু হয়েছিল https://www.nytimes.com/1979/11/21/archives/mecca-mosque-seized-by-gunmen-believed-to-be-militants-from-iran.html
৩. স্রেফ ছবির হিসেবে দেখলেও পর্ব ধরে দেখতে পারেন এই প্রতিবেদন গুলো https://www.youtube.com/watch?v=Z7kzj-zPoOM
৪. একই ভাবে পরের পর্ব https://www.youtube.com/watch?v=JufzBz6gbnA
৫. তিন নম্বর পর্ব https://www.youtube.com/watch?v=oomQ6IyWyg4

Posted at April 18, 2019 |  by Arya ঋষি
No photo description available.
এক বিষ বৃক্ষের সূচনা -১ম পর্ব 
মুখবন্ধ: আমরা অনেক কাছের বিষয় দেখি না বা ভুলে যাই।এই লেখাটি একটি ঐতিহাসিক তবে কালান্তক ঘটনার উপরে লেখা যা একটি দেশ বা গোটা পৃথিবীতে এক রক্ষণশীল ঘেরাটোপের সূচনা করেছিল। আসুন,জানি , ঠিক কি ছিল সেই ঘটনা। ইতিহাসের নিরিখে বেশি আগের নয় , স্রেফ চার দশকের আগে একটি ধর্মান্ধ মানুষ আর তার তৈরী একটি স্বশস্ত্র গোষ্ঠী আচমকা দখল নিয়েছিল কাবা এবং এর মধ্যে থাকা মসজিদ আর নানান স্থাপনাগুলো।এই ঘটনা ইসলামিক দুনিয়া তো বটেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা দুনিয়াকে।একই সাথে তুলনামূলক আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা সৌদি আরবকে পরিবর্তিত করেছিল একটি ধর্মের ঘেরাটোপে মধ্যযুগের একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়। সেই কলঙ্কিত দিনগুলোর শুরু হয় ২০শে নভেম্বর , ১৯৭৯ সালে।এই সময়ের এক মাস আগে ছিল হ্বজ এবং ঈদের উৎসবের সময়।দুনিয়ার নানান প্রান্ত থেকে আগত পুণ্যার্থী এবং আশেপাশের নানান দেশের অনেক শীর্ষস্থানীয় মানুষের সমাগম হয়েছিল ওই মাসে মানে অক্টবরে।পরের মাসেও প্রায় হাজার পঞ্চাশেক মানুষ ছিল এই কাবা প্রাঙ্গনে সকালের প্রথম প্রার্থনা মানে ফজরের নামাজের সময়ে।এই সময়েই দুশো অস্ত্রধারী লোকের সাথে এই পবিত্রতম স্থানের দখল নিয়েছিল চল্লিশ বছরের জুহাইমান আল উতায়বি।কাবা সংলগ্ন শীর্ষ মসজিদের ইমাম তার ফজরের নামাজ শেষ করার পরেই এই ঘটনা ঘটে। কি করে লোকটি এই ঘটনা ঘটিয়েছিল ? এই কাজের সুযোগ পেয়েছিল কারণ পঞ্চাশের দশক থেকেই এই স্থানের প্রসারণ এবং আরো মানুষের স্থান করে দিতে নানান প্রাসঙ্গিক নির্মাণের কাজ হচ্ছিল সেই প্রথম বাদশা সৌদ এর সময় থেকেই।ওই মাস সেই বছরের ইসলামী নতুন বছরের শুরুর কারণে আরো একটু বেশি নির্মাণের কাজ চলছিল।ঠিক এই সুযোগ নিয়েছিল এই দলটি। এই নতুন ইসলামী বছর মানে ১৪০০ উজ্জাপনের ধর্মীয় রীতির জন্য সৌদি এবং বিদেশী অনেক নাগরিক যখন ওই জায়গায় এসেছিল,ঠিক সেই সময়েই কয়েকটি ট্রাকে নির্মাণ শ্রমিকদের নিত্য আনাগোনার পথেই নজর এড়িয়ে মসজিদের ফাতাহ দরজা দিয়ে ঢুকে যায় এই দলটি।আল সুবাইল যিনি ওই সময়ের ইমামতি করতেন ,তার ভাষায় ,ফজরের নামাজ আদায়ের পরেই দেখতে পেলেন তার দিকে বিশ /তিরিশজন সশস্ত্র মানুষ এগিয়ে আসছে।আশংকা প্রবল হয়ে উঠলো যখন তিনি প্রাঙ্গনে বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পেলেন।এই পুরো জায়গাটি দখলের শুরুতেই দরজার দুজন লাঠি হাতে থাকা রক্ষী গুলিতে নিহত হলো এই সময়ে।এই আতংক আর হুড়োহুড়ির মধ্যেই বেশ কিছু মানুষ এই জায়গা থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো।এরপরেই এই দখলকারী বাহিনী বেরিয়ে যাওয়ার দরজা গুলো বন্ধ করে দিলো।এই পর্যায়ে তিনজন সশস্ত্র লোক ইমামের দিকে এগিয়ে এলো ,এদের একজন মানে জুহাইমান মাইক দখল করে নির্দেশ দিতে থাকলো তার সঙ্গের নানান অস্ত্রধারীদের। সব মিনারের উপরে বন্দুকধারী আর প্রত্যেক দরজায় একই ভাবে তাঁদের অবস্থান নিতে নির্দেশ দিলো সে। সোজা কথায় কেউ অগ্রসর হলেই গুলি করতে ফরমান জারি করে সে।এই দলটি তাদের অস্ত্র এবং অন্য গোলা বারুদ নিয়ে আসার জন্য ব্যবহার করেছিল কফিনের মধ্যে।এই জায়গাতে প্রায়শই মৃত মানুষের দেহ নিয়ে আসা হয় অন্তিম যাত্রার আগে মৃতের কল্যাণের জন্য। জুহাইমান এর পরে মাইক দেয় তার অপর সঙ্গী আরো এক ধর্মপ্রচারক খালেদ আল ইয়ামিকে।সে পূর্ব লিখিত ভাষণ থেকে মসজিদের মাইকে ঘোষণা করে তাদের সাথে আছে প্রত্যাশিত সেই ইমাম মেহেদী যার পরিচিত নাম মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল কাহ্তানী।এই বিষয়ে বলতে গিয়ে এও বলা হয় যে , সে কুরেশ বংশের এবং তার বাবা এবং মা আশরাফ।একই সাথে এর বংশপরিচয়ে নবী মোহাম্মদের সঙ্গী এবং আত্মীয় আর অন্যতম খলিফা আলীর এবং ফাতেমার ঔরসজাত সন্তানের ধারক ও বলা হয়।এই গুণাবলী গুলি প্রত্যাশিত ইমাম মেহেদির থাকার কথা যা এই মানুষটির আছে এই ছিল মূল দাবি।এই পর্যায়ে বলতে ইচ্ছে হয় , সব জায়গায় সেই একই উচ্চ বংশ এবং শ্রেণী বিভাজনের জন্য আলাদা ব্যবস্থার কথা দেখা যায়,কোনো ব্যতিক্রম নেই !এই সঙ্গে বলা হয় তাঁরা এক পরিচ্ছন্ন দুনিয়া বিশেষতঃ কুশাসন মুক্ত সৌদি প্রশাসনের জন্য এসেছে।একই সাথে তৎকালীন সৌদি রাজতন্ত্র এবং উলেমা এবং অন্য ইসলামী ধর্মীয় গুরু যাঁরা সৌদি সমাজে স্বীকৃত ছিল তাদের উৎখাত এবং তাদের নির্দেশাবলী কে নস্যাৎ করার কথাও বলে।উপস্থিত সব মানুষকে তাঁদের ঘোষিত মেহেদির আনুগত্য জানাতে আহ্বান ও জানানো হয় একই সাথে।তাদের এই কার্যাবলী সবই মানুষকে কোরান এবং হাদিসের পথে নিয়ে যাওয়ার তাই কোনো অন্যায় করতে তাঁরা আসেনি,এই ছিল ভাষণের মূল বক্তব্য। এই মেহেদির আবির্ভাব একটি অত্যাশ্চর্য ঘোষণা ছিল ওই মসজিদ চত্বরে উপস্থিত সব পুণ্যার্থীর জন্য। যারা জানেন না তাঁদের জন্য বলে রাখি , এই ইমাম মেহেদির আগমন কেয়ামতের আগে ঘটবে এবং এক সার্বিক যুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীতে আবার অন্যায় ,অবিচার ইত্যাদি মিটিয়ে শোষণ নির্যাতন দূর করে এক সুবর্ন যুগের সূচনার কথা ইসলামী হাদিসে বলা আছে। এই আবির্ভাব হওয়ার কথা নবী মোহাম্মদ বলেছে বলেই বলা হয় আর তাই এই ঘোষণা এক অভূতপূর্ব চাঞ্চল্য তৈরী করে ওই জায়গায় থাকা সবার কাছেই। এই ঘটনার মূল চক্রী জুহাইমান এরপরে নাটকীয় ভাবে সবার সামনে তুলে ধরা সেই মেহেদীকে সর্বপ্রথম শ্রদ্ধা জানায় আর তারপরেই তার দলের "আল্লাহ আকবর " উল্লাস ধ্বনি শোনা যায়।এক সার্বিক অচলাবস্থার সূচনা হয়।এই পুণ্যার্থীদের একটি বড় অংশ ছিল বিদেশী এবং তাঁরা আরবি সে ভাবে জানতো না। এই কারণে ঠিক কি হচ্ছে তা বুঝে উঠতে পারে নি। এর সাথে এই সর্বাধিক পবিত্র জায়গায় নিষিদ্ধ ছিল কোনো অস্ত্র বহন করা তাই এতো অস্ত্রধারী আর এই সব কান্ড দেখে তাঁরা হতচকিত হয়ে যায়।সত্যি বলতে কাবাতে ওই সময়ে অস্ত্রের প্রবেশ এতোটাই নিষিদ্ধ ছিল যে মূল দরজার রক্ষীদের হাতেও স্রেফ লাঠি থাকতো। এই প্রবল বিশৃঙ্খলার মধ্যে ইমাম কোনক্রমে তার মসজিদের অফিসে ঢুকে যেতে তার উর্দ্ধতন কর্তিপক্ষ শেখ নাসের বিন হামাদ আল রাশিদ যিনি ওই সময়ের প্রাসঙ্গিক বিষয়ের কর্তা ছিলেন তাকে ফোনে বিষয়টি জানান,একই সাথে আসেপাশে হওয়া ঘটনার গুরুত্ব বুঝাতে ফোনটি ধরে রাখে যাতে বন্দুকের আওয়াজ শোনানো যায়।এরপরে তিনি খেয়াল করেন এই দখলদারের দল বিদেশী পূন্যার্থীদের চলে যেতে দিচ্ছে তবে আরব বিশেষত সৌদি নাগরিকদের না।ঘন্টা চারেক অপেক্ষা করে নিজের নির্দিস্ট ইমামতির পোশাক ছেড়ে সাধারণ পোশাকে ভূগর্ভস্থ দরজা দিয়ে ইন্দোনেশীয় তীর্থযাত্রীদের সাথে বাইরে চলে আসতে স্বক্ষম হন। স্রেফ এক ঘন্টার মধ্যেই এই দলটি পুরো কাবা এবং সংলগ্ন পুরো জায়গাটি দখল করে নিয়ে সোজাসুজি সৌদি রাজার মানে রাজশক্তির জন্য অতীব বিপদজনক সংকেত তৈরী করে দিলো।এই দখলদারি করা লোকগুলো একটি সংগঠন তৈরী করেছিল এর আগে যার নাম আল-জামা আল-সালাফিয়া আল মুহতাসিবা বা JSM যেটির মূল দাবি ছিল ইসলামী পথে তৎকালীন সৌদি আরব কে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। সোজা কথায় একটি পুরো দস্তুর ধর্মীয় পথে রাষ্ট্রের চালনা এবং তৎকালীন শাসকের অপসারণ। মূল ঘটনার পূর্বাপর বৃত্তান্ত তিরিশের দশকের পর থেকে তেলের টাকার কারণে একটা অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক আর সামাজিক পটপরিবর্তন শুরু হয়েছিল গোটা আরব অঞ্চলে। নানান ভোগের সামগ্রী অতি সুলভ আর ক্রমশঃ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো নারী পুরুষের সামাজিক মেলামেশা ইত্যাদি নানান নতুন বস্তুর প্রচলন এক শ্রেণীর মৌলবাদী আর প্রাচীন পন্থী মানুষের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল।এই সময়ে এই জেএসএম নামের দল বা এদের সমর্থক গোষ্ঠী সেই পুরোনো ধাঁচে কোরান পাঠ ,হাদিসের বা প্রাসঙ্গিক পথেই চলার কাজ করে চলেছিল। এদের কাছে সৌদি রাজার কোনো অনুশাসনের বদলে স্রেফ কোরানের বাক্য ধরে চলার পথ গ্রহণীয় হয়েছিল।এক কথায়,সৌদি রাজতন্ত্রের কোনো অনুশাসন তাদের কাছে গ্রাহ্য ছিল না।দলের তরুণ নেতৃত্ব দেওয়া জুহাইমান সৌদি আরবের সাজির বলে একটি অঞ্চলের বেদুঈন পরিবারের সন্তান ছিল।তাঁর প্রথম জীবনের সৌদি রাজার সেনাদলের কাজের অভিজ্ঞতা এই অভিযানের জন্য কাজে লেগেছিল।এক পর্যায়ে সেনার চাকরি থেকে বেরিয়ে এসে এই কাজে যোগ দেয় এই লোকটি। দিনের পর দিন নিজের এলাকাতে মরুভূমির রাতের আসরে নিজের আগের জীবনের পথ ভুল ইত্যাদি বলে সঠিক পথ দেখানোর এই ধর্মীয় কথা বলে গিয়েছিল অসংখ্য নিজের গোষ্ঠীর লোকেদের কাছে।এই ভাবে সে ব্যক্তিগত অনুসারীর দল ও তৈরী করে ফেলেছিল। তার এই ধর্মীয় বয়ান বা নানান প্রাসঙ্গিক আসরের প্রত্যক্ষদর্শী ওসামা আল কোয়াশি ,যে নিজেও একটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিল ,বলেছিল যে জুহাইমান এই সময়ে বেআইনি নেশার বস্তু চোরাচালানের কাজ ও করছিল।ক্রমশঃ এক বড় সংখ্যক অল্পবয়েসী ছেলেদের আকর্ষিত করে তাঁর অনুসারী করে ফেলে।একটিই জায়গায় তার খামতি ছিল যা হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এমনকি অন্য আর পাঁচটি ধর্মীয় গুরুর মতো প্রাসঙ্গিক পড়াশোনাতে। এই প্রসঙ্গে তার এক সময়ের অনুসারী নাসের আল হজেইমির বয়ানে জানা যায় যে লোকটি মুলত প্রত্যন্ত বেদুইন অঞ্চলেই নিজের প্রচার করতো যেহেতু তার নিজের ভাষা মানে আরবির ধাঁচ ছিল তাঁদের মতো।শহরের বিশেষতঃ বুনিয়াদি আরবি ভাষাতে তাঁর দখল কম থাকায় কোনো শহরের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় স্থানে নিজের বক্তব্য রাখতে যায় নি।এই কাজ করতে গেলে তাঁর ওই শ্রোতাদের কাছে সম্ভ্রম বা শ্রদ্ধা আদায় করা সম্ভব হতো না ওটা সে নিজেও বুঝেছিল। এই ইমাম মেহেদী মোহ নিয়ে ওই সময়ের সৌদি রাষ্ট্রীয় নজরদারি বিভাগ বা ইন্টালিজেন্সির প্রধান তুর্কি আল ফায়সাল পরবর্তীতে একটি স্বাক্ষাৎকারে জানিয়েছিল যে এই গোষ্ঠীতে অসংখ্য ছাত্র ছিল যাঁরা এই মেহেদির আবির্ভাব কে আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করতো।প্রাথমিক পর্যায়ে কাবা এবং গোটা সৌদি আরবের ক্ষমতা দখল এবং পরবর্তীতে গোটা ইসলামী দুনিয়ায় নেতৃত্ব করা একটি প্রবল বাসনা ছিল এই দলটির।পাঠক,আল কায়দা বা আইসিস এর সাথে অনেকটাই মিল পাচ্ছেন কি ? যাইহোক ,একটা মজার বিষয় দেখুন , এই একই ভাবে প্রায় সব প্রচলিত ধর্মেই একজন পরিত্রাতা অন্তে আসার কথা বলা হয়েছে যে এই ধরিত্রীর সব পাপ বা ক্লেশ ইত্যাদি দূর করে একটি কাঙ্খিত যুগের সূচনা করবে। এই ক্ষেত্রেও কোনো ব্যতিক্রম নেই ,এক বহু যুগের এই আকাঙ্খা কে পুঁজি করে অনেক লোক এই কাজ করেছে।মুসলিম সমাজেও নানান দেশে এই কাজ আগেও হয়েছে।ঊনবিংশ শতকে মোহাম্মদ আহমেদ নামের এক সুদানিস শেখ ১৮৮১তে এই ধরণের একটি উত্থানের কাজ করতে গিয়েছিল তৎকালীন মিশরীয় পরাধীনতায় থাকা শাসকের বিরুদ্ধে। মজার কথা হলো এই মেহেদির কোনো প্রসঙ্গ কোরানে কিন্তু নেই।কেয়ামতের মানে শেষ দিনের আগে এই ধরণের ঘটনার আভাস থাকলেও হাদিস বর্ণিত কোনো ঘটনার বিষয় নেই বলেই মতামত দিয়েছে ইসলামের নানান পন্ডিত মহল।সে যে যাই বলুক,জুহাইমান এই মেহেদী বলে কাঙ্খিত মানুষের ভিত্তিতে এক বড় সংখ্যক অনুসারীর দল বানিয়ে ফেলেছিল।এই অনুসারীদের নিয়ে একটি নিকটস্থ মসজিদে এক জায়গায় হয় এই অভিযানের তিনদিন আগে।এই প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক নানান স্বাক্ষাতকারে দেখতে পাই এই অনুসারীদের প্রাক্তন কয়েকজন সদস্য এই গোষ্ঠিকে সালাফি আন্দোলনের একটি ধারা বলেছে,যাদের প্রবীন মাথাদের সরিয়ে এই নতুন প্রজন্মের দল পুরো নেতৃত্ব হাতে নিয়েছিল জুহাইমানের নেতৃত্বে। পরবর্তী পর্বে থাকবে এক চলমান পনেরো দিনের ক্রমাগত লড়াই এবং বিশ্ব রাজনীতিতে বিবিধ দোলাচল আর অন্য প্রাসঙ্গিক বিষয়-ততক্ষণ একটু চা পানের বিরতি  তথ্যসূত্র : ১. আলোচিত বইটির লেখকের একটি স্বাক্ষাতকার দেখুন 

https://www.youtube.com/watch?v=1hNjJY1OXmM ২. যারা বিষয়টি প্রতিবেদনের আকারে দেখতে চাইছেন তাদের জন্য https://www.youtube.com/watch?v=HItn3u02RwU ৩. নির্মোহ তবে আংশিক একটি প্রতিবেদন https://www.bbc.com/news/stories-50852379 ৪.  আরো একটি ভালো প্রতিবেদন  https://www.arabnews.com/node/1371221/saudi-arabia ৫. মূল বইটির লেখকের একটি স্বাক্ষাতকার এবং ঘটনার বিবরণ জানতে পারেন এই সুত্রে https://www.npr.org/templates/story/story.php?storyId=112051155

