কোরানের কোন আয়াতেই মুরতাদের দুনিয়ার শাস্তির বিধান নাই । কোরআন বলে এই শাস্তি শুদুমাত্র পরকালেই হবে । (ফতোয়া কাউন্সিলের ওয়েবসাইট)
information about theology and science
প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন দিগন্ত সরকার।
প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন দিগন্ত সরকার।
১৯৬০ সালের পরে বিজ্ঞানীগণ প্রাণের উৎস অনুসন্ধানে তিনটি মতবাদে বিভক্ত হয়ে গেলেন। কারো ধারণা জীবন শুরু হয়েছিল প্রাথমিক পর্যায়ের জৈবিক কোষ গঠনের মাধ্যমে। অন্য একদল বিজ্ঞানী মনে করেন জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল রাসায়নিক বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কিন্তু আরেক দল বিজ্ঞানী বংশগতি এবং আপন কোষের প্রতিলিপি সৃষ্টির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শেষ দলের বিজ্ঞানীগণ, যে কোষটি নিজেই নিজের অনুরূপ সৃষ্টি করতে পারে তাদের স্বরূপ কেমন ছিল সেটা অন্বেষণের চেষ্টা করেন। এই বিজ্ঞানীগণ প্রথম থেকেই জোর দিয়ে প্রচার করেন জীব-কোষ আরএনএ দিয়ে তৈরি।
১৯৬০ দশকের বিজ্ঞানীগণের চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ ছিল যে আরএনএ হল সকল প্রাণের উৎস। বিশেষত আরএনএ এমনকিছু করতে পারে যেটা ডিএনএ করতে পারে না। আরএনএ হল একটা নমনীয় সুতো সদৃশ মলিকিউল। অন্যদিকে ডিএনএ হল দুইটা সুতো যারা নিজেরা পেঁচিয়ে স্তরে স্তরে বিভিন্ন আকারে সাজানো থাকে। আপনি এনজাইম ছাড়া বাঁচতে পারবেন না। আরএনএ এর ভিতরে কাগজের মত ভাজ করা একটা বস্তু দেখা গেল যেটা প্রোটিনের মত আচরণ করে। প্রোটিন দেখতে সাধারণত অনেকটা লম্বা সুতোর মত। প্রোটিন নিউক্লিওটাইড নয় বরং অ্যামাইনো এসিড দিয়ে তৈরি এবং তারা বিশদ জটিল অবয়ব সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আরএনএ হল প্রোটিন উৎপাদনের সবচেয়ে আশ্চর্য দক্ষতা। কিছু আরএনএ রাসায়নিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে অনুঘটকের কাজ করে। এই সমস্ত প্রোটিনকেই এনজাইম বলে।
আপনার মেরুদণ্ডের হাড়ের মজ্জায় বিপুল পরিমাণ এনজাইম বিদ্যমান। এনজাইম খাদ্যের জটিল মলিকিউলকে ভেঙে শর্করা বা চিনিজাতীয় সাধারণ সরল খাদ্য উপাদানে পরিণত করে যাতে প্রাণীর দেহকোষ সহজে গ্রহণ করতে পারে।
লেজলি ওরগেল এবং ফ্রান্সিস ক্রিক’র মনে হচ্ছিল যদি আরএনএ প্রোটিনের মত ভাজে ভাজে থাকে তাহলে আরএনএ এর মধ্যে জীবন্ত মলিকিউল থাকার সম্ভাবনা আছে এবং সেখানে তথ্যগুলো ডিএনএ আকারে সংরক্ষিত থাকে আর কিছু প্রোটিন রাসায়নিক বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। লেজলি ওরগেল এবং ফ্রান্সিস ক্রিক’র সন্দেহ ছিল নিছক ধারণা কিন্তু দশক ধরে সেই ধারণার কোন সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।
টমাস রবার্ট চেক জন্মগ্রহণ করেন আমেরিকার আইওয়া শহরে এবং সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। শিশুকাল থেকেই চেক পাথর এবং খনিজ উপাদানের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ অনুভব করেন। তিনি যখন নিম্ন মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র তখনই সে স্থানীয় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের গবেষণাগারের দরজায় উঁকি দিয়ে শিক্ষকদের কাছে খনিজ উপাদানের গঠন প্রণালী দেখতে চেয়েছিলেন। টমাস রবার্ট চেক জৈব রসায়নবিদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন এবং তার আগ্রহের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল আরএনএ। এখন দেখা যাচ্ছে জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল আরএনএ দিয়ে এবং এতদিনের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর প্রায় দ্বারপ্রান্তে।
১৯৮০ সালের শুরুর দিকে টমাস রবার্ট চেক এবং তার কিছু সহকর্মী কোলারাডো বোলডার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে এককোষী প্রাণ ‘Tetrahymena thermophila’ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এককোষী প্রাণের অনুষঙ্গের সুতা সদৃশ বস্তুটি আরএনএ দিয়ে গঠিত। চেক আবিষ্কার করলেন আরএনএ’র একটা বিশেষ অংশ কখনো কখনো মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে যেন তাকে কাঁচি দিয়ে কেটে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। চেকের গবেষকদল যখন সব এনজাইমকে পৃথক করে ফেললেন তখন অন্যান্য মলিকিউল কাঁচির মত কাটাকুটির কাজ করছিল। এই কাজটি চালিয়ে নিচ্ছিল আরএনএ। তারা খুঁজে পেলেন প্রথম আরএনএ এনজাইম। আরএনএ’র ক্ষুদ্র অংশ যারা নিজেদেরকে বৃহৎ অংশ থেকে দ্বিখণ্ডিত করতে সক্ষম।
চেক তার গবেষণামূলক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করলেন ১৯৮২ সালে। পরের বছর অন্য একটি বিজ্ঞানীদল রাইবোজম নামের দ্বিতীয় আরেকটি আরএনএ এনজাইমের সন্ধান পেলেন। দুইটি আরএনএ পাওয়ার সফলতার দ্রুত ইঙ্গিত দিলো সেখানে আরও অনেক কিছুর অস্তিত্ব আছে। এই আবিষ্কারের ফলে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল জীবন সৃষ্টি হয়েছিল আরএনএ থেকে।
ম্যাসাচুচেটস প্রদেশের কেমব্রিজের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওয়াল্টার গিলবার্ট প্রথম মানুষের বংশগতি ধারণার গোড়াপত্তন করেন। পদার্থবিজ্ঞানী হলেও গিলবার্ট মলিকিউলার বায়োলজিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মানুষের জীনের ক্রমবিবর্তনের ধারা প্রমাণ করতে তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা। বিচ্ছিন্ন বস্তুকণা থেকে আরএনএ জগতে উত্তরণ হল প্রাণের বিকাশে রাজকীয় যাত্রার শুরু। ১৯৮৬ সালে ‘নেচার’ বিজ্ঞান সাময়িকীতে গিলবার্ট প্রস্তাব করেন প্রাণের উৎপত্তি হয়ে আরএনএ’র হাত ধরে।
গিলবার্ট যুক্তি দেখান বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে নিউক্লিওটাইড ঘনতরল থেকে বস্তুকণা থেকে নিজেই নিজের প্রাণ সৃষ্টির কাজকে ত্বরান্বিত করে আরএনএ মলিকিউল। আরএনএ সম্মিলিতভাবে দ্বিভাজিত হয় এবং নিজের স্বরূপ সৃষ্টি করে। আরএনএ মলিকিউল ক্রমান্বয়ে অনেক প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার জন্ম দিল। আরএনএ খুঁজে পেল প্রোটিন এবং প্রোটিন এনজাইম সৃষ্টির উপায় এবং প্রমাণিত হল তাদের গুরুত্ব এবং তারা যাত্রা শুরু করলো জীবনের পথে যে জীবন আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রাণের বিকাশ প্রথমদিকের নিউক্লিওটাইড আদিম ঘনতরল স্যুপ থেকে একাধিক জৈবরাসায়নিক অণুজীবের গঠনের উপর যুগপৎ নির্ভর করেনি বরং একটা বিশেষ অণুজীব প্রাণ সৃষ্টির সর্বকাজের কাজি। ২০০০ সালে আরএনএ তত্ত্বের সমর্থনে এক নাটকীয় প্রমাণ পাওয়া গেল।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবরসায়নের অধ্যাপক টমাস আর্থার স্টিৎজ সুদীর্ঘ ৩০ বছর ধরে জীবন্ত কোষে অণুজীবের গঠন নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। ১৯৯০ সালে তিনি রাইবোজোমের গঠনপ্রণালী খুঁজে দেখার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলেন। প্রকৃত ঘটনা হলো প্রাণের প্রয়োজনীয় ক্রিয়াকর্ম আরএনএ নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এবং আরএনএ কেন্দ্রিক প্রাণের বিকাশ বেশি গ্রহণযোগ্য।
প্রতিটি জীবন্ত কোষে রাইবোজোম আছে। রাইবোজোম আরএনএ থেকে সংকেত গ্রহণ করতে পারে এবং আরএনএ’র অভ্যন্তরীণ সুতোর-মত জালিকা অ্যামাইনো এসিড একত্রিত করে প্রোটিন সৃষ্টি করতে পারে। প্রাণীদেহের বেশিরভাগ কোষ রাইবোজোম দ্বারা গঠিত। রাইবোজোম কোষের আরএনএ বহনকারী হিসেবে পরিচিত। ২০০০ সালে অধ্যাপক স্টিৎজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল রাইবোজোমের গঠনের বিশদ চিত্র খুঁজে পেলেন এবং আবিষ্কার করলেন রাইবোজোমের অন্তঃস্থলে অনুঘটকের কাজ করছে আরএনএ।
ভাবতেই কেমন জটিল লাগছে, তাই না? কারণ রাইবোজোম হলো জীবনের ভিত্তিমূল এবং একই সাথে প্রাচীন। যেসব বিজ্ঞানীগণ সমর্থন করতেন প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএন থেকে তাদের আনন্দের আর সীমা নাই। এই অসামান্য আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালে অধ্যাপক টমাস আর্থার স্টিৎজ রসায়নে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। কিন্তু সমস্যা ঘটে যায় অন্যত্র। এই আবিষ্কারের ফলে প্রাণ সৃষ্টির রহস্য আবার পিছনের দিকের সেই তিনটি ধারণার মধ্যে সন্দেহ ঘনীভূত হলো। আসলেই কী দিয়ে প্রাণ সৃষ্টি, কীভাবে সৃষ্টি? আরএনএ থেকে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল এই মতবাদের শুরুতেই দুইটা সমস্যা বিদ্যমান ছিল। আরএনএ কী প্রকৃতপক্ষে নিজে নিজেই প্রাণের সবধরনের ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম? পৃথিবীর প্রথম-যুগে কী প্রথমেই আরএনএ সৃষ্টি হয়েছিল?
বিজ্ঞানীগণ তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে গবেষণাগারে নিজেই নিজের সৃষ্টিকর্তা আরএনএ সৃষ্টির কাজ শুরু করলেন। ৩০ বছরের দীর্ঘ গবেষণার পরেও গিলবার্ট প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ দিয়ে এই মতবাদের সমর্থনে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারলেন না। গিলবার্ট পেলেন অণুজীব কিন্তু সেটা প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল। যদি প্রাণ সৃষ্টি হয় আরএনএ অণুজীব দিয়ে তাহলে আরএনএ অবশ্যই নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারবে। আরএনএ’কে হতে হবে স্বয়ম্ভূ।
কিন্তু আরএনএ নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে না। ডিএনএ’র দ্বারাও একাজ সম্ভব নয়। আরএনএ বা ডিএনএ যাকিছুই বলি না কেন নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে হলে তাদের দরকার বিপুল পরিমাণ এনজাইম এবং অন্যান্য অণুজীব। ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে কিছু জীববিজ্ঞানী প্রাণ বিকাশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কিছু অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের সমাধান করতে গবেষণা শুরু করেন। তাদের মতবাদের সমর্থনে তারা নেমে পড়লেন নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এমন আরএনএ’র সন্ধানে।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের জীনতত্ত্বের প্রফেসর জ্যাক ইউলিয়াম সোসটাক প্রাণের উৎস সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। শিশুকাল থেকেই তিনি রসায়নের প্রতি এত মুগ্ধ ছিলেন যে তার বাড়ির বেইজমেন্টে তার নিজস্ব একটা গবেষণাগার ছিল। তার নিজের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লেও তিনি একবার রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটান। ফলাফলে যা ঘটেছিল তা ছিল বিস্ময়কর। বিস্ফোরণের ফলে একটা গ্লাসের টিউব তীব্র-বেগে ছুটে গিয়ে ছাদের দেয়ালে গেঁথে গিয়েছিল।
১৯৮০ দশকের শুরুতে সোসটাক প্রমাণ করে দেখাতে সক্ষম হন কীভাবে জীন বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। তার এই গবেষণার ফলাফল তার জন্য নোবেল পুরষ্কার এনে দিয়েছিল। তিনি দেখান আরএনএ এনজাইম কতটা শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু তিনি অতি দ্রুতই টমাস রবার্ট চেক’র আরএনএ এনজাইমের গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। সোসটাক বলেন, “আমি মনে করেছিলাম এনজাইম নিয়ে গবেষণা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। মোটের উপর সম্ভবত আরএনএ নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে।”
১৯৮৮ সালে চেক এক বিশেষ ধরণের আরএনএ ইনজাইমের সন্ধান পেলেন যারা ক্ষুদ্র আরএনএ মলিকিউল বানাতে পারে এবং এই আরএনএ ১০ নিউক্লিওটাইডের সমান দীর্ঘ। সোসটাক গবেষণাগারে নতুন ধরণের আরএনএ ইনজাইম সৃষ্টি করে তার আবিষ্কারকে সমৃদ্ধ করতে গবেষণা শুরু করলেন। সোসটাকের গবেষকদল বিপুল পরিমাণ গবেষণার ফলাফল দৈব-চয়ন পদ্ধতিতে আবার পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন কোন ধরণের এনজাইম অনুঘটকের কাজ করে। সেই পরীক্ষাগুলো থেকে আবার পরীক্ষা করলেন। একই পদ্ধতিতে ১০ বার পরীক্ষার পর সোসটাক এমন এক আরএনএ এনজাইম সৃষ্টি করলেন যার বিক্রিয়ার অনুঘটক ক্ষমতা সাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশের তুলনায় ৭০লক্ষ গুণ বেশি গতিশীল। তারা দেখালেন আরএনএ এনজাইম প্রকৃত অর্থেই প্রভূত শক্তিশালী কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদের আরেকটি অনুরূপ সৃষ্টি করতে পারে না। এমনকি অনুরূপ সৃষ্টির ধারে কাছেও যায় না। সোসটাক যেন অসম্ভবের দেয়ালে আঘাত করলেন।
তারপরে সবচেয়ে বড় সাফল্য এলো ২০০১ সালে অধ্যাপক সোসটাক’র সাবেক শিক্ষার্থী কেমব্রিজের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির জীব বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড বারটেল’র হাত ধরে। বারটেল আর১৮ নামে আরএনএ এনজাইম সৃষ্টি করলেন যা বিদ্যমান আরএনএ জালের সাথে নতুন নিউক্লিওটাইড যোগ করতে পারে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে এই সাফল্য শুধু আরএনএ’র সাথে যথেচ্ছ নিউক্লিওটাইড সংযুক্তিই নয় বরং পূর্বের পরীক্ষার ফলাফলের যথাযথ প্রতিফলন।
এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের যা কিছু অর্জন তার কিছুই নিজেই নিজের অবিকল কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু অগ্রগতি প্রায় উদ্দেশ্যের কাছাকাছি চলে এসেছে। আর১৮ ১৮৯টি নিউক্লিওটাইড সুতোর জাল দিয়ে গঠিত এবং এটা নির্ভরযোগ্য-ভাবে আরও ১১টি নিউক্লিওটাইড আগের আরএনএ সুতোর জালের সাথে যুক্ত করতে পারে যা নিজের দৈর্ঘ্যের প্রায় ৬ শতাংশ। নতুন গবেষণা আশা জাগালো জালের কিছু সুতোর প্রান্ত ১৮৯টি নিউক্লিওটাইডের সমান দীর্ঘ। তবে এটা নিশ্চিত হওয়া গেল প্রাণের সৃষ্টি আরএনএ থেকে সূত্রপাত হয়নি।
২০১১ সালে কেমব্রিজের মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগে গবেষণাগারে সবচেয়ে সফল পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন ফিলিপ হোলিগার। তার গবেষকদল আর১৮ আরএনএ’র উন্নতি সাধন করেন তার নাম দিলেন টিসি১৯জেড। এই নতুন আরএনএ যেটা নিজেদের ফলাফলের নিউক্লিওটাইড ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিলিপি করতে পারে। তাদের ৪৮ শতাংশ নিজেদের দৈর্ঘ্য যা আর১৮ আরএনএ থেকেও বড় কিন্তু ১০০ শতাংশ সেখানে অত্যাবশ্যকীয় নয়। ক্যালিফোর্নিয়াতে লা জোলা’তে অবস্থিত ‘স্ক্রিপস রিসার্চ ইন্সটিটিউটে’ বিকল্প আর একটা গবেষণা তখন চলছিল জেরাল্ড ফ্রান্সিস জয়েস এবং ট্রেসি লিংকন’র নেতৃত্বে। ২০০৯ সালে তারা আর একধরণের এনজাইমের সন্ধান পেলেন যারা নিজেদের অগোচরেই নিজেদেরকে অবিকল প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। নতুন সৃষ্ট এনজাইম দুইটা ক্ষুদ্র আরএনএ’র সাথে যুক্ত হয়ে দ্বিতীয় আরেকটা এনজাইমের জন্ম দেয়। এই এনজাইম আর দুইটা আরএনএ’র সাথে যুক্ত হয়ে আবার নতুন এনজাইম সৃষ্টি করে। প্রয়োজনীয় উপাদান এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এনজাইম সৃষ্টির এই সরল চক্র অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতেই থাকে। কিন্তু এনজাইম শুধু তখনই সফলভাবে কাজ করতে পারে যখন তাদেরকে সঠিক আরএনএ সূত্র দেয়া হয়। ঠিক এই পরীক্ষাটাই জেরাল্ড ফ্রান্সিস জয়েস এবং ট্রেসি লিংকন গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করেন।
অনেক বিজ্ঞানী প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে এমন তত্ত্বে সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন কারণ আরএনএ নিজেই নিজের আর একটা অবিকল প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে না এবং এটাই এই তত্ত্বের প্রধান দুর্বলতা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আরএনএ থেকে জীবনের সূচনা হয়নি। সম্ভবত নবগঠিত পৃথিবীতে অন্যকোন ধরণের জৈব-কণার উপস্থিতি ছিল সেখান থেকেই প্রাণের সৃষ্টি। প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে যখন রসায়নবিজ্ঞানগণ পারস্পারিক সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন কোন বস্তু থেকে আরএনএ উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়। ডিএনএ’র তুলনায় অণুজীবকে মনে হল অনেক সাধারণ কিন্তু আরএনএ সৃষ্টি করা ভীষণ কঠিন এবং শ্রমসাধ্য কাজ। সমস্যা দেখা দিলো কোষের শর্করা উৎপাদন করতে গিয়ে এবং যার উপর ভিত্তি করে নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি হয় সেখানে বিস্তর ঝামেলা। কোষের এই দুইটা অপরিহার্য উপাদান আলাদা আলাদা উৎপাদন করা সম্ভব কিন্তু এই দুইটা উপাদানের মাঝে কোনভাবেই সংযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই সমস্যা ১৯৯০ দশকের শুরুতেই পরিষ্কার জানা গিয়েছিল সুতরাং অনেক বিজ্ঞানীই নাকসিটকিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে এই তত্ত্ব শুধুই নিরেট ধারণা মাত্র, বাস্তবের সাথে লেশমাত্র সম্পর্ক নাই। তত্ত্বটা মোটেও সঠিক নয়।
সম্ভবত নবগঠিত পৃথিবীতে অন্যকোন ধরণের জৈব-কণার উপস্থিতি ছিল যারা আরএনএ থেকে সরল এবং যারা পৃথিবীর আদিম জৈব-কণা ভর্তি ঘন তরল থেকে নিজেদেরকে সংগঠিত করতে পারে এবং নিজেদের অবিকল প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে শুরু করে এবং আরএনএ, ডিএনএ এবং অন্যান্য উপাদান সৃষ্টির দিকে ধাবিত করে।
ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পিটার নিলসেন ১৯৯১ সালে দাবী করলেন জীবনের সূচনা সেই আদিম পুকুরের ঘন তরল থেকে। যেখানে অণুজীব নিজের প্রতিলিপি নিজেই সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এটা ছিল বিস্তর বিবর্তিত ডিএনএ। পিটার নিলসেন পূর্বের বিজ্ঞানীদের গবেষণার উপর ভিত্তি করেই এগিয়ে গেলেন নতুন উদ্যমে এবং স্থির থাকলেন ডিএনএ’র মধ্যে প্রাপ্ত এ, টি, সি এবং জি এনজাইমে। নিলসেন অণুজীব গবেষণার মূল ভিত্তি গড়ে দিলেন এবং ডিএনএ’র ভিতরে শর্করার পরিবর্তে পলিএমাইডস অ্যামাইনো এসিডের সন্ধান পেলেন। তিনি নতুন প্রাপ্ত অণুজীবের নাম দিলেন পলিএমাইডস নিউক্লিক এসিড সংক্ষেপে পিএনএ। যদিও বিভ্রান্তিকরভাবে আমরা এখনো পিএনএ’কে জানি পেপটাইড নিউক্লিক এসিড নামে। আরএনএ’র পিএনএ গঠন এত দুঃসাধ্য নয়, সম্ভবত পৃথিবীর আদিম অবস্থায় পিএনএ গঠিত হয়েছিল।
পিএনএ প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, একে সৃষ্টি করতে হয় এবং আচরণ অনেকাংশে ডিএনএ’র মত। পিএনএ’র সুতার মতো একটা প্রান্ত ডিএনএ’র একটা প্রান্ত দখল করে নিতে পারে। অণুজীবের এই মিলে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তদুপরি পিএনএ, ডিএনএ’র মত দুইটা প্রান্ত পেঁচিয়ে মইয়ের আকার ধারণ করতে পারে। স্ট্যানলি মিলার এখানেই আমাদেরকে মুগ্ধ করে এবং প্রাণ সৃষ্টির রহস্য জগতে কৌতূহলী করে তোলে। তিনি প্রাণের বিকাশ হয়ে আরএনএ থেকে এই তত্ত্বের ঘোরতর অবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন প্রথম প্রাণের উপাদান সৃষ্টিতে পিএনএ বরং অনেক বেশী বিশ্বাসযোগ্য এবং যুক্তিপূর্ণ দাবীদার।
২০০০ সালে স্ট্যানলি মিলার আরও শক্তিশালী প্রমাণ উপস্থাপন করলেন। ইতিমধ্যে তিনি ৭০ বছরের অভিজ্ঞতায় পৌঁছে গেছেন। কিন্তু বিধি বাম, সেই সময়ে তিনি পরপর কয়েকটি ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন ফলে তাকে গবেষণা ছেড়ে নার্সিং হোমে চলে যেতে হয়। তার কাজ আর সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। মিলার তার সেই ক্লাসিকাল ‘স্ট্যানলি মিলার-হ্যারল্ড উরে পরীক্ষা’ পুনরায় করে দেখেন যে পরীক্ষার কথা আমরা ইতিমধ্যেই প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। এবারের পরীক্ষায় মিলার মিথেন, নাইট্রোজেন, অ্যামোনিয়া, পানির সাথে পিএনএ যুক্ত করে দিলেন।