কাবা এবং মসজিদ আল হারাম দখলের কালান্তক ইতিহাসঃ-১ম পর্ব

No photo description available.
এক বিষ বৃক্ষের সূচনা -১ম পর্ব 
মুখবন্ধ: আমরা অনেক কাছের বিষয় দেখি না বা ভুলে যাই।এই লেখাটি একটি ঐতিহাসিক তবে কালান্তক ঘটনার উপরে লেখা যা একটি দেশ বা গোটা পৃথিবীতে এক রক্ষণশীল ঘেরাটোপের সূচনা করেছিল। আসুন,জানি , ঠিক কি ছিল সেই ঘটনা। ইতিহাসের নিরিখে বেশি আগের নয় , স্রেফ চার দশকের আগে একটি ধর্মান্ধ মানুষ আর তার তৈরী একটি স্বশস্ত্র গোষ্ঠী আচমকা দখল নিয়েছিল কাবা এবং এর মধ্যে থাকা মসজিদ আর নানান স্থাপনাগুলো।এই ঘটনা ইসলামিক দুনিয়া তো বটেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা দুনিয়াকে।একই সাথে তুলনামূলক আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা সৌদি আরবকে পরিবর্তিত করেছিল একটি ধর্মের ঘেরাটোপে মধ্যযুগের একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়। সেই কলঙ্কিত দিনগুলোর শুরু হয় ২০শে নভেম্বর , ১৯৭৯ সালে।এই সময়ের এক মাস আগে ছিল হ্বজ এবং ঈদের উৎসবের সময়।দুনিয়ার নানান প্রান্ত থেকে আগত পুণ্যার্থী এবং আশেপাশের নানান দেশের অনেক শীর্ষস্থানীয় মানুষের সমাগম হয়েছিল ওই মাসে মানে অক্টবরে।পরের মাসেও প্রায় হাজার পঞ্চাশেক মানুষ ছিল এই কাবা প্রাঙ্গনে সকালের প্রথম প্রার্থনা মানে ফজরের নামাজের সময়ে।এই সময়েই দুশো অস্ত্রধারী লোকের সাথে এই পবিত্রতম স্থানের দখল নিয়েছিল চল্লিশ বছরের জুহাইমান আল উতায়বি।কাবা সংলগ্ন শীর্ষ মসজিদের ইমাম তার ফজরের নামাজ শেষ করার পরেই এই ঘটনা ঘটে। কি করে লোকটি এই ঘটনা ঘটিয়েছিল ? এই কাজের সুযোগ পেয়েছিল কারণ পঞ্চাশের দশক থেকেই এই স্থানের প্রসারণ এবং আরো মানুষের স্থান করে দিতে নানান প্রাসঙ্গিক নির্মাণের কাজ হচ্ছিল সেই প্রথম বাদশা সৌদ এর সময় থেকেই।ওই মাস সেই বছরের ইসলামী নতুন বছরের শুরুর কারণে আরো একটু বেশি নির্মাণের কাজ চলছিল।ঠিক এই সুযোগ নিয়েছিল এই দলটি। এই নতুন ইসলামী বছর মানে ১৪০০ উজ্জাপনের ধর্মীয় রীতির জন্য সৌদি এবং বিদেশী অনেক নাগরিক যখন ওই জায়গায় এসেছিল,ঠিক সেই সময়েই কয়েকটি ট্রাকে নির্মাণ শ্রমিকদের নিত্য আনাগোনার পথেই নজর এড়িয়ে মসজিদের ফাতাহ দরজা দিয়ে ঢুকে যায় এই দলটি।আল সুবাইল যিনি ওই সময়ের ইমামতি করতেন ,তার ভাষায় ,ফজরের নামাজ আদায়ের পরেই দেখতে পেলেন তার দিকে বিশ /তিরিশজন সশস্ত্র মানুষ এগিয়ে আসছে।আশংকা প্রবল হয়ে উঠলো যখন তিনি প্রাঙ্গনে বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পেলেন।এই পুরো জায়গাটি দখলের শুরুতেই দরজার দুজন লাঠি হাতে থাকা রক্ষী গুলিতে নিহত হলো এই সময়ে।এই আতংক আর হুড়োহুড়ির মধ্যেই বেশ কিছু মানুষ এই জায়গা থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো।এরপরেই এই দখলকারী বাহিনী বেরিয়ে যাওয়ার দরজা গুলো বন্ধ করে দিলো।এই পর্যায়ে তিনজন সশস্ত্র লোক ইমামের দিকে এগিয়ে এলো ,এদের একজন মানে জুহাইমান মাইক দখল করে নির্দেশ দিতে থাকলো তার সঙ্গের নানান অস্ত্রধারীদের। সব মিনারের উপরে বন্দুকধারী আর প্রত্যেক দরজায় একই ভাবে তাঁদের অবস্থান নিতে নির্দেশ দিলো সে। সোজা কথায় কেউ অগ্রসর হলেই গুলি করতে ফরমান জারি করে সে।এই দলটি তাদের অস্ত্র এবং অন্য গোলা বারুদ নিয়ে আসার জন্য ব্যবহার করেছিল কফিনের মধ্যে।এই জায়গাতে প্রায়শই মৃত মানুষের দেহ নিয়ে আসা হয় অন্তিম যাত্রার আগে মৃতের কল্যাণের জন্য। জুহাইমান এর পরে মাইক দেয় তার অপর সঙ্গী আরো এক ধর্মপ্রচারক খালেদ আল ইয়ামিকে।সে পূর্ব লিখিত ভাষণ থেকে মসজিদের মাইকে ঘোষণা করে তাদের সাথে আছে প্রত্যাশিত সেই ইমাম মেহেদী যার পরিচিত নাম মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল কাহ্তানী।এই বিষয়ে বলতে গিয়ে এও বলা হয় যে , সে কুরেশ বংশের এবং তার বাবা এবং মা আশরাফ।একই সাথে এর বংশপরিচয়ে নবী মোহাম্মদের সঙ্গী এবং আত্মীয় আর অন্যতম খলিফা আলীর এবং ফাতেমার ঔরসজাত সন্তানের ধারক ও বলা হয়।এই গুণাবলী গুলি প্রত্যাশিত ইমাম মেহেদির থাকার কথা যা এই মানুষটির আছে এই ছিল মূল দাবি।এই পর্যায়ে বলতে ইচ্ছে হয় , সব জায়গায় সেই একই উচ্চ বংশ এবং শ্রেণী বিভাজনের জন্য আলাদা ব্যবস্থার কথা দেখা যায়,কোনো ব্যতিক্রম নেই !এই সঙ্গে বলা হয় তাঁরা এক পরিচ্ছন্ন দুনিয়া বিশেষতঃ কুশাসন মুক্ত সৌদি প্রশাসনের জন্য এসেছে।একই সাথে তৎকালীন সৌদি রাজতন্ত্র এবং উলেমা এবং অন্য ইসলামী ধর্মীয় গুরু যাঁরা সৌদি সমাজে স্বীকৃত ছিল তাদের উৎখাত এবং তাদের নির্দেশাবলী কে নস্যাৎ করার কথাও বলে।উপস্থিত সব মানুষকে তাঁদের ঘোষিত মেহেদির আনুগত্য জানাতে আহ্বান ও জানানো হয় একই সাথে।তাদের এই কার্যাবলী সবই মানুষকে কোরান এবং হাদিসের পথে নিয়ে যাওয়ার তাই কোনো অন্যায় করতে তাঁরা আসেনি,এই ছিল ভাষণের মূল বক্তব্য। এই মেহেদির আবির্ভাব একটি অত্যাশ্চর্য ঘোষণা ছিল ওই মসজিদ চত্বরে উপস্থিত সব পুণ্যার্থীর জন্য। যারা জানেন না তাঁদের জন্য বলে রাখি , এই ইমাম মেহেদির আগমন কেয়ামতের আগে ঘটবে এবং এক সার্বিক যুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীতে আবার অন্যায় ,অবিচার ইত্যাদি মিটিয়ে শোষণ নির্যাতন দূর করে এক সুবর্ন যুগের সূচনার কথা ইসলামী হাদিসে বলা আছে। এই আবির্ভাব হওয়ার কথা নবী মোহাম্মদ বলেছে বলেই বলা হয় আর তাই এই ঘোষণা এক অভূতপূর্ব চাঞ্চল্য তৈরী করে ওই জায়গায় থাকা সবার কাছেই। এই ঘটনার মূল চক্রী জুহাইমান এরপরে নাটকীয় ভাবে সবার সামনে তুলে ধরা সেই মেহেদীকে সর্বপ্রথম শ্রদ্ধা জানায় আর তারপরেই তার দলের "আল্লাহ আকবর " উল্লাস ধ্বনি শোনা যায়।এক সার্বিক অচলাবস্থার সূচনা হয়।এই পুণ্যার্থীদের একটি বড় অংশ ছিল বিদেশী এবং তাঁরা আরবি সে ভাবে জানতো না। এই কারণে ঠিক কি হচ্ছে তা বুঝে উঠতে পারে নি। এর সাথে এই সর্বাধিক পবিত্র জায়গায় নিষিদ্ধ ছিল কোনো অস্ত্র বহন করা তাই এতো অস্ত্রধারী আর এই সব কান্ড দেখে তাঁরা হতচকিত হয়ে যায়।সত্যি বলতে কাবাতে ওই সময়ে অস্ত্রের প্রবেশ এতোটাই নিষিদ্ধ ছিল যে মূল দরজার রক্ষীদের হাতেও স্রেফ লাঠি থাকতো। এই প্রবল বিশৃঙ্খলার মধ্যে ইমাম কোনক্রমে তার মসজিদের অফিসে ঢুকে যেতে তার উর্দ্ধতন কর্তিপক্ষ শেখ নাসের বিন হামাদ আল রাশিদ যিনি ওই সময়ের প্রাসঙ্গিক বিষয়ের কর্তা ছিলেন তাকে ফোনে বিষয়টি জানান,একই সাথে আসেপাশে হওয়া ঘটনার গুরুত্ব বুঝাতে ফোনটি ধরে রাখে যাতে বন্দুকের আওয়াজ শোনানো যায়।এরপরে তিনি খেয়াল করেন এই দখলদারের দল বিদেশী পূন্যার্থীদের চলে যেতে দিচ্ছে তবে আরব বিশেষত সৌদি নাগরিকদের না।ঘন্টা চারেক অপেক্ষা করে নিজের নির্দিস্ট ইমামতির পোশাক ছেড়ে সাধারণ পোশাকে ভূগর্ভস্থ দরজা দিয়ে ইন্দোনেশীয় তীর্থযাত্রীদের সাথে বাইরে চলে আসতে স্বক্ষম হন। স্রেফ এক ঘন্টার মধ্যেই এই দলটি পুরো কাবা এবং সংলগ্ন পুরো জায়গাটি দখল করে নিয়ে সোজাসুজি সৌদি রাজার মানে রাজশক্তির জন্য অতীব বিপদজনক সংকেত তৈরী করে দিলো।এই দখলদারি করা লোকগুলো একটি সংগঠন তৈরী করেছিল এর আগে যার নাম আল-জামা আল-সালাফিয়া আল মুহতাসিবা বা JSM যেটির মূল দাবি ছিল ইসলামী পথে তৎকালীন সৌদি আরব কে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। সোজা কথায় একটি পুরো দস্তুর ধর্মীয় পথে রাষ্ট্রের চালনা এবং তৎকালীন শাসকের অপসারণ। মূল ঘটনার পূর্বাপর বৃত্তান্ত তিরিশের দশকের পর থেকে তেলের টাকার কারণে একটা অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক আর সামাজিক পটপরিবর্তন শুরু হয়েছিল গোটা আরব অঞ্চলে। নানান ভোগের সামগ্রী অতি সুলভ আর ক্রমশঃ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো নারী পুরুষের সামাজিক মেলামেশা ইত্যাদি নানান নতুন বস্তুর প্রচলন এক শ্রেণীর মৌলবাদী আর প্রাচীন পন্থী মানুষের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল।এই সময়ে এই জেএসএম নামের দল বা এদের সমর্থক গোষ্ঠী সেই পুরোনো ধাঁচে কোরান পাঠ ,হাদিসের বা প্রাসঙ্গিক পথেই চলার কাজ করে চলেছিল। এদের কাছে সৌদি রাজার কোনো অনুশাসনের বদলে স্রেফ কোরানের বাক্য ধরে চলার পথ গ্রহণীয় হয়েছিল।এক কথায়,সৌদি রাজতন্ত্রের কোনো অনুশাসন তাদের কাছে গ্রাহ্য ছিল না।দলের তরুণ নেতৃত্ব দেওয়া জুহাইমান সৌদি আরবের সাজির বলে একটি অঞ্চলের বেদুঈন পরিবারের সন্তান ছিল।তাঁর প্রথম জীবনের সৌদি রাজার সেনাদলের কাজের অভিজ্ঞতা এই অভিযানের জন্য কাজে লেগেছিল।এক পর্যায়ে সেনার চাকরি থেকে বেরিয়ে এসে এই কাজে যোগ দেয় এই লোকটি। দিনের পর দিন নিজের এলাকাতে মরুভূমির রাতের আসরে নিজের আগের জীবনের পথ ভুল ইত্যাদি বলে সঠিক পথ দেখানোর এই ধর্মীয় কথা বলে গিয়েছিল অসংখ্য নিজের গোষ্ঠীর লোকেদের কাছে।এই ভাবে সে ব্যক্তিগত অনুসারীর দল ও তৈরী করে ফেলেছিল। তার এই ধর্মীয় বয়ান বা নানান প্রাসঙ্গিক আসরের প্রত্যক্ষদর্শী ওসামা আল কোয়াশি ,যে নিজেও একটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিল ,বলেছিল যে জুহাইমান এই সময়ে বেআইনি নেশার বস্তু চোরাচালানের কাজ ও করছিল।ক্রমশঃ এক বড় সংখ্যক অল্পবয়েসী ছেলেদের আকর্ষিত করে তাঁর অনুসারী করে ফেলে।একটিই জায়গায় তার খামতি ছিল যা হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এমনকি অন্য আর পাঁচটি ধর্মীয় গুরুর মতো প্রাসঙ্গিক পড়াশোনাতে। এই প্রসঙ্গে তার এক সময়ের অনুসারী নাসের আল হজেইমির বয়ানে জানা যায় যে লোকটি মুলত প্রত্যন্ত বেদুইন অঞ্চলেই নিজের প্রচার করতো যেহেতু তার নিজের ভাষা মানে আরবির ধাঁচ ছিল তাঁদের মতো।শহরের বিশেষতঃ বুনিয়াদি আরবি ভাষাতে তাঁর দখল কম থাকায় কোনো শহরের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় স্থানে নিজের বক্তব্য রাখতে যায় নি।এই কাজ করতে গেলে তাঁর ওই শ্রোতাদের কাছে সম্ভ্রম বা শ্রদ্ধা আদায় করা সম্ভব হতো না ওটা সে নিজেও বুঝেছিল। এই ইমাম মেহেদী মোহ নিয়ে ওই সময়ের সৌদি রাষ্ট্রীয় নজরদারি বিভাগ বা ইন্টালিজেন্সির প্রধান তুর্কি আল ফায়সাল পরবর্তীতে একটি স্বাক্ষাৎকারে জানিয়েছিল যে এই গোষ্ঠীতে অসংখ্য ছাত্র ছিল যাঁরা এই মেহেদির আবির্ভাব কে আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করতো।প্রাথমিক পর্যায়ে কাবা এবং গোটা সৌদি আরবের ক্ষমতা দখল এবং পরবর্তীতে গোটা ইসলামী দুনিয়ায় নেতৃত্ব করা একটি প্রবল বাসনা ছিল এই দলটির।পাঠক,আল কায়দা বা আইসিস এর সাথে অনেকটাই মিল পাচ্ছেন কি ? যাইহোক ,একটা মজার বিষয় দেখুন , এই একই ভাবে প্রায় সব প্রচলিত ধর্মেই একজন পরিত্রাতা অন্তে আসার কথা বলা হয়েছে যে এই ধরিত্রীর সব পাপ বা ক্লেশ ইত্যাদি দূর করে একটি কাঙ্খিত যুগের সূচনা করবে। এই ক্ষেত্রেও কোনো ব্যতিক্রম নেই ,এক বহু যুগের এই আকাঙ্খা কে পুঁজি করে অনেক লোক এই কাজ করেছে।মুসলিম সমাজেও নানান দেশে এই কাজ আগেও হয়েছে।ঊনবিংশ শতকে মোহাম্মদ আহমেদ নামের এক সুদানিস শেখ ১৮৮১তে এই ধরণের একটি উত্থানের কাজ করতে গিয়েছিল তৎকালীন মিশরীয় পরাধীনতায় থাকা শাসকের বিরুদ্ধে। মজার কথা হলো এই মেহেদির কোনো প্রসঙ্গ কোরানে কিন্তু নেই।কেয়ামতের মানে শেষ দিনের আগে এই ধরণের ঘটনার আভাস থাকলেও হাদিস বর্ণিত কোনো ঘটনার বিষয় নেই বলেই মতামত দিয়েছে ইসলামের নানান পন্ডিত মহল।সে যে যাই বলুক,জুহাইমান এই মেহেদী বলে কাঙ্খিত মানুষের ভিত্তিতে এক বড় সংখ্যক অনুসারীর দল বানিয়ে ফেলেছিল।এই অনুসারীদের নিয়ে একটি নিকটস্থ মসজিদে এক জায়গায় হয় এই অভিযানের তিনদিন আগে।এই প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক নানান স্বাক্ষাতকারে দেখতে পাই এই অনুসারীদের প্রাক্তন কয়েকজন সদস্য এই গোষ্ঠিকে সালাফি আন্দোলনের একটি ধারা বলেছে,যাদের প্রবীন মাথাদের সরিয়ে এই নতুন প্রজন্মের দল পুরো নেতৃত্ব হাতে নিয়েছিল জুহাইমানের নেতৃত্বে। পরবর্তী পর্বে থাকবে এক চলমান পনেরো দিনের ক্রমাগত লড়াই এবং বিশ্ব রাজনীতিতে বিবিধ দোলাচল আর অন্য প্রাসঙ্গিক বিষয়-ততক্ষণ একটু চা পানের বিরতি  তথ্যসূত্র : ১. আলোচিত বইটির লেখকের একটি স্বাক্ষাতকার দেখুন 

https://www.youtube.com/watch?v=1hNjJY1OXmM ২. যারা বিষয়টি প্রতিবেদনের আকারে দেখতে চাইছেন তাদের জন্য https://www.youtube.com/watch?v=HItn3u02RwU ৩. নির্মোহ তবে আংশিক একটি প্রতিবেদন https://www.bbc.com/news/stories-50852379 ৪.  আরো একটি ভালো প্রতিবেদন  https://www.arabnews.com/node/1371221/saudi-arabia ৫. মূল বইটির লেখকের একটি স্বাক্ষাতকার এবং ঘটনার বিবরণ জানতে পারেন এই সুত্রে https://www.npr.org/templates/story/story.php?storyId=112051155