অন্যান্য রসায়নবিদগণ প্রাণ গবেষণায় এগিয়ে এলেন তাদের নিজস্ব বিকল্প নিউক্লিক এসিড এবং তাদের তত্ত্ব ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান নিয়ে। প্রতিটি বিকল্প নিউক্লিক এসিড ব্যবহারের পিছনে ভিন্ন ভিন্ন সমর্থক বিজ্ঞানীদলের বিশেষ করে যারা এই এসিডের উদ্ভাবন করেছেন তাদের পৃথক যুক্তি আছে। ২০০০ সালে আলবার্ট ইসেনমসার কৃত্রিম জেনেটিক পলিমার ‘থ্রেওস নিউক্লিক এসিড’ উদ্ভাবন করেন। থ্রেওস নিউক্লিক এসিড বা টিএনএ মূলত ডিএনএ কিন্তু এর রাইবোজোমে ভিন্ন ধরণের শর্করা আছে। টিএনএ রাইবোজোমের সুতোর প্রান্ত দুইটা দ্বিমুখী কুণ্ডলী বানাতে পারে এবং আরএনএ এবং টিএনএ’র মাঝে পূর্বাপর তথ্যের অবিকল প্রতিলিপি আদান প্রদান করতে পারে। এছাড়াও টিএনএ জটিলতর ভাজে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারে এবং প্রোটিন সংরক্ষণ করতে পারে। এথেকেই বোঝা যায় টিএনএ আরএনএ’র মতই এনজাইমের কাজ করতে পারে। একইভাবে ২০০৫ সালে এরিক মেগারস গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে গ্লাইকল নিউক্লিক এসিড উৎপাদন করলেন যেগুলো প্যাঁচানো কাঠামো তৈরি করতে পারে। এতক্ষণ যতগুলো নিউক্লিক এসিড নিয়ে আলোচনা হয়েছে তাদের কোনটিই প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, সৃষ্টি হয়েছে গবেষণাগারে। সুতরাং যদি প্রথম প্রাণ এইসব নিউক্লিক এসিডের মধ্য থেকে কোন একটিকে ব্যবহার করে থাকে তাহলে বলতেই হবে এতদিনের চলমান বিতর্ক চলে যাবে আরএনএ এবং ডিএনএ’র পক্ষে অর্থাৎ প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল আরএনএ এবং ডিএনএ দিয়ে। এই মতবাদ হয়ত সত্য, কিন্তু বিজ্ঞানীদের হাতে এই দাবীর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই।
আর এইসব কিছুর অর্থ দাঁড়ালো, ২০০০ শতকের মাঝামাঝি উপনীত হয়ে আরএনএ মতবাদের বিজ্ঞানীগণ প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। আরএনএ মতবাদের বিজ্ঞানীগণের চিন্তা, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ খুব যৌক্তিক এবং গোছানো পরিপাটি কিন্তু প্রাণের উৎস সম্পর্কে পুরোপুরি সত্যের কাছে পৌঁছাতে পারেননি।
অন্যদিকে আরএনএ এনজাইম প্রকৃতিতেই বিদ্যমান ছিল এবং সুসংবাদ হলো সেই এনজাইমে জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক উপাদান রাইবোজোমের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু এমন কোন আরএনএ’র সন্ধান পাওয়া গেল না যে নিজেই নিজের অনুরূপ প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এবং কোন বিজ্ঞানীই প্রমাণ করতে পারলেন না যে আদিম ঘন তরল স্যুপ থেকে কীভাবে আরএনএ সৃষ্টি হয়েছিল। বিকল্প নিউক্লিক এসিড হয়ত পরবর্তী প্রশ্নের সমাধান দিতে সক্ষম কিন্তু হতাশার খবর এই যে, প্রাণের এইসব প্রাথমিক উপাদানগুলো প্রকৃতিতে আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল তার কোন নির্ভুল প্রমাণ বিজ্ঞানীগণের হাতে নেই। ঠিক সেই সময়ে ১৯৮০ দশক থেকে আরএনএ মদবাদের বিরোধী আর একটি মতবাদ ধীরেধীরে তাদের যুক্তির স্বপক্ষে প্রমাণ যোগার করতে ব্যস্ত ছিল। নতুন মতবাদে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীগণ যুক্তি দেখাতে লাগলেন জীবন আরএনএ বা ডিএনএ বা অন্যকোন বংশগতির বস্তু থেকেও নয় বরং জীবন সৃষ্টি হয়েছিল শক্তির যান্ত্রিক কৌশল ত্বরান্বিত করে। কারণ জীবনকে বেঁচে থাকতে হলে দরকার শক্তি।
১৯৬০ সালের পরে বিজ্ঞানীগণ প্রাণের উৎস অনুসন্ধানে তিনটি মতবাদে বিভক্ত হয়ে গেলেন। কারো ধারণা জীবন শুরু হয়েছিল প্রাথমিক পর্যায়ের জৈবিক কোষ গঠনের মাধ্যমে। অন্য একদল বিজ্ঞানী মনে করেন জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল রাসায়নিক বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কিন্তু আরেক দল বিজ্ঞানী বংশগতি এবং আপন কোষের প্রতিলিপি সৃষ্টির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শেষ দলের বিজ্ঞানীগণ, যে কোষটি নিজেই নিজের অনুরূপ সৃষ্টি করতে পারে তাদের স্বরূপ কেমন ছিল সেটা অন্বেষণের চেষ্টা করেন। এই বিজ্ঞানীগণ প্রথম থেকেই জোর দিয়ে প্রচার করেন জীব-কোষ আরএনএ দিয়ে তৈরি।
১৯৬০ দশকের বিজ্ঞানীগণের চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ ছিল যে আরএনএ হল সকল প্রাণের উৎস। বিশেষত আরএনএ এমনকিছু করতে পারে যেটা ডিএনএ করতে পারে না। আরএনএ হল একটা নমনীয় সুতো সদৃশ মলিকিউল। অন্যদিকে ডিএনএ হল দুইটা সুতো যারা নিজেরা পেঁচিয়ে স্তরে স্তরে বিভিন্ন আকারে সাজানো থাকে। আপনি এনজাইম ছাড়া বাঁচতে পারবেন না। আরএনএ এর ভিতরে কাগজের মত ভাজ করা একটা বস্তু দেখা গেল যেটা প্রোটিনের মত আচরণ করে। প্রোটিন দেখতে সাধারণত অনেকটা লম্বা সুতোর মত। প্রোটিন নিউক্লিওটাইড নয় বরং অ্যামাইনো এসিড দিয়ে তৈরি এবং তারা বিশদ জটিল অবয়ব সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আরএনএ হল প্রোটিন উৎপাদনের সবচেয়ে আশ্চর্য দক্ষতা। কিছু আরএনএ রাসায়নিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে অনুঘটকের কাজ করে। এই সমস্ত প্রোটিনকেই এনজাইম বলে।
আপনার মেরুদণ্ডের হাড়ের মজ্জায় বিপুল পরিমাণ এনজাইম বিদ্যমান। এনজাইম খাদ্যের জটিল মলিকিউলকে ভেঙে শর্করা বা চিনিজাতীয় সাধারণ সরল খাদ্য উপাদানে পরিণত করে যাতে প্রাণীর দেহকোষ সহজে গ্রহণ করতে পারে।
লেজলি ওরগেল এবং ফ্রান্সিস ক্রিক’র মনে হচ্ছিল যদি আরএনএ প্রোটিনের মত ভাজে ভাজে থাকে তাহলে আরএনএ এর মধ্যে জীবন্ত মলিকিউল থাকার সম্ভাবনা আছে এবং সেখানে তথ্যগুলো ডিএনএ আকারে সংরক্ষিত থাকে আর কিছু প্রোটিন রাসায়নিক বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। লেজলি ওরগেল এবং ফ্রান্সিস ক্রিক’র সন্দেহ ছিল নিছক ধারণা কিন্তু দশক ধরে সেই ধারণার কোন সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।
টমাস রবার্ট চেক জন্মগ্রহণ করেন আমেরিকার আইওয়া শহরে এবং সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। শিশুকাল থেকেই চেক পাথর এবং খনিজ উপাদানের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ অনুভব করেন। তিনি যখন নিম্ন মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র তখনই সে স্থানীয় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের গবেষণাগারের দরজায় উঁকি দিয়ে শিক্ষকদের কাছে খনিজ উপাদানের গঠন প্রণালী দেখতে চেয়েছিলেন। টমাস রবার্ট চেক জৈব রসায়নবিদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন এবং তার আগ্রহের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল আরএনএ। এখন দেখা যাচ্ছে জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল আরএনএ দিয়ে এবং এতদিনের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর প্রায় দ্বারপ্রান্তে।
১৯৮০ সালের শুরুর দিকে টমাস রবার্ট চেক এবং তার কিছু সহকর্মী কোলারাডো বোলডার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে এককোষী প্রাণ ‘Tetrahymena thermophila’ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এককোষী প্রাণের অনুষঙ্গের সুতা সদৃশ বস্তুটি আরএনএ দিয়ে গঠিত। চেক আবিষ্কার করলেন আরএনএ’র একটা বিশেষ অংশ কখনো কখনো মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে যেন তাকে কাঁচি দিয়ে কেটে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। চেকের গবেষকদল যখন সব এনজাইমকে পৃথক করে ফেললেন তখন অন্যান্য মলিকিউল কাঁচির মত কাটাকুটির কাজ করছিল। এই কাজটি চালিয়ে নিচ্ছিল আরএনএ। তারা খুঁজে পেলেন প্রথম আরএনএ এনজাইম। আরএনএ’র ক্ষুদ্র অংশ যারা নিজেদেরকে বৃহৎ অংশ থেকে দ্বিখণ্ডিত করতে সক্ষম।
চেক তার গবেষণামূলক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করলেন ১৯৮২ সালে। পরের বছর অন্য একটি বিজ্ঞানীদল রাইবোজম নামের দ্বিতীয় আরেকটি আরএনএ এনজাইমের সন্ধান পেলেন। দুইটি আরএনএ পাওয়ার সফলতার দ্রুত ইঙ্গিত দিলো সেখানে আরও অনেক কিছুর অস্তিত্ব আছে। এই আবিষ্কারের ফলে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল জীবন সৃষ্টি হয়েছিল আরএনএ থেকে।
ম্যাসাচুচেটস প্রদেশের কেমব্রিজের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওয়াল্টার গিলবার্ট প্রথম মানুষের বংশগতি ধারণার গোড়াপত্তন করেন। পদার্থবিজ্ঞানী হলেও গিলবার্ট মলিকিউলার বায়োলজিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মানুষের জীনের ক্রমবিবর্তনের ধারা প্রমাণ করতে তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা। বিচ্ছিন্ন বস্তুকণা থেকে আরএনএ জগতে উত্তরণ হল প্রাণের বিকাশে রাজকীয় যাত্রার শুরু। ১৯৮৬ সালে ‘নেচার’ বিজ্ঞান সাময়িকীতে গিলবার্ট প্রস্তাব করেন প্রাণের উৎপত্তি হয়ে আরএনএ’র হাত ধরে।
গিলবার্ট যুক্তি দেখান বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে নিউক্লিওটাইড ঘনতরল থেকে বস্তুকণা থেকে নিজেই নিজের প্রাণ সৃষ্টির কাজকে ত্বরান্বিত করে আরএনএ মলিকিউল। আরএনএ সম্মিলিতভাবে দ্বিভাজিত হয় এবং নিজের স্বরূপ সৃষ্টি করে। আরএনএ মলিকিউল ক্রমান্বয়ে অনেক প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার জন্ম দিল। আরএনএ খুঁজে পেল প্রোটিন এবং প্রোটিন এনজাইম সৃষ্টির উপায় এবং প্রমাণিত হল তাদের গুরুত্ব এবং তারা যাত্রা শুরু করলো জীবনের পথে যে জীবন আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রাণের বিকাশ প্রথমদিকের নিউক্লিওটাইড আদিম ঘনতরল স্যুপ থেকে একাধিক জৈবরাসায়নিক অণুজীবের গঠনের উপর যুগপৎ নির্ভর করেনি বরং একটা বিশেষ অণুজীব প্রাণ সৃষ্টির সর্বকাজের কাজি। ২০০০ সালে আরএনএ তত্ত্বের সমর্থনে এক নাটকীয় প্রমাণ পাওয়া গেল।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবরসায়নের অধ্যাপক টমাস আর্থার স্টিৎজ সুদীর্ঘ ৩০ বছর ধরে জীবন্ত কোষে অণুজীবের গঠন নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। ১৯৯০ সালে তিনি রাইবোজোমের গঠনপ্রণালী খুঁজে দেখার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলেন। প্রকৃত ঘটনা হলো প্রাণের প্রয়োজনীয় ক্রিয়াকর্ম আরএনএ নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এবং আরএনএ কেন্দ্রিক প্রাণের বিকাশ বেশি গ্রহণযোগ্য।
প্রতিটি জীবন্ত কোষে রাইবোজোম আছে। রাইবোজোম আরএনএ থেকে সংকেত গ্রহণ করতে পারে এবং আরএনএ’র অভ্যন্তরীণ সুতোর-মত জালিকা অ্যামাইনো এসিড একত্রিত করে প্রোটিন সৃষ্টি করতে পারে। প্রাণীদেহের বেশিরভাগ কোষ রাইবোজোম দ্বারা গঠিত। রাইবোজোম কোষের আরএনএ বহনকারী হিসেবে পরিচিত। ২০০০ সালে অধ্যাপক স্টিৎজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল রাইবোজোমের গঠনের বিশদ চিত্র খুঁজে পেলেন এবং আবিষ্কার করলেন রাইবোজোমের অন্তঃস্থলে অনুঘটকের কাজ করছে আরএনএ।
ভাবতেই কেমন জটিল লাগছে, তাই না? কারণ রাইবোজোম হলো জীবনের ভিত্তিমূল এবং একই সাথে প্রাচীন। যেসব বিজ্ঞানীগণ সমর্থন করতেন প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএন থেকে তাদের আনন্দের আর সীমা নাই। এই অসামান্য আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালে অধ্যাপক টমাস আর্থার স্টিৎজ রসায়নে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। কিন্তু সমস্যা ঘটে যায় অন্যত্র। এই আবিষ্কারের ফলে প্রাণ সৃষ্টির রহস্য আবার পিছনের দিকের সেই তিনটি ধারণার মধ্যে সন্দেহ ঘনীভূত হলো। আসলেই কী দিয়ে প্রাণ সৃষ্টি, কীভাবে সৃষ্টি? আরএনএ থেকে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল এই মতবাদের শুরুতেই দুইটা সমস্যা বিদ্যমান ছিল। আরএনএ কী প্রকৃতপক্ষে নিজে নিজেই প্রাণের সবধরনের ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম? পৃথিবীর প্রথম-যুগে কী প্রথমেই আরএনএ সৃষ্টি হয়েছিল?