Posted at March 12, 2019 |  by Arya ঋষি

এক বিষ বৃক্ষের সূচনা -অন্তিম পর্ব



মুখবন্ধ বা নিজের কিছু কথা : এই লেখার শেষ পর্বে দাঁড়িয়ে কোনো একটি পর্বে এক পাঠকের কথা মনে পড়ছে। তিনি সৌদি সংস্কার বা ধর্মীয় মৌলবাদের রাস্তা ত্যাগ করে অন্য পথে যেতে পারে তা নস্যাৎ করেছিলেন কোনো যুক্তি না দিয়েই। আংশিক বিরক্ত হলেও পরবর্তীতে বিষয়টি ভাবলাম , দেখলাম ,এই ধরণের নীতি নির্ধারকরা নানান দেশে অতীব সফল হয় এই কারণেই। আমরা মূল উদ্দেশ্য দেখি না তাই অতীব সহজে একটা বিভাজন নিয়ে এসে আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভাঙা অতি সহজ হয়। কোনো রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধর্মের ধ্বজা ধরে নিজেদের স্বার্থ পূরণের জন্য যা আমরা ভুলে যাই। একই ভাবে ধর্মের বিরুদ্ধে সরব নানান স্বঘোষিত পক্ষ আবার এর উল্টো স্রোতের সুযোগ নেয় সেই একই কারণে। নীরবে কাজ করে মানুষের একমুখী অগ্রগতি।আমরা অনেকেই জানি না যে ওই সময়ে মানে এই ঘটনার আগে পর্যন্ত ওই দেশে বাকি আর পাঁচটা মধ্য প্রাচ্যের তুলনামূলক সংস্কার পন্থী দেশের মতো ওই সময় মেয়েরা গাড়ি চালাতেন বা সিনেমা হল ইত্যাদি চালু ছিল।এই ঘটনার পরেই সব শেষ হয়ে যায়।যাইহোক,ইতিহাস স্বাক্ষী,কিছু সময়ের জন্য মানুষ পথভ্রষ্ট হয়েছে তবে সামগ্রিক মানব উত্তরণ আটকে দেওয়া কারোর সাধ্যে নেই।নিজের কথা রাখি,আসুন দেখি বিষবৃক্ষের রোপন এবং কালের নিয়মে এর অপসারণ কি ভাবে হচ্ছে।
বিষবৃক্ষের রোপন এবং তাঁর বৃদ্ধি:
সৌদি রাজতন্ত্রর কাছে গদি বড় দায় তাই কোনো ঝুকি না নিয়ে একদম মোল্লাতন্ত্র চালুর পথে যেতে পুরো একটা উল্টো দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এরা।পাশের ইরানের মোল্লাতন্ত্র সৌদি রাজাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল,ইসলামের মূল ধারকের গদি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয় এবং নিজেদের টিকে থাকার একটা কারণ একেবারে ঘড়ির কাটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার মানসিকতা তৈরী করলো।শুধু নিজের দেশেই না,গোটা পৃথিবীতেই এই গোড়া মানসিকতা এবং নিজেদের মতে চলার মতো করে একটি ভাবনা বা আজকের পরিচিত ওয়াহাবী মতের প্রসার শুরু করলো পেট্রো ডলার এর অনুদান দিয়ে।এক কথায়, নিজেদের মনমতো ইসলামের রপ্তানি একটি মূল লক্ষ্য হয়ে উঠলো।
শুনলে অবাক হবেন এই জুহাইমান এবং এদের দলের নানান দাবি মেনে নেওয়া হয়।এর মধ্যে ফুটবল খেলা ,টিভিতে বিনোদনের নানান অনুষ্ঠান বা মেয়েদের দেখানো ইত্যাদি যা কিছু নিয়ে প্রশ্ন করেছিল সব বন্ধ হয়ে গেলো।পশ্চিমের সভ্যতার পথে চলা সৌদি আরব মধ্যযুগের মোল্লাতন্ত্রের পথে চলা শুরু করলো। ইতিহাসের কি পরিহাস, একই ঘটনা শুরু হয়ে গিয়েছিল কয়েক মাস আগে এদের প্রবল বৈরী শিয়া পথের ইরানেও।একই সঙ্গে মেয়েদের চাকরিতে নিষেধাজ্ঞা,এমনকি মেয়েদের ছবি পত্রিকা ইত্যাদিতে ছাপানো সবই নিষিদ্ধ হয়ে গেলো।
যে জেদ্দা শহরে মেয়েরা স্বচ্ছন্দে সিনেমায় যেতে পারতো তা নিষিদ্ধ হলো। বিশেষ বস্তার বোরখা সার্বিক হলো।আজকে অবাক লাগতে পারে , ওই সময়ে সৌদি টিভি তে বা রেডিওতে পুরুষ এবং নারী উভয়েই অংশ গ্রহণ করতো।এরপরে ? সব বন্ধ হয়ে গেলো।শুধু দেশের না , আশেপাশের বিখ্যাত গায়ক গায়িকা যেমন লেবাননের ফাইরুজ বা সামিরা আগে প্রায় নিয়মিত মুখ ছিল ওই দেশের টিভিতে।যে দেশ সংগীতপ্রেমী ছিল তাঁদের জন্য এরপরের দশকগুলো কেবল অন্ধকার ছেয়ে গিয়েছিল।
এতেই শেষ না , এসে গেলো ধর্মীয় এক ষাঁড়ের দল মানে নীতি পুলিশ।নাগরিকের জীবনের সর্বত্র এদের হস্তক্ষেপ শুরু হয়ে গেলো।এই অন্ধকারের দিনের জন্য দায়ী সৌদি রাজ্ পরিবার আর তাদের গোষ্ঠী।সোজা কথায়, অপরিণত এই অশিক্ষিত মৌলবাদী শ্রেণীকে তোষণ এবং এদের নিজেদের শিবিরে নিয়ে আসতে পুরো ভোল পাল্টে ফেলার কাজ করেছিল সৌদি রাজতন্ত্র।
প্রিন্স তুর্কির ভাষায়, তাঁরা ইসলাম যে একটি রাজনৈতিক দর্শন ওটা উপলব্ধি করে এর ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র সাজিয়ে ফেলেছিল যাতে আর এই ধরণের কোনো প্রতিষ্ঠান বিরোধী কাজ না হয়। ঈমাম এবং বশংবদ উলেমাদের সামনে রেখে একটি আবরণ তৈরী করলেই যে রাজত্ব অনেক সহজ হয় ওই উপলব্ধি হয়েছিল তা পরিষ্কার।আধুনিক চিন্তার বদলে এই ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার দোকান খুলে বরং এই ভাবধারা আরো প্রসার করা হয়ে উঠলো মুখ্য লক্ষ্য। রপ্তানি করা শুরু করলো নিজেদের ওয়াহাবি তত্বের পথ যতদিন না বুঝতে পারলো বোতলের দৈত্য ভয়ংকর হয়ে উঠছে।
বোধদয়ের পালা:
আইসিস এবং আল কায়দার উত্থান এদের আবার ভাবতে বাধ্য করেছে যে এই ভাবে কিছু হবে না। একই সাথে তেলের বিকল্প নিয়ে গোটা পৃথিবী রাস্তা খুঁজে বের করছে।সোজা কথায় এই ২০৩০ এর সময়ের কিছু আগে বা পরে এই তেলের মুফতে খাওয়ার দিন শেষ হতে চলেছে।তাই এরপরে ওই গোড়া মনঃবৃত্তি নিয়ে চললে দেশের আয়ের তিন ভাগের এক ভাগের রোজগার যা আসে এই হ্বজ বা ওমরা থেকে তাতে ভাটা আসতে পারে।
মহম্মদ বিন সালমান মানে আজকের মূল ক্ষমতার অধিকারীর কথা এক অর্থে আশার বাণী মনে হয় ,তিনি আগামী তিরিশ বছরের এই ধ্বংসের যন্ত্রনা না বহন করে এখনই এই ভাবনা চিন্তা গুলো শেষ করতে চাইছেন।অন্ততঃ রিয়াদে তিন বছর আগের একটি বিনিয়োগ সম্মেলনে তাই বলেছেন।একই ভাবে পরের বছর সেই কালান্তক সময়ের থেকে দেশে যে অসহ এক লৌহ বর্মের অবস্থান আর মধ্যযুগের আইন চলছে তার অবসান ও চেয়েছেন তিনি।বাস্তবিক দিক থেকে খুব ভুল বলেন নি।ষাটের বা সত্তরের দশকের সৌদি আরব কিন্তু এক ভিন্ন পরিবেশ বহন করে চলতো। এই বিষয়ে বিবিধ সূত্র ধরে যা দেখছি তাতে এই ধর্মান্ধের কারবার যে কি পরিমান ক্ষতি করেছে তার প্রাসঙ্গিক কিছু ছবি দেখলেই বুঝতে পারবেন ,সঙ্গে দিয়ে দিলাম।
অনেক গুলো কাজ ইতিমধ্যেই করেও ফেলেছেন।যা সংস্কার হয়েছে এই পর্যন্ত,তার প্রধান কিছু নিচে দিলাম:
১.একদম শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত স্বাধীন মত প্রকাশ করা ব্লগার বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে শাস্তির বিশেষতঃ অতীব গুরুতর অপরাধ ছাড়া প্রকাশ্যে বেত্রাঘাতের ফরমান তুলে নেওয়া হয়েছে।
২.সৌদি মহিলাদের কাজের পরিধিতে আগে শতকরা ২২ ভাগ অংশগ্রহণের ধার্যকৃত অংশের বৃদ্ধি করে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে অর্থাৎ মহিলাদের স্বনির্ভর হওয়ার পথে চলছে দেশটি।
৩.সবচেয়ে আলোচতি যে বিষয়টি আমরা সবাই জেনেছি তা হলো মেয়েদের এই অভিশপ্ত সময়ের আগে রাস্তায় গাড়ি চালানোর যে স্বাধীনতা ছিল তা আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে ২০১৮ তে।
৪.আগের মতো চাকরি করতে যাওয়ার সময়ে কোনো মহিলাকে তার তথাকথিত পুরুষ অভিভাবকের থেকে অনুমতি নিতে হতো।কোনো ক্ষেত্রে তার স্বামী,কখনো বাবা বা ভাই ইত্যাদি।এই বিষয়টি রদ করা হয়েছে ,আর এর দরকার হবে না।একই ভাবে কোনো উচ্চশিক্ষার জন্য এমনকি কোনো শল্য চিকিৎসার ক্ষেত্রেও একেই কুৎসিত এই আইনের রদ হয়েছে।আজ এই সব ক্ষেত্রে মেয়েরা একক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
৫. পরিবর্তিত আইনে এখন মেয়েরা সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করা , বিয়ে/ বিবাহ বিচ্ছিন্নতা সংক্রান্ত নিবন্ধন করা এমনকি কোনো নাবালক /নাবালিকার অভিভাবিকা হতে পারবেন।আগে এর একটিও অধিকার তাঁদের ছিল না।
৬. আগের কালা কানুন বিদেশ গমন বা পাসপোর্ট তৈরির আগে পুরুষ অভিভাবকের অনুমতির আইন ও বাতিল হয়েছে।
৭. সিনেমা বা আগের সেই সংগীত ইত্যাদির কনসার্ট আবার চালু হয়েছে।একই সাথে দোকান বা ব্যবসার অনেক ক্ষেত্র এখন ২৪ঘন্টা খুলে রাখার অনুমতি ও দেওয়া হয়েছে আর পাঁচটি আধুনিক সমাজের মতো।
৮. ফৌজে মেয়েদের যোগ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং ফুটবল ইত্যাদি খেলার পুনরায় প্রচলন আর মাঠে দর্শক হিসেবে মেয়েদের প্রবেশের অনুমতি ও দেওয়া হয়েছে।
৯. নীতি পুলিশ নামের কুৎসিত এক চাপিয়ে দেওয়ার বাহিনী কে প্রত্যাহার করা হয়েছে।এরা মানুষের জীবন অতিষ্ট করে তুলছিল এই কয়েক দশক ধরে।
১০. স্রেফ ধর্মীয় দু একটি জায়গা বাদে দেশের অন্য সর্বত্র অমুসলিম এবং বিদেশী পর্যটকের জন্য অবাধ প্রবেশের ব্যবস্থা হয়েছে।
১১. শিক্ষা ব্যবস্থা কে আধুনিক করে সৌদি নতুন প্রজন্ম কে মূল ধারার বাকি পৃথিবীর সাথে সংযুক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে।
আজকে বিদেশী মেয়েরা সৌদির রাস্তায় বোরখা ইত্যাদি ছাড়াই ঘুরে বেড়াতে পারে এবং একই সুযোগ নিচ্ছে সৌদি মেয়েরাও,অন্তত যারা একটু সাহসী।প্রসঙ্গত এই নানান কাজ গুলো আগে পর্দার আড়ালে হতো যা আজ বৈধতা প্রাপ্ত হয়েছে।রেস্তেরা বা অন্য সামাজিক জায়গায় নারী পুরুষের এক সাথে থাকা বা এই মুক্ত হওয়ার কারণে অবশ্যই প্রবীন বা ধর্মীয় ভাবধারায় চলা এক দল লোকের মাথা ব্যথার কারণ হয়েছে।ভয় একটাই,এদের নিয়ন্ত্রন যেন গুরুত্ব সহকারে করা হয়।এর কারণ,যে কোনো পরিবর্তন কেই প্রতিরোধ করা মানুষের একটি স্বাভাবিক ধর্ম বিশেষত মনন যদি একটি ধাঁচে আগেই তৈরী হয়ে যায়।একটু ধীরে ধীরে সংস্কার গুলো করে যাওয়া আর তাকে আরো কিছু দশক বহাল রাখার কাজ হলেই আবার দেশটি আধুনিক পথে চালিত হবে।
এই চমক লাগানো সংস্কারের জন্য আলোচ্য মোহাম্মদ বিন সালমান এর মূল শক্তির একটি জায়গা হলো বর্তমান সৌদি আরবের জনসংখ্যার প্রায় ৬৭ শতাংশ ৩৪ বছরের কম বয়েসী বলে। এক অর্থে রাজতন্ত্রের এই শাসকের এই ক্ষেত্রে অন্ততঃ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন আছে ভাবতে পারেন।
না,আমি মোটেই বলছি না যে এই লোকটি একটি সজ্জন।তবু , যদি বড় অংশের সংস্কার হয় আর তাতে যদি পৃথিবীর চেহারা একটু অন্য হয় তবে ক্ষতি কি ? মূল বইটির লেখক এবং বাকি আরো অনেকেই যা বলেছে তার প্রতিধ্বনি করে বলা যায় জুহাইমান ওই লড়াইয়ে হেরে গেলেও বৃহৎ রণাঙ্গনে কিন্তু জিতেছিল।আজ সঙ্গত কারণে,দুর্জন হলেও সলমান স্বাগত তার এই কাজগুলোর জন্য অন্তত আমার কাছে।
আশার আরো কথা আছে , রাহা মোহার্রাক বলে এক প্রথম সৌদি মহিলা পর্বতারোহী উঠেছেন মাউন্ট এভারেস্ট এ ২০১৩ তে আরো অনেক চূড়াতে উঠবে এই আরব নারীকুল।আমরা সবাই তা দেখবো , কোনো অলীক কল্পনা না ,এটি আমার যুক্তিভিত্তিক চিন্তা।
শেষ করছি,আবার অশেষ রবীন্দ্রনাথ কে স্মরন করে,তিনি এক দল স্বঘোষিত আলোকপ্রাপ্ত মানুষের অস্বস্থি বাড়িয়ে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন সেই সময়ের তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’ নিবন্ধে,একটু ওই জায়গাটি তুলে ধরার সাধ হলো,তিনি বলেছিলেন “এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই তা বলি নে; গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে--কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না--সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিম্বা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।“ –অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছিল,সেই সময়ের সেভিয়েত ইউনিয়নে,একই ফলাফল হবে অন্য দেশেও যদি বাকি রাষ্ট্রনায়করা তা না বুঝতে পারে।অমিত শক্তির মানুষ ছাঁচে ফেলার প্রাণী না।