বিজ্ঞানীগণ তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে গবেষণাগারে নিজেই নিজের সৃষ্টিকর্তা আরএনএ সৃষ্টির কাজ শুরু করলেন। ৩০ বছরের দীর্ঘ গবেষণার পরেও গিলবার্ট প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ দিয়ে এই মতবাদের সমর্থনে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারলেন না। গিলবার্ট পেলেন অণুজীব কিন্তু সেটা প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল। যদি প্রাণ সৃষ্টি হয় আরএনএ অণুজীব দিয়ে তাহলে আরএনএ অবশ্যই নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারবে। আরএনএ’কে হতে হবে স্বয়ম্ভূ।
কিন্তু আরএনএ নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে না। ডিএনএ’র দ্বারাও একাজ সম্ভব নয়। আরএনএ বা ডিএনএ যাকিছুই বলি না কেন নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে হলে তাদের দরকার বিপুল পরিমাণ এনজাইম এবং অন্যান্য অণুজীব। ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে কিছু জীববিজ্ঞানী প্রাণ বিকাশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কিছু অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের সমাধান করতে গবেষণা শুরু করেন। তাদের মতবাদের সমর্থনে তারা নেমে পড়লেন নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এমন আরএনএ’র সন্ধানে।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের জীনতত্ত্বের প্রফেসর জ্যাক ইউলিয়াম সোসটাক প্রাণের উৎস সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। শিশুকাল থেকেই তিনি রসায়নের প্রতি এত মুগ্ধ ছিলেন যে তার বাড়ির বেইজমেন্টে তার নিজস্ব একটা গবেষণাগার ছিল। তার নিজের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লেও তিনি একবার রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটান। ফলাফলে যা ঘটেছিল তা ছিল বিস্ময়কর। বিস্ফোরণের ফলে একটা গ্লাসের টিউব তীব্র-বেগে ছুটে গিয়ে ছাদের দেয়ালে গেঁথে গিয়েছিল।
১৯৮০ দশকের শুরুতে সোসটাক প্রমাণ করে দেখাতে সক্ষম হন কীভাবে জীন বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। তার এই গবেষণার ফলাফল তার জন্য নোবেল পুরষ্কার এনে দিয়েছিল। তিনি দেখান আরএনএ এনজাইম কতটা শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু তিনি অতি দ্রুতই টমাস রবার্ট চেক’র আরএনএ এনজাইমের গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। সোসটাক বলেন, “আমি মনে করেছিলাম এনজাইম নিয়ে গবেষণা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। মোটের উপর সম্ভবত আরএনএ নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে।”
১৯৮৮ সালে চেক এক বিশেষ ধরণের আরএনএ ইনজাইমের সন্ধান পেলেন যারা ক্ষুদ্র আরএনএ মলিকিউল বানাতে পারে এবং এই আরএনএ ১০ নিউক্লিওটাইডের সমান দীর্ঘ। সোসটাক গবেষণাগারে নতুন ধরণের আরএনএ ইনজাইম সৃষ্টি করে তার আবিষ্কারকে সমৃদ্ধ করতে গবেষণা শুরু করলেন। সোসটাকের গবেষকদল বিপুল পরিমাণ গবেষণার ফলাফল দৈব-চয়ন পদ্ধতিতে আবার পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন কোন ধরণের এনজাইম অনুঘটকের কাজ করে। সেই পরীক্ষাগুলো থেকে আবার পরীক্ষা করলেন। একই পদ্ধতিতে ১০ বার পরীক্ষার পর সোসটাক এমন এক আরএনএ এনজাইম সৃষ্টি করলেন যার বিক্রিয়ার অনুঘটক ক্ষমতা সাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশের তুলনায় ৭০লক্ষ গুণ বেশি গতিশীল। তারা দেখালেন আরএনএ এনজাইম প্রকৃত অর্থেই প্রভূত শক্তিশালী কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদের আরেকটি অনুরূপ সৃষ্টি করতে পারে না। এমনকি অনুরূপ সৃষ্টির ধারে কাছেও যায় না। সোসটাক যেন অসম্ভবের দেয়ালে আঘাত করলেন।
তারপরে সবচেয়ে বড় সাফল্য এলো ২০০১ সালে অধ্যাপক সোসটাক’র সাবেক শিক্ষার্থী কেমব্রিজের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির জীব বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড বারটেল’র হাত ধরে। বারটেল আর১৮ নামে আরএনএ এনজাইম সৃষ্টি করলেন যা বিদ্যমান আরএনএ জালের সাথে নতুন নিউক্লিওটাইড যোগ করতে পারে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে এই সাফল্য শুধু আরএনএ’র সাথে যথেচ্ছ নিউক্লিওটাইড সংযুক্তিই নয় বরং পূর্বের পরীক্ষার ফলাফলের যথাযথ প্রতিফলন।
এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের যা কিছু অর্জন তার কিছুই নিজেই নিজের অবিকল কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু অগ্রগতি প্রায় উদ্দেশ্যের কাছাকাছি চলে এসেছে। আর১৮ ১৮৯টি নিউক্লিওটাইড সুতোর জাল দিয়ে গঠিত এবং এটা নির্ভরযোগ্য-ভাবে আরও ১১টি নিউক্লিওটাইড আগের আরএনএ সুতোর জালের সাথে যুক্ত করতে পারে যা নিজের দৈর্ঘ্যের প্রায় ৬ শতাংশ। নতুন গবেষণা আশা জাগালো জালের কিছু সুতোর প্রান্ত ১৮৯টি নিউক্লিওটাইডের সমান দীর্ঘ। তবে এটা নিশ্চিত হওয়া গেল প্রাণের সৃষ্টি আরএনএ থেকে সূত্রপাত হয়নি।
২০১১ সালে কেমব্রিজের মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগে গবেষণাগারে সবচেয়ে সফল পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন ফিলিপ হোলিগার। তার গবেষকদল আর১৮ আরএনএ’র উন্নতি সাধন করেন তার নাম দিলেন টিসি১৯জেড। এই নতুন আরএনএ যেটা নিজেদের ফলাফলের নিউক্লিওটাইড ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিলিপি করতে পারে। তাদের ৪৮ শতাংশ নিজেদের দৈর্ঘ্য যা আর১৮ আরএনএ থেকেও বড় কিন্তু ১০০ শতাংশ সেখানে অত্যাবশ্যকীয় নয়। ক্যালিফোর্নিয়াতে লা জোলা’তে অবস্থিত ‘স্ক্রিপস রিসার্চ ইন্সটিটিউটে’ বিকল্প আর একটা গবেষণা তখন চলছিল জেরাল্ড ফ্রান্সিস জয়েস এবং ট্রেসি লিংকন’র নেতৃত্বে। ২০০৯ সালে তারা আর একধরণের এনজাইমের সন্ধান পেলেন যারা নিজেদের অগোচরেই নিজেদেরকে অবিকল প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। নতুন সৃষ্ট এনজাইম দুইটা ক্ষুদ্র আরএনএ’র সাথে যুক্ত হয়ে দ্বিতীয় আরেকটা এনজাইমের জন্ম দেয়। এই এনজাইম আর দুইটা আরএনএ’র সাথে যুক্ত হয়ে আবার নতুন এনজাইম সৃষ্টি করে। প্রয়োজনীয় উপাদান এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এনজাইম সৃষ্টির এই সরল চক্র অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতেই থাকে। কিন্তু এনজাইম শুধু তখনই সফলভাবে কাজ করতে পারে যখন তাদেরকে সঠিক আরএনএ সূত্র দেয়া হয়। ঠিক এই পরীক্ষাটাই জেরাল্ড ফ্রান্সিস জয়েস এবং ট্রেসি লিংকন গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করেন।
অনেক বিজ্ঞানী প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে এমন তত্ত্বে সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন কারণ আরএনএ নিজেই নিজের আর একটা অবিকল প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে না এবং এটাই এই তত্ত্বের প্রধান দুর্বলতা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আরএনএ থেকে জীবনের সূচনা হয়নি। সম্ভবত নবগঠিত পৃথিবীতে অন্যকোন ধরণের জৈব-কণার উপস্থিতি ছিল সেখান থেকেই প্রাণের সৃষ্টি। প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে যখন রসায়নবিজ্ঞানগণ পারস্পারিক সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন কোন বস্তু থেকে আরএনএ উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়। ডিএনএ’র তুলনায় অণুজীবকে মনে হল অনেক সাধারণ কিন্তু আরএনএ সৃষ্টি করা ভীষণ কঠিন এবং শ্রমসাধ্য কাজ। সমস্যা দেখা দিলো কোষের শর্করা উৎপাদন করতে গিয়ে এবং যার উপর ভিত্তি করে নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি হয় সেখানে বিস্তর ঝামেলা। কোষের এই দুইটা অপরিহার্য উপাদান আলাদা আলাদা উৎপাদন করা সম্ভব কিন্তু এই দুইটা উপাদানের মাঝে কোনভাবেই সংযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই সমস্যা ১৯৯০ দশকের শুরুতেই পরিষ্কার জানা গিয়েছিল সুতরাং অনেক বিজ্ঞানীই নাকসিটকিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে এই তত্ত্ব শুধুই নিরেট ধারণা মাত্র, বাস্তবের সাথে লেশমাত্র সম্পর্ক নাই। তত্ত্বটা মোটেও সঠিক নয়।
সম্ভবত নবগঠিত পৃথিবীতে অন্যকোন ধরণের জৈব-কণার উপস্থিতি ছিল যারা আরএনএ থেকে সরল এবং যারা পৃথিবীর আদিম জৈব-কণা ভর্তি ঘন তরল থেকে নিজেদেরকে সংগঠিত করতে পারে এবং নিজেদের অবিকল প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে শুরু করে এবং আরএনএ, ডিএনএ এবং অন্যান্য উপাদান সৃষ্টির দিকে ধাবিত করে।
ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পিটার নিলসেন ১৯৯১ সালে দাবী করলেন জীবনের সূচনা সেই আদিম পুকুরের ঘন তরল থেকে। যেখানে অণুজীব নিজের প্রতিলিপি নিজেই সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এটা ছিল বিস্তর বিবর্তিত ডিএনএ। পিটার নিলসেন পূর্বের বিজ্ঞানীদের গবেষণার উপর ভিত্তি করেই এগিয়ে গেলেন নতুন উদ্যমে এবং স্থির থাকলেন ডিএনএ’র মধ্যে প্রাপ্ত এ, টি, সি এবং জি এনজাইমে। নিলসেন অণুজীব গবেষণার মূল ভিত্তি গড়ে দিলেন এবং ডিএনএ’র ভিতরে শর্করার পরিবর্তে পলিএমাইডস অ্যামাইনো এসিডের সন্ধান পেলেন। তিনি নতুন প্রাপ্ত অণুজীবের নাম দিলেন পলিএমাইডস নিউক্লিক এসিড সংক্ষেপে পিএনএ। যদিও বিভ্রান্তিকরভাবে আমরা এখনো পিএনএ’কে জানি পেপটাইড নিউক্লিক এসিড নামে। আরএনএ’র পিএনএ গঠন এত দুঃসাধ্য নয়, সম্ভবত পৃথিবীর আদিম অবস্থায় পিএনএ গঠিত হয়েছিল।
পিএনএ প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, একে সৃষ্টি করতে হয় এবং আচরণ অনেকাংশে ডিএনএ’র মত। পিএনএ’র সুতার মতো একটা প্রান্ত ডিএনএ’র একটা প্রান্ত দখল করে নিতে পারে। অণুজীবের এই মিলে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তদুপরি পিএনএ, ডিএনএ’র মত দুইটা প্রান্ত পেঁচিয়ে মইয়ের আকার ধারণ করতে পারে। স্ট্যানলি মিলার এখানেই আমাদেরকে মুগ্ধ করে এবং প্রাণ সৃষ্টির রহস্য জগতে কৌতূহলী করে তোলে। তিনি প্রাণের বিকাশ হয়ে আরএনএ থেকে এই তত্ত্বের ঘোরতর অবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন প্রথম প্রাণের উপাদান সৃষ্টিতে পিএনএ বরং অনেক বেশী বিশ্বাসযোগ্য এবং যুক্তিপূর্ণ দাবীদার।
২০০০ সালে স্ট্যানলি মিলার আরও শক্তিশালী প্রমাণ উপস্থাপন করলেন। ইতিমধ্যে তিনি ৭০ বছরের অভিজ্ঞতায় পৌঁছে গেছেন। কিন্তু বিধি বাম, সেই সময়ে তিনি পরপর কয়েকটি ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন ফলে তাকে গবেষণা ছেড়ে নার্সিং হোমে চলে যেতে হয়। তার কাজ আর সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। মিলার তার সেই ক্লাসিকাল ‘স্ট্যানলি মিলার-হ্যারল্ড উরে পরীক্ষা’ পুনরায় করে দেখেন যে পরীক্ষার কথা আমরা ইতিমধ্যেই প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। এবারের পরীক্ষায় মিলার মিথেন, নাইট্রোজেন, অ্যামোনিয়া, পানির সাথে পিএনএ যুক্ত করে দিলেন।
অন্যান্য রসায়নবিদগণ প্রাণ গবেষণায় এগিয়ে এলেন তাদের নিজস্ব বিকল্প নিউক্লিক এসিড এবং তাদের তত্ত্ব ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান নিয়ে। প্রতিটি বিকল্প নিউক্লিক এসিড ব্যবহারের পিছনে ভিন্ন ভিন্ন সমর্থক বিজ্ঞানীদলের বিশেষ করে যারা এই এসিডের উদ্ভাবন করেছেন তাদের পৃথক যুক্তি আছে। ২০০০ সালে আলবার্ট ইসেনমসার কৃত্রিম জেনেটিক পলিমার ‘থ্রেওস নিউক্লিক এসিড’ উদ্ভাবন করেন। থ্রেওস নিউক্লিক এসিড বা টিএনএ মূলত ডিএনএ কিন্তু এর রাইবোজোমে ভিন্ন ধরণের শর্করা আছে। টিএনএ রাইবোজোমের সুতোর প্রান্ত দুইটা দ্বিমুখী কুণ্ডলী বানাতে পারে এবং আরএনএ এবং টিএনএ’র মাঝে পূর্বাপর তথ্যের অবিকল প্রতিলিপি আদান প্রদান করতে পারে। এছাড়াও টিএনএ জটিলতর ভাজে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারে এবং প্রোটিন সংরক্ষণ করতে পারে। এথেকেই বোঝা যায় টিএনএ আরএনএ’র মতই এনজাইমের কাজ করতে পারে। একইভাবে ২০০৫ সালে এরিক মেগারস গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে গ্লাইকল নিউক্লিক এসিড উৎপাদন করলেন যেগুলো প্যাঁচানো কাঠামো তৈরি করতে পারে। এতক্ষণ যতগুলো নিউক্লিক এসিড নিয়ে আলোচনা হয়েছে তাদের কোনটিই প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, সৃষ্টি হয়েছে গবেষণাগারে। সুতরাং যদি প্রথম প্রাণ এইসব নিউক্লিক এসিডের মধ্য থেকে কোন একটিকে ব্যবহার করে থাকে তাহলে বলতেই হবে এতদিনের চলমান বিতর্ক চলে যাবে আরএনএ এবং ডিএনএ’র পক্ষে অর্থাৎ প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল আরএনএ এবং ডিএনএ দিয়ে। এই মতবাদ হয়ত সত্য, কিন্তু বিজ্ঞানীদের হাতে এই দাবীর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই।
আর এইসব কিছুর অর্থ দাঁড়ালো, ২০০০ শতকের মাঝামাঝি উপনীত হয়ে আরএনএ মতবাদের বিজ্ঞানীগণ প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। আরএনএ মতবাদের বিজ্ঞানীগণের চিন্তা, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ খুব যৌক্তিক এবং গোছানো পরিপাটি কিন্তু প্রাণের উৎস সম্পর্কে পুরোপুরি সত্যের কাছে পৌঁছাতে পারেননি।
অন্যদিকে আরএনএ এনজাইম প্রকৃতিতেই বিদ্যমান ছিল এবং সুসংবাদ হলো সেই এনজাইমে জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক উপাদান রাইবোজোমের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু এমন কোন আরএনএ’র সন্ধান পাওয়া গেল না যে নিজেই নিজের অনুরূপ প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এবং কোন বিজ্ঞানীই প্রমাণ করতে পারলেন না যে আদিম ঘন তরল স্যুপ থেকে কীভাবে আরএনএ সৃষ্টি হয়েছিল। বিকল্প নিউক্লিক এসিড হয়ত পরবর্তী প্রশ্নের সমাধান দিতে সক্ষম কিন্তু হতাশার খবর এই যে, প্রাণের এইসব প্রাথমিক উপাদানগুলো প্রকৃতিতে আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল তার কোন নির্ভুল প্রমাণ বিজ্ঞানীগণের হাতে নেই। ঠিক সেই সময়ে ১৯৮০ দশক থেকে আরএনএ মদবাদের বিরোধী আর একটি মতবাদ ধীরেধীরে তাদের যুক্তির স্বপক্ষে প্রমাণ যোগার করতে ব্যস্ত ছিল। নতুন মতবাদে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীগণ যুক্তি দেখাতে লাগলেন জীবন আরএনএ বা ডিএনএ বা অন্যকোন বংশগতির বস্তু থেকেও নয় বরং জীবন সৃষ্টি হয়েছিল শক্তির যান্ত্রিক কৌশল ত্বরান্বিত করে। কারণ জীবনকে বেঁচে থাকতে হলে দরকার শক্তি।
—॰ ইফকের ঘটনা ॰—
আবদুল আযীয ইবনে আবদুল্লাহ রহ………..উরওয়া ইবনে যুবাইর, সাঈদ ইবনে মুসায়্যিব, আলকামা ইবনে ওয়াক্কাস ও উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবা ইবনে মাসউদ রা. সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিণী আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, যখন অপবাদ রটনাকারীগণ তাঁর প্রতি অপবাদ রটিয়েছিল রাবী যুহরী রহ. বলেন, তারা প্রত্যেকেই হাদীসটির অংশবিশেষ আমার কাছে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি স্মরণ রাখা ও সঠিকভাবে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে তাদের কেউ কেউ একে অন্যের চেয়ে অধিকতর অগ্রগামী ও নির্ভরযোগ্য। আয়েশা রা. সম্পর্কে তারা আমার কাছে যা বর্ণনা করেছেন আমি তাদের প্রত্যেকের কথাই যথাযথভাবে স্মরণ রেখেছি। তাদের একজনের বর্ণিত হাদীসের অংশবিশেষ অপরের বর্ণিত হাদীসের অংশবিশেষের সত্যতা প্রমাণ করে। যদিও তাদের একজন অন্যজনের চেয়ে অধিক স্মৃতিশক্তির অধিকারী। রাবীগণ বলেন:
আয়েশা রা. বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সফরের ইচ্ছা করতেন তখন তিনি তাঁর স্ত্রীগণের (নামের জন্য) কোরা ব্যবহার করতেন। এতে যার নাম আসত তাকেই তিনি সাথে করে সফরে বের হতেন। আয়েশা রা. বলেন, এমনি এক যুদ্ধে (মুরায়সীর যুদ্ধ) তিনি আমাদের মাঝে কোরা ব্যবহার করেন, এতে আমার নাম বেরিয়ে আসে। তাই আমিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সফরে বের হলাম। এ ঘটনাটি পর্দার হুকুম নাযিল হওয়ার পর সংঘটিত হয়েছিল। তখন আমাকে হাওদাজ সহ সাওয়ারীতে উটানো ও নামানো হত। এমনি করে আমরা চলতে থাকলাম। অবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ যুদ্ধ থেকে অবসর হলেন, তখন তিনি (বাড়ির দিকে) ফিরলেন। ফেরার পথে আমরা মদীনার নিকটবর্তী হলে তিনি একদিন রাতের বেলা রওয়ানা হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। রওয়ানা হওয়ার ঘোষণার পর আমি উঠলাম এবং (প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য) পায়ে হেটে সেনাছাউনী অতিক্রম করে (একটু সামনে) গেলাম। এরপর প্রয়োজন সেরে আমি আমার সাওয়ারীর কাছে ফিরে এসে বুকে হাত দিয়ে দেখলাম যে, (ইয়ামানের অন্তর্গত) যিফার শহরের পুতি দ্বারা তৈরী করা আমার গলার হারটি ছিড়ে কোথায় পড়ে গিয়েছে। তাই আমি ফিরে গিয়ে আমার হারটি তালাশ করতে আরম্ভ করলাম। হার তালাশ করতে করতে আমার আসতে বিলম্ব হয়ে যায়।
আয়েশা রা. বলেন, যে সমস্ত লোক উটের পিঠে আমাকে উঠিয়ে দিতেন তারা এসে আমার হাওদাজ উঠিয়ে তা আমার উটের পিঠে তুলে দিলেন, যার উপর আরোহণ করতাম। তারা মনে করেছিলেন যে, আমি এর মধ্যে আছি, কারণ খাদ্যভাবে মহিলাগণ তখন খুবই হালকা পাতলা হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের দেহ মাংসল ছিলনা। তাঁরা খুবই স্বল্প পরিমাণ খানা খেতে পেত। তাই তারা যখন হাওদাজ উঠিয়ে উপরে রাখেন তখন তখন তা হালকা হওয়ার বিষয়টিকে কোন প্রকার অস্বাভাবিক মনে করেননি। অধিকন্তু আমি ছিলাম একজন অল্প বয়স্কা কিশোরী। এরপর তারা উট হাঁকিয়ে নিয়ে চলে যায়। সৈন্যদল রওয়ানা হওয়ার পর আমি আমার হারটি খুঁজে পাই এবং নিজস্ব স্থানে ফিরে এসে দেখি তাদের (সৈন্যদল) কোন আহবায়ক এবং কোন উত্তরদাতা তথায় নেই। ( নিরুপায় হয়ে) তখন আমি পূর্বে যেখানে ছিলাম সেখানে বসে রইলাম। ভাবছিলাম, তাঁরা আমাকে দেখতে না পেলে অবশ্যই আমার কাছে ফিরে আসবে। ঐ স্থানে বসে থাকা অবস্থায় ঘুম চেপে আসলে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। বানূ সুলামী গোত্রের যাকওয়ান শাখার সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল রা. (যাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফেলে যাওয়া আসবাবপত্র কুড়িয়ে নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন) সৈন্যদল চলে যাওয়ার পর সেখানে ছিলেন। তিনি প্রত্যুষে আমার অবস্থানস্থলের কাছে পৌঁছে একজন ঘুমন্ত মানুষ দেখে আমার দিকে তাকানোর পর আমাকে চিলে ফেললেন। তিনি আমাকে দেখেছিলে পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বে। তিনি আমাকে চিনতে পেরে ‘ইন্না লিল্লাহহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন’ পড়লে আমি তা শুনতে পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম এবং চাদর টেনে আমার চেহারা ঢেকে ফেললাম। আল্লাহর কসম, আমি কোন কথা বলিনি এবং তাঁর থেকে ইন্না লিল্লাহ……..পাঠ ছাড়া আর কোন কথাই শুনতে পাইনি। এরপর তিনি সাওয়ারী থেকে অবতরণ করলেন এবং সাওয়ারীকে বসিয়ে তার সামনের পা নিচু করে দিলে আমি গিয়ে তাতে আরোহণ করলাম। পরে তিনি আমাকেসহ সাওয়ারীকে টেনে আগে আগে চলতে লাগলেন, পরিশেষে ঠিক দ্বিপ্রহরে প্রচণ্ড গরমের সময় আমরা গিয়ে সেনাদলের সাথে মিলিত হলাম। সে সময় তাঁরা একটি জায়গায় অবতরণ করছিলেন।
আয়েশা রা. বলেন, এরপর যাদের ধ্বংস হওয়ার ছিল তারা (আমার প্রতি অপবাদ আরোপ করে) ধ্বংস হয়ে গেল। তাদের মধ্যে এ অপবাদ আরোপের ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল সে হচ্ছে আবদুল্লাহ ইবনে উবায় ইবনে সুলুল। রাবী উরওয়া রা. বলেন, আমি জানতে পেরেছি যে, তার সামনে অপবাদের কথাগুলো প্রচার করা হত এবং আলোচনা করা হত আর অমনি সে এগুলোকে বিশ্বাস করত, খুব ভালভাবে শ্রবণ করত এবং শোনা কথার ভিত্তিতেই বিষয়টিকে প্রমাণ করার চেষ্টা করত।
উরওয়া রা. আরো বর্ণনা করেছন যে, অপবাদ আরোপকারী ব্যক্তিদের মধ্যে হাসসান ইবনে সাবিত, মিসতাহ ইবনে উসাসা এবং হামনা বিনতে জাহাশ রা. ব্যতীত আরো কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। তারা গুটিকয়েক ব্যক্তির একটি দল ছিল, এতটুক ব্যতীত তাদের সম্পর্কে আমার আর কিছু জানা নেই। যেমন (আল কুরআনে) মহান আল্লাহ পাক বলেছেন, এ ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তাকে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বিন সুলুল বলে ডাকা হয়ে থাকে। বর্ণনাকারী উরওয়া রা. বলেন, আয়েশা রা.-এর এ ব্যাপারে হাসসান ইবনে সাবিত রা.-কে গালমন্দ করাকে পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, হাসসান ইবনে সাবিত রা. তো ঐ ব্যক্তি যিনি তার এক কবিতায় বলেছেন, আমার মান সম্মান এবং আমার বাপ দাদা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মান সম্মান রক্ষায় নিবেদিত।
আয়েশা রা. বলেন, এরপর আমরা মদীনায় আসলাম। মদীনায় আগমন করার পর এক মাস পর্যন্ত আমি অসুস্থ থাকলাম। এদিকে অপবাদ রটনাকরীদের কথা নিয়ে লোকদের মধ্যে আলোচনা ও চর্চা হতে লাগল। কিন্তু এসবের কিছুই আমি জানি না। তবে আমার সন্দেহ হচ্ছিল এবং তা আরো দৃঢ় হচ্ছিল আমার এ অসুখের সময়। কেননা এর পূর্বে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যেরূপ স্নেহ-ভালবাসা লাভ করতাম আমার এ অসুখের সময় তা আমি পাচ্ছিলাম না। তিনি আমার কাছে এসে সালাম করে কেবল ‘তুমি কেমন আছ’ জিজ্ঞাসা করে চলে যেতেন। তাঁর এ আচরণই আমার মনে চরম সন্দেহের উদ্রেক করে। তবে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাইরে বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ জঘন্য অপবাদ সম্বন্ধে আমি কিছুই জানতাম না। উম্মে মিসতাহ রা. একদা আমার সাথে পায়খানার দিকে বের হন। আর প্রকৃতির ডাকে আমাদের বের হওয়ার অবস্থা এই ছিল যে, এক রাতে বের হলে আমরা আবার পরের রাতে বের হতাম। এ ছিল আমাদের ঘরের পার্শ্বে পায়খানা তৈরী করার পূর্বের ঘটনা। আমাদের অবস্থা প্রাচীন আরবীয় লোকদের অবস্থার মত ছিল। তাদের মত আমরাও পায়খানা করার জন্য ঝোঁপঝাড়ে চলে যেতাম। এমনকি বাড়ির পার্শ্বে পায়খান তৈরী করলে আমরা খুব কষ্ট পেতাম। আয়েশা রা. বলেন, একদা আমি এবং উম্মে মিসতাহ “যিনি ছিলেন আবু রূহম ইবনে মুত্তালিব ইবনে আবদে মানাফের কন্যা, যার মা সাখার ইবনে আমির-এর কন্যা ও আবু বকর রা. সিদ্দীকের খালা এবং মিসতাহ ইবনে উসাসা ইবনে আব্বাদ ইবনে মুত্তালিব যার” একত্রে বের হলাম। আমরা আমাদের কাজ থেকে ফারিগ হওয়ার পর বাড়ি ফেরার পথে উম্মে মিসতাহ তার কাপড়ে জাড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে বললেন, মিসতাহ ধ্বংস হোক। আমি তাকে বললাম, আপনি খুব খারাপ কথা বলছেন। আপনি কি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকে গালি দিচ্ছেন? তিনি আমাকে বললেন, ওগো অবলা, সে তোমার সম্পর্কে কি বলে বেড়াচ্ছে তুমি তো তা শোননি। আয়েশা রা. বলেন, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে আমার সম্পর্কে কি বলছে? তখন তিনি অপবাদ রটনাকরীদের কথাবার্তা সম্পর্কে আমাকে জানালেন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, এরপর আমার পুরানো রোগ আরো বেড়ে গেল। আমি বাড়ি ফেরার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে আসলেন এবং সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কেমন আছ? আয়েশা রা. বলেন, আমি আমার পিতা-মাতার কাছে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক খবর জানতে চাচ্ছিলাম, তাই আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললাম, আপনি কি আমাকে আমার পিতা-মাতার কাছে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেবেন? আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমকে অনুমতি দিলেন। তখন (বাড়িতে গিয়ে) আমি আমার আম্মাকে বললাম, আম্মাজান, লোকজন কি আলোচনা করছে? তিনি বললেন, বেটী ও বিষয়টিকে হালকা করে ফেল। আল্লাহর কসম, সতীন আছে এমন স্বামী সোহাগিনী সুন্দরী রমণীকে তাঁর সতীনরা বদনাম করবে না, এমন খুব কমই হয়ে থাকে।