কাবা এবং মসজিদ আল হারাম দখলের কালান্তক ইতিহাসঃ– পর্ব ৪


এক বিষ বৃক্ষের সূচনা -অন্তিম পর্ব



মুখবন্ধ বা নিজের কিছু কথা : এই লেখার শেষ পর্বে দাঁড়িয়ে কোনো একটি পর্বে এক পাঠকের কথা মনে পড়ছে। তিনি সৌদি সংস্কার বা ধর্মীয় মৌলবাদের রাস্তা ত্যাগ করে অন্য পথে যেতে পারে তা নস্যাৎ করেছিলেন কোনো যুক্তি না দিয়েই। আংশিক বিরক্ত হলেও পরবর্তীতে বিষয়টি ভাবলাম , দেখলাম ,এই ধরণের নীতি নির্ধারকরা নানান দেশে অতীব সফল হয় এই কারণেই। আমরা মূল উদ্দেশ্য দেখি না তাই অতীব সহজে একটা বিভাজন নিয়ে এসে আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভাঙা অতি সহজ হয়। কোনো রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধর্মের ধ্বজা ধরে নিজেদের স্বার্থ পূরণের জন্য যা আমরা ভুলে যাই। একই ভাবে ধর্মের বিরুদ্ধে সরব নানান স্বঘোষিত পক্ষ আবার এর উল্টো স্রোতের সুযোগ নেয় সেই একই কারণে। নীরবে কাজ করে মানুষের একমুখী অগ্রগতি।আমরা অনেকেই জানি না যে ওই সময়ে মানে এই ঘটনার আগে পর্যন্ত ওই দেশে বাকি আর পাঁচটা মধ্য প্রাচ্যের তুলনামূলক সংস্কার পন্থী দেশের মতো ওই সময় মেয়েরা গাড়ি চালাতেন বা সিনেমা হল ইত্যাদি চালু ছিল।এই ঘটনার পরেই সব শেষ হয়ে যায়।যাইহোক,ইতিহাস স্বাক্ষী,কিছু সময়ের জন্য মানুষ পথভ্রষ্ট হয়েছে তবে সামগ্রিক মানব উত্তরণ আটকে দেওয়া কারোর সাধ্যে নেই।নিজের কথা রাখি,আসুন দেখি বিষবৃক্ষের রোপন এবং কালের নিয়মে এর অপসারণ কি ভাবে হচ্ছে।
বিষবৃক্ষের রোপন এবং তাঁর বৃদ্ধি:
সৌদি রাজতন্ত্রর কাছে গদি বড় দায় তাই কোনো ঝুকি না নিয়ে একদম মোল্লাতন্ত্র চালুর পথে যেতে পুরো একটা উল্টো দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এরা।পাশের ইরানের মোল্লাতন্ত্র সৌদি রাজাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল,ইসলামের মূল ধারকের গদি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয় এবং নিজেদের টিকে থাকার একটা কারণ একেবারে ঘড়ির কাটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার মানসিকতা তৈরী করলো।শুধু নিজের দেশেই না,গোটা পৃথিবীতেই এই গোড়া মানসিকতা এবং নিজেদের মতে চলার মতো করে একটি ভাবনা বা আজকের পরিচিত ওয়াহাবী মতের প্রসার শুরু করলো পেট্রো ডলার এর অনুদান দিয়ে।এক কথায়, নিজেদের মনমতো ইসলামের রপ্তানি একটি মূল লক্ষ্য হয়ে উঠলো।
শুনলে অবাক হবেন এই জুহাইমান এবং এদের দলের নানান দাবি মেনে নেওয়া হয়।এর মধ্যে ফুটবল খেলা ,টিভিতে বিনোদনের নানান অনুষ্ঠান বা মেয়েদের দেখানো ইত্যাদি যা কিছু নিয়ে প্রশ্ন করেছিল সব বন্ধ হয়ে গেলো।পশ্চিমের সভ্যতার পথে চলা সৌদি আরব মধ্যযুগের মোল্লাতন্ত্রের পথে চলা শুরু করলো। ইতিহাসের কি পরিহাস, একই ঘটনা শুরু হয়ে গিয়েছিল কয়েক মাস আগে এদের প্রবল বৈরী শিয়া পথের ইরানেও।একই সঙ্গে মেয়েদের চাকরিতে নিষেধাজ্ঞা,এমনকি মেয়েদের ছবি পত্রিকা ইত্যাদিতে ছাপানো সবই নিষিদ্ধ হয়ে গেলো।
যে জেদ্দা শহরে মেয়েরা স্বচ্ছন্দে সিনেমায় যেতে পারতো তা নিষিদ্ধ হলো। বিশেষ বস্তার বোরখা সার্বিক হলো।আজকে অবাক লাগতে পারে , ওই সময়ে সৌদি টিভি তে বা রেডিওতে পুরুষ এবং নারী উভয়েই অংশ গ্রহণ করতো।এরপরে ? সব বন্ধ হয়ে গেলো।শুধু দেশের না , আশেপাশের বিখ্যাত গায়ক গায়িকা যেমন লেবাননের ফাইরুজ বা সামিরা আগে প্রায় নিয়মিত মুখ ছিল ওই দেশের টিভিতে।যে দেশ সংগীতপ্রেমী ছিল তাঁদের জন্য এরপরের দশকগুলো কেবল অন্ধকার ছেয়ে গিয়েছিল।
এতেই শেষ না , এসে গেলো ধর্মীয় এক ষাঁড়ের দল মানে নীতি পুলিশ।নাগরিকের জীবনের সর্বত্র এদের হস্তক্ষেপ শুরু হয়ে গেলো।এই অন্ধকারের দিনের জন্য দায়ী সৌদি রাজ্ পরিবার আর তাদের গোষ্ঠী।সোজা কথায়, অপরিণত এই অশিক্ষিত মৌলবাদী শ্রেণীকে তোষণ এবং এদের নিজেদের শিবিরে নিয়ে আসতে পুরো ভোল পাল্টে ফেলার কাজ করেছিল সৌদি রাজতন্ত্র।
প্রিন্স তুর্কির ভাষায়, তাঁরা ইসলাম যে একটি রাজনৈতিক দর্শন ওটা উপলব্ধি করে এর ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র সাজিয়ে ফেলেছিল যাতে আর এই ধরণের কোনো প্রতিষ্ঠান বিরোধী কাজ না হয়। ঈমাম এবং বশংবদ উলেমাদের সামনে রেখে একটি আবরণ তৈরী করলেই যে রাজত্ব অনেক সহজ হয় ওই উপলব্ধি হয়েছিল তা পরিষ্কার।আধুনিক চিন্তার বদলে এই ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার দোকান খুলে বরং এই ভাবধারা আরো প্রসার করা হয়ে উঠলো মুখ্য লক্ষ্য। রপ্তানি করা শুরু করলো নিজেদের ওয়াহাবি তত্বের পথ যতদিন না বুঝতে পারলো বোতলের দৈত্য ভয়ংকর হয়ে উঠছে।
বোধদয়ের পালা:
আইসিস এবং আল কায়দার উত্থান এদের আবার ভাবতে বাধ্য করেছে যে এই ভাবে কিছু হবে না। একই সাথে তেলের বিকল্প নিয়ে গোটা পৃথিবী রাস্তা খুঁজে বের করছে।সোজা কথায় এই ২০৩০ এর সময়ের কিছু আগে বা পরে এই তেলের মুফতে খাওয়ার দিন শেষ হতে চলেছে।তাই এরপরে ওই গোড়া মনঃবৃত্তি নিয়ে চললে দেশের আয়ের তিন ভাগের এক ভাগের রোজগার যা আসে এই হ্বজ বা ওমরা থেকে তাতে ভাটা আসতে পারে।
মহম্মদ বিন সালমান মানে আজকের মূল ক্ষমতার অধিকারীর কথা এক অর্থে আশার বাণী মনে হয় ,তিনি আগামী তিরিশ বছরের এই ধ্বংসের যন্ত্রনা না বহন করে এখনই এই ভাবনা চিন্তা গুলো শেষ করতে চাইছেন।অন্ততঃ রিয়াদে তিন বছর আগের একটি বিনিয়োগ সম্মেলনে তাই বলেছেন।একই ভাবে পরের বছর সেই কালান্তক সময়ের থেকে দেশে যে অসহ এক লৌহ বর্মের অবস্থান আর মধ্যযুগের আইন চলছে তার অবসান ও চেয়েছেন তিনি।বাস্তবিক দিক থেকে খুব ভুল বলেন নি।ষাটের বা সত্তরের দশকের সৌদি আরব কিন্তু এক ভিন্ন পরিবেশ বহন করে চলতো। এই বিষয়ে বিবিধ সূত্র ধরে যা দেখছি তাতে এই ধর্মান্ধের কারবার যে কি পরিমান ক্ষতি করেছে তার প্রাসঙ্গিক কিছু ছবি দেখলেই বুঝতে পারবেন ,সঙ্গে দিয়ে দিলাম।
অনেক গুলো কাজ ইতিমধ্যেই করেও ফেলেছেন।যা সংস্কার হয়েছে এই পর্যন্ত,তার প্রধান কিছু নিচে দিলাম:
১.একদম শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত স্বাধীন মত প্রকাশ করা ব্লগার বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে শাস্তির বিশেষতঃ অতীব গুরুতর অপরাধ ছাড়া প্রকাশ্যে বেত্রাঘাতের ফরমান তুলে নেওয়া হয়েছে।
২.সৌদি মহিলাদের কাজের পরিধিতে আগে শতকরা ২২ ভাগ অংশগ্রহণের ধার্যকৃত অংশের বৃদ্ধি করে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে অর্থাৎ মহিলাদের স্বনির্ভর হওয়ার পথে চলছে দেশটি।
৩.সবচেয়ে আলোচতি যে বিষয়টি আমরা সবাই জেনেছি তা হলো মেয়েদের এই অভিশপ্ত সময়ের আগে রাস্তায় গাড়ি চালানোর যে স্বাধীনতা ছিল তা আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে ২০১৮ তে।
৪.আগের মতো চাকরি করতে যাওয়ার সময়ে কোনো মহিলাকে তার তথাকথিত পুরুষ অভিভাবকের থেকে অনুমতি নিতে হতো।কোনো ক্ষেত্রে তার স্বামী,কখনো বাবা বা ভাই ইত্যাদি।এই বিষয়টি রদ করা হয়েছে ,আর এর দরকার হবে না।একই ভাবে কোনো উচ্চশিক্ষার জন্য এমনকি কোনো শল্য চিকিৎসার ক্ষেত্রেও একেই কুৎসিত এই আইনের রদ হয়েছে।আজ এই সব ক্ষেত্রে মেয়েরা একক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
৫. পরিবর্তিত আইনে এখন মেয়েরা সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করা , বিয়ে/ বিবাহ বিচ্ছিন্নতা সংক্রান্ত নিবন্ধন করা এমনকি কোনো নাবালক /নাবালিকার অভিভাবিকা হতে পারবেন।আগে এর একটিও অধিকার তাঁদের ছিল না।
৬. আগের কালা কানুন বিদেশ গমন বা পাসপোর্ট তৈরির আগে পুরুষ অভিভাবকের অনুমতির আইন ও বাতিল হয়েছে।
৭. সিনেমা বা আগের সেই সংগীত ইত্যাদির কনসার্ট আবার চালু হয়েছে।একই সাথে দোকান বা ব্যবসার অনেক ক্ষেত্র এখন ২৪ঘন্টা খুলে রাখার অনুমতি ও দেওয়া হয়েছে আর পাঁচটি আধুনিক সমাজের মতো।
৮. ফৌজে মেয়েদের যোগ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং ফুটবল ইত্যাদি খেলার পুনরায় প্রচলন আর মাঠে দর্শক হিসেবে মেয়েদের প্রবেশের অনুমতি ও দেওয়া হয়েছে।
৯. নীতি পুলিশ নামের কুৎসিত এক চাপিয়ে দেওয়ার বাহিনী কে প্রত্যাহার করা হয়েছে।এরা মানুষের জীবন অতিষ্ট করে তুলছিল এই কয়েক দশক ধরে।
১০. স্রেফ ধর্মীয় দু একটি জায়গা বাদে দেশের অন্য সর্বত্র অমুসলিম এবং বিদেশী পর্যটকের জন্য অবাধ প্রবেশের ব্যবস্থা হয়েছে।
১১. শিক্ষা ব্যবস্থা কে আধুনিক করে সৌদি নতুন প্রজন্ম কে মূল ধারার বাকি পৃথিবীর সাথে সংযুক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে।
আজকে বিদেশী মেয়েরা সৌদির রাস্তায় বোরখা ইত্যাদি ছাড়াই ঘুরে বেড়াতে পারে এবং একই সুযোগ নিচ্ছে সৌদি মেয়েরাও,অন্তত যারা একটু সাহসী।প্রসঙ্গত এই নানান কাজ গুলো আগে পর্দার আড়ালে হতো যা আজ বৈধতা প্রাপ্ত হয়েছে।রেস্তেরা বা অন্য সামাজিক জায়গায় নারী পুরুষের এক সাথে থাকা বা এই মুক্ত হওয়ার কারণে অবশ্যই প্রবীন বা ধর্মীয় ভাবধারায় চলা এক দল লোকের মাথা ব্যথার কারণ হয়েছে।ভয় একটাই,এদের নিয়ন্ত্রন যেন গুরুত্ব সহকারে করা হয়।এর কারণ,যে কোনো পরিবর্তন কেই প্রতিরোধ করা মানুষের একটি স্বাভাবিক ধর্ম বিশেষত মনন যদি একটি ধাঁচে আগেই তৈরী হয়ে যায়।একটু ধীরে ধীরে সংস্কার গুলো করে যাওয়া আর তাকে আরো কিছু দশক বহাল রাখার কাজ হলেই আবার দেশটি আধুনিক পথে চালিত হবে।
এই চমক লাগানো সংস্কারের জন্য আলোচ্য মোহাম্মদ বিন সালমান এর মূল শক্তির একটি জায়গা হলো বর্তমান সৌদি আরবের জনসংখ্যার প্রায় ৬৭ শতাংশ ৩৪ বছরের কম বয়েসী বলে। এক অর্থে রাজতন্ত্রের এই শাসকের এই ক্ষেত্রে অন্ততঃ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন আছে ভাবতে পারেন।
না,আমি মোটেই বলছি না যে এই লোকটি একটি সজ্জন।তবু , যদি বড় অংশের সংস্কার হয় আর তাতে যদি পৃথিবীর চেহারা একটু অন্য হয় তবে ক্ষতি কি ? মূল বইটির লেখক এবং বাকি আরো অনেকেই যা বলেছে তার প্রতিধ্বনি করে বলা যায় জুহাইমান ওই লড়াইয়ে হেরে গেলেও বৃহৎ রণাঙ্গনে কিন্তু জিতেছিল।আজ সঙ্গত কারণে,দুর্জন হলেও সলমান স্বাগত তার এই কাজগুলোর জন্য অন্তত আমার কাছে।
আশার আরো কথা আছে , রাহা মোহার্রাক বলে এক প্রথম সৌদি মহিলা পর্বতারোহী উঠেছেন মাউন্ট এভারেস্ট এ ২০১৩ তে আরো অনেক চূড়াতে উঠবে এই আরব নারীকুল।আমরা সবাই তা দেখবো , কোনো অলীক কল্পনা না ,এটি আমার যুক্তিভিত্তিক চিন্তা।
শেষ করছি,আবার অশেষ রবীন্দ্রনাথ কে স্মরন করে,তিনি এক দল স্বঘোষিত আলোকপ্রাপ্ত মানুষের অস্বস্থি বাড়িয়ে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন সেই সময়ের তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’ নিবন্ধে,একটু ওই জায়গাটি তুলে ধরার সাধ হলো,তিনি বলেছিলেন “এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই তা বলি নে; গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে--কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না--সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিম্বা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।“ –অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছিল,সেই সময়ের সেভিয়েত ইউনিয়নে,একই ফলাফল হবে অন্য দেশেও যদি বাকি রাষ্ট্রনায়করা তা না বুঝতে পারে।অমিত শক্তির মানুষ ছাঁচে ফেলার প্রাণী না।





Posted at February 21, 2019 |  by Arya ঋষি

আল্লাহ তালাহ- একটি অশুভ বদরাগী অসুখী চরিত্র


সেইদিন হোম পেইজে কীভাবে জানি ঘুরে ঘুরে একটা পোস্ট আমার নজরে পড়ে গেল। বিষয়বস্তু হচ্ছে, পোস্টের লেখক সবাইকে জানাচ্ছেন, ক্রিকেট খেলা দেখে জিতে যাওয়ার আনন্দে আত্মহারা হয়ে খুশী প্রকাশ করা ইসলামের দৃষ্টিতে উচিত কাজ নয়। ফেইসবুকে এরকম খুশি বা আনন্দ প্রকাশ করা গর্হিত কাজ। মুসলমানদের উচিত মৃত্যুর পরে কী হবে তা ভেবে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করা। খেলায় জিতে তা নিয়ে আনন্দ করা, খুশি হওয়া, তা আবার প্রকাশ করে ফেলাতে আল্লাহ নাখোশ হতে পারেন। মুসলমানদের সব সময়ই মৃত্যু ভয়ে ভীত এবং দোজখের ভয়ে আতঙ্কিত থাকা উচিত!
আমি মন দিয়েই লেখাটি পড়লাম। মুমিন মুসলমানদের লেখা আমার কাজের জন্যেই মন দিয়ে পড়তে হয়। তাদের মনের গঠন বোঝার জন্য। তাদের বুদ্ধিমত্তা বোঝার জন্য। আপনি কী এই ধরণের লেখা আগে পড়েছেন? আমি নিশ্চিত, আপনার চোখেও হয়তো পড়েছে।

আল্লাহ চরিত্রটি নিয়ে একটু ভেবে দেখুন। খুবই অসুখী, হীনমন্য, ছোটলোক এবং পাছায় লেগে থাকা একটি চরিত্র। আপনি খাচ্ছেন নাকি ঘুমাচ্ছেন, ঘুম থেকে উঠলেন কিংবা প্রশাব করতে গেলেন, আপনি বাসা থেকে বের হচ্ছেন নাকি বাসায় ফিরছেন, প্রতিটা পদক্ষেপে আপনার ওপর তার কড়া নজরদারি। আপনি ডানদিকে কাত হয়ে শুচ্ছেন নাকি বা দিকে, আপনার প্যান্ট টাখনুর কতটুকু ওপরে রয়েছে, আপনি প্রশাব করার পরে ঢিলা কুলুপ করেছেন কিনা, আপনি স্ত্রীর সাথে প্রেম করার পরে ফরজ গোছল করেছেন কিনা, মানুষের জীবনে এমন কোন সময় নেই যেই সময়ে সে খবরদারি করতে আসবে না। সে চাইবে আপনি তাকে সর্বক্ষণ ভয় পান, ভীত আতঙ্কিত হয়ে জীবন কাটান। কান্নাকাটি করেন। আপনি যদি মনের সুখে হাসেন, বা কাঁদেন, সব জায়গাতেই তার অনেক সমস্যা। সেই চায় একদম গৃহপালিত দাস, যে সর্বক্ষণ তার তোষামোদ করতে ব্যস্ত থাকবে।

ভাবুন তো, আপনার সন্তানের কথা। আপনি কেমন মানুষ তা জানি না। তবে আমি আমার সন্তানকে চাইবো সবসময় হাসিখুশী। আনন্দ করা একজন সুখী মানুষ হিসেবে। সে আমার ভয়ে সারাক্ষণ ভীত হয়ে থরথর করে কাঁপবে, আমার পিটানির ভয় আতঙ্কিত থাকবে, এরকম হলে তাতে তার মানসিক বৃদ্ধি ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সে হয়তো ছোটখাটো ভুল করে ফেলবে, কিন্তু আমি তাকে আদর করে বোঝাবো। ভুল তো হবেই, কিন্তু সে তো আমার সন্তানই। তাকে মানুষের অধিকারের কথা বোঝাবো, মানবতাবাদ শেখাবো। সব মানুষের সমান অধিকার এবং সমান মর্যাদা, এরকম তাকে ছোট বেলা থেকেই শিক্ষা দেবো। তাকে বলবো না, সে দুষ্টুমি করলে তাকে আমি মাইক্রো ওয়েভে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে পোড়াবো। এইসব বর্বর কায়দায় অত্যাচারের কথা বললে কেউ কোনদিন উন্নত চরিত্রের মানুষ হতে পারে না। আজকে আমি যদি তাকে এরকম বর্বর ভয় দেখাই, তার মাথায় এগুলো ঢুকে যাবে। এই বর্বরতা পরবর্তী জীবনে সে চর্চা করবে।

উন্নত বিশ্বে নানা মানসিক গবেষনায় দেখা গেছে, ছোটবেলা যেই সব শিশুদের ওপর অত্যাচার বেশি হয়, বা ভয় দেখানো হয়, তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা তুলনামূলক বেশি হয়। তাদের মধ্যে এক ধরণের জেদ কাজ করে। আপনি ছোটখাটো ভুলের জন্য আপনার সন্তানকে মারধোর করলে বা ভয়ঙ্কর রকমের ভয় দেখালে সে ক্রমশ জেদি হয়ে উঠবে। তখন জেদ করেই সেই নিষিদ্ধ কাজটি সে বারবার করতে চাইবে। তার মনের মধ্যে থাকবে সেই কাজটি করার আগ্রহ। কিন্তু ভয়ের কারণে সে হয়তো কিছুদিনের জন্য তা করবে না, তবে তার মনে সেটা চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে যাবে।

আল্লাহ পাক কোরআনে বলছেন, আল্লাহ হচ্ছেন প্রতিশোধ গ্রহণকারী। এর মানে কী? তুচ্ছ মানুষের ওপর আল্লাহ প্রতিশোধ নেন? কী হাস্যকর!

■ আর আল্লাহ হচ্ছেন পরাক্রমশীল, প্রতিশোধ গ্রহণকারী
কুরআন ৩ঃ৪

■ আল্লাহ বলছেন, তিনি ভীতি প্রদর্শক, ভয় প্রদর্শক। এর মানে কী? আল্লাহ ভয় দেখান? আল্লাহ কী ভুত?
আর বলুনঃ আমি প্রকাশ্য ভয় প্রদর্শক।
কোরআন  ১৫ঃ৮৯

আল্লাহ কী ক্ষেপে গেলে হুমকিধামকি দেয়া শুরু করেন? সামান্য মানুষের চুল ধরে টেনে হিচড়ে নেয়ার হুমকি দেন?

■ কখনই নয়, যদি সে বিরত না হয়, তবে আমি মস্তকের সামনের কেশগুচ্ছ ধরে হেঁচড়াবই
কোরআন ৯৬/১৫-১৬

■ আর যারা কাফের হয়েছে, তাদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাদেরকে মৃত্যুর আদেশও দেয়া হবে না যে, তারা মরে যাবে এবং তাদের থেকে তার শাস্তিও লাঘব করা হবে না। আমি প্রত্যেক অকৃতজ্ঞকে এভাবেই শাস্তি দিয়ে থাকি।
কোরআন ৩৫ঃ৩৬

■ সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার।
কোরআন ৯ঃ৩৫

■ আমি তার নাসিকা দাগিয়ে দিব।
কোরআন ৬৮ঃ১৬

■ …তাদের জন্যে উত্তপ্ত পানি এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে-কুফরের কারণে।
কোরআন ৬ঃ৭০

আল্লাহ পাক তোষামোদ এর ভালবাসেন কেন? নিজেই নিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ?