আয়েশা রা. বলেন, আমি বিস্ময়ের সাথে বললাম, সুবহানাল্লাহ । লোকজন কি এমন গুজবই রটিয়েছে। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, রাতভর আমি কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে ভোর হয়ে গেল। এর মধ্যে আমার অশ্রুও বন্ধ হল না এবং আমি ঘুমাতেও পারলাম না। এরপর ভোরবেলাও আমি কাঁদছিলাম। তিনি আরো বলেন যে, এ সময ওহী নাযিল হতে বিলম্ব হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রীর (আমার) বিচ্ছেদের বিষয়টি সম্পর্কে পরামর্শ ও আলোচনা করার নিমিত্তে আলী ইবনে আবু তালিব এবং উসামা ইবনে যায়েদ রা.-কে ডেকে পাঠালেন। আয়েশা রা. বলেন, উসামা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীদের পবিত্রতা এবং তাদের প্রতি (নবীজীর) ভালবাসার কারণে বললেন, (হে আল্লাহর রাসূল) তাঁরা আপনার স্ত্রী, তাদের সম্পর্কে আমি ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না। আর আলী রা. বললেন, হে আল্লাহ রাসূল, আল্লাহ তো আপনার জন্য সংকীর্ণতা রাখেননি। তাকে (আয়েশা) ব্যতীত আরো বহু মহিলা রয়েছে। তবে আপনি এ ব্যাপারে দাসী (বারীরা রা.) কে জিজ্ঞাসা করুন। সে আপনার কাছে সত্য কথাই বলবে। আয়েশা রা. বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারীরা রা.-কে ডেকে বললেন, হে বারীরা তুমি তাঁর মধ্যে কোন সন্দেহমূলক আচরণ দেখেছ কি? বারীরা রা. তাকে বললেন, সেই আল্লাহর শপথ যিনি আপনাকে সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন আমি তার মধ্যে কখনো এমন কিছু দেখিনি যার দ্বারা তাকে দোষী বলা যায়। তবে তাঁর ব্যাপারে শুধু এতটুকু বলা যায় যে, তিনি হলেন অল্প বয়স্কা যুবতী, রুটি তৈরী করার জন্য আটা খামির করে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। আর বকরী এসে অমনি তা খেয়ে ফেলে।
আয়েশা রা .বলেন, (এ কথা শুনে) সেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে সাথে উঠে গিয়ে মিম্বরে বসে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই-এর ক্ষতি থেকে রক্ষার আহবান জানিয়ে বললেন, হে মুসলিম সম্প্রদায়, যে আমার স্ত্রীর ব্যাপারে অপবাদ ও বদনাম রটিয়ে আমাকে কষ্ট দিয়েছে তার এ অপবাদ থেকে আমাকে কে মুক্ত করবে? আল্লাহর কসম, আমি আমার স্ত্রী সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানিনা। আর তাঁরা (অপবাদ রটনাকারীরা) এমন এক ব্যক্তির (সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল) নাম উল্লেখ করছে যার সম্বন্ধেও আমি ভাল ছাড়া কিছু জানি না। সে তো আমর সাথেই আমার ঘরে যায়। আয়েশা রা. বলেন, (এ কথা শুনে) বনী আবদুল আশহাল গোত্রের সাদ (ইবনে মুআয) রা. উঠে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি আপনাকে এ অপবাদ থেকে মুক্তি দেব। সে যদি আউস গোত্রের লোক হয় তা হলে তার শিরচ্ছেদ করব। আর যদি সে আমাদের ভাই খাযরাজের লোক হয় তাহলে তার ব্যাপারে আপনি যা বলবেন তাই পালন করব। আয়েশা রা. বলেন, এ সময় হাসসান ইবনে সাবিত রা.-এর মায়ের চাচাতো ভাই খাযরাজ গোত্রের সর্দার সাঈদ ইবনে উবাদা রা. দাঁড়িয়ে এ কথার প্রতিবাদ করলেন। আয়েশা রা. বলেন, এ ঘটনার পূর্বে তিনি একজন সৎ ও নেককার লোক ছিলেন। কিন্তু (এ সময়) গোত্রীয় অহমিকায় উত্তেজিত হয়ে তিনি সাদ ইবনে মুআয রা.-কে বললেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। আল্লাহর কসম, তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না এবং তাকে হত্যা করার ক্ষমতাও তোমার নেই। যদিসে তোমার গোত্রের লোক হত তাহলে তুমি তার হত্যা হওয়া কখনো পছন্দ করতে না। তখন সাদ ইবনে মুআয রা.-এর চাচাতো ভাই উসাইদ ইবনে হুযাইর রা. সাদ ইবনে ওবায়দা রা.-কে বললেন, বরং তুমি মিথ্যা কথা বললে। আল্লাহর কসম, আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করব। তুমি হলে মুনাফিক। তাই মুনাফিকদের পক্ষ অবলম্বন করে কথাবার্তা বলছ।
আয়েশা রা. বলেন, এ সময় আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্র খুব উত্তেজিত হয়ে উঠে। এমনকি তারা যুদ্ধের সংকল্প পর্যন্ত করে বসে। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থামিয়ে শান্ত করলেন এবং নিজেও চুপ হয়ে গেলেন। আয়েশা রা. বলেন, আমি সেদিন সারাক্ষণ কেঁদে কাটালাম। অশ্রুঝরা আমার বন্ধ হয়নি এবং একটু ঘুমও আমার আসেনি। তিনি বলেন, আমি ক্রন্দনরত ছিলাম আর আমার পিতা-মাতা আমার পার্শ্বে বসা ছিলেন। এমনি করে একদিন দুই রাত কেঁদে কেঁদে কাটিয়ে দিই। এর মাঝে আমার কোন ঘুম আসেনি। বরং অবারিত ধারায় আমার চোখ থেকে অশ্রুপাত হতে থাকে। মনে হচ্ছিল যেন, কান্নার ফলে আমার কলিজা ফেটে যাবে। আমি ক্রন্দনরত ছিলাম আর আমার আব্বা-আম্মা আমার পাশে বসা ছিলেন। এমতাবস্থায় একজন আনসারী মহিলা আমার কাছে আসার অনুমতি চাইলে আমি তাকে আসার অনুমতি দিলাম। সে এসে বসল এবং আমার সাথে কাঁদতে আরম্ভ করল। তিনি বলেন, আমরা ক্রন্দনরত ছিলাম ঠিক এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে এসে সালাম করলেন এবং আমাদের পাশে বসে গেলেন। আয়েশা রা. বলেন, অপবাদ রটানোর পর আমার কাছে এসে এভাবে তিনি আর কখনো বসেননি। এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ একমাস কাল অপেক্ষা করার পরও আমার বিষয়ে তাঁর নিকট কোন ওহী আসেনি।
আয়েশা রা. বলেন, বসার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালিমা শাহাদাত পড়লেন। এরপর বললেন, যা হোক, আয়েশা তোমার সম্বন্ধে আমার কাছে অনেক কথাই পৌঁছেছে, যদি তুমি এর থেকে মুক্ত হও তাহলে শীঘ্রই আল্লাহ তোমাকে এ অপবাদ থেকে মুক্ত করে দেবেন। আর যদি তুমি কোন গুনাহ করে থাক তাহলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাওবা কর। কেননা বান্দা গুনাহ স্বীকার করে তাওবা করলে আল্লাহ তায়ালা তাওবা কবূল করেন। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা বলে শেষ করলে আমার অশ্রুপাত বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি এক ফোটা অশ্রুও আমি আর অনুভব করলাম না। তখন আমি আমার আব্বাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলছেন আমার পক্ষ হতে আপনি তার জবাব দিন। আমার আব্বা বললেন, আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কি জবাব দিব আমি তা জানিনা। তখন আমি আমার আম্মাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন, আপনি তার জবাব দিন। আম্মা বললেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কি জবাব দিব আমি তা জানি না। তখন আমি ছিলাম অল্প বয়স্কা কিশোরী। কুরআনও বেশি পড়তে পারতাম না। তথাপিও এ অবস্থা দেখে নিজেই বললাম, আমি জানি আপনারা এ অপবাদের ঘটনা শুনেছেন, আপনারা তা বিশ্বাস করেছেন এবং বিষয়টি আপনাদের মনে সুদৃঢ় হয়ে আছে। এখন যদি আমি বলি যে, এর থেকে আমি পবিত্র এবং আমি নিষ্কলুষ তাহলে আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন না। আর যদি আমি এ অপরাধের কথা স্বীকার করে নেই যা সম্পর্কে আল্লাহ জানেন যে, আমি এর থেকে পবিত্র তাহলে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন। আল্লাহর কসম, আমি ও আপনারা যে অবস্থায় শিকার হয়েছি এর জন্য (নবী) ইউসুফ আ.-এর পিতার কথা উদাহরণ ব্যতীত আমি কোন উদাহরণ খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি বলেছিলেন: “সুতরাং পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছ সে বিষয়ে আল্লাহই একমাত্র আমার আশ্রয়স্থল” এরপর আমি মুখ ফিরিয়ে আমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আল্লাহ তায়ালা জানেন যে, সে মুহূর্তেও আমি পবিত্র। অবশ্যই আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন। (একথার প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল) তবে আল্লাহর কসম,আমি কখনো ধারণা করিনি যে, আমার ব্যাপারে আল্লাহর ওহী নাযিল করবেন যা পঠিত হবে। আমার ব্যাপারে আল্লাহ কোন কথা বলবেন আমি নিজেকে এতখানি যোগ্য মনে করিনি বরং আমি নিজেকে এর চেয়ে অধিক অযোগ্য বলে মনে করতাম। তবে আমি আশা করাতাম যে, হয়তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এমন স্বপ্ন দেখানো হবে যার দ্বারা আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনো তাঁর বসার জায়গা ছাড়েননি এবং ঘরের লোকদের থেকেও কেউ ঘর থেকে বাইরে যাননি। এমতাবস্থায় তাঁর উপর ওহী নাযিল হতে শুরু হল। ওহী নাযিল হওয়ার সময় তাঁর যে বিশেষ কষ্ট হত তখনও সে অবস্থা তাঁর হল। এমনকি প্রচণ্ড শীতের দিনেও তাঁর দেহ থেকে মোতির দানার মত বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়ত ঐ বাণীর গুরুভাবের কারণে, যা তাঁর প্রতি নাযিল করা হয়েছে। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ অবস্থা দূরীভূত হলে তিনি হাসিমুখে প্রথমে যে কথাটি বললেন, তা হল, হে আয়েশা ! আল্লাহ তোমার পবিত্রতা জাহির করে দিয়েছেন। আয়েশা রা. বলেন, এ কথা শুনে আমার আম্মা আমাকে বললেন, তুমি উঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর। আমি বললাম, আল্লাহর কসম আমি এখন তাঁর দিকে উঠে যাব না। মহান আল্লাহ ব্যতীত আমি কারো প্রশংসা করব না। আয়েশা রা বললেন, আল্লাহ (আমার পবিত্রতা ঘোষণা করে) যে দশটি আয়াত নাযিল করেছেন, তা হল এই : “যারা এ অপবাদ রটনা করেছে (তারা তো তোমাদেরই একটি দল; এ ঘটনাকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না; বরং এও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য আছে তাদের কৃত পাপকর্মের ফল এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে তার জন্য আছ কঠিন শাস্তি। এ কথা শোনার পর মুমিন পুরুষ এবং নারীগণ কেন নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারণা করেনি এবং বলেনি, এটা তো সুষ্পষ্ট অপবাদ। তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি? যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সেহেতু তারা আল্লাহর বিধানে মিথ্যাবাদী। দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমরা যাতে লিপ্ত ছিলে তার জন্য কঠিন শাস্তি তোমাদেরকে স্পর্শ করত। যখন তোমরা মুখে মুখে এ মিথ্যা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিলনা এবং একে তোমরা তুচ্ছ ব্যাপার বলে ভাবছিলে, অথচ আল্লাহর কাছে তা ছিল খুবই গুরুতর ব্যাপার। আল্লাহ পবিত্র, মহান! এ তো এক গুরুতর অপনাদ। আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক তাহলে কখনো অনুরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি করবে না, আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বিবৃত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। যারা মুনিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতের মর্মন্তুদ শাস্তি। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউই অব্যাহতি পেতে না। আল্লাহ দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। (২৪ : ১১-২০) এরপর আমার পবিত্রতা ঘোষণা করে আল্লাহ এ আয়াতগুলো নাযিল করলেন।
আত্মীয়তা এবং দারিদ্রের কারণে আবু বকর সিদ্দীক রা. মিসতাহ ইবনে উসাসাকে আর্থিক ও বৈষয়িক সাহায্য করতেন। কিন্তু আয়েশা রা. সম্পর্কে তিনি যে অপবাদ রটিয়েছিলেন এ কারণে আবু বকর সিদ্দীক রা কসম করে বললেন, আমি আর কখনো মিসতাহকে আর্থিক কোন সাহায্য করব না। তখন আল্লাহ তায়ালা নাযিল করলে, তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ গ্রহণ করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজন ও অভাবগ্রস্তকে এবং আল্লাহর রাস্তায় যারা গৃহত্যাগ করেছে তাদেরকে কিছুই দিবে না। তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে এবং তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। শোন! তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (২৪: ২২) (এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর) আবু বকর সিদ্দীক রা. বলে উঠলেন হ্যাঁ, আল্লাহর কসম অবশ্যই আমি পছন্দ করি যে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিন। এরপর তিনি মিসতাহ রা.-এর জন্য যে অর্থ খরচ করতেন তা পুন: দিতে শুরু করলেন এবং বললেন, আল্লাহর কসম, আমি তাকে এ অর্থ দেওয়া আর কখনো বন্ধ করব না। আয়েশা রা .বললেন, আমার এ বিষয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়নাব বিনতে জাহাশ রা.-কেও জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তিনি যায়নাব রা. -কে বলেছিলেন, তুমি আয়েশা রা. সম্পর্কে কি জান অথবা বলেছিলেন তুমি কী দেখেছ? তখন তিনি বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি আমার চোখ ও কানকে সংরক্ষণ করেছি। আল্লাহর কসম ! আমি তাঁর সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না। আয়েশ রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর স্ত্রীগণের মধ্যে তিনি আমার সমকক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। আল্লাহ তাকে আল্লাহ-ভীতির ফলে রক্ষা করেছেন। আয়েশা রা. বলেন, অথচ তাঁর বোন হামনা রা. তাঁর পক্ষ অবলম্বন করে অপবাদ রটনাকারীদের মত অপবাদ রটনা করে বেড়াচ্ছিলেন। ফলে তিনি ধ্বংসপ্রাপ্তদের সাথে ধ্বংস হয়ে গেলেন। বর্ণনাকারী ইবনে শিহাব রহ. বলেন, ঐ সমস্ত লোকের ঘটনা সম্পর্কে আমার কাছে যা পৌঁছেছে তা হল এই : উরওয়ার রা. বলেন, আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ কসম, যে ব্যক্তি সম্পর্কে অপবাদ দেওয়া হয়েছিল, তিনি এসব কথা শুনে বলতেন, আল্লাহ মহান। ঐ সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, আমি কোন স্ত্রীলোকের কাপড় খু্লেও কোনদিন দেখিনি। আয়েশা রা. বলেন, পরে তিনি আল্লাহর পথে শাহাদত লাভ করেছিলেন।
(সহীহ বুখারী, আল মাগাযী অধ্যায়, হাদীস নং ৩৮৪৬)
উৎস: আরবী বাংলা হাদীস বিশ্বকোষ
—॰ ইফকের ঘটনা ॰—
আবদুল আযীয ইবনে আবদুল্লাহ রহ………..উরওয়া ইবনে যুবাইর, সাঈদ ইবনে মুসায়্যিব, আলকামা ইবনে ওয়াক্কাস ও উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবা ইবনে মাসউদ রা. সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিণী আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, যখন অপবাদ রটনাকারীগণ তাঁর প্রতি অপবাদ রটিয়েছিল রাবী যুহরী রহ. বলেন, তারা প্রত্যেকেই হাদীসটির অংশবিশেষ আমার কাছে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি স্মরণ রাখা ও সঠিকভাবে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে তাদের কেউ কেউ একে অন্যের চেয়ে অধিকতর অগ্রগামী ও নির্ভরযোগ্য। আয়েশা রা. সম্পর্কে তারা আমার কাছে যা বর্ণনা করেছেন আমি তাদের প্রত্যেকের কথাই যথাযথভাবে স্মরণ রেখেছি। তাদের একজনের বর্ণিত হাদীসের অংশবিশেষ অপরের বর্ণিত হাদীসের অংশবিশেষের সত্যতা প্রমাণ করে। যদিও তাদের একজন অন্যজনের চেয়ে অধিক স্মৃতিশক্তির অধিকারী। রাবীগণ বলেন:
আয়েশা রা. বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সফরের ইচ্ছা করতেন তখন তিনি তাঁর স্ত্রীগণের (নামের জন্য) কোরা ব্যবহার করতেন। এতে যার নাম আসত তাকেই তিনি সাথে করে সফরে বের হতেন। আয়েশা রা. বলেন, এমনি এক যুদ্ধে (মুরায়সীর যুদ্ধ) তিনি আমাদের মাঝে কোরা ব্যবহার করেন, এতে আমার নাম বেরিয়ে আসে। তাই আমিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সফরে বের হলাম। এ ঘটনাটি পর্দার হুকুম নাযিল হওয়ার পর সংঘটিত হয়েছিল। তখন আমাকে হাওদাজ সহ সাওয়ারীতে উটানো ও নামানো হত। এমনি করে আমরা চলতে থাকলাম। অবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ যুদ্ধ থেকে অবসর হলেন, তখন তিনি (বাড়ির দিকে) ফিরলেন। ফেরার পথে আমরা মদীনার নিকটবর্তী হলে তিনি একদিন রাতের বেলা রওয়ানা হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। রওয়ানা হওয়ার ঘোষণার পর আমি উঠলাম এবং (প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য) পায়ে হেটে সেনাছাউনী অতিক্রম করে (একটু সামনে) গেলাম। এরপর প্রয়োজন সেরে আমি আমার সাওয়ারীর কাছে ফিরে এসে বুকে হাত দিয়ে দেখলাম যে, (ইয়ামানের অন্তর্গত) যিফার শহরের পুতি দ্বারা তৈরী করা আমার গলার হারটি ছিড়ে কোথায় পড়ে গিয়েছে। তাই আমি ফিরে গিয়ে আমার হারটি তালাশ করতে আরম্ভ করলাম। হার তালাশ করতে করতে আমার আসতে বিলম্ব হয়ে যায়।
আয়েশা রা. বলেন, যে সমস্ত লোক উটের পিঠে আমাকে উঠিয়ে দিতেন তারা এসে আমার হাওদাজ উঠিয়ে তা আমার উটের পিঠে তুলে দিলেন, যার উপর আরোহণ করতাম। তারা মনে করেছিলেন যে, আমি এর মধ্যে আছি, কারণ খাদ্যভাবে মহিলাগণ তখন খুবই হালকা পাতলা হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের দেহ মাংসল ছিলনা। তাঁরা খুবই স্বল্প পরিমাণ খানা খেতে পেত। তাই তারা যখন হাওদাজ উঠিয়ে উপরে রাখেন তখন তখন তা হালকা হওয়ার বিষয়টিকে কোন প্রকার অস্বাভাবিক মনে করেননি। অধিকন্তু আমি ছিলাম একজন অল্প বয়স্কা কিশোরী। এরপর তারা উট হাঁকিয়ে নিয়ে চলে যায়। সৈন্যদল রওয়ানা হওয়ার পর আমি আমার হারটি খুঁজে পাই এবং নিজস্ব স্থানে ফিরে এসে দেখি তাদের (সৈন্যদল) কোন আহবায়ক এবং কোন উত্তরদাতা তথায় নেই। ( নিরুপায় হয়ে) তখন আমি পূর্বে যেখানে ছিলাম সেখানে বসে রইলাম। ভাবছিলাম, তাঁরা আমাকে দেখতে না পেলে অবশ্যই আমার কাছে ফিরে আসবে। ঐ স্থানে বসে থাকা অবস্থায় ঘুম চেপে আসলে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। বানূ সুলামী গোত্রের যাকওয়ান শাখার সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল রা. (যাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফেলে যাওয়া আসবাবপত্র কুড়িয়ে নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন) সৈন্যদল চলে যাওয়ার পর সেখানে ছিলেন। তিনি প্রত্যুষে আমার অবস্থানস্থলের কাছে পৌঁছে একজন ঘুমন্ত মানুষ দেখে আমার দিকে তাকানোর পর আমাকে চিলে ফেললেন। তিনি আমাকে দেখেছিলে পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বে। তিনি আমাকে চিনতে পেরে ‘ইন্না লিল্লাহহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন’ পড়লে আমি তা শুনতে পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম এবং চাদর টেনে আমার চেহারা ঢেকে ফেললাম। আল্লাহর কসম, আমি কোন কথা বলিনি এবং তাঁর থেকে ইন্না লিল্লাহ……..পাঠ ছাড়া আর কোন কথাই শুনতে পাইনি। এরপর তিনি সাওয়ারী থেকে অবতরণ করলেন এবং সাওয়ারীকে বসিয়ে তার সামনের পা নিচু করে দিলে আমি গিয়ে তাতে আরোহণ করলাম। পরে তিনি আমাকেসহ সাওয়ারীকে টেনে আগে আগে চলতে লাগলেন, পরিশেষে ঠিক দ্বিপ্রহরে প্রচণ্ড গরমের সময় আমরা গিয়ে সেনাদলের সাথে মিলিত হলাম। সে সময় তাঁরা একটি জায়গায় অবতরণ করছিলেন।
আয়েশা রা. বলেন, এরপর যাদের ধ্বংস হওয়ার ছিল তারা (আমার প্রতি অপবাদ আরোপ করে) ধ্বংস হয়ে গেল। তাদের মধ্যে এ অপবাদ আরোপের ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল সে হচ্ছে আবদুল্লাহ ইবনে উবায় ইবনে সুলুল। রাবী উরওয়া রা. বলেন, আমি জানতে পেরেছি যে, তার সামনে অপবাদের কথাগুলো প্রচার করা হত এবং আলোচনা করা হত আর অমনি সে এগুলোকে বিশ্বাস করত, খুব ভালভাবে শ্রবণ করত এবং শোনা কথার ভিত্তিতেই বিষয়টিকে প্রমাণ করার চেষ্টা করত।
উরওয়া রা. আরো বর্ণনা করেছন যে, অপবাদ আরোপকারী ব্যক্তিদের মধ্যে হাসসান ইবনে সাবিত, মিসতাহ ইবনে উসাসা এবং হামনা বিনতে জাহাশ রা. ব্যতীত আরো কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। তারা গুটিকয়েক ব্যক্তির একটি দল ছিল, এতটুক ব্যতীত তাদের সম্পর্কে আমার আর কিছু জানা নেই। যেমন (আল কুরআনে) মহান আল্লাহ পাক বলেছেন, এ ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তাকে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বিন সুলুল বলে ডাকা হয়ে থাকে। বর্ণনাকারী উরওয়া রা. বলেন, আয়েশা রা.-এর এ ব্যাপারে হাসসান ইবনে সাবিত রা.-কে গালমন্দ করাকে পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, হাসসান ইবনে সাবিত রা. তো ঐ ব্যক্তি যিনি তার এক কবিতায় বলেছেন, আমার মান সম্মান এবং আমার বাপ দাদা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মান সম্মান রক্ষায় নিবেদিত।
আয়েশা রা. বলেন, এরপর আমরা মদীনায় আসলাম। মদীনায় আগমন করার পর এক মাস পর্যন্ত আমি অসুস্থ থাকলাম। এদিকে অপবাদ রটনাকরীদের কথা নিয়ে লোকদের মধ্যে আলোচনা ও চর্চা হতে লাগল। কিন্তু এসবের কিছুই আমি জানি না। তবে আমার সন্দেহ হচ্ছিল এবং তা আরো দৃঢ় হচ্ছিল আমার এ অসুখের সময়। কেননা এর পূর্বে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যেরূপ স্নেহ-ভালবাসা লাভ করতাম আমার এ অসুখের সময় তা আমি পাচ্ছিলাম না। তিনি আমার কাছে এসে সালাম করে কেবল ‘তুমি কেমন আছ’ জিজ্ঞাসা করে চলে যেতেন। তাঁর এ আচরণই আমার মনে চরম সন্দেহের উদ্রেক করে। তবে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাইরে বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ জঘন্য অপবাদ সম্বন্ধে আমি কিছুই জানতাম না। উম্মে মিসতাহ রা. একদা আমার সাথে পায়খানার দিকে বের হন। আর প্রকৃতির ডাকে আমাদের বের হওয়ার অবস্থা এই ছিল যে, এক রাতে বের হলে আমরা আবার পরের রাতে বের হতাম। এ ছিল আমাদের ঘরের পার্শ্বে পায়খানা তৈরী করার পূর্বের ঘটনা। আমাদের অবস্থা প্রাচীন আরবীয় লোকদের অবস্থার মত ছিল। তাদের মত আমরাও পায়খানা করার জন্য ঝোঁপঝাড়ে চলে যেতাম। এমনকি বাড়ির পার্শ্বে পায়খান তৈরী করলে আমরা খুব কষ্ট পেতাম। আয়েশা রা. বলেন, একদা আমি এবং উম্মে মিসতাহ “যিনি ছিলেন আবু রূহম ইবনে মুত্তালিব ইবনে আবদে মানাফের কন্যা, যার মা সাখার ইবনে আমির-এর কন্যা ও আবু বকর রা. সিদ্দীকের খালা এবং মিসতাহ ইবনে উসাসা ইবনে আব্বাদ ইবনে মুত্তালিব যার” একত্রে বের হলাম। আমরা আমাদের কাজ থেকে ফারিগ হওয়ার পর বাড়ি ফেরার পথে উম্মে মিসতাহ তার কাপড়ে জাড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে বললেন, মিসতাহ ধ্বংস হোক। আমি তাকে বললাম, আপনি খুব খারাপ কথা বলছেন। আপনি কি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকে গালি দিচ্ছেন? তিনি আমাকে বললেন, ওগো অবলা, সে তোমার সম্পর্কে কি বলে বেড়াচ্ছে তুমি তো তা শোননি। আয়েশা রা. বলেন, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে আমার সম্পর্কে কি বলছে? তখন তিনি অপবাদ রটনাকরীদের কথাবার্তা সম্পর্কে আমাকে জানালেন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, এরপর আমার পুরানো রোগ আরো বেড়ে গেল। আমি বাড়ি ফেরার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে আসলেন এবং সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কেমন আছ? আয়েশা রা. বলেন, আমি আমার পিতা-মাতার কাছে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক খবর জানতে চাচ্ছিলাম, তাই আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললাম, আপনি কি আমাকে আমার পিতা-মাতার কাছে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেবেন? আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমকে অনুমতি দিলেন। তখন (বাড়িতে গিয়ে) আমি আমার আম্মাকে বললাম, আম্মাজান, লোকজন কি আলোচনা করছে? তিনি বললেন, বেটী ও বিষয়টিকে হালকা করে ফেল। আল্লাহর কসম, সতীন আছে এমন স্বামী সোহাগিনী সুন্দরী রমণীকে তাঁর সতীনরা বদনাম করবে না, এমন খুব কমই হয়ে থাকে।
আয়েশা রা. বলেন, আমি বিস্ময়ের সাথে বললাম, সুবহানাল্লাহ । লোকজন কি এমন গুজবই রটিয়েছে। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, রাতভর আমি কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে ভোর হয়ে গেল। এর মধ্যে আমার অশ্রুও বন্ধ হল না এবং আমি ঘুমাতেও পারলাম না। এরপর ভোরবেলাও আমি কাঁদছিলাম। তিনি আরো বলেন যে, এ সময ওহী নাযিল হতে বিলম্ব হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রীর (আমার) বিচ্ছেদের বিষয়টি সম্পর্কে পরামর্শ ও আলোচনা করার নিমিত্তে আলী ইবনে আবু তালিব এবং উসামা ইবনে যায়েদ রা.-কে ডেকে পাঠালেন। আয়েশা রা. বলেন, উসামা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীদের পবিত্রতা এবং তাদের প্রতি (নবীজীর) ভালবাসার কারণে বললেন, (হে আল্লাহর রাসূল) তাঁরা আপনার স্ত্রী, তাদের সম্পর্কে আমি ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না। আর আলী রা. বললেন, হে আল্লাহ রাসূল, আল্লাহ তো আপনার জন্য সংকীর্ণতা রাখেননি। তাকে (আয়েশা) ব্যতীত আরো বহু মহিলা রয়েছে। তবে আপনি এ ব্যাপারে দাসী (বারীরা রা.) কে জিজ্ঞাসা করুন। সে আপনার কাছে সত্য কথাই বলবে। আয়েশা রা. বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারীরা রা.-কে ডেকে বললেন, হে বারীরা তুমি তাঁর মধ্যে কোন সন্দেহমূলক আচরণ দেখেছ কি? বারীরা রা. তাকে বললেন, সেই আল্লাহর শপথ যিনি আপনাকে সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন আমি তার মধ্যে কখনো এমন কিছু দেখিনি যার দ্বারা তাকে দোষী বলা যায়। তবে তাঁর ব্যাপারে শুধু এতটুকু বলা যায় যে, তিনি হলেন অল্প বয়স্কা যুবতী, রুটি তৈরী করার জন্য আটা খামির করে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। আর বকরী এসে অমনি তা খেয়ে ফেলে।