■ হে মূসা, আমি আল্লাহ, প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়
কোরআন ২৭:৯

■ হে মানুষ, তোমরা আল্লাহর গলগ্রহ। আর আল্লাহ; তিনি অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।
কোরআন ৩৫ঃ১৫

■ আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও অধিক জ্ঞানবান
কোরআন ১২ঃ৫৫

■  আল্লাহ অমুখাপেক্ষী,
তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি
এবং তার সমতুল্য কেউ নেই।
কোরআন ১১২ঃ২-৪

■ অতএব সকল প্রশংসা ও ধন্যবাদ আল্লাহর উপরে বর্ষিত হোক, কারণ তিনিই জগতের প্রভু।
কোরআন ৪৫ঃ৩৬

■ নভোমন্ডল, ভূমন্ডল এবং এতদুভয়ে অবস্থিত সবকিছুর আধিপত্য আল্লাহরই। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।
কোরআন ৫ঃ১২০

কোরআন আরো ভালভাবে বুঝে বুঝে পড়ে দেখুন। আল্লাহ এখানে একে অভিশাপ দিচ্ছে তো সেখানে তাকে হুমকি দিচ্ছে! কী অদ্ভুত রকমের হিংস্রতা তার মধ্যে। কাফের মারো অমুককে জোড়ায় জোড়ায় কাটো তমুকের গলায় রশি বাধো অপমান করে জিজিয়া কর আরোপ কর তাদের দাস বানাও, কত্ত কিছু। আর হচ্ছে মুহাম্মদকে বলতে থাকবে, বিয়ে কর বিয়ে কর। যেন মুহাম্মদের একের পর এক বিয়ে ছাড়া দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল। আল্লাহ চরিত্রটি আমাদের দেশের মাদ্রাসার শিক্ষকদের মতই, প্রাগৌতিহাসিক একটি অশুভ চরিত্র। আমি এমন কোন হাদিস বা আয়াত পড়ি নি, যেখানে আল্লাহকে কেউ হাসতে শুনেছে। তার মনে কোন আনন্দ নেই। যার মনে আনন্দ নেই, সে একটি অশুভ চরিত্রই বটে। মনে হয় যেন, সরকারী অফিসের কর্মচারী, যে বৌয়ের সাথে সারারাত ঝগড়া করে অফিসে এসেছে। নাক মুখ কুচকে বসে আছে। কোন আনন্দ নেই, কোন খুশি নেই যার মনে। বা বাসার কমবয়সী বাচ্চা ছেলেটি, যাকে তার পছন্দের খেলনাটি কিনে দেয়া হয় নি। তাই রাগ করে বসে আছে। আর তাকে কেন কেউ পাত্তা দিচ্ছে না, তা নিয়ে অভিযোগ করছে। আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগা এক অশুভ সত্ত্বা যেন, যে সবচাইতে বেশি এটেনশোন সিকার। সকলের এটেনশনের জন্য সে মুখিয়ে থাকে। বদমেজাজি, ছোট খাট ভুল নিয়ে হাউমাউ করা একটি ছোটলোক টাইপ চরিত্র। একটি বদরাগী চরিত্র। সারাক্ষণ নিজের প্রশংসা শুনতে চাওয়া নিজের তোষামোদ পছন্দ করা বিশ্রী চরিত্র। যে আমার ফেইসবুকের কোন একটি খুশির পোস্ট দেখে আমাকে কয়েক লক্ষ বছর আগুণে ফ্রাই করবেন। আমি কোনদিকে কাত হয়ে ঘুমাচ্ছি, আমার বউকে চুমু দেয়ার সময় তার নাম নিচ্ছি কিনা, এইসব কারণে সে ক্ষিপ্ত হয়ে রাগে জ্বলতে থাকে! সিরিয়াসলি? কাম অন, গেট এ লাইফ অ্যাসহোল!

অশুভ বদরাগী

যেমন ধরুন মা কালী চরিত্রটি। এই দেবীর ছবি দেখলেই আমার ঘেন্না পায়। কিরকম বিশ্রী এবং অশুভ একজন দেবী চরিত্র! এরকম দেবীর পুজা কেউ কীভাবে করে, তা আমার মাথায় আসে না। জিহবা বের করে অস্ত্র হাতে একটা কাটা মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! কী মারাত্মক ব্যাপার।

ঢাকায় থাকার সময় বাসে ট্রেনে উঠলেই এরকম অসুখী চরিত্রগুলো চোখে পড়তো। মুখে কখনো হাসি নেই। চোখে চোখ পড়লেই কেমন ভয়াবহ আগুন দৃষ্টিতে তাকাতো। মনে হতো এই মারবে বুঝি। গায়ে অল্প ধাক্কা লাগলেই মারতে আসতো। বাসের হেলপার ড্রাইভারকে সারাক্ষণ গালাগালি করতো। এক টাকা বেশি ভাড়া চাইলেই চড় মেরে বসতো। অসুখি এবং মানসিকভাবে অপরিণত! ইউরোপে দেখেছি, বাসে ট্রেনে বেশিরভাগ মানুষ হাসি মুখে উঠবে। চোখে চোখ পড়লেই মিস্টি করে একটা হাসি দেবে। ছেলে হোক বা মেয়ে, বেশিরভাগ সময়ই এরকম হবে। মাঝে মাঝে এরকম অসুখি চেহারাও চোখে পড়ে। তারা হাসে না। কেমন কড়া দৃষ্টিতে তাকায়। তখন আমরা ভাবি, হয়তো মানুষটার বাসায় কোন সমস্যা হয়েছে। বা বৌ বা স্বামী বা পার্টনারের সাথে ঝগড়া করেছে। আমরা অবাক হই। আল্লাহ চরিত্রটি তার চাইতেও অনেক ভয়াবহ মাত্রার মানসিক অসুস্থতার শিকার। ওল্ড টেস্টামেন্টের বদমাজাজী ঈশ্বরের মতই ইসলামের আল্লাহও একজন অসুখী মানুষের অশুভ চিন্তার ফসল।

আপনি ভাবতে পারেন, মহাবিশ্বের অসংখ্য গ্রহ উপগ্রহ নক্ষত্র স্পেস টাইম অসংখ্য বড় বড় ধুমকেতু জানা অজানা কতকিছু যে সৃষ্টি করেছে, সে মুসলমানদের ফেইসবুক পোস্ট পড়ে দেখছে যে কেউ ক্রিকেট খেলার আনন্দে খুশি প্রকাশ করছে নাকি মৃত্যুর ভয়ে কান্নাকাটি করছে? খুশী প্রকাশ করলে সে ক্ষেপে যাচ্ছে, আর কান্নাকাটি করলে খুশী হচ্ছে?

কাম অন, গেট এ লাইফ! অ্যাসহোল!

আসিফ মহিউদ্দীন 

আল্লাহ

আল্লাহ তালাহ- একটি অশুভ বদরাগী অসুখী চরিত্র


সেইদিন হোম পেইজে কীভাবে জানি ঘুরে ঘুরে একটা পোস্ট আমার নজরে পড়ে গেল। বিষয়বস্তু হচ্ছে, পোস্টের লেখক সবাইকে জানাচ্ছেন, ক্রিকেট খেলা দেখে জিতে যাওয়ার আনন্দে আত্মহারা হয়ে খুশী প্রকাশ করা ইসলামের দৃষ্টিতে উচিত কাজ নয়। ফেইসবুকে এরকম খুশি বা আনন্দ প্রকাশ করা গর্হিত কাজ। মুসলমানদের উচিত মৃত্যুর পরে কী হবে তা ভেবে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করা। খেলায় জিতে তা নিয়ে আনন্দ করা, খুশি হওয়া, তা আবার প্রকাশ করে ফেলাতে আল্লাহ নাখোশ হতে পারেন। মুসলমানদের সব সময়ই মৃত্যু ভয়ে ভীত এবং দোজখের ভয়ে আতঙ্কিত থাকা উচিত!
আমি মন দিয়েই লেখাটি পড়লাম। মুমিন মুসলমানদের লেখা আমার কাজের জন্যেই মন দিয়ে পড়তে হয়। তাদের মনের গঠন বোঝার জন্য। তাদের বুদ্ধিমত্তা বোঝার জন্য। আপনি কী এই ধরণের লেখা আগে পড়েছেন? আমি নিশ্চিত, আপনার চোখেও হয়তো পড়েছে।

আল্লাহ চরিত্রটি নিয়ে একটু ভেবে দেখুন। খুবই অসুখী, হীনমন্য, ছোটলোক এবং পাছায় লেগে থাকা একটি চরিত্র। আপনি খাচ্ছেন নাকি ঘুমাচ্ছেন, ঘুম থেকে উঠলেন কিংবা প্রশাব করতে গেলেন, আপনি বাসা থেকে বের হচ্ছেন নাকি বাসায় ফিরছেন, প্রতিটা পদক্ষেপে আপনার ওপর তার কড়া নজরদারি। আপনি ডানদিকে কাত হয়ে শুচ্ছেন নাকি বা দিকে, আপনার প্যান্ট টাখনুর কতটুকু ওপরে রয়েছে, আপনি প্রশাব করার পরে ঢিলা কুলুপ করেছেন কিনা, আপনি স্ত্রীর সাথে প্রেম করার পরে ফরজ গোছল করেছেন কিনা, মানুষের জীবনে এমন কোন সময় নেই যেই সময়ে সে খবরদারি করতে আসবে না। সে চাইবে আপনি তাকে সর্বক্ষণ ভয় পান, ভীত আতঙ্কিত হয়ে জীবন কাটান। কান্নাকাটি করেন। আপনি যদি মনের সুখে হাসেন, বা কাঁদেন, সব জায়গাতেই তার অনেক সমস্যা। সেই চায় একদম গৃহপালিত দাস, যে সর্বক্ষণ তার তোষামোদ করতে ব্যস্ত থাকবে।

ভাবুন তো, আপনার সন্তানের কথা। আপনি কেমন মানুষ তা জানি না। তবে আমি আমার সন্তানকে চাইবো সবসময় হাসিখুশী। আনন্দ করা একজন সুখী মানুষ হিসেবে। সে আমার ভয়ে সারাক্ষণ ভীত হয়ে থরথর করে কাঁপবে, আমার পিটানির ভয় আতঙ্কিত থাকবে, এরকম হলে তাতে তার মানসিক বৃদ্ধি ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সে হয়তো ছোটখাটো ভুল করে ফেলবে, কিন্তু আমি তাকে আদর করে বোঝাবো। ভুল তো হবেই, কিন্তু সে তো আমার সন্তানই। তাকে মানুষের অধিকারের কথা বোঝাবো, মানবতাবাদ শেখাবো। সব মানুষের সমান অধিকার এবং সমান মর্যাদা, এরকম তাকে ছোট বেলা থেকেই শিক্ষা দেবো। তাকে বলবো না, সে দুষ্টুমি করলে তাকে আমি মাইক্রো ওয়েভে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে পোড়াবো। এইসব বর্বর কায়দায় অত্যাচারের কথা বললে কেউ কোনদিন উন্নত চরিত্রের মানুষ হতে পারে না। আজকে আমি যদি তাকে এরকম বর্বর ভয় দেখাই, তার মাথায় এগুলো ঢুকে যাবে। এই বর্বরতা পরবর্তী জীবনে সে চর্চা করবে।

উন্নত বিশ্বে নানা মানসিক গবেষনায় দেখা গেছে, ছোটবেলা যেই সব শিশুদের ওপর অত্যাচার বেশি হয়, বা ভয় দেখানো হয়, তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা তুলনামূলক বেশি হয়। তাদের মধ্যে এক ধরণের জেদ কাজ করে। আপনি ছোটখাটো ভুলের জন্য আপনার সন্তানকে মারধোর করলে বা ভয়ঙ্কর রকমের ভয় দেখালে সে ক্রমশ জেদি হয়ে উঠবে। তখন জেদ করেই সেই নিষিদ্ধ কাজটি সে বারবার করতে চাইবে। তার মনের মধ্যে থাকবে সেই কাজটি করার আগ্রহ। কিন্তু ভয়ের কারণে সে হয়তো কিছুদিনের জন্য তা করবে না, তবে তার মনে সেটা চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে যাবে।

আল্লাহ পাক কোরআনে বলছেন, আল্লাহ হচ্ছেন প্রতিশোধ গ্রহণকারী। এর মানে কী? তুচ্ছ মানুষের ওপর আল্লাহ প্রতিশোধ নেন? কী হাস্যকর!

■ আর আল্লাহ হচ্ছেন পরাক্রমশীল, প্রতিশোধ গ্রহণকারী
কুরআন ৩ঃ৪

■ আল্লাহ বলছেন, তিনি ভীতি প্রদর্শক, ভয় প্রদর্শক। এর মানে কী? আল্লাহ ভয় দেখান? আল্লাহ কী ভুত?
আর বলুনঃ আমি প্রকাশ্য ভয় প্রদর্শক।
কোরআন  ১৫ঃ৮৯

আল্লাহ কী ক্ষেপে গেলে হুমকিধামকি দেয়া শুরু করেন? সামান্য মানুষের চুল ধরে টেনে হিচড়ে নেয়ার হুমকি দেন?

■ কখনই নয়, যদি সে বিরত না হয়, তবে আমি মস্তকের সামনের কেশগুচ্ছ ধরে হেঁচড়াবই
কোরআন ৯৬/১৫-১৬

■ আর যারা কাফের হয়েছে, তাদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাদেরকে মৃত্যুর আদেশও দেয়া হবে না যে, তারা মরে যাবে এবং তাদের থেকে তার শাস্তিও লাঘব করা হবে না। আমি প্রত্যেক অকৃতজ্ঞকে এভাবেই শাস্তি দিয়ে থাকি।
কোরআন ৩৫ঃ৩৬

■ সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার।
কোরআন ৯ঃ৩৫

■ আমি তার নাসিকা দাগিয়ে দিব।
কোরআন ৬৮ঃ১৬

■ …তাদের জন্যে উত্তপ্ত পানি এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে-কুফরের কারণে।
কোরআন ৬ঃ৭০

আল্লাহ পাক তোষামোদ এর ভালবাসেন কেন? নিজেই নিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ?

■ হে মূসা, আমি আল্লাহ, প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়
কোরআন ২৭:৯

■ হে মানুষ, তোমরা আল্লাহর গলগ্রহ। আর আল্লাহ; তিনি অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।
কোরআন ৩৫ঃ১৫

■ আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও অধিক জ্ঞানবান
কোরআন ১২ঃ৫৫

■  আল্লাহ অমুখাপেক্ষী,
তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি
এবং তার সমতুল্য কেউ নেই।
কোরআন ১১২ঃ২-৪

■ অতএব সকল প্রশংসা ও ধন্যবাদ আল্লাহর উপরে বর্ষিত হোক, কারণ তিনিই জগতের প্রভু।
কোরআন ৪৫ঃ৩৬

■ নভোমন্ডল, ভূমন্ডল এবং এতদুভয়ে অবস্থিত সবকিছুর আধিপত্য আল্লাহরই। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।
কোরআন ৫ঃ১২০

কোরআন আরো ভালভাবে বুঝে বুঝে পড়ে দেখুন। আল্লাহ এখানে একে অভিশাপ দিচ্ছে তো সেখানে তাকে হুমকি দিচ্ছে! কী অদ্ভুত রকমের হিংস্রতা তার মধ্যে। কাফের মারো অমুককে জোড়ায় জোড়ায় কাটো তমুকের গলায় রশি বাধো অপমান করে জিজিয়া কর আরোপ কর তাদের দাস বানাও, কত্ত কিছু। আর হচ্ছে মুহাম্মদকে বলতে থাকবে, বিয়ে কর বিয়ে কর। যেন মুহাম্মদের একের পর এক বিয়ে ছাড়া দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল। আল্লাহ চরিত্রটি আমাদের দেশের মাদ্রাসার শিক্ষকদের মতই, প্রাগৌতিহাসিক একটি অশুভ চরিত্র। আমি এমন কোন হাদিস বা আয়াত পড়ি নি, যেখানে আল্লাহকে কেউ হাসতে শুনেছে। তার মনে কোন আনন্দ নেই। যার মনে আনন্দ নেই, সে একটি অশুভ চরিত্রই বটে। মনে হয় যেন, সরকারী অফিসের কর্মচারী, যে বৌয়ের সাথে সারারাত ঝগড়া করে অফিসে এসেছে। নাক মুখ কুচকে বসে আছে। কোন আনন্দ নেই, কোন খুশি নেই যার মনে। বা বাসার কমবয়সী বাচ্চা ছেলেটি, যাকে তার পছন্দের খেলনাটি কিনে দেয়া হয় নি। তাই রাগ করে বসে আছে। আর তাকে কেন কেউ পাত্তা দিচ্ছে না, তা নিয়ে অভিযোগ করছে। আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগা এক অশুভ সত্ত্বা যেন, যে সবচাইতে বেশি এটেনশোন সিকার। সকলের এটেনশনের জন্য সে মুখিয়ে থাকে। বদমেজাজি, ছোট খাট ভুল নিয়ে হাউমাউ করা একটি ছোটলোক টাইপ চরিত্র। একটি বদরাগী চরিত্র। সারাক্ষণ নিজের প্রশংসা শুনতে চাওয়া নিজের তোষামোদ পছন্দ করা বিশ্রী চরিত্র। যে আমার ফেইসবুকের কোন একটি খুশির পোস্ট দেখে আমাকে কয়েক লক্ষ বছর আগুণে ফ্রাই করবেন। আমি কোনদিকে কাত হয়ে ঘুমাচ্ছি, আমার বউকে চুমু দেয়ার সময় তার নাম নিচ্ছি কিনা, এইসব কারণে সে ক্ষিপ্ত হয়ে রাগে জ্বলতে থাকে! সিরিয়াসলি? কাম অন, গেট এ লাইফ অ্যাসহোল!

অশুভ বদরাগী

যেমন ধরুন মা কালী চরিত্রটি। এই দেবীর ছবি দেখলেই আমার ঘেন্না পায়। কিরকম বিশ্রী এবং অশুভ একজন দেবী চরিত্র! এরকম দেবীর পুজা কেউ কীভাবে করে, তা আমার মাথায় আসে না। জিহবা বের করে অস্ত্র হাতে একটা কাটা মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! কী মারাত্মক ব্যাপার।

ঢাকায় থাকার সময় বাসে ট্রেনে উঠলেই এরকম অসুখী চরিত্রগুলো চোখে পড়তো। মুখে কখনো হাসি নেই। চোখে চোখ পড়লেই কেমন ভয়াবহ আগুন দৃষ্টিতে তাকাতো। মনে হতো এই মারবে বুঝি। গায়ে অল্প ধাক্কা লাগলেই মারতে আসতো। বাসের হেলপার ড্রাইভারকে সারাক্ষণ গালাগালি করতো। এক টাকা বেশি ভাড়া চাইলেই চড় মেরে বসতো। অসুখি এবং মানসিকভাবে অপরিণত! ইউরোপে দেখেছি, বাসে ট্রেনে বেশিরভাগ মানুষ হাসি মুখে উঠবে। চোখে চোখ পড়লেই মিস্টি করে একটা হাসি দেবে। ছেলে হোক বা মেয়ে, বেশিরভাগ সময়ই এরকম হবে। মাঝে মাঝে এরকম অসুখি চেহারাও চোখে পড়ে। তারা হাসে না। কেমন কড়া দৃষ্টিতে তাকায়। তখন আমরা ভাবি, হয়তো মানুষটার বাসায় কোন সমস্যা হয়েছে। বা বৌ বা স্বামী বা পার্টনারের সাথে ঝগড়া করেছে। আমরা অবাক হই। আল্লাহ চরিত্রটি তার চাইতেও অনেক ভয়াবহ মাত্রার মানসিক অসুস্থতার শিকার। ওল্ড টেস্টামেন্টের বদমাজাজী ঈশ্বরের মতই ইসলামের আল্লাহও একজন অসুখী মানুষের অশুভ চিন্তার ফসল।

আপনি ভাবতে পারেন, মহাবিশ্বের অসংখ্য গ্রহ উপগ্রহ নক্ষত্র স্পেস টাইম অসংখ্য বড় বড় ধুমকেতু জানা অজানা কতকিছু যে সৃষ্টি করেছে, সে মুসলমানদের ফেইসবুক পোস্ট পড়ে দেখছে যে কেউ ক্রিকেট খেলার আনন্দে খুশি প্রকাশ করছে নাকি মৃত্যুর ভয়ে কান্নাকাটি করছে? খুশী প্রকাশ করলে সে ক্ষেপে যাচ্ছে, আর কান্নাকাটি করলে খুশী হচ্ছে?