আয়েশা রা .বলেন, (এ কথা শুনে) সেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে সাথে উঠে গিয়ে মিম্বরে বসে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই-এর ক্ষতি থেকে রক্ষার আহবান জানিয়ে বললেন, হে মুসলিম সম্প্রদায়, যে আমার স্ত্রীর ব্যাপারে অপবাদ ও বদনাম রটিয়ে আমাকে কষ্ট দিয়েছে তার এ অপবাদ থেকে আমাকে কে মুক্ত করবে? আল্লাহর কসম, আমি আমার স্ত্রী সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানিনা। আর তাঁরা (অপবাদ রটনাকারীরা) এমন এক ব্যক্তির (সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল) নাম উল্লেখ করছে যার সম্বন্ধেও আমি ভাল ছাড়া কিছু জানি না। সে তো আমর সাথেই আমার ঘরে যায়। আয়েশা রা. বলেন, (এ কথা শুনে) বনী আবদুল আশহাল গোত্রের সাদ (ইবনে মুআয) রা. উঠে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি আপনাকে এ অপবাদ থেকে মুক্তি দেব। সে যদি আউস গোত্রের লোক হয় তা হলে তার শিরচ্ছেদ করব। আর যদি সে আমাদের ভাই খাযরাজের লোক হয় তাহলে তার ব্যাপারে আপনি যা বলবেন তাই পালন করব। আয়েশা রা. বলেন, এ সময় হাসসান ইবনে সাবিত রা.-এর মায়ের চাচাতো ভাই খাযরাজ গোত্রের সর্দার সাঈদ ইবনে উবাদা রা. দাঁড়িয়ে এ কথার প্রতিবাদ করলেন। আয়েশা রা. বলেন, এ ঘটনার পূর্বে তিনি একজন সৎ ও নেককার লোক ছিলেন। কিন্তু (এ সময়) গোত্রীয় অহমিকায় উত্তেজিত হয়ে তিনি সাদ ইবনে মুআয রা.-কে বললেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। আল্লাহর কসম, তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না এবং তাকে হত্যা করার ক্ষমতাও তোমার নেই। যদিসে তোমার গোত্রের লোক হত তাহলে তুমি তার হত্যা হওয়া কখনো পছন্দ করতে না। তখন সাদ ইবনে মুআয রা.-এর চাচাতো ভাই উসাইদ ইবনে হুযাইর রা. সাদ ইবনে ওবায়দা রা.-কে বললেন, বরং তুমি মিথ্যা কথা বললে। আল্লাহর কসম, আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করব। তুমি হলে মুনাফিক। তাই মুনাফিকদের পক্ষ অবলম্বন করে কথাবার্তা বলছ।
আয়েশা রা. বলেন, এ সময় আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্র খুব উত্তেজিত হয়ে উঠে। এমনকি তারা যুদ্ধের সংকল্প পর্যন্ত করে বসে। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থামিয়ে শান্ত করলেন এবং নিজেও চুপ হয়ে গেলেন। আয়েশা রা. বলেন, আমি সেদিন সারাক্ষণ কেঁদে কাটালাম। অশ্রুঝরা আমার বন্ধ হয়নি এবং একটু ঘুমও আমার আসেনি। তিনি বলেন, আমি ক্রন্দনরত ছিলাম আর আমার পিতা-মাতা আমার পার্শ্বে বসা ছিলেন। এমনি করে একদিন দুই রাত কেঁদে কেঁদে কাটিয়ে দিই। এর মাঝে আমার কোন ঘুম আসেনি। বরং অবারিত ধারায় আমার চোখ থেকে অশ্রুপাত হতে থাকে। মনে হচ্ছিল যেন, কান্নার ফলে আমার কলিজা ফেটে যাবে। আমি ক্রন্দনরত ছিলাম আর আমার আব্বা-আম্মা আমার পাশে বসা ছিলেন। এমতাবস্থায় একজন আনসারী মহিলা আমার কাছে আসার অনুমতি চাইলে আমি তাকে আসার অনুমতি দিলাম। সে এসে বসল এবং আমার সাথে কাঁদতে আরম্ভ করল। তিনি বলেন, আমরা ক্রন্দনরত ছিলাম ঠিক এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে এসে সালাম করলেন এবং আমাদের পাশে বসে গেলেন। আয়েশা রা. বলেন, অপবাদ রটানোর পর আমার কাছে এসে এভাবে তিনি আর কখনো বসেননি। এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ একমাস কাল অপেক্ষা করার পরও আমার বিষয়ে তাঁর নিকট কোন ওহী আসেনি।
আয়েশা রা. বলেন, বসার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালিমা শাহাদাত পড়লেন। এরপর বললেন, যা হোক, আয়েশা তোমার সম্বন্ধে আমার কাছে অনেক কথাই পৌঁছেছে, যদি তুমি এর থেকে মুক্ত হও তাহলে শীঘ্রই আল্লাহ তোমাকে এ অপবাদ থেকে মুক্ত করে দেবেন। আর যদি তুমি কোন গুনাহ করে থাক তাহলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাওবা কর। কেননা বান্দা গুনাহ স্বীকার করে তাওবা করলে আল্লাহ তায়ালা তাওবা কবূল করেন। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা বলে শেষ করলে আমার অশ্রুপাত বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি এক ফোটা অশ্রুও আমি আর অনুভব করলাম না। তখন আমি আমার আব্বাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলছেন আমার পক্ষ হতে আপনি তার জবাব দিন। আমার আব্বা বললেন, আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কি জবাব দিব আমি তা জানিনা। তখন আমি আমার আম্মাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন, আপনি তার জবাব দিন। আম্মা বললেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কি জবাব দিব আমি তা জানি না। তখন আমি ছিলাম অল্প বয়স্কা কিশোরী। কুরআনও বেশি পড়তে পারতাম না। তথাপিও এ অবস্থা দেখে নিজেই বললাম, আমি জানি আপনারা এ অপবাদের ঘটনা শুনেছেন, আপনারা তা বিশ্বাস করেছেন এবং বিষয়টি আপনাদের মনে সুদৃঢ় হয়ে আছে। এখন যদি আমি বলি যে, এর থেকে আমি পবিত্র এবং আমি নিষ্কলুষ তাহলে আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন না। আর যদি আমি এ অপরাধের কথা স্বীকার করে নেই যা সম্পর্কে আল্লাহ জানেন যে, আমি এর থেকে পবিত্র তাহলে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন। আল্লাহর কসম, আমি ও আপনারা যে অবস্থায় শিকার হয়েছি এর জন্য (নবী) ইউসুফ আ.-এর পিতার কথা উদাহরণ ব্যতীত আমি কোন উদাহরণ খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি বলেছিলেন: “সুতরাং পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছ সে বিষয়ে আল্লাহই একমাত্র আমার আশ্রয়স্থল” এরপর আমি মুখ ফিরিয়ে আমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আল্লাহ তায়ালা জানেন যে, সে মুহূর্তেও আমি পবিত্র। অবশ্যই আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন। (একথার প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল) তবে আল্লাহর কসম,আমি কখনো ধারণা করিনি যে, আমার ব্যাপারে আল্লাহর ওহী নাযিল করবেন যা পঠিত হবে। আমার ব্যাপারে আল্লাহ কোন কথা বলবেন আমি নিজেকে এতখানি যোগ্য মনে করিনি বরং আমি নিজেকে এর চেয়ে অধিক অযোগ্য বলে মনে করতাম। তবে আমি আশা করাতাম যে, হয়তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এমন স্বপ্ন দেখানো হবে যার দ্বারা আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনো তাঁর বসার জায়গা ছাড়েননি এবং ঘরের লোকদের থেকেও কেউ ঘর থেকে বাইরে যাননি। এমতাবস্থায় তাঁর উপর ওহী নাযিল হতে শুরু হল। ওহী নাযিল হওয়ার সময় তাঁর যে বিশেষ কষ্ট হত তখনও সে অবস্থা তাঁর হল। এমনকি প্রচণ্ড শীতের দিনেও তাঁর দেহ থেকে মোতির দানার মত বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়ত ঐ বাণীর গুরুভাবের কারণে, যা তাঁর প্রতি নাযিল করা হয়েছে। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ অবস্থা দূরীভূত হলে তিনি হাসিমুখে প্রথমে যে কথাটি বললেন, তা হল, হে আয়েশা ! আল্লাহ তোমার পবিত্রতা জাহির করে দিয়েছেন। আয়েশা রা. বলেন, এ কথা শুনে আমার আম্মা আমাকে বললেন, তুমি উঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর। আমি বললাম, আল্লাহর কসম আমি এখন তাঁর দিকে উঠে যাব না। মহান আল্লাহ ব্যতীত আমি কারো প্রশংসা করব না। আয়েশা রা বললেন, আল্লাহ (আমার পবিত্রতা ঘোষণা করে) যে দশটি আয়াত নাযিল করেছেন, তা হল এই : “যারা এ অপবাদ রটনা করেছে (তারা তো তোমাদেরই একটি দল; এ ঘটনাকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না; বরং এও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য আছে তাদের কৃত পাপকর্মের ফল এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে তার জন্য আছ কঠিন শাস্তি। এ কথা শোনার পর মুমিন পুরুষ এবং নারীগণ কেন নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারণা করেনি এবং বলেনি, এটা তো সুষ্পষ্ট অপবাদ। তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি? যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সেহেতু তারা আল্লাহর বিধানে মিথ্যাবাদী। দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমরা যাতে লিপ্ত ছিলে তার জন্য কঠিন শাস্তি তোমাদেরকে স্পর্শ করত। যখন তোমরা মুখে মুখে এ মিথ্যা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিলনা এবং একে তোমরা তুচ্ছ ব্যাপার বলে ভাবছিলে, অথচ আল্লাহর কাছে তা ছিল খুবই গুরুতর ব্যাপার। আল্লাহ পবিত্র, মহান! এ তো এক গুরুতর অপনাদ। আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক তাহলে কখনো অনুরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি করবে না, আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বিবৃত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। যারা মুনিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতের মর্মন্তুদ শাস্তি। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউই অব্যাহতি পেতে না। আল্লাহ দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। (২৪ : ১১-২০) এরপর আমার পবিত্রতা ঘোষণা করে আল্লাহ এ আয়াতগুলো নাযিল করলেন।
আত্মীয়তা এবং দারিদ্রের কারণে আবু বকর সিদ্দীক রা. মিসতাহ ইবনে উসাসাকে আর্থিক ও বৈষয়িক সাহায্য করতেন। কিন্তু আয়েশা রা. সম্পর্কে তিনি যে অপবাদ রটিয়েছিলেন এ কারণে আবু বকর সিদ্দীক রা কসম করে বললেন, আমি আর কখনো মিসতাহকে আর্থিক কোন সাহায্য করব না। তখন আল্লাহ তায়ালা নাযিল করলে, তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ গ্রহণ করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজন ও অভাবগ্রস্তকে এবং আল্লাহর রাস্তায় যারা গৃহত্যাগ করেছে তাদেরকে কিছুই দিবে না। তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে এবং তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। শোন! তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (২৪: ২২) (এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর) আবু বকর সিদ্দীক রা. বলে উঠলেন হ্যাঁ, আল্লাহর কসম অবশ্যই আমি পছন্দ করি যে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিন। এরপর তিনি মিসতাহ রা.-এর জন্য যে অর্থ খরচ করতেন তা পুন: দিতে শুরু করলেন এবং বললেন, আল্লাহর কসম, আমি তাকে এ অর্থ দেওয়া আর কখনো বন্ধ করব না। আয়েশা রা .বললেন, আমার এ বিষয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়নাব বিনতে জাহাশ রা.-কেও জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তিনি যায়নাব রা. -কে বলেছিলেন, তুমি আয়েশা রা. সম্পর্কে কি জান অথবা বলেছিলেন তুমি কী দেখেছ? তখন তিনি বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি আমার চোখ ও কানকে সংরক্ষণ করেছি। আল্লাহর কসম ! আমি তাঁর সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না। আয়েশ রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর স্ত্রীগণের মধ্যে তিনি আমার সমকক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। আল্লাহ তাকে আল্লাহ-ভীতির ফলে রক্ষা করেছেন। আয়েশা রা. বলেন, অথচ তাঁর বোন হামনা রা. তাঁর পক্ষ অবলম্বন করে অপবাদ রটনাকারীদের মত অপবাদ রটনা করে বেড়াচ্ছিলেন। ফলে তিনি ধ্বংসপ্রাপ্তদের সাথে ধ্বংস হয়ে গেলেন। বর্ণনাকারী ইবনে শিহাব রহ. বলেন, ঐ সমস্ত লোকের ঘটনা সম্পর্কে আমার কাছে যা পৌঁছেছে তা হল এই : উরওয়ার রা. বলেন, আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ কসম, যে ব্যক্তি সম্পর্কে অপবাদ দেওয়া হয়েছিল, তিনি এসব কথা শুনে বলতেন, আল্লাহ মহান। ঐ সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, আমি কোন স্ত্রীলোকের কাপড় খু্লেও কোনদিন দেখিনি। আয়েশা রা. বলেন, পরে তিনি আল্লাহর পথে শাহাদত লাভ করেছিলেন।
(সহীহ বুখারী, আল মাগাযী অধ্যায়, হাদীস নং ৩৮৪৬)
উৎস: আরবী বাংলা হাদীস বিশ্বকোষ