কাম অন, গেট এ লাইফ! অ্যাসহোল!

আসিফ মহিউদ্দীন 

Posted at February 06, 2019 |  by Arya ঋষি

২০০০ সালের প্রথমদিকে জীবনের প্রথম পথ চলা কীভাবে শুরু হয় এই গবেষণার প্রধান দুইটা তত্ত্ব প্রচলিত ছিল। আরএনএ ঘরানার বিজ্ঞানীগণ মনে করতেন প্রাণের বিকাশ হয়েছিল নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এমন অণুজীব থেকে। ইতিমধ্যে যেসব বিজ্ঞানীগণ “বিপাক ক্রিয়া” প্রথম শুরু হয়েছিল বলে মনে করতেন তারা গভীর সমুদ্রের আগ্নেয়গিরির গরম তরল প্রবাহের জ্বালামুখে কীভাবে প্রাণের বিকাশ হয়েছিল তার বিশদ বিবরণ হাজির করলেন। যাইহোক চলমান এই বিতর্কের মধ্যেই আমাদের সামনে উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে প্রাণের উৎস গবেষণার তৃতীয় আর একটা মতবাদ।

আমরা জানি পৃথিবীতে জীবিত সব প্রাণই কোষ দ্বারা গঠিত। প্রতিটি কোষই মূলত নরম তুলতুলে ছিদ্রযুক্ত গোলাকার সদৃশ বস্তু যার চারিধার অমসৃণ পর্দার আবরণে ঘেরা। কোষের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল কোষ জীবনের সব প্রয়োজনীয় উপাদান একত্রে ধরে রাখে। যদি কোষের দেয়াল কোন কারণে জীর্ণ হয়ে ধ্বসে যায় তাহলে কোষের মূল উপাদান বেরিয়ে পড়ে এবং কোষের মৃত্যু ঘটে। ঠিক যেমন যদি কোন মানুষের উদর থেকে নাড়ীভুঁড়ি কেটে ফেলে দিই তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সে আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না।

পৃথিবীর আদিতে প্রচণ্ড তাপ আর ঘূর্ণিপাকে কিছু রাসায়নিক উপাদান একত্রিত হয়ে অবিকশিত কোষ গঠিত হয়। কোষের বাইরের পর্দার আবরণ এতই প্রয়োজনীয় যে প্রাণের উৎস সন্ধানী কিছু গবেষক যুক্তি দেখালেন যে, কোষ সৃষ্টির আগেই কোষের আবরণ সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করতেন ‘যেভাবে জীবনের শুরু’ বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ের আলোচিত “জীনতত্ত্ব প্রথম” এবং চতুর্থ অধ্যায়ের “বিপাক ক্রিয়া প্রথম” ধারণাগুলো বিভ্রান্তিকর। তাদের বিকল্প মতবাদটি ছিল “কোষের কাঠামো পৃথকীকরণ প্রথম” ঘটেছিল। এই মতবাদের পুরোধা ব্যক্তি হলেন ইটালির রোমে অবস্থিত রোমা ট্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিয়ের লুইগি লুইজি।

লুইজির মতবাদের স্বপক্ষে কারণ যথেষ্ট সহজ সরল হলেও ব্যাখ্যা করার জন্য এত সহজ ছিল না। কীভাবে আপনি প্রমাণ করবেন “বিপাক ক্রিয়া” বা “স্বয়ম্ভূ আরএনএ” মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব যদি একটা বিশেষ স্থানে প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো যায়। অন্যথায় অণুজীব থেকে প্রাণ সঞ্চার হবে কোথায়?

যদি আপনি উপরের যুক্তি স্বীকার করে নেন তাহলে প্রাণ সৃষ্টির একটাই উপায় আছে সেটা হল, যেকোনভাবে আদি পৃথিবীর উত্তপ্ত ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যেও প্রাণ সৃষ্টির কিছু কাঁচামাল একত্রিত হয়ে অবিকশিত কোষ বা প্রাথমিক কোষের জন্ম নেয়া। প্রতিকূলতা পেরিয়ে গবেষণাগারে এই তত্ত্ব প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। বিজ্ঞানীগণ গবেষণাগারেই একটা সরল এককোষী জীবন্ত কোষ বানানো সম্ভব করেছেন।

কোষের জন্ম
All living things are made up of cells (Credit: Cultura Creative RF/Alamy)

লুইজি যেন তার সব চিন্তার সাথে যোগসূত্র স্থাপনে ফিরে গেলেন অ্যালেক্সান্ডার ওপারিনের কাছে এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রাণের সৃষ্টি রহস্য গবেষণার ঊষালগ্নে। অ্যালেক্সান্ডার ওপারিনের গবেষণার বিষয় ইতিমধ্যে প্রথম অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। ওপারিন গুরুত্বের সাথে দেখালেন কোয়াসারভেট থেকে উৎসারিত কিছু উষ্ণ রাসায়নিক তরলের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে যার কেন্দ্রে আছে কিছু অবিকশিত কোষের মত বস্তু। তিনি দাবী করেন কোয়াসারভেটগুলোই আসলে কোষের প্রথম নমুনা।

সঠিক উপাদান থাকার পরেও গবেষণাগারে কোষের প্রাথমিক নমুনা সৃষ্টি খুব কঠিন কাজ। যেকোনো চর্বিযুক্ত বা তৈলাক্ত বস্তু আছে এমন পানিতে ব্লব বা ফিল্ম সৃষ্টি হয় আর এইসব রাসায়নিক উপাদান একসাথে লিপিড নামে পরিচিত। আলোচনার এই পর্যায়ে বিজ্ঞানীগণ ধারণা পোষণ করতে থাকেন লিপিড থেকেই জীবনের প্রথম সূচনা। আমরা প্রাণের সৃষ্টি গবেষণায় বিজ্ঞানের এই মতবাদকে ‘লিপিড ঘরানা’ বলতে পারি।

কিন্তু শুধুই রাসায়নিক উষ্ণ ঘন তরলের ধারা সৃষ্টি করলেই সব সমাধা হয়ে গেল এমন নয় বিষয়টা। বিগত কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন বস্তু ব্যবহার করেও লুইজি এমনকিছু বানাতে পারলেন না যা দিয়ে তিনি বিজ্ঞানীদের সম্মতি অর্জনের জন্য জীবন-সদৃশ কিছু উপস্থাপন করা যায়। এখানে উল্লেখ্য উষ্ণ রাসায়নিক পানির প্রবাহের স্থিতিশীলতা থাকতে হবে এবং সেই প্রবাহ থেকে বিভাজিত হয়ে আর একটা ধারা সৃষ্টি করার সক্ষমতা থাকতে হবে। সেই ধারার মধ্যে কী কী উপাদান পরিবাহিত হচ্ছে তার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। এতকিছু করতে হবে কিন্তু আধুনিক একটা কোষের পরিণত প্রোটিন ব্যবহার না করেই।

কোষের জন্ম
Somehow cells formed (Credit: Christian Jegou/Publiphoto Diffusion/Science Photo Library)

এরপরে ১৯৯৪ সালে লুইজি এক সাহসী প্রস্তাবনা রাখলেন। তিনি বলেন প্রাথমিক পর্যায়ের কোষে অবশ্যই আরএনএ থাকতে হবে। তিনি আরও দাবী করেন এই আরএনএ অবশ্যই নিজের আর একটা প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে সম্ভব। লুইজির প্রস্তাবনা বিজ্ঞানের নতুন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিলো। তার মানে হল, প্রাণ বিকাশের প্রথম প্রস্তাবনায় আমরা আসলে প্রাণের সৃষ্টি রহস্য গবেষণার বিভিন্ন তত্ত্বের মিলন মেলায় মিলিত হয়েছি এবং দীর্ঘ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছি। লুইজির প্রস্তাবিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি আমলে নিলে, প্রাণ বিকাশের প্রথম প্রস্তাবনা কম্পার্টমেন্টালাইজেশন তত্ত্ব বা কোষের বিভাজন তত্ত্বকে বাতিল করে দিতে হয়। কিন্তু লুইজির কাছেও উপযুক্ত কারণ ছিল।

ভিতরে জীন বিহীন চারপাশে আবৃত কোষ খুব বেশী কিছু করতে পারে না। হয়ত কোষ বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ সৃষ্টি করতে পারে কিন্তু তারা নিজের বংশগতির কোন তথ্য, উপাত্ত পরবর্তী কোষের মাঝে সঞ্চার করতে পারবে না। কোষ কেবল তখনি বিবর্তিত হতে শুরু করবে এবং ক্রমাগত জটিলতর হয়ে উঠতে পারবে যদি কোষের অভ্যন্তরে জীন থাকে।

এই তত্ত্ব খুব দ্রুত জ্যাক সোসটাকের সমর্থকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। আমরা ইতিমধ্যে তৃতীয় অধ্যায়ে সোসটাকের আরএনএ নিয়ে গবেষণা আলোচনা তুলে ধরেছি। যখন লুইজি ছিলেন কম্পার্টমেন্টালাইজেশন তত্ত্বের প্রথম দিকের সমর্থক ঠিক তখন সোসটাক সমর্থন করতেন জীনতত্ত্বকে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন কোন মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত ছিল না। আমরা প্রাণের সৃষ্টি রহস্য গবেষণার বিভিন্ন তত্ত্বের মিলন মেলায় মিলিত হয়েছি এবং দীর্ঘ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছি এবং সোসটাকের গবেষণার সূত্র ধরে নির্ধারণ করছে চাচ্ছি কোনটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ। মোটের উপর আমরা বুঝতে পারলাম দুই গবেষণাতেই কোষের উপস্থিতি আছে। আমরা একটা সম্মতিতে এলাম যে প্রাণের উৎস সন্ধানে কম্পার্টমেন্টালাইজেশন বা বিভাজন তত্ত্ব এবং জীনতত্ত্ব উভয় গবেষণাতেই কোষ খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।

কোষের জন্ম
Almost all life is single-celled (Credit: Science Photo Library/Alamy)

সোসটাকের তত্ত্ব প্রাণের উৎস গবেষণার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী এবং সোসটাক অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন তার গবেষণা তত্ত্বে অর্থ বিনিয়োগ করবেন যেখানে তার আগ্রহ। কারণ হিসেবে বললেন, “এমন একটা তত্ত্বের সমর্থনে তত্ত্বকে গবেষণার বাইরে রাখতে পারি না।” তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন প্রাথমিক কোষ দিয়ে গবেষণা শুরু করবেন।

দুই বছর পরে সোসটাক এবং তার দুইজন সহকর্মী ২০০১ সালে বড় ধরণের সাফল্যের সুসংবাদ দিলেন। বিজ্ঞান বিষয়ক বিখ্যাত ‘নেচার’ জার্নালে তারা যুক্তি দেখিয়ে লিখলেন প্রকৃতিতে প্রাপ্ত আপাত বিচ্ছিন্ন উপাদান থেকে সহজেই প্রাথমিক কোষ সৃষ্টি করা সম্ভব। চর্বিযুক্ত তেলতেলে বস্তুর সংস্পর্শে আরএনএ নিজের নিজের প্রতিলিপি জন্ম দিতে পারে।

কোষের জন্ম
Vesicles are simple containers made of lipids (Credit: Alfred Pasieka/Science Photo Library)

সোসটাক এবং তার গবেষক-দল কোষের ভেসিকল (কোষের তরল পূর্ণধারক) নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ভেসিকল দেখতে অনেকটা সর্পিল ঘন তরলের আকার যার গভীরে এবং বাইরের আবরণে দুইটা ফ্যাটি এসিডের স্তর আছে। ভেসিকলের উৎপাদন ত্বরান্বিত করার উপায় খুঁজতে গিয়ে সোসটাকের গবেষক-দল এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদার মত দেখতে থকথকে একটা বস্তুকে বিক্রিয়ার কাজে লাগিয়ে দিলেন এবং মনে করলেন এই নিরীক্ষা প্রাণ গবেষণার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে। এই যৌগের মিশ্রণ গবেষণা কাজে যোগ করার পরেই ভেসিকলের উৎপাদন ১০০ গুণ ত্বরান্বিত হয়ে গেল। কাদার মত বস্তুর পৃষ্ঠতল ভেসিকল উৎপাদনে অনুঘটকের কাজ করে যে কাজটা সচারচার এনজাইম করে থাকে।

তদুপরি, ভেসিকল এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদার কণা এবং কাদার পৃষ্ঠতল থেকে আরএনএ গ্রহণ করতে পারে। প্রথমদিকের এইসব কোষ এখন বহন করছে জীন এবং অনুঘটক আর এতকিছু ঘটে যাচ্ছে একটা সরল কাঠামোর মধ্যে। তবে প্রাণ গবেষণার এই পর্যায়ে এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদা প্রয়োগের সিদ্ধান্ত কিন্তু হঠাৎ করে নেয়া হয়নি। বিগত কয়েক দশক ধরে চলমান গবেষণার পরম্পরা গবেষকদলকে এই সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এবং তারা অনুমান করেছিলেন প্রাণ সৃষ্টিতে এই যৌগ হয়ত খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কোষের জন্ম
This lump of clay is mostly montmorillonite (Credit: Susan E. Degginger/Alamy)

এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ খুব সহজলভ্য। এখনকার সময়ে আমাদের ব্যবহার্য নিত্যদিনের জিনিসপত্রে এটা হরহামেশা ব্যবহৃত হয় এমনকি বিড়ালের বিছানা বানাতেও এটার ব্যবহার দেখা যায়। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় নির্গত ছাইয়ের ধুলো পৃথিবীর আবহাওয়াতে মিশে এই যৌগ সৃষ্টি হয়। যেহেতু পৃথিবীর শৈশবে অনেক আগ্নেয়গিরি ছিল সেহেতু এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ ছিল পরিমাণে বিপুল।

ফিরে যাই ১৯৮৬ সালে, তখন আমেরিকান রসায়নবিদ জেমস ফেরিস দেখালেন এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ আসলে অণুঘটক যা জৈব-কণা সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আরও পরে তিনি আবিষ্কার করেন এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ আরএনএ সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখে। এই দুইটি কাজের উপর ভিত্তি করে জেমস ফেরিস ধারণা করেন গড়পড়তা দেখতে কাদার মত এই যৌগটি আসলে প্রাণ সৃষ্টির উপাদান। জ্যাক সোসটাক ফেরিসের ধারণাকে গ্রহণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন এবং এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ ব্যবহার করে প্রথম কোষ সৃষ্টি করলেন। সোসটাক যুক্তি দেখালেন, আদি-কোষ যদি বেড়ে উঠতে পারে তাহলে সেটা বিভাজিতও হতে পারে। এক বছর পরে সোসটাকের গবেষক-দল প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, প্রথমদিকের কোষ নিজেদের মত করেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেড়ে উঠতে পারে। এমনকি আদি-কোষে আরএনএ সংরক্ষিত থাকে এবং সময়ের হাত ধরে কোষের দেয়ালের বাইরের পাশ অতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। মনে হয় যেন আদি-কোষ একটা ফুলে ওঠা পাকস্থলী এবং যেকোনো সময় সশব্দে ফেটে পড়বে। ফেটে পড়া রোধ করতে গিয়ে কোষ অধিকমাত্রায় ফ্যাটি এসিড গ্রহণ করে এবং তাদের সমন্বয়ে নিজের দেয়ালকে আরও মজবুত করে তোলে ফলে কোষ ফুলে আকারে আর একটু বড় হয় এবং ফেটে পড়ার আশংকা দূর হয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল আদি-কোষ যে কোষের আরএনএ কম তার থেকে ফ্যাটি এসিড গ্রহণ করছে ফলে সেই কোষগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ছে। তার মানে এ থেকে বোঝা যায় আদি-কোষ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল এবং যে কোষের আরএনএ বেশী স্বাভাবিকভাবে সে কোষ জিতে যায়। এই অনুসিদ্ধান্ত আমাদের মনে আরও বিস্ময় জাগায়। যদি আদি-কোষ বেড়ে ওঠতে পারে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের অনুরূপ কোষ সৃষ্টি করতে পারে তবে কি সোসটাকের গবেষণালব্ধ প্রাথমিক কোষ নিজের প্রতিলিপি বানাতে পারবে?

কোষের জন্ম
Cells reproduce by dividing into two (Credit: Science Photo Library/Alamy)


সোসটাকের প্রথম পরীক্ষায় দেখানো হয়েছে কীভাবে আদি-কোষ বিভাজিত হয়। আদি-কোষকে দুমড়ে মুচড়ে যদি ছোট ছিদ্র পথের সুড়ঙ্গে ঢুকিয়ে দেয়া যায় তাহলে সেখান থেকে আদি-কোষ ভেঙে ছড়িয়ে পড়বে। আদি-কোষ বেড়ে ওঠে, তাদের আকার পরিবর্তিত হয়, আয়তনে প্রসারিত হয় এবং তাদের শরীরে রশির মত লম্বা পাতলা প্রান্ত দেখা যায়।

এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া একেবারে নির্ভেজাল কারণ এখানে কোষের কোন যান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম জড়িত নাই। এখানে শুধু চাপ প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু এটা কোন সমাধান নয় কারণ নিজেই নিজের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় আদি-কোষ তার নিজস্ব কিছু উপাদান হারায়। এছাড়াও আদি-কোষ তখনই বিভাজিত হতে পারে যখন ছোট ছিদ্রপথে বল প্রয়োগে প্রবেশ করানো হয়।

ভেসিকলকে বিভাজিত করার বিভিন্ন উপায় আছে যেমন কোষকে পানির প্রবল স্রোত যুক্ত করতে পারলে কোষে নতুন শক্তির সৃষ্টি হয়। আদি-কোষের অভ্যন্তরীণ উপাদান বের হতে না দিয়ে কোষকে বিভাজন করার জন্য এই কৌশল অবলম্বন করা হয়।

অবশেষে ২০০৯ সালে জ্যাক সোসটাক এবং তার সহযোগী ছাত্র টিং ঝু একটা সমাধান বের করতে সক্ষম হন। তারা সামান্য একটু জটিল আদি-কোষ সৃষ্টি করলেন যার চতুর্দিকে একাধিক দেয়াল যেন অনেকটা পেয়াজের মত। সরল আদি-কোষের গঠনে জটিলতা থাকলেও সহজেই তাদেরকে সৃষ্টি করা সম্ভব। টিং ঝু যখন আদি-কোষের সাথে আরও বেশী ফ্যাটি এসিড যোগ করলেন তখন আদি-কোষের আকার পরিবর্তিত হয়ে গেল, সুতার মত দেখতে প্রান্তগুলো আরও লম্বা হয়ে গেল। আদি-কোষের আকার যথেষ্ট বড় হয়ে গেলে অল্প চাপে আদি-কোষ ভেঙে বেশকিছু ছোট ছোট আদি-কোষে রূপান্তরিত হল। পিতৃ-কোষের কোন আরএনএ কিন্তু হারিয়ে গেল না বরং প্রতিটি ক্ষুদ্র আদি-কোষ তার পিতৃ-কোষের আরএনএ বহন করতে লাগল। তাছাড়া, আদি-কোষ নতুন কোষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া পৌনঃপুনিক ভাবে চালিয়ে যেতে পারে। নতুন আদি-কোষ পরিপূর্ণ হয়ে গেলে নিজেই আবার নতুন কোষে বিভাজিত হতে শুরু করে।

পরবর্তী পরীক্ষায় ঝু এবং সোসটাক আদি-কোষ ভেঙে নতুন কোষ জন্ম দেয়ার ভিন্ন ভিন্ন উপায় খুঁজে বের করতে পেরেছিলেন। গবেষণার এই পর্যায়ে মনে হচ্ছিল অবশেষে সমস্যার বুঝি সমাধান পাওয়া গেল।

যাইহোক আদি-কোষ কিন্তু তখন যথেষ্ট কার্যকরী ছিল না। লুইজি ভেবেছিলেন, আদি-কোষ আরএনএ প্রতিলিপি সৃষ্টির ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করবে কিন্তু যতদূর বোঝা যায় আদি-কোষে আরএনএ শুধু অলস বসে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ করে না।

সত্যিকার অর্থেই যদি আদি-কোষ থেকে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের বিকাশ প্রমাণ করতে হয় তাহলে সোসটাকের দেখাতে হবে আরএনএ কীভাবে কোষের অভ্যন্তরে নিজেই নিজের প্রতিলিপি জন্ম দেয়। কিন্তু এই তথ্যকে তত্ত্ব হিসেবে প্রমাণ করে দেখানো এত সহজ নয় কারণ দশকব্যাপী পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর পরেও কোন বিজ্ঞানী আরএনএ উৎপাদন করে দেখাতে পারেন নি যা নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে। ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা বিশদ আলোচনা করে ফেলেছি। এই সমস্যার কারণেই প্রাণ বিকাশে আরএনএ তত্ত্ব ঘরানার গবেষণার কাজ প্রথমদিকে ব্যাহত হচ্ছিল এবং তখন পর্যন্ত কেউ এই সমস্যার সমাধান বের করতে পারেনি। সুতরাং সোসটাক লেসলি ওরগেলের গবেষণার ফলাফল ও লিখিত কাগজ পুনরায় পড়তে শুরু করেন। আমরা জানি লেসলি ওরগেল দীর্ঘদিন আরএনএ তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। পুরনো ধুলো পড়া কাগজের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল প্রাণের উৎস গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র।

কোষের জন্ম
So The first cells had to host the chemistry of life (Credit: Science Photo Library/Alamy)

ওরগেল ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আরএনএ’র সুতোর মত প্রান্তগুলো কীভাবে নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করে সেই গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ওরগেলের গবেষণার সারাংশ ছিল খুবই সহজ সরল এবং সাধারণ। আরএনএ’র সুতোর মত একপ্রান্ত থেকে আলগা নিউক্লিওটাইড তুলে নেয়া হল এবং তখন নিউক্লিওটাইড জড়ো করে আরএনএ’র প্রথম সুতোর মত অবিকল আর একটা প্রান্ত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ, ধরি আরএনএ’র একটা সুতোর মত প্রান্তে CGC লিখিত আছে এবং সেখানেই উৎপাদিত হয়েছে অনুরূপ আরেকটা সুতোর মত প্রান্ত যেটা পড়তে GCG এর মত মনে হয়। সম্ভবত কেউ যদি এই প্রক্রিয়া দুইবার করে তবে প্রকৃত CGC পাওয়া যাবে।

ওরগেল বুঝতে পারলেন যে, কোন অনুকূল পরিবেশে আরএনএ’র সুতোর মত প্রান্ত একই প্রক্রিয়ায় এনজাইমের সাহায্য ছাড়াই আরএনএ’র প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে। সম্ভবত এভাবেই প্রথম প্রাণ আরএনএ থেকে জীন সংগ্রহ করত। ১৯৮৭ সালে ওরগেল আবিষ্কার করলেন, আরএনএ’র ১৪ লম্বা নিউক্লিওটাইড সুতোর প্রান্ত অনুরূপ ১৪ নিউক্লিওটাইড লম্বা প্রান্ত সৃষ্টি করতে সক্ষম। তিনি এর থেকে বেশী লম্বা আরএনএ’র প্রান্ত বানাতে পারেন নি কিন্তু সোসটাকের চিন্তার সলতেই আগুন উস্কে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। সোসটাকের ছাত্রী ক্যাটারজিনা অ্যাডামালা আদি-কোষ সৃষ্টির জন্য পুনরায় প্রবৃত্ত হলেন। তারা যে আদি-কোষ সৃষ্টি করলেন সেগুলো আগের কোষের গায়ের বাইরের সংলগ্ন মলিকিউল থেকে জীন বহন করে।

তারা বুঝতে পারলেন, এই বিক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য ম্যাগনেসিয়াম প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা এখানেই যে, ম্যাগনেসিয়ামের উপস্থিতি আদি-কোষকে ধ্বংস করে। সব সমস্যারই সমাধান আছে এবং এই সমস্যার সমাধানে ব্যবহার করা হল সাইট্রিক এসিড। লেবু, কমলা জাতীয় ফলে প্রচুর সাইট্রিক এসিড পাওয়া যায় এবং প্রতিটি জীবন্ত কোষে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সাইট্রিক এসিডের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটা গবেষণায় গবেষক-দল উল্লেখ করেন তারা বিক্রিয়ার সময় সাইট্রেট যুক্ত করে দেন ফলে বিক্রিয়াতে অংশগ্রহণ থেকে ম্যাগনেসিয়ামকে বিরত রাখা সম্ভব হয়। এতে আদি-কোষ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং কোষের প্রতিলিপি সৃষ্টির প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে চলতে থাকে। সরলভাবে বলতে গেলে গবেষক-দল ১৯৯৪ সালে ইটালিয়ান বিজ্ঞানী পিয়ের লুইগি লুইজির প্রস্তাবিত তত্ত্বকে বাস্তবায়ন করলেন। জ্যাক সোসটাক বলেন, “আমরা কোষের ফ্যাটি এসিডে ভেসিকলের অভ্যন্তরে আরএনএ’র অবিকল প্রতিলিপি সৃষ্টির রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু করলাম।”

কোষের জন্ম
Szostak’s protocells can survive extreme heat (Credit: Jon Sullivan, PDPhoto.org)

মাত্র এক দশকের বেশী কিছু সময়ের গবেষণায় জ্যাক সোসটাকের গবেষক-দল প্রাণের উৎস সন্ধানে যুগান্তকারী অর্জন সম্পন্ন করে ফেললেন। তারা আদি-কোষ বানাতে সক্ষম হলেন যারা পূর্বের কোষের জীন বহন করে এবং কোষের বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় মলিকিউল সংগ্রহ করতে পারে। এই আদি-কোষ নিজেরাই নিজেদের বৃদ্ধি এবং বিভাজন করতে পারে এমনকি নিজেদের মাঝে প্রতিযোগিতা পর্যন্ত করতে পারে। আর কোষের অভ্যন্তরে চলতে থাকে আরএনএ’র অবিকল প্রতিলিপি সৃষ্টির অবিরাম কর্মযজ্ঞ। যেকোনো বিচারেই এই প্রক্রিয়া নতুন জীবন সৃষ্টির সূচনা বলা যেতে পারে।

এতকিছু স্বত্বেও সোসটাকের গবেষণার ফলাফল প্রায় ৪০ বছর ধরে চলমান প্রাণের উৎস গবেষণার বিপরীতে চলে গেল। কোষের নিজেই নিজেকে জন্ম দিয়েছিল প্রথমে এই মতবাদকে প্রাধান্য না দিয়ে অথবা কোষের বিভাজন প্রক্রিয়াকে অধিক গুরুত্ব না দিয়ে সোসটাক এই দুই মতবাদের সমন্বয় সাধন করে বলতে চেয়েছিলেন এই দুই প্রক্রিয়া সমান-তালে একসাথে চলছিল। কিন্তু সোসটাকের গবেষক-দল যেকোনো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে প্রস্তুত। ২০০৮ সালে সোসটাকের গবেষক-দল বুঝতে জানতে পারলেন, আদি-কোষ প্রায় ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও দিব্যি টিকে থাকতে পারে অথচ এই পরিমাণ উচ্চ তাপমাত্রায় বর্তমান সময়ের পরিণত বেশীরভাগ কোষেরই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা। ফলে সোসটাকের ধারণা আরও জোরালো হয় যে আদি-কোষের সাথে প্রথম প্রাণের যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। এর থেকে আরও প্রমাণিত হয় অবিরাম চলতে থাকা উল্কা পতনের প্রভাবে সৃষ্ট গরমেও আদি-কোষ বহাল তবিয়তে টিকে ছিল।

জার্মানির ওসনাব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শিক্ষক আরমেন মালকিদজানিয়ান সোসটাকের গবেষণাকে অতুলনীয় হিসেবে অভিহিত করেন। সোসটাকে তত্ত্বাবধানে ইতিপূর্বে বর্ণিত দুই মতবাদের সমন্বয় করার প্রচেষ্টা প্রাণের উৎস গবেষণায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয় যার কারণে শুরু হয় প্রাণ কীভাবে কাজ করে তার আলোচনা। এই “সবকিছু প্রথমে” ধারণা ইতিমধ্যে জোগাড় করে ফেলেছে তথ্য প্রমাণের আকরিক সম্পদ এবং প্রাণের উৎস গবেষণার চলমান বিতর্কের সম্ভাব্য সমাধান।

কোষের জন্ম
The molecules of life behave in incredibly complex ways (Credit: Equinox Graphics Ltd)

কোষের জন্ম

২০০০ সালের প্রথমদিকে জীবনের প্রথম পথ চলা কীভাবে শুরু হয় এই গবেষণার প্রধান দুইটা তত্ত্ব প্রচলিত ছিল। আরএনএ ঘরানার বিজ্ঞানীগণ মনে করতেন প্রাণের বিকাশ হয়েছিল নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এমন অণুজীব থেকে। ইতিমধ্যে যেসব বিজ্ঞানীগণ “বিপাক ক্রিয়া” প্রথম শুরু হয়েছিল বলে মনে করতেন তারা গভীর সমুদ্রের আগ্নেয়গিরির গরম তরল প্রবাহের জ্বালামুখে কীভাবে প্রাণের বিকাশ হয়েছিল তার বিশদ বিবরণ হাজির করলেন। যাইহোক চলমান এই বিতর্কের মধ্যেই আমাদের সামনে উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে প্রাণের উৎস গবেষণার তৃতীয় আর একটা মতবাদ।

আমরা জানি পৃথিবীতে জীবিত সব প্রাণই কোষ দ্বারা গঠিত। প্রতিটি কোষই মূলত নরম তুলতুলে ছিদ্রযুক্ত গোলাকার সদৃশ বস্তু যার চারিধার অমসৃণ পর্দার আবরণে ঘেরা। কোষের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল কোষ জীবনের সব প্রয়োজনীয় উপাদান একত্রে ধরে রাখে। যদি কোষের দেয়াল কোন কারণে জীর্ণ হয়ে ধ্বসে যায় তাহলে কোষের মূল উপাদান বেরিয়ে পড়ে এবং কোষের মৃত্যু ঘটে। ঠিক যেমন যদি কোন মানুষের উদর থেকে নাড়ীভুঁড়ি কেটে ফেলে দিই তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সে আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না।

পৃথিবীর আদিতে প্রচণ্ড তাপ আর ঘূর্ণিপাকে কিছু রাসায়নিক উপাদান একত্রিত হয়ে অবিকশিত কোষ গঠিত হয়। কোষের বাইরের পর্দার আবরণ এতই প্রয়োজনীয় যে প্রাণের উৎস সন্ধানী কিছু গবেষক যুক্তি দেখালেন যে, কোষ সৃষ্টির আগেই কোষের আবরণ সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করতেন ‘যেভাবে জীবনের শুরু’ বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ের আলোচিত “জীনতত্ত্ব প্রথম” এবং চতুর্থ অধ্যায়ের “বিপাক ক্রিয়া প্রথম” ধারণাগুলো বিভ্রান্তিকর। তাদের বিকল্প মতবাদটি ছিল “কোষের কাঠামো পৃথকীকরণ প্রথম” ঘটেছিল। এই মতবাদের পুরোধা ব্যক্তি হলেন ইটালির রোমে অবস্থিত রোমা ট্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিয়ের লুইগি লুইজি।

লুইজির মতবাদের স্বপক্ষে কারণ যথেষ্ট সহজ সরল হলেও ব্যাখ্যা করার জন্য এত সহজ ছিল না। কীভাবে আপনি প্রমাণ করবেন “বিপাক ক্রিয়া” বা “স্বয়ম্ভূ আরএনএ” মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব যদি একটা বিশেষ স্থানে প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো যায়। অন্যথায় অণুজীব থেকে প্রাণ সঞ্চার হবে কোথায়?

যদি আপনি উপরের যুক্তি স্বীকার করে নেন তাহলে প্রাণ সৃষ্টির একটাই উপায় আছে সেটা হল, যেকোনভাবে আদি পৃথিবীর উত্তপ্ত ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যেও প্রাণ সৃষ্টির কিছু কাঁচামাল একত্রিত হয়ে অবিকশিত কোষ বা প্রাথমিক কোষের জন্ম নেয়া। প্রতিকূলতা পেরিয়ে গবেষণাগারে এই তত্ত্ব প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। বিজ্ঞানীগণ গবেষণাগারেই একটা সরল এককোষী জীবন্ত কোষ বানানো সম্ভব করেছেন।

কোষের জন্ম
All living things are made up of cells (Credit: Cultura Creative RF/Alamy)

লুইজি যেন তার সব চিন্তার সাথে যোগসূত্র স্থাপনে ফিরে গেলেন অ্যালেক্সান্ডার ওপারিনের কাছে এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রাণের সৃষ্টি রহস্য গবেষণার ঊষালগ্নে। অ্যালেক্সান্ডার ওপারিনের গবেষণার বিষয় ইতিমধ্যে প্রথম অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। ওপারিন গুরুত্বের সাথে দেখালেন কোয়াসারভেট থেকে উৎসারিত কিছু উষ্ণ রাসায়নিক তরলের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে যার কেন্দ্রে আছে কিছু অবিকশিত কোষের মত বস্তু। তিনি দাবী করেন কোয়াসারভেটগুলোই আসলে কোষের প্রথম নমুনা।

সঠিক উপাদান থাকার পরেও গবেষণাগারে কোষের প্রাথমিক নমুনা সৃষ্টি খুব কঠিন কাজ। যেকোনো চর্বিযুক্ত বা তৈলাক্ত বস্তু আছে এমন পানিতে ব্লব বা ফিল্ম সৃষ্টি হয় আর এইসব রাসায়নিক উপাদান একসাথে লিপিড নামে পরিচিত। আলোচনার এই পর্যায়ে বিজ্ঞানীগণ ধারণা পোষণ করতে থাকেন লিপিড থেকেই জীবনের প্রথম সূচনা। আমরা প্রাণের সৃষ্টি গবেষণায় বিজ্ঞানের এই মতবাদকে ‘লিপিড ঘরানা’ বলতে পারি।

কিন্তু শুধুই রাসায়নিক উষ্ণ ঘন তরলের ধারা সৃষ্টি করলেই সব সমাধা হয়ে গেল এমন নয় বিষয়টা। বিগত কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন বস্তু ব্যবহার করেও লুইজি এমনকিছু বানাতে পারলেন না যা দিয়ে তিনি বিজ্ঞানীদের সম্মতি অর্জনের জন্য জীবন-সদৃশ কিছু উপস্থাপন করা যায়। এখানে উল্লেখ্য উষ্ণ রাসায়নিক পানির প্রবাহের স্থিতিশীলতা থাকতে হবে এবং সেই প্রবাহ থেকে বিভাজিত হয়ে আর একটা ধারা সৃষ্টি করার সক্ষমতা থাকতে হবে। সেই ধারার মধ্যে কী কী উপাদান পরিবাহিত হচ্ছে তার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। এতকিছু করতে হবে কিন্তু আধুনিক একটা কোষের পরিণত প্রোটিন ব্যবহার না করেই।

কোষের জন্ম
Somehow cells formed (Credit: Christian Jegou/Publiphoto Diffusion/Science Photo Library)

এরপরে ১৯৯৪ সালে লুইজি এক সাহসী প্রস্তাবনা রাখলেন। তিনি বলেন প্রাথমিক পর্যায়ের কোষে অবশ্যই আরএনএ থাকতে হবে। তিনি আরও দাবী করেন এই আরএনএ অবশ্যই নিজের আর একটা প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে সম্ভব। লুইজির প্রস্তাবনা বিজ্ঞানের নতুন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিলো। তার মানে হল, প্রাণ বিকাশের প্রথম প্রস্তাবনায় আমরা আসলে প্রাণের সৃষ্টি রহস্য গবেষণার বিভিন্ন তত্ত্বের মিলন মেলায় মিলিত হয়েছি এবং দীর্ঘ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছি। লুইজির প্রস্তাবিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি আমলে নিলে, প্রাণ বিকাশের প্রথম প্রস্তাবনা কম্পার্টমেন্টালাইজেশন তত্ত্ব বা কোষের বিভাজন তত্ত্বকে বাতিল করে দিতে হয়। কিন্তু লুইজির কাছেও উপযুক্ত কারণ ছিল।

ভিতরে জীন বিহীন চারপাশে আবৃত কোষ খুব বেশী কিছু করতে পারে না। হয়ত কোষ বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ সৃষ্টি করতে পারে কিন্তু তারা নিজের বংশগতির কোন তথ্য, উপাত্ত পরবর্তী কোষের মাঝে সঞ্চার করতে পারবে না। কোষ কেবল তখনি বিবর্তিত হতে শুরু করবে এবং ক্রমাগত জটিলতর হয়ে উঠতে পারবে যদি কোষের অভ্যন্তরে জীন থাকে।

এই তত্ত্ব খুব দ্রুত জ্যাক সোসটাকের সমর্থকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। আমরা ইতিমধ্যে তৃতীয় অধ্যায়ে সোসটাকের আরএনএ নিয়ে গবেষণা আলোচনা তুলে ধরেছি। যখন লুইজি ছিলেন কম্পার্টমেন্টালাইজেশন তত্ত্বের প্রথম দিকের সমর্থক ঠিক তখন সোসটাক সমর্থন করতেন জীনতত্ত্বকে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন কোন মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত ছিল না। আমরা প্রাণের সৃষ্টি রহস্য গবেষণার বিভিন্ন তত্ত্বের মিলন মেলায় মিলিত হয়েছি এবং দীর্ঘ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছি এবং সোসটাকের গবেষণার সূত্র ধরে নির্ধারণ করছে চাচ্ছি কোনটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ। মোটের উপর আমরা বুঝতে পারলাম দুই গবেষণাতেই কোষের উপস্থিতি আছে। আমরা একটা সম্মতিতে এলাম যে প্রাণের উৎস সন্ধানে কম্পার্টমেন্টালাইজেশন বা বিভাজন তত্ত্ব এবং জীনতত্ত্ব উভয় গবেষণাতেই কোষ খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।

কোষের জন্ম
Almost all life is single-celled (Credit: Science Photo Library/Alamy)

সোসটাকের তত্ত্ব প্রাণের উৎস গবেষণার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী এবং সোসটাক অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন তার গবেষণা তত্ত্বে অর্থ বিনিয়োগ করবেন যেখানে তার আগ্রহ। কারণ হিসেবে বললেন, “এমন একটা তত্ত্বের সমর্থনে তত্ত্বকে গবেষণার বাইরে রাখতে পারি না।” তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন প্রাথমিক কোষ দিয়ে গবেষণা শুরু করবেন।

দুই বছর পরে সোসটাক এবং তার দুইজন সহকর্মী ২০০১ সালে বড় ধরণের সাফল্যের সুসংবাদ দিলেন। বিজ্ঞান বিষয়ক বিখ্যাত ‘নেচার’ জার্নালে তারা যুক্তি দেখিয়ে লিখলেন প্রকৃতিতে প্রাপ্ত আপাত বিচ্ছিন্ন উপাদান থেকে সহজেই প্রাথমিক কোষ সৃষ্টি করা সম্ভব। চর্বিযুক্ত তেলতেলে বস্তুর সংস্পর্শে আরএনএ নিজের নিজের প্রতিলিপি জন্ম দিতে পারে।

কোষের জন্ম
Vesicles are simple containers made of lipids (Credit: Alfred Pasieka/Science Photo Library)

সোসটাক এবং তার গবেষক-দল কোষের ভেসিকল (কোষের তরল পূর্ণধারক) নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ভেসিকল দেখতে অনেকটা সর্পিল ঘন তরলের আকার যার গভীরে এবং বাইরের আবরণে দুইটা ফ্যাটি এসিডের স্তর আছে। ভেসিকলের উৎপাদন ত্বরান্বিত করার উপায় খুঁজতে গিয়ে সোসটাকের গবেষক-দল এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদার মত দেখতে থকথকে একটা বস্তুকে বিক্রিয়ার কাজে লাগিয়ে দিলেন এবং মনে করলেন এই নিরীক্ষা প্রাণ গবেষণার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে। এই যৌগের মিশ্রণ গবেষণা কাজে যোগ করার পরেই ভেসিকলের উৎপাদন ১০০ গুণ ত্বরান্বিত হয়ে গেল। কাদার মত বস্তুর পৃষ্ঠতল ভেসিকল উৎপাদনে অনুঘটকের কাজ করে যে কাজটা সচারচার এনজাইম করে থাকে।

তদুপরি, ভেসিকল এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদার কণা এবং কাদার পৃষ্ঠতল থেকে আরএনএ গ্রহণ করতে পারে। প্রথমদিকের এইসব কোষ এখন বহন করছে জীন এবং অনুঘটক আর এতকিছু ঘটে যাচ্ছে একটা সরল কাঠামোর মধ্যে। তবে প্রাণ গবেষণার এই পর্যায়ে এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদা প্রয়োগের সিদ্ধান্ত কিন্তু হঠাৎ করে নেয়া হয়নি। বিগত কয়েক দশক ধরে চলমান গবেষণার পরম্পরা গবেষকদলকে এই সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এবং তারা অনুমান করেছিলেন প্রাণ সৃষ্টিতে এই যৌগ হয়ত খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কোষের জন্ম
This lump of clay is mostly montmorillonite (Credit: Susan E. Degginger/Alamy)

এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ খুব সহজলভ্য। এখনকার সময়ে আমাদের ব্যবহার্য নিত্যদিনের জিনিসপত্রে এটা হরহামেশা ব্যবহৃত হয় এমনকি বিড়ালের বিছানা বানাতেও এটার ব্যবহার দেখা যায়। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় নির্গত ছাইয়ের ধুলো পৃথিবীর আবহাওয়াতে মিশে এই যৌগ সৃষ্টি হয়। যেহেতু পৃথিবীর শৈশবে অনেক আগ্নেয়গিরি ছিল সেহেতু এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ ছিল পরিমাণে বিপুল।

ফিরে যাই ১৯৮৬ সালে, তখন আমেরিকান রসায়নবিদ জেমস ফেরিস দেখালেন এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ আসলে অণুঘটক যা জৈব-কণা সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আরও পরে তিনি আবিষ্কার করেন এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ আরএনএ সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখে। এই দুইটি কাজের উপর ভিত্তি করে জেমস ফেরিস ধারণা করেন গড়পড়তা দেখতে কাদার মত এই যৌগটি আসলে প্রাণ সৃষ্টির উপাদান। জ্যাক সোসটাক ফেরিসের ধারণাকে গ্রহণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন এবং এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ ব্যবহার করে প্রথম কোষ সৃষ্টি করলেন। সোসটাক যুক্তি দেখালেন, আদি-কোষ যদি বেড়ে উঠতে পারে তাহলে সেটা বিভাজিতও হতে পারে। এক বছর পরে সোসটাকের গবেষক-দল প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, প্রথমদিকের কোষ নিজেদের মত করেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেড়ে উঠতে পারে। এমনকি আদি-কোষে আরএনএ সংরক্ষিত থাকে এবং সময়ের হাত ধরে কোষের দেয়ালের বাইরের পাশ অতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। মনে হয় যেন আদি-কোষ একটা ফুলে ওঠা পাকস্থলী এবং যেকোনো সময় সশব্দে ফেটে পড়বে। ফেটে পড়া রোধ করতে গিয়ে কোষ অধিকমাত্রায় ফ্যাটি এসিড গ্রহণ করে এবং তাদের সমন্বয়ে নিজের দেয়ালকে আরও মজবুত করে তোলে ফলে কোষ ফুলে আকারে আর একটু বড় হয় এবং ফেটে পড়ার আশংকা দূর হয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল আদি-কোষ যে কোষের আরএনএ কম তার থেকে ফ্যাটি এসিড গ্রহণ করছে ফলে সেই কোষগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ছে। তার মানে এ থেকে বোঝা যায় আদি-কোষ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল এবং যে কোষের আরএনএ বেশী স্বাভাবিকভাবে সে কোষ জিতে যায়। এই অনুসিদ্ধান্ত আমাদের মনে আরও বিস্ময় জাগায়। যদি আদি-কোষ বেড়ে ওঠতে পারে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের অনুরূপ কোষ সৃষ্টি করতে পারে তবে কি সোসটাকের গবেষণালব্ধ প্রাথমিক কোষ নিজের প্রতিলিপি বানাতে পারবে?

কোষের জন্ম
Cells reproduce by dividing into two (Credit: Science Photo Library/Alamy)


সোসটাকের প্রথম পরীক্ষায় দেখানো হয়েছে কীভাবে আদি-কোষ বিভাজিত হয়। আদি-কোষকে দুমড়ে মুচড়ে যদি ছোট ছিদ্র পথের সুড়ঙ্গে ঢুকিয়ে দেয়া যায় তাহলে সেখান থেকে আদি-কোষ ভেঙে ছড়িয়ে পড়বে। আদি-কোষ বেড়ে ওঠে, তাদের আকার পরিবর্তিত হয়, আয়তনে প্রসারিত হয় এবং তাদের শরীরে রশির মত লম্বা পাতলা প্রান্ত দেখা যায়।

এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া একেবারে নির্ভেজাল কারণ এখানে কোষের কোন যান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম জড়িত নাই। এখানে শুধু চাপ প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু এটা কোন সমাধান নয় কারণ নিজেই নিজের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় আদি-কোষ তার নিজস্ব কিছু উপাদান হারায়। এছাড়াও আদি-কোষ তখনই বিভাজিত হতে পারে যখন ছোট ছিদ্রপথে বল প্রয়োগে প্রবেশ করানো হয়।

ভেসিকলকে বিভাজিত করার বিভিন্ন উপায় আছে যেমন কোষকে পানির প্রবল স্রোত যুক্ত করতে পারলে কোষে নতুন শক্তির সৃষ্টি হয়। আদি-কোষের অভ্যন্তরীণ উপাদান বের হতে না দিয়ে কোষকে বিভাজন করার জন্য এই কৌশল অবলম্বন করা হয়।

অবশেষে ২০০৯ সালে জ্যাক সোসটাক এবং তার সহযোগী ছাত্র টিং ঝু একটা সমাধান বের করতে সক্ষম হন। তারা সামান্য একটু জটিল আদি-কোষ সৃষ্টি করলেন যার চতুর্দিকে একাধিক দেয়াল যেন অনেকটা পেয়াজের মত। সরল আদি-কোষের গঠনে জটিলতা থাকলেও সহজেই তাদেরকে সৃষ্টি করা সম্ভব। টিং ঝু যখন আদি-কোষের সাথে আরও বেশী ফ্যাটি এসিড যোগ করলেন তখন আদি-কোষের আকার পরিবর্তিত হয়ে গেল, সুতার মত দেখতে প্রান্তগুলো আরও লম্বা হয়ে গেল। আদি-কোষের আকার যথেষ্ট বড় হয়ে গেলে অল্প চাপে আদি-কোষ ভেঙে বেশকিছু ছোট ছোট আদি-কোষে রূপান্তরিত হল। পিতৃ-কোষের কোন আরএনএ কিন্তু হারিয়ে গেল না বরং প্রতিটি ক্ষুদ্র আদি-কোষ তার পিতৃ-কোষের আরএনএ বহন করতে লাগল। তাছাড়া, আদি-কোষ নতুন কোষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া পৌনঃপুনিক ভাবে চালিয়ে যেতে পারে। নতুন আদি-কোষ পরিপূর্ণ হয়ে গেলে নিজেই আবার নতুন কোষে বিভাজিত হতে শুরু করে।

পরবর্তী পরীক্ষায় ঝু এবং সোসটাক আদি-কোষ ভেঙে নতুন কোষ জন্ম দেয়ার ভিন্ন ভিন্ন উপায় খুঁজে বের করতে পেরেছিলেন। গবেষণার এই পর্যায়ে মনে হচ্ছিল অবশেষে সমস্যার বুঝি সমাধান পাওয়া গেল।

যাইহোক আদি-কোষ কিন্তু তখন যথেষ্ট কার্যকরী ছিল না। লুইজি ভেবেছিলেন, আদি-কোষ আরএনএ প্রতিলিপি সৃষ্টির ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করবে কিন্তু যতদূর বোঝা যায় আদি-কোষে আরএনএ শুধু অলস বসে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ করে না।

সত্যিকার অর্থেই যদি আদি-কোষ থেকে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের বিকাশ প্রমাণ করতে হয় তাহলে সোসটাকের দেখাতে হবে আরএনএ কীভাবে কোষের অভ্যন্তরে নিজেই নিজের প্রতিলিপি জন্ম দেয়। কিন্তু এই তথ্যকে তত্ত্ব হিসেবে প্রমাণ করে দেখানো এত সহজ নয় কারণ দশকব্যাপী পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর পরেও কোন বিজ্ঞানী আরএনএ উৎপাদন করে দেখাতে পারেন নি যা নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে। ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা বিশদ আলোচনা করে ফেলেছি। এই সমস্যার কারণেই প্রাণ বিকাশে আরএনএ তত্ত্ব ঘরানার গবেষণার কাজ প্রথমদিকে ব্যাহত হচ্ছিল এবং তখন পর্যন্ত কেউ এই সমস্যার সমাধান বের করতে পারেনি। সুতরাং সোসটাক লেসলি ওরগেলের গবেষণার ফলাফল ও লিখিত কাগজ পুনরায় পড়তে শুরু করেন। আমরা জানি লেসলি ওরগেল দীর্ঘদিন আরএনএ তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। পুরনো ধুলো পড়া কাগজের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল প্রাণের উৎস গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র।

কোষের জন্ম
So The first cells had to host the chemistry of life (Credit: Science Photo Library/Alamy)

ওরগেল ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আরএনএ’র সুতোর মত প্রান্তগুলো কীভাবে নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করে সেই গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ওরগেলের গবেষণার সারাংশ ছিল খুবই সহজ সরল এবং সাধারণ। আরএনএ’র সুতোর মত একপ্রান্ত থেকে আলগা নিউক্লিওটাইড তুলে নেয়া হল এবং তখন নিউক্লিওটাইড জড়ো করে আরএনএ’র প্রথম সুতোর মত অবিকল আর একটা প্রান্ত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ, ধরি আরএনএ’র একটা সুতোর মত প্রান্তে CGC লিখিত আছে এবং সেখানেই উৎপাদিত হয়েছে অনুরূপ আরেকটা সুতোর মত প্রান্ত যেটা পড়তে GCG এর মত মনে হয়। সম্ভবত কেউ যদি এই প্রক্রিয়া দুইবার করে তবে প্রকৃত CGC পাওয়া যাবে।

ওরগেল বুঝতে পারলেন যে, কোন অনুকূল পরিবেশে আরএনএ’র সুতোর মত প্রান্ত একই প্রক্রিয়ায় এনজাইমের সাহায্য ছাড়াই আরএনএ’র প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে। সম্ভবত এভাবেই প্রথম প্রাণ আরএনএ থেকে জীন সংগ্রহ করত। ১৯৮৭ সালে ওরগেল আবিষ্কার করলেন, আরএনএ’র ১৪ লম্বা নিউক্লিওটাইড সুতোর প্রান্ত অনুরূপ ১৪ নিউক্লিওটাইড লম্বা প্রান্ত সৃষ্টি করতে সক্ষম। তিনি এর থেকে বেশী লম্বা আরএনএ’র প্রান্ত বানাতে পারেন নি কিন্তু সোসটাকের চিন্তার সলতেই আগুন উস্কে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। সোসটাকের ছাত্রী ক্যাটারজিনা অ্যাডামালা আদি-কোষ সৃষ্টির জন্য পুনরায় প্রবৃত্ত হলেন। তারা যে আদি-কোষ সৃষ্টি করলেন সেগুলো আগের কোষের গায়ের বাইরের সংলগ্ন মলিকিউল থেকে জীন বহন করে।

তারা বুঝতে পারলেন, এই বিক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য ম্যাগনেসিয়াম প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা এখানেই যে, ম্যাগনেসিয়ামের উপস্থিতি আদি-কোষকে ধ্বংস করে। সব সমস্যারই সমাধান আছে এবং এই সমস্যার সমাধানে ব্যবহার করা হল সাইট্রিক এসিড। লেবু, কমলা জাতীয় ফলে প্রচুর সাইট্রিক এসিড পাওয়া যায় এবং প্রতিটি জীবন্ত কোষে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সাইট্রিক এসিডের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটা গবেষণায় গবেষক-দল উল্লেখ করেন তারা বিক্রিয়ার সময় সাইট্রেট যুক্ত করে দেন ফলে বিক্রিয়াতে অংশগ্রহণ থেকে ম্যাগনেসিয়ামকে বিরত রাখা সম্ভব হয়। এতে আদি-কোষ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং কোষের প্রতিলিপি সৃষ্টির প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে চলতে থাকে। সরলভাবে বলতে গেলে গবেষক-দল ১৯৯৪ সালে ইটালিয়ান বিজ্ঞানী পিয়ের লুইগি লুইজির প্রস্তাবিত তত্ত্বকে বাস্তবায়ন করলেন। জ্যাক সোসটাক বলেন, “আমরা কোষের ফ্যাটি এসিডে ভেসিকলের অভ্যন্তরে আরএনএ’র অবিকল প্রতিলিপি সৃষ্টির রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু করলাম।”

কোষের জন্ম
Szostak’s protocells can survive extreme heat (Credit: Jon Sullivan, PDPhoto.org)

মাত্র এক দশকের বেশী কিছু সময়ের গবেষণায় জ্যাক সোসটাকের গবেষক-দল প্রাণের উৎস সন্ধানে যুগান্তকারী অর্জন সম্পন্ন করে ফেললেন। তারা আদি-কোষ বানাতে সক্ষম হলেন যারা পূর্বের কোষের জীন বহন করে এবং কোষের বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় মলিকিউল সংগ্রহ করতে পারে। এই আদি-কোষ নিজেরাই নিজেদের বৃদ্ধি এবং বিভাজন করতে পারে এমনকি নিজেদের মাঝে প্রতিযোগিতা পর্যন্ত করতে পারে। আর কোষের অভ্যন্তরে চলতে থাকে আরএনএ’র অবিকল প্রতিলিপি সৃষ্টির অবিরাম কর্মযজ্ঞ। যেকোনো বিচারেই এই প্রক্রিয়া নতুন জীবন সৃষ্টির সূচনা বলা যেতে পারে।

এতকিছু স্বত্বেও সোসটাকের গবেষণার ফলাফল প্রায় ৪০ বছর ধরে চলমান প্রাণের উৎস গবেষণার বিপরীতে চলে গেল। কোষের নিজেই নিজেকে জন্ম দিয়েছিল প্রথমে এই মতবাদকে প্রাধান্য না দিয়ে অথবা কোষের বিভাজন প্রক্রিয়াকে অধিক গুরুত্ব না দিয়ে সোসটাক এই দুই মতবাদের সমন্বয় সাধন করে বলতে চেয়েছিলেন এই দুই প্রক্রিয়া সমান-তালে একসাথে চলছিল। কিন্তু সোসটাকের গবেষক-দল যেকোনো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে প্রস্তুত। ২০০৮ সালে সোসটাকের গবেষক-দল বুঝতে জানতে পারলেন, আদি-কোষ প্রায় ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও দিব্যি টিকে থাকতে পারে অথচ এই পরিমাণ উচ্চ তাপমাত্রায় বর্তমান সময়ের পরিণত বেশীরভাগ কোষেরই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা। ফলে সোসটাকের ধারণা আরও জোরালো হয় যে আদি-কোষের সাথে প্রথম প্রাণের যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। এর থেকে আরও প্রমাণিত হয় অবিরাম চলতে থাকা উল্কা পতনের প্রভাবে সৃষ্ট গরমেও আদি-কোষ বহাল তবিয়তে টিকে ছিল।

জার্মানির ওসনাব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শিক্ষক আরমেন মালকিদজানিয়ান সোসটাকের গবেষণাকে অতুলনীয় হিসেবে অভিহিত করেন। সোসটাকে তত্ত্বাবধানে ইতিপূর্বে বর্ণিত দুই মতবাদের সমন্বয় করার প্রচেষ্টা প্রাণের উৎস গবেষণায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয় যার কারণে শুরু হয় প্রাণ কীভাবে কাজ করে তার আলোচনা। এই “সবকিছু প্রথমে” ধারণা ইতিমধ্যে জোগাড় করে ফেলেছে তথ্য প্রমাণের আকরিক সম্পদ এবং প্রাণের উৎস গবেষণার চলমান বিতর্কের সম্ভাব্য সমাধান।

কোষের জন্ম
The molecules of life behave in incredibly complex ways (Credit: Equinox Graphics Ltd)

Posted at January 04, 2019 |  by Arya ঋষি

Tags

Text Widget

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipisicing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation test link ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat.

Blog Archive

© 2013 Arya Rishi. WP Theme-junkie converted by Bloggertheme9Published..Blogger Templates
Blogger templates. Proudly Powered by Blogger.
back to top